পড়াই প্রথম বাণী । পড়ার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে আমার প্রচেষ্টা । কবিতা আমার ভীষণ প্রিয় । Poetry touches my mind, moves me and makes me and forget self. তাই আমার প্রিয় কিছু কবিতা, প্রবন্ধ ও আরো কিছু বিষয় দিয়ে সাজিয়েছি আমার এ বর্ণমালার ঊচ্চারনের ব্লগ । এখানে বেড়াতে এসে যদি আপনার মনে সামান্য প্রশান্তির ছোঁয়া লাগে, তবে ভাববো আমার প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে ।
Monday, 8 September 2014
কানকথা শুনে ইতিহাস লেখা যায় না
আমাদের এক বিখ্যাত কবি লিখেছিলেন, ‘সব শালা কবি হতে চায়।’ তিনি যদি একথাটাও লিখতেন, ‘সব শালা ইতিহাসবিদ হতে চায়’, তাহলে সম্ভবত ভালো করতেন। কারণ, বাংলাদেশের জন্য কথাটা সত্য। নীরদ সি. চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘বাঙালিরা জন্মালেই কবি, হাঁটতে শেখার আগেই ইতিহাসবিদ।’ নীরদ চৌধুরী অত্যুক্তি করেননি। বাংলাদেশে প্রকৃত ইতিহাসবিদরা কল্কে পান না। কিন্তু ভুয়া ইতিহাসবিদের অন্ত নেই। এই ইতিহাস লেখার জন্য গবেষণা, অধ্যয়ন কোনো কিছুরই এদের কাছে দরকার নেই। কানকথা, শোনা কথা ইত্যাদি দিয়ে তারা ইতিহাস লেখেন। স্মৃতিকথা লেখার নামেও কেউ কেউ মনগড়া কথা লেখেন। বাংলাদেশের মতো এত ইতিহাস-বিকৃতির নজির আর কোনো সভ্য দেশে নেই।
আমাদের সবার শ্রদ্ধাভাজন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ নামে সম্প্রতি যে বইটি প্রকাশ করেছেন, সেটিও তিনি শোনা কথা ও কানকথার ওপর নির্ভর করে লিখেছেন। তিনি তার বইতে সত্য প্রকাশের বড়াই করেছেন। কিন্তু এই সত্য জানার জন্য কিছুমাত্র সত্যানুসন্ধান ও তথ্যানুসন্ধান করেননি। তিনি বইটির ৫৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন এই তথ্যটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
কেন বিশ্বাসযোগ্য নয়? তিনি কি এই ব্যাপারে একটু গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন? না করেননি। তার সূত্র কানকথা। তিনি তার বইতে নিজেই লিখেছেন, ‘একদিন আমি তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে আপনি কি তার কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা পেয়েছিলেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, না, আমি কোনো নির্দেশ পাইনি।’
ব্যস, এই কানকথা শুনেই একজন এয়ার ভাইস মার্শালের বিশ্বাস হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠাননি! আর সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস লেখা হয়ে গেল। খন্দকার সাহেবকে বলি, ইতিহাস লেখা কি এতই সহজ? যদি এতই সহজ হতো তাহলে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে ইংরেজদের ভাড়াটিয়া বাঙালি ইতিহাসবিদদের ছড়ানো কালিমা থেকে মুক্ত করতে অক্ষয়কুমার মৈত্রয়কে বারো বছর ধরে নিরন্তর গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান করতে হতো না। তিনি কানকথা শুনে ইতিহাস লেখেননি। কানকথা শুনে ইতিহাস লেখা যায় না।
আমি যদি খন্দকার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি তাজউদ্দীন সাহেবকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কোনো নির্দেশ পাওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন এবং তাজউদ্দীন সাহেব তাতে পাননি বলেছেন, একথা যে সত্য তারই বা প্রমাণ কী? একমাত্র প্রমাণ তিনি নিজে। তার কথায় সত্যতা সম্পর্কে কেউ যদি সন্দেহ প্রকাশ করতে চান তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়?
২৬ মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটকে পড়েছিলেন এমন এক বিদেশী সাংবাদিক লিখেছেন, বেতার যন্ত্রটি অত্যন্ত দুর্বল থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠের এই ঘোষণাটি তিনি শুনেছেন। চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীও একাধিকবার বলেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পেয়েছেন। ওই ঘোষণা পেয়ে তারা ঘোষণাটি প্রচারের উদ্যোগ নেন।
একে খন্দকার যদি সত্যিই সত্যের সন্ধান করতে চাইতেন, তাহলে জহুর আহমদ চৌধুরীকেও তো পেয়ে কথাটি জিজ্ঞেস করতে পারতেন। তিনি তা না করে এখন তাজউদ্দীন আহমদ ও জহুর আহমদ চৌধুরী দুজনেই যখন প্রয়াত, তখন তাজউদ্দীন আহমদের বরাত দিয়ে যে কথাটি প্রচার করছেন, তার সত্যতা কে বিশ্বাস করবে? তার এই দায়িত্বহীন কথাবার্তায় নিজে তো বিতর্কিত হয়েছেনই, তার ওপর মুক্তিযুদ্ধের একজন মহান নেতা তাজউদ্দীন আহমদকেও বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন।
কানকথা শুনে ইতিহাস লিখতে নেই বলেই (যার সত্যতা প্রমাণ করা বা অন্যকে বিশ্বাস করানো মুশকিল) তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে আমার নিজের শোনা একটি কথা ইতিপূর্বে আমি বিশদভাবে লিখিনি। আজ খন্দকার সাহেবকে জানানোর জন্য লিখছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগরে থাকার সময় আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ’৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা বৈঠক অসমাপ্ত রেখে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো যখন রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডি রওনা হন, সে খবর পাওয়ার পরও কি বঙ্গবন্ধু কোনো সিদ্ধান্ত নেননি, কোনো নির্দেশনা দেননি?
তাজউদ্দীন হেসে বলেছেন, না দিলে আমরা সীমান্ত পাড়ি দিলাম কী করে, মুজিবনগরই বা হল কী করে? সে রাতে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর পাওয়া পর্যন্ত আমরা পরামর্শ-বৈঠকে ছিলাম। ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করেন শেষ রাতে। লিডারকে এবং আমাদেরও সেই রাতে গ্রেফতার করা হবে বলে ধরে নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের গ্রেফতার বরণ না করার এবং আত্মগোপন করে সীমান্তে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কী কথাবার্তা বলতে হবে তারও নির্দেশ দেন, এ সম্পর্কিত ব্রিফিং তিনি দিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেনকে। কিন্তু কামাল হোসেন আত্মগোপনে না গিয়ে হানাদারদের কাছে ধরা দেন এবং লাহোরে চলে যান।
তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের ধরা না পড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু নিজে ধরা পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাকে না পেলে হানাদাররা তার খোঁজে ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালাবে বলে তিনি ভয় করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব আজ নেই। ড. কামাল হোসেন এখনও বেঁচে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা সম্পর্কে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা অভিযোগ প্রচার করা হয়েছে। তিনি আজ পর্যন্ত তার কোনো জবাব দেননি। মুক্তিযুদ্ধকালে তার লাহোরে অবস্থান এবং তার ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বিস্ময়করভাবে নীরব। আমাদের অব. এয়ার মার্শাল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা কী ছিল (তখন ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন) তা জানার জন্য তার সঙ্গেও কথা বলেননি কেন? তাজউদ্দীন আহমদ বেঁচে নেই বলেই কি তাকে সাক্ষী গোপাল করা হল?
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন এটাও সম্ভবত খন্দকার সাহেব কানকথা শুনে লিখেছেন। তার আগে প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান (শেলী) এই কথাটি লিখে সমালোচিত হয়েছেন। তিনিও নাকি আমাদের ‘গোলআলু পণ্ডিত’ ড. আনিসুজ্জামানের কানে কানে বলে গেছেন যে, তিনি (বিচারপতি) বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন এটা স্বকর্ণে শুনেছেন। এটা নিয়ে বিচারপতির সঙ্গে আমার কলম যুদ্ধ হয়। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এই কলমযুদ্ধের পর ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি আমার কাছে স্বীকার করেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ৪ জানুয়ারির (৭১) ও ৭ মার্চের (৭১) ভাষণকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ৪ জানুয়ারির নির্বাচন বিজয়ের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছিলেন, ৭ মার্চের ভাষণে বলেননি। তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।
তাকে বলেছি, মনে এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি নিয়ে কথাটি আপনি কেন লিখতে গেলেন? তিনি বিব্রতভাবে বলেছেন, যে পত্রিকাটিতে আমার এ সম্পর্কিত লেখাটি বের হয় তার সম্পাদক আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান বলেছেন কথাটা যখন আপনার মনে জেগেছে তখন লিখে ফেলুন। একটা কনট্রোভাসি সৃষ্টি হোক। কনট্রোভাসির মধ্য দিয়ে সত্য বেরিয়ে আসবে।’ আমি আমার প্রিয় বিচারপতি শেলী ভাইকে বলেছিলাম, আপনি ওই অসাধু সম্পাদকের ফাঁদে পা দিয়েছেন। আপনাকে দিয়ে কনট্রোভাসি সৃষ্টি করে ওই সম্পাদক তার কাগজের কাটতি বাড়াবেন, কিন্তু আপনি সুনাম হারাবেন। এই একই খেলার ফাঁদে একে খন্দকারও পা দিয়েছেন কিনা আমি জানি না। তবে ওই সম্পাদকের প্রকাশনা সংস্থাই খন্দকার সাহেবের বইটি প্রকাশ করেছে। বিতর্কের ঝড়ে বইটি নাকি হু হু করে বিক্রি হয়ে গেছে। তাতে পকেট ভারি হয়েছে মুনাফালোভী সম্পাদকের। সুনাম খোয়াচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের একজন বর্ষীয়ান নেতা।
আওয়ামী লীগ একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর দল। এই বইটি যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত তার বেশি গুরুত্ব দিয়ে তারা পার্লামেন্টেও হৈচৈ করেছেন এবং বইটি নিষিদ্ধ করার জন্যও কেউ কেউ দাবি তুলেছেন। আমি অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। এই বই মোটেই নিষিদ্ধ করা উচিত হবে না। বরং এই বইয়ের মিথ্যাচারগুলো পাঠকদের কাছে তুলে ধরে সত্য ও সঠিক ইতিহাস চর্চা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। খন্দকার সাহেব যদি সত্যই বিবেকবান মানুষ হন, তার উচিত হবে বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া। এর সংশোধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশের ব্যবস্থা করা।
খন্দকার সাহেব যদি তা না করেন, তাহলে সেক্টর কমান্ডাস ফোরামের উচিত হবে, তার কাছে কৈফিয়ত তলব করা এবং তিনি উপযুক্ত কৈফিয়ত দিতে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। খন্দকার সাহেবকে বোঝানো উচিত, কানকথা শুনে ইতিহাস লেখা অন্যায়।
# আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
www.jugantor.com/sub-editorial/2014/09/08/144846