জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক সাফল্য এখানেই যে, তিনি তার দেশের রাজনীতিকে অনেকটা জটিল করে তুলতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার সুযোগে অর্থ, অস্ত্র আর নেতৃত্বের লোভ দেখিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। সুবিধাবাদী রাজনীতিক, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে প্রবলভাবে ধারণ না করতে পারা এ অংশটি নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ তৈরিতে রাতারাতি জাতীয়তাবাদী হয়ে গেলেন।
বিএনপি ইতিহাসের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করানোর সব রকম পথ তৈরি করতে থাকে জিয়াউর রহমান পরবর্তী পর্বে। পাকিস্তানপন্থী মানসিকতাকে আরও সক্রিয় করে। সাম্প্র্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে নিজেদের ভোটব্যাংক ও বিকল্প পেশিশক্তি হিসেবে পাওয়ার আনন্দে প্রায় স্থায়ী বন্ধু করে ফেলে। জিয়াউর রহমান নিজে দাবি না করলেও ১৯৭৫-এ জন্ম নেয়া দলকে মুক্তিযুদ্ধের দল এবং তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে ফেলে বিএনপির পরবর্তী নেতৃত্ব। এতেও সুবিধার ফসল ঘরে না ওঠায় ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কালিমা ও আবেগ যাতে ফসল হয়ে আওয়ামী লীগের গোলায় না ওঠে তাই খোদ খালেদা জিয়ার গলাটিই যূপকাষ্ঠে তুলে দেয়া হল। শোক দিবসকে উৎসবের দিবসে রূপান্তরিত করার জন্য ঘোষিত হল খালেদা জিয়ার নতুন জন্মদিন। এমন অমানবিক ও নির্লজ্জ আচরণ বিশ্বে আর কোথাও হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। প্রজন্মকে মিথ্যার চাদরে ঢেকে দিতে বিএনপি নেতারা ঘোষক থিওরি দমে দমে প্রচার করতে লাগলেন।
এসবেও যখন খুব সুবিধা হল না, তখন লন্ডনে বসে ইতিহাস ও সুস্থ রাজনীতিবিচ্ছিন্ন বিএনপি নেতা তারেক রহমান নতুন প্রেসিডেন্ট থিওরি নিয়ে এলেন। ভেবেছিলাম এসব পাগলামিকে বিএনপি নেতারা বাড়তে দেবেন না। কিন্তু চমকে গেলাম ২২ আগস্ট জয়পুরহাটে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শুনে। দেখলাম তিনি নিজেই ছেলের থিওরি প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাবৎ দেশবাসীকে মূর্খ বিচার করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার দল বিএনপি- এমন কথা খোদ বিএনপি প্রধানের মুখ থেকেই শুনতে হল। একবার মনে হল, আংশিক হলেও ঠিক কথাই বলেছেন খালেদা জিয়া। অনেকটা যুক্তিবিদ্যার সেই আমি টেবিল ছুঁয়ে আছি, টেবিল মাটি ছুঁয়ে আছে তাই আমি মাটি ছুঁয়ে আছি ধরনের। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন বিএনপি নামের দলটির। যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বুকে জড়িয়ে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল! এখন তো ফর্মুলা অনুযায়ী সব সেক্টর কমান্ডার, যে কোনো পর্যায়ের কমান্ডার বা সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক দল গঠন করলে সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের দল হয়ে যাবে। খালেদা জিয়া বন্দি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানিদের সেনানিবাসে দিন কাটিয়েছেন। বিএনপির পরের চমক হতে পারে একই ফর্মুলায় প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খালেদা জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করা।
