Sunday, 18 October 2015

শরণার্থী সমস্যা : -- আরব দেশগুলো কেন নিদায় নীরব?

ভূমধ্যসাগরতীরে মানবতার করুণ উপাখ্যান রচিত হচ্ছে প্রতিদিন। হাঙ্গেরিতেও কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটার বাহু কেটে রক্তাক্ত হলেও সীমান্তরক্ষীরা শুনবে বলে সে একটুও কাঁদেনি। গর্ব করে তার বাবা বলেন, আমার ছেলেটা বীর। সাগরতীরে আয়লান কুর্দির লাশ হৃদয় ভেঙে দেয়, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উদাসীনতার দুর্গ তবু ভাঙে না।
৪০ লাখের বেশি সিরীয় দেশ থেকে দেশে, সীমান্ত থেকে সীমান্তে আশ্রয়ের সন্ধানে ভুগছে ও ছুটছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একযোগে নির্বিকার। সভ্যতার আঁতুড়ঘর বলা হতো ইরাক ও সিরিয়াকে। এখন তারা বধ্যভূমি। এখন খবর বের হচ্ছে আইএস তাদেরই সৃষ্টি। আর আইএস সৃষ্টি করছে লাখ লাখ উদ্বাস্তু। পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট জঙ্গিরা পৃথিবীতেই দোজখের মডেল দেখাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবেও
আরব ধনকুবেরদের দানে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী এসব ধ্বংসের কারিগর। তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া সিরীয় ওমর হারিরির কণ্ঠে তাই তিক্ত হতাশা, ‘তারা বিদ্রোহীদের সাহায্য করে, শরণার্থীদের দেখে না।’
উপসাগরীয় সালতানাতগুলো বিশ্বের শীর্ষ ধনী, অথচ শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ। যে কুয়েতিরা ১৯৯০ সালে ইরাকি হামলায় শরণার্থী হয়েছিল, সিরীয় শরণার্থীরা তাদের চোখে ‘ভিন্ন, আতঙ্কগ্রস্ত ও মানসিকভাবে অসুস্থ, আমাদের জীবনধারায় তারা বেমানান!’ ইরাক আক্রমণের পক্ষে জর্জ বুশের যুক্তিও ছিল এমন: তারা আমাদের জীবনধারা ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু ভোগবিলাসে মত্ত থেকে স্বজাতি, স্বধর্মের আরবদের জীবন তছনছ করা কেমন সুস্থতা? ওদিকে ইয়েমেনে হামলা করে করে উদ্বাস্তুর ঢল প্রতিদিন বাড়িয়ে চলেছে সৌদি আরব। আরব উপদ্বীপ ও উপসাগরীয় দেশগুলোয় একজন সিরীয়ও আশ্রয় পায়নি। বরং আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে বলায় আরব আমিরাত থেকে এক ফিলিস্তিনি ব্লগারকে বহিষ্কার করা হয়।
সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করায় তুরস্কের ভূমিকাও কম নয়। তারপরও দেশটির ২০ লাখ আশ্রিত মানুষের মধ্যে ১৭ লাখ সিরীয় ও এক লাখ ইরাকি। লেবাননের প্রতি পাঁচজনের একজন সিরীয়। ইরাকেও আশ্রয় নিয়েছে আড়াই লাখ সিরীয়। আরবদের মধ্যে মিসর ও জর্ডানে রয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৩০ হাজার ও ৬৩ হাজার সিরীয়। তিউনিসিয়ায় রয়েছে ২২ লাখ লিবীয়। আলজেরিয়ায় আছে ৫৫ হাজার।
শরণার্থীদের ডুবন্ত হাত যখন আরব শাসকেরা ফিরিয়ে দেয়, তখনই অগতির গতি হয় ইউরোপ। এ বছর ভূমধ্যসাগর পেরিয়েছে সাড়ে তিন লাখ শরণার্থী, এদের ২ হাজার ৬০০ জনের সলিলসমাধি ঘটেছে। গত সপ্তাহে অস্ট্রিয়ায় এক লরির ভেতর ৭১ জনের গলিত লাশ মেলে। তুরস্কের উপকূলে শিশু আয়লানের মৃত্যুদৃশ্যের অভিঘাতে পরদিনই জার্মানি সীমান্ত খুলে দেয়। তিন বছরের সেই শিশুটিই হয়ে ওঠে মানবতার আপন সন্তান। ইউরোপীয় বিবেক নড়ে ওঠে। নিজেদের হাতেও রক্ত ও কালিমার দাগ দেখে বিব্রত হয় তারা। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অভিবাসনকামীদের ‘পঙ্গপাল’ বললেও জনমতের চাপে দ্রুত অবস্থান বদলান। অথচ আরব িলগ, ওআইসি ও জিসিসি যেন অবশ। এ দেশগুলোর কোনোটিই শরণার্থীর অধিকার–বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি।
সৌদি আরবের অবস্থান তবু বদলায় না। আরব বসন্তের পর থেকে শিয়া, ফিলিস্তিনি ও সিরীয়দের আশ্রয় দেওয়ায় সেখানে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাদের ভয়, এরা রাজতান্ত্রিক দুঃশাসন মানবে না বেশি দিন। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত একজন শরণার্থীকেও আশ্রয় না দেওয়াকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ‘চরম লজ্জাজনক’ আখ্যা দেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্রের ভাষায়, ‘দায়ের অংশীদার তারা হতে চায় না, তারা চায় অন্যরা বোঝা সামলাক, তারা কেবল চেক লিখে দিয়েই খালাস।’
সিরিয়ার বিপর্যয়ের দায় এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশি। অথচ তাদের ‘রাইট টু প্রটেক্ট’ কিংবা ‘মানবিক হস্তক্ষেপের’ হাত সিরিয়ায় পৌঁছায় না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কিছু সদস্যের ভাষ্য, শরণার্থীরা সন্ত্রাসীদের পাইপলাইন বানাবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই সেক্যুলার সিরিয়ায় গণতন্ত্র রপ্তানির নামে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়েছে জঙ্গিদের। হাজার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব দিয়ে সন্ত্রাসের পাইপলাইন এখনো চালু রেখেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার মহৎ দৃষ্টান্ত। জার্মানির এই উদারতার পেছনে রয়েছে অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। তাদের জনসংখ্যা কমতির দিকে। উন্নতি বজায় রাখতে আরও শ্রমিক চাই। প্রচলিত কোটায় এত শ্রমিক আনা সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, প্রধান দুই দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ও গ্রিন পার্টি একজোট হওয়ায় বর্ণবাদীদের আপত্তি ধোপে টিকছে না।
এই যুদ্ধের আগে সিরীয়রা কখনোই শরণার্থী হয়নি। পড়তে আসা সিরীয়রা আশ্রয়প্রার্থী হয়নি পাশ্চাত্যে। সেই সিরিয়ার এমন অবমাননায় আরবশাহির হাত থাকা লজ্জাজনক।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

