Friday, 19 September 2014

একটি অগ্রহণযোগ্য বই -- মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

একে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটি এইমাত্র হাতে পেলাম। গুলশান ১-এর সিগনালে একজন বই বিক্রেতা সাদা পলিথিনে মোড়া বইটি বাড়িয়ে দিলে দাম চুকিয়ে বাড়ি এসে খুলে দেখি বইটির ফটোকপি বাজারে ছাড়া হয়েছে! সুন্দর করে পলিথিনে মোড়ানো থাকায় না খোলা পর্যন্ত বিষয়টি বোঝার উপায় ছিল না। অর্থাৎ বইটি বিক্রিতে জালিয়াতি শুরু হয়েছে। যা হোক, এক দমে প্রায় অর্ধেক পড়ে মনে হল, বইটির ভেতরেও জালিয়াতি আছে। ওই পর্যন্ত পড়ে আমার মনেই হল না যে, বইটি একে খন্দকারের লেখা। প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করে লেখা শুরু করা হয়েছে। বারবার তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি বাঙালিদের লুটেরা বলা হয়েছে। আমি বইটির ৩০ পৃষ্ঠার ২৫ লাইন থেকে ২৮ লাইন পর্যন্ত এখানে উদ্ধৃত করলাম : ‘অবাঙালিরা নিরাপত্তার জন্য ঢাকা ছেড়ে যখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকা বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের সোনার গয়না, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা।’ পক্ষান্তরে ২০ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘১৮ বছর পাকিস্তান অবস্থানকালে আমি পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছি... তারা সবসময় আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি যত্নবান ছিলেন।’ পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন এ কথাটি যেমন তার কাছে এই প্রথম শুনলাম, তেমনি ’৭১-এর মার্চে পাকিস্তানিদের সোনার গয়না, টাকা-পয়সা বাঙালিরা লুট করেছে সে কথাও প্রথম জানলাম। এসব লুটতরাজের ক্ষেত্রে তিনি ‘বাঙালিরা’ শব্দটি ব্যবহার করায় যার-পর-নাই অবাক হয়েছি। জনাব খন্দকারকে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন করব : প্যারিসের রাস্তায় চলার পথে দুর্বৃত্তরা আমাদের রাষ্ট্রদূতের গাড়ির কাচ ভেঙে তার ব্রিফকেস, মোবাইলসহ যাবতীয় সামগ্রী নিয়ে গেছে, লন্ডন থেকে আগত এক বাঙালির ব্রিফকেসভর্তি টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে, আমার পকেট থেকে নগদ ডলার, ক্রেডিট কার্ড চুরি করেছে- তাই বলে কি আমরা বলব যে, ফরাসিরা আমাদের টাকা-পয়সা-সম্পদ লুটতরাজ করেছে? দুই-চারজন চোর-ডাকাতের জন্য কি ‘ফরাসিরা’ শব্দটি ব্যবহার করা যায় বা যেত? অথচ খন্দকার সাহেব অবলীলায় বলে দিয়েছেন, ‘লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা।’ কিছু দুষ্কৃতকারীর অপকর্মকে ‘বাঙালিরা’ বলে উল্লেখ করতেও তিনি দ্বিধা করেননি।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বঙ্গবন্ধুকে পদে পদে দোষারোপ করা হয়েছে। দোষারোপ করা হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে! বারবার বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলে বাঙালিদের এত ক্ষতি হতো না। এত প্রাণহানি ঘটত না ইত্যাদি। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বা ঘোষণাকে খাটো করে দেখাতেও তিনি কসুর করেননি। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা জয় পাকিস্তান’। আবার পরবর্তী লাইন লিখেছেন, তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, ‘জয় পাকিস্তান’। এক্ষেত্রে তার কাছে আবারও প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ডাক দিলেন একথা স্বীকার করার পরও তিনি কেন বারবার বলছেন, বঙ্গবন্ধু কোনো সিদ্ধান্ত দেননি? আসলে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত জানার, শোনার বা বোঝার কোনো ইচ্ছা, ধৈর্য বা শক্তি একে খন্দকারের সে সময়ও ছিল না, এখনও নেই। কারণ সে সময়ে তিনি ছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের কর্মকর্তা এবং বর্তমানে আলঝেইমার রোগী। মাঝখানে ১৯৭১ সালে তিনি বাইচান্স পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং পাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অনেক পরে মে মাসে পাক এয়ারফোর্সের চাকরি বহাল রেখে তিন মাসের ছুটি নিয়ে আগরতলায় গিয়েছিলেন। তার তিন মাসের ছুটি মঞ্জুর হওয়ায় তিনি জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত পাক এয়ারফোর্সে চাকরিরত ছিলেন।

