Saturday, 25 October 2014

উপমহাদেশে কট্টর ওয়াহাবিজমের দ্বিতীয় মন্ত্রগুরুর মৃত্যু


দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের দোসর এবং অসংখ্য ইহুদি হত্যাকারী আইকম্যানকে যখন পরবর্তীকালে ইসরায়েলের গোয়েন্দারা পলাতক অবস্থা থেকে ধরে এনে প্রাণদণ্ড দেয়, তখন লন্ডনের একটি দৈনিক মন্তব্য করেছিল, 'আইকম্যানের মৃত্যুতে শুধু একজন মানবতাদ্রোহীর নয়, ইউরোপে অ্যান্টি সেমেটিক বর্বরতার একজন মন্ত্রগুরুর মৃত্যু হলো।' আইকম্যানের মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং জল্লাদ ইয়াহিয়ার গণহত্যার দোসর হিসেবে ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত গোলাম আযমের মৃত্যুর (২৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার) কিছু মিল রয়েছে। গোলাম আযমের মৃত্যুতে যে শুধু একজন যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাদ্রোহীর মৃত্যু হলো তা নয়, তার মৃত্যুতে উপমহাদেশে কট্টর ওয়াহাবিজমের দ্বিতীয় মন্ত্রগুরুর মৃত্যু হলো।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসি জার্মানি পরাজিত হলে বিচার ও দণ্ড এড়ানোর জন্য আইকম্যান বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য কোনো দেশ রাজি ছিল না। ফলে নিজের নাম-পরিচয় মুছে ফেলে ছদ্মনাম ও ছদ্মপরিচয়ে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশে লুকিয়ে দীর্ঘকাল বসবাস করেছেন। ফলে তাকে খুঁজে বের করতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের দীর্ঘ কয়েক বছর লেগেছিল। তারা তাকে গোপনে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে যায় এবং প্রাণদণ্ড দেয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর গোলাম আযমও আইকম্যানের মতো বিদেশে পালিয়ে যান। কিন্তু তাকে আশ্রয়দানের মতো দেশ ছিল। যেমন পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরও দু'একটি দেশ। ফলে তাকে নাম-পরিচয় বদল করে পালিয়ে থাকতে হয়নি, বরং পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছেন এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তার আঁতুড়ঘরেই ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছেন।

আইকম্যানের মতো গোলাম আযমকে বিদেশ থেকে ধরে এনে বিচার করা ও দণ্ডদানের চেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সরকার করেনি। তিনি আইকম্যানের চেয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাকে পরম আদরে পাকিস্তানের পাসপোর্টসহ বাংলাদেশে আসতে দেন এবং দেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে পুনর্বাসিত করেন। গোলাম আযম জামায়াতের আমির হিসেবে দ্রুত দলটিকে সংগঠিত করেন এবং প্রথমে সামরিক সরকার ও পরে বিএনপির সহায়তায় দেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশে সশস্ত্র ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করে জামায়াত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে তারা পবিত্র ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসের রাজনীতির বিস্তার ঘটায়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য গোলাম আযম বা জামায়াত আজ পর্যন্ত জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হননি। বরং প্রচার ও প্রোপাগান্ডার জোরে এই অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

পৃথিবীর ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। দেশটির স্বাধীন অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে না এবং তার স্বাধীনতা যুদ্ধের শত্রুতা করেছে, তারা বাংলা স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার হয় এবং ক্ষমতায় প্রধান পার্টনার বিএনপিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে মূলত জামায়াতি এজেন্ডা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। এই এজেন্ডা ইসলামের এজেন্ডা নয়। সৌদি রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসারিত কট্টর ওয়াহাবিজমের এজেন্ডা। উপমহাদেশে এই ওয়াহাবিজমের প্রথম রাজনৈতিক মন্ত্রগুরু মাওলানা আবুল আলা মওদুদী। দ্বিতীয় মন্ত্রগুরু গোলাম আযম।

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। এমনকি ইসলামের বিধিবিধানের ব্যাখ্যা ও কোরআনের তাফসির রচনায় অত্যন্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেখিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি সৌদি বাদশাদের অর্থানুকূল্যে কিতাব লিখতে গিয়ে ওয়াহাবিজমে দীক্ষা নেন এবং ওয়াহাবিজমের উগ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিয়া, আহমদিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়কে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে তাদের 'কতল' করা জায়েজ বলে অভিমত প্রকাশ করেন।

মাওলানা মওদুদীর প্ররোচনাতেই পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে 'গ্রেট আহমদিয়া কিলিং' শুরু হয়েছিল এবং তাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ৫০ হাজার মুসলমান নিহত হয়। লাহোর হাইকোর্ট মাওলানা মওদুদীর বিচারপূর্বক প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। সৌদি বাদশার হস্তক্ষেপে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে মাওলানা মওদুদী নিজের জীবন রক্ষা করেন।

পাকিস্তান আমলের গোড়াতে বাংলাদেশে বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীতে কোনো বাঙালি সদস্য ছিল না। ঢাকার ১০৬, নওয়াবপুর রোডে ছিল জামায়াতের অফিস এবং একজন পাঞ্জাবি ছিলেন জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির। বরিশালের মাওলানা আবদুর রহিম ছিলেন সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের প্রথম বাঙালি নেতা এবং পরে তিনি জামায়াতের আমির হন। তিনি একজন ভদ্র, অমায়িক এবং ইসলামী শাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মওদুদীর মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও উগ্র ওয়াহাবিজমের অনুসারী ছিলেন না। তিনি মওদুদীর বহু গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন এবং বরিশাল থেকেই জামায়াতের প্রথম সাপ্তাহিক মুখপত্র 'তানজিম' প্রকাশ করেন।

গোলাম আযমকে তিনিই জামায়াত দলে রিত্রুক্রট করেন। গোলাম আযম মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম নন। তিনি ইংরেজি শিক্ষিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুসলিম লীগ পরিবারে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। জামায়াতে যোগ দিয়ে তিনি অতি শিগগিরই কট্টর মওদুদীবাদী হয়ে ওঠেন। মাওলানা আবদুর রহিমের সঙ্গে তার মতপার্থক্য শুরু হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় বিশ্বাসী থাকলেও মাওলানা আবদুর রহিম পাকিস্তানের হানাদারদের বর্বর গণহত্যার দোসর হতে রাজি ছিলেন না। তবু তাকেও পাকিস্তানে পালাতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকার কথা জেনে বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করেন। তিনি দেশে ফিরে এসে জামায়াত ত্যাগ করে সম্ভবত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন।

এই দল গঠনের আগেই তাকে জামায়াতের আমির পদ থেকে অপসারণ করা হয়। শোনা যায়, গোলাম আযমই চক্রান্ত করে মাওলানা আবদুর রহিমকে জামায়াতের আমির পদ থেকে অপসারণ করেন এবং নিজে আমির নির্বাচিত হন। তিনি যাদের জামায়াতে রিত্রুক্রট করেন, তাদের মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন। বর্তমানে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারে সোপর্দ অথবা দণ্ডিত সব জামায়াত নেতাই ছিলেন গোলাম আযমের অনুসারী। এদের নিয়ে গোলাম আযম জামায়াতকে একটি কট্টরপন্থি দল হিসেবে গড়ে তোলেন। সৌদি আরবের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য দ্বারা জামায়াত শক্তিশালী হয় এবং ওয়াহাবিজমের মধ্যযুগীয় অনুশাসন ও উগ্রতা জামায়াতের মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের নাম ভাঙালেও এই মূলনীতির সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের সম্পর্ক খুব কমই।

গোলাম আযম খুব জ্ঞানী পণ্ডিত ছিলেন না। তবু জামায়াত নেতা হিসেবে দু'চারটি বই লিখেছেন। তাতে ইসলামের চর্চা নেই। আছে ইসলামের নামে ওয়াহাবিজম ও মওদুদীবাদের চর্চা। আমার একটি ধারণা সঠিক কিনা জানি না, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামীর মতো মানবতাবোধহীন কট্টরপন্থিদের নিয়ে গোলাম আযম জামায়াতের নেতৃত্বে না থাকতেন, বরং মাওলানা আবদুর রহিম ও তার মতো তুলনামূলক উদারপন্থি নেতারা নেতৃত্বে থাকতেন, তাহলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা চালালেও জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় হানাদারদের গণহত্যার বর্বরতায় সরাসরি দোসরের ভূমিকা গ্রহণ করত না। তখন গভর্নর হাউসে টিক্কা খান, রাও ফরমান আলিদের সঙ্গে গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়নে গোলাম আযমের ঘন ঘন বৈঠক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে জামায়াতের বিভিন্ন ঘোষণা ও বিজ্ঞপ্তি (যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে) দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি আইকম্যান মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গোলাম আযমের অপরাধ তার চেয়ে কম ছিল না।

কিন্তু আইকম্যানের চেয়ে গোলাম আযম সৌভাগ্যবান। আইকম্যানকে বিদেশ থেকে ধরে এনে ইসরায়েল সরকার ফাঁসি দিয়েছিল। গোলাম আযমকে বিদেশে পলাতক অবস্থা থেকে ধরে এনে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বিচার ও দণ্ড দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করেনি। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারেও তিনি প্রাণদণ্ডাদেশ থেকে বেঁচে গেছেন। ৯০ বছরের কারাদণ্ড লাভ করেছেন। এই দণ্ডভোগের সময়েই বার্ধক্যজনিত কারণে (৯২ বছর) তার মৃত্যু হলো। তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এই যে, তিনি এত কিছু করেও মানুষের আদালতের দণ্ড এড়াতে পারেননি। ইতিহাসের দণ্ড এড়াবেন সে সম্ভাবনাও নেই।

গোলাম আযম ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন না। কোনো মহৎ কাজের জন্য নয়, নিজের কৃতকর্মের জন্যই তিনি আইকম্যানের মতোই মানুষের স্মরণে থাকবেন এবং সমালোচনার পাত্র হবেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও তার বুদ্ধিজীবী সহকর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় যে গণআদালত বসেছিল, সেই আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডদানের সুপারিশ করেছিলেন। তার মৃত্যুদণ্ড হয়নি, কিন্তু আদালতের বিচারে ৯০ বছরের দণ্ডাদেশ পেতে হয়েছে। গণআদালতের বিচারের সময়েই দেখা গিয়েছিল, দেশব্যাপী তার বিরুদ্ধে কী বিশাল গণধিক্কার। তিনি '৭১-এর সব যুদ্ধাপরাধের যেন একমাত্র প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

গোলাম আযম চলে গেলেন। কিন্তু তার রাজনীতির অভিশপ্ত লেগাসি থেকে জামায়াত কি মুক্ত হতে পারবে? যদি পারে তাহলে জামায়াতের জন্য ভালো এবং গোলাম আযমের জন্যও ভালো। নইলে জামায়াত যেমন গণনিন্দার অভিশাপ থেকে কোনোদিন মুক্ত হতে পারবে না, তেমনি গোলাম আযমও মৃত্যুর পরেও ইতিহাসের দণ্ডাদেশ ভোগ করতে থাকবেন।

# আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আরেকটু সুন্দর বাংলাদেশ 

‘রাজাকারকুল’ শিরোমণি গোলাম আযম মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশের সঙ্গে আমার এখন যোগাযোগের মূল মাধ্যম অনলাইন দৈনিক ও ফেসবুক। কাজেই আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় টাইমলাইনে বিভিন্ন বয়সী ‘ফেসবুক বন্ধুদের’ কাছ থেকে বিভিন্ন মাত্রার উচ্ছ্বাস দেখতে পাচ্ছি।পড়াশোনা অনেক বেশি করেছেন, চিন্তাভাবনা একটু গভীরভাবে করেন, বয়সও একটু বেশি– এ রকম কেউ কেউ অবশ্য টেলিভিশনের টক শো আর ফেসবুক পেইজে দেশ ও জাতিকে পরামর্শ দিয়েছেন উচ্ছ্বাসের মাত্রা যেন খুব বেশি না হয়। আশেপাশে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না কেউ ওনাদের কথা শুনছে। নিজের চেয়ে কমবয়সীদের কখনও উপদেশ দিতে নেই! পরিবারের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত, বুড়ো, খিটখিটে আর সবসময় উপদেশ দেওয়া সদস্যটিকে কেউ পছন্দ করে?