মানুষ হত্যার এমন উৎসব আগে কখনো দেখা যায়নি

কোথাও যুদ্ধ হয়, বেশুমার মানুষ মরে। আমরা তার খবর পড়ি আর ভুলে যাই। বাড়ির পাশে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়, পরদিন খবরের কাগজ থেকে জানা যায়, আরও একটি লাশ পড়েছে। যুদ্ধে যে মারে তার জবাবদিহি হয় না। যাদের মারা যায়, তারাও জানে এসব হত্যার বিচার হবে না; হয় না কদাচিৎ। নিহত স্বজনের লাশ পাওয়ার আর আদরযত্নে আর শোকে তাকে দাফন করার সুযোগও থাকে না যুদ্ধের দিনে। যুদ্ধ থামলে হয়তো সুযোগ পেলে তারা স্বজনের শেষনিঃশ্বাস ছাড়ার জায়গাটা দেখে আসে। পারলে গণকবর খুঁজে বের করে ফুল দেয়। তারপর আবার ফিরে আসে যার যার জীবনে। জীবন এমন এক কঠিন কারাগার, যেখানে ফিরতেই হয়।
বাংলাদেশে অপঘাতে মৃত্যুও এক নাছোড় দানব, যার লাশের ক্ষুধা মেটাতে হয় প্রতিদিন। এখানে এখন গড়ে প্রতিদিন একজন মানুষ মারা যাচ্ছে ‘যুদ্ধে’। যুদ্ধই বলছি, কারণ সরকারি বাহিনীগুলো এসব হত্যাকাণ্ডকে যুদ্ধের পরিভাষা দিয়েই চিনিয়েছে: ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি। কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের একটি গল্পের নাম ছিল ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’। এখন আমাদের খবরের কাগজের শিরোনাম হয় ‘প্রতিদিন গড়ে একটি হত্যা’।
খুন করে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার ‘ঐতিহ্য’ আছে বাংলাদেশে। প্রায়ই নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে খুন করে লাশ ডোবানোর ঘটনা সংবাদে আসে। লঞ্চডুবির পরও অজস্র লাশ ভাসে। একাত্তর সালে, পাকিস্তানি বাহিনী নদীর ধারে সারবেঁধে বাঙালিদের দাঁড় করিয়ে গুলি করত। দেহগুলো নদীতে পড়ে ভাসতে ভাসতে কাক-শকুন আর মাছের খোরাক হতো। পুরাকালে সাপে কাটা কিংবা বেওয়ারিশ লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতিও ছিল। এখনকার রীতি হলো বন্দুকযুদ্ধ। সবাই জানে এসব আসলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
এত মৃত্যুর জন্য পেশাদার বাহিনী লাগে, প্রয়োজন হয় ‘ডেথ স্কোয়াডের’। আমাদেরই চারপাশে তারা থাকে, খায়, ঘুমায়, আনন্দ করে, টহল দেয়। তারপর তালিকা ধরে ধরে মধ্যরাত থেকে ভোরের কোনো সময়ে নদীর বাঁধ বা খেতের কিনারে নিয়ে শিকারকে হত্যা করে। এ রকম করে প্রতিদিন একটি রুমাল এখন কার প্রয়োজন?
এই মৃত্যুর চানমারি শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সহিংস প্রতিরোধের মাধ্যমে। যে সহিংসতা তারা শুরু করেছিল, আজ তা-ই বহুগুণে বড় হয়ে হয়ে তাদের বিনাশ করছে। সেই ককটেল, পেট্রলবোমা—যার শুদ্ধ নাম মলোটভ ককটেল খুবই গরিব-দরদি। বেছে বেছে মেহনতি মানুষকেই তারা হত্যা করত। সেটা এমন সময়, যখন সরকারি দলের সমর্থকদেরও কেউ কেউ বোমা-বারুদসহ জনতার হাতে ধৃত হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের লোকেরা তো আগুন নিয়ে খেলছিলই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর হঠাৎ সেই সব বোমাবাজ গায়েব হয়ে গেল। কোথায় গেল? এখন কেন আর তাদের প্রয়োজন হচ্ছে না?
এসব ককটেল আর পেট্রলবোমা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে সাধারণ মানুষের, দ্বিতীয় ক্ষতিগ্রস্ত বিরোধীদের ভাবমূর্তি। এর জন্য তাদের জনপ্রিয়তা কমেছে। অন্যদিকে হিসাব করলে বোঝা যায়, লাভবান হয়েছে ‘সরকার’। সেই লাভ এমনই লাভ যে নির্বাচন, গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিত্ব—সবকিছুই ওই ‘পেট্রলবোমার’ ভয়ে উবে গেল, তেমন কোনো আহাজারিও করল না কেউ।
আগুন দিয়ে চলন্ত বাস-গাড়ি-ট্রাকে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংসতা কি একাত্তরের পরে দেখেছে বাংলাদেশ? হ্যাঁ, কি স্বৈরশাসক, কি নির্বাচিত শাসক—সব আমলেই গুলি চলেছে। কিন্তু মানুষ হত্যার এমন উৎসব আগে কখনো দেখা যায়নি। ২০১৩ সালে এ রকম রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫০৭ জন নিহত হন। এখন শোনা যাচ্ছে, জামায়াতি সন্ত্রাসীদেরই নাকি খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন নেতা-নেত্রী পরোক্ষভাবে এসব হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমরা যাঁরা পকেটমারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে উচিত শিক্ষা দিই, তাঁদের অনেকেই এ রকম আইনবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করছেন। এই সমর্থনের শুরু হয়েছিল বিএনপি আমলের অপারেশন ক্লিন হার্টের সময়। তারপর এল ক্রসফায়ার। অনেকেই এটাকেই সন্ত্রাস দমনের ধন্বন্তরি পথ বলে বাহবা দিলেন। কিন্তু তাতে কি জনগণের নিরাপত্তাহীনতা কমেছে? রাজনীতি থেকে সহিংসতা দূর হয়েছে? নাকি তা আরও বহুগুণে বেড়েছে। এখন আর বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস হয় না। এখন হয় বেআইনি ও আইনি বাহিনীর সংঘবদ্ধ হত্যাযজ্ঞ। পৌরাণিক কাহিনিতে পরশুরাম পাপের বিনাশে কুঠার হাতে নিজের বংশকেই নাশ করেছিলেন। নদীর তীর ধরে তিনি হত্যা করতে করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। পরিণামে সেই কুঠার তাঁর হাতের অংশ হয়ে যায়, কোনোভাবেই তাকে ছাড়ানো যায় না। অবশেষে করতোয়া নদীর জলে হাত ধুলে সেই ঘাতক
কুঠার খসে। রাষ্ট্রের হাতে যাঁরা পরশুরামের কুঠার তুলে দিয়েছেন, আশা করছেন প্রতিপক্ষ বিনাশেই সেটা শেষ হবে, তাঁরা ভুল করছেন।
র‌্যাবের জন্ম দিয়েছিল বিএনপি, অথচ আজ তারাই এই বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সোচ্চার। যে আওয়ামী লীগ ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে ক্রসফায়ার বন্ধের কথা বলেছিল, আজ তারাই হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ প্রবর্তক। হত্যা আরও হত্যা ডেকে আনে; এই সত্য তারা ভুলে
যেতে পারে, কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য এমন বিস্মরণ হবে আত্মঘাতী।
যারা পেট্রলবোমায় মানুষ মেরেছে, তাদের বিচার করতে অসুবিধা কোথায়? এত মৃত্যু যাদের হাতে ঘটেছে, তাদের নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পনা ছিল, উদ্দেশ্য ছিল, সহায়-সরঞ্জাম ও তহবিল ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, তাদের ছিল ‘নিয়োগদাতা, হুকুমদাতা’। আটক করে বিচার করলে তাদের মুখ থেকে সম্পূর্ণ সত্যটা মানুষ জানতে পারত। যে রাজনীতি এ রকম হত্যার আয়োজন চালায়, তাদের মুখোশ খসে পড়ত। কিন্তু সরকার সেই জরুরি কাজটা কেন করছে না? সত্য উন্মোচনে তাদের কিসের ভয়? এ ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শেষাবধি রাজনীতিকেই হত্যা করে। হত্যা করে আইন, যুক্তি ও ন্যায়কে।
সত্য নেই, রয়েছে গুজব। ভূতের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি করে না আধুনিক কোনো সরকার; কিন্তু জগতে এমন সরকার কম যে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করে না। এ যেন হাওয়ায় তরবারি চালিয়ে গুজবের আগামাথা তরমুজের মতো ফালাফালা করার কারবার। যখন সত্য বিতর্কিত বা জানার অতীত, তেমন সময়ই গুজবের বসন্ত। সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোয় যে-ই হাত দিচ্ছে, তার হাতই পুড়ে যাচ্ছে। সরকারি প্রেসনোটের মধ্যিখানে ফোকর ধরা পড়লে জানবেন, সত্যটা ওই পথেই পগারপার। এমন দিনেই তারে বলা যায়: মতিঝিলে নাকি...রানা প্লাজার রেশমা নাকি...বিএনপি নাকি..., বন্দুকযুদ্ধ নাকি... ইত্যাদি। গুজবে উত্তর থাকে না, থাকে সময়ের সবচেয়ে জ্বলন্ত ও জরুরি প্রশ্ন। সবলের বিরুদ্ধে গুজব দুর্বলের অস্ত্র। যখন সত্যের কারবারিরা জনমনের আস্থা হারায়, তখন ‘নাকি’ শব্দটা আমাদের বাক্যের মধ্যে খিল গেড়ে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকে প্রশ্ন করে, ‘তোমরা নাকি...’। আমাদের কালের দুর্ধর্ষ গুজব রাশি সেসব প্রশ্নেরই উত্তর প্রস্তাব করে, একচক্ষু সরকার যার ওপর ধামা হয়ে চেপে বসেছে; যার উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে, প্রতিদিন একটি বা ততোধিক হত্যা নিয়েও গুজব ডানা মেলা শুরু করেছে।
তাহলেও সরকার নড়বে না চড়বে না। সাগর-রুনির মতো ব্যাখ্যাতীত অনেক মৃত্যুর প্রতিকারে ব্যাখ্যাতীত দায়িত্বহীনতা দেখিয়েই যাবে। কেবল নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো মায়ের মতো অসীম মমতায় অপঘাতে নিহত সন্তানদের লাশ বুকে নিয়ে বইতে থাকবে। বইতেই থাকবে। যারা বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার বা পেট্রলবোমায় নিহতদের লাশ আনতে যায়, সকালে বা সন্ধ্যায়, তাদের বোবা প্রতিবাদের ভাষা পড়ার ক্ষমতা জাতি হিসেবেই হয়তো আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
তুর্কি চলচ্চিত্রকার ইলমাজ গুনের ছবি ইওল। ছবির একটি দৃশ্যে কুর্দিস্তানের বিদ্রোহীদের লাশ নিয়ে আসতে দেখা যায় সেনাদের। তাদের ট্রাকের পেছনটায় সার সার লাশ। ট্রাকটা একের পর এক কুর্দি গ্রামে ঢোকে, আর গ্রামবাসীদের বলা হয় লাশ শনাক্ত করতে। তারা বাধ্য হয় সারবেঁধে নির্বিকার মুখে একে একে লাশগুলো দেখে যেতে। একটি লাশের সামনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াতে দেখা যায় এক বাবাকে। সেনারা এগিয়ে আসে, চোখে প্রশ্ন: আপনার? লোকটি নীরবে মাথা নাড়িয়ে সরে যায়। নিজের ছেলের লাশ শনাক্ত করাও যে বিপদ! বাংলাদেশে আমরা ধন্য, আমাদের বাবাদের নিহত ছেলের লাশ শনাক্ত করার সুযোগ আছে।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

সব বলে দিয়েছে শিশু আয়লান // ফারুক ওয়াসিফ

‘আমি খোদার কাছে সব বলে দেব’, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মুখে এই ছিল তিন বছর বয়সী অন্য এক সিরীয় শিশুর শেষ আর্তনাদ। বিশ্বের রাজাধিরাজেরা তখন শোনেননি। এরই সাড়ে তিন মাস পর একই বয়সী আরেকটি শিশুর নির্বাক প্রতিবাদ দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিল। যে মানবতা ভেসে গেছে, সেই অমানবতার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে শিশুটি এসে ঠেকেছিল তুরস্কের উপকূলে। সেই দৃশ্য কেউ তুললেন, কেউ তা ফেসবুকে দিলেন, কোনো পত্রিকা তা প্রকাশ করল, কোনো টেলিভিশনে তা প্রচারিত হলো। যে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা সান আগের দিন সিরীয় উদ্বাস্তুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক শিরোনাম করেছিল: উদ্বাস্তু ঠেকাও। পরদিন তারাই সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে থাকা আয়লানের ছবি ফলাও করে ছাপল। আবারও প্রমাণিত হলো, নিষ্পাপের মৃত্যু অসহনীয়, অবর্ণনীয়, ক্ষমার অযোগ্য। আয়লান একাই বিশ্বমানবতার ঘুম ভাঙিয়েছে, বিশ্বনেতাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দায়িত্বহীনতার কাঠগড়ায়, বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াবহ দোজখের দুর্দশার কথা।

আয়লানের ওই ছবিটা যেন অপার্থিব বিষাদের প্রতীক। যেন সে ঘুমিয়ে আছে এক শুভ্র বিছানায়। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন তার শীততাড়ানি কম্বলের ঝালর। পায়রার বুকের মতো কোমল গাল পেতেছে সে যে বেলাভূমিতে, তা যেন তার মায়ের পাতা সোহাগী বিছানা। তার লাল জামাটি যেন অতীতের কোনো যুদ্ধহীন দিনের স্মৃতির ঝলক। তার পায়ের জুতা জোড়াও তার মতোই আদুরে। জুতা নিয়ে সব শিশুরই দারুণ আমোদ, উৎসাহ আর গল্প থাকে। পৃথিবীতে যা সবচেয়ে সুন্দর, তার ধ্বংসই সবচেয়ে অসহনীয়। আয়লানের মৃত্যুর মর্মান্তিকতার আরেক পিঠে তাই দেখা যায় যুদ্ধবাজ রাজনীতির নৃশংসতা আর রাষ্ট্রনেতাদের স্বার্থপরতার প্রমাণচিত্র।

আয়লানের জুতাজোড়া মনে করিয়ে দেয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক বাক্যের এক গল্পের ধাক্কা, ‘বিক্রি হবে: কখনো না পরানো এক জোড়া পুরোনো জুতা।’ আয়লানের ওই ছবিটা ফিরিয়ে এনেছে ভিয়েতনামে মার্কিন নাপাম বোমায় পোড়া কিশোরীর ভয়ার্ত মুখ, ফিরিয়ে এনেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অসহায় ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের আকুতি। বিপন্ন শৈশব বিপন্ন মানবতার চিহ্ন, সেই চিহ্নই আজ ভাসছে ভূমধ্যসাগরে।
যখন ভূমিতে জল্লাদ, তখন দরিয়ায় কী ভয়! আয়লানের বাবা-মাও তাই মরিয়া ছিলেন দেশ ছাড়তে। ফেরাউনের ভয়ে শিশু মুসা (আ.)-এর প্রাণ বাঁচাতে তাঁর মাও তাঁকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নীল নদে, ছোট্ট একটি গামলায়। পরিণত বয়সে আবারও তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল মৃত্যু ও উত্তাল সমুদ্রের কিনারে। সমুদ্র সেদিন তাঁকে ও তাঁর জাতিকে পথ করে দিয়েছিল। কিন্তু এটা কলিকাল। আবদুল্লাহ কুর্দির মতো অসংখ্য সিরীয়-লিবীয়-ইয়েমেনীয় উদ্বাস্তুর ডাক শুনবে কে? ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই’।
মহান আরব ভ্রাতৃত্ব অন্ধ ও বধির। ধনী আরব শাসকেরা গরিব আরবদের ধ্বংসে মেতেছে। ইউরোপীয় সভ্যতা আর সেই সভ্যতার ত্রাতা যুক্তরাষ্ট্র দূর থেকে দেখছিল। জীবনের মায়া এমন, সন্তানের জীবনের ভয় এমন অদম্য যে হতভাগ্য আবদুল্লাহ কুর্দি দমে যাননি। তিনি কানাডায় বোনের কাছে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন কানাডীয় সরকারের কাছে। একদা অভিবাসীদের স্বর্গ কানাডায় এখন রক্ষণশীল সরকার। সেই সরকারের আমলারা কাগজপত্রের খুঁত দেখিয়ে পরিবারটিকে বারবার ফেরায়। অবশেষে টাকা জোগাড় করে তুর্কি দালালের কাছে ধরনা দেন আবদুল্লাহ। জাহাজের কথা বললেও পরিবারটিকে আরও অনেকের সঙ্গে তুলে দেওয়া হয় ছোট্ট একটি নৌকায়। (সাম্প্রতিক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মর্মান্তিক মৃত্যুর আখ্যান যেন) যথারীতি মাঝ দরিয়ায় তা ডুবে যায়। পিতা কেবল উঠতে পারেন তীরে। সমুদ্র নাকি সবই ফিরিয়ে দেয়। আবদুল্লাহর দুই সন্তান ও স্ত্রীকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জীবনটা কেড়ে নিয়ে।

আবদুল্লাহ কুর্দি ছিলেন এক সিরীয় কুর্দি নাপিত। বোনের দোহাই দিয়ে কুর্দি কানাডায় আবেদন করেছিলেন, ‘আমাদের খরচ সে জোগাবে’। বোনও কানাডীয় কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, ‘তারা আমার সঙ্গে চুল কাটার কাজ করতে পারবে। আমি তাদের কাজও খুঁজে দিতে পারব।’ থাকার, চলার অসুবিধা হতো না। তবু অনুমতি মিলল না। হলে আয়লান বেঁচে যেত। এখন কানাডীয় সরকার দেশবাসীর কাছে অনুতাপ করছে। আয়লানের ফুফুও কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘কেন আমি ওদের আসতে বললাম!’ এখানেই থামেননি তিনি, ‘আমি আজ সত্যিই যা চাই তা হলো যুদ্ধের অবসান। সারা পৃথিবীর মানুষের উচিত এগিয়ে এসে সিরীয় যুদ্ধ বন্ধ করা। তারাও তো মানুষ!’

যে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উচ্ছেদের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষক ঢেলেছিল, যে সৌদি আরব ইরান ও সিরিয়াকে এক ঢিলে ঘায়েল করতে জঙ্গি জিহাদি সৃষ্টি করেছিল, তারা জানত না যুদ্ধ মানেই গণহত্যা, দেশান্তর আর নিরীহ-নিষ্পাপের নিধন? কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলই বর্বর আইএসকে সৃষ্টি করেছে, যেমন করেছিল তালেবানদের। ব্রিটেনের জনপ্রিয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় সেই পত্রিকার নামজাদা প্রতিবেদক সিম্যাস মিলনে তথ্য–প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস অথবা আইসিসের উত্থানে জ্বালানি জুগিয়ে গেছে। আইএসের ধ্বংসযজ্ঞের সুবাদেই আজ তেলের দাম কম, জোগান বেশি আর তেল ব্যবসায়ীদের রমরমা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে বিরাট আকারের গণহত্যা চলে আসছে, তার দায়ও যেমন তারা স্বীকার করেনি, তেমনি বলকান অঞ্চলে যে ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ দেখা গিয়েছিল, এখানে তার দরকার মনে করেনি। কিন্তু চোখের আড়ে পাহাড় লুকানো যায় না। প্রতিবাদ, খবর, হুঁশিয়ারি যা পারেনি, এক আয়লানের লাশের ভাসান সেই মিথ্যার জারিজুরি ছিঁড়ে ফেলেছে। কোনো বুলেট যা পারেনি, আয়লান তা পেরেছে। সে বেহুঁশ বেবুঝ শাসকদের মুখোশ খুলে দিয়েছে।
আর তখনই দেখা গেল, মানুষের ভরসা আজও সাধারণ মানুষই। অভিবাসীদের যাত্রাপথের দেশের সাধারণ মানুষ সিরীয় উদ্বাস্তুদের বরণ করে নিতে রাস্তার পাশে খাবার, পানি ও ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করেছে। উদার জার্মানি দুয়ার খুলে দিয়েছে। ইউরোপীয় জাতগর্বী দুর্গের দেয়াল টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
কিন্তু কী করবেন আয়লানের বাবা? যে কানাডা তাঁর পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারাই এখন তাঁকে সাধছে। কিন্তু কী আসে যায় এখন? নিউইয়র্ক টাইমস-এ এসেছে তাঁর হাহাকার: ‘সারা দুনিয়ার সব দেশ দিয়ে দিলেও আমি তা চাই না। যা ছিল অমূল্য, তার সবই তো গেছে আমার!’
জীবনে আশ্রয় পায়নি আয়লান, মৃত্যুতে পেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। নিহত হয়েছে লাখো শিশু। অমানবিকতার পাষাণ পাথর তাতে নড়েনি। নতুন নতুন দেশে তেল দখলের, ভূমি দখলের, শাসক বদলের আর গণতন্ত্র রপ্তানির যুদ্ধ রপ্তানি চলছেই। শিশু আয়লানের ছোট্ট দেহটি এই যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক অর্থনীতিকেই প্রশ্ন করছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একাত্ম হয়ে কেঁদেছে আয়লানের বাবা আবদুল্লাহর সঙ্গে।

যে চলে গেছে তার যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। যিনি বেঁচে আছেন, আয়লানের সেই হতভাগ্য পিতা এখন রোজ উদ্বাস্তু শিবিরে যান, মানব পাচারকারীদের কাছে যেতে নিষেধ করেন শরণার্থীদের। এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর আরেক প্রতিবেদক শরণার্থী দলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সিরীয়-লিবীয়দের মধ্যে আবিষ্কার করেন এক বাংলাদেশিকে। যুদ্ধের বিশ্বায়ন মৃত্যুরও বিশ্বায়ন ঘটাচ্ছে।
একা এক আয়লান সত্যিই সব বলে গেছে

