ঝালে ঝোলে অম্বলে
সংযমের মাসে অসংযমী রাজনৈতিক বক্তব্য ও মান-অপমানবোধ
এদেশে কোনো কিছুই যেন রাজনীতির বাইরে থাকতে পারবে না। সব কিছুকেই একটা রাজনৈতিক রূপ দিতে হবে। পবিত্র রমজান মাসকে বলা হয় সংযমের মাস। পার্থিব সকল অন্যায়কে বিসর্জন দিয়ে ন্যায় অর্জনই এর একমাত্র শিক্ষা। রাজনীতির সঙ্গে এর দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। এই সংযমের মাসেও আমাদের নেতানেত্রীদের অসংযমী বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে। রমজান মাসও পরিণত হয়েছে রাজনীতির মাসে। 'ইফতার পার্টি'র নামে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কথামালার রাজনীতি অব্যাহত রেখেছেন। হাবভাব দেখে মনে হয় রাজনীতিবিদরা এই মাসটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। বলা বাহুল্য, তাদের এই অপেক্ষা রোজার মাধ্যমে, ত্যাগ ও সংযমের মাধ্যমে স্রষ্টার অনুগ্রহ হাসিলের উদ্দেশ্যে নয় বরং এর মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন!
এদেশের রাজনীতিতে মেধার মূল্যায়ন সীমিত। মঞ্চে গলাবাজি আর ক্যামেরার সামনে নেত্রীর পক্ষে চাটুকারিতাই রাজনীতিবিদ হওয়ার বড় সার্টিফিকেট। রমজান মাসেও এমন রাজনীতি-যজ্ঞের ব্যত্যয় ঘটে না। পার্থক্য এই যে, এ মাসে এসব গলাবাজি আর চাটুকারিতা মাঠ-ময়দান থেকে নামি-দামি রেস্তোরাঁয় জায়গা করে নেয়। যেখানে ইফতার সামনে নিয়ে বেশি বেশি স্রষ্টাকে স্মরণ করার কথা, সেখানে ইফতার সামনে নিয়ে শুরু হয়ে যায় নিরেট রাজনৈতিক বক্তব্য আর আস্ফাালন। মাঝে মাঝে বক্তা হয়তো ভুলে যান তিনি এখন পল্টন ময়দানে অবস্থান করছেন না। সজোরে টেবিল চাপড়ে তিনি সকল রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি চাইছেন। রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিচ্ছেন। সরকারকে টেনে-হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর হুমকিও আসছে। এ সবই হচ্ছে 'ইফতার'কে সামনে নিয়ে। রোজার সুমহান আদর্শের সঙ্গে এর সম্পর্ক কতটুকু— আল্লাহ মালুম!
এসব ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে নেতানেত্রীদের বক্তৃতা ও ভোজন-বিলাসের মহোত্সব চলছে যেন। একেকটি ইফতার পার্টির আয়োজন করতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে। এই আয়োজনে কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এসব টাকার উত্স নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলছেন না! ধর্মীয় বিধান মতে, রোজার মাধ্যমে যে সংযম আর কৃচ্ছ তা সাধনের শিক্ষার কথা বলা হয়, এখানে তার কিছু অবশিষ্ট থাকে কী ?
কূটনীতিবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীসহ আরো নানা 'ধনিক গোষ্ঠী'র সম্মানে ইফতারের আয়োজন করা হয় কিন্তু আম জনতার জন্য এমন আয়োজন চোখে পড়ে না। ব্যাপারটা অনেকটা তেলা মাথায় তেল দেয়ার মত। ইদানিং অবশ্য আরো একটি ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই বিশেষ গোষ্ঠীসমূহের জন্য উনত্রিশ দিন বরাদ্দ রেখে একদিন 'এতিমদের জন্য' ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। সেটিও মিডিয়া কভারেজ পাওয়ার জন্য!
খবরে প্রকাশ, এই রমজানে শুধু ঢাকায় ৬০০০ ইফতার পার্টি আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে জামায়াতে ইসলামী। এক্ষেত্রে তারা অবশ্য রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছে, এসব আয়োজন কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য। এদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও ঘোষণা দিয়েছে, রোজার মাসে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি এসব ইফতার মাহফিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
যদিও এসব আয়োজন এখন স্রেফ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এসব আয়োজন থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে। তখন রমজানের রাজনীতিকরণের ষোলকলা পূর্ণ হবে!
আপাতত চলছে হুমকি! বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া 'ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের' হুমকি দিয়ে বলেছেন, 'অত্যাচারী সরকারকে উত্খাতে আন্দোলনের বিকল্প নেই। এই সরকারকে তত্পর করতে ঈদের পর কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই জালিম সরকারকে তত্পর করতে হবে। জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জালিম সরকারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলব।'
গত সোমবার রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সম্মানে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)'র ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন। মতিঝিলস্থ পূর্বানী হোটেলে এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
বিএনপি নেত্রী অবশ্য গত প্রায় পাঁচ বছর ধরেই এই ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন। 'কঠিন' আন্দোলন, 'কঠোর' আন্দোলন, 'মারাত্মক' আন্দোলন, 'ভয়ঙ্কর' আন্দোলন—এমনি নানা আন্দোলনের হুমকির কথা আমরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে শুনছি, কিন্তু পোড়া চোখে এখনও তেমন কিছুই দেখিনি। যা করার এবং যা না করার—সবই আওয়ামী লীগ করছে, বিনা বাধায়, প্রতিরোধহীনভাবে!
এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিএনপির হুমকির জবাবে বলেছেন, 'আন্দোলন করে সরকার পতন করার মত সাংগঠনিক শক্তি এই দলের নেই। তিনি বলেন, সেজন্য বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার ঈদের পর আন্দোলন করার হুমকিকে আমলে নেয়ার প্রয়োজন নেই।'
বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, 'নখ-দন্তহীন বুড়ো বাঘিনীর ডাকে দেশের মানুষ আর কখনো সাড়া দেবে না'।
মাহবুব-উল আলম হানিফের এমন বক্তব্য বিএনপির জন্য নিঃসন্দেহে 'অপমানজনক'। যদিও বিএনপিওয়ালারা তাতে অপমানিত হবেন বা হয়েছেন বলে মনে হয় না। এসব আমাদের দেশের নেতানেত্রীদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে অপমান করলেও কেউ কারুরটা গায়ে মাখেন না। এটা অবশ্য তাদের ঔদার্যও বটে!
অবশ্য সবার মান-অপমান বোধ সমান নয়। এমন অনেক লোক আছেন যাদের গায়ের চামড়া খুব পুরু এবং চোখের চামড়া নেই, তাদের চেষ্টা করেও অপমান করা যায় না। আবার এক ধরনের লোক আছেন, যারা কারণে-অকারণে হঠাত্-হঠাত্ই অপমানিত বোধ করেন। মনে করুন, একজন আপনার কাছে দেয়াশলাইটা একটু চাইলেন, আপনি একটু অন্যমনস্ক কিংবা অন্য কোনো কারণে দেয়াশলাইটা দিতে একটু দেরি করলেন, তিনি রাগে-অপমানে লাল হয়ে উঠলেন!
এরকম উদাহরণ অবশ্য আরো বহু দেখা যায়। আমাদের প্রত্যেকেরই এই দু'ধরনের লোকের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় আছে এবং শুধু তা-ই নয়, আমাদের কেউ কেউ এদেরই মতো। সবার অপমানবোধ যেমন সমান নয়, তেমনি চিরদিন কিছু সরল প্রকৃতির লোক আছেন অপমান হলেও বুঝতে পারেন না। তাদের যে আত্মসম্মানবোধ নেই—তা কিন্তু নয়। এরা আসলে সরল প্রকৃতির লোক; অপমান হলেও বুঝতে পারেন না। তাদের যে আত্মসম্মানবোধ নেই তাও নয়, কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাঁকা কথা বললে এরা ধরতে পারেন না। আকারে-ইঙ্গিতে এদের অপমান করা যায় না। তবে এরকম যদি বুঝতে পারেন যে, অপমানিত হয়েছেন কিংবা কেউ তাকে অপমান করেছেন, তখন রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন।
মান-অপমান বিষয়ে একটা পুরনো গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে। গল্পটি পুরানো, সেই 'সাধু ভাষা'র আমলের।
