Monday, 4 April 2016

নববর্ষ উদযাপন ও বর্তমান বাংলাদেশ

নববর্ষ উদযাপন ও বর্তমান বাংলাদেশ
ড. একে এম শাহনাওয়াজ | প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০১৫
ঋতুর বিচিত্র খেয়ালে প্রকৃতি নববর্ষের দিনে এবার রুদ্ররূপে সাজেনি। তবুও বৈশাখ আবহমান বাঙালি সত্তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বৈশাখে আকাশ যেমনই থাক, তবু কল্পনায় কালো করে আসা মেঘ, বজ্রের ডমরু, উন্মাতাল ঝড় প্রতিবাদী বাঙালির প্রতীক হয়েই আছে। এবার চৈত্রের শেষেই কয়েকটি বজ্র-বর্ষণ হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের খরতাপে বিপর্যস্ত জীবনে বারিধারার অমিয় বর্ষণে নরম হয়ে যাওয়া বিগলিত মাটি বাঙালির কোমল হৃদয়কেই যেন মেলে ধরে। বাঙালি জীবনের এ বিচিত্র রূপের মোহনীয় আবেশে নতুন বছরের যাত্রা শুরু হয়েছে দু’দিন আগে। নানা রঙে রাঙিয়ে সব আয়োজনের ডালি সাজিয়ে বাঙালি নববর্ষ বরণ করেছে। রংবেরঙের পোশাকে ঢাকঢোল আর নানা বাদ্যে মাতোয়ারা সব কণ্ঠে সুধা ঢেলে সুর লহরি ছড়িয়ে দিয়েছে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। কবিগুরুর মতো আমাদের প্রত্যাশা, যা কিছু গ্লানি যা কিছু জরা- সব ধুয়ে মুছে যাক। বৃষ্টি ধোয়া আকাশ আর প্রকৃতি যেমন নিষ্পাপ-নির্দোষ, তেমনি আবেশ মেখেই যেন নতুন বছরের শুভ উদ্বোধন হয়েছে। ঢাকের শব্দে মাতোয়ারা হয়েছে চারপাশ। চঞ্চল হয়ে উঠেছে ঢুলির হাতের কাঠি। নাচ-গানে ছন্দময় হয়েছে চারপাশ। পিঠাপুলি আর পায়েসের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে দখিনা বাতাস।
বৈশাখ এভাবে বারবার আসে নিজের চিরপরিচিত সাজে। সমাজ ও রাজনীতির অসুস্থ অবয়ব প্রতিবার শুদ্ধ করতে যেন অপেক্ষা করতে হয় বৈশাখের। ক্ষমতার রাজনীতির প্রচণ্ড স্বার্থপরতা ও অমানবিক আচরণ বিপর্যস্ত করে তুলেছে সংগ্রামী বাঙালির জীবন। সম্প্রতি রাজনীতির নামে অতিষ্ঠ করে তুলেছে জনজীবন এ দেশেরই রাজনীতি অঙ্গনের মানুষ। এজন্য সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের কোনো পরোয়া যেন নেই। কোনো ক্ষমা ভিক্ষা নয়, নয় দুঃখ প্রকাশ বা সমবেদনা জানানো। আবহমান বাঙালির জীবনবোধের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
তবে মানতে হবে, সব অনাচার থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে বৈশাখ বরাবরই প্রাসঙ্গিক। সময়ের প্রয়োজনে বারবারই নিজের রূপে পরিবর্তন এনেছে সে। আজ যেভাবে নানা রঙে-বর্ণে বৈশাখের আয়োজন, আদিতে এমনভাবে নববর্ষের আয়োজন হয়নি। বাঙালির পঞ্জিকা বৈদিক যুগের সৌর পঞ্জিকার ধারাতেই তৈরি হয়েছিল। উৎসটি অভিন্ন থাকায় মিথিলা, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়–, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, শ্রীলংকা ইত্যাদি জায়গার মতো মধ্য এপ্রিলে বাংলায় নববর্ষ পালিত হতো।
মোগলযুগের প্রথম দিকে হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো। তবে এতে সমস্যা ছিল। হিজরি সন তৈরি হয়েছে চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসরণ করে। কৃষকের ফসল তোলার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। তাই বিরুদ্ধ ঋতুতে খাজনা পরিশোধ করা কৃষকের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। এ বাস্তব সংকটটি সম্রাট আকবরের দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি এর সমাধান খোঁজার দায়িত্ব দেন সে সময়ের প্রখ্যাত পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে। সিরাজী বৈদিক সৌর পঞ্জিকা ও হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকার সমন্বয়ে বাংলা সন হিসাবের জন্য একটি পঞ্জিকা তৈরি করলেন। একে সম্পর্কিত করা হল কৃষকের ফসল কাটার সময়ের সঙ্গে। সাধারণের মুখে মুখে সনটির নাম হয়ে গেল ফসলি সন। অর্থাৎ কৃষিবর্ষ। পরে এ সনের নাম হয় বঙ্গাব্দ। সম্রাটের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল। কৃষকের গোলায় ফসল উঠবে। খাজনা পরিশোধে তাকে কোনো চাপে পড়তে হবে না। নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন হয় বৈশাখ মাসের প্রথম দিন। তখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তারিখ ছিল ১৫৮৪ সালের ১০ অথবা ১১ মার্চ। তবে এই সন গণনা কার্যকর হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার দিন থেকে। অর্থাৎ ১৪ ফেব্র“য়ারি (মতান্তরে ৫ নভেম্বর) ১৫৫৬ সালে।
এসব ইতিহাসের সন-তারিখ বাদ দিলেও বলা যায়, নববর্ষ আদিকাল থেকে বাঙালি ঋতুভিত্তিক উৎসব হিসেবে পালন করত। কৃষির সঙ্গে ছিল এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইরানি ভাবধারার প্রভাবে মোগলরা জমকালোভাবে নববর্ষ বা নওরোজ উৎসব পালন করত। বাংলা নববর্ষ প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে দিনটি সাড়ম্বরে উদযাপিত হতে থাকে। সম্রাট আকবরের সময় থেকে (১৫৫৬-১৬০৫) বিশ শতকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার গ্রাম-গঞ্জে আনন্দ-উদ্দীপনায় নববর্ষ পালিত হতো। বুঝতে হবে আজকের কলুষিত রাজনীতি এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিকবলিত জীবনবোধের সঙ্গে আবহমান বাঙালির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।
জমিদারি যুগে নববর্ষ পালনে বিশেষ রেওয়াজ ছিল। জমিদার ও ছোট-বড় ভূস্বামীদের কৃষক চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করত। নববর্ষের দিন প্রসন্ন চিত্তে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে মেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। জমিদারদের মাধ্যমে এমনি করে আনুষ্ঠানিকভাবে নববর্ষ পালনের যাত্রা শুরু হয়। পরে বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ একটি বড় উৎসবে পরিণত হয়। জমিদারদের এ ধরনের অনুষ্ঠানের একটি বৃহত্তর রূপ ছিল পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। প্রথমদিকে পুণ্যাহের সঙ্গে বাংলা নববর্ষের সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। পরে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পুণ্যাহ অনুষ্ঠান নববর্ষের একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ব্রিটিশ-পূর্ব যুগে বিশেষ করে নবাবি আমলে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। এটি ছিল নবাব বা নবাবের দিউয়ানের কাছে জমিদার ইজারাদারদের বার্ষিক খাজনা পরিশোধের অনুষ্ঠান। খাজনা পরিশোধের ওপর ভিত্তি করে এদিন নতুন করে ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া হতো। আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে নবাব ভূমি বন্দোবস্ত পাওয়ার যোগ্য জমিদার ইজারাদারদের সম্মানসূচক পোশাক পরিয়ে দিতেন। একইভাবে জমিদার তার প্রজাদের জন্য পুণ্যাহ পালনের অনুষ্ঠান করতেন। পুণ্যাহ উপলক্ষে নাচ-গান, যাত্রা-পালা, নৌকাবাইচ ইত্যাদি বিনোদনের আয়োজন করা হতো। সে যুগে নববর্ষ ঘিরে নয়, ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই পুণ্যাহের উৎসব হতো। উনিশ শতকের মাঝপর্বে এসে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান নববর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে নিয়মিতভাবে পুণ্যাহ উদযাপন হতে থাকে। ১৯৫০ সালে জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ ঘটার পর থেকে পুণ্যাহ উৎসবেরও অবসান ঘটে। এই যে পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মধ্য দিয়ে জীবনযাত্রার ভারসাম্য, তা কি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি বর্তমানের কঠিন বাস্তবতায়। রাজনীতির কুশলী শব্দে সাধারণ নাগরিককে রাষ্ট্রের মালিক বলছি আর প্রতিদিন তাদের জীবনকে করে তুলছি বিষময়।
যুগ যুগ ধরে ব্যবসায়ী, কৃষক ও নাগরিক সমাজের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব ও বৈচিত্র্য নিয়ে নববর্ষ পালন করত। এখনও বনেদি ব্যবসায়ীর কাছে নববর্ষ একটি পবিত্র দিন। এ ধারার ব্যবসায়ীরা বাংলা সনের হিসাবেই সাধারণত ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। তাই ব্যবসাকে ঘিরে হালখাতা ও খেরোখাতা দুটি শব্দের বাস্তবতা অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। হালখাতা উৎসব উপলক্ষে নববর্ষের আগেই যথাসম্ভব বাকি আদায় করা হয়। হালখাতা অর্থাৎ নববর্ষের দিন হিন্দু ব্যবসায়ী নিয়মমতো পূজা-অর্চনা করে সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। মুসলমান ব্যবসায়ী মিলাদ পড়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। এভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে যুগে যুগে নববর্ষ আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার কৃষকের কাছে নববর্ষ একটি পবিত্র দিন। তাদের বিশ্বাস, নববর্ষের দিন ভালো কাটলে এর প্রভাব সারা বছর প্রতিফলিত হবে। নববর্ষকে কৃষিজীবী মানুষ কৃষির সাফল্যের প্রত্যাশায় বিশেষভাবে বরণ করত। এদিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো। চেষ্টা করা হতো ভালো খাবার পরিবেশন করতে। নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য না থাকলে মানুষ ধোয়া কাপড় পরত। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পরস্পরের খোঁজখবর নিত। শুভেচ্ছা বিনিময় করত। গ্রামে গ্রামে গেরস্থের বাড়িতে হরেক পিঠাপুলিসহ নানা লোকজ খাবারের আয়োজন করা হতো। গ্রামেগঞ্জে বৈশাখী মেলার আয়োজন ছিল নববর্ষের বিশেষ আকর্ষণ। এ সময় কৃষকের গোলায় থাকত ধান, ট্যাকে থাকত টাকা। ফলে নববর্ষের অনুষ্ঠান হতো আনন্দঘন।
নগরকেন্দ্রিক বৈশাখী উৎসবে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে রবীন্দ্র চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাঁয়তারা চলতে থাকে। এই অশুভ উদ্দেশ্যকে মোকাবেলা করার জন্য ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মীরা ছায়ানট নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলে। বাঙালি সংস্কৃতি লালন করার জন্য ছায়ানট পথে নেমে আসে। নববর্ষের প্রত্যুষে ঢাকায় রমনার বটমূলে সঙ্গীত মূর্ছনার মধ্য দিয়ে শুরু করে নববর্ষের আনন্দ আয়োজনের। এই আনন্দ পল্লবিত হয় নগরীর নানা অলিগলিতে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হচ্ছে বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যিক শক্তি। অভিন্ন ছাতার নিচে বাঙালি জাতিকে এমনভাবে একত্রিত করার আর কোনো দিবস আমাদের নেই। একটি জাতির পরিপূর্ণ বিকাশে সাংস্কৃতিক শক্তির ভূমিকা সবচেয়ে প্রবল। এই সাংস্কৃতিক শক্তি সঞ্জীবিত করার জন্য এমন প্রণোদনা প্রদায়ী আর কোনো দিবস বাংলা নববর্ষের বিকল্প হতে পারে না। প্রমাণ তো আমরা বারবার পেয়েছি। শোষক আর নিপীড়ক শক্তি যুগে যুগে ভয় পেয়েছে বাঙালি শক্তির আবাহনকে। তাই এককালে সেন রাজারা বাঙালির সংস্কৃতি চর্চাকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। ব্রাহ্মণ সেন রাজারা শূদ্র অভিধায় কোণঠাসা করে রাখা বাঙালির শিক্ষা চর্চাকে নিষিদ্ধ করেছিল। একইভাবে সংস্কৃতিশূন্য করে দেয়ার জন্য বাংলা ভাষাকে গ্রাস করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র। কিন্তু বাঙালির দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগে তা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও কি এই ষড়যন্ত্র থেমে ছিল? একই মানসিকতার শক্তি রমনার বটমূলে বোমা হামলায় মর্মান্তিকভাবে মানুষ হত্যা করে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। যুগ যুগ ধরে নববর্ষে সংস্কৃতি চর্চার যে নবায়ন, তা বাঙালির আত্মপ্রত্যয়কে বেগবান করেছে। ফলে বোমা হামলার পরের বছর থেকে নববর্ষে বাঙালি মুখরিত হয়েছে আরও অনেক শক্তি নিয়ে। রাজধানীকেন্দ্রিকতা ছাড়িয়ে সমগ্র দেশে নববর্ষের আনন্দ মিছিল পল্লবিত হয়েছে।
এই বাস্তবতা বলে দেয়, নববর্ষ উদযাপন শ্রেণী-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির যে মিলনমেলা- এর প্রচণ্ডতা সব পংকিলতা ও অন্যায় থেকে বাঙালিকে রক্ষা করবে। এ সত্য সুবিধাবাদী ও লোভীগোষ্ঠী যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে, ততই সবার মঙ্গল।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্বনবী (সা.)-এর মেরাজ

বিশ্বনবী (সা.)-এর মেরাজ
মো. লুৎফুর রহমান    ২৩ মে, ২০১৪ ০০:০০  173 শেয়ার মন্তব্য()প্রিন্ট

অ- অ অ+

আমাদের কাছে শবে মেরাজ খুবই পরিচিত একটি নাম। বিশ্বে এ দিবসকে মুসলমানরা পালন করে থাকে নানা আয়োজনে- সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও মিলাদ-মাহফিলের মাধ্যমে। রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে এ দিবসে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও খবর প্রচার হয়ে থাকে। (যদিও এসব কাজে সওয়াব অর্জনের কথা শরিয়তে প্রমাণিত নয়)

'মেরাজ' মূলত মানুষের ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। মেরাজ মানে ঊর্ধ্বারোহণ। কিন্তু এই ঊর্ধ্বারোহণ কোনো সাধারণ ঊর্ধ্বারোহণ নয়, আকাশে কিংবা চাঁদে যাওয়া নয়, মঙ্গল গ্রহে যাওয়াও নয়। এটি হলো এমন ঊর্ধ্বারোহণ, যেখানে আরশে আজিম অর্থাৎ আল্লাহপাকের আরশ কুরছি ও লওহে মাহফুজ (পবিত্র কোরআন যেখানে সংরক্ষিত) রয়েছে। ঠিক সেখানেই রাসুলে পাক (সা.)-এর গমন।

এটি সত্যি বিস্ময়কর একটি ঘটনা শুধু ইতিহাসের জন্য নয়, বিজ্ঞানের জন্যও। যখন বিমান কিংবা রকেটের আবিষ্কার হয়নি, তখন একজন মানুষ যন্ত্রবিহীন পৃথিবী ছেড়ে সাত আসমান ভেদ করে 'সর্বশেষ ফটক' বা ছিদরাতুল মুনতাহা ভেদ করে স্বয়ং আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়া এবং সেখানে অবস্থান করে পৃথিবীর মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার সব নিদর্শন দেখে ও নির্দেশনামা নিয়ে আবার পৃথিবীর বুকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা এক অকল্পনীয় বিস্ময়।

এখানে উল্লেখ্য যে ছিদরাতুল মুনতাহা হলো সেই ফটক, যে ফটকে হজরত জিবরাইল (আ.) এবং অন্য ফেরেশতাদেরও যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই।

প্রথম ঘটনা : যাহোক, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেই সর্বশেষ ফটক অতিক্রম করে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার মতো ঘটনা স্বয়ং আল্লাহই প্রকাশ করেছেন বিস্ময়সূচক 'সুবহান' শব্দ ব্যবহার করে। যেমন সুরা বনি ইসরাইলে প্রথমেই সুবহানাল্লাজি আসরা বি-আবদিহি...বলে এ ঘটনার সূত্রপাত করেছেন অর্থাৎ 'পবিত্র ও মহিমান্বিত (সেই আল্লাহ!) যিনি তাঁর (এক) বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপাশ্বর্িকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, যেন আমি তাকে আমার (দৃশ্য-অদৃশ্য) দেখাতে পারি, (মূলতঃ) সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা তো স্বয়ং তিনিই।' (বনি ইসরাইল : ১)।

নবীদের সঙ্গে নামাজ : ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, সঠিক বর্ণনানুযায়ী জানা যায়, নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে স্বশরীরে বোরাকে তুলে হজরত জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। নবী করিম (সা.) সেখানে মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বোরাক বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং সব নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেন।

প্রথম আসমানে প্রবেশ : এরপর সে রাতেই রাসুল (সা.)-কে বায়তুল মাকদাস থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবী (সা.) হজরত আদম (আ.)-কে সালাম করেন। হজরত আদম প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে মারহাবা বলে সালামের জবাব দেন। তাঁর নবুয়তের স্বীকারোক্তি করেন। তখন আল্লাহপাক হজরত আদম (আ.)-এর ডানদিকে নেককার ও বামদিকে পাপীদের দেখান প্রিয় নবী (সা.)-কে।