যাক সে কথা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যা বলছিলাম, সে কথায় ফিরে আসি। জনাব খন্দকার তার বইয়ে ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’কে হাইলাইট না করে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ দুটি বাক্যকে প্রাধান্য দিয়ে যদি একটু চিন্তাভাবনা করতেন, বাক্য দুটিকে তার মস্তিষ্কে যদি একটু ভালোভাবে জায়গা করে দিতেন, তাহলে হয়তো তার কলম দিয়ে অন্যকিছু বের হতো। জনাব তাজউদ্দীন আহমদের লেখা খসড়া ঘোষণাপত্র রেকর্ড করা না-করা নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেক্ষেত্রেও একই কথা বলব। কারণ যা বলার বা ঘোষণা করার তা তিনি ৭ মার্চের ভাষণেই করে রেখেছিলেন। সেদিনের ভাষণে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করবা ইত্যাদি কথা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যময়। এসব না বলে সেদিন বা পরে তিনি যদি সরাসরি (নষঁহঃষু) বলতেন, আজ এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নাম দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হল, তাহলে সেটাই হতো স্থূল বুদ্ধির কাজ। এমনকি ২৫ মার্চ রাতেও যদি তিনি কোনো ঘোষণা দিতেন, তাতে করে কোটি কোটি মানুষ তার ডাকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ শুরু করে দিতেন এবং সেই অসম যুদ্ধে আরও কয়েক গুণ লোকের প্রাণ যেত। তাছাড়া সেক্ষেত্রে পাকবাহিনী বাঙালিদেরই আক্রমণকারী হিসেবে বিশ্বের সামনে প্রমাণ করত। বঙ্গবন্ধু নিজেকে এবং দেশের মানুষকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ পাকিস্তানিদের দেননি। ভুলে গেলে চলবে না যে, ৭ মার্চ বা ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে এ দেশটি ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাচনে বিজয়ী সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এই স্বল্প পরিসরে এ বিষয়ে বেশি ব্যাখ্যায় যাওয়া সম্ভব নয় বলে শুধু এটুকুই বলব যে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ কথাটিতেই স্বাধীনতা ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল। আর তিনি যদি আরও সরাসরি কথাটি বলতেন, তা যেমন বোকামি হতো, সেই সঙ্গে দেশে বিরাট বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো এবং তাতে করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারির দল বিভিন্ন অপকর্ম ঘটিয়ে বাঙালির ঘাড়ে দোষ চাপাত। যেমন খন্দকার সাহেব বাঙালির ঘাড়ে লুটপাটের দোষ চাপিয়েছেন!

পরিশেষে আবারও বলব, বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ ও তীর্যক বুদ্ধির ফলেই মার্চ মাসে ৭ কোটি বাঙালি ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করায় পাকিস্তানিরা আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। সেদিন সারা পৃথিবী জেনেছিল, বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। বাঙালি সেদিন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে না পারলে বরং প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। আগেভাগেই সহিংস সংগ্রামে নেমে পড়লে পাকিস্তানিরা যে বাঙালিদেরই আক্রমণকারী বলত, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। আর বিষয়টি বিন্দুমাত্র প্রমাণ করতে পারলে আমেরিকার ৭ম নৌবহর ফিরে যেত না, চীনও বসে থাকত না। চীন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা একত্রে কার্যকর বিরোধিতা বা শক্তি প্রয়োগ করলে তখন একে খন্দকারের মতো গ্র“প ক্যাপ্টেন কী করতেন সে কথাও তাকে ভেবে দেখতে বলব।

উপসংহারে বলব, জনাব খন্দকার বইটি নিজে লিখেছেন, না অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছেন সে কথাও দেশবাসীকে ভেবে দেখতে হবে। কারণ আমরা যতদূর জানি, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। সেক্ষেত্রে তাকে দিয়ে

কেউ স্বার্থ হাসিল করাতেও পারেন। সেসব যাচাই-বাছাইয়ের আগে এ কথাটি বলে রাখি যে, তার লেখা বইটি ‘একটি অগ্রহণযোগ্য বই’।

#মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট