পড়াই প্রথম বাণী । পড়ার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে আমার প্রচেষ্টা । কবিতা আমার ভীষণ প্রিয় । Poetry touches my mind, moves me and makes me and forget self. তাই আমার প্রিয় কিছু কবিতা, প্রবন্ধ ও আরো কিছু বিষয় দিয়ে সাজিয়েছি আমার এ বর্ণমালার ঊচ্চারনের ব্লগ । এখানে বেড়াতে এসে যদি আপনার মনে সামান্য প্রশান্তির ছোঁয়া লাগে, তবে ভাববো আমার প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে ।
Sunday, 5 January 2014
আজ নির্বাচন, কাল রবিন হুড: আবু হাসান শাহরিয়ার
আজ বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, এটা প্রহসনের নির্বাচন। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ একে দেখছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতারক্ষার সাঁকো হিসেবে। নির্বাচনটিকে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলেও বলাবলি হচ্ছে। তবে সবার কথা একবাক্যে বলে দিয়েছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, এটা কোনও নির্বাচনই না।
অর্থাত্ যা কোনও নির্বাচনই না, আজ তা-ই অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশে। সবারই জানা, এর অর্ধেক কাজ আগেভাগেই শেষ— ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগাম বিজয়ী।
দুই.
শিশুটির বয়স দশ কী এগারো বছর। আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। নাম তন্ময়। নানা প্রসঙ্গে ওর সঙ্গে আমার প্রায়ই ভাবনাবিনিময় হয়। ওর মনে কখনও কোনও প্রশ্নের উদয় হলেই আমার কাছে ছুটে আসে। ও জানে, কখন এলে আমাকে বাসায় পাওয়া যাবে। যেদিন সরকারসমর্থকরা লাঠিসোঁটা হাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেদিন টিভির খবরে তাণ্ডব-দৃশ্যাবলি দেখে তন্ময় আমার কাছে এসেছিল। জানতে চেয়েছিল, লাঠি-হাতে ওই লোকগুলো কারা? তন্ময়ের সঙ্গে সেদিনের আলাপচারিতা হুবহু তুলে ধরছি নিচে—
: টিভিতে লাঠি-হাতে যে গুণ্ডাদের দেখাচ্ছে, ওরা কারা?
: ওরা দেশ চালায়।
: গুণ্ডারা দেশ চালায়?
: হ্যাঁ বাবা, গুণ্ডারাই দেশ চালায়।
: বুঝতে পেরেছি, ওরা রবিন হুডের মতো গুণ্ডা। খারাপ-বড়লোকদের টাকা ডাকাতি করে ভালো-গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়।
: না বাবা, ওরা ভালো-গরিবদের টাকা লুট করে সম্পদের পাহাড় বানায়। সম্পদের পাহাড় বানাতেই ওরা ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি করে।
: তাহলে ওরা রবিন হুড না। রবিন হুড জানলে ওদের কান-ধরে ওঠ-বস করাবে। আমি রবিন হুডকে ওদের কথা জানিয়ে দেব।
: রবিন হুডকে তুমি চেনো?
: কেন চিনব না, আমি তো ওর বন্ধু হই।
দুদিন আগে ফের তন্ময়ের সঙ্গে দেখা। এবার গাড়ি-বারান্দায়। তখন বিকেল। তন্ময়ের হাতে ক্রিকেটের ব্যাট। আমাকে দেখেই কাছে এসে গল্প জুড়ে দিল।
: জানো, গুণ্ডারা আজ কয়েকটা স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই সব স্কুলের বাচ্চারা খুব কাঁদছিল। টিভিতে ওদের কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়েছে। এই গুণ্ডারাও কি দেশ চালায়?
: না, ওরা আগে দেশ চালিয়েছিল। তবে, আবারও দেশ চালাতে চায়।
: ওরা কি আমার স্কুলও পুড়িয়ে দেবে?
: তোমরা যদি পাহারা না দাও, পুড়িয়ে দিতেও পারে।
: তাহলে তো এখনি রবিন হুডকে বলতে হয়। আমার স্কুল পোড়াতে এলে গুণ্ডাদের ধরে আচ্ছা করে পেটাবে রবিন হুড। জানো, রবিন হুডের মার খেয়ে অনেক গুণ্ডা ভালো হয়ে গেছে।
তিন.
