হজ ও কোরবানির ত্যাগের এ সময় একসময়ের সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক ও সিরিয়ার মুসলমানদের শরণার্থী হয়ে আপনভূমি ত্যাগ করে ইউরোপীয় দেশে চলে যাওয়ার দৃশ্য মুসলিম-অমুসলিম সারা দুনিয়াকে হতবাক করেছে। একসময় যে দেশের মানুষ লাব্বাইকা বলে কাবার পথে পাড়ি জমাত, তারা কেন আজ ইউরোপের দুয়ারে উদ্বাস্তু হল- মুসলিম দুনিয়ার কাছে এটাই আজ জিজ্ঞাসার বিষয়। আরব বিশ্ব, আরব লীগ, ওআইসি’র নীরবতা মুমিনের অন্তরকে ব্যথাতুর করে দিচ্ছে। আমরা জানি না, যে উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) উকুফে আরাফার প্রবর্তন করেছিলেন তার আলোকে এবারের আরাফার ময়দানে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হবে কিনা! মিনার ময়দানে কোরবানির দীক্ষা নিয়ে বিপদগ্রস্ত মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয়দানে কোনো ধনবান মুসলিম রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে কিনা? এ দেশের অনেক বুজুর্গই মনে করেন, মুসলমানদের ওই মহাসম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য আসা উচিত। যদি না হয় তবে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, চলমান হজ, মানবতা এবং আমাদের কোরবানি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এমনকি অনেক মুসলমানের মনেও নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে।
আপনজনকে কোরবানি দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হিসেবে হজরত ইবরাহিম (আ.) জগতের সবচেয়ে পরিচিত নবী। কোরবানি ছাড়াও তিনি মহান রবের পক্ষ থেকে আরও অন্তত ৪০টি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং সবক’টিতেই সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধি লাভ করেন। মুসলমান ছাড়াও অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের কাছে তিনি জাদ্দুল আম্বিয়া বা বহু নবীর পূর্ব পুরুষ হিসেবে খ্যাত। ১০ জিলহজ পশু জবাইয়ের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায় যে কোরবানি উদযাপন করে তার সঙ্গে হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.)-এর কোরবানির একটি বিশেষ যোগসূত্র আছে। হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি জগতের কাছে স্মরণীয় করার জন্য পরবর্তী উম্মতদের কাছে কোরবানির বিধান চালু রাখা হয়েছে; যেন মানুষ নিজের পশুত্বকে কোরবানি করে মানবতাবোধে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা পেতে পারে। বিদায় হজে রাসূল (সা.) ১০০টি উট কোরবানি করেন এবং এর মাধ্যমেই ৪০০০ বছর আগের ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।
পশু জবাই করার বিধানকে আজকাল অনেক মুসলমানও ‘পশুহত্যা’ এবং পশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা মনে করে। কোরআনিক নির্দেশনা সত্ত্বেও ইসলামের বিধান সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। ১৩২৭ সনে শ্রাবণ মাসে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের লেখা নিবন্ধে কোরবানির পশু জবাইকে পশুহত্যার সঙ্গে তুলনা করলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘কোরবানী’ কবিতা রচনার মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য বছরের বাকি দিনগুলোতে যে পশু জবাই করা হয় তার সংখ্যা ঈদুল আজহার চেয়ে অনেক বেশি। এসব যুক্তি উত্থাপন করে কবি নজরুল ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রশ্ন করেন, বছরের অন্যান্য দিনে পশু জবাই হয় সে ব্যাপারে কোনো নিবন্ধ লিখেছেন কিনা।
কোরবানির ঈদ আসে বছরে একবার। তাশরিকের দিনগুলোতে (১০, ১১ ও ১২ জিলহজ) হাজীরা মিনার ময়দানে কোরবানি দিয়ে থাকেন। এটি হজেরই অংশবিশেষ। হাজীদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একযোগে সারা মুসলিম দুনিয়ায় কোরবানির অনুষ্ঠান পালন করার অর্থ হল মুসলমানদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জাগ্রত করা। কিন্তু মুসলমানরা সে ত্যাগের স্পৃহা ও ভ্রাতৃত্বের প্লাটফর্ম আজও গড়ে তুলতে পারেনি। হজে না গিয়েও হজ কবুল হওয়ার কথা বিভিন্ন কিতাবাদিতে লেখা আছে। মানবতাবোধে উজ্জীবিত সেসব কাবার পথিকরা অপরের কল্যাণে নিজের প্রয়োজনকে কোরবান করতে পেরেছিলেন। আমরা সে ত্যাগ ও কোরবানি থেকে দূরে সরে গেছি। আমাদের হজ ও কোরবানি আজ কেবল আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে।
একশ্রেণীর মুসলমান কোরবানির ঈদে পশু কেনা ও পশু জবাইয়ের ঝামেলা এড়িয়ে চলে, তারা বরং পরিবারসহ ভ্রমণে লিপ্ত হয়। এদের মধ্যে অনেকেই আবার সমপরিমাণ অর্থ কোরবানির পরিবর্তে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে চায়। ব্যক্তিপর্যায়ের এসব উদ্যোগ কস্মিনকালেও ইসলামে অনুমোদনযোগ্য নয়। অবৈধ উপার্জনের নেশায় মত্ত আরেক শ্রেণীর মুসলমান নিজের স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও পশুসুলভ বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করতে পারে না, তারা বরং দামি ও হৃষ্টপুষ্ট পশু কেনার দৃশ্যমান প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। জবাইকৃত পশুর বড় বড় টুকরা বিজ্ঞানের বদৌলতে আর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ডিসকাউন্টের সুবাদে কেনা ডিপ ফ্রিজে জমানোর প্রতিযোগিতাও চলে। কোরবানিকৃত মাংস তিন ভাগ করে দুই-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার রেওয়াজ নিকট অতীতেও ছিল। আল্লাহর জিয়াফত হিসেবে খ্যাত কোরবানির ঈদে সে রেওয়াজ এখন আর চোখে পড়ে না। মঙ্গাপীড়িত, অনগ্রসর ও দরিদ্রকবলিত এলাকার মানুষ যারা ৫০০ টাকা কেজি দরে মাংস কিনে পুষ্টির জোগান দিতে পারে না, তাদের জন্য কোরবানির ঈদ এক আশার প্রতীক। কিন্তু যাদের প্রতি মহান আল্লাহ ত্যাগের (কোরবানি) নির্দেশ দিয়েছেন তাদের স্বার্থবাদিতা ও কুস্বভাবের কারণে গরিবরা চরম আশাহত হয়ে ফিরে যায়। কবি নজরুল এজন্য বলেছিলেন-
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ হালাল অর্থে কেনা পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজের পশুসুলভ চরিত্র ত্যাগ করে অপরের কল্যাণে উৎসর্গ করার সওগাত নিয়ে কোরবানির ঈদ বছর ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয়। কিন্তু আমরা সে শিক্ষা নিতে পারি না। বরং অনেক সময় পশুর চেয়েও হীনতর কাজ করে বসি। তখন তার বাহ্যিক পশু জবাই এক ভোগ-বিলাসের উৎসব, মাংস ভক্ষণ আর লৌকিকতার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। কাজেই, স্বার্থত্যাগের দৃঢ়তা ও স্পৃহা যে কোরবানির মাধ্যমে অর্জিত হয় বাস্তবজীবনে তার প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করে একজন হাজী কিংবা একজন মুমিনের পরহেজগারী ও তাকওয়া।
লেখক : মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন, ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক ।