Friday, 28 March 2014

বাবুই পাখিরে ডাকি,বলিছে চড়াই,
“কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোধ, বৃষ্টির, ঝড়ে৷”

বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়৷
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা৷”
                                                                                                                                    [রজনীকান্ত সেন]

স্বাধীনতা, উলঙ্গ কিশোর

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উল্ঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছো পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
তোমার পরমায়ু বৃদ্ধি পাক আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে,
প্রাত্যহিক বাহুর পেশীতে, জীবনের রাজপথে,
মিছিলে মিছিলে; তুমি বেঁচে থাকো, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
তোমার হা-করা মুখে প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে
সূর্যাস্ত অবধি হরতাল ছিল একদিন,
ছিল ধর্মঘট, ছিলো কারখানার ধুলো।
তুমি বেঁচেছিলে মানুষের কলকোলাহলে,
জননীর নাভিমূলে ক্ষতচিহ্ন রেখে
যে তুমি উল্ঙ্গ শিশু রাজপথে বেরিয়ে এসেছো,
সে-ই তুমি আর কতদিন ‘স্বাধীনতা, স্বাধীনতা’ বলে
ঘুরবে উলঙ্গ হয়ে পথে পথে সম্রাটের মতো?
জননীর নাভিমূল থেকে ক্ষতচিহ্ন মুছে দিয়ে
উদ্ধত হাতের মুঠোয় নেচে ওঠা, বেঁচে থাকা
হে আমার দূঃখ, স্বাধীনতা, তুমিও পোশাক পরো;
ক্ষান্ত করো উলঙ্গ ভ্রমণ, নয়তো আমারো শরীরি থেকে
ছিঁড়ে ফেলো স্বাধীনতা নামের পতাকা।
বলো উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়,
বলো দূঃখ কোনো স্বাধীনতা নয়,
বলো ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়,
বলো ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়।

জননীর নাভিমূল ছিন্ন-করা রক্তজ কিশোর তুমি
স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি বেঁচে থাকো
আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে, প্রেমে, বল পেন্সিলের
যথেচ্ছ অক্ষরে,
শব্দে,
যৌবনে,
কবিতায়।

[নির্মলেন্দু গুণ]

Thursday, 27 March 2014

গৃহশত্রু - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি একাকিনী যবে চলি রাজপথে 
 নব অভিসারসাজে , 
 নিশীথে নীরব নিখিল ভুবন , 
 না গাহে বিহগ , না চলে পবন , 
 মৌন সকল পৌর ভবন 
 সুপ্তনগরমাঝে — 
 শুধু আমার নূপুর আমারি চরণে 
 বিমরি বিমরি বাজে । 
অধীর মুখর শুনিয়া সে স্বর 
পদে পদে মরি লাজে । 

আমি চরণশব্দ শুনিব বলিয়া 
 বসি বাতায়নকাছে — 
 অনিমেষ তারা নিবিড় নিশায় , 
 লহরীর লেশ নাহি যমুনায় , 
 জনহীন পথ আঁধারে মিশায় , 
 পাতাটি কাঁপে না গাছে — 
 শুধু আমারি উরসে আমারি হৃদয় 
 উলসি বিলসি নাচে । 
 উতলা পাগল করে কলরোল , 
 বাঁধন টুটিলে বাঁচে । 

 আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে , 
 মধুর মিলনরাতি — 
 স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার , 
 নির্বাণ দীপ , রুদ্ধ দুয়ার , 
 শ্রাবণগগন করে হাহাকার 
 তিমিরশয়ন পাতি — 
 শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে 
 জ্বালায়ে রেখেছে বাতি । 
 কোথায় লুকাই , কেমনে নিবাই 
 নিলাজ ভূষণভাতি । 

 আমি আমার গোপন মরমের কথা 
 রেখেছি মরমতলে । 
 মলয় কহিছে আপন কাহিনী , 
 কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী , 
 নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী 
 আপনার কলকলে — 
 শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি 
 গীতঝংকারছলে 
 যে কথা যখন করিব গোপন 
 সে কথা তখনি বলে ।

Wednesday, 26 March 2014

বিদ্রোহী : কাজী নজরুল ইসলাম

বল বীর -
          বল উন্নত মম শির!
শির     নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
                বল বীর -
বল     মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
          চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
          ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
          খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া
           উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম     ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল বীর -
          আমি চির-উন্নত শির!

আমি     চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-     প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি     মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
               আমি দুর্ব্বার,
আমি     ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি     অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি     দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি     মানি নাকো কোনো আইন,
আমি     ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
                              ভাসমান মাইন!
আমি     ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি     বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!

বল বীর -
          চির উন্নত মম শির!

আমি     ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি     পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি     নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি     আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি     হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি     চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'
          পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'
          ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
আমি     চপলা-চপল হিন্দোল!

আমি     তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা',
করি     শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
          আমি উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি     মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি     শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।

বল বীর -
          আমি     চির-উন্নত শির!

          আমি     চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি     দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
                              ভরপুর মদ।
আমি     হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি     যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি     সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি     অবসান, নিশাবসান।
আমি     ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম     এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি     কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি     ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।

বল বীর -
          চির উন্নত মম শির।

আমি     সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি     যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি     বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি     আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি     ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি     পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি     চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি     প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি     মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি     কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি     অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি     প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি     উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি     উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!

আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।
আমি     উন্মন মন উদাসীর,
আমি     বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি     বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি     অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!
আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত-     চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি     গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন,
আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি     চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি     যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি     উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি     পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি     আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি     মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! -
আমি     তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি     সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে  সব বাঁধ!

আমি     উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি     বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি     ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
          স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
          তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
                              হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!
আমি     বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি     পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি     তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি     ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!
          ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', -
ধরি     স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!
          আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি     ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!

               আমি     অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
               মহা-     সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
          ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
          মম বাঁশরী তানে পাশরি'
          আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।

আমি     রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে     সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি     বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি     প্লাবন-বন্যা,
কভু     ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা -
আমি     ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি     অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি     ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি     ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি     জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

আমি     মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি     অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি     মানব দানব দেবতার ভয়,
          বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
          জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি     তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি     উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি     চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
                              সব বাঁধ!!
আমি     পরশুরামের কঠোর কুঠার,
          নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!


আমি     হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি     উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।

          মহা-     বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
          আমি     সেই দিন হব শান্ত,
যবে     উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
          অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
               বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
          আমি     আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি     স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
          আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

          আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি     বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