১৯৭১ সালের ‘ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী’ গোলাম আযম ২০১৪তে এসে ‘ব্যক্তি গোলাম আযম’কে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ১৯৭১ সালে ঘটা যুদ্ধাপরাধের প্রতীক। তিনি হয়ে উঠেছিলেন নৃশংসতার প্রতীক। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ১৯৭৫ সালের পরে দশকের পর দশক ধরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের ঔদ্ধত্য ও আস্ফালনের প্রতীক।

শুধু তাই নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি– জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র– এর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। আমাদের জাতীয় জীবনের পুঞ্জীভূত ঘৃণার সর্বশেষ গন্তব্য সবসময়ই ছিলেন গোলাম আযম।

কীভাবে রংপুর কারমাইকেল কলেজের একজন প্রভাষক বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন? শুধুই কি একাত্তরে রাখা তার ভূমিকার জন্য? একদমই নয়! পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার যে কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন এই গোলাম আযম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এদেরকে এক কথায় বলা হয় জামায়াতে ইসলামী– সেই দল যেটি যুদ্ধাপরাধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অংশ নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে নিষিদ্ধ ছিল।

পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদের আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাবেক এই মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য দিতে হয়েছে গোটা জাতিকে। এখনও দিতে হচ্ছে, যদিও আমরা জানি আর খুব বেশিদিন দিতে হবে না। বিচার শুরু হয়েছে, বিচার চলবে।

এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়াটা কিন্তু খুব বেশি সোজা ছিল না। এখনকার বাংলাদেশ আর আশির দশকের বাংলাদেশে অনেক তফাত। একাত্তরে গোলাম আযম কী বলেছিলেন, কী করেছিলেন সেসব এখন স্কুলের বাচ্চাদেরও দাঁড়ি-কমাসহ মুখস্ত। স্বাধীনতার পর থেকে তার নেতৃত্বে কী করে একসময়কার নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামীকে আবার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে তারা আবারও সংগঠিত হওয়া শুরু করে আর বিপুল অর্থের মালিক হয় তা নিয়ে অন্তত শ’খানেকের উপরে লেখালেখি অনলাইনে পাওয়া যায় (বিশ্বাস না হলে গুগল বা পিপীলিকা করে দেখতে পারেন!)।

কাজেই এই লেখায় সেই স্মৃতিচারণ করব না। আমি শুধু অল্প কথায় বলব কীভাবে কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়েছিল। সাদা চোখে মনে হতে পারে যে, এই শেষ পেরেকটি হল গোলাম আযমের অপরাধ আদালতেে প্রমাণ করা। কিন্তু এর দার্শনিক গভীরতা অনেক বেশি। ২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানূভূতিশীল মানুষদের (একই রকম দুর্বৃত্ত মানসিকতার কারণেই হোক কিংবা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি প্যাথলজিক্যাল ঘৃণা আর উন্নাসিকতার কারণেই হোক) কিছু খুব মজার মজার যুক্তি ছিল। তারা বলত–‘‘এতদিন কোনো বিচারের কথা শুনিনি, চল্লিশ বছর পরে করার কী দরকার”,কিংবা “সবকিছু আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র”,কিংবা “ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ”,“কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না”,“স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না” ইত্যাদি।

কিন্তু আদালতের রায়ে (এই বিচারকদের সবার কাজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেড়শ বছরের আশেপাশে হবে) সন্দেহের উর্ধ্বে গোলাম আযমের রায় প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই স্কুলের বাচ্চারাও এখন তাদের একটা প্রশ্নই করবে–“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু তোমাদের দামি দামি উকিলরা সেটি প্রমাণ করতে পারল না কেন বাপু? সুযোগ তো দেওয়া হয়েছিল!”

আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণের কারিগরিভাবে জটিল এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর (যুদ্ধাপরাধের কারণে প্রথম ফাঁসিটি কার্যকর হয়েছিল ২০১৩ সালের একই দিনে, কী কাকতাল),যখন প্রসিকিউশন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়। তার বিরুদ্ধে মোট বায়ান্নটি অভিযোগ ছিল যা শুধু পড়তেই সময় লেগেছিল পাঁচ দিন!

