Friday, 26 September 2014

'ইতিহাসের ইতিহাস' 

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সবসময়েই আমার বুকের মাঝে এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা কাজ করে। মাঝে-মাঝেই পথে-ঘাটে রেল স্টেশনে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমার হয়তো একজন মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষের সাথে দেখা হয়, টুকটাক কথার পর হঠাৎ করে সেই মানুষটি বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা!’ আমি তখন সবসময়েই দ্বিতীয়বার তার হাত স্পর্শ করি এবং সেই মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষটার মাঝে আমি টগবগে তেজস্বী একজন তরুণকে খুঁজে পাই। আমি জানি সেই তরুণটি কিন্তু নিজের জীবনকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করতেই যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন আমরা সবাই জানি কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসের ভেতর আত্মসমর্পণ করেছিল, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিল তারা কিন্তু তখন সেটি জানতো না। তারা সবাই কিন্তু বছরের পর বছর যুদ্ধ করার জন্যেই গিয়েছিল। তাই সবসময়েই আমি মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির হাত স্পর্শ করে বলি, ‘থ্যাংকু! আমাদের একটি দেশ উপহার দেবার জন্যে।’
মাঝে মাঝে কোনো তরুণ কিংবা তরুণীর সাথে আমার দেখা হয়, যে লাজুক মুখে আমাকে বলে, ‘আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা’, আমি তখন আবার তার মুখের দিকে তাকাই। তার লাজুক মুখের পিছনে তখন আমি তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গর্ব আর গৌরবের আলোটুকু খুঁজে পাই। আমি তখন তার বাবার খোঁজখবর নিই। বেশিরভাগ সময় আবিষ্কার করি, তিনি আর বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে আমি সেই তরুণ কিংবা তরুণীকে বলি তাঁর কাছে আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পৌঁছে দিতে।

একাত্তর সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, দেশ স্বাধীন হবার পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে তখন আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবেরা, যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, তারাও ক্লাসে ফিরে আসতে শুরু করেছে। কম বয়সী তরুণ, কিন্তু এর মাঝে তাদের ভেতর কী বিস্ময়কর দেশের জন্যে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আমি তাদের দেখি এবং হিংসায় জ্বলে-পুড়ে যাই! একাত্তরের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে আমি কম চেষ্টা করিনি— পিরোজপুরে মাঠে দু’একদিন লেফট-রাইট করা ছাড়া খুব লাভ হয়নি। আমার বাবাকে মেরে ফেলার পর পুরো পরিবারকে নিয়ে একেবারে বনের পশুর মত দীর্ঘদিন দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। একটু স্থিতু হয়ে যখন বর্ডার পার হবার পরিকল্পনা করছি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র তেরোদিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেল— আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সেই নিয়ে আমার ভেতরে বহুদিন একটা দুঃখবোধ কাজ করতো এবং আমার বয়সী মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই আমি হিংসায় জর্জরিত হতাম।

খুব ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সেই (হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী) হিংসাটুকু গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পাল্টে গেছে। আমি বুঝতে শিখেছি দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়, সৃষ্টিকর্তা অনেক যত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবে, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবে, অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক হবে, অলিম্পিক স্বর্ণবিজয়ী দৌড়বিদ হবে, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে, এমনকী মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবে, কিন্তু আর কখনোই মুক্তিযোদ্ধা হবে না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তারাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নয়। (তাই আমি যখন দেখি অল্প কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ বের করে ফেলছে, তখন আমার মনে হয় গলায় আঙুল ঢুকিয়ে তাদের ওপর হড়-হড় করে বমি করে দিই!)

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার ভেতরে এখন গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। আমি সবসময়ে চেষ্টা করে এসেছি নতুন প্রজন্মের ভেতর সেই অনুভূতিটুকু সঞ্চারিত করতে, যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পৌঁছে দিতে। একটি সময় ছিল যখন এই দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তো, মুক্তিযুদ্ধকে খাঁটো করে দেখানো হতো, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা হতো— তখন এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর যে গভীর অভিমান জমা হয়েছিল আমি সেই কথা কখনো ভুলতে পারব না। আমাদের খুব সৌভাগ্য, আমরা সেই সময়টি পিছনে ফেলে এসেছি। এই দেশের মাটিতে আমরা আর কখনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অবমাননা করতে চাই না। তাই যখন আমি আবিষ্কার করেছি একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছে। এ কে খন্দকার শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ। ষোলই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে, তখন তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম তৈরি করে নতুনভাবে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং আমাদের তরুণরা সেটা সাগ্রহে গ্রহণ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভালোবাসা এদেশে আবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছেন। মনে আছে তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পথটুকু আমি গাড়িতে তার পাশে বসে এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এরকম একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পাশে বসে আছি চিন্তা করেই আমি শিহরিত হয়েছিলাম। তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলেছিলেন, তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমরা তাঁদের নিয়ে আমাদের একটা খোলা চত্বরে তাঁদের হাতে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম, এতোদিনে গাছগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে অনেক বড় হয়েছে। আমরা সেই চত্বরটিকে সেক্টর কমান্ডার্স চত্বর বলে ডাকি।

সে কারণে যখন আমি দেখি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে তীব্র ভাষায় শুধু সমালোচনা নয়, অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সেটি আমাকে তীব্রভাবে আহত করে। যারা তাঁকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করছেন তারা কী বুঝতে পারছেন না, এভাবে আসলে আমরা শুধু আমাদের নিজেদেরকেই না, মুক্তিযুদ্ধকেও অপমান করছি? তাঁর অবদানকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করছি? খবরের কাগজে দেখেছি বার্ধক্যের কথা বলে তিনি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতৃত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, কাউকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না তাঁকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা, বিতর্ক এবং অপমানই হচ্ছে মূল কারণ। আমরা আমাদের দেশে একজন মানুষকে তাঁর নিজের মতপ্রকাশের জন্যে এভাবে অসম্মান করব, আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
২.
এটি অবশ্যি কেউ অস্বীকার করবে না যে, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমাদের সবারই কম বেশি মন খারাপ হয়েছে। আমরা সবাই আশা করেছিলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন, সেটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু তিনি যেটুকু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তার থেকে বেশি ইতিহাসকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি একজন সৈনিক, তাঁর বিশ্লেষণ হয়েছে সৈনিকের চোখে, ইতিহাসবিদ সাধারণ মানুষ কিংবা রাজনৈতিক মানুষের সাথে তাঁর বিশ্লেষণ মিলবে তার গ্যারান্টি কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা এই বইয়ে তিনি যা লিখেছেন সেখানে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাগুলো ছাড়া অন্য সব কথাই কিন্তু আমরা সবাই অন্য জায়গায় শুনেছি! আমার দুঃখ হয় অন্য মানুষের মুখে আগে শুনে থাকা কথাগুলোর জন্যে আজকে তাঁর মতো একজন মানুষকে এতো অসম্মান করা হলো।

আমি মোটেই বইটি নিয়ে আলোচনা করব না, শুধু বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় নিয়ে কথা বলব। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার লিখেছেন: ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণটি শেষ করেছেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। হুবহু এই বিষয়টি লিখেছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান তাঁর ‘বাংলাদেশের তারিখ’ বইটিতে। তিনি অবশ্যি ‘জয় পাকিস্তান’ লিখেননি, তিনি লিখেছিলেন ‘জিয়ে পাকিস্তান’। পরবর্তী কোনো একটি সংস্করণে তিনি বই থেকে এই কথাটি সরিয়ে দিয়েছিলেন, আমি ধরে নিচ্ছি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই তথ্যটি ভুল ছিল, তিনি ভুল সংশোধন করেছেন। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার যেহেতু দাবি করেননি তিনি নিজের কানে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন তাই আমি ধরে নিচ্ছি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, যেখান থেকে এই তথ্যটি পেয়েছেন তিনিও সম্ভবত একই জায়গায় সেটি পেয়েছেন। এই বিচিত্র তথ্যসূত্রটি কী? আমার মনে হয় এর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন সৈয়দ বদরুল আহসান ডেইলি স্টার পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন: ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণটি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচার করা হয় তখন স্থানীয় পত্রিকাগুলো তাদের দেশের মানুষ যেন বিচলিত না হয় সেজন্যে বক্তৃতার শেষে এই কথাটুকু জুড়ে দিয়েছিল। সেই কথাটিই এখনো নানা জনের কথায় নানাভাবে চলে এসেছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে। তিনি লিখেছেন: তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধের পরও তিনি একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। আমি ইতিহাসবিদ নই, আমি নির্মোহভাবে চিন্তা করতে পারি না, কিন্তু আমার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ আছে, ছোটদের জন্যে ২২ পৃষ্ঠার একটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্যে আমাকে অনেক বই পড়তে হয়েছিল। আমি পাকিস্তানি মিলিটারী অফিসার সিদ্দিক মালিকের বইয়ে দেখেছি, তিনি লিখেছেন: পঁচিশে মার্চ রাতে খুবই ক্ষীণভাবে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণাটি কোথা থেকে এসেছিল তার একটি ব্যাখ্যা তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের বইটিতে (তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭) দেয়া আছে। ট্রান্সমিটার বানানোতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক ঘোষণাটি প্রচার করেছিলেন বলেই হয়তো পাকিস্তান মিলিটারীর হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল!

যাই হোক, আগেই বলেছি আমি আসলে এই বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে বসিনি, অনেকেই সেটা লিখছেন। সবচেয়ে বড় কথা একাত্তরে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক দুটি শব্দ ছিল, এতদিন পর দুটি শব্দকে আলাদা করে দেখার সুযোগ কোথায়? বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে কী বাংলাদেশের জন্ম হতো?
৩.
আগেই বলেছি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে। শুধু আমার নয়— আমার মতো অনেকেরই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মতো যেসব মানুষের এক ধরনের ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি মনে কষ্ট পেয়েছে। তবে আমার ধারণা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের, যে ভাষায় এবং যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে সেটা মেনে নেয়া কঠিন। আমার ধারণা তিনি নিজেও নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে কথাগুলো ইতিহাসের সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছি সেই কথাগুলো তো বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখানোর জন্যে আরো অনেকেই আগে এভাবে বলেছে— তাহলে এই বইয়ে সেটি লিখে কার লাভ হলো?

আমিও ভাবছিলাম, কার লাভ হলো, তখন হঠাৎ করে উপলব্ধি করেছি যে, লাভ হয়েছে বইয়ের প্রকাশকের! বইটি প্রকাশ করেছে প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা এবং তারা একটু পরে পরে বইটির বিজ্ঞাপন দিয়ে বইটি বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। খুবই স্থূলভাবে বলা যায় একটি করে বই বিক্রি হচ্ছে, একজন সেই বই কিনছে, সেই বই পড়ছে আর মন খারাপ করছে, আর প্রথমা প্রকাশনীর ক্যাশ বাক্সে একটু করে অর্থ যুক্ত হচ্ছে। আমি যদি একজন প্রকাশক হতাম তাহলে কী শুধু কিছু অর্থ উপার্জন করার জন্যে এরকম একটি বই প্রকাশ করে এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষটিকে এরকম অসম্মানের দিকে ঠেলে দিতাম? কিছুতেই দিতাম না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে, মাওলানা আবুল কালাম আজাদও তাঁর মতপ্রকাশ করার জন্যে ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই পড়ে বইয়ের সংক্ষিপ্ত একটা রূপ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো বইটি পড়ে অনেকে মনে কষ্ট পেতে পারে বলে তিনি বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে যেন পুরো বইটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পর আমরা সেই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই ইতিহাসে সত্য যুক্ত করার জন্য সময় নেয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে— একজন মানুষকে অসম্মান করা হবে জানলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত অর্থ উপার্জন পৃথিবীর একমাত্র পথ নয়।

বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি খচখচ করছিল, বার বার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কী বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার এই বইটি নিজের হাতে কাগজের ওপর কলম ঘষে ঘষে লিখেছেন? আমার কৌতূহলটি মেটানোর জন্যে আমি প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’কে ফোন করলাম, তাদের কাছে অনুরোধ করলাম তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কী আমি একনজর দেখতে পারি? তারা একটু ইতস্তত করে আমাকে জানালেন, সেভাবে হাতে লেখা পুরো পাণ্ডুলিপি তাদের কাছে নেই। কিছু আছে। তবে তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করেই পুরোটা প্রস্তুত করা আছে এবং এই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তুর সাথে তিনি পুরোপুরি একমত সেরকম সাক্ষ্য-প্রমাণ তাদের কাছে আছে।

আমি লেখালেখি করি, তাই এই উত্তর শুনে আমি কেমন যেন ভ্যাবা-চ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার মনে হতে লাগল, এই বইটি কেমন করে লেখা হয়েছে কিংবা ‘প্রস্তুত’ করা হয়েছে সেটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক একটা বিষয় হতে পারে। বই লেখা আর বই প্রস্তুত করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমরা কি প্রথমা প্রকাশনীর কাছ থেকে এই বই প্রস্তুত করা সংক্রান্ত একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেতে পারি? আমাদের মনের সান্ত্বনার জন্য?
৪.
আমরা সবাই জানি এই বইটি লেখার জন্যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতৃত্ব দেবেন না, আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। তাঁর বই পোড়ানো হয়েছে, খন্দকার মুশতাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে— ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী বলা হচ্ছে সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু সবার কাছে আমার খুব সোজা একটি প্রশ্ন। এই বইটি লেখার দায়ভার কি শুধু লেখকের? প্রকাশককেও কি খানিকটা দায়ভার নিতে হবে না? আপত্তিকর কিংবা বিতর্কিত কিছু লিখে একজন লেখক সমালোচনা আর অসম্মান সহ্য করবেন এবং সেই সমালোচনা আর অসম্মান বিক্রি করে প্রকাশক অর্থ উপার্জন করবেন, সেটি কেমন কথা? আমরা কি কোনোভাবে প্রকাশককেও দায়ী করতে পারি না?

হুবহু এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে এর একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ আছে এবং আমাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই ঘটনাটি মনে আছে। ২০০৭ সালে প্রথম আলোর রম্য সাপ্তাহিকী আলপিনে একটা অত্যন্ত নিরীহ কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এই দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সেই নিরীহ কার্টুনটিকে একটা ইসলাম-বিরোধী রূপ দিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে দেয় এবং আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হল। শুধু তাই নয়, এটা প্রকাশ করার অপরাধে আলপিনের সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বরখাস্ত করা হল। এখানেই শেষ নয়, আমরা দেখলাম প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান স্বাধীনতা-বিরোধী হিসেবে পরিচিত বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পেলেন। (আমার ধারণা ছিল সংবাদপত্র আদর্শ এবং নীতির কাছে কখনো মাথা নত করে না, সেদিন আমার সেই ধারণাটিতে চোট খেয়েছিল!)

এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নাটকীয় ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম কোনোকিছু বিতর্কিত বা আপত্তিকর ছাপানো হলে লেখকের সাথে সাথে প্রকাশকদেরও সেই দায় গ্রহণ করতে হয়। আগে গ্রহণ করেছে।

আমার খুব ইচ্ছে আমাদের সবার কাছে সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকারের বক্তব্যের দায়ভার প্রকাশক খানিকটা হলেও গ্রহণ করে তাঁকে যেন তাঁর সম্মানটুকু ফিরিয়ে দেয়।

লেখক: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Wednesday, 24 September 2014

বাহিরে খন্দকার ভেতরে মোশতাক

প্রতিদিন নতুন নতুন খবর, নতুন নতুন আলোচনা-সমালোচনা নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে সাধারণ মানুষের মনে। এই সেদিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি আজীবন কারাবাসে বদল হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছে এটা একটা চালাকি, জামায়াতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ দেন-দরবারের রাস্তা খোলা রাখা। কেউ কেউ ভাবছে অন্য কিছু। চালাকরা চালাকি করবে এটাই স্বাভাবিক। আশার কথা, এখন সাধারণ মানুষও অনেক চালাকি ধরতে পারে। যে যাই বলুক, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চায়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন, তার চেয়ে দলীয় পর্যায়ে অনেক বেশি খুন-খারাবি, অন্যায়-অবিচার হয়েছে তার বিচার হওয়া দরকার। কিন্তু আদৌ হবে কিনা তা শুধু ক্ষমতাবানরাই জানেন। ক্ষমতাবানরা যে তাদের সুবিধামতো যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তামাশা করছেন এবং অনেক অযোগ্য আইনজ্ঞকে দিয়ে কৌশলে এগিয়ে চলেছেন তা প্রায় সবার কাছে স্পষ্ট। টিভিতে নারী-পুরুষের সুন্দর মুখ দেখালেই চলে না। রায় শুনে সরকার পক্ষের কেউ মূর্ছা গেলেই তিনি যে খুব আন্তরিক এবং দক্ষ তা বলা যায় না। আর কার ফাঁসি হবে, কার জেল হবে বা কে মুক্তি পাবে গণঅধমদের মতো কেউ নির্দেশ করতে চায় না। বিচারে যা হওয়ার তাই হবে। কোনো পূর্ব ধারণা থেকে কাউকে কোনো শাস্তি দেওয়া এটাও কেউ আশা করে না। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সবার যে মৃত্যুদণ্ড হবে তাও ঠিক নয়, সেটা কোনো বিচারও নয়। কেউ কেউ অভিযোগ থেকে রেহাই পাবে এটাই বিচার। আর দোষী সাব্যস্ত হলেই সবার মৃত্যুদণ্ড হবে তেমনও নয়। আমরা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সত্যিকারের তুলাদণ্ডে মাপা ফাঁকফোকর ছাড়া ন্যায়বিচার চাই। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছি, ঠিক তেমনি শত চাপ প্রলোভনের মধ্যেও সারা দুনিয়ার কাছে গর্ব করার মতো মানসম্মত বিচার চাই। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, সর্বোচ্চ শাস্তিও চাই। কিন্তু সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শর্টকাটে জীবন যন্ত্রণা থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার পক্ষে নই। তারা কেউ কেউ বেঁচে থেকে তিলে তিলে সারা জীবন কলঙ্কময় জীবন ভোগ করুক এমনটাও অনেকে চায়।


যাক, আজ 'বাহিরে খন্দকার, ভেতরে মোশতাক' এবং মুক্তিযুদ্ধে তার খেতাব নিয়ে আলোচনা করি। এ কে খন্দকার আমাদের অনেকের কাছে এক সময় মাথার তাজ ছিলেন। থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ায় তিনি এখন বড় বেশি নিন্দিত হচ্ছেন। এখনো আমি যেমন তাকে পাকিস্তানি দালাল মনে করি না, তেমনি খুব বেশি মুক্তিকামী স্বাধীনতাপ্রেমীও মনে করি না। মুক্তিযুদ্ধে হানদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না করায় পাকিস্তানিদের কাছে এ কে খন্দকার অবশ্যই অপরাধী, আমাদের কাছে নয়। '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' লিখে আমাদের জাতীয় শৌর্যবীর্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলঙ্কিত বা বরবাদ করায় প্রচলিত আইনে যদি বিচার হয়, হতেই পারে। এ জন্য তিনি পাকিস্তানের দালাল হবেন কেন? যুদ্ধাপরাধী হবেন কেন? তিনি বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে কোরআন স্পর্শ করে পাকিস্তান রক্ষার শপথ করেছিলেন। কিন্তু তা না করে অপরাধ করেছেন পাকিস্তানের কাছে, আমাদের কাছে নয়। মুক্তিযুদ্ধে যতটুকু করেছেন তাতে তিনি আমাদের প্রশংসার পাত্র। এ জন্য তার সারা জীবন সম্মান পাওয়া উচিত। তার ২৩২ পৃষ্ঠার বই এক-দুবার নয়, বেশ ক'বার পড়েছি। যেহেতু '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' নিয়ে 'বাহিরে খন্দকার, ভেতরে মোশতাক' নামে একটি বই লিখছি, সেহেতু তার বইটি মেয়েদের উকুন বাছার মতো লাইনে লাইনে চিহ্ন করার চেষ্টা করেছি। কেউ কেউ তার খেতাব কেড়ে নিতে চায়, কেউ তাকে মুক্তিযোদ্ধা থেকে বাদ দিতে চায়, তা চাইতেই পারে। চাইতে আর দোষ কি? আসমান থেকে কমলা খাওয়ার কারও শখ হলে হতেই পারে, সেটা বাস্তব কিনা বিচার করে দেখতে হবে। আমি তার বীরউত্তম খেতাব নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আগে মনে করতাম এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধে না জানি কত কী করেছেন। সেনা, বিমান, নৌবাহিনীর মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ হওয়ায় তার আরও বড় কিছু পাওয়া উচিত ছিল। এ ক'বছরে তার কাছে নিজেকে বেশ হীনমন্য মনে করতাম। আমার থেকে ১৭ বছরের বড়, আমি যে বছর জন্মেছি সে বছর তিনি মেট্রিক পাস করেছেন। মেট্রিক আবার এখন অনেকেই বুঝবে না। এখন মেট্রিকের জায়গায় SSC। আইএ, আইকম, আইএসসি এর স্থলে HSC। তাই সব সময় মনে হতো জনাব খন্দকারও বীরউত্তম, আমি লাচার, আনপর, এক সময়ের সেনাবাহিনীর সামান্য সিপাই কী করে বীরউত্তম হই। এখন দেখছি আমাদের সঙ্গে বড় জালিয়াতি করা হয়েছে, ভীষণ ঠকানো হয়েছে সাধারণ যোদ্ধাদের, নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে জনসাধারণকে। এর কোনো বিচার হবে এখন আর তেমনটা আশা করি না। কিন্তু এ কে খন্দকার বই লিখে আমাদের প্রতি, গণমানুষের প্রতি যে অন্যায় করেছেন সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাবের কাইটেরিয়া ছিল, যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখবে তাকে শ্রেণীমতো খেতাব দেওয়া হবে। সাহসিকতা বিবেচনায় যাকে যে খেতাবই দেওয়া হোক প্রধান শর্তই হবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ। সেটা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত অথবা শত্রুকে আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ করে যেভাবেই হোক। মূল কথা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। যে কারণে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এমএজি আতাউল গনি ওসমানীকে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়া হয়নি বা তিনি নেননি। খেতাব পাননি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক, একজন MNA, MP-কেও দেওয়া হয়নি। যুবনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক খেতাব পাননি। ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব, আবদুল কদ্দুস মাখন কাউকে দেওয়া হয়নি। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ছাড়া বীরত্বসূচক খেতাবের প্রশ্ন এলে ওই সময়ের MNA, MP যারা পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তারা ছাড়া সবাইকে খেতাব না দিয়ে উপায় কোথায়? ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন আরও যারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ছিল তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সবাইকেসহ সব জেলা শাখার অন্তত সভাপতি সেক্রেটারিকে অবশ্যই খেতাব দিতে হয়। ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক চট্টগ্রামের স্বপন, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বা সভাপতি দাউদকান্দির দাশপাড়ার নজরুল এদের খেতাব না দিয়ে উপায় কী? সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি কেন পাননি? এ জন্য পাননি বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক এ বীরত্বসূচক খেতাবগুলো দেওয়া হয়েছে প্রত্যক্ষ যোদ্ধাদের। যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তাদের। ২৩২ পৃষ্ঠার খন্দকারের বইয়ে কোথাও তার সরাসরি কোনো যুদ্ধে অংশ নেওয়া, এমনকি কোনো যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ারও তো কোনো ঘটনা দেখলাম না। তাহলে তিনি খেতাব পেলেন কী করে? নাকি নিজে খেতাব বিতরণ কমিটির সভাপতি ছিলেন, তার জুনিয়ররা কমিটিতে ছিলেন বলে নিজেরটা নিজেই বাগিয়ে নিয়েছেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়। তিনি লিখেছেন, ৪ঠা মার্চ ১৯৬৯ পর্যন্ত একনাগাড়ে ২০ বছর পাকিস্তানে থেকে স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে ঢাকার দায়িত্ব নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এর আগে বাঙালির গৌরব '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-র যুক্তফ্রন্টের বিজয়, '৬৬-র ৬ দফা, '৬৯-র ১১ দফা ও গণঅভ্যুত্থানের কিছুই জানতেন না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় লাখো মানুষ সংগ্রাম করে জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে এর কিছুই নাকি তার জানা ছিল না। সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদও তার 'শান্তির স্বপ্নে' বইয়ে '৭১-এর অক্টোবরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা আসার আগে বাংলাদেশে কী হয়েছে তার কিছুই জানতেন না। মানে সব এক গোয়ালের গরু। মইন ইউ আহমেদের বই থেকেই আগামী পর্বে কিছু তুলে দেব। তার বীরউত্তম খেতাবে বলা হয়েছে- "আব্দুল করিম খন্দকার (এ কে. খন্দকার) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান বাতিল এবং তৎপরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে তিনি অধীনস্থ এমওডিসি কমান্ডারের মাধ্যমে বাঙালি এমওডিসিদের ছুটি নিয়ে এবং সম্ভব হলে অস্ত্রসহ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনায় তিনি পাকিস্তানিদের মনোভাব বুঝতে পেরে বিদ্রোহ করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ২৫ মার্চ রাতের ক্র্যাক ডাউনের পর দুই দিনের ছুটি নিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ১৫ মে তিনি উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিন, ফ্লাইট লে. সুলতান, ফ্লাইট লে. কাদের, এক্স ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলমসহ আগরতলা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে একটি বিমান বাহিনী গঠনের উদ্দেশে তিনি ১৯-২০ মে দিলি্ল যান। সময় আসলে সাহায্য করা হবে- এ আশ্বাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলে মে মাসের শেষদিকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে তিনি স্থলযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য রিক্রুটমেন্ট ট্রেনিং, ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র করে বিভিন্ন সেক্টরে প্রেরণ করা ছিল তার প্রধানতম দায়িত্ব। তিনি অত্যন্ত কুশলতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতের নাগাল্যান্ড ডিমাপুরে গঠন করেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীকে তিনি অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেন। উন্নততর যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কৌশল প্রয়োগ করে নিখুঁত নিশানায় বোমাবর্ষণ করে শত্রুবাহিনীর সরবরাহ লাইন ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হন। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন।

যুদ্ধের রসদ সংগ্রহ, বহিঃবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, যুুদ্ধ কৌশল নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশের সেনাপ্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময়, সর্বোপরি সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত করা হয়।"

জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা ধ্বংস করে নাপাক হানাদার জল্লাদ বাহিনীকে কত টাকা খেয়ে পাকবাহিনী লিখেছেন তা শুধু আল্লাহ পাকই জানেন। এসব পণ্ডিতের কাছে খুন-খারাবি, নারী ধর্ষণ করেও হানাদাররা পাক, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মনে হয় নাপাক। 'একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাথা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রন্থে' যেভাবে তার বীরউত্তম খেতাব নিয়ে লিখেছেন, সেখানে কোথাও কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা নেই। কথা আছে, দু'চারজনকে তিনি যুদ্ধের আগে পরামর্শ দিয়েছেন। ১৫ মে ভারতে গিয়ে ১৯ মে পায়ে হেঁটে নয়, বিমানে চড়ে দিলি্ল যান। মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করেন, ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান- এসব তো আরও অনেকেই করেছে। বারাঙ্গাপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে বর্তমান ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান প্রায় ৩০ হাজার যুবককে রক্ষণাবেক্ষণ, দেখাশোনা করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। তাহলে তাকে কেন দেওয়া হলো না? তিনি সবসময় রণাঙ্গনের কাছাকাছি থেকেছেন। যে ১৫ মে তিনি ভারতে গেছেন তার ৩ দিন আগে ১২ মে আমরা বল্লার যুদ্ধে হানাদারদের তছনছ করে দিয়েছিলাম। সে যুদ্ধ শুধু পরিচালনা করিনি, নিজে করেছি। ভদ্রলোক ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দখল করা ঢাকায় হেলিকপ্টারে উড়ে এসে সন্ধ্যার আগেই আবার ভারত চলে গেলেন, তিনিও বীরউত্তম, আর আমিও বীরউত্তম। এ কেমন বিচার? একে কোন ন্যায়বিচার বলে? এ তো ন্যায়বিচার হতে পারে না, এসব তো ঘোরতর অন্যায়। ২৫ মার্চের বেশ ক'দিন আগে থেকেই ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক ছোটাছুটি করছিলেন। সাধ্যমতো যা করা সম্ভব তা করেছেন। জনাব জিয়াউর রহমানকে যুদ্ধে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানাতে গিয়ে পাগল ছাগল গালি শুনে অপমানিত হয়ে ফিরেছিলেন। ৪ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সেখান থেকে হবিগঞ্জের শমশেরনগর সীমান্তে নকশালী দমন করতে পাঠানো হয়েছিল। তারা ২৫ মার্চ নয়, দেশের অবস্থা দেখে তার আগেই তাদের কোম্পানির অবাঙালি কমান্ডার এবং অন্যদের বন্দী করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। জনাব খন্দকারের কৃতিত্বে এসবের লেশমাত্র দেখছি না। বউ-পোলাপান নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা, ১৯-২০ তারিখ দিলি্ল গিয়ে বিমানবাহিনী গঠন সম্পর্কে আলোচনা করে ভবিষ্যতে সময় সুযোগ হলে হবে আশ্বাস পাওয়া আর কলকাতা নিউমার্কেটে ঘুরার সময় সরকারের নির্দেশে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসা এবং ফিরে যাওয়া, এই কৃতিত্বে কী করে বীরউত্তম হন। বীরউত্তমের জন্য আরও কিছু করা বা বীরত্ব দেখানো দরকার, যার ছিটেফোঁটাও তো দেখছি না। কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এলেও না হয় ভাবতাম চলি্লশোধর্্ব একজন মানুষ কষ্ট করে এসেছেন তাতে বীরউত্তম দিলেও না হয় সান্ত্বনা পাওয়া যেত। কিন্তু কোনো যুদ্ধে অংশ না নিয়ে খেতাব নেওয়া এ তো দেখছি একেবারে পুরোদস্তুর জালিয়াতি।

তিনি বীরউত্তম কেন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব নিতেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানের সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে যে কয়টা জেড ছিল, হেলিকপ্টার ছিল সব কয়টা নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে যেতেন, বীরউত্তম কেন, যা চাইতেন তাই নিতেন। তা কি গেছেন? যাননি। সবকয়টি বিমান উড়িয়ে দিয়ে যেতেন, সব কয়টা না পারতেন, দু-একটাতে আগুন ধরিয়ে দিতেন- কোনো আপত্তি করতাম না। আর কিছু না হোক একটা জেড-এ উঠে সীমান্তের কাছাকাছি প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ে বীরউত্তম হতেন। আর কিছু না পারতেন জেড এবং হেলিকপ্টারের তেলের ট্যাঙ্কে এক ছটাক করে চিনি দিয়ে যেতেন, তাও তো করেননি বা করতে পারেননি। তাহলে অমন জালিয়াতি কেন করতে গেলেন? বিমান বাহিনী নিয়ে লিখেছেন, সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ বিমান বাহিনী গঠিত হয়, ৩ ডিসেম্বর বোমারু বিমান নিয়ে চট্টগ্রামে এবং অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ তেলের ডিপোতে বোমা ফেলে তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেন। সে কাজ তো তিনি করেননি, পাইলট সুলতান মাহমুদ, কো-পাইলট বদরুল আলম আর সার্জেন্ট শাহাবউদ্দিন বীরপ্রতীক করেছেন। সেখানে যে গল্প ফেঁদেছেন তা একেবারে অবিশ্বাস্য। এ যেন বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানোর প্রবণতা। শত্রুকবলিত দুই-আড়াইশ কিলোমিটার দিনেই আসা যেত না, ওভাবে রাতের অন্ধকারে শত্রুর পেটের ভিতর আসা যায়? কী করে অতটা এলেন? আর অতটা পথ পাড়ি জমিয়ে নিরাপদে বোমা ফেলে চলে গেলেন? এক জায়গায় বলেছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উপর দিয়ে বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে তার ক্যাডাররা হেলিকপ্টার চালিয়ে বাজিমাত করেছিল। ওটা রিকশা বা গরুর গাড়ি ছিল না, যে কোনো দিকে গেলে খবর থাকে না। লক বুক দেখলেই থলির বিড়াল বেরিয়ে আসবে। কবে কতক্ষণ কোনো বিমান, হেলিকপ্টার আকাশে উড়েছে সব রেকর্ড থাকে। সেই অভিযানের কথা ১২ ডিসেম্বরের পরে হলে না হয় মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর অভিযান হওয়ায় কেন যেন সন্দেহের সৃষ্টি হয়। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে ২ জন পাইলট, ৫ জন প্যাসেঞ্জার বহন করা যায়। হেলিকপ্টার লম্বা ৩৩ ফুট, পাখা ৩৬ ফুট ১ ইঞ্চি, উচ্চতা ১০-১১ ফুট। নিজস্ব ওজন ১১৪৩ কেজি। বহন করার ক্ষমতা সব মিলিয়ে ২২০০ কেজি। ফুল ট্যাঙ্ক তেল নেওয়া যায় ৫২৫ লিটার। সর্বোচ্চ স্প্রিড ২১০ কিমি। হেলিকপ্টার কখনো ১২০-৩০ নটিক্যাল মাইলের বেশি চালানো হয় না। একটানা পৌনে ৩ ঘণ্টা চলতে পারে। তাতে সর্বোচ্চ দূরত্ব পার করতে পারে ৫০০ কিমি। এই ধরনের হেলিকপ্টারে নারায়ণগঞ্জ এসে বোমা ফেলা বিশ্বাস করার মতো? তাও আবার শীতলক্ষ্যার পানির উপর ও বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে হেলিকপ্টার চালানো কে বিশ্বাস করবে? তার চেয়ে বরং আগামী দু-এক মাসের মধ্যে জনাব খন্দকার একটা হেলিকপ্টার শীতলক্ষ্যায় বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে চালিয়ে দেখিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। প্রশ্নটা প্রথম প্রথম আমার মনেও আসেনি।

আড়াইহাজারের আমাদের প্রবীণ নেতা খোকন জসিম, সেদিন বলছিল বিদ্যুতের তারের নিচ দিয়ে কোনো সময় পাখি গেলে মাঝে মধ্যে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সেখানে হেলিকপ্টার গেল কী করে? খোকন জসিমের প্রশ্নের উত্তর তো জনাব খন্দকারকে দিতেই হবে। কারণ প্রশ্নটা তো শুধু তার একার নয়।

লেখক : বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, রাজনীতিক।

Monday, 22 September 2014

ইতিহাস
এ কে খন্দকারের বই সম্পর্কে কিছু কথা 

বদরুদ্দীন উমর আমার দীর্ঘকালের বন্ধু, অতি আপনজন। কোনো কোনো বিষয়ে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করি। তবে এ নিয়ে উমরের সঙ্গে আমি কখনও আলোচনা ও তর্ক করতে চাইনি। বদরুদ্দীন উমরের মতো আমার প্রিয় বন্ধু মঈদুল হাসান। তারা দু'জনেই পণ্ডিত মানুষ, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং করেন। আমি তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনি কিন্তু তাদের সব কথা মেনে না নিলেও উত্তর দেই না বা তাদের সঙ্গে তর্ক বা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ি না। আমি শান্তি ও সৌহার্দ্যে বিশ্বাস করি। এই দুই বন্ধুকে হারাতে চাই না। বন্ধুরা হয়তো মনে করতে পারেন আমি পণ্ডিতের খোলস পরে বসে আছি; কিন্তু আমি আসলে একটা মূর্খ ও নির্বোধ জীব, কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার এই লেখা পড়ে এই বন্ধুরা যদি আমার ওপর রাগ করে আমাকে ত্যাগ করতে চান, আমি কিন্তু তাদের ছাড়ছি না। মতবিরোধ যতই থাকুক, মনের মিল তো কোনোদিন নষ্ট হওয়ার নয়।


আমার বয়স হয়েছে, নব্বই পার হয়ে গেছে; আজকাল লেখালেখি করতে খুব কষ্ট হয়। তবু এই লেখাটি লিখতে বসেছি বলতে পারেন নেহাত বিবেকের তাগিদে। গত ১২ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর 'খন্দকারের বই ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' শীর্ষক একটি অগি্নগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটি পড়ে তৎক্ষণাৎ আমার যে প্রতিক্রিয়া হলো সেটাই আমার এ লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করছি।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি। এটা ছিল দীর্ঘকালের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অমোঘ ফলশ্রুতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের প্রথম দিকে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন এই ভেবে যে, এতে এ অঞ্চলের মুসলমানরা, যারা ছিল সর্বক্ষেত্রে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ_ তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিলে শেরেবাংলা ফজলুল হকের উপস্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব এই দুই অঞ্চলে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ_ এই দুই অঞ্চলে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র (ওহফবঢ়বহফবহঃ ধহফ ঝড়াবৎবরমহ ঝঃধঃবং) প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে দিলি্লতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা স্রেফ ছলচাতুরীর মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবকে পরিবর্তন করে দুই রাষ্ট্রের বদলে এক রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম, যিনি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তিনি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন_ এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে বদলানো যায় না। কিন্তু আবুল হাশিমের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে দুই পাকিস্তানের জায়গায় একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তখন থেকেই তার মনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল।

মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতাদের বাঙালিবিরোধী চক্রান্ত সম্পর্কে শেখ সাহেব সজাগ হতে শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সময় অনেক বাঙালি মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মনেও এই চিন্তাভাবনা জাগ্রত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পরই যখন কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করল, তখনই শুরু হয়ে গেল আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটল। 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি_' মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই অমর উক্তির মধ্যে নিহিত ছিল এই নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানরা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর ভাষায় 'পাকিস্তান জ্বরে আক্রান্ত', 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' ও ইসলামী জোশ-এর উন্মাদনা তখনও কাটেনি। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লেই বোঝা যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি ভাবছিলেন কীভাবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। স্বাধীনতা কথাটি উচ্চারণ করাই তখন অসম্ভব ছিল। শেখ মুজিব প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ববাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাদের প্রধান শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বশংবদ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ঘোষণা করেছিলেন, যতদিন তিনি গভর্নর পদে থাকবেন, শেখ মুজিবকে জেলে থাকতে হবে।

বস্তুত ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাহিনীর লোকেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর কিংবা হয়তো কিছুকাল আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এবং ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে গোপনে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নভাবে কর্মতৎপরতার কথা জানা যায়। এমনকি সুদূর লন্ডনে ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল' জারির বেশ আগে থেকেই ব্রিটেনে বসবাসরত কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবী গোপনীয় কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ শুরু করেছিলেন। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে পেঁৗছাই ৩০ সেপ্টেম্বর (১৯৫৮)। তার ৭-৮ দিন পরই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা মার্শাল ল' জারি করে। লন্ডন যাওয়ার কয়েক মাস পর হঠাৎ আমীর-উল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো ঝঙঅঝ-এর লাউঞ্জে। এই যুবক এবং ব্যারিস্টারি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। তিনি নিম্নস্বরে বললেন, পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আলাপ করতে চান। তিনি আমাকে হাতে কবিরউদ্দীন আহমদের লেখা একটি পুস্তিকা দেন_ যার শিরোনাম ছিল 'টহযধঢ়ঢ়ু ঊধংঃ চধশরংঃধহ'. এটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে কীভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বঞ্চিত ও শোষণ করা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে, তার বিস্তৃত বিবরণ পরিসংখ্যানসহ দেওয়া ছিল। আমীর আমাকে বললেন, এটা গোপন দলিল, আমি যেন বাসায় নিয়ে পড়ি। তিনি উত্তর লন্ডনের ক্ল্যাপহাম অঞ্চলের একটা ঠিকানা দিয়ে বললেন, আমি যেন নির্দিষ্ট দিনে ওখানে যাই। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে এসেছি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কাজ করতে। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওহফরধ ঙভভরপব খরনৎধৎু-তে কাজ করি। তবু এক সন্ধ্যায় আমীর সাহেবের বাসায় গেলাম। সেখানে দেখি ১০-১২ জন বাঙালি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তরিকুল আলম, জাকারিয়া চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। কয়েকদিন আগে ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে দেখা হলে জানালেন, তিনিও ওই বৈঠকে যোগ দিতেন। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে ঢাকা থেকে আমার পুরনো বন্ধু কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ইৎরঃরংয ঈড়ঁহপরষ-এর ংযড়ৎঃ ঃবৎস ঋবষষড়ংিযরঢ় নিয়ে লন্ডনে এলো। জহুর আসায় আমাদের বৈঠক প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সে কথা জহুর বারবার বলল। সে বলত, পাকিস্তান সৃষ্টি করে আমরা যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ নেই_ এ কথার ওপর জোর দিত।

১৯৬০ সালের শেষ দিকে বদরুদ্দীন উমরও অক্সফোর্ডে এসেছিল। আমি ওকে আমাদের বৈঠকে নিয়ে গেলাম। উমর আসায় আমাদের বৈঠক আরও সজীব হয়ে উঠল। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার এবং বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। উমর এবং আমার পড়াশোনা ও গবেষণার চাপে আমীরের গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। তবে জহুর থাকতেই এই ভাবনা হয়েছিল যে, আমাদের জীবদ্দশায় বোধহয় পাকিস্তানের কবল থেকে দেশ স্বাধীন হবে না। তবুও আমরা স্বাধীনতার পথে পূর্বসূরির কাজ করে গেলাম। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী এই গোষ্ঠীর নাম নেওয়া হলো 'পূর্বসূরি'। এত কথা বললাম এই জন্য, সুদূর লন্ডনে বসে সেই ১৯৪৮-৬০ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আমরা যে কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম এবং পরে জানতে পেরেছি আমাদের দেশের মধ্যেও এ ধরনের চিন্তাভাবনা অনেকেই গোপনে করে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কীভাবে ধাপে ধাপে তিনি দেশকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব নয়। সম্প্রতি শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিবিদ, যাকে বাংলাদেশ সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য সম্মাননা দিয়েছে, তার একটি বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৬৩-৬৪ সালে যখন তিনি ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনে জুনিয়র কর্মকর্তা, তখন গোপনে ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব তার সঙ্গে দেখা করেন। শেখ মুজিব জানতে চান যে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলে ভারত সরকার সাহায্য করবে কি-না কিংবা কতটা সাহায্য করবে। শশাঙ্ক বাবু শেখ মুজিবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গোপন পথে আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শেখ মুজিব সেখানে পেঁৗছালে তাকে পরিষ্কারভাবে বলা হয়, নেহরু সরকার এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দিতে পারবে না। শেখ সাহেব বিফল মনোরথ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। সে সময় ভারত সরকারের পক্ষে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না স্রেফ নিজস্ব নিরাপত্তার কারণে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ হয়ে গেছে এবং সে যুদ্ধে ভারত ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। চীনের কাছে এই লজ্জাকর পরাজয় নেহরুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় আধুনিক ভারতের রূপকার এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জওয়াহেরলাল নেহরু মৃত্যুবরণ করেন।

ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো অনেক বাঙালি নেতা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছেন। পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রধান নেতায় পরিণত হন। নিজের পরিকল্পনামতো আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শ অনুসরণ করে পূর্ব বাংলার সব সম্প্রদায়ের মানুষ_ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হলেন। শেখ সাহেবের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি অনুসরণ করে বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যা তার আগে কোনো নেতা পারেননি। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় থেকে জনসচেতনতা বাড়তে লাগল। জনমনে প্রশ্ন জাগল, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে আমাদের কী লাভ? এই চিন্তাধারাকে শেখ মুজিব রূপায়িত করলেন তার ঐতিহাসিক 'ছয় দফায়'। সেখানে বলা হলো, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি ছাড়া সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে। আলাদা মুদ্রার ও প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করার প্রস্তাবও করা হলো। বস্তুত বলা যেতে পারে, ছয় দফা দাবির মধ্যে ছিল স্বাধীনতার পূর্বাভাস। সামরিক শাসক আইয়ুব খান সেটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তীব্রভাবে দমননীতি শুরু করে। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। কিন্তু ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে শেখ সাহেবকে মুক্তি দিল। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন যে, 'এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বলে অভিহিত করা হবে।' এটা ছিল বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক ঘোষণা। পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর আইডিয়া ছিল আমাদের স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু যেতে হবে ধাপে ধাপে। জনগণের কাছে সেটি গৃহীত হতে হবে, পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। 'আমরা স্বাধীন হলাম'_ এ কথা না বলে পাক সামরিক শাসকদের নাকের ডগায় বসে তিনি বলেছিলেন, 'যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং ... রাস্তাঘাট যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।'

তিনি বলেন, 'আমরা [শত্রুদের] ভাতে মারব, পানিতে মারব।' ওই ভাষণে তিনি পাক সৈন্যদের ব্যারাকে গিয়ে থাকতে বললেন এবং যদি তারা না যায় এবং বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে, তা হলে তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, 'তোমরা আমার ভাই_ তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।' বঙ্গবন্ধু তার ওই ভাষণের শেষের দিকে বললেন, '... যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব_ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'

আমি এবং আমার মতো অগণিত লোক যারা রেসকোর্স ময়দানে সেই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শেখ সাহেবের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনছিলাম, তারা শুনলাম, বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শেষ করলেন 'জয় বাংলা' বলে। ওই সময় লোকজন বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিচ্ছিল, সেই হট্টগোলের মধ্যে তিনি জয় বাংলার পর 'জয় পাকিস্তান' কিংবা 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'ও বলেছিলেন কি-না আমি শুনতে পাইনি। আমি বলব, যদি বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেও থাকেন, তাহলে কোনো দোষ ছিল না। স্বাধীনতার পক্ষে এত কথা বলার পর জয় পাকিস্তান বলে পাকিস্তানি শাসকদের স্রেফ বিভ্রান্ত করতে নেহাত কৌশলগত কারণে তিনি এ কথা বলতে পারেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নাগের ডগায় বসে স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করা ছিল দুঃসাহসিক কাজ।