দ্বিতীয় আসমানে প্রবেশ : প্রথম আকাশ থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) নবী (সা.)-কে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে যান। আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত জাকারিয়া (আ.)-এর সঙ্গে। সাক্ষাতেই নবী (সা.) সালাম করেন। সেখানে হজরত ঈসা ইবনে মরিয়মও ছিলেন। সালাম বিনিময় শেষে তাঁরা আখেরি নবীর নবুয়তের স্বীকৃতি দেন।

তৃতীয় আসমানে প্রবেশ : এরপর রাসুল (সা.)-কে হজরত জিবরাইল (আ.) তৃতীয় আসমানে নিয়ে গেলেন। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে। এখানে সালাম বিনিময় হয়। নবী (সা.)-কে তিনি স্বাগত জানান।

চতুর্থ আসমানে প্রবেশ : তৃতীয় আকাশ থেকে চতুর্থ আকাশে যান। সঙ্গে হজরত জিবরাইল (আ.)। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর সঙ্গে। দুজন দুজনকে সালাম করেন। এরপর হজরত ইদ্রিস (আ.) নবী (সা.)-কে মোবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি দেন।

পঞ্চম আসমানে প্রবেশ : এরপর রাসুল (সা.)-কে পঞ্চম আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি হজরত হারুন (আ.)কে দেখে সালাম দেন। তিনি সালামের জবাবে মোবারকবাদ জানান এবং তাঁর নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

ষষ্ঠ আসমানে প্রবেশ ও মুসা (আ.)-এর ক্রন্দন : নবী (সা.)-কে এরপর ষষ্ঠ আকাশে নেওয়া হয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি সালাম করেন। হজরত মুসা (আ.) তাঁকে স্বাগত জানান এবং রাসুলের নবুয়তের স্বীকার করেন। এরপর নবী (সা.) সামনে এগিয়ে গেলেন। তখন হজরত মুসা (আ.) কাঁদতে লাগলেন। নবী (সা.) জানতে চাইলেন আপনি কাঁদছেন কেন? হজরত মুসা (আ.) বললেন, আমার পরে একজন নবী আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর উম্মতরা আমার উম্মতের চেয়ে সংখ্যায় বেশি জান্নাতে যাবে।

সপ্তম আসমানে প্রবেশ : নবী করিম (সা.)-কে এরপর সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে সালাম করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) সালামের জবাব দেন এবং নবী পাক (সা.)-কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ও তাঁর নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

সিদরাতুল মুনতাহা পার হওয়ার ঘটনা : প্রথম আসমান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত যাওয়ার পর নবী (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটি আল্লাহর কাছে পৌঁছার প্রথম গেট। যে গেট দিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.)ও যেতে পারেন না। এরপর নবী (সা.) একাই আল্লাহপাকের আরশে পৌঁছে যান। সেখানে পৌঁছার পর নবী (সা.) আল্লাহকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন, 'আত্তাহিয়াতু লিল্লাহ...। আল্লাহ পাক জবাবে বলেন, আস্সালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবি। আল্লাহপাকের সালামের জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, আস্সালামু আলাইনা ওয়ালা ইবাদিল্লাহিস সালেহিন। এরপর আল্লাহপাক নবী (সা.)-কে যা দেওয়ার দিয়ে দেন, যা ইচ্ছা ওহি নাজিল করেন এবং ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অর্জন : আরশে আজিমের সেই মহা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, উপঢৌকন ও নামাজের আদেশ পেয়ে ফেরার পথে সাক্ষাৎ হয় হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আপনাকে আল্লাহ কী কাজের আদেশ করেছেন? নবী (সা.) বললেন, ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। হজরত মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত এত নামাজ আদায়ের শক্তি রাখে না। আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে নামাজ কমিয়ে আনার দরখাস্ত করুন। এ সময় নবী (সা.) হজরত জিবরাইল (আ.)-এর দিকে তাকালে তিনি ইশারা করলেন। এরপর নবী (সা.) ফিরে গিয়ে নামাজ কমিয়ে দেওয়ার আবেদন করলে আল্লাহপাক ৪৫ ওয়াক্ত নামাজ দান করেন। ফিরে আসার পথে আবার মুসা (আ.) জিজ্ঞেস করেন এবং ৪৫ ওয়াক্ত নামাজের ব্যাপারে একই কথা বলেন। নবী (সা.) এভাবে আল্লাহ পাকের দরবারে আটবার গেলেন এবং প্রত্যেকবার পাঁচ ওয়াক্ত করে কমিয়ে দেওয়া হলো। অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যখন আল্লাহ নির্ধারণ করলেন, তখন হজরত মুসা (আ.) এ সংখ্যাকেও বেশি মনে করলেন এবং নবী (সা.)-কে আবারও দরখাস্ত পেশ করতে বললেন। নবী (সা.) বারবার যেতে লজ্জাবোধ করলেন এবং বললেন আমি আল্লাহর এ আদেশের ওপরই মাথানত করলাম। ফেরার পথে কিছুদূর আসার পর আওয়াজ হলো, 'আমি আমার ফরজ নির্ধারণ করে দিয়েছি এবং আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিয়েছি।'

এ সময়ও নবী (সা.)-এর শাককুস সদর বা বক্ষ বিদার ঘটে। এ সফরে রাসুল (সা.)-কে কয়েকটি জিনিস দেখানো হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জান্নাত ও জাহান্নাম। (জাদুল মা'আদ)

মেরাজের ঘটনা শেষে রাসুল (সা.) যখন পৃথিবীতে এলেন, তখনো রাসুলের ওজু করা পানি গড়িয়ে পড়ছিল। এদিকে এ ঘটনা জানতে পেরে কাফেররা তিরস্কার করা শুরু করল। হজরত আবু বকর (রা.) আবু জাহেলের মুখে ভর্ৎসনার সুর শুনে তিনি বললেন, যদি আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) এ কথা বলে থাকেন, তবে আমি খাঁটি ইমানে বিশ্বাস করলাম। সেই ঘটনা থেকেই হজরত আবু বকর (রা.)-এর নামের সঙ্গে সিদ্দিক বা সত্যায়নকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। (ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ : ৬৯৯)।

লেখক : সাংবাদিক

- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/dhormo/2014/05/23/87498#sthash.BJlX5Mys.dpuf

মিরাজ রজনীর আধ্যাত্মিক ভ্রমণ


সৈয়দ গোলাম মোরশেদ | প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৪
মিরাজ একটি গভীর অন্তর্ব্যাপী, আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। রজনীযোগে ভ্রমণ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে মিরাজ-সংক্রান্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। নবুয়ত প্রকাশের দশম বছর, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সকালে, ২৭ রজব ওই অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়। মিরাজ নিয়ে মুসলিম দার্শনিক, তত্ত্বজ্ঞানী, ধর্মবিষয়ক লেখকরা আলোচনায় খুব একটা প্রবৃত্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। সাহাবিদের কিছু কিছু বর্ণনা কাহিনী আকারে হাদিস গ্রন্থগুলোতে দেখা যায়। এ বিষয়ে তাত্ত্বিক মতামত, গবেষণা, পর্যালোচনা নেই বললেই চলে। কোনো কোনো লেখক সাহাবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যেহেতু এটি আমলি বিষয় নয় সেহেতু এ বিষয়ে চিন্তা করা বা এর কোনো মর্ম বা তাত্ত্বিক আলোচনার দরকার নেই। অথচ আগামী সোমবার রাতে সারাদেশে পবিত্র শবেমিরাজ পালিত হবে। মিরাজ ঘটনাটি ইসলামকে মহিমান্বিত করেছে। প্রিয় নবীকে (সা.) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেছে। সর্বোপরি মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর মহামিলন ঘটিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মর্ম, দর্শন, তাত্ত্বিক আলোচনা ও গবেষণা এড়িয়ে যাওয়া ইসলাম সম্পর্কে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দৈন্য ও বিমুখতা বৈ আর অন্য কিছু নয়। মানব ইতিহাসে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা হচ্ছে এই মিরাজুন্নবী (সা.)। মূলত মানবাত্মা এবং পরমাত্মার মহামিলন-সংক্রান্ত ঘটনাবলীই হচ্ছে মিরাজ। মিরাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো এরকম পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়। যার পরিবেশ আমরা করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা [১৭:১]।
অন্তর্গামী নক্ষত্রের শপথ, তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নন, পথভ্রষ্টও নন এবং তিনি আপন প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। এটা তো অহি যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে। মহাশক্তিধর তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। চির প্রকাশমান শক্তিধর, কাজেই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং এরপর নিকটবর্তী হলেন এবং অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তার চেয়েও কম। তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা অহি করার, করলেন। তিনি যা দেখলেন তাঁর অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি। তিনি যা দেখেছেন সে সম্পর্কে কি তোমরা তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করবে? নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন প্রান্তবর্তী বদরি বৃক্ষের কাছে, যার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি আচ্ছাদিত হল, যা দিয়ে আচ্ছাদিত হওয়ার কথা। তখন তাঁর দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিশ্চয় তিনি তাঁর প্রভুর শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো দেখেছিলেন। [৫৩:১-১৮]।
মিরাজ শব্দটি পবিত্র কোরআনে নেই। এফ, স্টেইন গাসের আরবি ইংরেজি অভিধানে মিরাজ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে tairs, Ladder Ascension অর্থাৎ সিঁড়ি, মই বা উন্নতি লাভের সিঁড়ি বা আরোহণ। মিরাজ বলতে যা বুঝানো হয়েছে তাতে তা উন্নতি লাভের সোপান হিসেবেই বেশি প্রযোজ্য। তবে অধিকাংশ তাফসিরকারক মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্ব গমন বা ঊর্ধ্ব আরোহণ বুঝিয়েছেন।
মিরাজ অর্থ উন্নতির সোপান বলেই অধিক যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়। সূরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে (সা.) মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছেন। মসজিদুল হারাম বলতে পবিত্র কাবা শরিফকেই যে বুঝানো হয়েছে এতে কারও দ্বিমত নেই। পবিত্র কাবাঘরকে পবিত্র কোরআনে মসজিদুল হারাম বলে একাধিক বার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দাসকে মসজিদুল আকসা বলে পবিত্র কোরআনে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। মসজিদুল আকসা অর্থ দূরবর্তী মসজিদ। পবিত্র কোরআনের আয়াত দৃষ্টে মনে হয় নবী করিমকে (সা.) উন্নত থেকে উন্নতর স্থানে বা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং হজরত আদম (আ.) এবং পরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক আল্লাহর নির্দেশে নির্মিত পৃথিবীর আদি মসজিদ, মসজিদুল হারাম (যা প্রিয়নবী (সা.) এবং তাঁর উম্মতের কাবা) থেকে হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত বায়তুল মুকাদ্দাস কীভাবে উন্নতর হল তা মোটেই বোধগম্য হয় না। পবিত্র কোরআনে মসজিদুল আকসা বলতে বায়তুল মামুরকেই বুঝানো হয়েছে বলে মনে হয়। কবি গোলাম মোস্তফা তার বিখ্যাত, বিশ্বনবী কিতাবের ১৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, দূরতম মসজিদ বলতে বায়তুল মামুরকে গ্রহণ করলে মিরাজের দার্শনিক তাৎপর্য বুঝতে সহজ হয়। মক্কার কাবা হচ্ছে বস্তুজগতের কাবা আর বায়তুল মামুর হচ্ছে আধ্যাত্মিক বা ধ্যান জগতের কাবা। কাজেই কাবা থেকে বায়তুল মামুরে নেয়া হয়েছে। এ কথার দ্বারা বুঝা যায় যে, বস্তুজগৎ হতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) উচ্চতর আধ্যাত্মিক বা ধ্যান জগতে নেয়া হয়েছিল। সূরা নজমের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, মহাশক্তিধর তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। এখানে মহাশক্তিধর বলতে তাফসিরকারকরা জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। মহাশক্তিধর শব্দটির জন্য পবিত্র কোরআনে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হল, শাহিদুল কুওয়া। পবিত্র কোরআনে এ শব্দ আরও অনেক জায়গায় আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে একমাত্র আল্লাহরই জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- শাদিদুল ইকবা, কুওয়াতিল মাতিন। এসব জায়গায় তাফসিরকারকরা ও শব্দগুলোকে আল্লাহর নামবাচক হিসেবেই লিখেছেন। সূরা নজমে এসে যখন রাসূলুল্লাহকে (সা.) শিক্ষা দেয়ার প্রশ্ন এলো তখনই তা আল্লাহর পরিবর্তে জিব্রাইল হয়ে গেল। এটাই হয়তো তাদের ধারণা হবে যে, আল্লাহ কেন মুহাম্মদকে (সা.) শিক্ষা দিতে যাবেন? আরও অধস্থান কারও কাছ থেকে শিক্ষার ব্যবস্থা করাই বুঝি ভালো হয়! অথচ তারা ভুলে গেছেন যে, আল্লাহপাক নিজেই মানুষের মহান শিক্ষক। আসমাগুলো (নামগুলো) স্বয়ং আল্লাহপাকই হজরত আদমকে (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর আদমই (আ.) তা ফেরেশতাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেখানে হজরত জিব্রাইলও (আ.) ছিলেন। সুতরাং আদমই ফেরেশতাদের শিক্ষক। আদমের এ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে (আ.) সিজদা করেছিলেন। এ কথা পবিত্র কোরআনেরই কথা। সুতরাং পবিত্র কোরআনের দলিল অনুযায়ী জিব্রাইল (আ.) কস্মিনকালেও প্রিয়নবীকে (সা.) শিক্ষাদানের যোগ্যতা ও অধিকার রাখেন না।
সূরা নজমের ৬নং আয়াতে বলা হয়েছে, চির প্রকাশমান শক্তিধর, কাজই তিনি পূর্ণতা লাভ করলেন। তাফসিরকারকরা এ আয়াতে তিনি বলতে জিব্রাইলকে (আ.) বুঝিয়েছেন। অথচ এ সর্বনামে প্রিয় নবীকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। জিব্রাইল (আ.)-এর পূর্ণতা হাসিলের কিছুই নেই। ফেরেশতাদের আল্লাহপাক যেটুকু জানান, কেবলমাত্র সেটুকুই তারা জানতে সক্ষম। এর বাইরে কোনো এলম, যোগ্যতা বা পূর্ণতা হাসিলের কোনো প্রচেষ্টাই তারা করতে অক্ষম। একমাত্র মানুষই পারে সাধনাবলে যোগ্যতার শ্রেষ্ঠতম আসনে আসীন হতে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তিনি সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন এবং নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী, ফলে তাঁদের মধ্যে রইল দুধনুকের ব্যবধান অথবা তার চেয়েও কম। এখানেও তাফসিরকারকরা তিনি বলতে জিব্রাইলকে টেনে এনেছেন এবং তাঁদের বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকে (সা.) বুঝিয়েছেন। হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রিয়নবী (সা.) যেন জিব্রাইলের সঙ্গেই মিরাজ করার জন্য ঊর্ধ্ব গমন করেছিলেন। মহিমাময় আল্লাহ এখানে একেবারেই অনুপস্থিত! সুফি এবং সুধী সমাজ এ ধরনের ভাবধারা গ্রহণ করতে নারাজ। কবি গোলাম মোস্তাফা তার বিশ্বনবীতে উল্লেখ করেছেন, তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের বলতে আল্লাহ ও রাসূলকেই (সা.) বুঝানো হয়েছে। দশম আয়াতে এ কথার যথার্থতা পাওয়া যায়, কারণ এখানে আল্লাহ লেখা হয়েছে। ত্রয়োদশ আয়াতে বলা হয়েছে, নিশ্চয় তিনি তাঁকে আর একবার দেখেছিলেন। এখানেও তাফসিরকারকরা তিনি বলতে মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের বলতে জিব্রাইল ও মুহাম্মদকেই (সা.) বুঝিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়- তাফসিরকারকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রিয়নবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ করাতে নারাজ। তাই জিব্রাইলকে বারবার টেনে নিয়ে আসা। অথচ তারা একথা বেমালুম ভুলে গেছেন, জিব্রাইল তো শুরু থেকে প্রিয়নবী (সা.) এর সঙ্গেই আছেন। সুতরাং তাকে (জিব্রাইল) আবার নতুন করে দেখার এবং তার কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ারই বা কি আছে? মিরাজের আয়াতগুলোর সার কথা হল, মহিমান্বিত আল্লাহর সঙ্গে তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.) এর মুলাকাত বা দিদার। এ দিদার লাভ কেউ বলেন আধ্যাত্মিকভাবে আবার কেউ বলেন, স্বশরীরে হয়েছে। আমরা কোনোটাকেই অসম্ভব বলে মনে করি না। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার কিমিয়ায়ে সাদাআতে উল্লেখ করেন, মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের বেহেশতের অবস্থা দর্শন করেছেন বলে যে সংবাদ প্রদান করেছেন তা কেবল জিব্রাইলের মুখে শুনে নয়, বরং তিনি তা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি চাক্ষুস দৃষ্ট ঘটনা জগতে প্রকাশ করেছেন। ইহজগৎ থেকে কেউ বেহেশতের অবস্থা জানতে পারে না, এ কথা সত্য কিন্তু রাসূল (সা.) এর দৃষ্টি এ জগৎ অতিক্রম করে পরলোক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর এ অবস্থাকে দ্বিবিধ মিরাজের এক ধরনের মিরাজ বলা যায়। জীবাত্মার মৃত্যুতে মানবাত্মার মিরাজ হয় অথবা জীবাত্মা দুর্বল হলে মানবাত্মার মিরাজ সংঘটিত হয়। নূরে মুহাম্মদী (সা.) হচ্ছেন সৃষ্টির আদি নূর, যাবতীয় সৃষ্টির অন্তর্নিহিত সত্তাসার। প্রিয়নবী (সা.) হচ্ছেন নূরুন আলা নূর। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব (৫:১৫)। তাছাড়া হাদিস শরিফে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, আনা মিন নূরিল্লাহ, অ কুল্লে শাইয়িম মিন নূরী। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর হতে আর সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর হতে। সুতরাং পবিত্র কোরআন ও কোরআন সমর্থিত সহি হাদিসের আলোকে প্রিয়নবী (সা.) এর মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয় সাপেক্ষে মিরাজের গূঢ়তত্ত্ব ও রহস্য উন্মোচন করার কাজে ব্রত হওয়া প্রত্যেক ইসলামী দার্শনিকের একান্ত কর্তব্য

Tuesday, 12 January 2016

বাংলাদেশ এগিয়ে যাক শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে -- কামাল লোহানী

সহনশীলতা আর গ্রহণযোগ্যতার উদার মানসিকতা শীতের কুয়াশার মতন লক্ষ করছি বর্তমানের রাজনীতিতে এ কি অব্যাহত থাকবে? যদি থাকে তবেই ভালো। সংসদীয় রাজনীতির দ্বান্দ্বিক পরিবেশ গোটা দেশটাকে ‘জিম্মি’ করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতন সাংগঠনিক শক্তি অন্য কারও নেই। ‘সশস্ত্র বিপ্লব’-এর রাজনীতি যারা করতেন, তারাও ঝুঁকেছেন সংসদের প্রতি, তবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে। আত্মশক্তির যে উত্থান তৈরি হয়েছিল সত্তরের দশকে গত শতাব্দীতে, তবে খেই হারিয়ে ফেলে, দেশীয় রাজনীতিতে একমাত্র বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হতে পারত যারা, তারা আজ কৃষক-শ্রমিকের কথা মুখে বলেন কিন্তু জনগণের আদতশক্তি হিসেবে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে উপরি রাজনীতিতেই ‘গোঁত্্তা খেয়ে’ পড়ে আছেন। মানুষ কিন্তু বিকল্প চায়। অথচ গোটা দেশটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ৪৪টা বছর কাটিয়ে দিল দেশ আর জনগণের প্রগতির দিকে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে পূর্বপুরুষের ঐশ্বর্যম-িত রাজনৈতিক ধারাকে অনুসরণ করে ঔপনিবেশিক নিপীড়ক শক্তির বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের মাধ্যমে দেশটাকে শত্রুমুক্তির দ্বারপ্রান্তে ১৯৭১ সালে এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু গত শতাব্দীর মহত্তম লড়াইÑ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নানা অপশক্তির কৌশলে নিগৃহীত হতে হয়েছে কত যে বার তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই অপকৌশল জয়ী হয়েছে আমাদের দুর্বলতার কারণে। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সমর্থন করেছিলেন, সশস্ত্র লড়াইয়ে জানকবুল করে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশকে পাকিস্তানি নিপীড়ক দস্যু আর নরপিশাচ হায়েনার দলকে বিতাড়িত করে মাতৃভূমিকে পুনরুদ্ধার করতে। অথচ দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শভিত্তিক ফারাক ক্রমে বাড়তে থাকলে মুক্তিফোজ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের বন্ধনও ক্রমে ঢিলে হতে থাকল রাজনৈতিক একদর্শিতার কাছে। অন্যদিকে চক্রান্ত, কুমতলব আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে থাকল এবং স্থানীয় নরপিশাচ শক্তিÑ ঘাতক, দালাল-দোসর-জল্লাদ গোষ্ঠী গোপনে একত্রিত হতে হতে গোপন আস্তানা ছেড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়ার অপরিপক্ব রাজনীতি এবং ক্ষমতালিপ্সার সুযোগ নিয়ে দেশীয় রাজনীতিতেই পাখা মেলে দিল। ক্রমে ক্রমে রাজনীতি হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধীশক্তি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে গিয়ে জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরকে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানি কায়দায় সেনাশাসন জারি করেছিল দেশে। এর বিরুদ্ধে যে জনমত তার সুযোগ গ্রহণ করে জিয়া শাসনের অবসান ঘটিয়ে জেনারেল এরশাদ গদিনসীন হলেন। প্রায় এক দশকে তার স্বৈরশাসন দেশবাসীকে হত্যা, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করে ফেলল। তারপর সবাই মিলে এরশাদকে হটিয়ে একটা আপসরফায় ক্ষমতাবদল হলো।... কত নির্মম ইতিহাস রচিত হলো। তারপর নিরবধি দিনরাত্রির সংগ্রামী আমাদের আবার গণতন্ত্রের পথে পৌঁছে দিল। কিন্তু কী অদ্ভুত! জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিতে গেলেন। অতঃপর যেসব কুৎসিত রাজনীতির নামে যে ঘটনাবলি হয়েছে, তার কোনো শেষ নেই। আর আমরা তো এই দেশেরই লড়াকু মানুষ, সব অঘটন-অপশাসনকে কখনো কিছুটা সহ্য করে আবার কখনো বিদ্রোহ করে জানিয়ে দিয়েছি আমাদের মতামত। তাই গণতন্ত্রের যাত্রা যদিও বা শুরু হলো, তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণ করেন না এমন একজন গৃহবধূ নির্বাচিত হলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। একনায়কতন্ত্রের অবসান হলো না, গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কা-কারখানা ইতিহাস বিকৃতি, জামায়াত-শিবিরকে পুনর্বাসন নয়, শুধু তাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মন্ত্রী সাজিয়ে তাদের গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে দিলেন খালেদা। মুক্তিযুদ্ধ না করা এবং সেই মুক্তিযুদ্ধের হন্তারক-নরখাদক জল্লাদের মিতালি দেশটাকে ধর্মান্ধাতার গহ্বরে নিমজ্জিত করতে শুরু করে সর্বত্র জামায়াতিদের অবস্থানকে পোক্ত করে ফেলল বিএনপির কাঁধে চেপে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে অপশাসন, দুঃশাসনে আমরা যেভাবে নিষ্পিষ্ট হয়েছি, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে কালক্ষেপণ এবং চকিত চর্বণ দুটোই হবে। সূচনাতেই পরিবর্তনের যে আভাস-ইঙ্গিতের উল্লেখ করেছি তাকে একটু খুঁজে দেখি, বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহল যারা কোনোদিন রাজনীতিতে পা দেন না ক্ষমতারোহণের জন্য, তারা সচেতন জনগণ এবং দেশের সাধারণ মানুষÑ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা। নারী-পুরুষ আবলবৃদ্ধবনিতা, তারা দেশকে নিঃশর্তে ভালবাসেন; তারা সবাই চান দেশে জিয়া বা এরশাদ গণতন্ত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ অন্যতম প্রধানস্তম্ভÑ গণতন্ত্র কার্যকর হোক দেশে। অবশ্য বর্তমান ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী ১৪ দলীয় সরকার যে পুরো গণতান্ত্রিকতা প্রাকটিস করছে তা বলা যাবে না।
অতীতকে দূরে ঠেলে রেখে বর্তমানকেই যদি গ্রহণ করি, তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক মানসিকতা’ বোধহয় নিজস্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে ক্রমেই চেতনোদয় ঘটতে শুরু করেছে, বিশেষ করে দেশের বড় দুটি দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মুখে আক্রমণাত্মক বুলি কপচালেও এখন মনে হচ্ছে, কথার ধারটা ক্রমেই কমে আসছে। পারস্পরিক উদারতার পরিবেশ তৈরি হতে শুরু হয়েছে। সহনশীলতা আসবে শিগগিরই মনে হচ্ছে। কারণ বিএনপি যে ভুল করেছিল গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তা নিয়ে প্রচুর রাজনৈতিক গোঁয়ার্তুমি করে দেখেছে মহাজোট সরকার এবং বিশেষ করে দলীয় ভিত্তিতে আওয়ামী লীগকে কাবু করা যাচ্ছে না। খালেদা জিয়া কত নাটকীয় রাজনীতি করলেন কিন্তু জমাতে পারলেন না। ৯৩ দিন নিজ-অবরোধ গুলশান কার্যালয়ে আলিশান ব্যবস্থাপনায় ৩০-৪০ সহচর-সহচারী নিয়ে দিনরাত্রি যাপন করলেন। ফায়দা কিছুই হলো না। মাঝখান থেকে ১৬৪ জন নিরীহ-গরিব মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার অপরাধে ভবিষ্যতে অপরাধের সম্মুখীন হতে হবে। খালেদা শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতেও চেয়েছিলেন পারেননি। এখনো পর্যন্ত যে সেনাবাহিনীর প্রতি দারুণ বিরাগভাজন ছিলেন বেগমসাহেবাÑ ইদানীং তিনি তাদের তোষামোদি করে কথা বলছেন। আমলাদের আক্রমণ করছেন বটে তবে রয়ে-সয়ে। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব রিজভীসহ অনেক নেতাকর্মী কারামুক্তি পাচ্ছেন জামিনে। তারা আবার সংবাদ সম্মেলন করে ‘বামপন্থায় অভ্যস্ত শব্দাবলিতে ক্ষমতাসীনদের বেশ ভালোই আক্রমণ করছেন। আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন তো ভারতে অনুপ্রবেশের মামলায় আটকে থাকলেও জামিনে দিন গুজরান করছেন। তবে খালেদাপুত্র তারেক পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন ব্রিটিশদের করুণায় লন্ডনে। সেখানে বসে যে বেয়াদবি ও ইতিহাস নিয়ে ছেলেখেলা করছিল, অজ্ঞতার হাস্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করছিল, তাও যেন থেমে গেছে।
নির্বাচন না করার যে খেসারত বিএনপিকে দিতে হয়েছে, একটি সংসদীয় রাজনীতি করা দল হয়েও তা বোঝার মতন ক্ষমতা তাদের ছিল না। দলের অভিজ্ঞ কর্মী-সংগঠকদের তো কোন পাত্তাই নেই, নেতারাও বেগম জিয়ার ওপর দিয়ে কথা বলতে পারেন না বলে একক সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু মনে সর্বস্তরে প্রচ- ক্ষোভ জমেছিল নেতৃত্বের ওপর। জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করায় দলীয় ইমেজ যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অবশেষে তারা বুঝতে পেরেছেন, ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ছেড়ে দিচ্ছেন ক্রমেই। যত মামলাই থাকুক না কেন, ইদানীং সেসব মামলা থেকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। মামলার দিন-তারিখ পড়ছে বেশ দূরে দূরে। তাই বিএনপি এখন নিজেদের গুছিয়ে সংগঠনকে ‘শক্তিশালী’ করার চেষ্টা করছে। কারণ ক্ষোভ ও ক্রোধÑ দুটোই তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন শুরু হয়েছে জোট ত্যাগের ঘোষণা। এই জোটে যারা আছে, তাদের সাংগঠনিক শক্তি যাই থাকুক না কেন, সংখ্যা তো বাড়িয়ে দিয়েছিল ২০ হোক আর ১৮-ই হোক, কিছু যায় আসে না কারণ এদের জনসম্পৃক্ততা নেই এবং বৃহদান্ত ধর্মান্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাসী, যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনেই তার প্রমাণ মিলেছে। তাই এবার যখন পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তখনো মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। ভেবেছিলেন, ছুঁতার তো অভাব নেই, যে কোনো অজুহাত তুলে বিএনপি হয়তো নির্বাচন ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু তা করেনি। এ থেকে তাদের নির্বাচন ফল এতটা মর্মান্তিক! শিক্ষা এভাবেই হচ্ছে। ফলস্বরূপ, তৃণমূলে যখন যাচ্ছেন তখন তারা বোধহয় বুঝতে পারছেন, এভাবে রাজনীতি বা ক্ষমতারোহণ সম্ভব নয়। তাই এবার ঘর পোড়া গরুর মতোন সামনে সিঁদুরে মেঘে ভয় পাচ্ছে। এবার তাই দল গোছানোর কাজ করার কর্মসূচি নিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, রাজনৈতিক এতবড় দল গত বছর হরতাল, সন্ত্রাস, অবরোধ, রোডমার্চÑ যা কিছুই ডেকে থাকুক, কোনোটাই সফল হয়নি। ২০১৩ থেকে আজ পর্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। ওপর-নিচের যে উপলব্ধি তার মূল্যায়ন এতদিন না করলেও পৌর নির্বাচনের ফলাফলে যত চিৎকারই করুক না কেন, তারা প্রার্থী বাছাইয়ে অনভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক চর্চাবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারই প্রমাণ মিলেছে।... এখন বিএনপি জোট ও দলের মধ্যেও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোট বেরিয়ে গেছে বটে, তারা বেরিয়ে তো ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল করতে পারবে না। তাছাড়া এরা তো রাজনৈকিত দল নয়, এরা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, নিজেদের সৃষ্ট তরিকার ছত্রচ্ছায়ায় পীর কিংবা ধর্মীয় নেতার অনুসারী। ধর্মের নামে দল করা যাবে না, এটা মক্তিযুদ্ধ চেতনার দাবি। এ দাবি সরকারকে মানতে হবে। সে জন্য বিএনপি নিজেদের গুছিয়ে, পুনর্গঠিত করে, নেতৃত্ব অদল-বদল করে জাতীয়তাবাদী দলকে নতুন ছাঁচে চালতে চেষ্টা করবে সামনে। দলীয় স্থবিরতার প্রকৃষ্ট নমুনা সংসদীয় অন্যতম প্রধান দল বিএনপির ভেতরে ভেতরে চলছে খুরারোগ। গঠনতন্ত্রে তিন বছর অন্তর কাউন্সিলর হওয়ার কথা, দু’বছরে হয়নি। এবার বাধ্য হবে কাউন্সিল করতে। কারণ হরতাল ডেকে নেতাকর্মী কাউকেই রাজপথে তেমন পায়নি, তাই পরিবর্তন আনতেই হবে যদি রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয় এবং জামায়াতনির্ভরতাকে বিসর্জন দিতে হবে। লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়ার রাজনৈতিক পরামর্শে দেশে পলিটিক্স চলবে না। ফলে প্রবীণদের প্রতি অনীহা প্রকাশ পাচ্ছে তৃণমূলে। তাই তাকে বাদ না দিয়ে ‘সম্মান’ দেওয়ার চেষ্টা থাকবে তবে নতুন মুখের অধিষ্ঠান হবে বলে অনেকে মনে করছেন। এছাড়া বিএনপিকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। মহাজোট যেভাবে কঠিন হাতে দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল তা অনেকটা ঢিলে হয়েছে। ফলে দম পাবে বিএনপি। একটা নির্বাচন গেল আরেকটা বুঝি মার্চেÑ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এদিকে মহাজোট সরকারের অংশীদার এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েও সব ধরনের কুৎসিত মন্তব্য করছেন সরকার সম্পর্কে এবং পৌর নির্বাচনে নিজদলের যে আসন প্রাপ্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারে সরকারের কর্মপরিকল্পনা যেভাবে প্রণয়ন  করেছেন, তাতে তিনি যে কঠিন হয়েছেন, হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন তা সুস্পষ্ট। সেই সঙ্গে তিনি দলকেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্য সব দিক থেকে আটঘাট বেঁধেই কাজ করছেন। পৌর নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, কতটা স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্যতা, তা বিচারের সময় এখন আর নেই। বিএনপি তো এবারে গোটা নির্বাচনে অংশ নিয়ে গোহারা হেরেছে। ছাপমারা, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ধমকি-হুমকি যত অভিযোগই মহাজোটের ওপর আরোপ করা হোক না কেন, ক্ষমতা হাসিনার পক্ষেই। সামনের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন মার্চ-এপ্রিলে। এ নির্বাচনও দলীয় প্রতীকেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখানে আবার সত্যিকার জনপ্রিয়তা যাচাই করার আরেকটা সুযোগ পাবে বিএনপি। তাই ভেবেছিলাম, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দল নিজেদের কাউন্সিল করে ভবিষ্যতেও যদি জনগণের কাছে যায়, তখন পরীক্ষা হবে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে, কে জনগণের কাছাকাছি যেতে পেরেছেন বা পারবেন। সরকারি দল তো অনেকটাই ছাড় দিয়েছে এবং ৫ জানুয়ারি নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পুলিশ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কাউকেই দেয়নি। আমি মনে করি, পুলিশ গণতান্ত্রিক আচরণ করেছে। বিএনপি আবার এ নিয়ে কোনো নাটক চালবে কিনা কে জানে। তবে দুই দলই নিজেদের অফিসের সামনে সমাবেশ করেছে। তবে আক্রমণের ভাষা তেমন ধারালো ছিল না। কিন্তু একটা বিষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে প্রশ্ন রাখব, ৪৫ বছর পর যারা শহীদের সংখ্যা, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে প্রশ্ন ওঠান, তাদের সঙ্গে কি কোনো ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করার প্রয়োজন আছে? যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের নির্বোধ করার মতন ধৃষ্টতা দেখাতে পারে, তাদের কি এ দেশে কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত? ধীরে ধীরে যে ‘কনজিনিয়াল অ্যাটমোসফিয়ার’ তৈরি হয়েছে এবং এখনো আরও হতে হবে, তবেই সরকারকে অনুরোধ জানাব, আপনারা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে লড়াই তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিবিধান করছেন বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু একই ধর্মনিরপেক্ষতা হরণ করার মতন কোনো আচরণ না করার অনুরোধ জানাব। জামায়াত এবং ধর্মীয় নামধারী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেশবাসী তাবৎ জনগণের আশিস গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন, যত আপসই করুন, যতই এরপর সমর্থক পাবেন বলে আশা করছেন, সবকিছু তুচ্ছ করে জনগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, তবেই সত্যিকার গণতন্ত্র স্থাপন হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার কথা মুখে বুলি কপচিয়ে যতই বছরের পর বছর আস্ফালন করুন, জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা ক্রমেই কমে যাওয়ার দিকে নজর দিন।
বিএনপিকে সনির্বন্ধ অনুরোধ, জামায়াত থেকে সরে আসুন। মুক্তিযুদ্ধকে যারা অপশক্তি মনে করেন, তারা দলের অভ্যন্তরে, চাপ সৃষ্টি করুন। যেন দল আর কোনো কারণেই ওদের ওপর নির্ভর না করে।
তবেই সরকারকে অনুরোধ করব, দেশের আপসহীন বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী এবং সব পেশাজীবী প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংলাপ করে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত সফল লাখো শহীদের অবদান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে চলুন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামনিস্ট