যারা মনে করে আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো বিচারকাজ হয় না, গণভবন থেকে পাঠানো প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনার গায়েবি ইশারায় ওখানে সবকিছু হয়, তাদের জানানো দরকার– অভিযোগ দাখিল করা থেকে শুরু করে অভিযোগপত্র নিয়ে শুনানির আগ পর্যন্ত চারদিন দীর্ঘ যুক্তিতর্ক চলেছিল দুই পক্ষের মধ্যে, শুধুমাত্র অভিযোগপত্রের লেখার স্টাইল আইন অনুযায়ী নিখুঁত হয়েছিল কিনা ও গোলাম আযম এ সময়টিতে জামিন পাওয়ার যোগ্য কিনা এ বিষয়ে। পত্রিকায় ও ব্লগে এ নিয়ে যে তথ্য লিপিবদ্ধ আছে তাতে কোনো গায়েবি ইশারার নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

অনেকেই হতাশ কেন গোলাম আযমের জীবদ্দশায় আপিলের কাজটি শেষ করা গেল না। কেউ কেউ মনে করেন আপিল শেষ করলে আরও কঠোর সাজা হতে পারত। কিন্তু মূল বিচারটি শেষ করতে আদালতকে অনেক ঝক্কি সামলাতে হয়েছে। ২০০৯ সালে যুদ্ধপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে যারা এটি অনুুসরণ করছেন, সবাই একমত হবেন যে, জামায়াতের আইনজীবীরা সময়ক্ষেপণের ব্যাপারে ‘অবিশ্বাস্য’ সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

এর একটা উদাহরণ পাওয়া যায় এই অভিযোগ গঠন পর্যায়ে। জামায়াতের আইনজীবী গোলাম আযমের খাবার-দাবারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে দরখাস্ত দেন আর বার বার আবেদন করতে থাকেন। আদালত যতই তাদের বুঝান যে, এটি আইজি প্রিজনের অধীনে, তারা মানতে চান না। তারা আদালতকে বলেন এখানে নাক গলাতে; কখনও কখনও রীতিমতো চেঁচামেচি করেন।

আদালত এক পর্যায়ে তাদের বলেন ঠাণ্ডা মাথায় নিয়মটি বুঝতে এবং প্রথমে যথাযথ প্রক্রিয়া সেরে সবার শেষ আশ্রয় হিসেবে আদালতে আসতে। ফলাফল কী দাঁড়াল? কয়েক দিনে বেশ কিছু সেশন অভিযোগপত্র পড়ে শুনানো যায়নি। এর মধ্যেই একদিন (১৩ মার্চ, ২০১২) নিজেরাই (বিএনপি-জামায়াত) মহাসমাবেশ ডেকে নিজেরাই (জামায়াতের আইনজীবীরা) আগের দিন নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে আদালতে অনুপস্থিত ছিলেন। প্রসিকিউশন মামলা চালাতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিচারকরা বিবাদীর আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে সেটি করতে রাজি হননি। আবারও একাধিক সেশন নষ্ট। পরের দিন তারা এসে আবার এক সপ্তাহ সময় চাইলেন; কারণ একজন অনুপস্থিত আর অন্যজন অসুস্থ!

পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে যেসব বড় বড় বিশেষজ্ঞ কোনো রকম সুনির্দিষ্ট উদাহরণ ছাড়াই অন্ধের মতো লিখে যান বিচার “স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকমানের” হচ্ছে না, তারা কেন কেউ কখনও এই সময়ক্ষেপণ নিয়ে কিছু লিখেননি সেটি আমার কাছে এখনও একটি রহস্য।

জামায়াত কী করে তেতাল্লিশ বছর ধরে গোলাম আযমের অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে তার সারাংশ পাওয়া যায় আদালতে তাদের আইনজীবী কর্তৃক অভিযোগ গঠনের বিরোধিতা করে দেওয়া বক্তব্য থেকে। জন্ম থেকে শুরু করে গোলাম আযমের কাছে কবে কোন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দোয়া নিতে এসেছিলেন সব তারা উল্লেখ করেছেন। খালি ভুলে গেছেন বলতে যে, গোলাম আযম ভাষা আন্দোলনকে ‘ভুল’ আন্দোলন হিসেবে আখ্যাদানকারী, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী, ১৯৭১ সালে রাজাকারদের বেতনের রশিদে স্বাক্ষরদানকারী ইত্যাদি।

তেতাল্লিশ বছর ধরেই জামায়াত ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের কাজের একটি ক্ল্যাসিক প্যাটার্ন ছিল এই অর্ধসত্য পরিবেশনা। একটা সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিই। জামায়াতের আইনজীবীরা তাদের বক্তব্যের চব্বিশ নম্বর অনুচ্ছেদে বলেছেন: ১৯৭২ সালের সংবিধান ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতে দলগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল বলেজামায়াত নিষিদ্ধ ছিল।

এটি হল মিথ্যাকে সত্যের সঙ্গে মিশিয়ে উপস্থাপনের জামায়াতী চর্চা। ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের আদর্শের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। শুধুমাত্র সেই সব দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল যারা একটিমাত্র ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকে রাষ্ট্রপরিচালনায় চাপিয়ে দিতে চায়। এর কারণ কী?