বন্ধুবর বদরুদ্দীন উমর এ কে খন্দকারের বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন : ''তিনি (শেখ মুজিব) যদি জনগণের ওপর নির্ভরশীল হতেন এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন তা হলে ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানের বক্তৃতার শেষে দেশের লোককে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরির আহ্বান না জানিয়ে এবং বক্তৃতার শেষে 'জয় পাকিস্তান' না বলে ওই মহাসমাবেশেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সমবেত লাখ লাখ মানুষকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে পরিচালিত করতেন এবং বাঙালি সামরিক লোকদের ক্যান্টনমেন্টের দখল নেওয়ার আহ্বান জানাতেন। বিমানবন্দর দখল সহজ হতো এবং তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের সংখ্যা কম থাকায় জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি সামরিক সদস্যরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করতেন। সেই সংঘর্ষে হাজার হাজার লোক নিহত হতে পারত কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ওইদিনই পাকিস্তান সরকারের পতন হতো।" উমরের এই বক্তব্য পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেছি। তিনি তো ফরাসি বিপ্লব ও তার পরবর্তীকালের ইতিহাস ভালো করে পড়েছেন। তিনি কি ভুলে গেছেন ১৮৭১ সালে ফরাসি-জার্মান যুদ্ধে লুই ফিলিপ, যিনি নিজেকে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তার পতনের পর নতুন ফরাসি সরকারের আমলে প্যারিস কম্যুনের বিপ্লবকে কী নৃশংসভাবে ফরাসি সৈন্যবাহিনী দমন করেছিল? প্যারিসের বিপ্লবী জনতার ওপর সৈন্যবাহিনী কামানের গোলা চালিয়ে হাজার হাজার ফরাসিকে হত্যা করে কম্যুনকে ধ্বংস করেছিল। শেখ মুজিব যদি উমরের কথামতো লাখো জনতা নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্ট দখল করার চেষ্টা করতেন, তাহলে অবাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা সংখ্যায় যতই কম হোক তাদের হাতে প্রচুর ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ ছিল, তারা নির্বিচারে কামান দেগে শেখ মুজিবসহ লাখো বাঙালিকে হত্যা করত। বাইরের কোনো শক্তি আমাদের রক্ষা করতে আসত না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো। আমরা চিরদিনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের গোলাম হয়ে থাকতাম।

এবার খন্দকার সাহেব ও বাঙালি সামরিক অফিসারদের কথা বলি। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে একাধিকবার শেখ সাহেবের কাছে পরামর্শ ও নির্দেশের জন্য গেছেন; কিন্তু শেখ সাহেব তাদের আশ্বাস দিতে পারেননি। এ জন্য খন্দকার সাহেবরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। শেখ সাহেব কেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি তার কারণ ছিল। আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের হাতে কি বড় যুদ্ধ করার মতো ভারী অস্ত্র ছিল? অস্ত্র পাওয়া যেত একমাত্র ভারতের কাছ থেকে। কিন্তু ওই সময় ভারত কেন অস্ত্র দিতে যাবে? ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বাঙালিদের কোনো কার্যক্রমে বড় আকারের সাহায্য করতে ওই সময় প্রস্তুত ছিল না। যদি ভারত সে রকম করত, তখনই পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করত এই অজুহাতে যে, ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে বিনষ্ট করতে চায়। সে সুযোগে চীন ১৯৬২ সালের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আক্রমণ করে বসত, সে আক্রমণকে প্রতিহত করার ক্ষমতা ভারতের ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও আমরা সমর্থন পেতাম না। খন্দকার সাহেব ও অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি দিতেন তাহলে ক্ষিপ্রগতিতে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকবাহিনী আমাদের শেষ করে দিত। আমাদের অবস্থা নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার মতো হতো।

সে সময় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যত কমই থাকুক, তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। এই উপলব্ধি আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের ছিল না মোটেই, যদিও তারা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কোনো কন্টিনজেন্ট প্ল্যান ছিল না। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর একটা গোপনীয় সমঝোতা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত ভারত অপেক্ষা করবে।

বস্তুত মার্চ-এপ্রিল ১৯৭১ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাদের অনুকূলে ছিল না। বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তখন আমরা এর শিকার হয়েছিলাম। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে আমেরিকা; আবার কমিউনিস্ট চীনের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকা চীনের কাছে আসার চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে চীন ও আমেরিকার পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুধু এই দুই পরাশক্তি নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তথা মুসলিম উম্মাহ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপক্ষে। একদিকে জাতিসংঘের পক্ষেও আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করার সম্ভাবনা ছিল না প্রধানত এই কারণে যে, জাতিসংঘের সনদে রয়েছে কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ তারা কখনও সমর্থন করবে না। সে পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলে টিকতেই পারত না। সুতরাং বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, ধাপে ধাপে সাবধানে আমাদের এগোতে হবে। এ কে খন্দকার সাহেব তার বইয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লিখেছেন, ভারত সরকার আমাদের মুক্তিবাহিনীকে যথেষ্টভাবে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল না। তখন ভারত চায়নি মুক্তিবাহিনী ভারতের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের বাহিনীর সঙ্গে কোনো বড় রকম সংঘর্ষে লিপ্ত হোক। তা হলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। ভারত সময় চাচ্ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে। তাছাড়া ভারত শীতের আগে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়নি। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ যখন উত্তর-পশ্চিম হিমালয় বরফে ঢেকে যাবে সে সময় চীনের পক্ষে ওই অঞ্চল থেকে সৈন্য নামিয়ে ভারত আক্রমণ করতে পারবে না। এপ্রিল থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি অসহায় মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং এর ফলে ভারতের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন বিশ্ববাসীকে সচেতন করে দিতে। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরস্পরকে সাহায্য করার বন্ধুত্ব চুক্তি সই হয়ে গেছে। ভারতের রণকৌশল ছিল, আমাদের মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকসেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখবে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ-সাধারণ মানুষ ভারত সৈন্যবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
একটা প্রশ্ন অনেকেই করেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাক সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিলেন কেন? পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর যে ছবিটি প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, তিনি অত্যন্ত শান্ত, অবিচলিত ও আত্মমর্যাদাসহ করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জের একটি সোফায় বসে আছেন। তার চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই; বরং একটা প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ সুস্পষ্ট। বস্তুত তিনি জীবনের বাজি রেখে নির্ভীক ও শান্তভাবে মৃত্যুভয়কে জয় করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানিরা তাকে হয়তো মেরে ফেলতে পারে কিন্তু বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবেই_ এ বিশ্বাস তার অটুট ছিল। ২৫ মার্চ রাতে যখন তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম শেখ সাহেবকে তাদের সঙ্গে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করছিলেন, তখন শেখ সাহেব তাদের চলে যেতে বলেন। 'তোমরা চলে যাও, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।' এ কথা তাজউদ্দীনকন্যা রিমি লিখেছেন তার বইয়ে।

পরিশেষে এ কে খন্দকার সাহেব সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। তরুণ বয়সে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। গভীর স্বদেশপ্রেমের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমি বলব আমাদের অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তা সম্পর্কে এ কথা বলা যায়। স্নেহভাজন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার একটা বইয়ে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর কাকুল মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষণের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এ কে খন্দকার সাহেবের মতো আমাদের বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা গভীর স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করেছেন, অনেকে শহীদও হয়েছেন। তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে আমরা যেন কোনো কার্পণ্য না করি। খন্দকার সাহেব তার সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে যা মনে হয়েছে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। বলতে হয় অত্যন্ত সীমিত প্রেক্ষাপটে, সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি উনিশশ' একাত্তরের জটিল পরিস্থিতিকে নিরীক্ষণ করেছেন, যার প্রকাশ তার বইয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।

যারা খন্দকার সাহেবের বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে তার সম্পর্কে অশালীন উক্তি করেছেন তাদের আমি সমর্থন করি না। খন্দকার সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন। সেই ব্যাপারটাকে সম্মান জানানো দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয় সম্পর্কে মতপার্থক্য হলেও তাদের অবদানের কথা মনে করে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের কর্তব্য। তেমন যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে নিজেদেরই অসম্মান করব।

# প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ
জাতীয় অধ্যাপক; প্রাক্তন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
www.samakal.net/2014/09/22/87696


Friday, 19 September 2014

একটি অগ্রহণযোগ্য বই -- মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

একে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটি এইমাত্র হাতে পেলাম। গুলশান ১-এর সিগনালে একজন বই বিক্রেতা সাদা পলিথিনে মোড়া বইটি বাড়িয়ে দিলে দাম চুকিয়ে বাড়ি এসে খুলে দেখি বইটির ফটোকপি বাজারে ছাড়া হয়েছে! সুন্দর করে পলিথিনে মোড়ানো থাকায় না খোলা পর্যন্ত বিষয়টি বোঝার উপায় ছিল না। অর্থাৎ বইটি বিক্রিতে জালিয়াতি শুরু হয়েছে। যা হোক, এক দমে প্রায় অর্ধেক পড়ে মনে হল, বইটির ভেতরেও জালিয়াতি আছে। ওই পর্যন্ত পড়ে আমার মনেই হল না যে, বইটি একে খন্দকারের লেখা। প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করে লেখা শুরু করা হয়েছে। বারবার তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি বাঙালিদের লুটেরা বলা হয়েছে। আমি বইটির ৩০ পৃষ্ঠার ২৫ লাইন থেকে ২৮ লাইন পর্যন্ত এখানে উদ্ধৃত করলাম : ‘অবাঙালিরা নিরাপত্তার জন্য ঢাকা ছেড়ে যখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকা বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের সোনার গয়না, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা।’ পক্ষান্তরে ২০ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘১৮ বছর পাকিস্তান অবস্থানকালে আমি পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছি... তারা সবসময় আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি যত্নবান ছিলেন।’ পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন এ কথাটি যেমন তার কাছে এই প্রথম শুনলাম, তেমনি ’৭১-এর মার্চে পাকিস্তানিদের সোনার গয়না, টাকা-পয়সা বাঙালিরা লুট করেছে সে কথাও প্রথম জানলাম। এসব লুটতরাজের ক্ষেত্রে তিনি ‘বাঙালিরা’ শব্দটি ব্যবহার করায় যার-পর-নাই অবাক হয়েছি। জনাব খন্দকারকে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন করব : প্যারিসের রাস্তায় চলার পথে দুর্বৃত্তরা আমাদের রাষ্ট্রদূতের গাড়ির কাচ ভেঙে তার ব্রিফকেস, মোবাইলসহ যাবতীয় সামগ্রী নিয়ে গেছে, লন্ডন থেকে আগত এক বাঙালির ব্রিফকেসভর্তি টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে, আমার পকেট থেকে নগদ ডলার, ক্রেডিট কার্ড চুরি করেছে- তাই বলে কি আমরা বলব যে, ফরাসিরা আমাদের টাকা-পয়সা-সম্পদ লুটতরাজ করেছে? দুই-চারজন চোর-ডাকাতের জন্য কি ‘ফরাসিরা’ শব্দটি ব্যবহার করা যায় বা যেত? অথচ খন্দকার সাহেব অবলীলায় বলে দিয়েছেন, ‘লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা।’ কিছু দুষ্কৃতকারীর অপকর্মকে ‘বাঙালিরা’ বলে উল্লেখ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বঙ্গবন্ধুকে পদে পদে দোষারোপ করা হয়েছে। দোষারোপ করা হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে! বারবার বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলে বাঙালিদের এত ক্ষতি হতো না। এত প্রাণহানি ঘটত না ইত্যাদি। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বা ঘোষণাকে খাটো করে দেখাতেও তিনি কসুর করেননি। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা জয় পাকিস্তান’। আবার পরবর্তী লাইন লিখেছেন, তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, ‘জয় পাকিস্তান’। এক্ষেত্রে তার কাছে আবারও প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ডাক দিলেন একথা স্বীকার করার পরও তিনি কেন বারবার বলছেন, বঙ্গবন্ধু কোনো সিদ্ধান্ত দেননি? আসলে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত জানার, শোনার বা বোঝার কোনো ইচ্ছা, ধৈর্য বা শক্তি একে খন্দকারের সে সময়ও ছিল না, এখনও নেই। কারণ সে সময়ে তিনি ছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের কর্মকর্তা এবং বর্তমানে আলঝেইমার রোগী। মাঝখানে ১৯৭১ সালে তিনি বাইচান্স পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং পাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অনেক পরে মে মাসে পাক এয়ারফোর্সের চাকরি বহাল রেখে তিন মাসের ছুটি নিয়ে আগরতলায় গিয়েছিলেন। তার তিন মাসের ছুটি মঞ্জুর হওয়ায় তিনি জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত পাক এয়ারফোর্সে চাকরিরত ছিলেন।

যাক সে কথা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যা বলছিলাম, সে কথায় ফিরে আসি। জনাব খন্দকার তার বইয়ে ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’কে হাইলাইট না করে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ দুটি বাক্যকে প্রাধান্য দিয়ে যদি একটু চিন্তাভাবনা করতেন, বাক্য দুটিকে তার মস্তিষ্কে যদি একটু ভালোভাবে জায়গা করে দিতেন, তাহলে হয়তো তার কলম দিয়ে অন্যকিছু বের হতো। জনাব তাজউদ্দীন আহমদের লেখা খসড়া ঘোষণাপত্র রেকর্ড করা না-করা নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেক্ষেত্রেও একই কথা বলব। কারণ যা বলার বা ঘোষণা করার তা তিনি ৭ মার্চের ভাষণেই করে রেখেছিলেন। সেদিনের ভাষণে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করবা ইত্যাদি কথা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যময়। এসব না বলে সেদিন বা পরে তিনি যদি সরাসরি (নষঁহঃষু) বলতেন, আজ এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নাম দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হল, তাহলে সেটাই হতো স্থূল বুদ্ধির কাজ। এমনকি ২৫ মার্চ রাতেও যদি তিনি কোনো ঘোষণা দিতেন, তাতে করে কোটি কোটি মানুষ তার ডাকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ শুরু করে দিতেন এবং সেই অসম যুদ্ধে আরও কয়েক গুণ লোকের প্রাণ যেত। তাছাড়া সেক্ষেত্রে পাকবাহিনী বাঙালিদেরই আক্রমণকারী হিসেবে বিশ্বের সামনে প্রমাণ করত। বঙ্গবন্ধু নিজেকে এবং দেশের মানুষকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ পাকিস্তানিদের দেননি। ভুলে গেলে চলবে না যে, ৭ মার্চ বা ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে এ দেশটি ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাচনে বিজয়ী সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এই স্বল্প পরিসরে এ বিষয়ে বেশি ব্যাখ্যায় যাওয়া সম্ভব নয় বলে শুধু এটুকুই বলব যে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ কথাটিতেই স্বাধীনতা ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল। আর তিনি যদি আরও সরাসরি কথাটি বলতেন, তা যেমন বোকামি হতো, সেই সঙ্গে দেশে বিরাট বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো এবং তাতে করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারির দল বিভিন্ন অপকর্ম ঘটিয়ে বাঙালির ঘাড়ে দোষ চাপাত। যেমন খন্দকার সাহেব বাঙালির ঘাড়ে লুটপাটের দোষ চাপিয়েছেন!