আপাতত প্রথম প্রেসিডেন্ট থিওরি নিয়ে একটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। বন্ধুর দেয়া তথ্যটি আমার মনে ধরেছে। এক অর্থে যৌক্তিকও বটে। একথাটি তো ঠিক, ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ছিলেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তো ভেবেছিলেন বিশ্ববাসী বা পাকিস্তানিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একটি সাংগঠনিক কাঠামোর ধারণা তুলে ধরা প্রয়োজন। তাই নিজ বিবেচনায় নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলে ফেলেছিলেন। তারপর যখন তাকে ভুলটি ধরিয়ে দেয়া হল, বলা হল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলে তা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এরপর থেকে তিনি বিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২) তৃতীয় খণ্ডে মুদ্রিত জিয়াউর রহমানের ঘোষণাপত্রে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তাই হঠাৎ প্রেসিডেন্টতত্ত্ব শুনে আমার পুরনো বন্ধু কিশোরগঞ্জ থেকে ফোন করলেন। বললেন, একই ফর্মুলায় এখন নান্টু পাগলকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বলতে হবে।
বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন তিনি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর কয়েকটি বাস্তব ঘটনা লক্ষণীয় ছিল। পাড়ায়-মহল্লায় তরুণরা বাঁশের লাঠি বানিয়ে মার্চপাস্ট করছিল। আমার বন্ধুর পাড়ায়ও অমন প্রশিক্ষণ চলছিল। সেখানে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন এলাকার পরিচিত নান্টু পাগল। মাঝ বয়সী মানুষ। কখনও আধা, আবার কখনও পুরো পাগলামি আচরণে পেয়ে বসে। সেদিন নান্টু পাগলের হাতে ছিল মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা। তিনি কণ্ঠ চড়িয়ে বললেন, এহিয়া খান নিপাত যাক। আজ থেকে আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিলাম। জয়বাংলা। উপস্থিত সবাই বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নান্টু পাগলকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল।
বন্ধু বললেন, তারেক রহমানদের দাবি মতো কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেই যদি প্রেসিডেন্ট হয়ে যায় এবং নান্টু পাগলের পরে ও জিয়াউর রহমানের ঘোষণার আগে আর কেউ যদি নিজেকে প্রেসিডেন্ট দাবি না করে থাকেন, তবে জিয়াউর রহমানকে প্রথম নয়, স্বঘোষিত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট বলা যেতে পারে।
আমার বন্ধুর অমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে স্যাটায়ার। জিয়াউর রহমানের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে অমন স্যাটায়ার স্বস্তিদায়ক নয়। একজন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে অমন স্যাটায়ার নিন্দনীয়ও। আমি বন্ধুটিকে বলেছিলামও সে কথা। বন্ধুটি ক্ষমা চেয়ে বললেন, জিয়াউর রহমানকে হেয় করার কোনো ইচ্ছে এ গল্পের ভেতর নেই। স্বাধীনতার তেঁতাল্লিশ বছর পর বিএনপির প্রথম প্রেসিডেন্ট থিওরির দায় জিয়াউর রহমানের নয়। বস্তুত রাজনীতির হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজ নেতাকে লাঞ্ছিত করছেন বিএনপির জীবিত নেতা-নেত্রীরা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা নয়। অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত মেধা মানুষকে শিক্ষিত করে তোলে। খালেদা জিয়া একটি বড় দলের কাণ্ডারি। তাছাড়া তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে তো ইতিহাস-মূর্খ আর বাস্তববোধ বর্জিত বলা যায় না। তরুণ ছেলে যদি ভুলও করে থাকে, তবে মা হিসেবে তাকে ধমকে দেয়া যায় আর দলীয় নেত্রী হিসেবে সাবধান করে দেয়া যায়। একসময় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাতত্ত্ব জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পারিষদবর্গের ওপর দায়িত্ব ছিল দমে দমে তা বলে বেড়ানো। সে দায়িত্ব এখনও পালিত হচ্ছে। কাজের কাজ তো তেমন হয়নি। সাধারণ মানুষকে যতটা মূর্খ আর বোকা ভাবা হয়েছিল, দেখা গেল বাস্তবে তারা তেমনটি নন। তারপরও হুঁশ হয়নি। আজকে আবার প্রেসিডেন্টতত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন নেতা-নেত্রীরা। প্রথম ও দ্বিতীয় দায়িত্ব পালন করলেন যথাক্রমে তারেক ও খালেদা জিয়া। এখন হয়তো মির্জা ফখরুলদের পালা। শুরু হবে আরেক ভাঙা রেকর্ডের বাজনা।
এসব পাগলামো কি বলে দেয় না দলটি চরম হতাশায় ভুগছে? এ হতাশা কাটাতে ভুল পথে হাঁটা কেন? মানতে হবে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ভ্রান্তি আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের অপরিণামদর্শী করে তুলছে। তারা দিনে দিনে আরও বেশি গণতন্ত্রবিচ্ছিন্ন দাপুটে হয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগের প্রতি জনক্ষুব্ধতা বাড়াচ্ছে। শুভবুদ্ধিই পারে বিএনপিকে হতাশামুক্ত করতে। জনকল্যাণমূলক ইতিবাচক রাজনীতি করে জনসম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে তাদের। এ সত্যটি যত দ্রুত বিএনপি নেতারা বুঝতে পারবেন ততই তা দলের এবং দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
www.jugantor.com/sub-editorial/2014/06/27/116069#sthash.lA7K1E9g.dpuf
এসবেও যখন খুব সুবিধা হল না, তখন লন্ডনে বসে ইতিহাস ও সুস্থ রাজনীতিবিচ্ছিন্ন বিএনপি নেতা তারেক রহমান নতুন প্রেসিডেন্ট থিওরি নিয়ে এলেন। ভেবেছিলাম এসব পাগলামিকে বিএনপি নেতারা বাড়তে দেবেন না। কিন্তু চমকে গেলাম ২২ আগস্ট জয়পুরহাটে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শুনে। দেখলাম তিনি নিজেই ছেলের থিওরি প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাবৎ দেশবাসীকে মূর্খ বিচার করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার দল বিএনপি- এমন কথা খোদ বিএনপি প্রধানের মুখ থেকেই শুনতে হল। একবার মনে হল, আংশিক হলেও ঠিক কথাই বলেছেন খালেদা জিয়া। অনেকটা যুক্তিবিদ্যার সেই আমি টেবিল ছুঁয়ে আছি, টেবিল মাটি ছুঁয়ে আছে তাই আমি মাটি ছুঁয়ে আছি ধরনের। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন বিএনপি নামের দলটির। যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বুকে জড়িয়ে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল! এখন তো ফর্মুলা অনুযায়ী সব সেক্টর কমান্ডার, যে কোনো পর্যায়ের কমান্ডার বা সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক দল গঠন করলে সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের দল হয়ে যাবে। খালেদা জিয়া বন্দি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানিদের সেনানিবাসে দিন কাটিয়েছেন। বিএনপির পরের চমক হতে পারে একই ফর্মুলায় প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খালেদা জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করা।
আপাতত প্রথম প্রেসিডেন্ট থিওরি নিয়ে একটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। বন্ধুর দেয়া তথ্যটি আমার মনে ধরেছে। এক অর্থে যৌক্তিকও বটে। একথাটি তো ঠিক, ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ছিলেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তো ভেবেছিলেন বিশ্ববাসী বা পাকিস্তানিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একটি সাংগঠনিক কাঠামোর ধারণা তুলে ধরা প্রয়োজন। তাই নিজ বিবেচনায় নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলে ফেলেছিলেন। তারপর যখন তাকে ভুলটি ধরিয়ে দেয়া হল, বলা হল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলে তা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এরপর থেকে তিনি বিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২) তৃতীয় খণ্ডে মুদ্রিত জিয়াউর রহমানের ঘোষণাপত্রে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তাই হঠাৎ প্রেসিডেন্টতত্ত্ব শুনে আমার পুরনো বন্ধু কিশোরগঞ্জ থেকে ফোন করলেন। বললেন, একই ফর্মুলায় এখন নান্টু পাগলকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বলতে হবে।
বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন তিনি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর কয়েকটি বাস্তব ঘটনা লক্ষণীয় ছিল। পাড়ায়-মহল্লায় তরুণরা বাঁশের লাঠি বানিয়ে মার্চপাস্ট করছিল। আমার বন্ধুর পাড়ায়ও অমন প্রশিক্ষণ চলছিল। সেখানে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন এলাকার পরিচিত নান্টু পাগল। মাঝ বয়সী মানুষ। কখনও আধা, আবার কখনও পুরো পাগলামি আচরণে পেয়ে বসে। সেদিন নান্টু পাগলের হাতে ছিল মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা। তিনি কণ্ঠ চড়িয়ে বললেন, এহিয়া খান নিপাত যাক। আজ থেকে আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিলাম। জয়বাংলা। উপস্থিত সবাই বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নান্টু পাগলকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল।
বন্ধু বললেন, তারেক রহমানদের দাবি মতো কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেই যদি প্রেসিডেন্ট হয়ে যায় এবং নান্টু পাগলের পরে ও জিয়াউর রহমানের ঘোষণার আগে আর কেউ যদি নিজেকে প্রেসিডেন্ট দাবি না করে থাকেন, তবে জিয়াউর রহমানকে প্রথম নয়, স্বঘোষিত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট বলা যেতে পারে।
আমার বন্ধুর অমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে স্যাটায়ার। জিয়াউর রহমানের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে অমন স্যাটায়ার স্বস্তিদায়ক নয়। একজন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে অমন স্যাটায়ার নিন্দনীয়ও। আমি বন্ধুটিকে বলেছিলামও সে কথা। বন্ধুটি ক্ষমা চেয়ে বললেন, জিয়াউর রহমানকে হেয় করার কোনো ইচ্ছে এ গল্পের ভেতর নেই। স্বাধীনতার তেঁতাল্লিশ বছর পর বিএনপির প্রথম প্রেসিডেন্ট থিওরির দায় জিয়াউর রহমানের নয়। বস্তুত রাজনীতির হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে নিজ নেতাকে লাঞ্ছিত করছেন বিএনপির জীবিত নেতা-নেত্রীরা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা নয়। অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত মেধা মানুষকে শিক্ষিত করে তোলে। খালেদা জিয়া একটি বড় দলের কাণ্ডারি। তাছাড়া তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে তো ইতিহাস-মূর্খ আর বাস্তববোধ বর্জিত বলা যায় না। তরুণ ছেলে যদি ভুলও করে থাকে, তবে মা হিসেবে তাকে ধমকে দেয়া যায় আর দলীয় নেত্রী হিসেবে সাবধান করে দেয়া যায়। একসময় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাতত্ত্ব জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পারিষদবর্গের ওপর দায়িত্ব ছিল দমে দমে তা বলে বেড়ানো। সে দায়িত্ব এখনও পালিত হচ্ছে। কাজের কাজ তো তেমন হয়নি। সাধারণ মানুষকে যতটা মূর্খ আর বোকা ভাবা হয়েছিল, দেখা গেল বাস্তবে তারা তেমনটি নন। তারপরও হুঁশ হয়নি। আজকে আবার প্রেসিডেন্টতত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন নেতা-নেত্রীরা। প্রথম ও দ্বিতীয় দায়িত্ব পালন করলেন যথাক্রমে তারেক ও খালেদা জিয়া। এখন হয়তো মির্জা ফখরুলদের পালা। শুরু হবে আরেক ভাঙা রেকর্ডের বাজনা।
এসব পাগলামো কি বলে দেয় না দলটি চরম হতাশায় ভুগছে? এ হতাশা কাটাতে ভুল পথে হাঁটা কেন? মানতে হবে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ভ্রান্তি আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের অপরিণামদর্শী করে তুলছে। তারা দিনে দিনে আরও বেশি গণতন্ত্রবিচ্ছিন্ন দাপুটে হয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগের প্রতি জনক্ষুব্ধতা বাড়াচ্ছে। শুভবুদ্ধিই পারে বিএনপিকে হতাশামুক্ত করতে। জনকল্যাণমূলক ইতিবাচক রাজনীতি করে জনসম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে তাদের। এ সত্যটি যত দ্রুত বিএনপি নেতারা বুঝতে পারবেন ততই তা দলের এবং দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
www.jugantor.com/sub-editorial/2014/06/27/116069#sthash.lA7K1E9g.dpuf