এর কারণ হল মুক্তিযুদ্ধ কেবল মুসলমানরা করেনি। বাংলাদেশে কেবল মুসলমানরা থাকে না। দেশকে কেবল মুসলমানরা ভালোবাসে না, বাকিরাও বাসে। কতটুকু বাসে? ঠিক যতটুকু মুসলমানরা ভালোবাসে ঠিক ততটুকুই অন্য বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মানুষরা বাসে। কাজেই রাষ্ট্র কখনও একটি ধর্মকে কম গুরুত্ব আর অন্য ধর্মকে বেশি গুরুত্ব দিবে না। সব ধর্ম পাবে সমান মর্যাদা।
ঠিক এই জায়গাতেই জামায়াতে ইসলামী সাধারণ মানুষের আবেগের জায়গা থেকে দূরে ছিল, এখনও আছে। কাজেই এক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সংবিধানে আর জামায়াত এবং এ রকম আরও কিছু দল তার ফল ভোগ করেছিল। তারা কোন ধর্মকে ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল সেটি বিষয় নয়, বিষয় হল তারা একটিমাত্র ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাষ্ট্রপরিচালনায় আনতে চেয়েছিল।
এভাবে দশকের পর দশক জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে গেছে। কখনও কখনও তারা সাময়িকভাবে সফলও হয়েছে। এটি ছিল আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি ভুল বুদবুদ। গোলাম আযম আদালতে যখন দোষী প্রমাণিত হন, তখন এই বুদবুদটি চিরতরে ফেটে গেছে। আদালতে প্রমাণিত হয়েছে জামায়াতের সবচেয়ে বড় যে তাত্ত্বিক তিনি নিজেই একজন ‘দুর্বৃত্ত’ । এখানেই জামায়াতের আদর্শিক পরাজয়।

আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিভিন্ন মামলার স্বাক্ষ্যগুলো ইতিহাসের আকর। কত গুরুত্বপূর্ণ নতুন নতুন তথ্য প্রসিকিউটরদের গবেষণা আর সাক্ষীদের প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে বের হয়ে এসেছে সেটি হিসেব করে শেষ করা যাবে না। প্রায়ই এটি সাক্ষীদের একাত্তরের শোকের আবহে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের আইনজীবীদের জেরার নামে সময়ক্ষেপণের আপ্রাণ চেষ্টা (তারা ঘন ঘন যেটি করতেন সেটি হল সাক্ষীদেরকে এক একটি জেলা ধরে ধরে কোন জেলার শান্তি কমিটির নেতার নাম কী জিজ্ঞেস করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতেন। বিসিএস পরীক্ষাতেও মনে হয় এত জেলার তথ্য মুখস্ত করা লাগে না)!

আরেকটি অদ্ভূত ব্যাপার হল, হাজার হাজার সাক্ষীর নামের তালিকা দেওয়া। প্রমাণের দায়ভার তাদের উপর না থাকা সত্ত্বেও (আমাদের আইন অনুযায়ী এটি প্রমাণের দায়ভার রাষ্ট্রের) ঠিক এই হাজার হাজার লোক কীভাবে গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধ করেননি সেটি প্রমাণ করবেন তা যখন জিজ্ঞেস করা হত, তখন আর কোনো উত্তর পাওয়া যেত না। আমি নিশ্চিত, আগামী দশকগুলোতে আমাদের ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের আন্ডারগ্র্যাড, মাস্টার্স আর পিএইচ-ডির গবেষণার জন্য প্রথম পছন্দের বিষয় হবে এই যুদ্ধাপরাধের মামলার শুনানিগুলো।
আমি আরও নিশ্চিত, এই আবেগ আর সংকল্প কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। স্বাধীনতার পর পর যারা চলচ্চিত্র বানানো শিখেছেন তাদের সবার যেমন সাধারণ লক্ষ্য হল মুক্তিযুদ্ধের উপর সিনেমা বানানো, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সে রকম আগামী দিনের চলচ্চিত্রের ছাত্রছাত্রীদেরও আগ্রহের জায়গা হবে কত ঝুঁকি, হুমকি আর ত্যাগের বিনিময়ে এই বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে কষ্ট করে তাদের কাজ করে গেছেন, পর্দার পিছনের সেই গল্পগুলোর চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া।

আমরা কেবল পত্রিকায় প্রসিকিউটরদের নামে কত অভিযোগ শুনে গেছি। কিন্তু যাদের আমরা মাপি পত্রিকায় ছাপা হওয়া খারাপ খবরের কলাম-ইঞ্চি দিয়ে, তাদের নিজেদের কাছে এই কাজের দৈর্ঘ্য ছিল তাদের গোটা জীবন! আমরা আমাদের মতো করে তাদের নিয়ে ভালোমন্দ ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেদের কাজে ফেরত গেছি। কিন্তু এই মানুষদের স্বাভাবিক জীবন, দোকানে যাওয়া, পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া– এই সবই জামায়াতের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের ভয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।

তাঁদের ব্যক্তিজীবন থেমে গেলেও মামলার কাজ বন্ধ করেননি। আর তার ফল হিসেবে তাঁরা দ্ব্যর্থহীনভাবে অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে পেরেছেন। এই গভীর আত্মত্যাগ, এই ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব, মামলার শুনানির টানটান মুহূর্তগুলো যদি পর্দায় বলার মতো গল্প না হয়, তাহলে আর কী হবে?
এক গোলাম আযম থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। বাংলাদেশ এখন আগের চেয়ে আরেকটু সুন্দর! কিন্তু আরও অনেক (শতাংশের হিসেবে হয়তো এক কী দুই শতাংশ কিন্তু এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সেটিও কম নয়) মানুষের মধ্যে গোলাম আযমের ভূত রয়ে গেছে। জামায়াত রাজনৈতিকভাবে হেরে গেছে অনেক দিন আগেই। গড়ে প্রতি নির্বাচনে তাদের নিজস্ব ভোট থাকে সবসময়ই ৫ শতাংশের কম। বাম দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে তারাই হত দেশের সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া দল। কাজেই তারা বা তাদের অসুস্থ আদর্শ রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
সেটি আমার মাথাব্যথাও নয়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হবে এটি প্রতিষ্ঠা করা যে, এটি রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের ব্যাপার নয়। এটি সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামত প্রতিষ্ঠার ব্যাপার নয়। এটি হল ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপার, সত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপার। সেই সত্যটি কী?

যতদিন এই গোলাম আযমের ভূতগুলোর সঙ্গে আমাদের দেখা হবে, আমরা জানিয়ে দিব– “এই যে শোন, গোলাম আযমের ভূত, তোমাকে বলছি! তুমি ছিলে একজন ঘৃণিত অপরাধী, ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলনকে ‘ভুল’ আন্দোলন বলা একজন মানুষ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত একজন প্রার্থী, ১৯৭১ সালে একজন দুর্বৃত্ত, গণহত্যার পরিকল্পনাকারী, নিযার্তন-লুটতরাজের জন্য ব্যবহৃত কোলাবরেটরদেরর সবচেয়ে বড় একজন নেতা, একাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ফেরারি, আশির দশকে সামরিক প্রশাসকের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে পূর্নবাসিত হওয়া আর যুদ্ধাপরাধের দায় উদ্ধতভাবে অস্বীকার করা একজন বোনাস জীবন পাওয়া মানুষ, আর সবশেষে আদালতে অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়া একজন বিবাদী। তুমি আইনের চোখে, ইতিহাসের পাতায় আর সময়ের কাছে পরাজিত। তোমার বিকৃত বিভ্রান্ত আদর্শসহ তুমি নিপাত যাও। তোমাকে ধিক্কার! ধিক্কার!! ধিক্কার!!!”
আমাদের জাতীয় জীবনের পুঞ্জীভূত ঘৃণার সর্বশেষ গন্তব্য সবসময়ই ছিলেন গোলাম আযম
# ওমর শেহাব: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচ-ডি অধ্যয়নরত, সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটিজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।