Tuesday, 25 March 2014

আমি ও যুদ্ধোত্তর মধ্যরাত্রি - মহাদেব সাহা



যেন হুহু করে মধ্যরাতে ঢুকে পড়ে সন্ত্রাসের ট্রাক
বড়ো ত্রাস, সদর দরোজা ভেঙে
অকস্মাৎ ভেঙে দেয় নিসর্গের রম্য খেলা
জ্যোৎস্নাময় এ-রাত্রি, কাঁঠালীচাঁপার বন,
বনচারী পাখিদের শান্ত ঘুম, অবকাশ
ত্রাস, শুধু ত্রাস ত্রাস,
শুধু কি আমার
এখন এ-মধ্যযামে নিদ্রামগ্ন রয়েছেন পিতা
অগ্রজ ঘুমান, কে নেবে তল্লাস কার
গৃহের কুকুর সেও গভীর নিদ্রায়,
নিদ্রিত সমস্ত বাড়ি অন্ধকারে কেঁপে কেঁপে ওঠে
এই কোলাহলহীন রাত্রি চোখে নিয়ে
আমি শুধু জেগে আছি, পিতা।
এ বাড়িতে, এই জনশূন্য মধ্যরাত্রিত্রাসিত বাড়িতে
আমার পিতার আগে
আর কোনোদিন কেউ বংশধর ছিলো,
আমাদের আগে এ শহরে ছিলো কোনো
সপ্রতিভ নারী ও পুরুষ অধিবাসী?
এই যুদ্ধোত্তর নগরের মধ্যরাত্রে আর কেউ
অধিবাসী নেই, নগরকোটাল গেছে ফিরে,
একে একে দিবসের দীপ্ত প্রদর্শনী শেষ
জনসমাগমহীন ধূসর চৌরাস্তা,
গোরস্থানে নেই শববাহী কেউ, এমনকি
রাত্রি পতনের শব্দে পালিয়েছে নগরের ঝানু গুণ্ডা,
মাতাল লম্পট,
নাগরিক নরনারী, এই ভয়াবহ মধ্যরাত্রে আমি শুধু
জেগে আছি তোমাদের সর্বশেষ প্রতিনিধি।
যেখানে আমার পিতা একদিন দাঁড়াতেন
হাতে মৌনতার মালা গেঁথে
এ বাড়ির সেই ছাদ ভগ্ন, বোমাবিদ্ধ কঠিন কার্নিশ,
আমার রোমাঞ্চকর শৈশবের সঙ্গীজন
দেখি তার সবুজ কবর
শহরের উচ্চতম টাওয়ার ছুঁয়ে যুদ্ধ তার রেখে গেছে
ভয়ঙ্কর মজ্জাগত প্রেম
এ-রাত্রিতে, এই মধ্যরাত্রে শহরের প্রধান দরোজা ভেঙে
যুদ্ধের পোশাকধারী কারা ছুটে আসে
ত্রাস, যুদ্ধের সন্ত্রাস?
এই মধ্যরাত্রে নিদ্রামগ্ন পিতা, আশ্রিত আলয় কম্পমান,
নিদ্রিত শহর
যুদ্ধোত্তর রাত্রির সন্ত্রাস বুকে
এই রাত্রে, এই ভয়াবহ মধ্যরাত্রে আমি শুধু
জেগে আছি তোমাদের সর্বশেষ প্রতিনিধি।



বন্দী শিবির থেকে 


ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।

অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি
এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।

স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।

অথচ জানেনা ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু'চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।

~ শামসুর রাহমান ~

Friday, 21 March 2014

আশীর্বাদ : কাজী নজরুল ইসলাম


আপনার ঘরে আছে যে শত্রু
তারে আগে করো জয়,
ভাঙো সে দেয়াল,প্রদীপের আলো
যাহা আগুলিয়া রয়।
অনাত্বীয়রে আত্বীয় করো,
তোমার বিরাট প্রাণ
করে না কো যেন কোনোদিন কোনো
মানুষে অসম্মান।
সংসারের মিথ্যা বাঁধন
ছিন্ন হোক আগে,
কবে সে তোমার সকল দেউল
রাঙিবে আলোর রাগে।

Tuesday, 18 March 2014

অনন্যোপায় - সুকান্ত ভট্টাচার্য


অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার,
নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার,
অর্ধেক প্রাসাদ তৈরী, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান,
চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান।

যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়।
উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায়।
বার বার ব্যর্থ, তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ,
নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে; ছিন্নভিন্ন মোহ।
আজকে ভাঙার স্বপ্ন- অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার,
বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর।

তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল,
রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল।
নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে,
উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে দাও চারিদিকে।।

(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)

Monday, 17 March 2014

A Legend of Antwerp 

  by: Anna Katherine Green (1846-1935)


They led him forth. The morning sun
Was shining wide o'er field and rill;
The glory of a day begun
Was in the sky, was on the hill,
Was in the wild bird's early trill.

His form was high, his cheek was fair,
The star of youth was on his brow,
The shadow of his falling hair
Was turning, in the early glow,
To the clear sunshine's rippling flow.

They led him forth. They bade him look
His very last upon the day,
And from his eyes the bandage took
One moment, that the morning's ray
Might bless him ere he passed away.

He looked around. He looked above,
On purple mount and tender sky,
Then turned and gazed on human love,
In sweet girl faces hurrying by,
And bowed his noble head to die.

When lo! from out the heaving throng
Behold a sudden form appear!
Ethereal as a dreaming song
Stealing through fragrant groves to cheer
The restless spirit of the ear.

A girlish form, so mystic bright,
The very guards were touched by fear
And trembled backward as the light
Of her pure glance fell on them, clear
As moonlight shimmering on the mere.

He shall not die, she said, and laid
Her woman's hand upon his breast,
Her bright smile glowing undismayed
From out her locks, as from the west
Looks forth a young star's joyful crest.

