Monday, 4 April 2016

নববর্ষ উদযাপন ও বর্তমান বাংলাদেশ

নববর্ষ উদযাপন ও বর্তমান বাংলাদেশ
ড. একে এম শাহনাওয়াজ | প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০১৫
ঋতুর বিচিত্র খেয়ালে প্রকৃতি নববর্ষের দিনে এবার রুদ্ররূপে সাজেনি। তবুও বৈশাখ আবহমান বাঙালি সত্তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বৈশাখে আকাশ যেমনই থাক, তবু কল্পনায় কালো করে আসা মেঘ, বজ্রের ডমরু, উন্মাতাল ঝড় প্রতিবাদী বাঙালির প্রতীক হয়েই আছে। এবার চৈত্রের শেষেই কয়েকটি বজ্র-বর্ষণ হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের খরতাপে বিপর্যস্ত জীবনে বারিধারার অমিয় বর্ষণে নরম হয়ে যাওয়া বিগলিত মাটি বাঙালির কোমল হৃদয়কেই যেন মেলে ধরে। বাঙালি জীবনের এ বিচিত্র রূপের মোহনীয় আবেশে নতুন বছরের যাত্রা শুরু হয়েছে দু’দিন আগে। নানা রঙে রাঙিয়ে সব আয়োজনের ডালি সাজিয়ে বাঙালি নববর্ষ বরণ করেছে। রংবেরঙের পোশাকে ঢাকঢোল আর নানা বাদ্যে মাতোয়ারা সব কণ্ঠে সুধা ঢেলে সুর লহরি ছড়িয়ে দিয়েছে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। কবিগুরুর মতো আমাদের প্রত্যাশা, যা কিছু গ্লানি যা কিছু জরা- সব ধুয়ে মুছে যাক। বৃষ্টি ধোয়া আকাশ আর প্রকৃতি যেমন নিষ্পাপ-নির্দোষ, তেমনি আবেশ মেখেই যেন নতুন বছরের শুভ উদ্বোধন হয়েছে। ঢাকের শব্দে মাতোয়ারা হয়েছে চারপাশ। চঞ্চল হয়ে উঠেছে ঢুলির হাতের কাঠি। নাচ-গানে ছন্দময় হয়েছে চারপাশ। পিঠাপুলি আর পায়েসের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে দখিনা বাতাস।
বৈশাখ এভাবে বারবার আসে নিজের চিরপরিচিত সাজে। সমাজ ও রাজনীতির অসুস্থ অবয়ব প্রতিবার শুদ্ধ করতে যেন অপেক্ষা করতে হয় বৈশাখের। ক্ষমতার রাজনীতির প্রচণ্ড স্বার্থপরতা ও অমানবিক আচরণ বিপর্যস্ত করে তুলেছে সংগ্রামী বাঙালির জীবন। সম্প্রতি রাজনীতির নামে অতিষ্ঠ করে তুলেছে জনজীবন এ দেশেরই রাজনীতি অঙ্গনের মানুষ। এজন্য সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের কোনো পরোয়া যেন নেই। কোনো ক্ষমা ভিক্ষা নয়, নয় দুঃখ প্রকাশ বা সমবেদনা জানানো। আবহমান বাঙালির জীবনবোধের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
তবে মানতে হবে, সব অনাচার থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে বৈশাখ বরাবরই প্রাসঙ্গিক। সময়ের প্রয়োজনে বারবারই নিজের রূপে পরিবর্তন এনেছে সে। আজ যেভাবে নানা রঙে-বর্ণে বৈশাখের আয়োজন, আদিতে এমনভাবে নববর্ষের আয়োজন হয়নি। বাঙালির পঞ্জিকা বৈদিক যুগের সৌর পঞ্জিকার ধারাতেই তৈরি হয়েছিল। উৎসটি অভিন্ন থাকায় মিথিলা, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়–, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, শ্রীলংকা ইত্যাদি জায়গার মতো মধ্য এপ্রিলে বাংলায় নববর্ষ পালিত হতো।
মোগলযুগের প্রথম দিকে হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো। তবে এতে সমস্যা ছিল। হিজরি সন তৈরি হয়েছে চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসরণ করে। কৃষকের ফসল তোলার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। তাই বিরুদ্ধ ঋতুতে খাজনা পরিশোধ করা কৃষকের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। এ বাস্তব সংকটটি সম্রাট আকবরের দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি এর সমাধান খোঁজার দায়িত্ব দেন সে সময়ের প্রখ্যাত পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে। সিরাজী বৈদিক সৌর পঞ্জিকা ও হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকার সমন্বয়ে বাংলা সন হিসাবের জন্য একটি পঞ্জিকা তৈরি করলেন। একে সম্পর্কিত করা হল কৃষকের ফসল কাটার সময়ের সঙ্গে। সাধারণের মুখে মুখে সনটির নাম হয়ে গেল ফসলি সন। অর্থাৎ কৃষিবর্ষ। পরে এ সনের নাম হয় বঙ্গাব্দ। সম্রাটের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল। কৃষকের গোলায় ফসল উঠবে। খাজনা পরিশোধে তাকে কোনো চাপে পড়তে হবে না। নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন হয় বৈশাখ মাসের প্রথম দিন। তখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তারিখ ছিল ১৫৮৪ সালের ১০ অথবা ১১ মার্চ। তবে এই সন গণনা কার্যকর হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার দিন থেকে। অর্থাৎ ১৪ ফেব্র“য়ারি (মতান্তরে ৫ নভেম্বর) ১৫৫৬ সালে।
