Tuesday, 5 January 2016

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের গুরুত্ব -- মিল্টন বিশ্বাস

সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সম্পন্ন হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখেছিলেন, ‘এটা ছিল সন্ত্রাসের মুখে অসাধারণ সংগ্রাম।’ তার এই মতামত যথার্থ ছিল এই কারণে যে, বিএনপি-জামায়াতের সহিংস মারমুখী অবস্থানের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার ঘটনা আমাদের দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষের সেই নির্বাচন দেশবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে। তবু জামায়াত-বিএনপির অপতৎপরতা চলছে। ওইদিনটিকে তারা গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ৩০ ডিসেম্বর (২০১৫) পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুবি হয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার কোনো বক্তব্যে সহিংস রাজনীতি বা ইস্যুশূন্য আন্দোলন অবসানের কোনো সদিচ্ছা প্রকাশ পায়নি। বরং নাশকতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি হরহামেশায়। আসলে তাদের প্রতিহত করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐক্য। নতুন সরকার হিসেবে দুই ও তার আগের পাঁচ বছর মোট সাত বছর যাবৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেই ঐক্যের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগসহ নতুন সংসদ সদস্যরা পুনরায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে উদ্দীপিত হয়েছেন। এ জন্য ১২ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে সাবেক মহাজোট সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। আপামর জনসাধারণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন রয়েছে এ নতুন সরকারের কর্মকা-ে।
তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে যারা সন্ত্রাস সংঘটনে ইন্ধন দিয়েছে, সক্রিয়ভাবে নাশকতায় জড়িত থেকেছে এবং সহিংসতাকে রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত করেছে তারা এবং তাদের সমর্থকরা সেই সময়ের মতো বর্তমানেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা করছে। পৌরসভা নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের সংখ্যা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অন্যদিকে ৫ জানুয়ারিকে কালো দিবস হিসেবে অভিহিত করে ওইদিনটিকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নতুন অভিযাত্রা শুরুর দিন গণনা করাÑ সবই বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলের ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দৃঢ় আস্থা প্রদর্শন করেছে। আর বিএনপি-জামায়াতকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছে। কারণ বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক আশ্চর্য সাহসী রাজনীতিকের নাম; যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া শেখ হাসিনাবিহীন যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতকে। আবার নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বীভৎস চিত্র গণমানুষকে আতঙ্কিত করে তোলায় তারা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সন্তোষ প্রকাশ করছে। এদিক থেকে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিএনপির অবরোধের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ২০১৪-এর শেষও হয়েছিল জামায়াতের হরতালের মাধ্যমে। কিন্তু সহিংসতা আর জ্বালাও-পোড়াও করে তারা থামাতে পারেনি যুদ্ধাপরাধের বিচার। বরং ২০১৫ সালে তিন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় জনগণকে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল করে তুলেছে অনেক বেশি। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে জামায়াতের বাঁচা-মরার আন্দোলনও দমে গেছে। অন্যদিকে দুই বছর ধরে বিএনপি কয়েক দফা আন্দোলনের হুঙ্কার দিয়েও মাঠ গরম করতে পারেনি। বরং জামায়াতের প্রধান মিত্র তারা এখন হরহামেশাই বলতে বাধ্য হচ্ছে, ‘জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্বাচনী রাজনীতি’র। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সব বিরূপ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছেন। তার মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা। কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদার বানিয়ে ফেলেছেন রাশিয়া ও জাপানকে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। পূর্বমুখী কূটনীতির অংশ হিসেবে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। নিজের সরকারের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে উপস্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর দুই (২০১৪ এবং ২০১৫) বছর ধরে দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি জোট আন্দোলনের ডাক দিয়ে যাচ্ছে; ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছে। এ জন্যই আন্দোলনের নামে সামান্যতম নৈরাজ্য-সহিংসতা চালানোর চেষ্টা করা হলে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানের ঘোষণা এসেছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। বিএনপির আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে রাজপথে সক্রিয় থাকছে আওয়ামী লীগ। এ কথা প্রমাণিত যে, বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে জানমালের ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। দেশের মানুষ যেখানে স্বস্তি ও শান্তিতে আছে; যেখানে মানুষ নির্বিঘেœ চলাফেরা করছে সেখানে জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রল ঢেলে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে চাইলে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ নেই। কারণ আন্দোলন করার মতো কোনো সংকট দেশে তৈরি হয়নি। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাই আন্দোলনের ডাক দিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। জনগণ তো দূরের কথা বিএনপির কর্মীরাই প্রস্তুত নয়; আর কর্মী তো দূরের কথা তাদের দলের নেতারা প্রস্তুত নন। আর আন্দোলন কখনো অঙ্ক কষে হয় না। যাদের নিয়ে কুচকাওয়াজ করে বিএনপি আন্দোলন করবে সেই জামায়াতের অবস্থা এখন নাজুক। এই জামায়াত-হেফাজতরা বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে মসজিদে হামলা চালিয়েছে, বিদেশিদের হত্যাসহ খ্রিস্টান যাজকদের হত্যার চেষ্টা করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে সারা দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ, হামলা, নির্যাতনের ঘটনাকে হেফাজত ইসলাম আন্তর্জাতিক চক্রের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছিল। আমাদের মতে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলাকে ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে বেশি। সেখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কী করে আধিপত্য বিস্তার করেছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বরং খোদ রাজধানীসহ অনেক জায়গায় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীসহ ছাত্রশিবির ক্যাডারদের গোপন বৈঠকের সংবাদ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশজুড়ে নাশকতায় লিপ্ত দলের এই গোপন বৈঠক নাগরিক সমাজের শান্তি বিঘিœত করছে এটা স্পষ্ট।  
অনেক আগেই দেশের বিশিষ্টজনরা যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও নাশকতাকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গাড়ি-বাড়িতে আগুন, পেট্রল বোমা, পুলিশকে মারধর ও হত্যা করা এটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা ও পঙ্গু করা হয়েছে কয়েক বছর ধরে। আর এই জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। সহিংসতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে জামায়াত-শিবির। টানা হরতাল-অবরোধে শিক্ষা, ব্যবসা আর বিদেশে দেশের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এমনকি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নাগরিককে তাদের দেশের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করেছিল। সুস্থ ধারার রাজনীতি থেকে এই বিচ্যুতি দেশের তরুণ প্রজন্মকে দিশেহারা করেছিল সাময়িকভাবে। কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা পুনরায় গণজাগরণ মঞ্চকে সামনে নিয়ে আসে এবং তরুণদের অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে ১৭ জন পুলিশ, ২ জন বিজিবি ও ২ জন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যা করে জামায়াত-বিএনপি সন্ত্রাসীরা। এছাড়া অসংখ্য সাধারণ জনতাকে হত্যা ও আহত করে আগুন দিয়ে, সেসব ঘটনা আমরা সবাই জানি। পুনরায় এখন বিএনপির ২০ দলীয় জোট আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। আসলে রাজপথে সরকার পতনের মতো আন্দোলনের সাংগঠনিক ক্ষমতা না থাকায় এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো হওয়ায় বিএনপি জনগণের কোনো আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার সামাজিক দুর্বৃত্তায়নকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ায় অতীতে (২০০১-২০০৬) দেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও লাগামহীন দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। সে সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় উন্মত্ত জোটের মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের তা-বের কথা আমাদের সবার মনে আছে।
রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- ব্যাপক। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রচারণায় আমরা দেখতে পেয়েছি অসাধারণ উপস্থাপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের সাফল্যগুলো নিরন্তর কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচার করে চলেছে। সেখানে তথ্যাদির নিরিখে উন্নয়নমূলক কর্মকা- প্রচার করা হয়েছিল। আর তা যে সম্পন্ন হয়েছে এটা জনগণের কাছে স্পষ্ট। না হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া কিংবা কোনো ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশিত হলে তার সমালোচনা করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যদিও কেউ কেউ মিথ্যাচার করেছেন। তবে উপস্থাপিত তথ্যাদি বা সরকারের উন্নয়ন না হওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি কেউ। সরকারের উন্নয়নের ব্যাপারে কোনো চ্যালেঞ্জ না করে নির্বাচনকে ভ-ুল করার জন্য উদ্ভট আর মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। শেষ পর্যন্ত তারা সরকারের উন্নয়নকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর সব দিক দিয়ে তাদের পরাজয় ঘটেছে বলেই দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।

লেখক : অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
email- writermiltonbiswas@gmail.com