And such, the legend runs, her grace,
And such the power of her mien,
She seemed to fill the market-place
With sense of angel forms serene
And sound of harps that sang unseen.

He shall not die! and from the crowd
She led him forth, while heavenly awe
Fell on each wondering heart, and bowed
The head of every mortal there,
Filling the silence like a prayer.

She led him forth, and none might say
If earth or Heaven was in the power
Of that young maiden's love that day,
To still the passions of the hour
And baffle vengeance in its flower.

We only know they passed unharmed
By peasant's cot and noble's hall,
And, in their youth and beauty armed,
Sped scathless through the city's wall
And vanished from the sight of all.


বঙ্গ-বন্ধু 

(১৯৭১ সনের ১৬ই মার্চে লিখিত ) 

মুজিবর রহমান।
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।
বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,
জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে ।
বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার।
হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার ;
দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,
দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে ;
তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি
ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।
মুজিবর রহমান।
তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান।
পীড়িত-জনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি,
বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যেতি।
দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে অদম্য বল,
জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল।
শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে,
মুর্হুমুহু যে ধবনিত হইছে তোমার পথের পরে।
মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা,
তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা।
জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে,
তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।
রাজভয় আর কারাশৃঙ্কল হেলায় করেছ জয়।
ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।
বাঙলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমুর্ত রাজ,
প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।
তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার।
অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে-স্তব্ধ হুকুমদার।
এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,
সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।
শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান,
মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।
তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর,
জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার।
সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,
কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস।
তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,
আমরা বাঙালীর মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।
ধন্য এ কবি ধন্য এ যুগে রয়েছে জীবন লয়ে,
সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে।
ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে ।
বুরেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়াল রণে ।
বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে,
পড়ে বলে গেলো, "আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।"
উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী, জানুয়ারী সত্তরে,
ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে।
পথে পথে তারা লিখিল লেখন বুকের রক্ত দিয়ে,
লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে।
মরিবার সে কি উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে,
পাগলের মত ছোট নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে।
আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,
দিকে দিগনে- বাজিল যেদিন বাঙালীর জয়ভেরী।
মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,
বঙ্গ-বঙ্গ শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।
আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,
জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।
মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,
বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী-কাঁথার ছবি।
মানুষ মানুষ রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,
এক সাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রুপালীর তার পরে,
পরাণ ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে।
আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে,
সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কুতুহলে।
আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে,
আমাদরে জাতি নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চাবে,
"কোন অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?"
আমার এদেশ হয় যেন সদা সেইরুপ নির্ভয়।
জসীমউদ্‌দীন~
[কাব্যগ্রন্থ : ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে]

Sunday, 16 March 2014

তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন-সহচরী 
লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করি….
হে আমার মানস-রঙ্গিণী,
অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
তোমারে বন্দনা করি….
নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা!
আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা….
গোপণ-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী!
সৃষ্টি-দিন হ’তে কাঁদ’ বাসনার অন্তরালে বসি’-
ধরা নাহি দিলে দেহে।
তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিলে না
দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে।
অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে!
স্বপনে পাইয়া তোমা’ স্বপনে হারাই বারে বারে
অরুপা লো! রহি হ’য়ে এলে মনে,
সতী হ’য়ে এলে না ক’ ঘরে।
প্রিয় হ’য়ে এলে প্রেমে,
বধূ হয়ে এলে না অধরে!
দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপনে তুমি শিরীন্‌ শরাব,
পেয়ালায় নাহি এলে!-
‘উতারো নেকার’-
হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা!
সুদুরিকা! দূরে থাক’-ভালোবাসা-নিকটে এসো না।

তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা।
তুমি মরীচিকা,
তুমি জ্যোতি।-
জন্ম-জন্মান্তর ধরি’ লোকে-লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি,
বারে বারে একই জন্মে শতবার করি!
যেখানে দেখেছি রূপ,-করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’।
রূপে রূপে, অপরূপা, খুঁজেছি তোমায়,
পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়!
বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্ত হিয়া ভরি’
বারে বারে উদিয়াছ ইন্দ্রধনুসমা,
হাওয়া-পরী
প্রিয় মনোরমা!
ধরিতে গিয়োছি-তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে
ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলে না ক’ কথা কওয়া হ’য়ে।

