সৈয়দ গোলাম মোরশেদ | প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৪
মিরাজ একটি গভীর অন্তর্ব্যাপী, আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। রজনীযোগে ভ্রমণ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে মিরাজ-সংক্রান্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। নবুয়ত প্রকাশের দশম বছর, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সকালে, ২৭ রজব ওই অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়। মিরাজ নিয়ে মুসলিম দার্শনিক, তত্ত্বজ্ঞানী, ধর্মবিষয়ক লেখকরা আলোচনায় খুব একটা প্রবৃত্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। সাহাবিদের কিছু কিছু বর্ণনা কাহিনী আকারে হাদিস গ্রন্থগুলোতে দেখা যায়। এ বিষয়ে তাত্ত্বিক মতামত, গবেষণা, পর্যালোচনা নেই বললেই চলে। কোনো কোনো লেখক সাহাবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যেহেতু এটি আমলি বিষয় নয় সেহেতু এ বিষয়ে চিন্তা করা বা এর কোনো মর্ম বা তাত্ত্বিক আলোচনার দরকার নেই। অথচ আগামী সোমবার রাতে সারাদেশে পবিত্র শবেমিরাজ পালিত হবে। মিরাজ ঘটনাটি ইসলামকে মহিমান্বিত করেছে। প্রিয় নবীকে (সা.) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেছে। সর্বোপরি মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর মহামিলন ঘটিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মর্ম, দর্শন, তাত্ত্বিক আলোচনা ও গবেষণা এড়িয়ে যাওয়া ইসলাম সম্পর্কে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দৈন্য ও বিমুখতা বৈ আর অন্য কিছু নয়। মানব ইতিহাসে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা হচ্ছে এই মিরাজুন্নবী (সা.)। মূলত মানবাত্মা এবং পরমাত্মার মহামিলন-সংক্রান্ত ঘটনাবলীই হচ্ছে মিরাজ। মিরাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো এরকম পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়। যার পরিবেশ আমরা করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা [১৭:১]।
অন্তর্গামী নক্ষত্রের শপথ, তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নন, পথভ্রষ্টও নন এবং তিনি আপন প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। এটা তো অহি যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে। মহাশক্তিধর তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। চির প্রকাশমান শক্তিধর, কাজেই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং এরপর নিকটবর্তী হলেন এবং অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তার চেয়েও কম। তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা অহি করার, করলেন। তিনি যা দেখলেন তাঁর অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি। তিনি যা দেখেছেন সে সম্পর্কে কি তোমরা তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করবে? নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন প্রান্তবর্তী বদরি বৃক্ষের কাছে, যার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি আচ্ছাদিত হল, যা দিয়ে আচ্ছাদিত হওয়ার কথা। তখন তাঁর দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিশ্চয় তিনি তাঁর প্রভুর শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো দেখেছিলেন। [৫৩:১-১৮]।
মিরাজ শব্দটি পবিত্র কোরআনে নেই। এফ, স্টেইন গাসের আরবি ইংরেজি অভিধানে মিরাজ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে tairs, Ladder Ascension অর্থাৎ সিঁড়ি, মই বা উন্নতি লাভের সিঁড়ি বা আরোহণ। মিরাজ বলতে যা বুঝানো হয়েছে তাতে তা উন্নতি লাভের সোপান হিসেবেই বেশি প্রযোজ্য। তবে অধিকাংশ তাফসিরকারক মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্ব গমন বা ঊর্ধ্ব আরোহণ বুঝিয়েছেন।
মিরাজ অর্থ উন্নতির সোপান বলেই অধিক যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়। সূরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে (সা.) মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছেন। মসজিদুল হারাম বলতে পবিত্র কাবা শরিফকেই যে বুঝানো হয়েছে এতে কারও দ্বিমত নেই। পবিত্র কাবাঘরকে পবিত্র কোরআনে মসজিদুল হারাম বলে একাধিক বার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দাসকে মসজিদুল আকসা বলে পবিত্র কোরআনে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। মসজিদুল আকসা অর্থ দূরবর্তী মসজিদ। পবিত্র কোরআনের আয়াত দৃষ্টে মনে হয় নবী করিমকে (সা.) উন্নত থেকে উন্নতর স্থানে বা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং হজরত আদম (আ.) এবং পরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক আল্লাহর নির্দেশে নির্মিত পৃথিবীর আদি মসজিদ, মসজিদুল হারাম (যা প্রিয়নবী (সা.) এবং তাঁর উম্মতের কাবা) থেকে হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত বায়তুল মুকাদ্দাস কীভাবে উন্নতর হল তা মোটেই বোধগম্য হয় না। পবিত্র কোরআনে মসজিদুল আকসা বলতে বায়তুল মামুরকেই বুঝানো হয়েছে বলে মনে হয়। কবি গোলাম মোস্তফা তার বিখ্যাত, বিশ্বনবী কিতাবের ১৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, দূরতম মসজিদ বলতে বায়তুল মামুরকে গ্রহণ করলে মিরাজের দার্শনিক তাৎপর্য বুঝতে সহজ হয়। মক্কার কাবা হচ্ছে বস্তুজগতের কাবা আর বায়তুল মামুর হচ্ছে আধ্যাত্মিক বা ধ্যান জগতের কাবা। কাজেই কাবা থেকে বায়তুল মামুরে নেয়া হয়েছে। এ কথার দ্বারা বুঝা যায় যে, বস্তুজগৎ হতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) উচ্চতর আধ্যাত্মিক বা ধ্যান জগতে নেয়া হয়েছিল। সূরা নজমের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, মহাশক্তিধর তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। এখানে মহাশক্তিধর বলতে তাফসিরকারকরা জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। মহাশক্তিধর শব্দটির জন্য পবিত্র কোরআনে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হল, শাহিদুল কুওয়া। পবিত্র কোরআনে এ শব্দ আরও অনেক জায়গায় আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে একমাত্র আল্লাহরই জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- শাদিদুল ইকবা, কুওয়াতিল মাতিন। এসব জায়গায় তাফসিরকারকরা ও শব্দগুলোকে আল্লাহর নামবাচক হিসেবেই লিখেছেন। সূরা নজমে এসে যখন রাসূলুল্লাহকে (সা.) শিক্ষা দেয়ার প্রশ্ন এলো তখনই তা আল্লাহর পরিবর্তে জিব্রাইল হয়ে গেল। এটাই হয়তো তাদের ধারণা হবে যে, আল্লাহ কেন মুহাম্মদকে (সা.) শিক্ষা দিতে যাবেন? আরও অধস্থান কারও কাছ থেকে শিক্ষার ব্যবস্থা করাই বুঝি ভালো হয়! অথচ তারা ভুলে গেছেন যে, আল্লাহপাক নিজেই মানুষের মহান শিক্ষক। আসমাগুলো (নামগুলো) স্বয়ং আল্লাহপাকই হজরত আদমকে (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর আদমই (আ.) তা ফেরেশতাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেখানে হজরত জিব্রাইলও (আ.) ছিলেন। সুতরাং আদমই ফেরেশতাদের শিক্ষক। আদমের এ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে (আ.) সিজদা করেছিলেন। এ কথা পবিত্র কোরআনেরই কথা। সুতরাং পবিত্র কোরআনের দলিল অনুযায়ী জিব্রাইল (আ.) কস্মিনকালেও প্রিয়নবীকে (সা.) শিক্ষাদানের যোগ্যতা ও অধিকার রাখেন না।
