Wednesday, 11 December 2013


হায় আমাদের পথভ্রষ্ট রাজনীতি

অবরোধ-হরতালে বিএনপি-জামায়াতের ভাঙচুর-অগ্নিসংয়োগ নিন্দনীয়। তার চেয়েও বেশি নিন্দনীয় প্রকাশ্য দিবালোকে কোনও নিরীহ পথচারীকে কুপিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করা। গত পরশু পুরনো ঢাকাবাসী স্বচক্ষে এবং বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ টিভির পর্দায় এরকম একটি পৈশাচিক দৃশ্য অবলোকন করেছে। গতকাল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকেও বিশদে এসেছে খবরটি। ১৮ দলীয় জোটের ডাকা রাজপথ অবরোধ প্রতিরোধের নামে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী হত্যা করেছে বিশ্বজিত্ দাস নামের এক দর্জি দোকানিকে। ঘটনাকালে বিশ্বজিত্ ছিলেন পথচারী। অবরোধের কারণে দোকান বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এক খদ্দেরকে তার পোশাক বুঝিয়ে দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি। পথে অবরোধবিরোধী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের আক্রমণের শিকার হন। কেন? ছাত্রদলকর্মী সন্দেহে। তারপর? নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাকে। কীভাবে? চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে-কুপিয়ে। আশপাশে পুলিশ ছিল না? ছিল, কিন্তু নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ছাত্রলীগের কোনও বিবেকমান নেতা বা কর্মী বাধা দেয়নি? না, অকুস্থলে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সবাই ছিল বিবেকহীন-মনুষ্যত্বহীন; চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত বিশ্বজিতের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বরং সহয়োগিতাই করেছে তারা লাঠিপেটা, রডপেটার মাধ্যমে।

বিশ্বজিত্ য়দি য়ুদ্ধাপরাধীদের বিচার-বানচালকারীদেরও একজন হন, তাকে এইভাবে হত্যা করার অধিকার ছাত্রলীগের আছে কি? বিশ্বজিতের জায়গায় একাত্তরের একজন য়ুদ্ধাপরাধী হলেও তো একজন মানুষকে বিনাবিচারে প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে হত্যার অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। তাহলে, কী তফাত্ থাকল একাত্তরের নরপিশাচ আলবদর-আলশামসের সঙ্গে আজকের ছাত্রলীগের? কী বলে মানবতা? কী বলে মানবাধিকার?

পৈশাচিকতায় একাত্তরের য়ুদ্ধাপরাধীদের কাছে হিটলারের নাসি বাহিনীও হার মানে। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, জ্বালাও-পোড়াও— কী-ই না করেছে ওরা। তারপরও, পাক হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর, অকুতোভয় মুক্তিয়োদ্ধা বাঘা কাদের সিদ্দিকী য়খন প্রকাশ্য বিচারে রাজাকার-আলবদরের মৃত্যুদণ্ড কার্য়কর করেন, তখনও বিষয়টিকে সমর্থন করেনি বিশ্বমানবতা। কেন? রণাঙ্গণে য়া চলে, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে তা চলে না। চলে না বলেই য়ুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ৪১ বছর অপেক্ষা করতে হয় জাতিকে। সেই বিচার য়খন রায়ের দোরগোড়ায়, তখন একাত্তরের য়ুদ্ধাপরাধীরা তা বানচাল করার চেষ্টা তো করবেই। নিজেদের অতীত-দুষ্কর্মের বিচার ঠেকাতে ছাত্রশিবিরের তরুণদেরও ঠেলে দেবে নাশকতায়, য়ে-তরুণদের জন্মই হয়নি একাত্তরে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতায় য়াওয়ার জন্য জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিএনপিও সমর্থন দেবে রাজপথের ভাঙচুর-অগ্নিসংয়োগে এবং দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবরোধ ডেকেই বলবেন, ‘৯ তারিখে কেউ গাড়ি বের করবেন না।’ মামার বাড়ির আবদার। য়েন মির্জা ফখরুল ‘জাতির মামা’ আর তার দল বিএনপি ‘জনতার মামার বাড়ি’। তাই বলে বিচার-বানচালকারীদের ঠেকাতে একাত্তরের বর্বরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান বর্বর হতে হবে ছাত্রলীগকে? তাহলে, কী তফাত্ থাকল রগ-কাটা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে কুপিয়ে-মানুষ-মারা ছাত্রলীগের? কী শিক্ষা নিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বাঙালির মহত্তম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে? আওয়ামীলীগের নেতা-নেত্রীরাই বা কতটুকু মনে রেখেছেন সেই মহান মানুষটিকে? পশ্চিম পাকিস্তানিদের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে পূর্ব বাংলার মানুষের বুক য়খন ঝাঁঝরা হতে শুরু করেছে, তখন, ৭ মার্চের ভাষণে, শেখ মুজিব ঘাতকদের ‘ভাই’ সম্বোধন করে বলেছিলেন— ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’

শত্রুকেও ‘ভাই’ সম্বোধনের বিনয়টুকু শেখ মুজিবের ছিল বলেই তার ডাকে সাড়ে সাত কোটি পরাধীন বাঙালি মুক্তিয়ুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাত্র ৯ মাসে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন করেছিল। সেই বাংলাদেশ এখন ষোলো কোটি স্বাধীন মানুষের দেশ এবং য়ুদ্ধাপরাধের বিচারে গোটা জাতি অপেক্ষমাণ। অভাব একটাই— জাতি আজ দ্বিখণ্ডিত ও নেতৃত্বহীন। আর সে কারণেই সভ্য পৃথিবীকে দেখতে হচ্ছে বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রে হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্য-নাশকতা চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত নামের দুটি রাজনৈতিক দল এবং অন্য একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও এর সহয়োগী সংগঠন ছাত্রলীগ হাতে চাপাতি নিয়ে অবরোধ ঠেকানোর নামে নিরীহ পথচারীকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করছে। হায় আমাদের পথভ্রষ্ট রাজনীতি!

@ আবু হাসান শাহরিয়ার

পাদটীকা:
জামায়াত-শিবির-বিএনপি-ছাত্রদল-আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ নয়, পথচারী ওই বিশ্বজিতই বাংলাদেশ। বিশ্বজিত্রা না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচে না।