এসব ইতিহাসের সন-তারিখ বাদ দিলেও বলা যায়, নববর্ষ আদিকাল থেকে বাঙালি ঋতুভিত্তিক উৎসব হিসেবে পালন করত। কৃষির সঙ্গে ছিল এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইরানি ভাবধারার প্রভাবে মোগলরা জমকালোভাবে নববর্ষ বা নওরোজ উৎসব পালন করত। বাংলা নববর্ষ প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে দিনটি সাড়ম্বরে উদযাপিত হতে থাকে। সম্রাট আকবরের সময় থেকে (১৫৫৬-১৬০৫) বিশ শতকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার গ্রাম-গঞ্জে আনন্দ-উদ্দীপনায় নববর্ষ পালিত হতো। বুঝতে হবে আজকের কলুষিত রাজনীতি এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিকবলিত জীবনবোধের সঙ্গে আবহমান বাঙালির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।
জমিদারি যুগে নববর্ষ পালনে বিশেষ রেওয়াজ ছিল। জমিদার ও ছোট-বড় ভূস্বামীদের কৃষক চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করত। নববর্ষের দিন প্রসন্ন চিত্তে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে মেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। জমিদারদের মাধ্যমে এমনি করে আনুষ্ঠানিকভাবে নববর্ষ পালনের যাত্রা শুরু হয়। পরে বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ একটি বড় উৎসবে পরিণত হয়। জমিদারদের এ ধরনের অনুষ্ঠানের একটি বৃহত্তর রূপ ছিল পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। প্রথমদিকে পুণ্যাহের সঙ্গে বাংলা নববর্ষের সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। পরে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পুণ্যাহ অনুষ্ঠান নববর্ষের একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ব্রিটিশ-পূর্ব যুগে বিশেষ করে নবাবি আমলে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। এটি ছিল নবাব বা নবাবের দিউয়ানের কাছে জমিদার ইজারাদারদের বার্ষিক খাজনা পরিশোধের অনুষ্ঠান। খাজনা পরিশোধের ওপর ভিত্তি করে এদিন নতুন করে ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া হতো। আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে নবাব ভূমি বন্দোবস্ত পাওয়ার যোগ্য জমিদার ইজারাদারদের সম্মানসূচক পোশাক পরিয়ে দিতেন। একইভাবে জমিদার তার প্রজাদের জন্য পুণ্যাহ পালনের অনুষ্ঠান করতেন। পুণ্যাহ উপলক্ষে নাচ-গান, যাত্রা-পালা, নৌকাবাইচ ইত্যাদি বিনোদনের আয়োজন করা হতো। সে যুগে নববর্ষ ঘিরে নয়, ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই পুণ্যাহের উৎসব হতো। উনিশ শতকের মাঝপর্বে এসে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান নববর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে নিয়মিতভাবে পুণ্যাহ উদযাপন হতে থাকে। ১৯৫০ সালে জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ ঘটার পর থেকে পুণ্যাহ উৎসবেরও অবসান ঘটে। এই যে পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মধ্য দিয়ে জীবনযাত্রার ভারসাম্য, তা কি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি বর্তমানের কঠিন বাস্তবতায়। রাজনীতির কুশলী শব্দে সাধারণ নাগরিককে রাষ্ট্রের মালিক বলছি আর প্রতিদিন তাদের জীবনকে করে তুলছি বিষময়।
যুগ যুগ ধরে ব্যবসায়ী, কৃষক ও নাগরিক সমাজের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব ও বৈচিত্র্য নিয়ে নববর্ষ পালন করত। এখনও বনেদি ব্যবসায়ীর কাছে নববর্ষ একটি পবিত্র দিন। এ ধারার ব্যবসায়ীরা বাংলা সনের হিসাবেই সাধারণত ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। তাই ব্যবসাকে ঘিরে হালখাতা ও খেরোখাতা দুটি শব্দের বাস্তবতা অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। হালখাতা উৎসব উপলক্ষে নববর্ষের আগেই যথাসম্ভব বাকি আদায় করা হয়। হালখাতা অর্থাৎ নববর্ষের দিন হিন্দু ব্যবসায়ী নিয়মমতো পূজা-অর্চনা করে সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। মুসলমান ব্যবসায়ী মিলাদ পড়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। এভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে যুগে যুগে নববর্ষ আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার কৃষকের কাছে নববর্ষ একটি পবিত্র দিন। তাদের বিশ্বাস, নববর্ষের দিন ভালো কাটলে এর প্রভাব সারা বছর প্রতিফলিত হবে। নববর্ষকে কৃষিজীবী মানুষ কৃষির সাফল্যের প্রত্যাশায় বিশেষভাবে বরণ করত। এদিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো। চেষ্টা করা হতো ভালো খাবার পরিবেশন করতে। নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য না থাকলে মানুষ ধোয়া কাপড় পরত। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পরস্পরের খোঁজখবর নিত। শুভেচ্ছা বিনিময় করত। গ্রামে গ্রামে গেরস্থের বাড়িতে হরেক পিঠাপুলিসহ নানা লোকজ খাবারের আয়োজন করা হতো। গ্রামেগঞ্জে বৈশাখী মেলার আয়োজন ছিল নববর্ষের বিশেষ আকর্ষণ। এ সময় কৃষকের গোলায় থাকত ধান, ট্যাকে থাকত টাকা। ফলে নববর্ষের অনুষ্ঠান হতো আনন্দঘন।
নগরকেন্দ্রিক বৈশাখী উৎসবে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে রবীন্দ্র চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাঁয়তারা চলতে থাকে। এই অশুভ উদ্দেশ্যকে মোকাবেলা করার জন্য ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মীরা ছায়ানট নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলে। বাঙালি সংস্কৃতি লালন করার জন্য ছায়ানট পথে নেমে আসে। নববর্ষের প্রত্যুষে ঢাকায় রমনার বটমূলে সঙ্গীত মূর্ছনার মধ্য দিয়ে শুরু করে নববর্ষের আনন্দ আয়োজনের। এই আনন্দ পল্লবিত হয় নগরীর নানা অলিগলিতে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হচ্ছে বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যিক শক্তি। অভিন্ন ছাতার নিচে বাঙালি জাতিকে এমনভাবে একত্রিত করার আর কোনো দিবস আমাদের নেই। একটি জাতির পরিপূর্ণ বিকাশে সাংস্কৃতিক শক্তির ভূমিকা সবচেয়ে প্রবল। এই সাংস্কৃতিক শক্তি সঞ্জীবিত করার জন্য এমন প্রণোদনা প্রদায়ী আর কোনো দিবস বাংলা নববর্ষের বিকল্প হতে পারে না। প্রমাণ তো আমরা বারবার পেয়েছি। শোষক আর নিপীড়ক শক্তি যুগে যুগে ভয় পেয়েছে বাঙালি শক্তির আবাহনকে। তাই এককালে সেন রাজারা বাঙালির সংস্কৃতি চর্চাকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। ব্রাহ্মণ সেন রাজারা শূদ্র অভিধায় কোণঠাসা করে রাখা বাঙালির শিক্ষা চর্চাকে নিষিদ্ধ করেছিল। একইভাবে সংস্কৃতিশূন্য করে দেয়ার জন্য বাংলা ভাষাকে গ্রাস করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র। কিন্তু বাঙালির দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগে তা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও কি এই ষড়যন্ত্র থেমে ছিল? একই মানসিকতার শক্তি রমনার বটমূলে বোমা হামলায় মর্মান্তিকভাবে মানুষ হত্যা করে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। যুগ যুগ ধরে নববর্ষে সংস্কৃতি চর্চার যে নবায়ন, তা বাঙালির আত্মপ্রত্যয়কে বেগবান করেছে। ফলে বোমা হামলার পরের বছর থেকে নববর্ষে বাঙালি মুখরিত হয়েছে আরও অনেক শক্তি নিয়ে। রাজধানীকেন্দ্রিকতা ছাড়িয়ে সমগ্র দেশে নববর্ষের আনন্দ মিছিল পল্লবিত হয়েছে।
এই বাস্তবতা বলে দেয়, নববর্ষ উদযাপন শ্রেণী-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির যে মিলনমেলা- এর প্রচণ্ডতা সব পংকিলতা ও অন্যায় থেকে বাঙালিকে রক্ষা করবে। এ সত্য সুবিধাবাদী ও লোভীগোষ্ঠী যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে, ততই সবার মঙ্গল।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্বনবী (সা.)-এর মেরাজ

বিশ্বনবী (সা.)-এর মেরাজ
মো. লুৎফুর রহমান    ২৩ মে, ২০১৪ ০০:০০  173 শেয়ার মন্তব্য()প্রিন্ট

অ- অ অ+

আমাদের কাছে শবে মেরাজ খুবই পরিচিত একটি নাম। বিশ্বে এ দিবসকে মুসলমানরা পালন করে থাকে নানা আয়োজনে- সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও মিলাদ-মাহফিলের মাধ্যমে। রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে এ দিবসে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও খবর প্রচার হয়ে থাকে। (যদিও এসব কাজে সওয়াব অর্জনের কথা শরিয়তে প্রমাণিত নয়)

'মেরাজ' মূলত মানুষের ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। মেরাজ মানে ঊর্ধ্বারোহণ। কিন্তু এই ঊর্ধ্বারোহণ কোনো সাধারণ ঊর্ধ্বারোহণ নয়, আকাশে কিংবা চাঁদে যাওয়া নয়, মঙ্গল গ্রহে যাওয়াও নয়। এটি হলো এমন ঊর্ধ্বারোহণ, যেখানে আরশে আজিম অর্থাৎ আল্লাহপাকের আরশ কুরছি ও লওহে মাহফুজ (পবিত্র কোরআন যেখানে সংরক্ষিত) রয়েছে। ঠিক সেখানেই রাসুলে পাক (সা.)-এর গমন।

এটি সত্যি বিস্ময়কর একটি ঘটনা শুধু ইতিহাসের জন্য নয়, বিজ্ঞানের জন্যও। যখন বিমান কিংবা রকেটের আবিষ্কার হয়নি, তখন একজন মানুষ যন্ত্রবিহীন পৃথিবী ছেড়ে সাত আসমান ভেদ করে 'সর্বশেষ ফটক' বা ছিদরাতুল মুনতাহা ভেদ করে স্বয়ং আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়া এবং সেখানে অবস্থান করে পৃথিবীর মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার সব নিদর্শন দেখে ও নির্দেশনামা নিয়ে আবার পৃথিবীর বুকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা এক অকল্পনীয় বিস্ময়।

এখানে উল্লেখ্য যে ছিদরাতুল মুনতাহা হলো সেই ফটক, যে ফটকে হজরত জিবরাইল (আ.) এবং অন্য ফেরেশতাদেরও যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই।

প্রথম ঘটনা : যাহোক, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেই সর্বশেষ ফটক অতিক্রম করে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার মতো ঘটনা স্বয়ং আল্লাহই প্রকাশ করেছেন বিস্ময়সূচক 'সুবহান' শব্দ ব্যবহার করে। যেমন সুরা বনি ইসরাইলে প্রথমেই সুবহানাল্লাজি আসরা বি-আবদিহি...বলে এ ঘটনার সূত্রপাত করেছেন অর্থাৎ 'পবিত্র ও মহিমান্বিত (সেই আল্লাহ!) যিনি তাঁর (এক) বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপাশ্বর্িকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, যেন আমি তাকে আমার (দৃশ্য-অদৃশ্য) দেখাতে পারি, (মূলতঃ) সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা তো স্বয়ং তিনিই।' (বনি ইসরাইল : ১)।

নবীদের সঙ্গে নামাজ : ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, সঠিক বর্ণনানুযায়ী জানা যায়, নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে স্বশরীরে বোরাকে তুলে হজরত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। নবী করিম (সা.) সেখানে মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বোরাক বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং সব নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেন।

প্রথম আসমানে প্রবেশ : এরপর সে রাতেই রাসুল (সা.)-কে বায়তুল মাকদাস থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবী (সা.) হজরত আদম (আ.)-কে সালাম করেন। হজরত আদম প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে মারহাবা বলে সালামের জবাব দেন। তাঁর নবুয়তের স্বীকারোক্তি করেন। তখন আল্লাহপাক হজরত আদম (আ.)-এর ডানদিকে নেককার ও বামদিকে পাপীদের দেখান প্রিয় নবী (সা.)-কে।

