Friday, 31 January 2014


বসন্ত বন্দনা 


শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন। 

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
স্পর্শসুখে লিখা হবে অজস্র কবিতা।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
তারপর হব ইতিহাস।

© নির্মলেন্দু গুণ
Now Winter Nights Enlarge
by Thomas Campion

Now winter nights enlarge
The number of their hours,
And clouds their storms discharge
Upon the airy towers.
Let now the chimneys blaze,
And cups o'erflow with wine;
Let well-tuned words amaze
With harmony divine.
Now yellow waxen lights
Shall wait on honey love,
While youthful revels, masques, and courtly sights
Sleep's leaden spells remove.
This time doth well dispense
With lovers' long discourse;
Much speech hath some defence,
Though beauty no remorse.
All do not all things well;
Some measures comely tread,
Some knotted riddles tell,
Some poems smoothly read.
The summer hath his joys
And winter his delights;
Though love and all his pleasures are but toys,
They shorten tedious nights.
Thomas Campion (1567 - 1620) was an English composer and poet.

শীতের সকাল
মোঃ আবু জাফর 
সকালে সোনার আলো করে ঝিকমিক,
সবুজ ঘাসের শিশির, করে চিক চিক ।
ক্ষনে ক্ষনে শীত আর শীতল অনুভূতি,
জানালার ধারে এসে, কাপে প্রজাপতি।
সোনা নয় রুপা নয় জ্বলে ঝিকি মিকি,
বিন্দু বিন্দু শিশির গুলো চেয়ে চেয়ে দেখি।
সাদাকাল নীল দিয়ে আকাশ কেমন সাজে,
আমার মনে গহীন বনে সুরের কঙ্কন বাজে।
চারি দিকে পাখিসব করেরব কল-কাকলী,
সূর্যের আলো মেঘের সাথে করেছে মিতালী
কুয়াশা ঢাকা ভোরে পড়ছে শিশির ঘাসে,
সূর্য মামা হেলে দূলে দেরী করে আসে।।     

Wednesday, 29 January 2014


কালের যাত্রার ধ্বনি 
- সুফিয়া কামাল -

কাল কভু চুপ নাহি রয়,
কথা কয়, সে যে কথা কয়।
সে আবার জেগে ওঠে প্রত্যহের জীবন-স্পন্দনে;
সে দুর্বার প্রাণবেগে বেঁচে ওঠে নিত্যের স্মরণে।
দুর্জয় শক্তিতে তার কীর্তি লেখে যুগের প্রাচীরে
শতাব্দীর সাক্ষ্য রাখি, দিবস-নিশীথ-বক্ষ চিরে
গতি চলে তার,
তার সাথে ছন্দ রেখে চলে সিন্ধু নদী পারাবার।
কত প্রভাতের সূর্য হেসে আসে বাড়াইয়া কর,
হেলে পড়ে শোণিতাক্ত দীপ্ত দ্বিপ্রহর,
শোকাচ্ছন্ন অপরাহ্ন আসে,
নিশীথের সুপ্তি ভাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে ভয়ে অবিশ্বাসে।
তারও পরে আসে সেই দিন
মৃতের কঙ্কাল পরে জেগে ওঠে জীবন নবীন।
বিলুপ্ত প্রত্যাশা কাঁপে শক্তিরূপে বক্ষের পঞ্জরে
সে মূর্ত প্রতীক হয়ে আযাদীর তরে
শতাব্দীর রুদ্ধ দ্বার আঘাতে আঘাতে করি চুর
বন্দীত্ব শৃঙ্খল ভাঙ্গা ধ্বনি শুনে অতি সুমধুর।
শোণিত উচ্ছ্বাসি ওঠে, শিরায় শিরায় জাগে সাড়া,
কোটি কণ্ঠে বেজে ওঠে উদাত্ত গম্ভীর সেই 'নারা'।
বিদ্যুৎ চমকি যায় শিহরণ লাগে তীব্র বেগে
বজ্রের আরাবে মেঘে মেঘে
নির্ঘোষিয়া স্বর প্রসারিয়া কর
ঊধর্ে্ব তুলি উড়ায় পতাকা
শ্বেত-শ্যাম অর্ধ চন্দ্র-পূর্ণতারা অাঁকা।
শান্তি সাম্য সেবা মৈত্রী ঘোষিয়াছে প্রসারিয়া হাত
কওমী হেলাল আজ দীনি-জমহুরিয়াত!
শানের জলুস চলে রাজপথে দৃপ্ত সুগম্ভীর মহিমায়,
নিত্যকার সূর্য তার সুপ্রসন্ন কিরণ ছড়ায়।
আ-সমুদ্র হিমাচল গিরিদরী বনানীর পারে
তৌহীদের মন্ত্র বাজে ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে।
ওড়ে একই ঝা-ার প্রতীক,
সর্বকালে সর্বদেশে সর্বদিগ্বিদিক
যে জাতি দিয়েছে পাড়ি,
গড়িয়া তুলেছে নিজ দেশ,
ক্ষুদ্র তুচ্ছ ভেদাভেদ করিয়া নিঃশেষ,
মহান ধর্মের সিংহদ্বার 
মুক্ত করি রাখিয়াছে, মিলনের মহা-পারাবার
গড়িয়াছে মানুষে মানুষে,
দিয়াছে আসন সব, মানুষের সব জাতিধর্ম-নির্বিশেষে,
যারা মুক্তি লাগি
গড়েছে বাঁশের কেল্লা, যে মহান ত্যাগী
মুক্তির অমৃত ফল করেছে সন্ধান-
যত মহা মানবের প্রাণ
অলক্ষ্যে রহিয়া তারা কালের যাত্রার ধ্বনি শুনি
হেরে নাকি সেই সঞ্জীবনী।
লভিয়াছে তাহাদের উত্তর সাধক
কালের কুটির কক্ষে অবরুদ্ধ ছিল যে আলোক
তাহার এনেছে প্রাণ, দুর্গমেরে করিয়াছে জয়
কাল কভু চুপ নাহি রয়-
কথা কয় সে যে কথা কয়।

Monday, 27 January 2014

নবযৌবন 

বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি’
যুগ হতে যুগান্তর ধরি’
কি গান উঠেছে বাজি’, কি সঙ্গীত তুলিয়াছে তান
কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান,
কি সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া
মর্ম্ম মাঝে রণিয়া-রণিয়া,
ওগো মহাকাল,
হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল
তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি,
নিরবধি
বয়ে চলা ফল্গুধারা সম
ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম
তোমার বুকের ’পরে জাগায়াছে যদি প্রতিধ্বনি
সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী,
তবে ওই ভীষণ মৌনতা
কেন আজ টুটিল তা?
কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন?
প্রসন্ন নবীন
উদিল প্রভাত
অকস্নাৎ,
পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী,
কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী।
আর ভয় নাই, নাই ভয়,
জীবনে-মরণে আজ, প্রভু মোর, হোক তব জয়!
এনেছে যৌবন তার
বিচিত্র সম্ভার;
বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেচে সে
নব-অতিথির বেশে।
তারে আজ করিনু বরণ,
তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হ’ল আমার মরণ,
ধন্য হ’ল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী,
তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি,
উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল,
চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল
বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম,
নিরুপম
উচ্ছ্বাসের উন্নত্ত ধারায়,
জীবনের সুত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়!
চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার
লহ নমস্কার!
তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর,
তাই তুমি অমন সুন্দর।
প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে
চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ন-জন্নান্তরে
সাধ মোর;
অন্ধতার ঘোর
রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ,
ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্েনষ,
বক্ষে তব নবজন্ন আশা
মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা
সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন
অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ
নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন।

বুদ্ধদেব বসু

বদলে যাও, কিছুটা বদলাও 


আবুল হাসান 
কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য; সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে
মাটির কনুই , ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…
বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুনি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী ,
যখোন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও ।
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও !

Wednesday, 15 January 2014

My Dream: A Vision of Peace 

Where the mountains touch the sky,
Where poets DREAM, where eagles fly,
A secret place above the crowd,
Just beneath a silver-lined cloud.

Lift your eyes to a snowy peak,
And see the soon-to-be we seek.
Whisper DREAMS and let them rise,
To the mountains old and wise.

Climbers climb, it's time to try,
Where the mountains touch the sky.
Take me there. Oh take me now,
Someway, Someday, Somewhere, Somehow.

Where the ocean meets the sky,
Where mermaid dance, where seagulls fly,
A place in DREAMS I know so well,
The sea inside a single shell.

Far across the living sea,
A pale blue possibility,
Beyond the castles made of sand,
Tomorrow in a small child's hand.

Only DREAMERS need apply,
Where the ocean meets the sky.
Take me there. Oh take me now,
Someway, Someday, Somewhere, Somehow.

A common ground for one and all,
Behind the crystal waterfall,
Where Peace flows like a mighty stream,
Like Dr. King I have a DREAM.

Imagine such a goal in sight,
For red and yellow, black and white…

New Delhi, Beijing, Kenya, Rome,
Earth is the place that we call home.
Baghdad, Belfast, Tel Aviv,
One race HUMAN, we still believe,
Come DREAM with me...

Where the forests reach the sky,
Wake to DREAMS, and don’t be shy.
We’ll DREAM the world a thorn-less rose;
We’ll plant then watch it as it grows.

We’ll conquer hate with DREAMS of hope,
We’ll DREAM one big kaleidoscope.

Whisper now; let the DREAM begin,
It's time to trust the truth within.
This is where we seek and find…
A place called PEACE for humankind.

DREAM on DREAMERS, hopes are high,
Where the forests reach the sky.
Take me there. Oh take me now,
Someway, Someday, Somewhere, Somehow.

Now, listen close, the future calls...
'Build your bridges and tear down walls! '
For time has taught and so it seems,
Realities are born of DREAMS!

Whisper DREAMS and let them rise,
To the mountains old and wise.

© Todd-Michael St. Pierre
http://www.youtube.com/watch?v=oSSPe4Kp_VY

শহর - জীবনানন্দ দাশের কবিতা

হৃদয়, অনেক বড়ো বড়ো শহর দেখেছ তুমি;
সেই সব শহরের ইটপাথর,
কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হদত চক্ষু
আমার মনের বিস্বাদের ভিতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

কিমও তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য উঠতে দেখেছি;
বন্দরের নদীর ওপারে সূর্যকে দেখেছি
মেঘের কমলারঙের ক্ষেতের ভিতর প্রণয়ী চাষার মতো বোঝা রয়েছে তার;
শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু উঁচু মিনারের উপরেও দেখেছি–নক্ষত্রেরা–
অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন্ দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে।

Tuesday, 14 January 2014



মিলাদুন্নবী (সাঃ)  


চকমকিয়ে উঠ্ল জ্বলে বিশ্বলোকের ভাগ্য-তারা 
মানব-রতন নবী যখন এলেন ধরায় জাগল সাড়া । 
বিশ্ববাগের কুসুম কলি ঝরল যখন হিমেল ঝড়ে
এলো নবীন বসন্ত ফের আসলে নবী ধরার 'পরে ।
মুক্তো ছিল বিশ্বলোকের দৃষ্টি আড়াল গুপ্ত___দূরে
আবির্ভাবে সেই মুকুতার আরশ-ফরশ হাসল নূরে ।
বিশ্বপালক আল্লা'তালা রহম সেথা দয়াল নবী
সেইখানে রব আল্লা'তালা রহম সেথা রাসূল-রবি ।
মোহাম্মাদের সত্তা-জ্যোতি দীপ্ত আহাদ মোতির মাঝে
আল্লা' আহাদ গুলিস্তানে গুল আহমদ ওই বিরাজে ।
সজনলীলার আদিম তিনি সৃষ্টি তাঁহার সবার আগে
জহুর তাঁহার সবার শেষে এই দুনিয়ার মানব বাগে ।
নবীর সে নূর দেখল না যে নিবাস তাহার জাহান্নামে
যে খোশনসীব দেখল সে নূর শান উঁচু তার সব মাকামে'
হে কলন্দর নয়ন তোমার করো উজাল নবীর নূরে
নাই পরোয়া জাহান্নামের শাস্তি সাজা থাকবে দূরে ।


- আল্লামা আব্দুল লতীফ (রঃ) -

Saturday, 11 January 2014

I know why the caged bird sings by Maya Angelou



A free bird leaps on the back
Of the wind and floats downstream
Till the current ends and dips his wing
In the orange suns rays
And dares to claim the sky.
But a BIRD that stalks down his narrow cage
Can seldom see through his bars of rage
His wings are clipped and his feet are tied
So he opens his throat to sing.

The caged bird sings with a fearful trill
Of things unknown but longed for still
And his tune is heard on the distant hill for
The caged bird sings of freedom.

The free bird thinks of another breeze
And the trade winds soft through
The sighing trees
And the fat worms waiting on a dawn-bright
Lawn and he names the sky his own.

But a caged BIRD stands on the grave of dreams
His shadow shouts on a nightmare scream
His wings are clipped and his feet are tied
So he opens his throat to sing.

The caged bird sings with
A fearful trill of things unknown
But longed for still and his
Tune is heard on the distant hill
For the caged bird sings of freedom.

Friday, 10 January 2014

মুসাফির 

চলে মুসাফির গাহি,
এ জীবনে তার ব্যথা আছে শুধু, ব্যথার দোসর নাহি।
নয়ন ভরিয়া আছে আঁখিজল, কেহ নাই মুছাবার,
হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেহ নাই শুনিবার।
চলে মুসাফির নির্জন পথে, দুপুরের উঁচু বেলা,
মাথার উপরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া করিছে আগুন-খেলা।
দুধারে উধাও বৈশাখ-মাঠ রৌদ্রেরে বুকে চাপি,
ফাটলে ফাটলে চৌচির হয়ে করিতেছে দাপাদাপি।
নাচে উলঙ্গ দমকা বাতাস ধুলার বসন ছিঁড়ে,
ফুঁদিয়ে ফুঁদিয়ে আগুন জ্বালায় মাঠের ঢেলারে ঘিরে।
দুর পানে চাহি হাঁকে মুসাফির, আয়, আয়, আয়, আয়,
কস্পন জাগে খর দুপুরের আগুনের হলকায়।
তারি তালে তালে দুলে দুলে উঠে দুধারের স্তব্ধতা,
হেলে নীলাকাশ দিগনে- বেড়ি বাঁকা বনরেখা-লতা।
চলে মুসাফির দুর দুরাশার জনহীন পথ পাড়ি,
বুকে করাঘাত হানিয়া সে যেন কি ব্যথা দেখাবে ফাড়ি।
নামে দিগনে- দুপুরের বেলা, আসে এলোকেশী রাতি,
গলায় তাহার শত তারকার মুন্ডমালার বাতি।
মেঘের খাঁড়ায় রবিরে বনিয়া নাচে সে ভয়ঙ্করী,
দুর পশ্চিমে নিহত দিনের ছিন্নমুন্ড ধরি।
রুধির লেখায় দিগন্ত বায় লোল সে রসনা মেলি,
হাসে দিগনে- মত্ত ডাকিনী করিয়া রক্ত-কেলি।
চলেছে পথিক-চলেছে সে তার ভয়ঙ্করের পথে,
বেদনা তাহার সাথে সাথে চলে সুরের ইন্দ্ররথে।
ঘরে ঘরে জ্বলে সন্ধ্যার দীপ, মন্দিরে বাজে শাঁখ,
গাঁয়ের ভগ্ন মসজিদে বসি ডাকে দুটো দাঁড়কাক।
কবরে বসিয়া মাথা কুটে কাঁদে কার বিরহিনী মাতা,
চলেছে পথিক আপনার মনে বকিয়া বকিয়া যা-তা।
চলেছে পথিক-চলেছে পথিক-কতদুর-কতদুর,
আর কতদুর গেলে পরে সে যে পাবে দেখা বন্ধুর।
কেউ কি তাহার আশাপথ চাহি গণেছে বয়ষ মাস,
ধুঁয়ার ছলায় কাঁদিয়া কি কেউ ভিজায়েছে বেশবাস?
কিউ কি তাহারে দেখায়েছে দীপ কানো গেঁয়ো ঘর হতে,
মাথার কেশেতে পাঠায়েছে লেখা গংকিণী নদী সোঁতে?
চলেছে পথিক চলেছে সে তার ললাটের লেখা পড়ি,
সীমালেখাহীন পথ-মায়াবীর অঞ্চলখানি ধরি।
ঘরে ঘরে ওঠে মৃদু কোলাহল, বঁধুরা বধুর গলে,
বাহুর লতায় বাহুরে বাঁধিয়া প্রণয়-দোলায় দোলে।
বাঁশী বাজে দুরে সুখ-রজনীর মদিরা-সুবাস ঢালি,
দীঘির মুকুরে হেরে মুখ রাত চাঁদের প্রদীপ জ্বালি।
নতুন বধুর বক্ষে জড়ায়ে কচি শিশু বাহু তুলি,
হাসিয়া হাসিয়া ছড়াইছে যেন মণি-মানিকের ধুলি।
চলেছে পথিক-রহিয়া রহিয়া করিছে আর্তনাদ-
ও যেন ধরার সকল সুখের জীবন- প্রতিবাদ।
রে পথিক ! বল, কারে তুই চাস, যে তোরে এমন করে,
কাঁদাইল হায়, কেমন করিয়া রহিল সে আজ ঘরে?
কোন ছায়া-পথ নীহারিকা পারে, দেখেছিলি তুই কারে,
কোন সে কথার মানিক পাইয়া বিকাইলি আপনারে ।
কার গেহ ছায়ে শুনেছিলি তুই চুড়ির রিণিকি-ঝিনি,
কে তোর ঘাটেতে এসেছিল ঘট বুড়াইতে একাকিনী ।
চলে মুসাফির আপনার রাহে কোন দিকে নাহি চায়,
দুর বনপথে থাকিয়া থাকিয়া রাত-জাগা পাখি গায়।
গগনের পথে চাঁদেরে বেড়িয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা,
সে মৌন চাঁদ আজো হাসিতেছে, বলিল না, উহু আহা।
বউ কথা কও-বউ কথা কও-কতকাল -কতকাল,
রে উদাস, বল আর কতকাল পাতিবি সুরের জাল।
সে নিঠুর আজো কহিল না কথা, রহস্য-যবনিকা
খুলিয়া আজিও পরাল না কারো ললাটে প্রণয় টীকা।
চলেছে পথিক চলেছে সে তার দুর দুরাশার পারে,
কোনো পথবাঁকে পিছু ডাকে আজ ফিরাল না কেউ তারে।
চলেছে পথিক চলেছে সে যেন মৃত্যুর মত ধীরে,
যেন জীবন- হাহাকার আজি কাঁদিছে তাহার ঘিরে।
চারিদিক হতে গ্রাসিয়াছে তারে নিদারুণ আন্ধার,
স্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধেছে ক্রন্দন শুনি তার।

@ জসীমউদ্‌দীন 

Thursday, 9 January 2014


হে স্বদেশ হে আমার বাংলাদেশ

– মোহাম্মদ রফিক

তোমার দেহের মতো খর-কৃপাণের মতো
দীর্ঘ ও উদ্যত ঋজু
সারি সারি
শাল-তরু শ্রেণী
দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই পাশে;
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চুমু খেলে
ভয়ে ও বিহ্বলতায়
যেমন কম্পন জাগে
তোমার দু’গালে ঠোঁটে, আজকে রাত্রেও তেমনি
উদগ্রীব অপেক্ষার
রুদ্ধ শিহরন সাড়া
শাখে শাখে; শকুনের ডানার ঝাপটে যেন
ঢেউ উঠে ভয়াল সাগরে;
তোমার গায়ের রং যেন
তপ্ত কাঞ্চনের মতো
লেগে আছে সড়কের প্রতি ধুলিকণা সাথে,
চোখের মণির মতো সজল নিবিড় কালো
জমছে খণ্ড খণ্ড মেঘ
সারাটা আকাশময়
হয়তো নামবে বৃষ্টি একটু পরে,
যেমন শোনিত চুঁয়ে চুঁয়ে
পড়ছে তোমার পথে পথে
তাল ও তমাল শাখে,
শত্রুর সৈন্যের বেয়নেটে
তোমার প্রাণের মতো
উষ্ঞ লাল রক্ত
যেমন ঝরছে
মাঠে মাঠে গঞ্জে বাটে;

ক’জন চলেছি আমরা
সড়কের ‘পর দিয়ে এই
একটি ট্রাকে ঠাসাঠাসি
উচিঁয়ে সঙীন দৃপ্ত
আমরা চলেছি এই
নীরন্ধ্র রাতের মাঝামাঝি
তোমার প্রেমের ঋণ
রক্ত ঋণ
রক্ত দিয়ে শোধ করে দিতে;

শুধু আলো হাওয়া চাঁদ
বা সূর্যকিরণ নয়
তোমার শরীরে মাগো
বিকট দুর্গন্ধ আছে,
ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন সব
কচি কচি যোদ্ধাদের
ঘামে ভেজা ছেঁড়া গেঞ্জি
ময়লা বিছানা হ’তে
বিবমিষা ছুটে আসে;
তোমার দেহের সাথে
এ দুর্গন্ধে মাগো
আমাদের ভবিষ্যত যেন
নবজাতকের মতো
হাত পা বাতাসে ছুঁড়ে খেলা করছে;

শুধু খালে বিলে মাঠে
নদীতে নালায় জলে
বা সীতাকুণ্ডুর
পর্বতমালায় নয়,
এইসব বৃষ্টিভেজা
কাঁদামাখা তাঁবুতে তাঁবুতে যেন
তোমার মানচিত্রখানি

কতগুলি
ছোট ছোট জারুল চারার মতো
উষ্ঞ তাজা
হৃদয়ের সাথে লেপ্টে আছে।

বিভিন্ন টিলায় ট্রেঞ্চে
রাইফেলে ট্রিগারে হাত চেপে
দেখছি প্রতিদিন
হাজার হাজার জীর্ণ অবসন্ন ধর্ষিতা নারী
পুরুষের সাথে
শত্রুর সন্ত্রাস গুলি বেয়নেট বেড়াজাল
কি করে এড়িয়ে মা আমার
হেঁটে চলেছে দল থেকে দলে
দৃপ্ত পায়ে
কুয়াশার আস্তরণ ছিঁড়ে
ভেঙেপড়া
প্রথম সূর্যের ক্ষীণ
আলোর রেখার মতো
কম্পমান সম্ভাবনার দিকে!

বহু পরে
অনেক রাতের শেষে
আঁধারের আস্তরণ ভেঙে
নির্দয় নিশ্চিত সূর্য
জরাজীর্ণ
দেয়াল ফাটলে বট
বৃক্ষের চারার মতো
যখন বেরিয়ে আসবে
ফেটে পড়বে
বহু প্রতীক্ষিত
সেই আনন্দিত ক্ষণে
হয়তো দেখবে
তোমার ঘরের পাশে
উজ্জ্বল পৈঠার ‘পর
দু’একটি ফোঁটা
পুরনো মলিন রক্ত
লেগে আছে,

তখন কি
মনে পড়বে
প্রিয়তমা
আমরা ক’জন মিলে
অবিচল প্রত্যাশায়
তোমার প্রেমের ঋণ
রক্ত-ঋণ
সহস্র সহস্র কোটি
হায়েনার চিৎকারের মতো
সেই এক
পৈশাচিক অন্ধকার রাতে
চলে গেছি
রক্ত দিয়ে
শোধ করে!

স্মৃতিস্তম্ভ - আলাউদ্দিন আল আজাদ


স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনোচারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো ! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক ! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার ।

এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার ? কেবল সেতার
হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার
পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল ?
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক । একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।
পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর ।

রিপোর্ট ১৯৭১ 

– আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে

জাগো হে বাংলার জনতা


জাগো হে বাংলার জনতা
বলো মানুষ মানুষের জন্য
ধর্ম বিভেদ বিষ জীর্ন
করো পুন্য এ জীবন ধন্য
স্বাপদে ভরা জনারণ্যে এ জঘন্য
করো দূর আমাদের পাপ অগন্য।।

বলো হোয়ো নাকো হিংসায় মত্ত
বলো বলো সবে মানবতা সত্য
পৃথিবীটাকে বদলে দাও
নব এক শতক সমাগত।

জ্ঞানের প্রদীপ আজ জ্বালো
এই আমাদের বাংলাদেশে
সৈনিক লহো তুলে ঝান্ডা
চেতনার নব উন্মেষে
তোমারই আঘাতে অবশেষে যাবে ভেসে
যারা এখনও অন্ধ অচৈতন্য।।

বলো হয়োনাকো …. শতক সমাগত।

মৌলবাদের কোন ঠাঁই নাই
এই আমাদের বাংলাদেশে
সৈনিক লহো তুলে ঝান্ডা
চেতনার নব উন্মেষে
তোমারই আঘাতে অবশেষে যাবে ভেসে

যারা করেছে ধর্ম পূঁজিপণ্য।।
বলো হয়োনাকো …শতক সমাগত।

- নাজিম মাহ্‌মুদ

বজ্র কঠিন শপথ 

-নাজিম মাহ্‌মুদ

বজ্র কঠিন শপথ আবার লহ সবাই
শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য কহ সবাই;
শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।।

মানবতার নিধনযজ্ঞ বিভৎসতা
বিভেদ বুদ্ধি, বিদ্বেষ বিষ, হিংস্রতা
হিংসা দ্বন্দ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে করব ছাই
শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।।

পলাতক আজ শুভ্র কপোত আকাশ নীল
আগামী সূর্যে করবে আবার সে ঝিলমিল।

তা যদি না হয়, বুঝব আমরা মানুষ নই,
শিরায় শিরায় এখনও পশুর রক্ত বই
তা যদি না হয়, গর্ব বড়াই দিও না ঠাঁই
শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।।

সূর্যতামসী 

(জীবনানন্দ দাশ)
কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের - জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক'রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর -
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?
সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ - নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে - যা শেখেনি -
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব'লে
জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।



জীবন-বন্দনা 

গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি' ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভ'রে ফুলে-ফলে!
বন্য শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা
যাদের শাসলে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।
যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে
বনের ব্যাঘ্র ময়ূর সিংহ বিবরের ফণী ল'য়ে।
এল দুর্জয় গতি-বেগ-সম যারা যাযাবর-শিশু
-তারাই গাহিল নব প্রেম-গান ধরণী-মেরীর যিশু-
যাহাদের চলা লেগে
উল্কার মত ঘুরিছে ধরণী শূন্যে অমিত বেগে!

খেয়াল-খুশীতে কাটি' অরণ্য রচিয়া অমরাবতী
যাহারা করিল ধ্বংস সাধপ্ন পুনঃ চঞ্চলমতি,
জীবন-আবেগে রুধিতে না পারি' যারা উদ্ধত-শির
লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর।
নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু অভিযানে,
পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে!
তবুও থামে না যৌবন বেগ, জীবনের উল্লাসে
চ'লেছে চন্দ্র-মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে।
যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে
করিতেছে ফিরি, ভীম রণভূমে প্রান বাজি রেখে হারে।
আমি-মরু-কবি-গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান।
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুন উগ্রসুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে!
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোনো বাধা মানিল না,
বর্বর বলি' যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপ-মন্ডুক 'অসংযমী'র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারি তরে ভাই গান রচে' যাই, বন্দনা করি তারে।

© কাজী নজরুল ইসলাম

Monday, 6 January 2014

গফুর স্যার আপনাকে আজ বড় বেশি প্রয়োজন: মেসবাহ য়াযাদ





এই জীবনে লেখাপড়া করেছি মাত্র কয়েক ক্লাস। তো কয়েক ক্লাস পড়তে গিয়ে আমি অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ৫ ক্লাস পার হতেই প্রায় ৫টি স্কুল মাড়িয়েছি। শুধু স্কুল নয়, জেলাও। পড়াশোনার শুরুটা রাঙামাটিতে। স্কুলের নাম আজ আর মনে নেই। তারপর লক্ষ্মীপুর। আমার গ্রামের স্কুলে। আটিয়াতলী প্রাইমারি স্কুল। মাঝে ভেড়ামারা। তারপর চাঁদপুর মটখোলায় খলিশাঢুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শেষ করলাম নারায়ণগঞ্জে এসে। এতে আমার কোনও কৃতিত্ব বা দোষ ছিল না। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সে কারণে আজ এখানে তো কাল সেখানে। উচ্চবিদ্যালয়ে খুব বেশি পড়া হয়নি। মাত্র ৩টিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। চাঁদপুর টেকনিক্যাল হাইস্কুল, লক্ষ্মীপুর ভাঙ্গা খাঁ উচ্চবিদ্যালয়। আর নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি। মহাবিদ্যালয়ে পড়েছি ৩টিতে। সরকারি তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ আর ফেনী সরকারি কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ২টিতে। চট্টগ্রাম আর ঢাকায়।

এতগুলো বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের লিস্টি দেখে যারা ভাবছেন— ছেলেটা তো মহাজ্ঞানী! তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, জ্ঞানী হওয়ার মতো জ্ঞান আমার কোনওকালেই ছিল না। আজও নেই। আমি ভাই সাদামাটা একজন মুখ্য-সুখ্য মানুষ। পড়তে হবে বলে কিংবা বাবার টাকায় ফ্রি পড়তে হয়েছে বলে পড়েছি।

নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি স্কুলের গফুর স্যার। ক্লাসে খুব পেটাতেন আমাদের। কারণে-অকারণে। ছাত্রদের মারার তার নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল। টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে পেছনে ডাস্টার দিয়ে মারতেন। সেই গফুর স্যারের একটা কথা এতদিন পর আজও মনে পড়ে। স্যার বলতেন— ‘বাবারা মনে রাখিস, শিক্ষা তিন প্রকার। অশিক্ষা, সুশিক্ষা আর কুশিক্ষা। তোরা সবাই বড় হয়ে সুশিক্ষিত হবি। আর কোনও কারণে পড়তে না পারলে অশিক্ষিত থাকিস। কিন্তু ভুলেও কেউ কুশিক্ষিত হবি না।’ প্রিয় স্যার, আপনার সেদিনের কথাটি আমি মনে রেখেছি।

সাম্প্রতিক আমাদের দেশের রাজনীতির যে অবস্থা, তা নতুন করে বলার অবকাশ নেই। আমাদের সন্তানেরা জীবনের প্রথম স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে— হরতাল আর অবরোধের মধ্যে। ১৫ দিনের পরীক্ষা শেষ করতে ওদের সময় লেগেছে এক মাসেরও বেশি। শত অনুরোধ সত্ত্বেও আমাদের ‘আপসহীন রাজনীতিবিদরা’ পরীক্ষার সময়ও হরতাল-অবরোধ দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। দেশের বেশিরভাগ জনগণ ঘুরেফিরে দুই দলের রাজনীতির মারপ্যাঁচে আটকা পড়েছি। এ থেকে বেরোনোর রাস্তা নেই আমাদের। একদল ক্ষমতায় যেতে চায়, অন্যদল ক্ষমতায় থাকতে চায়।

ধান ভানতে শীবের গীত গেয়ে লাভ কী! যে কারণে এই লেখার অবতারণা। গত দুদিনে সারা দেশে অসংখ্য স্কুল-কলেজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটগ্রহণ হবে। আর যেহেতু একপক্ষ নির্বাচন চাচ্ছে না, সেহেতু ভোটকেন্দ্রগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা। ভোটকেন্দ্রই যেখানে নাই, সেখানে ভোট হবে কী করে? ওদের হিসাবটা খুব সোজা। তারা একবারের জন্যও ভাবল না, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো কেবল একদিনের জন্য ভোটকেন্দ্র। বছরের বাকি দিনগুলো তো সেখানে শিক্ষাই দেওয়া হয়। প্রিয় গফুর স্যার, আমি বিশ্বাস করি— এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা আগুন দিয়েছে তাদের অনেকেই শিক্ষিত। যদিও জানি না, এরা কীরকম শিক্ষায় শিক্ষিত— অশিক্ষা, সুশিক্ষা নাকি কুশিক্ষায়!

অসংখ্য পুড়িয়ে দেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমার প্রিয় কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে কি না, আমি জানি না। আমি আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মসজিদ-মন্দির-গির্জার মতোই পবিত্র মনে করি। বাংলাদেশের সব পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ কী একজনও গফুর স্যার নেই? নষ্ট রাজনীতি করা মানুষগুলোর কেউ কি তার জীবনে একজন গফুর স্যারের দেখাও পায়নি? প্রিয় গফুর স্যার, আপনি কোথায়? আপনাকে আজ বড় বেশি প্রয়োজন।


লেখক : সাংবাদিক ।

Sunday, 5 January 2014

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোড়ানোর দায় কেউ এড়াতে পারেন না


শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোড়ানোর দায় কেউ এড়াতে পারেন না

শিক্ষাঘাতী রাজনীতি

ভোটের রাজনীতির রোষে এবার পুড়ল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভোট ঠেকাতে শনিবার ২৫ জেলায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচনবিরোধীরা। গানপাউডার ও পেট্রল ছিটিয়ে আগুন দেওয়ায় মুহূর্তেই সবকিছু গ্রাস করে নেয় আগুনের লেলিহান শিখা। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ, আসবাবপত্র, বই-খাতা, শিক্ষা উপকরণসহ প্রায় সবকিছু। সদ্যবিতরণ করা নতুন বইও বাদ যায়নি নাশকতাকারীদের হিংসার আগুন থেকে। সহায় হতে পারেনি সরকারও।

শুধু স্কুলই নয়, নির্বাচনবিরোধীদের আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি মাদ্রাসাও। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক মাদ্রাসায়ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দেশ ও মানুষের প্রতি সামান্যতম দায়িত্ববোধ থাকলে এই ঘৃণ্যতম কাজ কখনও করতে পারত না তারা। এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই।

একতরফা নির্বাচন যেমন কোনও সমাধান নয়, তেমনি সংঘাত-সহিংসতাও আন্দোলনের ভাষা হতে পারে না। নির্বাচন যাবে, নির্বাচন আসবে। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকটে যে প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংস হল, এর কী হবে? ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যেমন গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় বহন করে না, তেমনি ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় দেশের সম্পদ ধ্বংসও রাজনীতি হতে পারে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা নির্বিচারে স্কুল পোড়াতে পারে, পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যা করতে পারে, ক্ষমতায় গেলে তাদের কাছ থেকে মানুষ যে সুশাসন পাবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নির্বাচনি সহিংসতা যে মাত্রায় বেড়েছে, ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র করার ব্যাপারেও সরকার ও ইসিকে ভাবতে হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেড় মাস ধরেই সহিংসতা চলে আসার পরও কেন ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোট দশম সংসদ নির্বাচন বয়কট করার পর থেকেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর নির্বাচনি সহিংসতায় এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। এ প্রেক্ষাপটে ভোটের দিন নির্বাচনবিরোধীরা যে সর্বোচ্চ মাত্রায় সহিংসতা চালাতে পারে সেটি তো নির্বাচন কমিশনের আগেই বোঝা উচিত ছিল। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকে নির্বাচন কমিশনের ওপর। যদি ভোটকেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো নির্বাচনি নাশকতা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচানো যেত। কমিশন এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ধারাবাহিক নৈরাজ্য-নাশকতা ঠেকাতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শনিবার জরুরি এক প্রেসব্রিফিংয়ে অশুভ শক্তির হাত থেকে স্কুল-কলেজগুলো বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে বলেন, ভোটকেন্দ্র একদিনের জন্য, কিন্তু স্কুল-কলেজ চিরদিনের জন্য। এই আকুতি আসলে প্রতিটি মানুষেরই। আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে বারবার বলে আসছি— একতরফা নির্বাচন যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি নির্বাচন ঠেকানোর জন্য নৈরাজ্য, নাশকতা, প্রাণহানি, সম্পদ ধ্বংসও মেনে নেওয়া যায় না।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই টানা হরতাল-অবরোধে নৈরাজ্য-নাশকতায় দেশ প্রায় অচল। পেট্রল বোমাহামলায় পুড়ে মরছে মানুষ। ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্রের সম্পদ। রাস্তার পাশে শতবর্ষী গাছকাটা হয়েছে হাজার-হাজার। উপড়ে ফেলা হয়েছে রেললাইন। এরই ধারাবাহিকতায় বিনামূল্যে বিতরণের পাঠ্যবই ছাপা-পৌঁছনো বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সর্বশেষ ভোটকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় পুড়ে ছাই হয়েছে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার ওপর এই আঘাত কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

এ দায় জামায়াত-যুক্ত বিরোধী জোটেরই বেশি। সরকারও দায় এড়াতে পারে না।

curtesy:- amader shomoy.

আজ নির্বাচন, কাল রবিন হুড: আবু হাসান শাহরিয়ার


আজ বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, এটা প্রহসনের নির্বাচন। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ একে দেখছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতারক্ষার সাঁকো হিসেবে। নির্বাচনটিকে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলেও বলাবলি হচ্ছে। তবে সবার কথা একবাক্যে বলে দিয়েছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, এটা কোনও নির্বাচনই না।

অর্থাত্ যা কোনও নির্বাচনই না, আজ তা-ই অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশে। সবারই জানা, এর অর্ধেক কাজ আগেভাগেই শেষ— ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগাম বিজয়ী।

দুই.

শিশুটির বয়স দশ কী এগারো বছর। আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। নাম তন্ময়। নানা প্রসঙ্গে ওর সঙ্গে আমার প্রায়ই ভাবনাবিনিময় হয়। ওর মনে কখনও কোনও প্রশ্নের উদয় হলেই আমার কাছে ছুটে আসে। ও জানে, কখন এলে আমাকে বাসায় পাওয়া যাবে। যেদিন সরকারসমর্থকরা লাঠিসোঁটা হাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেদিন টিভির খবরে তাণ্ডব-দৃশ্যাবলি দেখে তন্ময় আমার কাছে এসেছিল। জানতে চেয়েছিল, লাঠি-হাতে ওই লোকগুলো কারা? তন্ময়ের সঙ্গে সেদিনের আলাপচারিতা হুবহু তুলে ধরছি নিচে—

: টিভিতে লাঠি-হাতে যে গুণ্ডাদের দেখাচ্ছে, ওরা কারা?

: ওরা দেশ চালায়।

: গুণ্ডারা দেশ চালায়?

: হ্যাঁ বাবা, গুণ্ডারাই দেশ চালায়।

: বুঝতে পেরেছি, ওরা রবিন হুডের মতো গুণ্ডা। খারাপ-বড়লোকদের টাকা ডাকাতি করে ভালো-গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়।

: না বাবা, ওরা ভালো-গরিবদের টাকা লুট করে সম্পদের পাহাড় বানায়। সম্পদের পাহাড় বানাতেই ওরা ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি করে।

: তাহলে ওরা রবিন হুড না। রবিন হুড জানলে ওদের কান-ধরে ওঠ-বস করাবে। আমি রবিন হুডকে ওদের কথা জানিয়ে দেব।

: রবিন হুডকে তুমি চেনো?

: কেন চিনব না, আমি তো ওর বন্ধু হই।


দুদিন আগে ফের তন্ময়ের সঙ্গে দেখা। এবার গাড়ি-বারান্দায়। তখন বিকেল। তন্ময়ের হাতে ক্রিকেটের ব্যাট। আমাকে দেখেই কাছে এসে গল্প জুড়ে দিল।

: জানো, গুণ্ডারা আজ কয়েকটা স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই সব স্কুলের বাচ্চারা খুব কাঁদছিল। টিভিতে ওদের কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়েছে। এই গুণ্ডারাও কি দেশ চালায়?

: না, ওরা আগে দেশ চালিয়েছিল। তবে, আবারও দেশ চালাতে চায়।

: ওরা কি আমার স্কুলও পুড়িয়ে দেবে?

: তোমরা যদি পাহারা না দাও, পুড়িয়ে দিতেও পারে।

: তাহলে তো এখনি রবিন হুডকে বলতে হয়। আমার স্কুল পোড়াতে এলে গুণ্ডাদের ধরে আচ্ছা করে পেটাবে রবিন হুড। জানো, রবিন হুডের মার খেয়ে অনেক গুণ্ডা ভালো হয়ে গেছে।

তিন.

আজকের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অচল হয়ে আছে দেশ। এ সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এই সহিংসতা। আজও থাকতে পারে। নির্বাচনি সহিংসতা আমরা আগেও দেখেছি। এবারের সহিংসতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর একটি বড় কারণ— নির্বাচনের সঙ্গে এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটিও জড়িত। কদিন আগে এই বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। কাদের মোল্লার দল জামায়াত একাত্তরে গণহত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। দলটির আরও কিছু শীর্ষ নেতার জন্য একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাই একাত্তরের চেহারায় দেশজুড়ে নাশকতা চালাচ্ছে জামায়াত। দলটি দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জোটবন্ধু। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপিরও দু-একজন নেতা বিচারাধীন আছেন। এ কারণেই বিএনপির নির্বাচনি সহিংসতা আর জামায়াতের বিচারবিরোধী নাশকতা এখন মিলেমিশে একাকার। অন্যদিকে দল দুটিকে মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ঘোষণা দিয়ে লাঠিসোঁটা হাতে মাঠে। তাদের পাশে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী র্যাব-পুলিশও আছে।

দু পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে মানুষের এখন বেঁচে থাকাই দায়। বিরোধী জোটের ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় ভেঙেই পড়েছে। সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতায় চিন্তিত বিদেশি কূটনীতিকরাও। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু দেশ স্ব-স্ব নাগরিকদের বাংলাদেশ-ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। সেই সব দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে ভাটা। ঘরে-বাইরে এ বিচ্ছিন্নতা ব্যর্থ রাষ্ট্রের লক্ষণ।

চার.

এ অচলাবস্থা একদিনে হয়নি। এর জন্য দায়ী রাজনীতিকদের আদর্শহীনতা। তবে শুধু রাজনীতিকদেরই দোষ দেওয়া যায় না। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টজীবী এক শ্রেণীর মানুষ যুক্তিহীনভাবে দলকানা বলেই রাজনীতিকরা বল্গাহীনভাবে আদর্শহীন হওয়ার সুযোগ পান। দলকানাদের সমর্থনের কারণেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে অথবা ক্ষমতায় যেতে রাজনীতিকরা— যত নিচে নামা যায়— নামতে প্রস্তুত। জনগণের দোহাই দিয়ে রাজনীতি করলেও জনগণের ভালোমন্দের তারা তোয়াক্কা করেন না। ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে মানুষকে পুড়িয়ে মারতেও হাত কাঁপে না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলিতে নির্বিচারে মানুষ মারতেও বাধে না।

পাঁচ.

সংবিধান সমুন্নত রাখতে আজকের নির্বাচন হচ্ছে। হয়ে যাক। শুধু সংবিধানেরই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতারক্ষার স্বার্থেও নির্বাচনটি হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু এর বেশি নয়। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে নতুন সরকারকে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাছে যেতে হবে। ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ায় দশম এই জাতীয় নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার আজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না। তাই, এ নির্বাচনের মাধ্যমে যে-সরকার ক্ষমতায় আসতে চলেছে, সেই সরকার হবে একটি প্রশ্নবিদ্ধ সরকার। এমন একটি সরকারের কাছে সুশাসন প্রত্যাশা করা যায় না। অন্যদিকে অশুভ জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপির কাছেও শুভ কিছু আশা করা বোকামি। কেননা নির্বাচনের আগে দেশ, নির্বাচনের আগে মুক্তিযুদ্ধ।

পাদটীকা
অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মোহে আমাদের রাজনীতিকরা আজ জনবিচ্ছিন্ন। মানুষকে তারা অনেক ঠকিয়েছেন। আর নয়। স্বভাব তাদের পাল্টাতেই হবে। আর এ পরিবর্তনের মূলে থাকতে হবে গণমুখী আদর্শ। তা না হলে রাজনীতিকে জঞ্জালমুক্ত করতে রবিন হুড হয়ে দেখা দেবে তন্ময়রা। ওদের জন্যই এই গদ্য।

Friday, 3 January 2014

অবাক সূর্যোদয় 

কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকুল সূর্যোদয়
রক্তভীষণ মুখমণ্ডলে চমকায় বরাভয় ।
বুকের অধীর ফিনকির ক্ষুরধার
শহীদের খুন লেগে
কিশোর তোমার দুই হাতে দুই
সূর্য উঠেছে জেগে ।
মানুষের হাতে অবাক সূর্যোদয়,
যায় পুড়ে যায় মর্ত্যের অমানিশা
শঙ্কার সংশয় ।

কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
প্রবল অহংকারে সূর্যের সাথে
অভিন্ন দেখ অমিত অযুত লাখ ।
সারা শহরের মুখ
তোমার হাতের দিকে
ভয়হারা কোটি অপলক চোখ একাকার হল
সূর্যের অনিমিখে ।

কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
লোলিত পাপের আমূল রসনা ক্রুর অগ্নিতে ঢাক ।
রক্তের খরতানে
জাগাও পাবক প্রাণ
কণ্ঠে কাটাও নিষ্ঠুরতম গান
যাক পুড়ে যাক আপামর পশু
মনুষ্যত্বের ধিক্ অপমান
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
কুহেলী পোড়ানো মিছিলের হুতাশনে
লাখ অযুতকে ডাক ।

কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকূল সূর্যোদয়
রক্তশোধিত মুখমণ্ডলে চমকাক্ বরাভয় ।

~হাসান হাফিজুর রহমান~

বিক্ষোভ - সুকান্ত ভট্টাচার্য 

দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম,
হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম।
জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে
ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে,
কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে
হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে?
যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী,
আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি।
ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি,
আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি,
অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা,
তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা?
বিদ্রোহী মন! আজকে ক'রো না মানা,
দেব প্রেম আর পাব কলসীর কণা,
দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে,
জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে।
কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল,
ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল,
ততদিনে প্রাণ দেব শত্রুর হাতে
মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে।
ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,
আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।।

(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)

Thursday, 2 January 2014

খেলিছ এ বিশ্বলয়ে --- কাজী নজরুল ইসলাম

খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট ও শিশু আনমনে।। খেলিছ
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট ও শিশু আনমনে।
শূণ্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে।।
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট ও শিশু আনমনে। খেলিছ
তারকা রবি শশী
খেলনা তব হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা
পায়ের কাছে রাশি রাশি।।
নিত্য তুমি হে উদার
সুখে-দুখে অবিকার।।
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট ও শিশু আনমনে খেলিছ।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট ও শিশু আনমনে খেলিছ।

Wednesday, 1 January 2014

দেখতে চাই 

আমাকে দেখাও তুমি দূরের আকাশ, ওই
দূরের পৃথিবী
আমি তো দেখতে চাই কাছের জীবন;
তুমি আমাকে দেখাতে চাও দূর নীহারিকা
সমুদ্র-সৈকত
বিসতৃত দিগন্তরেখা, দূরের পাহাড়
তুমি চাও আরো দূরে, দূর দেশে
আমাকে দেখাতে কোনো রম্য দ্বীপ, স্নিগ্ধ জলাশয়
আমি চাই কেবল দেখতে এই চেনা সরোবর,
কাছের নদীটি।
আমাকে দেখাতে চাও বিশাল জগৎ, নিয়ে যেতে
চাও অনন্তের কাছে
আমার দৃষ্টি খুবই সীমাবদ্ধ-
অতো দূরে যায় না আমার চোখ;
কেবল দেখতে চাই জীবনের কাছাকাছি
যেসব অঞ্চল-
দূরের নক্ষত্র থাক তুমি এই নিকটের মানচিত্র
আমাকে দেখাও;
দেখাও নদীর কুল, চালের কুমড়োলতা,
বাড়ির উঠোন্ত
দূরের রহস্য নয়, কেবল বুঝতে চাই
তোমার হৃদয়।

~ মহাদেব সাহা ।

আমূল বদলে দাও আমার জীবন 

পরিপূর্ণ পাল্টে দাও আমার জীবন, আমি ফের
বর্ণমালা থেকে শুরু করি-
আবার মুখস্ত করি ডাক-নামতা, আবার সাঁতার শিখি
একহাঁটু জলে;
তুমি এই অপগণ্ড বয়স্ক শিশুকে মেরেপিটে
কিছুটা মানুষ করো,
কেতে দাও আলুসিদ্ধ দুটি ফেনা ভাত।
আবার সবুজ মাঠে একা ছেড়ে দাও তাকে,
একটু করিয়ে দাও পরিচয় আকাশের সাথে
খুব যত্ন করে সব বৃক্ষ ও ফুলের নাম শিখি।
আমূল বদলে দাও পুরনো জীবন, ভালোবেসে
আবার নদীর তীরে নরম মাটিতে শুরু করি চলা
বানাই একটি ছোটো বাংলো খড়ের কুঁড়েঘর;
পুরোপুরি পাল্টে দাও আমার জীবন, আমি ফের
গোড়া থেকে শুরু করি-
একেবারে পরিশুদ্ধ মানুষের মতো করি
আরম্ভ জীবন;
এভাবে কখনো আর করবো না ভুলভ্রানি- কিছু
এবার নদীর জলে ধুয়ে নেই এই পরাজিত মুখ,
ধুয়ে নেই সকলের অপমান্তউপেক্ষার কালি।
একবার ভালোবেসে, মাতৃস্নেহে
আমূল বদলে দাও আমার জীবন
দেখো কীভাবে শুধরে নেই জীবনের ভুলচুকগুলি।

~ মহাদেব সাহা ।

মুনাজাত 

আরজু আমার শোন খোদা 
আরজু আমার শোন খোদা
শোন অবিরত,
এই জীবনের মালা থেকে
আর একটি দিন পড়ল খ'সে
ঝরা ফুলের মত।।

সত্য পথে জিন্দেগী যার
মরণ পরায় সাত নারী হার
সফলতার দ্বারে,
জাহার ভুলের কালি নিয়ে

দিন গুলি মোর যায় হারিয়ে
রাতের অন্ধকারে,
পাইনা আমি পথের দিশা
কালো ছায়ায় বেড়াই ঘুরে যত।।

নাইতো হিসাব, নিকাশ যে পাই
তাইতো শুধু তোমায় জানাই
ওগো দয়াল প্রভু।
সকল পাপের গ্লানি থেকে

আলোর পথে নাওগো দেকে
তোমার দয়ায় রাখো ঘিরে তবু
সত্য পথের দাও ইশারা
পাপের ছায়ায় হই না যেন নত।।

#ফররুখ আহমদ 

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে


আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান- অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে

পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান,
কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস,-লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান- নীরবতা-এরি মাঝে বাংলার প্রাণ;
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।

# জীবনানন্দ দাশ