পরিশেষে আবারও বলব, বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ ও তীর্যক বুদ্ধির ফলেই মার্চ মাসে ৭ কোটি বাঙালি ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করায় পাকিস্তানিরা আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। সেদিন সারা পৃথিবী জেনেছিল, বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। বাঙালি সেদিন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে না পারলে বরং প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। আগেভাগেই সহিংস সংগ্রামে নেমে পড়লে পাকিস্তানিরা যে বাঙালিদেরই আক্রমণকারী বলত, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। আর বিষয়টি বিন্দুমাত্র প্রমাণ করতে পারলে আমেরিকার ৭ম নৌবহর ফিরে যেত না, চীনও বসে থাকত না। চীন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা একত্রে কার্যকর বিরোধিতা বা শক্তি প্রয়োগ করলে তখন একে খন্দকারের মতো গ্র“প ক্যাপ্টেন কী করতেন সে কথাও তাকে ভেবে দেখতে বলব।

উপসংহারে বলব, জনাব খন্দকার বইটি নিজে লিখেছেন, না অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছেন সে কথাও দেশবাসীকে ভেবে দেখতে হবে। কারণ আমরা যতদূর জানি, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। সেক্ষেত্রে তাকে দিয়ে

কেউ স্বার্থ হাসিল করাতেও পারেন। সেসব যাচাই-বাছাইয়ের আগে এ কথাটি বলে রাখি যে, তার লেখা বইটি ‘একটি অগ্রহণযোগ্য বই’।

#মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট

Wednesday, 17 September 2014

একটি রূপকথার গল্প এবং এ কে খন্দকারের বক্তব্যের মুল্যায়ণ

স্বাধীনতাযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার সম্প্রতিকালে “১৯৭১-ভিতরে বাইরে” নামে একটি বই লিখেছেন। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতা ঘোষণার উপর বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বাক্যুদ্ধ চলছে। জাতীয় সংসদে বইটি নিষিদ্ধ এবং তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণার দাবী উঠেছে। সংসদের বাইরেও পক্ষে-বিপক্ষে বাক্যুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতিকে কেউ কেউ এখন শত্রুপক্ষের এজেন্ট ও রাজাকার বলছে। নবীন প্রজন্ম দিশাহারা। বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ের বিষয়টি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখলে এ বিতর্কের পক্ষ-বিপক্ষের অনেক অজ্ঞতা দূর হবে।

বাংলাদেশাঞ্চলের অভ্যুদয়:
সাম্প্রদাযিক নীতিতে ১৯০৫ সালে ব্যর্থ হয়ে আঞ্চলিক নীতিতে বৃহত্তর বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী আবার ১৯১২ সালে বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশ এবং বঙ্গপ্রদেশে বিভক্ত করা হয়। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের “ইউনিয়নরাষ্ট্র” প্রস্তাবের বিপরীতে ১৯২৯ সালে মুসলিম লীগ প্রদেশ পুনর্গঠনসহ ভারতকে “যুক্তরাষ্ট্র” গঠনের প্রস্তাব দেয়। নুতন প্রদেশসহ ১৯৩৫ সালের “ভারত সরকার আইন”-এ মুসলিম লীগের দাবী প্রাধান্য থাকায় প্রথমে বর্জন করলেও ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস অংশ নেয়। গণতন্ত্রমুখী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালুর পরে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ক্রমবর্ধমান হয়। স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের সাথে সাথে তা বেড়ে উঠে এবং সংঘর্ষিক ও দাঙ্গায় রূপ নেয়। ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন এবং ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মুলসমান জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেসনে পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুাষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে পৃথক যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। লাহোর প্রস্তাব আন্দোলন ও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের গণম্যান্ডেটের ভিত্তিতে বৃটিশ-ভারত বিভক্ত হয়। প্রথমে হিন্দু মহাসভা এবং পরে কংগ্রেসের দাবীতে ১৯৪৭-এ বঙ্গপ্রদেশ বিভক্ত এবং পশ্চিমাংশ ভারতে ও পূর্বাংশ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। নির্বাচনোত্তর মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেসনে (১৯৪৬) সোহরওয়ার্দীর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান ইউনিয়নরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠে। দিল্লী প্রস্তাবের ভিত্তিতে সোহরওয়ার্দীর ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।

তরুণ বয়সে মৌলানা ভাসানী বিপ্লবী (সন্ত্রাসবাদী) স্বরাজ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সন্ত্রাসমুখী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে ১৯০৫ সালে বৃহত্তর বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশকে বিভক্ত করা হয়। সরকারের রোষানল থেকে রক্ষার জন্যে তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মৌলানা ভাসানী দেওবন্দ মাদ্রাসায় ও মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন (আমার দাদা) প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ পড়াকালে ১৯০৭ সালে সাঁড়াঘাটে পরিচয় এবং উভয়ই পাবনার হওয়ায় বন্ধুত্ব। দিল্লী যাতায়াতে মৌলানা ভাসানী কোলকাতায় ইসমাইল হোসেনের হোষ্টেলে আথিথেয়তা নিতেন। ইসমাইল হোসেন ১৯০৬ সালেই এফএ পড়াকালে মুসলিম লীগের ছাত্রসদস্য।

মাদ্রাসায় পড়া ও টুপিপরা যুবনেতা মৌলানা ভাসানী অনুশীলন, যুগান্তর, স্বরাজ, কংগ্রেস, ইত্যাদি দল করলেও মুসলিম লীগে যুক্ত হননি। বগুড়ায় বিয়ে করার পরে ইসমাইল হোসেনের (বগুড়ায় কর্মরত) যুক্তি-ব্যাখ্যা-তাগিদে অবশেষে তিনি ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগে যোগদেন। পরবর্তীতে ১৯৩৭ ও ১৯৪৬ সালে সংসদ সদস্য এবং আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি হন। লাহোর প্রস্তাব উত্তর মোহাম্মদ ইসরাইল হোসেন (আমার আব্বা) মৌলানা ভাসানীকে এবং পাবনার মুসলিম লীগের সহকর্মী ছাত্র-যুব নেতাদের (মোকসেদ মন্ডল, মনসুর আলী, আমজাদ হোসেন, মোতাহার হোসেন তালুকদার, প্রমুখ) বোঝাতে সক্ষম হন যে, লাহোর প্রস্তাব ধরে রাখলেই ভবিষ্যতে পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে। ১৯৩৩ সালে চৌধুরী রহমত আলীর এমন ভবিষ্যতব্য ছিল।

পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন খেতাবপ্রাপ্ত যুবনেতা মোকসেদ (গেঁদা) মন্ডল (ইসরাইল হোসেনের মামা) ও যুবনেতা মনসুর আলী যথাক্রমে তখন ইশ্বরদী ও কাজিপুর থানার মুসলিম লীগের সেচ্ছাসেবক গার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার। আমজাদ হোসেন, মোতাহার তালুকদার, প্রমুখ (পরবর্তীতে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ সদস্য) তাঁর স্কুল-কলেজের সহপাঠী। মেধাবী ইসরাইল হোসেন প্রথমে প্রেসিডেন্সী ও পরে এডওয়ার্ড কলেজে পড়েছেন। তিনি স্বল্পকালীন পাবনা থানার মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা ও গার্ড রেজিমেন্টের উপ-কমান্ডার ছিলেন। ইসলামিয়া কলেছে একইবর্ষে সহপাঠী ও ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও তখন তাঁর ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী হন। এজন্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ উত্তর সোহরওয়ার্দীকে ছেড়ে মৌলানা ভাসানী সাথে আসেন। ১৯৪৪-এর পরে ইসরাইল হোসেন ব্যক্তিগত কারণে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান।

১৯১২ সালে বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশ বিভক্তি, ১৯২৯ সালে মুসলিম লীগের ভারত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব, ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন এবং লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭-এ বাংলাদেশাঞ্চলের ঊদ্ভুদয় হয়। ১৯৪৭-এ ঐতিহাসিক বিজয়গুলো হলোঃ ১) বৃটিশ ঔপনিবেসিক শাসনের অবসান, ২) সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি অবসান; ৩) ক্রমবর্দ্ধমান সংঘর্ষিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান; ৪) সামন্তব্যবস্থার অবসান ও প্রজাজীবনের মুক্তি; ৫) গণতান্ত্রিক ভূমিসংস্কার ও গণতান্ত্রিক জীবনধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; এবং ৬) স্বকীয় জাতিসত্ত্বাসহ স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ের ভিত্তি।

বাংলাদেশাঞ্চলের জনগণ বৃটিশামলে সাত প্রজন্মকাল ঔপনিবেসিক, সাম্প্রদায়িক ও সামন্তিক রাষ্ট্রনীতিতে শাসিত-শোষিত-নিষ্পেষিত প্রজাজীবন এবং প্রধানতঃ নিন্ম ও নিন্মমধ্যবিত্ত জীবনধারায় আবদ্ধ ছিল। দুই-তৃতীয়াংশ বাঙালী মৃসলমান জনতার জমিদারীত্বে ৭.০% এবং সরকারী কর্মে, ব্যবসায় ও নগরসভ্যতায় ১০.০% অংশীদারীত্বও ছিল না। ১৯৪৭-এর পরে বাংলাদেশাঞ্চলের জনগনের প্রজামুক্তিসহ উত্থান শুরু হয়। তাই বাংলাদেশাঞ্চলের মানুষ ১৯৪৭কে মুক্তি হিসেবেই দেখেছে। ১৯৪৭ উত্তর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুও স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম’।

শেখ হাসিনার মতো বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর সন্তান ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু তৃতীয়শ্রেণীর কর্মচারীর সন্তান ও প্রজা হিসেবেই বড় হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সকলগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিও ছিলেন না। বিএতে তৃতীয়শ্রেণী থাকলে বিশ্ববিদদ্যালয়ের শিক্ষক, বিসিএস কর্মকর্তা, বিচারক বা সেনা কর্মকর্তা হওয়া যায় না। কর্মজীবি হলে বঙ্গবন্ধুর জীবন শুরু হতো তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচানী হিসেবে। নিজের ও জাতির সেবার বহু পথের মধ্যে রাজনীতিই ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যে উত্তম। এ কে খন্দকারের একাডেমিক মেধা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে উপরে ছিল এবং পারিবারিক পরিচয়ও নিচে ছিল না। নিজের ও জাতির সেবায় তিনি বিমানবাহিনীর প্রথমশ্রেণীর কর্মকর্তার পদে যোগদেন।

বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ঃ
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে জনবন্ধু ভাসানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। মাঠে-মঞ্চে খামোশ বলে হুঙ্কার দিলেও হক-সোহরওয়ার্দীর কাছে জনবন্ধু ভাসানী দুর্বল ছিলেন। রাজনীতির অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু তখন শতব্যক্তির একজনও নন। তাই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় আওয়ামী লীগের লাহোর প্রস্তাব ছিল ১৯ নম্বর ক্রমিকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে জনবন্ধু ভাসানী প্রাদেশিক সরকারে ক্ষমতাসীন দলীয়জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ঘেড়াও-হরতাল-মিছিল ছাড়া সংসদ/সরকার রাজনীতির ধারা উনার প্রকৃতি বিরোধী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে ২১ দফা ও গণম্যান্ডেটের পরিপন্থীতে দিল্লী প্রস্তাব ও পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাসাম্য প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সম্মত হওয়ায় হক-সোহরওয়ার্দীর উপর তিনি ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে ১৯৫৬ সালের সংবিধান চালুর পরে লাহোর প্রস্তাব বাদ দিয়ে সোহরওয়ার্দীর সাথে বঙ্গবন্ধুও ক্ষমতার রাজনীতিতে যোগ দেন।

স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের জন্যে সমমনা বিপ্লবীদের (সন্ত্রাসবাদী/মার্ক্সবাদী) নিয়ে জনবন্ধু ভাসানী ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। একাধিকবার সরকার গঠন-পতন ঘটিয়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারী ও সংবিধান বাতিল করিয়ে জনবন্ধু ভাসানী হক-সোহরওয়ার্দীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলেন। অতঃপর স্বায়ত্বশাসন আন্দোলন শুরু করেন। দিল্লী প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠন এবং পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাসাম্য প্রতিনিধিত্বের অব্যহত রাখায় প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানও রাজনৈতিক সমাধানে ব্যর্থ হন। তবে তাঁর সুশাসন ও উন্নয়নের কাছে ১৯৬৪ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমের পেশাদার রাজনৈতিক নেতারা সবাই ধরাশায়ী। ইতোমধ্যে হক সাহেব ও সোহরওয়ার্দীর মৃত্যু হয়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে ১৯৬৫ সালে জনবন্ধু ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু কিছুটা নিরাশ হয়ে উঠেন। এ অবস্থায় ইসরাইল হোসেন প্রথমে জনবন্ধু ভাসানীকে এবং অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলনে আবার সম্মত করান। ১৯৪৭ উত্তর ভারতের অভিজ্ঞতায় বোঝাতে সক্ষম হন যে, ইউনিয়ররাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় তিন-চতুর্থাংশ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন। ইউনিয়ররাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেখানে রাজধানী, সে প্রদেশ সার্বভৌম। ৪টি প্রদেশ ও সেনাবাহিনীর জন্যে পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানী সড়ানো সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া হাজার মাইল ব্যবধানে দুই অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের সুযোগ নেই। এতে পৃথক রাষ্ট্র গঠনে একধাপ অগ্রগতি হবে। আর তেমন গণজাগরণ হলে পশ্চিমারা সম্মত না হলেই পৃথক রাষ্ট্র।

জনবন্ধু ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর ঐক্যমত্যে ইসরাইল হোসেন কর্তৃক মুসলিম লীগের ১৪ দফা ও লাহোর প্রস্তাবের সমন্বয়ে ৬ দফার ১ম দফার ১ম লাইন ---” লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হইবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা” প্রণীত। ইসরাইল হোসেনের যুক্তি ছিল যে, এরই ভিত্তিতে পাকিস্তান হওয়ায় এ দফা ভিত্তিক আন্দোলনে কোন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হওয়ার সুযোগ থাকবে না। অন্যদফাগুলো অন্যদের সাথে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু চুড়ান্ত করেন। জ্যেষ্ঠতর দলীয় নেতারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে হওয়ায় এজন্যে বঙ্গবন্ধু দলীয় অনুমোদন ছাড়া ৬ দফা উপস্থাপন করেন। প্রথম থেকেই জনবন্ধু ভাসানী ৬ দফাকে সমর্থন দেন। আমার এ কথা ছাত্র-যুব-আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস করা কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের পূনর্জাগরণের ১৯৮৮ সালের ৭ দফার নেপথ্যের ব্যক্তিটিও আমি ছিলাম, তা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা সন্মানীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়।

জাতির দামাল ছেলে বঙ্গবন্ধু একাডেমিক মেধায় তৃতীয়শ্রেণীর হলেও ভাষায় সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। এজন্যে ভাসানীর ঘেড়াও-হরতালের বদলে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ বেছে নেন। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হওয়ার সুযোগ না থাকায় ভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে মামলা ও কারাবন্ধি করে ৬ দফা আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করা হয়। কারাবন্ধি থাকায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রাখতে পারেন নি। প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছেন, ভাসানী-জিয়া, নজরুল-তাজউদ্দিন, ওসমানী-খন্দকার, সিরাজ-মনি, রব-সিদ্দিকী, প্রমুখরা। ৬ দফা আন্দোলনে বহু ছাত্র-যুবসহ স্থানীয়-জাতীয় নেতারাও যুক্ত ছিলেন। আন্দোলনের সফল নের্তৃত্ব দিলেও জিন্না যেমন লাহোর প্রস্তাবের রূপকার ও পাকিস্তানের স্বপ্নদষ্টা ছিলেন না। তেমনি আন্দোলনের সফল নের্তৃত্ব দিলেও বঙ্গবন্ধু ৬ দফা মূলরূপকার ও বাংলাদেশের স্বপ্নদষ্টা ছিলেন না।

তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল বিশ্বের সেরা জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনতা আন্দোলনের পাথেয় এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকালে প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা। অস্থায়ী মুজিবনগর নামটিও হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা প্রতীক। ৬ দফা আন্দোলনের সফল নের্তৃত্ব ও ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যে জনগণ বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় “জাতির প্রধাননেতা” বা “জাতির পিতা” হিসাবে সন্মান করে। ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রথম পর্ব যা পরম বিজয়ের। তবে ১৯৭১ উত্তর বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দ্বিতীয় পর্ব যা পরম পরাজয়ের।

৬ দফা রাষ্ট্রদর্শন বঙ্গবন্ধুর চেতনাপ্রসূত নয়। এজন্যে ৬ দফা, গণম্যান্ডেট ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পরিপন্থীতে ১৯৭২-এ সংবিধানের মুখবন্ধে বঙ্গবন্ধু লিখলেন, সমাজতন্ত্রবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জন্যে জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু শপথ নিয়েছিলেন, ‘৬ দফা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হলো। এই ৬ দফার সঙ্গে কেউ যদি বেঈমানী করে, তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। আমি যদি করি, আমাকেও (তোফায়েল আহম্মেদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪)এ। স্বাধীনতাযুদ্ধের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে শুরুতেই সাংবিধানিক মিথ্যাচার করা হয়েছে এবং ১৯৭৫-এ ৪র্থ সংশোধনী, সমাজতন্ত্রবাদ, একদল ও স্বৈরতন্ত্র।

১৯৭১ উত্তর রাষ্ট্র-পরিচালনার ব্যর্থতার দায় বঙ্গবন্ধুর কোনভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। ১৯৭২-৭৫ কালে সরকারী-বেসরকারী বাহিনীর হাতে সাড়ে তিন বছরে সরকারী-বেসরকারী দরের প্রায় ত্রিশহাজার অর্থ্যাৎ বছরে সাড়ে আট হাজার জন বিচার-বহিঃভুত হত্যা হয়। প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানের শাসনামলে বছরে গড়ে পঁচাশি জন অর্থ্যাৎ শতভাগের একভাগও বিচার-বহিঃভুত হত্যা হয়নি। তারপরেও প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানকে স্বৈরাচার আখ্যা করেই বঙ্গবন্ধুর নের্তৃত্বে আমরা গনতান্ত্রিক আন্দোলন করেছি। সেই গনতান্ত্রিক আন্দোলনের মহানেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতোত্তর হত্যার রাজনীতিসহ একের পর এক জনগণের অধিকার হরণ করেন।

রাষ্ট্রকাঠামো ও আইনের অধীনে হওয়ায় সামরিক ও বেসামরিক সংস্থাসমূহ কম-বেশী জাতীয়তাবাদী। ১৯৩৭ সালে আগে যাদের জন্ম, তাদের মন-মানসিকতা বৃটিশ-ভারত রাষ্ট্রকাঠামো ও লাহোর প্রস্তাব আন্দোলনে গড়ে উঠে। ১৯৩৭ সালের পরে যাদের জন্ম, তাদের মন-মানসিকতা পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো ও ৬ দফা আন্দোলনে গড়ে উঠে। ৭ই মার্চের ভাষণের পরে সামরিক-বেসামরিক সংস্থাসমূহের মধ্যেও স্বাধীনতার চেতনা জেগে উঠে এবং ক্রান্তিকালে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে তাঁরা জাতীয় দায়িত্ব পালন করে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে সাংবিধানিক মিথ্যাচার, হত্যার রাজনীতি, স্বেচ্চাচারিতা, হটকারিতা ও রাষ্ট্র-পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার জন্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জাতির শ্রদ্ধা-ভালবাসা হ্রাস পেতে থাকে। রব-ইনু, মতিয়া-সেলিম, প্রমুখদের সমকালের মন্তব্যগুলো তারই প্রতিধ্বনি। ৪র্থ সংশোধনী, অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, সমাজতন্ত্রবাদ, একদল, স্বৈরতন্ত্র, মৌলিক অধিকার হরণ, হত্যার রাজনীতি, ইত্যাদির জন্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি নির্দলীয় ও অন্যদলীয় জনগণের শ্রদ্ধা-ভালবাসা শুণ্যে নেমে যায়। জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধে যোগদেন, তাদের মধ্যে ঋণত্বক হয়ে পড়ে। এর ফলসূতিতে অনাকাংখিত ও বর্বর ১৫ই আগষ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর লাসের দাফন নিয়ে কর্ণেল তাহেরের এবং মুজিব সরকারের অপসারণে স্পীকার মালেক উকিলের মন্তব্যেও তার প্রতিফলন আছে।

সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ঃ
৪র্থ সংশোধনী ও অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে ১৫ই আগষ্ঠ অপ্রত্যাসিত ছিল না। তবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বর্বরতায় ১৫ই আগষ্ঠ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে আর সীমিত ছিল না। স্বাধীনতোত্তর অবনতিশীল পরিস্থিতিসহ ১৫ই আগষ্ঠ, ৩রা নভেম্বর ও ৭ই নভেম্বর আমার কাছে কেবল ক্ষমতার পালাবদল বলে মনে হয়নি। ইসরাইল হোসেনকে ১৯৭৩ সালে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এককপি সংবিধান দিয়েছিলেন। উভয়ের মধ্যে সংবিধান ও কিছু প্রসঙ্গে কথপোকথনে কিছুসুত্র আমার স্মরণে ছিল। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশ্বসমীক্ষা থেকে বুঝলাম, স্বৈরমুখী রাষ্ট্র-অবকাঠামো. স্বৈরমুখী প্রতিরক্ষা কাঠামো. ১৯৭২ সালের স্বৈরমুখী সংবিধানিক সরকারব্যবস্থা এবং সংসদে ৯৭% অংশীদারীত্বের জন্যে স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ উত্তরাত্তর স্বৈরমুখী হতে থাকে। রাষ্ট্র-অবকাঠমো, প্রতিরক্ষা কাঠামো ও সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্রমুখী পুনর্গঠন ছাড়া স্বৈরমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তির পথ ছিল না।

আমি সরকার নই। কম-বেশী স্বার্থরক্ষা না হলে সরকার আমার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে না। তাই ১৯৮২ থেকে সরকারের প্রয়োজনে বা সংকটকালে গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের উদ্যোগগুলো নিই। বাংলাদেশ ৯টি বিভাগে বিভক্ত হলে রাষ্ট্র-অবকাঠমো এবং ৯টি আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্ট ভিত্তিক হলে প্রতিরক্ষা কাঠামো সুষম-গণতন্ত্রমুখী হবে। অন্যদিকে দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা চালু হলে স্বৈরমুখী সংবিধানিক সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হবে (আহসান-উল-করিম, প্রগাতশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)এ। ১৯৮২ থেকে উপজেলা-জেলা-বিভাগ পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা বিভাগ গঠিত তথা বাংলাদেশ ৯টি বিভাগে বিভক্ত হলে বাজারকাঠামো সুষম প্রতিযোগীমুখী হওয়ায় সুষম আয়বন্টনসহ ৫ বছরেই জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধির হার ৯% এর উর্দ্ধে উন্নীত হবে। অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধম্যে তা ১২%-এর উর্দ্ধে উন্নীত করা সম্ভব হবে।

সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী অংশ ১৯৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৯৮০ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পারেননি। ১৯৮৮-এ শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে গুলি করে। ১৯৯৬-এ শেখ হাসিনা নির্বিঘেœ ভোটে ক্ষমতাসীন হন। সেনাবাহিনী এখন শেখ হাসিনাকে সেলুট দেয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোটে ক্ষমতাসীন হতে এখন আর বাধা নেই। এটা যেমন তোফায়েল আহম্মেদ, মোহাম্মদ নাসিম বা শেখ সেলিমের অবদান নয়। তেমনি ২০০১ উত্তর দুঃশাসন পরিস্থিতিতে রপ্তানী, রিমিটেন্স ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিসহ জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫% এর উর্দ্ধে উন্নীত ও দারিদ্রতা ক্রমঃমোচন শেখ হাসিনার দৈব্য অবদান নয়।

১৯৮৮ পর্যন্ত ৪/৫টি আঞ্চলিক ক্যন্টিমেন্ট ভিত্তিক থাকায় প্রতিরক্ষা কাঠামো স্বৈরমুখী ছিল। ৮টি আঞ্চলিক ক্যন্টিমেন্ট ভিত্তিক গণতন্ত্রমুখী প্রতিরক্ষা কাঠামো হওয়ায় গণক্ষোভ ছাড়া সহজে ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়। যথাসময়ে আপীল বিভাগ দু’পদক্ষেপে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও সম্ভব হয়। জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫% এর উর্দ্ধে উন্নীত ও দারিদ্রতা ক্রমঃমোচন হওয়ায় অর্থনেতিক পরিন্থিতি বাংলাদেশ ১৯৮২-এর পূর্বাস্থায় নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন আর কাউকে পরওয়া করেন না। কিন্তু বাংলাদেশ ৯টি বিভাগে বিভক্ত ও দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা চালু ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অসম্পূর্ণ এবং দূনীতি ও সন্ত্রাস ক্রমঃবর্দ্ধমান। রাজনৈতিক বিপর্যয়ও আশংকামুক্ত নয়। জ্ঞাত থেকেও সরকার হয়ে পদক্ষেপগুলো না নিয়ে নিজেকে বার বার গণতন্ত্র ও জননিরপত্তায় বিশ্বাসী বলা এবং গুম-হত্যার রাজনীতি অব্যহত রাখা জনপ্রতারণার সামিল। এর পরিণাম গণদ্রোহ ও গণ-অভুত্থান।

এ কে খন্দকারের মন্তব্যগুলোর মূল্যায়ণঃ
স্বাধীনতা ও সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে ইতিকথা ও রূপকথার গল্পগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো, কবিতার বদলে ঐতিহাসিক বাস্তবতার ভিত্তিতে এ কে খন্দকারের মন্তব্যগুলো মূল্যায়ণ করা। তিনি ৬ দফা আন্দেলনের চেতনাধারী। ১৯৭০-এর গণম্যান্ডেট ও ৭ই মার্চের ভাষণের পরে জীবন বাজী রেখে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে সাংবিধানিক মিথ্যাচার, হত্যার রাজনীতি, স্বেচ্চাচারিতা, ৪র্থ সংশোধনী, ইত্যাদির জন্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁরও শ্রদ্ধা-ভালবাসা হ্রাস পায়। এজন্যে ৪৩ বছর পরেও ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর কতিপয় বিষয় নিয়ে প্রশ্নগুলো তোলা এবং নিজের অভিজ্ঞতায় উত্তরগুলো দেওয়া।

এ কে খন্দকারের যে মন্তব্যগুলো নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তাঁর প্রধানগুলো হলো-এক, ২৬শে মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সত্যতা; দুই, ৭ই মার্চের ভাষণ “জয়বাংলা, জয় পাকিস্তান” বলে শেষ করা; তিন, স্বাধীনতা ঘোষণার স্বপক্ষে প্রযোজনীয় প্রস্তুতি না থাকা; এবং চার, ৭ই মার্চে ঘোষণা করা হলে সহজ ও কম রক্তে স্বাধীনতা অর্জন হতো। অন্যে কথা ও কর্ম আমরা নিজের মন ও প্রজ্ঞা দিয়ে মূল্যায়ন করি। সেজন্যে এ কে খন্দকারের মন্তব্যগুলো ইতিহাসের বাস্তবতায় মুল্যায়ণ করা সবচেয়ে সমীচীন ও গ্রহণযোগ্য হবে।

২৮শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত জাতির মানসিক প্রস্তুতি ছিল তিন-চতুর্থাংশ স্বাধীনতা ভিত্তিক ফেডারেল পাকিস্তান। ১লা মার্চে জাতীয় সংসদ অধিবেসন স্থগিতের পরে ছাত্র-যুব নেতারা বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে আবেদন করেন। উনি তাদের বলেছেন, ‘পাকিস্তানও হয়েছে জাতির আকাংখা, আন্দোলন, বহুত্যাগ ও সমর্থনে। হঠাৎ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া হলে মধ্যবয়সী ও প্রবীনেরা সমর্থন নাও করতে পারে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। আগে সর্বস্তরে স্বাধীনতার মন জাগাতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রেক্ষাপট তৈরী করতে হবে।’ ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেটাই করেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ৬ দফা আন্দোলনে ফেডারেল পাকিস্তান অথবা স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, তা জনবন্ধু ভাসানী, বঙ্গবন্ধু ও ইসরাইল হোসেন জানতেন। যেটা ‘৬ দফা না মানলে ১ দফা’ কথামালা হিসেবে প্রচারিত ছিল।

সিরাজুল আলম খানের নের্তৃত্বাধীন নিউক্লিয়ার্সের ২রা মার্চে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছাত্র-যুব নেতাদের পতাকা উত্তোলন (পাবনায় বিকাল ৪-০০ টায়) এবং ৭ই মার্চের ভাষণের পরে বাকী এক-চতুর্থাংশ স্বাধীনতার মানষিক প্রস্তুতি ক্রমশঃ সম্পন্ন হয়। পূর্বে বিছিন্নভাবে হলেও এজন্যে ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বর্বর আঘাত এলে সেনা-বিডিআর-পুলিশ-আনসার-জনতা সবাই যার যার অবস্থান থেকে স্ব-উদ্যোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৬ দফা হলো প্রথমে ফেডারেল পাকিস্তান, অতঃপর বা নাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার আন্দোলন। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রবাদী দল, কোন সন্ত্রাসবাদী দল ছিল না। গণজাগরণ ছাড়া গণতান্ত্রিক ও প্রচলিত প্রথায় এর চেয়ে বেশী প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ৭ই মার্চের ভাষণের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে, সেনাসহ জনগণ ভাগাভাগি হয়ে পড়তো। আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া কঠিন হতো। স্বাধীনতাযুদ্ধ নয় মাস কেন, নয় বছরেও শেষ হতো না। আর দশগুন বেশী মানুষ মারা যেতো।

“জয় পাকিস্তান” বলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ করা এ কে খন্দকারের মন্তব্যে নিয়ে বিতর্ক বেশী। এমন কথা অনেকে আগেও লিখেছেন। আমি পরের দিন রেডিওতে শুনেছি। বিষয়টি এখন খেয়াল করতে পারি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বুয়েটে অধ্যায়নরত ও ছাত্রলীগভুক্ত আমার দু’ভাই (ডঃ মোহাম্মদ রেজওয়ানুল করিম ও ডঃ মোহাম্মদ আনোয়ারুল করিম) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও কখনো এ নিয়ে আলোচনা করেননি। ৩রা জানুয়ারীতে ৬ দফার শপথ অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধু “জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান” বলেছেন। ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণা নয়, পরবর্তী আন্দোলনের পাথেয়। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার তারিখ ২৬শে মার্চ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধু যদি “জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান” বলে শেষ করা হলে তা প্রজ্ঞাসম্মত। এতে নের্তৃত্ব ও নেতার বিজয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত হয় না। এ নিয়ে ইপপ্রধান সেনাপতির মন্তব্যে বিপরীতে বিরূপ মন্তব্য করা ববং স্বাধীনতাযুদ্ধেকে কলঙ্কিত করা হয়।

গণতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতি ও ২৫শে মার্চে বঙ্গবন্ধুর নিজগৃহে অবস্থানের বিষয়টি অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না। এজন্যে স্বাধীনতা ঘোষণা বা পথ নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদসহ অনেকেরই সংশয় ছিল বা আছে। জ্ঞাত থাকায় জনবন্ধু ভাসানীর সংশয় ও প্রশ্ন ছিল না। স্বাধীনবাংলার প্রধানমন্ত্রীর সংশয়ের জন্যে এ কে খন্দকারের সংশয় জাগে। স্বাধীনত্তোর ৬ দফা, গণম্যান্ডেট ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পরিপন্থীতে সংবিধানের মুখবন্ধে মিথ্যাচারের জন্যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে তাঁর সংশয় বাড়ে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির খসড়া করেন এবং শীর্ষ নেতাদের অনুমোদনে ১০ই এপ্রিল ঘোষিত। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের অভিমত এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

গণতান্ত্রিক পথে সাতকোটি জনতার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলধারার সাথে বহু মত ও ধারা যুক্ত থাকে। নিজ নিজ মত ও পথ সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর মত ও পথ নিয়ে বহু প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক। অনেক বিতর্কের অবসানের জন্যে ১৫শ সংশোধনীতে ৬ দফা, ৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ সংবিধানে যুক্তকরার জন্যে (আহসান-উল-করিম, সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো, ২০১০)এ। ৬ দফা বাদ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নামে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার ওয়ারলেস বার্তাটি সংযুক্ত করা হয়। জাতীয়বন্ধু জিয়ার প্রভাবশীল স্বাধীনতার ঘোষণাটি বাদ দিয়ে কেবল বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি সংযুক্ত করাও এ কে খন্দকারের ক্ষোভের একটি কারণ হতে পারে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থাকলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামে কোন বার্তা আর সংযুক্ত করার প্রয়োজন নেই এবং ৬ দফা ছাড়া বঙ্গবন্ধু খন্ডিত। ভগবান ব্যক্তিক ও অবরোহমুখী, কিন্তু নেতা সমষ্টিক ও আরোহীমুখী। যত বড় নেতা, তত বেশী সমষ্টিক। ভগবান হয়ে বঙ্গবন্ধু একাই বাংলাদেশ বানিয়েছেন, এটা অবার্চীন-পাগল-ছাগলদের চেতনা।

বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণার ওয়ারলেস বার্তার কথায় ২৬শে মার্চের ভোরবেলা থেকেই আমরা পাবনা শহরবাসীরা ভোরবেলা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাকর্মকর্তা হিসেবে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ঐতিহাসিক ও প্রভাবশীল। এর মূলেও ৬ দফা, গণম্যান্ডেট ও ৭ই মার্চের ভাষণ। ৭ই মার্চের ভাষণের পরে নিজমুখে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে জাতির প্রধাননেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভুমিকা কলঙ্কিত বা হ্রাস হয় না। তিনিই বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে রাজনৈতিক প্রধাননেতা। তাঁর নামেই স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছে। তাঁকে নেতা রেখেই স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতি ও কারাবন্ধিত্ব দেয় জাতীয় ঐক্য। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যান্য নেতাদের অবদানও নক্ষত্রের মতো। বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে জাতির বঙ্গবন্ধুর প্রধাননেতা---তা যেমন অস্বীকার করার সুয়োগ নেই, তেমনি বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে তাঁকে ভগবান ভাবা বা বানোনোর সুযোগও নেই। বাংলাদেশের উদ্ভুদয় হয়েছে জাতির সম্মিলিত আকাংকায় ও প্রচেষ্টায়।
=================================
*মোহাম্মদ আহ্সানুল করিমঃ রাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বিসিএস কর্মকর্তা। 

Thursday, 11 September 2014

মুক্তিযুদ্ধের আরও একটি ফরমায়েশি ইতিহাস

প্রথমা প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ একে খন্দকারের বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’। প্রকাশিত হবার পরে পরেই বইটি নিয়ে দারুণ বিতর্ক শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির প্রতি মানুষের বিশেষ করে তরুণদের আগ্রহ বেশ বেড়েছে। কাজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই স্মৃতিচারণ করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই সেটা কৌতূহলী করে তুলবে পাঠককে। পাঠকের এই আগ্রহের কারণেই একে খন্দকারের বই নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

বই হিসেবে একে খন্দকার কিংবা প্রথমা প্রকাশনী পাঠকের সামনে কী উপস্থাপন করছেন খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে, উপজীব্য যখন মুক্তিযুদ্ধ, তখন ইতিহাসের পাঠক হিসেবেই এই বইয়ে উপস্থাপিত তথ্য ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখাটা জরুরি বলে মনে হয়। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা যা বলে গেছেন, বলে যাচ্ছেন এবং বলে যাবেন সেইসব সাক্ষ্য থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা হবে এবং যারা একাত্তর দেখেননি, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ও বিস্তৃত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে পারবেন।

সেই প্রেক্ষাপটেই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইয়ে যেসব তথ্য ও মন্তব্য উপস্থাপনা করা হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। বইয়ে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তার অনেক কিছু নিয়েই কথা বলা যায়। অত দীর্ঘ না করে, এখানে প্রধান কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

বইয়ে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তার অনেক কিছু নিয়েই কথা বলা যায় 

২.
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাপারটা নিয়েই প্রথমে কথা বলা যাক। একে খন্দকার লিখেছেন–
“শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে ৩০৩ রাইফেল দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো তখন তথ্যপ্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। তাই এ ধরনের কোনো তৎপরতার খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমি বা অন্য সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারিনি। এর ফলে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা হয় যে, রাজনৈতিক নেতাদের কোনো ধরনের যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই। ফলে ২৫ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করল, তখন একে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না।’’

এখানে প্রথমেই যে জিনিসটি দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে সেটা হল, অনুচ্ছেদের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পর্কে বলা কথাটির আগে জুড়ে দেওয়া দুটি শব্দ-– ‘শোনা যায়’। মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ একে খন্দকার স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পরে এসেও নিশ্চিতভাবে জানেন না যে, দেশের ছাত্ররা সেইদিন সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল! এর কাছে ওর কাছে যা শুনেছেন, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রস্তুতি ছাড়া আর কোনো খবর তিনি জানতে পারেননি! একে সম্ভবত অবজ্ঞা বলে। এই অবজ্ঞার দৃষ্টান্ত এর পরেও তিনি রেখেছেন। সে কথায় আমরা পরে ফিরে আসব।

অন্য এক জায়গায় একে খন্দকার বলেছেন, যদি আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনা থাকত, তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত।

যাহোক, উপরের দুটি অনুচ্ছেদ থেকে তিনটি সারকথা বের করে আনা যায়।
প্রথমত, বেসামরিক জনগণের তেমন কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিল না; যা ছিল সেটা সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, এই না জানার কারণে সেনাসদস্যরাও কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখেননি।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বেসামরিক জনগণ এবং সেনাসদস্যদের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় ছিল না।
তিনটির কোনোটিই সত্য নয়।

‘১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়’ বইটি লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান মণ্ডল। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, উত্তরবঙ্গে আখতারুজ্জামানরা একাত্তরের মার্চের শুরু নয়, ফেব্রুয়ারি থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন এবং মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর সঙ্গেও সমন্বয় সাধনের কাজটি সেরে ফেলেছেন।

আখতারুজ্জামান মণ্ডলের বই থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু গোপনে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে আখতারুজ্জামান মণ্ডল ও তার সঙ্গীদের কাছে পৌঁছেছে এবং সেই নির্দেশ অনুসারেই তারা একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতেই কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ উত্তরবঙ্গের একটি বড় অংশে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। গোপনে কন্ট্রোল রুম স্থাপন এবং ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমন্বয় সাধনের কাজও করেছেন। [১]

যার ন্যূনতম বিবেচনাবোধ আছে, তিনি আখতারুজ্জামান মণ্ডলের বিবরণ থেকেই বুঝবেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মোটেই অপ্রস্তুত ছিলেন না, বেসামরিক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য তাঁদের পরিকল্পনাও ছিল।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মোটেই অপ্রস্তুত ছিলেন না, বেসামরিক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য তাঁদের পরিকল্পনাও ছিল সেনাসদস্যদের সঙ্গেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সিভিলিয়ান জনগণের একাংশের যোগাযোগ ছিল, বেশ ভালোভাবেই ছিল। এর বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখা A Tale of Millions বইতে। রফিকুল ইসলামের জবানি থেকে জানা আচ্ছে, মার্চের মাঝামাঝি সময়েই তিনি প্রায় ৬০০ ইপিআর সদস্যকে চট্টগ্রামে সংগঠিত ও প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং সীমান্ত এলাকা থেকে আরও ৯০০ সদস্য তার পরিকল্পনায় যোগ দেবেন, সেটিও স্থির করেছেন। ঢাকায় কর্মরত জ্যেষ্ঠতম বাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিনি জনৈক দেলওয়ারকে দায়িত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রামে থাকা বাঙালি সেনা অফিসার, যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত। [২]

একই বইতে রফিকুল ইসলাম আরও লিখেছেন, তিনি নিজে বঙ্গবন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন প্রস্তুতির ব্যাপারে। রফিকুল ইসলাম এ-ও জানাচ্ছেন, বাঙালি সেনাসদস্যদের একটি অংশ মার্চের দ্বিতীয়াংশে এসেও বিশ্বাস করেননি যে আসলেই একটি যুদ্ধ হতে যাচ্ছে, বাঙালি অফিসারদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলেই এই অংশটি মনে করেননি তখনও-–
Although the officers agreed with me on the issue of the military build-up, they could not make up their mind whether the situation demanded any military action on our part or not.

একে খন্দকার যেভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপরে দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছেন এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সংগঠিত করায় ব্যর্থতার কথা বারবার বলছেন, তার প্রেক্ষিতে এই শেষের অংশটুকু গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেই হয় বৈকি!
যাহোক, আখতারুজ্জামান মণ্ডল এবং রফিকুল ইসলামের বিবরণ থেকে এই তিনটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে–
১. বাঙালি সেনাসদস্যরা পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তারা একেবারে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিহীন অবস্থান ছিলেন না;
২. বেসামরিক জনসাধারণ তাদের সাধ্যমতো সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন;
৩. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না, সেনাসদস্য ও বেসামরিক জনগণের সঙ্গে তাদের মোটামুটি ভালো রকম সমন্বয় ছিল, যুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাপারটিও মোটামুটিভাবে মনিটরিং করা হচ্ছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রস্তুতির মাত্রা কী রকম ছিল? সারা দেশের প্রত্যেকটি মানুষ এর সঙ্গে জড়িত ছিল, এমন নির্বোধের মতো দাবি অবশ্যই কেউ করবেন না। সেই সময়ে চারপাশেই বিশ্বাসঘাতকদের আনাগোনা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারাও বসে ছিল না। সতর্কভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে চোখ রাখছে তারা। সেনানিবাস থেকে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং খবর সংগ্রহ কতটা কঠিন ছিল তার খানিকটা নমুনা পাওয়া যাচ্ছে জহিরুল ইসলামের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তার বিয়োগান্ত বিদায়’ বইয়ে।

এই বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী, সেনানিবাসের অবস্থা তখন খুবই উত্তেজনাপূর্ণ, কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঙালি সেনা ও অফিসারদের সেনানিবাস থেকে বের হওয়া নিষেধ। ঢাকায় কী ঘটছে, দেশে কী ঘটছে, সেটা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে জানা বেশ কঠিন। এক সন্ধ্যায় লুকিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে, মতিঝিলে বোনের বাসায় যান মেজর হায়দার এবং ফেরার সময় প্রহরির হাতে ধরা পড়েন। শেষ পর্যন্ত তার পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তাঁবুতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। [৩]

এই ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে কমবেশি সকল বাঙালি সৈনিক পড়েছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। এইসবের প্রতিবন্ধকতা পার হওয়ার পরে, যেটুকু প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল সেটাকে অন্তত ‘শোনা যায়’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

এখানে উদ্ধৃত অংশে একে খন্দকার যা বলেছেন, সেটা অজ্ঞতা থেকে বলে থাকতে পারেন, অবজ্ঞা থেকেও পারেন, অন্য কোনো কারণেও পারেন। কারণটি কী সেই সিদ্ধান্তে না গিয়ে বরং আমরা এটুকু নিশ্চিত হয়ে থাকি, একে খন্দকার যা লিখেছেন তা সত্য নয়।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিশেষ করে শেখ মুজিব যুদ্ধের ব্যাপারে কী প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা পরে করা হবে।

৩.
একে খন্দকার লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেটা তার মনে হয় না। এই ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন।

প্রথমে ‘জয় পাকিস্তান’ বলার বিষয়টির মীমাংসা করা যাক। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি জনপ্রিয় কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। একে খন্দকারই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি এই দাবি করেছেন। এর আগে শামসুর রাহমান এবং আহমদ ছফাও এমন কথা বলেছেন। আহমেদ ছফা যে প্রবন্ধে বলেছেন (১৯৭১: মহাসিন্ধুর কল্লোল), সেখানে আবার জুড়ে দিয়েছেন, তার শ্রুতিবিভ্রম হতে পারে। পারে বটে! প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা কি সত্য বলেছেন?

এই দাবি সত্য কি মিথ্যা সেই বিশ্লেষণে যাবার আগে বরং এর বিপরীত মতগুলোর দিকে একটু তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি। আবুল মনসুর আহমেদের বিখ্যাত রচনা ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে এই প্রসঙ্গটি খোলাসাভাবেই আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে থেকেই উদ্ধৃত করা যাক–

‘‘যারা নিজেরা উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বলিয়া দাবি করেন তাদের কেউ কেউ আমার এই কথার বিরোধিতা করেন। তারা বলেন, শেখ মুজিব ৭ মার্চের সভাতেও ‘জয় বাংলা’, ‘জয় পাকিস্তান’ বলিয়া বক্তব্য শেষ করিয়াছিলেন। আমি যখন বলি যে, পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তাঁর বক্তব্য শুনিয়াছি এবং তাতে ‘জয় পাকিস্তান’ ছিল না, তার জবাবে তারা বলেন, পরদিন রেকর্ড ব্রডকাস্ট করিবার সময় ঐ কথাটা বাদ দেওয়া হইয়াছিল। যাক আমি নিজ কানে যা শুনিয়াছিলাম, তাই লিখিতেছি। বক্তৃতা শেষ করিয়াই মুজিব সভামঞ্চ ত্যাগ করিলেন। তাজুদ্দিন সাহেব মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া মাইকের স্ট্যান্ড চাপিয়া ধরিলেন এবং বলিলেন: ‘এইবার মাওলানা তর্কবাগীশ মোনাজাত করিবেন। সভার কাজ শেষ’। মাওলানা তর্কবাগীশ মাইকের সামনে দুই হাত তুলিয়া মোনাজাত শুরু করিলেন। সমবেত বিশ-পঁচিশ লক্ষ লোকের চল্লিশ পঞ্চাশ লক্ষ হাত উঠিয়া পড়িল। মোনাজাতের সময় এবং তকবিরের সময় কথা বলিতে নাই। তাই কেউ কথা বলিলেন না। নড়িলেন না। যখন মোনাজাত শেষ হইল, তখন শেখ মুজিব চলিয়া গিয়াছেন।’’

পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তাঁর বক্তব্য শুনিয়াছি এবং তাতে ‘জয় পাকিস্তান’ ছিল না আবুল মনসুর আহমেদের ভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে তিনি রেডিওতে ভাষণ শুনেছেন। একে খন্দকারও তাই শুনেছেন। আবুল মনসুর আহমেদের পরিচিত ব্যক্তি, যাদের দাবি শেখ মুজিব ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন, তারাও সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রেডিওতে প্রচারিত ভাষণে ওই অংশটি কেটে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে একে খন্দকার কীভাবে শুনেছেন? এই প্রশ্নটির উত্তর একে খন্দকার দিলে অনেক জট খুলতে পারে হয়তো।

শামসুর রাহমানের আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণ ‘কালের ধুলোয় লেখা’। এইখানে কবি শামসুর রাহমান ‘জয় পাকিস্তান’ শ্লোগানের ব্যাপারটি বলেছেন। এই সূত্রটি অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শামসুর রহমান নিজেই পরে স্বীকার করে নিয়েছেন, তার দেওয়া এই তথ্যটি ভুল। ৩০ জুলাই, ২০০৪ তারিখে সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় শামসুর রাহমান স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ‘জয় পাকিস্তান’ জাতীয় কোনো শ্লোগান দেননি, ‘জয় বাংলা’ বলেই সেইদিন ভাষণ শেষ করেছেন তিনি। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য পাঠক ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন শামসুর রাহমান।

বাংলাদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন মাত্র ক’দিন আগেই চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ওইদিনের সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং শেখ মুজিব সেদিন ‘জয় পাকিস্তান’ জাতীয় কিছু বলেননি।
এই প্রবন্ধ লিখবার আগে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে নিয়েছি, আরা সেইদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছেন, এমন কিছু তারা শোনেননি।

৭ মার্চের ভাষণের যতগুলো ফুটেজ পাওয়া গেছে, কোনোটিতেই এ রকম কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। সত্যি সত্যি এমন কোনো ফুটেজ থাকলে সেটা বিএনপির সর্বশেষ দু’টি শাসনকালে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?
এখন এই পরস্পরবিরোধী দু’টি বক্তব্যের মাঝে সত্য হিসেবে কোনটাকে ধরে নেওয়া উচিত? এর উত্তর খুব সহজ। যারা বলছেন এমন কিছু তারা শোনেননি, এখন পর্যন্ত পাওয়া সব ডকুমেন্ট ও ভিডিও ফুটেজ কিন্তু তাদের বক্তব্যই সমর্থন করে। যারা বলছেন, শেখ মুজিবকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে তারা শুনেছেন, এর সত্যতা প্রমাণের দায়ভারটাও তাদের ঘাড়েই বর্তায় এবং তারা এখনও তাদের দাবির পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি– না কোনো ভিডিও ফুটেজ, না ওই সময়ের পত্রিকায় এর উল্লেখ।

আমাদের হাতে থাকা প্রত্যক্ষ্যদর্শীর বিবরণ, ভিডিও ফুটেজ, পত্রিকার খবর কোনোটি থেকেই এমন কোনো মজবুত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, শেখ মুজিব ৭ মার্চ ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন। উলটো যাদের লেখা থেকে এই দাবি পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই কেউ কেউ ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। একে খন্দকারের এই বিভ্রান্তিকর বক্তব্যও তাই বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

এর পরে আসছে, তিনি একে স্বাধীনতার ডাক মনে করেন কি না। তিনি কী মনে করেন বা না করেন সেটা তো পুরোপুরি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একই জিনিসের প্রভাব একেক মানুষের কাছে একেক রকম। সামরিক ব্যক্তিত্ব একে খন্দকারের কাছে শতভাগ বেসামরিক মুজিবের বেসামরিক ভাষণ অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতেই পারে। তবে এই প্রবন্ধ লিখবার সময় একেবারে হাতের কাছেই অন্তত দুজন সেনাসদস্যের জবানি রয়েছে, যারা ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ডাক শুনতে পেয়েছেন।

জিয়াউর রহমান তার ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে এই ভাষণকে চূড়ান্ত যুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল মনে করেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী তার এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন-–
“বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি যে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শুধু আমাকেই উদ্বেলিত করেনি, বরং প্রতিটি বাঙালির বুকেই তুলেছে বিদ্রোহের ঝড়, স্বাধীনতার অনাস্বাদিত স্পৃহা।”
এখন একে খন্দকার যদি এই ভাষণ থেকে প্রেরণা না পেয়ে থাকেন, তাহলে কার কী করার আছে?

৪.
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন কি না তা নিয়েও একে খন্দকার প্রশ্ন তুলেছেন। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায়ের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা হয়েছে। আদালতের রায়ে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্কের প্রয়োজন নেই বলেই মনে করি। যে দলিল দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে সেটার সত্য মিথ্যা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় তর্ক করে সময় নষ্ট না করাই উচিত। এখানে বরং বিতর্ক হতে পারে অন্য ব্যাপারে; আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয় নিয়ে এভাবে প্রশ্ন তোলাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে কি না সেটাই বরং আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত।

আমরা আপাতত অন্য একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিই। একে খন্দকার লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল এবং না গিয়ে তিনি ক্ষতি করেছেন। কী হলে কী হতে পারত তা নিয়ে আসলে অনন্তকাল তর্ক করা সম্ভব, তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। বঙ্গবন্ধুর কাছে যা ভালো মনে হয়েছে তিনি তা করেছেন, একে খন্দকার সেটা স্বীকারও করেছেন এবং স্বীকার করেই ঠিক তার পরের অনুচ্ছেদের আবার একই মায়াকান্না জুড়েছেন।

যাহোক, বঙ্গবন্ধুর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিক হাতে কোনো বিকল্প না রেখেই কাজ করেছেন এটা মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার জন্য অপেক্ষা করা ছড়াও আরও পরিকল্পনা তার ছিল। তার অন্তত একটির সাক্ষ্য দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশি নয়ীম গহর। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস’ বইয়ে নয়ীম গহরের জবানিতে সেই কথা জানাচ্ছেন আ ফ ম সাঈদ–

“বঙ্গবন্ধু কেন চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকীর কাছে যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। হ্যাঁ, কথা ছিল চট্টগ্রাম থেকেই যুদ্ধটা শুরু হবে এবং তার নেতৃত্বে থাকবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি ইন্টেলিজেন্সের গোপন একটি তথ্য ঠিক সময়মতোই জানতে পারে যে, শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করলেই যেভাবেই হোক তাকে পাকিস্তানি আর্মি মেরে ফেলবে এবং সম্ভাব্য হত্যা করার জায়গাটি ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি। [৪]”

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল এবং না গিয়ে তিনি ক্ষতি করেছেন একে খন্দকার আরও বলেছেন, গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তিনি কোনো নির্দেশ দিয়ে যাননি। বঙ্গবন্ধুর জায়গা থেকে সেই সময় জনে জনে নির্দেশ দিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীসহ অনেকেই ধানমণ্ডিতে তাঁর বাসায় ছিলেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন রকম পরামর্শই বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন। এত বিশাল একটা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে, কত দিন সেটা চলবে কেউ জানে না, আর সেই ব্যাপারে সব রকম নির্দেশনা ঘরে বসেই মুজিব দিয়ে যাবেন এটা যদি কেউ আশা করে থাকে তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল।

একে খন্দকারও সেই আশা করেননি। এখন পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্যই এইসব বলছেন তিনি। যাহোক, নয়ীম গহরের ভাষ্য থেকেই আমরা জানতে পারছি, যুদ্ধ কীভাবে শুরু করতে হবে সেই ব্যাপার গ্রেফতার হওয়ার আগেই চট্টগ্রামে এম আর সিদ্দিকী ও ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনকে অভিন্ন একটি বার্তা আলাদাভাবে পৌঁছে দেন। নির্দেশনাগুলো ছিল-–
Talk has failed
Don’t surrender Arms (EPR, EBR, Police, Ansar and general people)
Let the people and other start…
Liberate Chittagong
Proceed toward Comilla
Carry out my earlier orders even if I am not available (dead or a captive)
Confirm me back that Chittagong understood me clearly[৪]

এই মেসেজের অর্থ, যুদ্ধ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল এবং এ ব্যাপারে আগে থেকেও নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। একে খন্দকারের দাবির যৌক্তিকতা তাহলে ধোপে টিকছে না।

একে খন্দকার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি বেশ গর্হিত মন্তব্যই করেছেন বলা যায়, শেখ মুজিব নাকি মার্চে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বসে বসে ভিন্ন রাজনৈতিক খেলা খেলছিলেন। যাহোক, এই ব্যাপারেও বেশি কিছু বলার নেই, কোনটা কার কাছে খেলা মনে হবে সেটা নিয়ে অন্য কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। শুধু দুটি কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে এই অংশটুকু শেষ করতে চাই। আলোচনা যখন চলছে, তার মাঝেই ১৭ মার্চ ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে মুজিব সম্পর্কে বলেছে, ‘দ্যা বাস্টার্ড ইজ নট বিহ্যাভিং, ইউ গেট রেডি’। [৫]

মুজিব ঠিক কী চাচ্ছিলেন যার জন্য ইয়াহিয়া এই উক্তি করেছেন, তার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে মার্চের ২৫ তারিখে করা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উক্তিতে–
২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ভুট্টো বললেন, ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত আশংকাজনক’। তিনি সাংবাদিকদের আরও বললেন– ‘আওয়ামী লীগ যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে তাকে আর স্বায়ত্তশাসন বলা যায় না। ওদের দাবি তো স্বায়ত্তশাসনের চেয়েও বেশি’। [৫]

এই প্রসঙ্গে এর বেশি আর কিছু আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

৫.
সামরিক বাহিনীর বাইরে থেকে আসা গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে কয়েকটি অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন একে খন্দকার। যুদ্ধের সময় সময়ে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া সামরিক সহযোগিতা নিয়েও কটূক্তি আছে বইয়ে। গেরিলা যোদ্ধাদের কৌশল ও অনভিজ্ঞতা নিয়ে একে খন্দকার যা বলেছেন তা যে কোনো বিচারেই অশালীন। তার মনে রাখা উচিত, বহু সেনাসদস্য যখন ইতস্তত করছিলেন তখন এইসব বেসামরিক তরুণরাই ঘর-পরিবারের মায়া কেটে যুদ্ধে যোগ দিতে ছুটে এসেছে। কী দিয়ে লড়াই করবে সে সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান না থাকলেও লড়তে হবে এই বোধটুকু তাদের ছিল; কারণ তারা চোখের সামনেই নিজের ভাই-বোন-বাবা-মাকে মরতে দেখে এসেছে।

একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনও-ই শতভাগ সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভর করে পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তাকে একটি কার্যকর গণযুদ্ধে রূপান্তরিত না করতে পারলে সেই যুদ্ধে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই সব সাধারণ মানুষদের সামান্য ট্রেনিং দিয়ে গেরিলায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। অদক্ষতা এবং অনভিজ্ঞতা তাদের অন্যতম প্রধান শত্রু ছিল, এতে দ্বিমত নেই কারও; তবে সেই সঙ্গে এ-ও সত্য এই অনভিজ্ঞ গেরিলারাই কিন্তু বহু সফল অভিযানের নায়ক। একে খন্দকার গেরিলাদের ব্যর্থতার কথা এনেছেন। সামরিক বাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারাও কি এসব ব্যর্থতা থেকে মুক্ত ছিলেন? তিনি নিজে তো সম্মুখ সমরে যাননি, যারা গিয়েছেন তাদের অবদান খাটো করার এই মানসিকতা একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তিনি কীভাবে ধারণ করেন?

একে খন্দকার লিখেছেন, প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কথা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের তখনকার মানসিকতা নিয়েও কয়েকটি মন্তব্য করেছেন। শুনতে রূঢ় মনে হলেও, ভারত নিশ্চয়ই তখন আমাদের জন্য নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দেবে না। যুদ্ধটা বাংলাদেশের, ভারতের নয়। কাজেই সেই যুদ্ধে সহযোগিতা করতে গিয়ে তাদের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে সেটা অবশ্যই ভারতকে হিসাব করতে হবে।

যুদ্ধের সেই দশটি মাস এবং তার পরেও এক কোটির বেশি শরণার্থীর প্রত্যেকে লাশ হয়ে যেত যদি ভারত সহযোগিতা না করত। ভারতের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে, নিজেদের প্রতিরক্ষা নিয়েও তাদের দুশ্চিন্তা আছে। সেইসব বাদ দিয়ে, কেন ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ গোলাবারুদ দেওয়া হচ্ছে এটা নিয়ে অনুযোগ করাটা খুবই অশ্লীল শোনায়।

বাঙালিরা বিহারি হত্যা করেছে, লিখেছেন একে খন্দকার। বিহারিদের সম্পত্তি লুটপাট করা হয়েছে। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগেই পরিকল্পিতভাবে বিহারিদের বাঙালি নিধনে লেলিয়ে দেওয়াটা তার চোখে পড়ল না? কিছু মানুষ পরিস্থিতির সুযোগ নেবেই, তাতে নিরপরাধ বিহারিদের প্রাণও গিয়েছে। কিন্তু এই বিহারিরাই যে দু’দিন আগেই এই বাঙালিদের স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে সেটা এড়িয়ে একে খন্দকার যেভাবে সরলীকৃত বক্তব্য দিলেন সেটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

৬.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে আমাদের জন্য হতাশাজনক ব্যাপার হল, ইতিহাসের ভুল ও বিভ্রান্তিকর সংস্করণ প্রকাশের সেই মিছিলে শামিল হয়েছেন স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধারাই। প্রথমা প্রকাশনী এই ধরনের মিথ্যাচার প্রকাশ করার দায়িত্বটা পালন করে চলছে অনেক দিন আগে থেকেই। এই প্রথমা থেকেই প্রকাশিত গোলাম মুরশিদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এত বছর পরে সংশয় তোলা হয়েছে।। তার ধারাবাহিকতা হিসেবে এবার এল ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’। প্রশ্ন হচ্ছে, কার স্বার্থে এই বিকৃতি?

এর উত্তর সহজ, আবার কঠিন। সহজ উত্তরটি হচ্ছে, অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের স্বার্থেই এসব হয়ে চলেছে। আবার আরও একটু কঠিন করে জিজ্ঞেস করা যায়, এসবের উদ্দেশ্য কী? এসব কি কোনো দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের আলামত? অন্য কোনো ষড়যন্ত্র থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখতে ডাইভারসন? এই ব্যাপারগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত।

এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হল ইতিহাস বিকৃতি রোধে কঠোর আইন এবং তার আরও কঠোর প্রয়োগ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনোসাইড ডিনায়াল শাস্তিযোগ্য অপরাধ, একইভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে কোনো বিকৃতি ও মিথ্যাচার কঠোর শাস্তির উপযুক্ত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে আইন তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা, উপাত্ত, দলিল আর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে বিশেষভাবে। না হলে দুই দিন পর পর এমন আকাশ থেকে পড়া ইতিহাসের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই পৌনঃপুনিক বিকৃতি চিরতরে বন্ধ হোক।


প্রীতম দাস: তড়িৎ প্রকৌশলী। ব্লগার, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় উৎসাহী।

তথ্যসূত্র:

১. ১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়, আখতারুজ্জামান মন্ডল

২. A Tale of Millions, Rafikul Islam BU

৩. ‘মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তার বিয়োগান্ত বিদায়, জহিরুল ইসলাম

৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস, আ. ফ. ম. সাঈদ

৫. একাত্তরে বন্দী মুজিব পাকিস্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা, অধ্যাপক আবু সাঈদ।