সূরা নজমের ৬নং আয়াতে বলা হয়েছে, চির প্রকাশমান শক্তিধর, কাজই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। তাফসিরকারকরা এ আয়াতে তিনি বলতে জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। অথচ এ সর্বনামে প্রিয় নবীকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। জিব্রাইল (আ.)-এর পূর্ণতা হাসিলের কিছুই নেই। ফেরেশতাদের আল্লাহপাক যেটুকু জানান, কেবলমাত্র সেটুকুই তারা জানতে সক্ষম। এর বাইরে কোনো এলম, যোগ্যতা বা পূর্ণতা হাসিলের কোনো প্রচেষ্টাই তারা করতে অক্ষম। একমাত্র মানুষই পারে সাধনাবলে যোগ্যতার শ্রেষ্ঠতম আসনে আসীন হতে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী, ফলে তাঁদের মধ্যে রইল দুধনুকের ব্যবধান অথবা তার চেয়েও কম। এখানেও তাফসিরকারকরা তিনি বলতে জিব্রাইলকে টেনে এনেছেন এবং তাঁদের বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকে (সা.) বুঝিয়েছেন। হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রিয়নবী (সা.) যেন জিব্রাইলের সঙ্গেই মিরাজ করার জন্য ঊর্ধ্ব গমন করেছিলেন। মহিমাময় আল্লাহ এখানে একেবারেই অনুপস্থিত! সুফি এবং সুধী সমাজ এ ধরনের ভাবধারা গ্রহণ করতে নারাজ। কবি গোলাম মোস্তাফা তার বিশ্বনবীতে উল্লেখ করেছেন, তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের বলতে আল্লাহ ও রাসূলকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। দশম আয়াতে এ কথার যথার্থতা পাওয়া যায়, কারণ এখানে আল্লাহ লেখা হয়েছে। ত্রয়োদশ আয়াতে বলা হয়েছে, নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন। এখানেও তাফসিরকারকরা তিনি বলতে মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকেই (সা.) বুঝিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়- তাফসিরকারকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রিয়নবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ করাতে নারাজ। তাই জিব্রাইলকে বারবার টেনে নিয়ে আসা। অথচ তারা একথা বেমালুম ভুলে গেছেন, জিব্রাইল তো শুরু থেকে প্রিয়নবী (সা.) এর সঙ্গেই আছেন। সুতরাং তাকে (জিব্রাইল) আবার নতুন করে দেখার এবং তার কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ারই বা কি আছে? মিরাজের আয়াতগুলোর সার কথা হল, মহিমান্বিত আল্লাহর সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.) এর মুলাকাত বা দিদার। এ দিদার লাভ কেউ বলেন আধ্যাত্মিকভাবে আবার কেউ বলেন, স্বশরীরে হয়েছে। আমরা কোনোটাকেই অসম্ভব বলে মনে করি না। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার কিমিয়ায়ে সাদাআতে উল্লেখ করেন, মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের বেহেশতের অবস্থা দর্শন করেছেন বলে যে সংবাদ প্রদান করেছেন তা কেবল জিব্রাইলের মুখে শুনে নয়, বরং তিনি তা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি চাক্ষুস দৃষ্ট ঘটনা জগতে প্রকাশ করেছেন। ইহজগৎ থেকে কেউ বেহেশতের অবস্থা জানতে পারে না, এ কথা সত্য কিন্তু রাসূল (সা.) এর দৃষ্টি এ জগৎ অতিক্রম করে পরলোক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর এ অবস্থাকে দ্বিবিধ মিরাজের এক ধরনের মিরাজ বলা যায়। জীবাত্মার মৃত্যুতে মানবাত্মার মিরাজ হয় অথবা জীবাত্মা দুর্বল হলে মানবাত্মার মিরাজ সংঘটিত হয়। নূরে মুহাম্মদী (সা.) হচ্ছেন সৃষ্টির আদি নূর, যাবতীয় সৃষ্টির অন্তর্নিহিত সত্তাসার। প্রিয়নবী (সা.) হচ্ছেন নূরুন আলা নূর। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব (৫:১৫)। তাছাড়া হাদিস শরিফে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, আনা মিন নূরিল্লাহ, অ কুল্লে শাইয়িম মিন নূরী। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর হতে আর সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর হতে। সুতরাং পবিত্র কোরআন ও কোরআন সমর্থিত সহি হাদিসের আলোকে প্রিয়নবী (সা.) এর মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয় সাপেক্ষে মিরাজের গূঢ়তত্ত্ব ও রহস্য উন্মোচন করার কাজে ব্রত হওয়া প্রত্যেক ইসলামী দার্শনিকের একান্ত কর্তব্য