চির-দূরে থাকা ওগো চির-নাহি-আসা! 
তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা
গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ল’য়ে যায় মোরে!
বাসনার বিপুল আগ্রহে-
জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে!
উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা
উদগ্র কামনা,
জন্ম তাই লভি বারে বারে,
না-পাওয়ার করি আরাধনা!….
যা-কিছু সুন্দর হেরি’ ক’রেছি চুম্বন,
যা-কিছু চুম্বন দিয়া ক’রেছি সুন্দর-
সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি!-ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে!
তোমারে যে করেছি চুম্বন
প্রতি তরুণীর ঠোঁটে
প্রকাশ গোপন।

যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে,
রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে,
সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’
সকলের ঠোঁটে যেন, হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা!
তরু, লতা, পশু, পাখী, সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে,-আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে!
বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি-
সকলের মাঝে আমি-সকলের প্রেমে মোর গতি!
যে-দিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম,
সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম।
আমি কাম, তুমি হ’লে রতি,
তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি!
কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-কত দিকে চাই!
নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই?
বৃথাই বাসিনু ভালো? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে?
তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় স’রে।
কেন হেন হয়, হায়, কেন লয় মনে-
যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ
বাসিছে গোপনে।

সে বুঝি সুন্দরতর-আরো আরো মধু!
আমারি বধূর বুকে হাসো তুমি হ’য়ে নববধূ।
বুকে যারে পাই, হায়,
তারি বুকে তাহারি শয্যায়
নাহি-পাওয়া হ’য়ে তুমি কাঁদ একাকিনী,
ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী।….
বারে বারে পাইলাম-বারে বারে মন যেন কহে-
নহে, এ সে নহে!
কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে?
জন্মেছিলে জন্মিয়াছ কিম্বা জন্ম লবে?
কথা কও, কও কথা প্রিয়া,
হে আমার যুগে-যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!

কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়,
প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।
জন্ম যার কামনার বীজে
কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে।
দিকে দিকে শাখা তার করে অভিযান,
ও যেন শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ।
আকাশ ঢেকেছে তার পাখা
কামনার সবুজ বলাকা!

প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন,
তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।
মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়!
যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়!
চির-সহচরী!
এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি!
আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন,
বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন।
প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি,
চিনেছি তোমায়,
যাহারে বাসিব ভালো-সে-ই তুমি,
ধরা দেবে তায়!
প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম-
সে শরাব লোহু।
তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,
ভৃঙ্গারে, গোলাসে কভু, কভু পেয়ালায়!

Friday, 14 March 2014

Sunrise from the Mountains

  by: Anna Katherine Green (1846-1935)


Hung thick with jets of burning gold, the sky
Crowns with its glorious dome the sleeping earth,
Illuminating hill and vale. O'erhead,
The nebulous splendor of the milky way
Stretches afar; while, crowding up the heavens,
The planets worship 'fore the thrones of God,
Casting their crowns of gold beneath His feet.
It is a scene refulgent! and the very stars
Tremble above, as though the voice divine
Reverberated through the dread expanse.
But soft! a change!
A timid creeping up of gray in east--
A loss of stars on the horizon's verge--
Gray fades to pearl and spreads up zenithward,
The while a wind runs low from hill to hill,
As if to stir the birds awake, rouse up
The nodding trees, and draw off silence like
A garment from the drowsy earth. The heavens
Are full of points of light that go and come
And go, and leave a tender ashy sky.
The pearl has pushed its way to north and south,
Save where a line spun 'tween two peaks at east,
Gleams like a cobweb silvered by the sun.
It grows--a gilded cable binding hill
To hill! it widens to a dazzling belt
Half circling earth, then stretches up on high--
A golden cloth laid down 'fore kingly feet.
Thus spreads the light upon the heavens above,
While earth hails each advancing step, and lifts
Clear into view her rich empurpled hills,
To keep at even beauty with the sky.
The neutral tints are deeply saffroned now;
In streaks, auroral beams of colored light
Shoot up and play about the long straight clouds
And flood the earth in seas of crimson. Ah,
A thrill of light in serpentine, quick waves,
A stooping of the eager clouds, and lo,
Majestic, lordly, blinding bright, the sun
Spans the horizon with its rim of fire!

