বিশ্বনবী (সা.)-এর মেরাজ
মো. লুৎফুর রহমান ২৩ মে, ২০১৪ ০০:০০ 173 শেয়ার মন্তব্য()প্রিন্ট
অ- অ অ+
আমাদের কাছে শবে মেরাজ খুবই পরিচিত একটি নাম। বিশ্বে এ দিবসকে মুসলমানরা পালন করে থাকে নানা আয়োজনে- সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও মিলাদ-মাহফিলের মাধ্যমে। রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে এ দিবসে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও খবর প্রচার হয়ে থাকে। (যদিও এসব কাজে সওয়াব অর্জনের কথা শরিয়তে প্রমাণিত নয়)
'মেরাজ' মূলত মানুষের ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। মেরাজ মানে ঊর্ধ্বারোহণ। কিন্তু এই ঊর্ধ্বারোহণ কোনো সাধারণ ঊর্ধ্বারোহণ নয়, আকাশে কিংবা চাঁদে যাওয়া নয়, মঙ্গল গ্রহে যাওয়াও নয়। এটি হলো এমন ঊর্ধ্বারোহণ, যেখানে আরশে আজিম অর্থাৎ আল্লাহপাকের আরশ কুরছি ও লওহে মাহফুজ (পবিত্র কোরআন যেখানে সংরক্ষিত) রয়েছে। ঠিক সেখানেই রাসুলে পাক (সা.)-এর গমন।
এটি সত্যি বিস্ময়কর একটি ঘটনা শুধু ইতিহাসের জন্য নয়, বিজ্ঞানের জন্যও। যখন বিমান কিংবা রকেটের আবিষ্কার হয়নি, তখন একজন মানুষ যন্ত্রবিহীন পৃথিবী ছেড়ে সাত আসমান ভেদ করে 'সর্বশেষ ফটক' বা ছিদরাতুল মুনতাহা ভেদ করে স্বয়ং আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়া এবং সেখানে অবস্থান করে পৃথিবীর মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার সব নিদর্শন দেখে ও নির্দেশনামা নিয়ে আবার পৃথিবীর বুকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা এক অকল্পনীয় বিস্ময়।
এখানে উল্লেখ্য যে ছিদরাতুল মুনতাহা হলো সেই ফটক, যে ফটকে হজরত জিবরাইল (আ.) এবং অন্য ফেরেশতাদেরও যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই।
প্রথম ঘটনা : যাহোক, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেই সর্বশেষ ফটক অতিক্রম করে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার মতো ঘটনা স্বয়ং আল্লাহই প্রকাশ করেছেন বিস্ময়সূচক 'সুবহান' শব্দ ব্যবহার করে। যেমন সুরা বনি ইসরাইলে প্রথমেই সুবহানাল্লাজি আসরা বি-আবদিহি...বলে এ ঘটনার সূত্রপাত করেছেন অর্থাৎ 'পবিত্র ও মহিমান্বিত (সেই আল্লাহ!) যিনি তাঁর (এক) বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপাশ্বর্িকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, যেন আমি তাকে আমার (দৃশ্য-অদৃশ্য) দেখাতে পারি, (মূলতঃ) সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা তো স্বয়ং তিনিই।' (বনি ইসরাইল : ১)।
নবীদের সঙ্গে নামাজ : ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, সঠিক বর্ণনানুযায়ী জানা যায়, নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে স্বশরীরে বোরাকে তুলে হজরত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। নবী করিম (সা.) সেখানে মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বোরাক বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং সব নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেন।
প্রথম আসমানে প্রবেশ : এরপর সে রাতেই রাসুল (সা.)-কে বায়তুল মাকদাস থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবী (সা.) হজরত আদম (আ.)-কে সালাম করেন। হজরত আদম প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে মারহাবা বলে সালামের জবাব দেন। তাঁর নবুয়তের স্বীকারোক্তি করেন। তখন আল্লাহপাক হজরত আদম (আ.)-এর ডানদিকে নেককার ও বামদিকে পাপীদের দেখান প্রিয় নবী (সা.)-কে।
দ্বিতীয় আসমানে প্রবেশ : প্রথম আকাশ থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) নবী (সা.)-কে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে যান। আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত জাকারিয়া (আ.)-এর সঙ্গে। সাক্ষাতেই নবী (সা.) সালাম করেন। সেখানে হজরত ঈসা ইবনে মরিয়মও ছিলেন। সালাম বিনিময় শেষে তাঁরা আখেরি নবীর নবুয়তের স্বীকৃতি দেন।
তৃতীয় আসমানে প্রবেশ : এরপর রাসুল (সা.)-কে হজরত জিবরাইল (আ.) তৃতীয় আসমানে নিয়ে গেলেন। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে। এখানে সালাম বিনিময় হয়। নবী (সা.)-কে তিনি স্বাগত জানান।
চতুর্থ আসমানে প্রবেশ : তৃতীয় আকাশ থেকে চতুর্থ আকাশে যান। সঙ্গে হজরত জিবরাইল (আ.)। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর সঙ্গে। দুজন দুজনকে সালাম করেন। এরপর হজরত ইদ্রিস (আ.) নবী (সা.)-কে মোবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি দেন।
পঞ্চম আসমানে প্রবেশ : এরপর রাসুল (সা.)-কে পঞ্চম আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি হজরত হারুন (আ.)কে দেখে সালাম দেন। তিনি সালামের জবাবে মোবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।
ষষ্ঠ আসমানে প্রবেশ ও মুসা (আ.)-এর ক্রন্দন : নবী (সা.)-কে এরপর ষষ্ঠ আকাশে নেওয়া হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি সালাম করেন। হজরত মুসা (আ.) তাঁকে স্বাগত জানান এবং রাসুলের নবুয়তের স্বীকার করেন। এরপর নবী (সা.) সামনে এগিয়ে গেলেন। তখন হজরত মুসা (আ.) কাঁদতে লাগলেন। নবী (সা.) জানতে চাইলেন আপনি কাঁদছেন কেন? হজরত মুসা (আ.) বললেন, আমার পরে একজন নবী আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর উম্মতরা আমার উম্মতের চেয়ে সংখ্যায় বেশি জান্নাতে যাবে।
সপ্তম আসমানে প্রবেশ : নবী করিম (সা.)-কে এরপর সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে সালাম করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) সালামের জবাব দেন এবং নবী পাক (সা.)-কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ও তাঁর নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।
সিদরাতুল মুনতাহা পার হওয়ার ঘটনা : প্রথম আসমান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত যাওয়ার পর নবী (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটি আল্লাহর কাছে পৌঁছার প্রথম গেট। যে গেট দিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.)ও যেতে পারেন না। এরপর নবী (সা.) একাই আল্লাহপাকের আরশে পৌঁছে যান। সেখানে পৌঁছার পর নবী (সা.) আল্লাহকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন, 'আত্তাহিয়াতু লিল্লাহ...। আল্লাহ পাক জবাবে বলেন, আস্সালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবি। আল্লাহপাকের সালামের জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, আস্সালামু আলাইনা ওয়ালা ইবাদিল্লাহিস সালেহিন। এরপর আল্লাহপাক নবী (সা.)-কে যা দেওয়ার দিয়ে দেন, যা ইচ্ছা ওহি নাজিল করেন এবং ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অর্জন : আরশে আজিমের সেই মহা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, উপঢৌকন ও নামাজের আদেশ পেয়ে ফেরার পথে সাক্ষাৎ হয় হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আপনাকে আল্লাহ কী কাজের আদেশ করেছেন? নবী (সা.) বললেন, ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। হজরত মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত এত নামাজ আদায়ের শক্তি রাখে না। আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে নামাজ কমিয়ে আনার দরখাস্ত করুন। এ সময় নবী (সা.) হজরত জিবরাইল (আ.)-এর দিকে তাকালে তিনি ইশারা করলেন। এরপর নবী (সা.) ফিরে গিয়ে নামাজ কমিয়ে দেওয়ার আবেদন করলে আল্লাহপাক ৪৫ ওয়াক্ত নামাজ দান করেন। ফিরে আসার পথে আবার মুসা (আ.) জিজ্ঞেস করেন এবং ৪৫ ওয়াক্ত নামাজের ব্যাপারে একই কথা বলেন। নবী (সা.) এভাবে আল্লাহ পাকের দরবারে আটবার গেলেন এবং প্রত্যেকবার পাঁচ ওয়াক্ত করে কমিয়ে দেওয়া হলো। অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যখন আল্লাহ নির্ধারণ করলেন, তখন হজরত মুসা (আ.) এ সংখ্যাকেও বেশি মনে করলেন এবং নবী (সা.)-কে আবারও দরখাস্ত পেশ করতে বললেন। নবী (সা.) বারবার যেতে লজ্জাবোধ করলেন এবং বললেন আমি আল্লাহর এ আদেশের ওপরই মাথানত করলাম। ফেরার পথে কিছুদূর আসার পর আওয়াজ হলো, 'আমি আমার ফরজ নির্ধারণ করে দিয়েছি এবং আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিয়েছি।'
এ সময়ও নবী (সা.)-এর শাককুস সদর বা বক্ষ বিদার ঘটে। এ সফরে রাসুল (সা.)-কে কয়েকটি জিনিস দেখানো হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জান্নাত ও জাহান্নাম। (জাদুল মা'আদ)
মেরাজের ঘটনা শেষে রাসুল (সা.) যখন পৃথিবীতে এলেন, তখনো রাসুলের ওজু করা পানি গড়িয়ে পড়ছিল। এদিকে এ ঘটনা জানতে পেরে কাফেররা তিরস্কার করা শুরু করল। হজরত আবু বকর (রা.) আবু জাহেলের মুখে ভর্ৎসনার সুর শুনে তিনি বললেন, যদি আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) এ কথা বলে থাকেন, তবে আমি খাঁটি ইমানে বিশ্বাস করলাম। সেই ঘটনা থেকেই হজরত আবু বকর (রা.)-এর নামের সঙ্গে সিদ্দিক বা সত্যায়নকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। (ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ : ৬৯৯)।
লেখক : সাংবাদিক
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/dhormo/2014/05/23/87498#sthash.BJlX5Mys.dpuf