রাজনীতির ভাষা ও জনগণের ভাষা
রাজনীতি ড. রাশিদ আসকারী
অনেক ঢাক ঢাক গুড় গুড়-এর পর অবশেষে গর্জনশীল বিএনপি সামান্য বর্ষালো। ১৯ তারিখে একটা জাতীয় সমাবেশ ডেকে আপাতত ক্ষান্ত দিল। আর যে কর্মসূচিগুলো ঘোষিত হয়েছে, সেগুলো প্রধানত আত্মসংস্কারের মাঝেই সীমিত থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। একেই বলে বহারম্ভে লঘুক্রিয়া! ইংরেজিতে বলে much ado about nothing বিশ্বখ্যাত নাট্যকার শেক্সপীয়র এই নামে একটি কমেডিও লিখেছিলেন। সত্যিই বিষয়টির মধ্যে অনেক কৌতুকের উপাদান রয়েছে। বহারম্ভে বেশিরভাগ সময়ই লঘুক্রিয়া হয়। যেমন হলো ঈদোত্তর বিএনপির রাজনীতিতে। ঈদের আগে আন্দোলন নিয়ে বিএনপি যে হম্বিতম্বি দেখানো শুরু করেছিলো, তা হঠাত্ করেই যেনো চুপসে গেল। অবশ্য এতে বিএনপির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কতোটুকু লাভ-লোকসান হলো তা এ মুহূর্তে নির্ণয় না করা গেলেও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যে যে একটা বড়ো লাভ হলো তা সম্ভবত কেউই অস্বীকার করবে না। বিএনপির সুবোধ রূপ দেখে জাতীয় রাজনীতি থেকে একটা মস্ত স্নায়ুচাপ যেনো উবে গেছে। সেজন্যে বিএনপি নেত্রী একটা বিগ হ্যান্ড পাওয়ার যোগ্য।
তবে একটি গণতান্ত্রিক দেশে একটি সক্রিয় বিরোধী দল না থাকলে, কিংবা বিরোধী রাজনীতি না থাকলে এক ধরনের রাজনৈতিক অচলায়তন সৃষ্টি হতে পারে। সে অচলায়তনে আটকা পড়তে পারে প্রগতির চাকা। তাই সমাজের গতি বা বিকাশ যেমন ডায়ালেকটিক্সের মাধ্যমে হয়, রাজনীতির বিকাশও তেমনি ডায়ালেকিটক্সের মধ্য দিয়ে হয়। রাজনীতির বিপরীতে যদি প্রতি-রাজনীতি না থাকে, Cheeks and balances না থাকে, তবে গণতন্ত্র স্বৈরাচারে পর্যবসিত হতে পারে। বিএনপি কি সেই সহায়ক প্রতি-রাজনীতি করতে পারছে? রাজনীতির স্টিয়ারিং এখন সরকারের হাতে। গাড়ি চলছে সমান্তরালে। যথার্থ বিরোধী দলের অভাবে কিংবা ছায়া সরকারের অভাবে সরকারকে হয়তো ক্লাচ, ব্রেক তেমন একটা ব্যবহার করতে হচ্ছে না। ফলে গতি হয়তোবা বাড়ছে, কিন্তু যেকোনো সময় এ্যাক্সিডেন্টের সম্ভাবনা রয়েছে। সত্যিকার বিরোধী দলীয় রাজনীতি বাইপাস সড়ক কিংবা স্পিড ব্রেকারের মতো প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ দিয়ে চলমান যানটিকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছুতে সাহায্য করে। সম্ভাব্য দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচায়। তবে প্রয়োজনীয় স্পিড ব্রেকার দিয়ে চলমান, যান নিয়ন্ত্রণ করা আর গাছ কেটে কিংবা রেললাইন উপড়ে তা দুর্ঘটনা কবলিত করার চেষ্টা করা সমার্থক নয়।
বর্তমানে বিএনপি রাজনীতির তথা একটি সফল বিরোধী রাজনীতির ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো রাজনীতির সত্যিকার ভাষা বুঝতে না পারা। রাজনীতির ভাষা দেশ-কাল-পাত্র নির্ভর। একাত্তরে বঙ্গবন্ধৃু যে অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন, তা পালনের জন্যে পিকেটারের দরকার পড়েনি। বাসে আগুন দেয়ার দরকার পড়েনি। Civil Disobedience-এর যে কি শক্তি তা বঙ্গবন্ধুর মতো বড়োমাপের নেতাই কেবল বোঝাতে পেরেছিলেন। কারণ, তিনি রাজনীতির ভাষা বুঝতেন। জনগণের ভাষা বুঝতেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনেও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভাষা বুঝেছে এবং স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু, সাম্প্রতিককালে