Wednesday, 12 March 2014

কবিতা এমন--আল মাহমুদ 

কবিতা তো কৈশরের স্মৃতি । সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি- রাবেয়া রাবেয়া-
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিনের ভেজানো কপাট !
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠোনে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর ।


Friday, 7 March 2014

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো


- নির্মলেন্দু গুণ-

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’

এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না৷
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হদৃয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প৷
সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর৷
না পার্ক না ফুলের বাগান, — এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়৷
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে৷

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক৷
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে৷
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: “কখন আসবে কবি?’ “কখন আসবে কবি?’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷

নতুন পথের যাত্রা-পথিক
চালাও অভিযান !
উচ্চ কণ্ঠে উচ্চার আজ -
“মানুষ মহীয়ান !”

চারদিকে আজ ভীরুর মেলা,
খেলবি কে আর নতুন খেলা ?
জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা
বাইবি কি উজান ?
পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল
স্বর্গে দিবি টান্ ।।

সরল সাজের নাইরে সময়
বেরিয়ে তোরা আয় ,
আজ বিপদের পরশ নেব
নাঙ্গা আদুল গায় ।

আসবে রণ-সজ্জা করে ,
সেই আশায়ই রইলি সবে !
রাত পোহাবে প্রভাত হবে
গাইবে পাখি গান ।
আয় বেরিয় , সেই প্রভাতে
ধরবি যারা তান ।।

আঁধার ঘোরে আত্নঘাতী
যাত্র-পথিক সব
এ উহারে হানছে আঘাত
করছে কলরব !
অভিযানে বীর সেনাদল !
জ্বালাও মশাল , চল্ আগে চল্ ।
কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল ,
গাও প্রভাতের গান !

ঊষার দ্বারে পৌছে গাবি
‘জয় নব উত্থান !’

-কাজী নজরুল ইসলাম

ইশতেহার - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

পৃথিবীতে মানুষ তখনও ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি ।
ভুমির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো ।
তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান ।
অরন্য আর মরুভূমির
সমুদ্র আর পাহাড়ের ভাষা তখন আমরা জানি ।
আমরা ভূমিকে কর্ষন করে শস্য জন্মাতে শিখেছি ।
আমরা বিশল্যকরনীর চিকিৎসা জানি
আমরা শীত আর উত্তাপে সহনশীল
ত্বক তৈরি করেছি আমাদের শরীরের ।
আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর
শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি ।

আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায়
আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিন।
আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি ।
জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি
আর প্রশংসা করি পৃথিবীর ।
আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি ।

পৃথিবীর পূর্নিমা রাতের ঝলোমলো জ্যোৎস্নায়
পৃথিবীর নারী আর পুরুষেরা
পাহাড়ের সবুজ অরন্যে এসে শরীরের উৎসব করে ।

তখন কী আনন্দরঞ্জিত আমাদের বিশ্বাস ।
তখন কী শ্রমমুখর আমাদের দিনমান ।
তখন কী গৌরবময় আমাদের মৃত্যু ।
তারপর –
কৌমজীবন ভেঙে আমরা গড়লাম সামন্ত সমাজ ।
বন্যপ্রানীর বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্রগুলো
আমরা ব্যবহার করলাম আমাদের নিজের বিরুদ্ধে ।
আমাদের কেউ কেউ শ্রমহীনতায় প্রশান্তি খুঁজে পেতে চাইলো ।
দুর্বল মানুষেরা হয়ে উঠলো আমাদের সেবার সামগ্রী ।
আমাদের কারো কারো তর্জনী জীবন ও মৃত্যুর নির্ধারন হলো ।

ভারী জিনিস টানার জন্যে আমরা যে চাকা তৈরি করেছিলাম
তাকে ব্যবহার করলাম আমাদের পায়ের পেশীর আরামের জন্যে ।
আমাদের বন্য অস্ত্র সভ্যতার নামে
গ্রাস করে চললো মানুষের জীবন ও জনপদ ।

আমরা আমাদের চোখকে সুদূরপ্রসারী করার জন্যে দূরবীন
আর সূক্ষ্ নিরীক্ষনের জন্যে অনুবীক্ষন তৈরি করলাম ।
আমাদের পায়ের গতি বর্ধন করলো উড়ন্ত বিমান ।

আমাদের কন্ঠস্বর বর্ধিত হলো,
আমাদের ভাষা ও বক্তব্য গ্রন্থিত হলো,
আমরা রচনা করলাম আমাদের অগ্রযাত্রার ইতিহাস ।
আমাদের মস্তিষ্ককে আরো নিখুঁত ও ব্যপক করার জন্যে
আমরা তৈরি করলাম কম্পিউটার ।

আমাদের নির্মিত যন্ত্র শৃঙ্খলিত করলো আমাদের
আমাদের নির্মিত নগর আবদ্ধ করলো আমাদের
আমাদের পুঁজি ও ক্ষমতা অবরুদ্ধ করলো আমাদের
আমাদের নভোযান উৎকেন্দ্রিক করলো আমাদের ।

অস্তিত্ব রক্ষার নামে আমরা তৈরী করলাম মারনাস্ত্র ।
জীবনরক্ষার নামে আমরা তৈরি করলাম
জীবনবিনাশী হাতিয়ার ।
আমরা তৈরি করলাম পৃথিবী নির্মূল-সক্ষম পারমানবিক বোমা ।

একটার পর একটা খাঁচা নির্মান করেছি আমরা ।
আবার সে খাঁচা ভেঙে নতুন খাঁচা বানিয়েছি –
খাঁচার পর খাঁচায় আটকে পড়তে পড়তে
খাঁচার আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো টুকরো হয়ে
আজ আমরা একা হয়ে গেছি ।

প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি ।
কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব !
কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা !
কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা !

এই সৌরমন্ডলের
এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে
যে-শিশুর জন্ম ।
দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন
যে-কিশোরের ।
জ্যোৎস্না যাকে প্লাবিত করে ।
বনভূমি যাকে দুর্বিনীত করে ।
নদীর জোয়াড় যাকে ডাকে নশার ডাকের মতো ।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল
গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র ।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে
এক হৃদয়হীন ধর্মের আচার ।
অথচ যাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে ।

যে-তরুন উনসত্তরের অন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
যে-তরুন অস্ত্র হাতে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়েছে
যে-তরুনের বিশ্বাস, স্বপ্ন, সাধ,
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভেঙে খান খান হয়েছে,
অন্তবে রক্তাক্ত যে-তরুন নিরুপায় দেখেছে নৈরাজ্য,
প্রতারনা আর নির্মমতাকে ।
দুর্ভিক্ষ আর দুঃশাসন যার নির্ভৃত বাসনাগুলো
দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করেছে
যে-যুবক দেখেছে এক অদৃশ্য হাতের খেলা
দেখেছে অদৃশ্য এক কালোহাত
যে-যুবক মিছিলে নেমেছে
বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে
আকন্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছে
অনাহারে উড়নচন্ডী ঘুরছে
যে-যুবক ভয়ানক অনিশ্চয়তা আর বাজির মুখে
ছুঁড়ে দিয়েছে নিজেকে
যে-পুরুষ এক শ্যমল নারীর সাথে জীবন বিনিময় করেছে
যে-পুরুষ ক্ষুধা, মৃত্যু আর বেদনার সাথে লড়ছে এখনো,
লড়ছে বৈষম্য আর শ্রেনীর বিরুদ্ধে –
সে আমি ।

আমি একা ।
এই ব্রক্ষ্মান্ডের ভিতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা ।
আমার অন্তর রক্তাক্ত ।
আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত ।
আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত ।
আমার শবীর লাবন্যহীন ।
আমার জীভ কাটা ।
তবু এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে
আমাকে তড়ায়...

আমাদের কৃষকেরা
শূন্য পাকস্থলি আর বুকের ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায় ।
আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত, হাড্ডিসার ।
আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থহীন ।
আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুন ।
আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর
দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে ।

পৃথিবীর যুদ্ধবাজ লোকদের জটিল পরিচালনায়
ষড়যন্ত্রে আর নির্মমতায়,
আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা
আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকে পড়েছি ।
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা !
আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকা পড়েছি ।
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা !
কী বিভৎস এই ভালোবাসাহীনতা !
কী নির্মম এই স্বপ্নহীনতা !

আজ আমরা আবার সেই
বিশ্বাস আর আনন্দকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
সাহস আর সরলতাকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
শ্রম আর উৎসবকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
ভালোবাসা আর প্রশান্তিকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
স্বাস্থ্য আর শরীরের লাবন্যকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
কান্নাহীন আর দীর্ঘশ্বাসহীন জীবনের কাছে যেতে চাই
আর আমরা শোষন আর ষঠতা
অকালমৃত্যু আর ক্ষুধার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে চাই ।

আমাদের সমৃদ্ধ এই বিজ্ঞান নিয়ে
আমাদের অভিজ্ঞতাময় এই শিল্পসম্ভার নিয়ে
আমাদের দূরলক্ষ্য আর সুক্ষ্ম বীক্ষন নিয়ে
আমাদের দ্বন্ধময় বেগবান দর্শন নিয়ে
আমরা ফিরে যাবো আমাদের বিশ্বাসের পৃথিবীতে
আমাদের শ্রম, উৎসব, আনন্দ আর প্রশান্তির পৃথিবীতে ।
পরমানুর সঠিক ব্যবহার
আমাদের শস্যের উৎপাদন প্রয়োজনতুল্য করে তুলবে,
আমাদের কারখানাগুলো কখনোই হত্যার অস্ত্র তৈরি করবে না,
আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিরোগ করবে পৃথিবীকে;
আমাদের মর্যদার ভিত্তি হবে মেধা, সাহস আর শ্রম ।
আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষের মতো
স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচন্ড পৌরষদীপ্ত হবে ।
আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষীমন্ত আর লাবন্যময়ী ।
আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদন।

আমরা শস্য আর স্বাস্থের, সুন্দর আর গৌরবের
কবিতা লিখবো ।
আমরা গান গাইবো
আমাদের বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা করে ।
আমরা উৎসব করবো শস্যের
আমরা উৎসব করবো পূর্নিমার
আমরা উৎসবা করবো
আমাদের গৌরবময় মৃত্যু আর বেগমান জীবনের ।

কিন্তু –
এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে
সামান্য কিছু মানুষ ।
অস্ত্র আর সেনা-ছাউনিগুলো তাদের দখলে ।
সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ংকর কারাগার
তৈরী করেছে আমাদের চারপাশে ।

তারা ক্ষুধা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা বস্ত্রহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা গৃহহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা জুলুম দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
বুলেট দিয়ে বন্দী করেছে ।

তারা সবচেয়ে কম শ্রম দেয়
আর সবচে বেশি সম্পদ ভোগ করে;
তারা সবচে ভালো খাদ্যগুলো খায়
আর সবচে দামি পোশাকগুলো পরে ।
তাদের পুরুষদের শরীর মেদে আবৃত, কদাকার;
তাদের মেয়েদের মুখের ত্বক দেখা যায় না, প্রসাধনে ঢাকা;
তারা আলস্য আর কর্মহীনতায় কাতর, কুৎসিত ।

তারা আমাদের জীভ কেটে নিতে চায়
তারা আমাদের চোখ উপড়ে ফেলতে চায়
তারা আমাদের মেধা বিকৃত করতে চায়
তারা আমাদের শ্রবন বধির করে দিতে চায়
তারা আমাদের পেশীগুলো অকেজো করে দিতে চায়
আমাদের সন্তানদেরও তারা চায় গোলাম বানাতে ;

একদা অরন্যে
যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রানী হত্যা করে
আমরা অরন্যজীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি,
আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো
নির্মুল করে
আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো
সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো
শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো ।

 

কান্ডারী হুশিয়ার ! 

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী!তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!

– কাজী নজরুল ইসলাম

“সংকল্প” -- কাজী নজরুল ইসলাম



থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে 
কেমন করে ঘুরছে মানুষ 
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।

কিসের আশায় করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে
কেমন করে বীর ডুবুরি
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী
চলছে উড়ে স্বর্গপানে।

হাউই চড়ে চায় যেতে কে
চন্দ্রলোকের অচিনপুরে,
শুনব আমি, ইঙ্গিতে কোন
মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।

পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।