আজকের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অচল হয়ে আছে দেশ। এ সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এই সহিংসতা। আজও থাকতে পারে। নির্বাচনি সহিংসতা আমরা আগেও দেখেছি। এবারের সহিংসতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর একটি বড় কারণ— নির্বাচনের সঙ্গে এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটিও জড়িত। কদিন আগে এই বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। কাদের মোল্লার দল জামায়াত একাত্তরে গণহত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। দলটির আরও কিছু শীর্ষ নেতার জন্য একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাই একাত্তরের চেহারায় দেশজুড়ে নাশকতা চালাচ্ছে জামায়াত। দলটি দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জোটবন্ধু। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপিরও দু-একজন নেতা বিচারাধীন আছেন। এ কারণেই বিএনপির নির্বাচনি সহিংসতা আর জামায়াতের বিচারবিরোধী নাশকতা এখন মিলেমিশে একাকার। অন্যদিকে দল দুটিকে মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ঘোষণা দিয়ে লাঠিসোঁটা হাতে মাঠে। তাদের পাশে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী র্যাব-পুলিশও আছে।
দু পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে মানুষের এখন বেঁচে থাকাই দায়। বিরোধী জোটের ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় ভেঙেই পড়েছে। সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতায় চিন্তিত বিদেশি কূটনীতিকরাও। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু দেশ স্ব-স্ব নাগরিকদের বাংলাদেশ-ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। সেই সব দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে ভাটা। ঘরে-বাইরে এ বিচ্ছিন্নতা ব্যর্থ রাষ্ট্রের লক্ষণ।
চার.
এ অচলাবস্থা একদিনে হয়নি। এর জন্য দায়ী রাজনীতিকদের আদর্শহীনতা। তবে শুধু রাজনীতিকদেরই দোষ দেওয়া যায় না। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টজীবী এক শ্রেণীর মানুষ যুক্তিহীনভাবে দলকানা বলেই রাজনীতিকরা বল্গাহীনভাবে আদর্শহীন হওয়ার সুযোগ পান। দলকানাদের সমর্থনের কারণেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে অথবা ক্ষমতায় যেতে রাজনীতিকরা— যত নিচে নামা যায়— নামতে প্রস্তুত। জনগণের দোহাই দিয়ে রাজনীতি করলেও জনগণের ভালোমন্দের তারা তোয়াক্কা করেন না। ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে মানুষকে পুড়িয়ে মারতেও হাত কাঁপে না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলিতে নির্বিচারে মানুষ মারতেও বাধে না।
পাঁচ.
সংবিধান সমুন্নত রাখতে আজকের নির্বাচন হচ্ছে। হয়ে যাক। শুধু সংবিধানেরই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতারক্ষার স্বার্থেও নির্বাচনটি হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু এর বেশি নয়। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে নতুন সরকারকে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাছে যেতে হবে। ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ায় দশম এই জাতীয় নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার আজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না। তাই, এ নির্বাচনের মাধ্যমে যে-সরকার ক্ষমতায় আসতে চলেছে, সেই সরকার হবে একটি প্রশ্নবিদ্ধ সরকার। এমন একটি সরকারের কাছে সুশাসন প্রত্যাশা করা যায় না। অন্যদিকে অশুভ জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপির কাছেও শুভ কিছু আশা করা বোকামি। কেননা নির্বাচনের আগে দেশ, নির্বাচনের আগে মুক্তিযুদ্ধ।
পাদটীকা
অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মোহে আমাদের রাজনীতিকরা আজ জনবিচ্ছিন্ন। মানুষকে তারা অনেক ঠকিয়েছেন। আর নয়। স্বভাব তাদের পাল্টাতেই হবে। আর এ পরিবর্তনের মূলে থাকতে হবে গণমুখী আদর্শ। তা না হলে রাজনীতিকে জঞ্জালমুক্ত করতে রবিন হুড হয়ে দেখা দেবে তন্ময়রা। ওদের জন্যই এই গদ্য।