দ্বিতীয় আসমানে প্রবেশ : প্রথম আকাশ থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) নবী (সা.)-কে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে যান। আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত জাকারিয়া (আ.)-এর সঙ্গে। সাক্ষাতেই নবী (সা.) সালাম করেন। সেখানে হজরত ঈসা ইবনে মরিয়মও ছিলেন। সালাম বিনিময় শেষে তাঁরা আখেরি নবীর নবুয়তের স্বীকৃতি দেন।

তৃতীয় আসমানে প্রবেশ : এরপর রাসুল (সা.)-কে হজরত জিবরাইল (আ.) তৃতীয় আসমানে নিয়ে গেলেন। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে। এখানে সালাম বিনিময় হয়। নবী (সা.)-কে তিনি স্বাগত জানান।

চতুর্থ আসমানে প্রবেশ : তৃতীয় আকাশ থেকে চতুর্থ আকাশে যান। সঙ্গে হজরত জিবরাইল (আ.)। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর সঙ্গে। দুজন দুজনকে সালাম করেন। এরপর হজরত ইদ্রিস (আ.) নবী (সা.)-কে মোবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি দেন।

পঞ্চম আসমানে প্রবেশ : এরপর রাসুল (সা.)-কে পঞ্চম আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি হজরত হারুন (আ.)কে দেখে সালাম দেন। তিনি সালামের জবাবে মোবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

ষষ্ঠ আসমানে প্রবেশ ও মুসা (আ.)-এর ক্রন্দন : নবী (সা.)-কে এরপর ষষ্ঠ আকাশে নেওয়া হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি সালাম করেন। হজরত মুসা (আ.) তাঁকে স্বাগত জানান এবং রাসুলের নবুয়তের স্বীকার করেন। এরপর নবী (সা.) সামনে এগিয়ে গেলেন। তখন হজরত মুসা (আ.) কাঁদতে লাগলেন। নবী (সা.) জানতে চাইলেন আপনি কাঁদছেন কেন? হজরত মুসা (আ.) বললেন, আমার পরে একজন নবী আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর উম্মতরা আমার উম্মতের চেয়ে সংখ্যায় বেশি জান্নাতে যাবে।

সপ্তম আসমানে প্রবেশ : নবী করিম (সা.)-কে এরপর সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে সালাম করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) সালামের জবাব দেন এবং নবী পাক (সা.)-কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ও তাঁর নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

সিদরাতুল মুনতাহা পার হওয়ার ঘটনা : প্রথম আসমান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত যাওয়ার পর নবী (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটি আল্লাহর কাছে পৌঁছার প্রথম গেট। যে গেট দিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.)ও যেতে পারেন না। এরপর নবী (সা.) একাই আল্লাহপাকের আরশে পৌঁছে যান। সেখানে পৌঁছার পর নবী (সা.) আল্লাহকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন, 'আত্তাহিয়াতু লিল্লাহ...। আল্লাহ পাক জবাবে বলেন, আস্সালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবি। আল্লাহপাকের সালামের জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, আস্সালামু আলাইনা ওয়ালা ইবাদিল্লাহিস সালেহিন। এরপর আল্লাহপাক নবী (সা.)-কে যা দেওয়ার দিয়ে দেন, যা ইচ্ছা ওহি নাজিল করেন এবং ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অর্জন : আরশে আজিমের সেই মহা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, উপঢৌকন ও নামাজের আদেশ পেয়ে ফেরার পথে সাক্ষাৎ হয় হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আপনাকে আল্লাহ কী কাজের আদেশ করেছেন? নবী (সা.) বললেন, ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। হজরত মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত এত নামাজ আদায়ের শক্তি রাখে না। আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে নামাজ কমিয়ে আনার দরখাস্ত করুন। এ সময় নবী (সা.) হজরত জিবরাইল (আ.)-এর দিকে তাকালে তিনি ইশারা করলেন। এরপর নবী (সা.) ফিরে গিয়ে নামাজ কমিয়ে দেওয়ার আবেদন করলে আল্লাহপাক ৪৫ ওয়াক্ত নামাজ দান করেন। ফিরে আসার পথে আবার মুসা (আ.) জিজ্ঞেস করেন এবং ৪৫ ওয়াক্ত নামাজের ব্যাপারে একই কথা বলেন। নবী (সা.) এভাবে আল্লাহ পাকের দরবারে আটবার গেলেন এবং প্রত্যেকবার পাঁচ ওয়াক্ত করে কমিয়ে দেওয়া হলো। অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যখন আল্লাহ নির্ধারণ করলেন, তখন হজরত মুসা (আ.) এ সংখ্যাকেও বেশি মনে করলেন এবং নবী (সা.)-কে আবারও দরখাস্ত পেশ করতে বললেন। নবী (সা.) বারবার যেতে লজ্জাবোধ করলেন এবং বললেন আমি আল্লাহর এ আদেশের ওপরই মাথানত করলাম। ফেরার পথে কিছুদূর আসার পর আওয়াজ হলো, 'আমি আমার ফরজ নির্ধারণ করে দিয়েছি এবং আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিয়েছি।'

এ সময়ও নবী (সা.)-এর শাককুস সদর বা বক্ষ বিদার ঘটে। এ সফরে রাসুল (সা.)-কে কয়েকটি জিনিস দেখানো হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জান্নাত ও জাহান্নাম। (জাদুল মা'আদ)

মেরাজের ঘটনা শেষে রাসুল (সা.) যখন পৃথিবীতে এলেন, তখনো রাসুলের ওজু করা পানি গড়িয়ে পড়ছিল। এদিকে এ ঘটনা জানতে পেরে কাফেররা তিরস্কার করা শুরু করল। হজরত আবু বকর (রা.) আবু জাহেলের মুখে ভর্ৎসনার সুর শুনে তিনি বললেন, যদি আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) এ কথা বলে থাকেন, তবে আমি খাঁটি ইমানে বিশ্বাস করলাম। সেই ঘটনা থেকেই হজরত আবু বকর (রা.)-এর নামের সঙ্গে সিদ্দিক বা সত্যায়নকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। (ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ : ৬৯৯)।

লেখক : সাংবাদিক

- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/dhormo/2014/05/23/87498#sthash.BJlX5Mys.dpuf

মিরাজ রজনীর আধ্যাত্মিক ভ্রমণ


সৈয়দ গোলাম মোরশেদ | প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৪
মিরাজ একটি গভীর অন্তর্ব্যাপী, আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। রজনীযোগে ভ্রমণ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে মিরাজ-সংক্রান্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। নবুয়ত প্রকাশের দশম বছর, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সকালে, ২৭ রজব ওই অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়। মিরাজ নিয়ে মুসলিম দার্শনিক, তত্ত্বজ্ঞানী, ধর্মবিষয়ক লেখকরা আলোচনায় খুব একটা প্রবৃত্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। সাহাবিদের কিছু কিছু বর্ণনা কাহিনী আকারে হাদিস গ্রন্থগুলোতে দেখা যায়। এ বিষয়ে তাত্ত্বিক মতামত, গবেষণা, পর্যালোচনা নেই বললেই চলে। কোনো কোনো লেখক সাহাবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যেহেতু এটি আমলি বিষয় নয় সেহেতু এ বিষয়ে চিন্তা করা বা এর কোনো মর্ম বা তাত্ত্বিক আলোচনার দরকার নেই। অথচ আগামী সোমবার রাতে সারাদেশে পবিত্র শবেমিরাজ পালিত হবে। মিরাজ ঘটনাটি ইসলামকে মহিমান্বিত করেছে। প্রিয় নবীকে (সা.) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেছে। সর্বোপরি মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর মহামিলন ঘটিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মর্ম, দর্শন, তাত্ত্বিক আলোচনা ও গবেষণা এড়িয়ে যাওয়া ইসলাম সম্পর্কে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দৈন্য ও বিমুখতা বৈ আর অন্য কিছু নয়। মানব ইতিহাসে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা হচ্ছে এই মিরাজুন্নবী (সা.)। মূলত মানবাত্মা এবং পরমাত্মার মহামিলন-সংক্রান্ত ঘটনাবলীই হচ্ছে মিরাজ। মিরাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো এরকম পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়। যার পরিবেশ আমরা করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা [১৭:১]।
অন্তর্গামী নক্ষত্রের শপথ, তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নন, পথভ্রষ্টও নন এবং তিনি আপন প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। এটা তো অহি যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে। মহাশক্তিধর তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। চির প্রকাশমান শক্তিধর, কাজেই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং এরপর নিকটবর্তী হলেন এবং অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তার চেয়েও কম। তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা অহি করার, করলেন। তিনি যা দেখলেন তাঁর অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি। তিনি যা দেখেছেন সে সম্পর্কে কি তোমরা তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করবে? নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন প্রান্তবর্তী বদরি বৃক্ষের কাছে, যার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি আচ্ছাদিত হল, যা দিয়ে আচ্ছাদিত হওয়ার কথা। তখন তাঁর দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিশ্চয় তিনি তাঁর প্রভুর শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো দেখেছিলেন। [৫৩:১-১৮]।
মিরাজ শব্দটি পবিত্র কোরআনে নেই। এফ, স্টেইন গাসের আরবি ইংরেজি অভিধানে মিরাজ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে tairs, Ladder Ascension অর্থাৎ সিঁড়ি, মই বা উন্নতি লাভের সিঁড়ি বা আরোহণ। মিরাজ বলতে যা বুঝানো হয়েছে তাতে তা উন্নতি লাভের সোপান হিসেবেই বেশি প্রযোজ্য। তবে অধিকাংশ তাফসিরকারক মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্ব গমন বা ঊর্ধ্ব আরোহণ বুঝিয়েছেন।
মিরাজ অর্থ উন্নতির সোপান বলেই অধিক যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়। সূরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে (সা.) মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছেন। মসজিদুল হারাম বলতে পবিত্র কাবা শরিফকেই যে বুঝানো হয়েছে এতে কারও দ্বিমত নেই। পবিত্র কাবাঘরকে পবিত্র কোরআনে মসজিদুল হারাম বলে একাধিক বার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দাসকে মসজিদুল আকসা বলে পবিত্র কোরআনে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। মসজিদুল আকসা অর্থ দূরবর্তী মসজিদ। পবিত্র কোরআনের আয়াত দৃষ্টে মনে হয় নবী করিমকে (সা.) উন্নত থেকে উন্নতর স্থানে বা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং হজরত আদম (আ.) এবং পরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক আল্লাহর নির্দেশে নির্মিত পৃথিবীর আদি মসজিদ, মসজিদুল হারাম (যা প্রিয়নবী (সা.) এবং তাঁর উম্মতের কাবা) থেকে হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত বায়তুল মুকাদ্দাস কীভাবে উন্নতর হল তা মোটেই বোধগম্য হয় না। পবিত্র কোরআনে মসজিদুল আকসা বলতে বায়তুল মামুরকেই বুঝানো হয়েছে বলে মনে হয়। কবি গোলাম মোস্তফা তার বিখ্যাত, বিশ্বনবী কিতাবের ১৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, দূরতম মসজিদ বলতে বায়তুল মামুরকে গ্রহণ করলে মিরাজের দার্শনিক তাৎপর্য বুঝতে সহজ হয়। মক্কার কাবা হচ্ছে বস্তুজগতের কাবা আর বায়তুল মামুর হচ্ছে আধ্যাত্মিক বা ধ্যান জগতের কাবা। কাজেই কাবা থেকে বায়তুল মামুরে নেয়া হয়েছে। এ কথার দ্বারা বুঝা যায় যে, বস্তুজগৎ হতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) উচ্চতর আধ্যাত্মিক বা ধ্যান জগতে নেয়া হয়েছিল। সূরা নজমের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, মহাশক্তিধর তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। এখানে মহাশক্তিধর বলতে তাফসিরকারকরা জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। মহাশক্তিধর শব্দটির জন্য পবিত্র কোরআনে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হল, শাহিদুল কুওয়া। পবিত্র কোরআনে এ শব্দ আরও অনেক জায়গায় আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে একমাত্র আল্লাহরই জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- শাদিদুল ইকবা, কুওয়াতিল মাতিন। এসব জায়গায় তাফসিরকারকরা ও শব্দগুলোকে আল্লাহর নামবাচক হিসেবেই লিখেছেন। সূরা নজমে এসে যখন রাসূলুল্লাহকে (সা.) শিক্ষা দেয়ার প্রশ্ন এলো তখনই তা আল্লাহর পরিবর্তে জিব্রাইল হয়ে গেল। এটাই হয়তো তাদের ধারণা হবে যে, আল্লাহ কেন মুহাম্মদকে (সা.) শিক্ষা দিতে যাবেন? আরও অধস্থান কারও কাছ থেকে শিক্ষার ব্যবস্থা করাই বুঝি ভালো হয়! অথচ তারা ভুলে গেছেন যে, আল্লাহপাক নিজেই মানুষের মহান শিক্ষক। আসমাগুলো (নামগুলো) স্বয়ং আল্লাহপাকই হজরত আদমকে (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর আদমই (আ.) তা ফেরেশতাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেখানে হজরত জিব্রাইলও (আ.) ছিলেন। সুতরাং আদমই ফেরেশতাদের শিক্ষক। আদমের এ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে (আ.) সিজদা করেছিলেন। এ কথা পবিত্র কোরআনেরই কথা। সুতরাং পবিত্র কোরআনের দলিল অনুযায়ী জিব্রাইল (আ.) কস্মিনকালেও প্রিয়নবীকে (সা.) শিক্ষাদানের যোগ্যতা ও অধিকার রাখেন না।
সূরা নজমের ৬নং আয়াতে বলা হয়েছে, চির প্রকাশমান শক্তিধর, কাজই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। তাফসিরকারকরা এ আয়াতে তিনি বলতে জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। অথচ এ সর্বনামে প্রিয় নবীকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। জিব্রাইল (আ.)-এর পূর্ণতা হাসিলের কিছুই নেই। ফেরেশতাদের আল্লাহপাক যেটুকু জানান, কেবলমাত্র সেটুকুই তারা জানতে সক্ষম। এর বাইরে কোনো এলম, যোগ্যতা বা পূর্ণতা হাসিলের কোনো প্রচেষ্টাই তারা করতে অক্ষম। একমাত্র মানুষই পারে সাধনাবলে যোগ্যতার শ্রেষ্ঠতম আসনে আসীন হতে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী, ফলে তাঁদের মধ্যে রইল দুধনুকের ব্যবধান অথবা তার চেয়েও কম। এখানেও তাফসিরকারকরা তিনি বলতে জিব্রাইলকে টেনে এনেছেন এবং তাঁদের বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকে (সা.) বুঝিয়েছেন। হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রিয়নবী (সা.) যেন জিব্রাইলের সঙ্গেই মিরাজ করার জন্য ঊর্ধ্ব গমন করেছিলেন। মহিমাময় আল্লাহ এখানে একেবারেই অনুপস্থিত! সুফি এবং সুধী সমাজ এ ধরনের ভাবধারা গ্রহণ করতে নারাজ। কবি গোলাম মোস্তাফা তার বিশ্বনবীতে উল্লেখ করেছেন, তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের বলতে আল্লাহ ও রাসূলকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। দশম আয়াতে এ কথার যথার্থতা পাওয়া যায়, কারণ এখানে আল্লাহ লেখা হয়েছে। ত্রয়োদশ আয়াতে বলা হয়েছে, নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন। এখানেও তাফসিরকারকরা তিনি বলতে মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকেই (সা.) বুঝিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়- তাফসিরকারকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রিয়নবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ করাতে নারাজ। তাই জিব্রাইলকে বারবার টেনে নিয়ে আসা। অথচ তারা একথা বেমালুম ভুলে গেছেন, জিব্রাইল তো শুরু থেকে প্রিয়নবী (সা.) এর সঙ্গেই আছেন। সুতরাং তাকে (জিব্রাইল) আবার নতুন করে দেখার এবং তার কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ারই বা কি আছে? মিরাজের আয়াতগুলোর সার কথা হল, মহিমান্বিত আল্লাহর সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.) এর মুলাকাত বা দিদার। এ দিদার লাভ কেউ বলেন আধ্যাত্মিকভাবে আবার কেউ বলেন, স্বশরীরে হয়েছে। আমরা কোনোটাকেই অসম্ভব বলে মনে করি না। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার কিমিয়ায়ে সাদাআতে উল্লেখ করেন, মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের বেহেশতের অবস্থা দর্শন করেছেন বলে যে সংবাদ প্রদান করেছেন তা কেবল জিব্রাইলের মুখে শুনে নয়, বরং তিনি তা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি চাক্ষুস দৃষ্ট ঘটনা জগতে প্রকাশ করেছেন। ইহজগৎ থেকে কেউ বেহেশতের অবস্থা জানতে পারে না, এ কথা সত্য কিন্তু রাসূল (সা.) এর দৃষ্টি এ জগৎ অতিক্রম করে পরলোক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর এ অবস্থাকে দ্বিবিধ মিরাজের এক ধরনের মিরাজ বলা যায়। জীবাত্মার মৃত্যুতে মানবাত্মার মিরাজ হয় অথবা জীবাত্মা দুর্বল হলে মানবাত্মার মিরাজ সংঘটিত হয়। নূরে মুহাম্মদী (সা.) হচ্ছেন সৃষ্টির আদি নূর, যাবতীয় সৃষ্টির অন্তর্নিহিত সত্তাসার। প্রিয়নবী (সা.) হচ্ছেন নূরুন আলা নূর। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব (৫:১৫)। তাছাড়া হাদিস শরিফে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, আনা মিন নূরিল্লাহ, অ কুল্লে শাইয়িম মিন নূরী। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর হতে আর সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর হতে। সুতরাং পবিত্র কোরআন ও কোরআন সমর্থিত সহি হাদিসের আলোকে প্রিয়নবী (সা.) এর মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয় সাপেক্ষে মিরাজের গূঢ়তত্ত্ব ও রহস্য উন্মোচন করার কাজে ব্রত হওয়া প্রত্যেক ইসলামী দার্শনিকের একান্ত কর্তব্য