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

Friday, 16 October 2015

হিজরতের স্মৃতি সমুজ্জ্বল হিজরী সন

হিজরত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মুবারক জীবননেতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করেন। এই হিজরতের ফলে ইসলামের সুদূরপ্রসারী বিজয়ের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এই হিজরতের মাহাত্ম্য বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক যোসেফ হেল বলেছেন : ওঃ রং ধ ঃঁৎরহহু চড়রহঃ রহ ঃযব ষরভব ধহফ ড়িৎশ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ঢ়যবঃ ঃযব মৎবধঃ ঃঁৎহরহম ঢ়ড়রহঃ রহ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ওংষধস- এটা হচ্ছে মহানবী (সা) এর জীবন ও কর্মে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা আর ইসলামের ইতিহাসে মহাদিগন্ত উন্মোচনকারী অধ্যায়।
আমরা জানি, প্রিয়নবী (সা) ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে প্রথম ওহী লাভ করেন। প্রথম ওহী লাভের তিন বছর পর আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর আপনজনদেরকে দীনের পথে আহ্বানের নির্দেশ দেন। গুটিকয়েক ভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া মক্কায় কাফির মুশরিকরা তাঁর হিদায়াত গ্রহণ তো করলই না বরং তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করল। তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের ওপর নেমে এলো অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন। তিনি ধৈর্য ধারণ করে হিদায়াতের বাণী পৌঁছানোর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে বেশকিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তি একে একে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। কাফির মুশরিকদের অত্যাচারের মাত্রা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পেতে লাগল। কাফির মুশরিকরা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটল এবং একদিন রাতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ওঁৎ পেতে থাকল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি হযরত আলী (রা.) কে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে অতি সন্তর্পণে তাঁর কদম মুবারকের বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর ভর করে বেরিয়ে গেলেন। বের হওয়ার সময় এক মুষ্টি ধুলোতে সূরা ইয়াসীনের প্রথম কয়েক খানি আয়াতে কারীমা পাঠ করে ফুঁক দিয়ে তা ওঁৎ পেতে থাকা কাফির-মুশরিককের দিকে ছিটিয়ে দিলেন। কাফির মুশরিকদের শরীরে সে ধুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তন্দ্রাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সন্তর্পণে বের হয়ে এসে হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে নিয়ে ছত্তর পর্বত গুহায় এসে কয়েক দিন থাকলেন। তারপর তিনি মক্কা মুকাররমা থেকে প্রায় ২৯৬ মাইল দূরে অবস্থিত ইয়াসরীব নগরীর উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মক্কা থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি আঁসুসিক্ত চোখে বার বার কা‘বা শরীফের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, হে কা‘বা আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে বের করে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহর যমীনে তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। হে মক্কা, তোমার সন্তানরা আমাকে এখানে থাকতে দিল না। যদি আমার কওম আমাকে তোমার কাছ থেকে চলে যেতে বাধ্য না করত তাহলে আমি আদৌ তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। তিনি আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন আর বার বার চোখের পানি মুছছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব (সা) কে উদ্দেশ করে ইরশাদ করলেন : আপনি বলুন, হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং আমাকে বের করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং তোমার কাছ থেকে আমাকে দান করো সাহায্যকারী শক্তি (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৮০)।
প্রিয় নবী (সা) ইয়াসরীব নগরীর তিন মাইল দূরে অবস্থিত নগরীর প্রবেশ মুখ কুবা নামক স্থানে প্রায় ১৫ দিন পরে এসে পৌঁছলে ইয়াসরীবের মানুষ তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করে। তখন ইয়াসরীবের অধিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। সমগ্র জনতা তাঁকে গ্রহণ করার জন্য সমবেত হয়েছিল। ছোট ছোট বালক-বালিকারাও তাদের মা এবং অন্যরা সমবেত কণ্ঠে সুললিত উচ্চারণে যে কাসিদা পাঠ করেছিলেন তা আজও মিলাদ মাহফিলে পাঠ করা হয়। প্রিয়নবী (সা) কুবাতে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং এখানে স্থাপন করেন একটি মসজিদ যা বর্তমানে কুবা মসজিদ নামে খ্যাত। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল তিনি কুবা থেকে ইয়াসরীব নগরীর উদ্দেশে রওয়ানা হন। বিশাল জশ্নে জুলুস বা আনন্দ মিছিল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসরীবের জনগণ তাঁদের নগরীর নাম করেন মদীনাতুন নবীÑ নবীর শহর, যা আজকের মদীনা মনওয়ারা মদীনা শরীফ সোনার মদীনা।
মদীনা তশরীফ আনায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ওহী লাভ করার পর তাঁর মক্কী জীবনের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ১২ বছর। মক্কী জীবনের এই সময়কালে তাঁকে মুকাবিলা করতে হয়েছে বহু নির্যাতন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ওপরও নেমে এসেছে কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারের জগদ্দল পাথর। এমনকি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবননাশেরও চেষ্টা করা হয়েছে। মদীনায় তাঁর হিজরত করে আসার ফলে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে।
মদীনায় স্থাপিত হয়েছে মসজিদে নববী। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কায়েম হয়েছে। রমাদানের এক মাস সিয়াম পালনের বিধান নাযিল হয়েছে, যাকাত ও হজের বিধানও নাযিল হয়েছে। মদীনায় হিজরতের ফলে ইসলামের বিধি-বিধানসমূহ সামগ্রিকভাবে পালনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে, প্রণীত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র মদীনার সনদ।
মক্কার কাফির মুশরিকরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাফল্য সহ্য করতে পারেনি। তারা বার বার মদীনা আক্রমণ করেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আক্রমণই প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছেন। এক কথায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা সম্ভব হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসার ফলে। যে কারণে হিজরতের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরব দেশে মাস গণনার রীতি প্রচলিত থাকলেও সুনির্দিষ্ট সন বা বর্ষ গণনার রীতি ছিল না বললেই চলে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জন্মের ৫০ দিন পূর্বে ইয়েমেনের জালিম রাজা আবরাহা মক্কায় কা‘বা শরীফ ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে একটি হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে এসে ছাউনি স্থাপন করে। আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু ছোট ছোট পাখি বা আবাবীল পাঠিয়ে আবরাহার বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। কুরআন মজীদে সূরা ফীলে সেই ঘটনার কথা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তুমি কি দেখোনি তোমার রব্ হস্তি অধিপতিদের প্রতি কি করেছিলেন? ওদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছিলেন। যারা ওদের ওপর প্রস্তর কংকর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি ওদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন।
হস্তিবাহিনীর সেই ঘটনার বছর থেকে আরবরা আমুল ফীল বা হস্তিবর্ষ নামে একটি বর্ষ গণনার সূচনা করলেও তা স্থায়িত্ব পায়নি। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রথম ওহী লাভ করেন। তিনি নবুয়ত ও রিসালতপ্রাপ্ত হন। এর স্মরণে মুসলিম মননে নবুওতের প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর, তৃতীয় বছর এমনিভাবে বর্ষ গণনার রীতি কিছুদিন চালু ছিল। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে এলে হিজরতের হিসেবে বর্ষ গণনা চালু হলেও তা বিধিবদ্ধ সন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা আলা আনহুর খিলাফতকালে। জানা যায়, খিলাফতের কাজকর্ম, দলিল দস্তাবেজ, নথি, চিঠি খতিয়ান, ফরমান, রাজস্ব আদায় ইত্যাদি জরুরী ক্ষেত্রে সন-তারিখের গুরুত্ব অনুধাবন করেন।
খলীফা হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা আলা আনহু একটি খাঁটি ইসলামী ক্যালেন্ডার প্রণয়নের নির্দেশ দেন। খলীফাতুল মুসলিমীন আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত আবু মুসা আল আশআরী রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুর একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একটি নিজস্ব সন তারিখের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। একটি নতুন সনের উদ্ভাবনের বিষয়ে তিনি বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। এই নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশদ আলাপ আলোচনা হয়। হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরামর্শে তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য যে সনটি প্রবর্তন করলেন সেই সনটিই হিজরী সন। এতে প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে প্রচলিত বারোটি মাসই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মুনওয়ারায় হিজরত করেন। কিন্তু আরবে প্রচলিত মাসগুলোর প্রথম মাস হচ্ছে মুহররম যে কারণে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মুহররমকেই নববর্ষের প্রথম তারিখ ধরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। ঠিক এ সময়টাতেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরী সনেরও আগমন ঘটে। হিজরী সন বিশ্ব মুসলিম মননে অতি পবিত্র সন হিসেবে গণ্য হয়। তার কারণ এই সনের মুহররম মাসের দশ তারিখে পালিত হয় আশুরা, সফর মাসের শেষ বুধবারে পালিত হয় আখেরী চাহার শম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী, ১১ রবিউসসানী পালিত হয় ফাতেহায়ে ইয়াযদহম, ২৭ রজব রাতে পালিত হয় শবে মিরাজ, ১৫ শাবান রাতে পালিত হয় শবে বরাত, মাহে রমাদানের এক মাস পালিত হয় সিয়াম, ২৭ রমাদান রাতে পালিত হয় শবে কদর, শাওয়াল মাসের ১ তারিখে পালিত হয় ঈদুল ফিতর, জিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত পালিত হয় হজ, ১০ জিলহজ পালিত হয় ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ।
হিজরী সনের প্রতি মাসের সূচনা হয় চন্দ্র উদয়ের মাধ্যমে। এই চাঁদ দেখার মধ্যেও এক আনন্দ বৈভব রয়েছে। বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখা রীতিমতো এক সাংস্কৃতিক উপাদানে পরিণত হয়েছে। হিজরী সনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই সন মুসলিম জাহানের সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত।

লেখক : অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউ-েশন বাংলাদেশ