গরিব বাড়ির একটি অল্পশিক্ষিত ছেলে এক নব্য বড়লোকের বাড়িতে কাজের জন্য নিযুক্ত হয়েছে। তার কাজ ছিলো ফুট-ফরমায়েশ খাটা, এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করা।
কিন্তু এই ধনীগৃহের লোকজন বড় বেশি সুবিধার ছিলো না। তারা কারণে-অকারণে নানারকম ছুঁতো ধরে সেই গরিব ছেলেটির ওপর অত্যাচার চালাতো। গরিব ছেলেটির কোনো উপায় ছিলো না বলে মুখ বুঁজে সব অপমান-অত্যাচার সহ্য করতো।
ছেলেটি একদিন তার এক বন্ধুর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলো। 'অপমান শাস্ত্রের' ইতিহাসে এটাকে চরমপত্র বলা যায়। চিঠিটির উল্লেখযোগ্য অংশ এরকম:
'প্রিয় রহমত,
আজ দেড় মাস হইল চৌধুরী বাড়িতে কাজ করিতেছি। এই চৌধুরীরা যেমন বড়লোক, তেমনই ছোটলোক। ইহাদের টাকা-পয়সার, অর্থের অভাব নাই। কিন্তু লোকের সঙ্গে বিশেষত বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করে, এমনকি মারধর করে। বিশেষ কি বলিব, কয়েকদিন আগে বাজার হইতে আসিতে দেরি হওয়ায় ছোটসাহেব লাথি মারিলেন। গতকাল পানি দিতে দেরি হওয়ায় মেজসাহেবা 'শুয়োরের বাচ্চা' বলিলেন, আজ কাঁচের গেলাস ভাঙিয়া ফেলায় বড়সাহেব জুতা মারিলেন।
আমার এখন ভয় হইতেছে, ইহারা আমাকে না জানি কোনোদিন অপমান করিয়া বসিবে। অপমান আমার সহ্য হইবে না, তখন কাজ ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইব।
-ইতি
তোমার হতভাগ্য বন্ধু
আজগর'
আমাদের দেশে যারা নম্র-ভদ্র, মান-ইজ্জত বিষয়ে যারা সচেতন ও সতর্ক, তারা সব রকম বিরোধ-বিসম্বাদ এড়িয়ে চলেন, কোনো রকম ঝামেলায় না জড়িয়ে কীভাবে মান বাঁচিয়ে চলা যায়, সমাজে টিকে থাকা যায়—সেই 'আর্ট' প্রতিনিয়ত চর্চা করেন। সচরাচর কোনো ভদ্রলোককে মান রক্ষার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে দেখা যায় না। মান-ইজ্জত নিয়ে কোথাও কখনো আশঙ্কা দেখা দিলে মানে মানে কেটে পড়ার চেষ্টা করেন। অনেকে বিরোধ-বিতর্ক এড়িয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পালিয়ে হলেও মান বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
বর্তমান জমানায় অবশ্য বিশ্বাসভাজন হওয়াটাই সবচাইতে বড় যোগ্যতা। যদিও প্রাণিজগত্ ছাড়া বিশ্বাসভাজন কাউকে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। দলের প্রয়োজনে লেজ নাড়বে, অপ্রয়োজনে ঘেউ ঘেউ করে গোটা পাড়া মুখর করে রাখবে, পরিবারের পরিচিতজন ছাড়া যে কোনো আগস্তুক দেখলেই ধাওয়া করবে, দরকার হলে কামড়ে দেবে—এমন গুণ মনুষ্যজগতে একেবারেই বিরল। অল্প দু'চারজন যারা এই বিরল গুণের অধিকারী হয়ে সমাজে এখনো টিকে আছেন, স্বাভাবিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সংখ্যায় তারা কম বলে দায়িত্বের বোঝাও তাদের ঘাড়েই বেশি চাপানো হয়।
গত পাঁচ বছর ধরে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে চরমভাবে ব্যর্থ বিএনপির নেতানেত্রীদের মুখে আন্দোলনের হুমকির কথা শুনে মনে পড়ছে একটি পুরানো গল্প। এক ভদ্রলোক একটি পুরানো জিনিসের দোকানে (এন্টিক শপ) গেছেন একটি উপহার কিনতে। একটি পাথরের মূর্তি তার নজরে পড়ল যেখানে একজন যোদ্ধা একটা ঘোড়ার উপর বসে আছে। কিন্তু মূর্তিটা অনেক পুরানো, তাই এর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। হাতের তলোয়ারটা আধা ভাঙ্গা, যোদ্ধার নাকটা পর্যন্ত কিছুটা ভেঙ্গে গেছে। মাথায় পরা হেলমেটের অবস্থাও খারাপ। মূর্তির উপর এক জায়গায় খোদাই করে লেখা 'বিজয়ী'।
এই দেখে ক্রেতা ভদ্রলোক আঁেক উঠে বলল, হায় হায়! এই যদি হয় বিজয়ীর অবস্থা তাহলে পরাজিত কাকে বলব?