Tuesday, 5 January 2016

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের গুরুত্ব -- মিল্টন বিশ্বাস

সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সম্পন্ন হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখেছিলেন, ‘এটা ছিল সন্ত্রাসের মুখে অসাধারণ সংগ্রাম।’ তার এই মতামত যথার্থ ছিল এই কারণে যে, বিএনপি-জামায়াতের সহিংস মারমুখী অবস্থানের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার ঘটনা আমাদের দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষের সেই নির্বাচন দেশবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে। তবু জামায়াত-বিএনপির অপতৎপরতা চলছে। ওইদিনটিকে তারা গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ৩০ ডিসেম্বর (২০১৫) পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুবি হয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার কোনো বক্তব্যে সহিংস রাজনীতি বা ইস্যুশূন্য আন্দোলন অবসানের কোনো সদিচ্ছা প্রকাশ পায়নি। বরং নাশকতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি হরহামেশায়। আসলে তাদের প্রতিহত করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐক্য। নতুন সরকার হিসেবে দুই ও তার আগের পাঁচ বছর মোট সাত বছর যাবৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেই ঐক্যের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগসহ নতুন সংসদ সদস্যরা পুনরায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে উদ্দীপিত হয়েছেন। এ জন্য ১২ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে সাবেক মহাজোট সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। আপামর জনসাধারণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন রয়েছে এ নতুন সরকারের কর্মকা-ে।
তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে যারা সন্ত্রাস সংঘটনে ইন্ধন দিয়েছে, সক্রিয়ভাবে নাশকতায় জড়িত থেকেছে এবং সহিংসতাকে রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত করেছে তারা এবং তাদের সমর্থকরা সেই সময়ের মতো বর্তমানেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা করছে। পৌরসভা নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের সংখ্যা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অন্যদিকে ৫ জানুয়ারিকে কালো দিবস হিসেবে অভিহিত করে ওইদিনটিকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নতুন অভিযাত্রা শুরুর দিন গণনা করাÑ সবই বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলের ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দৃঢ় আস্থা প্রদর্শন করেছে। আর বিএনপি-জামায়াতকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছে। কারণ বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক আশ্চর্য সাহসী রাজনীতিকের নাম; যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া শেখ হাসিনাবিহীন যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতকে। আবার নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বীভৎস চিত্র গণমানুষকে আতঙ্কিত করে তোলায় তারা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সন্তোষ প্রকাশ করছে। এদিক থেকে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিএনপির অবরোধের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ২০১৪-এর শেষও হয়েছিল জামায়াতের হরতালের মাধ্যমে। কিন্তু সহিংসতা আর জ্বালাও-পোড়াও করে তারা থামাতে পারেনি যুদ্ধাপরাধের বিচার। বরং ২০১৫ সালে তিন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় জনগণকে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল করে তুলেছে অনেক বেশি। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে জামায়াতের বাঁচা-মরার আন্দোলনও দমে গেছে। অন্যদিকে দুই বছর ধরে বিএনপি কয়েক দফা আন্দোলনের হুঙ্কার দিয়েও মাঠ গরম করতে পারেনি। বরং জামায়াতের প্রধান মিত্র তারা এখন হরহামেশাই বলতে বাধ্য হচ্ছে, ‘জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্বাচনী রাজনীতি’র। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সব বিরূপ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছেন। তার মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা। কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদার বানিয়ে ফেলেছেন রাশিয়া ও জাপানকে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। পূর্বমুখী কূটনীতির অংশ হিসেবে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। নিজের সরকারের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে উপস্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর দুই (২০১৪ এবং ২০১৫) বছর ধরে দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি জোট আন্দোলনের ডাক দিয়ে যাচ্ছে; ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছে। এ জন্যই আন্দোলনের নামে সামান্যতম নৈরাজ্য-সহিংসতা চালানোর চেষ্টা করা হলে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানের ঘোষণা এসেছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। বিএনপির আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে রাজপথে সক্রিয় থাকছে আওয়ামী লীগ। এ কথা প্রমাণিত যে, বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে জানমালের ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। দেশের মানুষ যেখানে স্বস্তি ও শান্তিতে আছে; যেখানে মানুষ নির্বিঘেœ চলাফেরা করছে সেখানে জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রল ঢেলে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে চাইলে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ নেই। কারণ আন্দোলন করার মতো কোনো সংকট দেশে তৈরি হয়নি। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাই আন্দোলনের ডাক দিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। জনগণ তো দূরের কথা বিএনপির কর্মীরাই প্রস্তুত নয়; আর কর্মী তো দূরের কথা তাদের দলের নেতারা প্রস্তুত নন। আর আন্দোলন কখনো অঙ্ক কষে হয় না। যাদের নিয়ে কুচকাওয়াজ করে বিএনপি আন্দোলন করবে সেই জামায়াতের অবস্থা এখন নাজুক। এই জামায়াত-হেফাজতরা বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে মসজিদে হামলা চালিয়েছে, বিদেশিদের হত্যাসহ খ্রিস্টান যাজকদের হত্যার চেষ্টা করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে সারা দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ, হামলা, নির্যাতনের ঘটনাকে হেফাজত ইসলাম আন্তর্জাতিক চক্রের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছিল। আমাদের মতে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলাকে ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে বেশি। সেখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কী করে আধিপত্য বিস্তার করেছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বরং খোদ রাজধানীসহ অনেক জায়গায় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীসহ ছাত্রশিবির ক্যাডারদের গোপন বৈঠকের সংবাদ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশজুড়ে নাশকতায় লিপ্ত দলের এই গোপন বৈঠক নাগরিক সমাজের শান্তি বিঘিœত করছে এটা স্পষ্ট।  
অনেক আগেই দেশের বিশিষ্টজনরা যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও নাশকতাকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গাড়ি-বাড়িতে আগুন, পেট্রল বোমা, পুলিশকে মারধর ও হত্যা করা এটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা ও পঙ্গু করা হয়েছে কয়েক বছর ধরে। আর এই জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। সহিংসতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে জামায়াত-শিবির। টানা হরতাল-অবরোধে শিক্ষা, ব্যবসা আর বিদেশে দেশের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এমনকি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নাগরিককে তাদের দেশের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করেছিল। সুস্থ ধারার রাজনীতি থেকে এই বিচ্যুতি দেশের তরুণ প্রজন্মকে দিশেহারা করেছিল সাময়িকভাবে। কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা পুনরায় গণজাগরণ মঞ্চকে সামনে নিয়ে আসে এবং তরুণদের অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে ১৭ জন পুলিশ, ২ জন বিজিবি ও ২ জন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যা করে জামায়াত-বিএনপি সন্ত্রাসীরা। এছাড়া অসংখ্য সাধারণ জনতাকে হত্যা ও আহত করে আগুন দিয়ে, সেসব ঘটনা আমরা সবাই জানি। পুনরায় এখন বিএনপির ২০ দলীয় জোট আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। আসলে রাজপথে সরকার পতনের মতো আন্দোলনের সাংগঠনিক ক্ষমতা না থাকায় এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো হওয়ায় বিএনপি জনগণের কোনো আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার সামাজিক দুর্বৃত্তায়নকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ায় অতীতে (২০০১-২০০৬) দেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও লাগামহীন দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। সে সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় উন্মত্ত জোটের মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের তা-বের কথা আমাদের সবার মনে আছে।
রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- ব্যাপক। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রচারণায় আমরা দেখতে পেয়েছি অসাধারণ উপস্থাপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের সাফল্যগুলো নিরন্তর কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচার করে চলেছে। সেখানে তথ্যাদির নিরিখে উন্নয়নমূলক কর্মকা- প্রচার করা হয়েছিল। আর তা যে সম্পন্ন হয়েছে এটা জনগণের কাছে স্পষ্ট। না হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া কিংবা কোনো ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশিত হলে তার সমালোচনা করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যদিও কেউ কেউ মিথ্যাচার করেছেন। তবে উপস্থাপিত তথ্যাদি বা সরকারের উন্নয়ন না হওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি কেউ। সরকারের উন্নয়নের ব্যাপারে কোনো চ্যালেঞ্জ না করে নির্বাচনকে ভ-ুল করার জন্য উদ্ভট আর মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। শেষ পর্যন্ত তারা সরকারের উন্নয়নকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর সব দিক দিয়ে তাদের পরাজয় ঘটেছে বলেই দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।

লেখক : অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
email- writermiltonbiswas@gmail.com

Saturday, 2 January 2016

চড়া ভুলের চড়া মাসুল দিয়েছে বিএনপি -- পীর হাবিবুর রহমান

চড়া ভুলের চড়া মাসুল দিয়েছে বিএনপি। ভুল করে ভুল পথে হেঁটে হেঁটে সর্বশেষ পৌর নির্বাচনেও ফল তুলতে পারেননি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। সরকারি দলের প্রকাশ্যে সিল মারা, কেন্দ্র দখল রুখে দাঁড়াবার মতো কোমর শক্ত সংগঠন বিএনপি আর নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কৌশলের পথ না নিয়ে একগুঁয়ে হঠকারী পথ নিয়েছিলেন। ভোট বর্জনের ডাক দিয়েই বসে থাকেননি, প্রতিরোধের জন্য জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে টানা তিন মাস সহিংস হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন। বিএনপি নেতৃত্ব মনে করেছিলÑ বিদেশি শক্তি সেই ভোট এসে বন্ধ করে দেবে। কিন্তু শেখ হাসিনার একক ক্যারিশমায় প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ৫ জানুয়ারির কঠিন চ্যালেঞ্জ উতরে যান সংবিধানের দোহাই দিয়ে। অন্যদিকে ভোটের পর বিএনপি হঠাৎ আন্দোলনের ইতি টানলে সরকার একদিকে বিরোধী দল দমন, অন্যদিকে নিজেদের কর্তৃত্ব সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। সেই নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট ও পদ্মা সেতু বিতর্কে যে জনমত তৈরি করেছিল সেটি বিএনপির দিকে ঝুঁকেছিল বলেই ৭টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্বল প্রার্থী দিয়ে বিস্ময়কর বিজয়লাভ করে বিএনপি। নির্বাচন প্রতিরোধ করতে না পেরে আন্দোলনে হুট করে ইতি দিয়ে তিন মাসের হরতাল-অবরোধে দলীয় শক্তিক্ষয়ই করেনি, দেশের অর্থনৈতিক লোকসানের কলঙ্ক মাথায় তোলে। নেতাকর্মীরা ডোবে হতাশায়। নির্বাচিত মেয়র আর নেতারা কারাগার আর আদালতমুখী হন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সেই নির্বাচনের আগে বিএনপি সাতটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিস্ময়কর জয় নিয়ে সাংগঠনিকভাবে যে যৌবন অর্জন করেছিল আর দল যেভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল তাতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভোটে গেলে আজকের এই করুণ পরিণতি দেখতে হতো না। অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লন্ডনে নির্বাসিত পুত্র তারেক রহমান আর খালেদা জিয়ার গৃহের রহস্যময় লোকজনই তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন নয়, এমন সিদ্ধান্ত অটল রেখে তাকে ভোট বর্জনের ফাঁদে ফেলে। ভোট বর্জনের ফাঁদে পড়ে বিএনপির যে পতন শুরু হয়েছিল তাতে দল নিজেই দেখেছে তার করুণ চেহারা পৌর ভোটে। তার আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন ছিল এর স্টেজ রিহার্সেল। মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিরোধ দূরে থাক এজেন্টই দিতে পারেনি। আর এবার পৌর ভোটে এজেন্ট দিতে পারলেও, কোথাও কোথাও প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও সমর্থকদের ভোট ধানের গোলায় তুলতে পারেনি। নৌকা ভরে নিয়ে গেছে সব।
আর এবার পৌর নির্বাচনের আগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনা নতুন ইমেজে প্রবল আত্মবিশ্বাসে রয়েছেন। সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। স্থলসীমান্ত চুক্তি, বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু, উন্নয়ন কর্মকা- মিলিয়ে ৫ জানুয়ারির আগের সময়কার পরিস্থিতিতে নেই। নতুন এক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তিনি ও তার দল।
বিএনপি মনে করেছিল বিতর্কিত নির্বাচন সরকার হজম করতে পারবে না। অচিরেই আরেকটি নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু সরকার উপজেলা নির্বাচনের পথ ধরে বছর পার করে ফেললে খালেদা জিয়া মিছিল ও সমাবেশ শুরু  করেন। সরকারের এক বছর পূর্তিতে গেল বছরের জানুয়ারির শুরুতে খালেদা জিয়াকে তার মিছিলে যেতে না দিলে তিনি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই, মাঠকর্মীদের প্রস্তুত না করেই অনির্দিষ্টকালের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে বসেন। আন্দোলন পরিণত হয় পেট্রলবোমার সহিংস রাজনীতিতে। বিএনপির ওপর মানুষের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। অন্যদিকে, সরকার বিএনপিকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে মানুষ খুনের অভিযোগ এনে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরে। অবরোধ কর্মসূচি হয়ে পড়ে অকার্যকর। উল্টো খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন গুলশান কার্যালয়ে। বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের কর্মীরা পর্যন্ত মামলার জালে বন্দি হয়ে কারা নির্যাতনের মুখে পড়েন। আন্দোলন করল বিএনপি, ফল তুলল সরকার।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণভবনের নৈশভোজ বৈঠকে যোগ দেননি। কিন্তু এই কর্মসূচিতে গিয়ে বিএনপির কোমর ভেঙে যাওয়ায় সরকারের প্রতি তাদের সংলাপের আহ্বান গুরুত্ব পায়নি। বিএনপির হঠকারী রাজনীতির পথে সরকার শুধু তাদেরই দমন করেনি, রাষ্ট্রীয় জীবনে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বিএনপি বা তাদের নেত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। শিবিরের হরতালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার সিদ্ধান্ত ছিল খালেদা জিয়ার জন্য সম্পূর্ণ আত্মঘাতী।
ইতোমধ্যে, হঠকারী পথ নেওয়ায় বিএনপি সিটি করপোরেশনগুলোতে যে জয়লাভ করেছিল সেই মেয়রদেরও বরখাস্তই শুধু করেনি, জেলেও পাঠায় সরকার। অথচ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে কর্তৃত্ব ফিরে পেত। ওই পরিস্থিতিতে সরকার গণরায় ছিনিয়ে নিলেও বিএনপিকে সংসদে শতাধিক আসন দিতে হতো। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে ঠাঁই নিয়ে, বিএনপি সেই ৭ সিটির বিজয়কে সুসংহত করে, শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে শক্তিশালী দল নিয়ে সরকারের ওপর অব্যাহত চাপ রাখতে পারত।
সংসদের ভেতরে-বাইরে বিএনপির নেতা-এমপিরা সরব থাকতে পারতেন। এতে আর যাই হোক ঢাকা-চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনসহ সর্বশেষ দেশের পৌরসভার ভোটের লড়াইয়ে এ রকম ফল দেখতে হতো না। একের পর এক ভুল পথে পা বাড়ানো বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে পশ্চিমারা চিহ্নত করলেও, দেশে নিন্দিত হলেও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারেননি। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তার এবং দলের অবস্থান পরিষ্কার করা দূরে থাক উল্টো যেন সেই অদৃশ্য শক্তির কাছেই বেশি করে আপস করছেন। একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ’৭১-এ বাঙালি জাতির ওপর যে আক্রমণ ও নৃশংসতা চালিয়েছে তা অস্বীকার করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের অশ্রুজল দেখে তরুণ প্রজন্ম পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা পোষণ করছে। সেই সময়ে বিএনপি নেত্রী ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় পাকিস্তানি শাসকরা খুশি হলেও এদেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ‘নির্বোধের মতো মারা গিয়েছিলেন’ এমন মন্তব্য করে তরুণ প্রজন্মের বুকে আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ জাতির জীবনে সর্বোচ্চ আত্ম-অহংকার ও গৌরবের। পাকিস্তানের কণ্ঠে কথা বলা মানেই, মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করা। বিএনপির নেতৃত্ব সেটিই করেছে। একাত্তরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের যে ভূমিকা সেটিকেও ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। পথহারা বিএনপির এসব বক্তব্যকে সরকারি দল জনগণের সামনে সেভাবেই উপস্থাপন করতে পারছে, যেভাবে করলে মানুষ বিশ^াস করে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানের সঙ্গে বিএনপির একটি গোপন সম্পর্ক রয়েছে।
পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অসংখ্য প্রার্থী ভোটের মেয়র হলেও অনেকেই হয়েছে লুটের মেয়র। বিএনপি পরাজিত হলেও রাজনৈতিকভাবে সারা দেশে সংগঠিত হয়েছে। বিএনপিকে লং টার্ম চিন্তায় দলের রাজনীতিকে এখন ঢেলে সাজাতে হবে। মামলা ও কারাগার থেকে আগে নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে হবে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের জীবনে কঠিন দুঃসময় এসেছিল। সেনাশাসনকবলিত বাংলাদেশে জুলুম নির্যাতন সয়েও একদিকে আন্দোলনের পথে ধীরলয়ে হেঁটেছে তেমনই মিডিয়া ক্যু ও প্রহসনের নির্বাচন জেনেও রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদ নির্বাচন কোনোটাকেই বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়েনি।
আওয়ামী লীগ এদেশে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যেভাবে রাজপথে হেঁটেছে এবং সাফল্য তুলেছে বিএনপিকে সেই পথ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম - See more at: http://www.dainikamadershomoy.com/2016/01/02/66046.php#sthash.tuoMEhek.dpuf