সরকার বিরোধী রাজনীতির যে চলমান ধারা, তাতে কি সত্যিকার জনভাষ্য উপলব্ধির কোনো লক্ষণ আছে? নাকি আছে কোনো তত্পরতা? রাজনীতিতে বিধ্বংসী/ আত্মধ্বংসী পোড়ামাটি নীতির প্রয়োগ একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর উন্নয়নশীল অর্থনীতির একটি দেশে ক্ষমতান্ধ হয়ে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগ কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। পূর্বাপর ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ এ দেশের রাজনীতিতে যে পোড়ামাটি নীতির প্রয়োগ হয়েছে, তার দায়ভার জামায়াত-নির্ভর বিএনপি কিংবা বিএনপি সমর্থিত জামায়াত কেউই এড়াতে পারবে না। এটা জনগণের ভাষা নয়। অনুল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া আমজনতা শান্তিকামী এবং উন্নয়ন-পিয়াসী। সন্ত্রাস ও সহিংসতার ভাষা দিয়ে তাদেরকে হয়তোবা তাত্ক্ষণিকভাবে বাধ্য করা যায়, কিন্তু জনগণকে স্থায়ীভাবে রাজনীতি সচেতন করতে হলে কিংবা আন্দোলনমুখী করতে হলে তাদের ভাষা বুঝতে হবে।
মিথ্যাচার ও নেতিবাচক রাজনীতি-চর্চার ধারা এ দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে অনেককাল বেশ সক্রিয় ছিলো এবং এখন আছে। নির্বাচন এলেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো-প্রপাগান্ডায় মুখর হয়ে উঠতো। বিএনপি-জামায়াত ভারত কার্ড ব্যবহার করতো। বলতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এ দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হবে। মসজিদে মসজিদে আজানের বদলে উধ্বনি শোনা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আওয়ামী লীগকেও হয়তো তার জবাবে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ডিয়া কার্ডের বিপরীতে পাকিস্তান কার্ড ব্যবহার করতে হতো। অবশ্য এখন এই ইন্ডিয়া কার্ড, পাকিস্তান কার্ডের বিষয়গুলো জনগণ তেমন গুরুত্ব দেয় না। আওয়ামী লীগের বিগত দু'দফা শাসনামলে ইন্ডিয়া কার্ডের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি, রাজনীতিতে পাক-আফগানপন্থিদের পরিহার করে। বিএনপিও পাকিস্তান কার্ডের অসারতা প্রমাণ করবে।
অন্দোলন জমাতে বিএনপির ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো—একুশ শতকের অধিকতর সচেতন, অর্থনৈতিক উন্নয়নকামী এক দেশ মানুষকে মোটিভেশনের জন্য বিএনপি এখনও সেই পুরনো ইন্ডিয়া কার্ডের ওপর নির্ভর করে বসে আছে। নতুন কোনো সৃষ্টিশীল স্ট্রাটেজি নিয়ে আসবে না। কর্পোরেট পুঁজির প্রভাবে বর্তমান সময়ের মানুষ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি মালিকানা আত্মকর্মসংস্থান প্রভৃতির সুযোগ বৃদ্ধির কারণে মানুষের আর্থিক অবস্থারও ক্রম-উন্নয়ন হচ্ছে। দারিদ্র্য, মঙ্গা প্রভৃতির মতো নিত্য-সহচর বিপর্যয়গুলো ক্রমাগত পিছু হটছে। শিক্ষার হার সম্প্রসারিত হচ্ছে। এককথায়, ধীরলয়ে হলেও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা অগ্রসরমান হচ্ছে। আর্থিক নিরাপত্তার সুযোগ একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষের দোরগোড়ায় পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। বিশ্বের 1.20 বিলিয়ন মানুষ যেখানে দৈনিক এক ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বাস করছে—সেখানে এরকম নিম্নতর আয়ের মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া গেলেও তার সংখ্যা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য হবে না। চলতি দশকে বেশ মোটা দাগে উন্নয়ন কাজ হয়েছে। কৃষিতে উন্নয়ন হয়েছে। সার ও কীটনাশকের দুষ্প্রাপ্যতা কমেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নিম্ন পেশা ও আয়ের মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ হয়েছে। বিদ্যুত্ উত্পাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রশস্ততর হয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনার মতো সামাজিক বিষয়গুলো বর্তমানে বিদ্যমান থাকলেও হাহাকার পর্যায়ে নেই। তাই সস্তা বুলি দিয়ে তাদের রাজনীতির মাঠে নামানো এখন আর সহজসাধ্য নয়।
তাই বলে মানুষ পদবাচ্য সামাজিক প্রাণীগুলোর রাজনীতি শূন্য হয়ে দেবতা কিংবা পশুর অবস্থানে উন্নীত বা অবনত হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। আদিগুরু এ্যারিস্টটল তো তাই বলে গেছেন। মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয় সমকালীন রাজনীতির ক্লেদ গায়ে না লাগানোর জন্যে। সত্যিকার উন্নয়নের রাজনীতির বাতাবরণ যদি সৃষ্টি হয়, তবে রাজনীতির মাঠেও জায়গার টানাটানি হবে। আজ একটি গঠনমূলক বিরোধী দলীয় রাজনীতির অভাবে যে গণতন্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, অসরকারি রাজনৈতিক দল-দলসমূহ সকলে কিংবা কেউ কেউ যদি একটি জনহিতৈষী প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পারে তাহলে বাসে আগুন দিয়ে হরতাল 'সফল' করতে হবে না। আন্দোলন স্বতস্ফূর্তভাবেই কাঙ্ক্ষিত গতি ও পরিণতি পাবে।
আমাদের রাজনীতির কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। অবশ্য প্রাপ্তিও অনেক। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের যতোটুকু প্রাপ্তি তার প্রায় পুরোটাই এসেছে আমাদের রাজনীতির হাত ধরে। অথচ সেই ঐতিহ্যবাহী কল্যাণ রাজনীতি আজ কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে পড়ে মরু-বেদুঈনদের ট্রাইবাল কোন্দলে পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার এতটাই অধঃপতিত যে, জাতীয় শোক দিবসের মতো একটি মর্মঘাতী বেদনাঘন মুহূর্তে সাড়ম্বরে মিথ্যে জন্মদিন পালনে লজ্জিত হই না। রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যদি সম্পর্ক এমনই হয়, জন্মদিন পালনকারীরা তাহলে শোক দিবস পালনকারীদের কাছে কতটুকু সহযোগিতা প্রত্যাশা করতে পারে?
রাজনীতির ভাষা কিংবা জনগণের ভাষা সরকারকেও বুঝতে হবে। সরকারের উদাসীনতায় ক্ষমতাধর গডফাদারদের দাপট অনেক জায়গায় শান্তিকামী নিরীহ মানুষদের সন্ত্রস্ত করলে জনগণের ভাষা নীরবে কাঁদবে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন উঠেছে— তার উপযুক্ত জবাব হবে একটি সম্প্রচার নীতিমালা কমিশন গঠন করে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সম্পৃক্ত করে তা প্রণয়ন করা। শুধু সম্প্রচার কেন, সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়েই নীতিমালা হবে, নীতিমালার আলোকেই আবর্তিত হবে উন্নয়ন কার্যক্রম। তবে তা অবশ্যই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। অস্বচ্ছতার ধোঁয়াশায় বাসা বাঁধবে বিরোধিতার জীবাণু আর জীবাণু-সংক্রমণ প্রাণঘাতী ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, রাজনীতির ভাষা ও জনগণের ভাষা বোঝা সরকার এবং বিরোধী দল/রাজনীতি উভয়ের জন্যেই কল্যাণকর।
লেখক: অধ্যাপক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক