উপমহাদেশে কট্টর ওয়াহাবিজমের দ্বিতীয় মন্ত্রগুরুর মৃত্যু
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের দোসর এবং অসংখ্য ইহুদি হত্যাকারী আইকম্যানকে যখন পরবর্তীকালে ইসরায়েলের গোয়েন্দারা পলাতক অবস্থা থেকে ধরে এনে প্রাণদণ্ড দেয়, তখন লন্ডনের একটি দৈনিক মন্তব্য করেছিল, 'আইকম্যানের মৃত্যুতে শুধু একজন মানবতাদ্রোহীর নয়, ইউরোপে অ্যান্টি সেমেটিক বর্বরতার একজন মন্ত্রগুরুর মৃত্যু হলো।' আইকম্যানের মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং জল্লাদ ইয়াহিয়ার গণহত্যার দোসর হিসেবে ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত গোলাম আযমের মৃত্যুর (২৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার) কিছু মিল রয়েছে। গোলাম আযমের মৃত্যুতে যে শুধু একজন যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাদ্রোহীর মৃত্যু হলো তা নয়, তার মৃত্যুতে উপমহাদেশে কট্টর ওয়াহাবিজমের দ্বিতীয় মন্ত্রগুরুর মৃত্যু হলো।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসি জার্মানি পরাজিত হলে বিচার ও দণ্ড এড়ানোর জন্য আইকম্যান বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য কোনো দেশ রাজি ছিল না। ফলে নিজের নাম-পরিচয় মুছে ফেলে ছদ্মনাম ও ছদ্মপরিচয়ে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশে লুকিয়ে দীর্ঘকাল বসবাস করেছেন। ফলে তাকে খুঁজে বের করতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের দীর্ঘ কয়েক বছর লেগেছিল। তারা তাকে গোপনে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে যায় এবং প্রাণদণ্ড দেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর গোলাম আযমও আইকম্যানের মতো বিদেশে পালিয়ে যান। কিন্তু তাকে আশ্রয়দানের মতো দেশ ছিল। যেমন পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরও দু'একটি দেশ। ফলে তাকে নাম-পরিচয় বদল করে পালিয়ে থাকতে হয়নি, বরং পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছেন এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তার আঁতুড়ঘরেই ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
আইকম্যানের মতো গোলাম আযমকে বিদেশ থেকে ধরে এনে বিচার করা ও দণ্ডদানের চেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সরকার করেনি। তিনি আইকম্যানের চেয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাকে পরম আদরে পাকিস্তানের পাসপোর্টসহ বাংলাদেশে আসতে দেন এবং দেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে পুনর্বাসিত করেন। গোলাম আযম জামায়াতের আমির হিসেবে দ্রুত দলটিকে সংগঠিত করেন এবং প্রথমে সামরিক সরকার ও পরে বিএনপির সহায়তায় দেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে সশস্ত্র ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করে জামায়াত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে তারা পবিত্র ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসের রাজনীতির বিস্তার ঘটায়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য গোলাম আযম বা জামায়াত আজ পর্যন্ত জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হননি। বরং প্রচার ও প্রোপাগান্ডার জোরে এই অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। দেশটির স্বাধীন অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে না এবং তার স্বাধীনতা যুদ্ধের শত্রুতা করেছে, তারা বাংলা স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার হয় এবং ক্ষমতায় প্রধান পার্টনার বিএনপিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে মূলত জামায়াতি এজেন্ডা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। এই এজেন্ডা ইসলামের এজেন্ডা নয়। সৌদি রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসারিত কট্টর ওয়াহাবিজমের এজেন্ডা। উপমহাদেশে এই ওয়াহাবিজমের প্রথম রাজনৈতিক মন্ত্রগুরু মাওলানা আবুল আলা মওদুদী। দ্বিতীয় মন্ত্রগুরু গোলাম আযম।
মাওলানা আবুল আলা মওদুদী মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। এমনকি ইসলামের বিধিবিধানের ব্যাখ্যা ও কোরআনের তাফসির রচনায় অত্যন্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেখিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি সৌদি বাদশাদের অর্থানুকূল্যে কিতাব লিখতে গিয়ে ওয়াহাবিজমে দীক্ষা নেন এবং ওয়াহাবিজমের উগ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিয়া, আহমদিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়কে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে তাদের 'কতল' করা জায়েজ বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
মাওলানা মওদুদীর প্ররোচনাতেই পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে 'গ্রেট আহমদিয়া কিলিং' শুরু হয়েছিল এবং তাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ৫০ হাজার মুসলমান নিহত হয়। লাহোর হাইকোর্ট মাওলানা মওদুদীর বিচারপূর্বক প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। সৌদি বাদশার হস্তক্ষেপে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে মাওলানা মওদুদী নিজের জীবন রক্ষা করেন।
পাকিস্তান আমলের গোড়াতে বাংলাদেশে বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীতে কোনো বাঙালি সদস্য ছিল না। ঢাকার ১০৬, নওয়াবপুর রোডে ছিল জামায়াতের অফিস এবং একজন পাঞ্জাবি ছিলেন জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির। বরিশালের মাওলানা আবদুর রহিম ছিলেন সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের প্রথম বাঙালি নেতা এবং পরে তিনি জামায়াতের আমির হন। তিনি একজন ভদ্র, অমায়িক এবং ইসলামী শাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মওদুদীর মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও উগ্র ওয়াহাবিজমের অনুসারী ছিলেন না। তিনি মওদুদীর বহু গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন এবং বরিশাল থেকেই জামায়াতের প্রথম সাপ্তাহিক মুখপত্র 'তানজিম' প্রকাশ করেন।
গোলাম আযমকে তিনিই জামায়াত দলে রিত্রুক্রট করেন। গোলাম আযম মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম নন। তিনি ইংরেজি শিক্ষিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুসলিম লীগ পরিবারে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। জামায়াতে যোগ দিয়ে তিনি অতি শিগগিরই কট্টর মওদুদীবাদী হয়ে ওঠেন। মাওলানা আবদুর রহিমের সঙ্গে তার মতপার্থক্য শুরু হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় বিশ্বাসী থাকলেও মাওলানা আবদুর রহিম পাকিস্তানের হানাদারদের বর্বর গণহত্যার দোসর হতে রাজি ছিলেন না। তবু তাকেও পাকিস্তানে পালাতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকার কথা জেনে বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করেন। তিনি দেশে ফিরে এসে জামায়াত ত্যাগ করে সম্ভবত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন।
এই দল গঠনের আগেই তাকে জামায়াতের আমির পদ থেকে অপসারণ করা হয়। শোনা যায়, গোলাম আযমই চক্রান্ত করে মাওলানা আবদুর রহিমকে জামায়াতের আমির পদ থেকে অপসারণ করেন এবং নিজে আমির নির্বাচিত হন। তিনি যাদের জামায়াতে রিত্রুক্রট করেন, তাদের মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন। বর্তমানে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারে সোপর্দ অথবা দণ্ডিত সব জামায়াত নেতাই ছিলেন গোলাম আযমের অনুসারী। এদের নিয়ে গোলাম আযম জামায়াতকে একটি কট্টরপন্থি দল হিসেবে গড়ে তোলেন। সৌদি আরবের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য দ্বারা জামায়াত শক্তিশালী হয় এবং ওয়াহাবিজমের মধ্যযুগীয় অনুশাসন ও উগ্রতা জামায়াতের মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের নাম ভাঙালেও এই মূলনীতির সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের সম্পর্ক খুব কমই।
গোলাম আযম খুব জ্ঞানী পণ্ডিত ছিলেন না। তবু জামায়াত নেতা হিসেবে দু'চারটি বই লিখেছেন। তাতে ইসলামের চর্চা নেই। আছে ইসলামের নামে ওয়াহাবিজম ও মওদুদীবাদের চর্চা। আমার একটি ধারণা সঠিক কিনা জানি না, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামীর মতো মানবতাবোধহীন কট্টরপন্থিদের নিয়ে গোলাম আযম জামায়াতের নেতৃত্বে না থাকতেন, বরং মাওলানা আবদুর রহিম ও তার মতো তুলনামূলক উদারপন্থি নেতারা নেতৃত্বে থাকতেন, তাহলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা চালালেও জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় হানাদারদের গণহত্যার বর্বরতায় সরাসরি দোসরের ভূমিকা গ্রহণ করত না। তখন গভর্নর হাউসে টিক্কা খান, রাও ফরমান আলিদের সঙ্গে গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়নে গোলাম আযমের ঘন ঘন বৈঠক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে জামায়াতের বিভিন্ন ঘোষণা ও বিজ্ঞপ্তি (যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে) দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি আইকম্যান মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গোলাম আযমের অপরাধ তার চেয়ে কম ছিল না।
কিন্তু আইকম্যানের চেয়ে গোলাম আযম সৌভাগ্যবান। আইকম্যানকে বিদেশ থেকে ধরে এনে ইসরায়েল সরকার ফাঁসি দিয়েছিল। গোলাম আযমকে বিদেশে পলাতক অবস্থা থেকে ধরে এনে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বিচার ও দণ্ড দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করেনি। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারেও তিনি প্রাণদণ্ডাদেশ থেকে বেঁচে গেছেন। ৯০ বছরের কারাদণ্ড লাভ করেছেন। এই দণ্ডভোগের সময়েই বার্ধক্যজনিত কারণে (৯২ বছর) তার মৃত্যু হলো। তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এই যে, তিনি এত কিছু করেও মানুষের আদালতের দণ্ড এড়াতে পারেননি। ইতিহাসের দণ্ড এড়াবেন সে সম্ভাবনাও নেই।
গোলাম আযম ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন না। কোনো মহৎ কাজের জন্য নয়, নিজের কৃতকর্মের জন্যই তিনি আইকম্যানের মতোই মানুষের স্মরণে থাকবেন এবং সমালোচনার পাত্র হবেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও তার বুদ্ধিজীবী সহকর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় যে গণআদালত বসেছিল, সেই আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডদানের সুপারিশ করেছিলেন। তার মৃত্যুদণ্ড হয়নি, কিন্তু আদালতের বিচারে ৯০ বছরের দণ্ডাদেশ পেতে হয়েছে। গণআদালতের বিচারের সময়েই দেখা গিয়েছিল, দেশব্যাপী তার বিরুদ্ধে কী বিশাল গণধিক্কার। তিনি '৭১-এর সব যুদ্ধাপরাধের যেন একমাত্র প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
গোলাম আযম চলে গেলেন। কিন্তু তার রাজনীতির অভিশপ্ত লেগাসি থেকে জামায়াত কি মুক্ত হতে পারবে? যদি পারে তাহলে জামায়াতের জন্য ভালো এবং গোলাম আযমের জন্যও ভালো। নইলে জামায়াত যেমন গণনিন্দার অভিশাপ থেকে কোনোদিন মুক্ত হতে পারবে না, তেমনি গোলাম আযমও মৃত্যুর পরেও ইতিহাসের দণ্ডাদেশ ভোগ করতে থাকবেন।
# আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী