Monday, 6 January 2014

গফুর স্যার আপনাকে আজ বড় বেশি প্রয়োজন: মেসবাহ য়াযাদ





এই জীবনে লেখাপড়া করেছি মাত্র কয়েক ক্লাস। তো কয়েক ক্লাস পড়তে গিয়ে আমি অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ৫ ক্লাস পার হতেই প্রায় ৫টি স্কুল মাড়িয়েছি। শুধু স্কুল নয়, জেলাও। পড়াশোনার শুরুটা রাঙামাটিতে। স্কুলের নাম আজ আর মনে নেই। তারপর লক্ষ্মীপুর। আমার গ্রামের স্কুলে। আটিয়াতলী প্রাইমারি স্কুল। মাঝে ভেড়ামারা। তারপর চাঁদপুর মটখোলায় খলিশাঢুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শেষ করলাম নারায়ণগঞ্জে এসে। এতে আমার কোনও কৃতিত্ব বা দোষ ছিল না। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সে কারণে আজ এখানে তো কাল সেখানে। উচ্চবিদ্যালয়ে খুব বেশি পড়া হয়নি। মাত্র ৩টিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। চাঁদপুর টেকনিক্যাল হাইস্কুল, লক্ষ্মীপুর ভাঙ্গা খাঁ উচ্চবিদ্যালয়। আর নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি। মহাবিদ্যালয়ে পড়েছি ৩টিতে। সরকারি তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ আর ফেনী সরকারি কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ২টিতে। চট্টগ্রাম আর ঢাকায়।

এতগুলো বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের লিস্টি দেখে যারা ভাবছেন— ছেলেটা তো মহাজ্ঞানী! তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, জ্ঞানী হওয়ার মতো জ্ঞান আমার কোনওকালেই ছিল না। আজও নেই। আমি ভাই সাদামাটা একজন মুখ্য-সুখ্য মানুষ। পড়তে হবে বলে কিংবা বাবার টাকায় ফ্রি পড়তে হয়েছে বলে পড়েছি।

নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি স্কুলের গফুর স্যার। ক্লাসে খুব পেটাতেন আমাদের। কারণে-অকারণে। ছাত্রদের মারার তার নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল। টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে পেছনে ডাস্টার দিয়ে মারতেন। সেই গফুর স্যারের একটা কথা এতদিন পর আজও মনে পড়ে। স্যার বলতেন— ‘বাবারা মনে রাখিস, শিক্ষা তিন প্রকার। অশিক্ষা, সুশিক্ষা আর কুশিক্ষা। তোরা সবাই বড় হয়ে সুশিক্ষিত হবি। আর কোনও কারণে পড়তে না পারলে অশিক্ষিত থাকিস। কিন্তু ভুলেও কেউ কুশিক্ষিত হবি না।’ প্রিয় স্যার, আপনার সেদিনের কথাটি আমি মনে রেখেছি।

সাম্প্রতিক আমাদের দেশের রাজনীতির যে অবস্থা, তা নতুন করে বলার অবকাশ নেই। আমাদের সন্তানেরা জীবনের প্রথম স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে— হরতাল আর অবরোধের মধ্যে। ১৫ দিনের পরীক্ষা শেষ করতে ওদের সময় লেগেছে এক মাসেরও বেশি। শত অনুরোধ সত্ত্বেও আমাদের ‘আপসহীন রাজনীতিবিদরা’ পরীক্ষার সময়ও হরতাল-অবরোধ দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। দেশের বেশিরভাগ জনগণ ঘুরেফিরে দুই দলের রাজনীতির মারপ্যাঁচে আটকা পড়েছি। এ থেকে বেরোনোর রাস্তা নেই আমাদের। একদল ক্ষমতায় যেতে চায়, অন্যদল ক্ষমতায় থাকতে চায়।

ধান ভানতে শীবের গীত গেয়ে লাভ কী! যে কারণে এই লেখার অবতারণা। গত দুদিনে সারা দেশে অসংখ্য স্কুল-কলেজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটগ্রহণ হবে। আর যেহেতু একপক্ষ নির্বাচন চাচ্ছে না, সেহেতু ভোটকেন্দ্রগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা। ভোটকেন্দ্রই যেখানে নাই, সেখানে ভোট হবে কী করে? ওদের হিসাবটা খুব সোজা। তারা একবারের জন্যও ভাবল না, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো কেবল একদিনের জন্য ভোটকেন্দ্র। বছরের বাকি দিনগুলো তো সেখানে শিক্ষাই দেওয়া হয়। প্রিয় গফুর স্যার, আমি বিশ্বাস করি— এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা আগুন দিয়েছে তাদের অনেকেই শিক্ষিত। যদিও জানি না, এরা কীরকম শিক্ষায় শিক্ষিত— অশিক্ষা, সুশিক্ষা নাকি কুশিক্ষায়!

অসংখ্য পুড়িয়ে দেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমার প্রিয় কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে কি না, আমি জানি না। আমি আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মসজিদ-মন্দির-গির্জার মতোই পবিত্র মনে করি। বাংলাদেশের সব পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ কী একজনও গফুর স্যার নেই? নষ্ট রাজনীতি করা মানুষগুলোর কেউ কি তার জীবনে একজন গফুর স্যারের দেখাও পায়নি? প্রিয় গফুর স্যার, আপনি কোথায়? আপনাকে আজ বড় বেশি প্রয়োজন।


লেখক : সাংবাদিক ।