Monday, 24 February 2014

একুশ আমার অহঙ্কার



একুশ, তুমি আমার অহঙ্কার 
তোমাকে সালাম সহস্রবার ।
তোমার জন্য জীবন ধন্য আমার
তুমি পথ দেখালে স্বাধীনতার ।

একুশ, তুমি দিলে শহীদ মিনার
নিলে কেড়ে তাজা প্রাণ কতো জনার
রফিক-বরকত, শফিক-সালাম-জব্বার
রক্তে ভেজালে রাজপথ নয়কো ভুলবার ।

আমতলায় সারি সারি লাশের দৃশ্য
অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল গোটা বিশ্ব ।
ভাষার জন্য বাঙালি দিতে পারে প্রাণ
সাক্ষী ইতিহাস আমরা তার প্রমাণ ।

ছেলেহারা মায়ের বুকের হাহাকার
বোবা কান্না বুকে চাপা কৃষক পিতার
ভাইহারা বোনের কষ্ট অপার
একুশ তবুও আমার অহঙ্কার ।

এনে দিলে মযাদা তুমি পাহার সমান
মায়ের ভাষা পেলো বিশ্ব ভাষার সম্মান ।

“মতিয়ার রহমান"

স্বপ্নের ধ্বনিরা



স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায় : স্থবিরতা সব চেয়ে ভালো;

নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে

অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে

স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোনো বিকেলের আলো।


সেই আলো চিরদিন হয়ে থাকে স্থির,

সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির

হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সোনালি জরির কাজ ফেলে

প্রদীপ নিভায়ে রব বিছানায় শুয়ে;

অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রব

বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতোস্থবিরতা,

কবে তুমি আসিবে বল তো।


[জীবনানন্দ দাশ]

সৃষ্টিলগ্নে ছিল ইলহামি ভাষা

মাহমুদ আহমদ সুমন
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
প্রত্যেক জাতির কাছে মাতৃভাষার মর্যাদা অপরিসীম। পবিত্র কোরআন পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে যত নবী রাসূলের আগমন ঘটেছে তারা সবাই নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই আল্লাহপাকের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছাতেন। এ ছাড়া পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সব ভাষাই আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা। সব জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গম্বর এসেছেন, তেমনি সব জাতির স্ব-স্ব ভাষাতেই আল্লাহতায়ালার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমাদের কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে (সূরা ইবরাহিম : ৪)। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সঙ্গে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আল্লাহপাক বলেন, আর তার নিদর্শনাবলীর মাঝে রয়েছে আকাশগুলোর ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতাও। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে (সূরা আর রূম : ২২)। ভাষা ও রঙের এ বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব জড়িত। আকাশ-মালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি। বর্ণের ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। কিন্তু তবুও এ বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। আর মানবতার এ ঐক্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সৃষ্টিকর্তাও একজনই। মানবজাতির সূচনালগ্নে ভাষা ছিল একটিই এবং তা ছিল ইলহামি ভাষা। এরপর মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে এলাকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবেই সূচনাতে মানুষের রংও ছিল একই রকম। এরপর গ্রীষ্ম, শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুযায়ী তার রঙেরও পরিবর্তন হতে থাকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্র“য়ারি অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি মাস। ১৯৫২ সালের এ মাসের ২১ তারিখে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই এ দাবিতে বাঙালিরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন পাকিস্তানিরা তার জবাব দিয়েছিল বুলেটের মাধ্যমে। বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। সেই রক্তের ছোঁয়া পেয়ে আশ্চর্য দ্রুততায় গোটা জাতি জেগে উঠেছিল তার শেকড়ের টানে। পাকিস্তানিদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোনো বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই।
বাংলা আমাদের দেশমাতৃকা বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে অবদান। আজ আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে যায়, পৃথিবীর সব দেশের জনগণ প্রতিবছর এ নদী বিধৌত পলি মাটির মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক সমর্থনে সাধারণ মানুষ কতটা নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক হতে পারে এবং কতটা আত্মত্যাগী হতে পারে এ বিষয়ে জানছে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত হারানো শাশ্বত এ বাঙালির রক্তের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ, আজ পরম শ্রদ্ধার দেদীপ্যমান সারা বিশ্বের জনগণের কাছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হজরত মূসা (আ.)-এর প্রতি তাওরাত হিব্র“ ভাষায়, হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ইঞ্জিল সুরিয়ানি ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি যাবুর ইউনানি ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর প্রতি আল কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়। হজরত রাসূল করিম (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তার কাছে মানবজাতির দিশারী এবং সৎ পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। এ ঐশী ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি। বিশ্ব নবীর মাতৃভাষায় পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ঘোষাণা করেছেন, নিশ্চয় আমরা এ কোরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তা দিয়ে মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহকারী জাতিকে সতর্ক করতে পার (সূরা মরিয়ম : ৯৭)। আরও বলা হয়েছে, আর এর পূর্বে মূসার কিতাব ছিল এক পথপ্রদর্শক ও কৃপা। আর এ কোরআন হল প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ ভাষায় এক সত্যায়নকারী কিতাব যে তা জালেমদের সতর্ক করে এবং সৎকর্মপরায়ণদের সুসংবাদ দেয় (সূরা আহকাফ : ১২)। তাই আমরা বলতে পারি কোনো ভাষা অপবিত্র নয় বরং সব ভাষাই ঐশী ভাষা।
মহান অল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নিজ মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে দিক আর আজকের দিনে বাঙালি সংস্কৃতির নামে যে বেহায়াপনা করা হচ্ছে তা থেকে আমাদের রক্ষা করুক। গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেসব বীর শহীদ ও বীর সৈনিকদের যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন। আমরা যেন আমাদের লেখায়, কথায়, চলনে-বলনে মাতৃভাষাকে আরও বেশি করে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি আর আল্লাহপাকের এ বিশেষ দান সব ভাষাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তার তওফিক
দান করুন।
www.jugantor.com/islam-and-life/2014/02/21/71078#sthash.NxtD9ezK.dpuf

Saturday, 22 February 2014

ভাষাবৈচিত্র্যে রাঙানো ইসলাম 

মাহমুদা আক্তার নীনা
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

নিঃসন্দেহে মানুষের জীবন বিধান হিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন বা ধর্ম হচ্ছে ‘ইসলাম’ (সূরা আলে ইমরান-১৯ আয়াত)। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন বা ধর্ম অন্বেষণ করবে, কখনও তা তার থেকে কবুল বা গ্রহণ করা হবে না। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত (সূরা আলে ইমরান-৮৫ আয়াত)। এ আয়াত দুটি প্রমাণ করে দেয়, আল্লাহর সব নবী-রাসূলদের দ্বীন বা ধর্মই ছিল ইসলাম। কেননা সৃষ্টির আদি থেকে আল্লাহ যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাদের সবাইকেই আল্লাহ তার একাত্মবাদ প্রচারের জন্য এবং মানুষের জীবন বিধান হিসেবে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যই পাঠিয়েছেন। তাই তো আল্লাহর সব নবী-রাসূলই ছিল আল্লাহর একাত্মবাদে দৃঢ় বিশ্বাসী ও আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী। আর যেহেতু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম তাই আল্লাহর সব নবী-রাসূলের ধর্মই ইসলাম এবং তারা সবাই মুসলমান। তাই তো আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, আপনি (মুহাম্মদ) তো কেবল একজন সতর্ককারী মাত্র। আর প্রত্যেক জাতির জন্যই এসেছে সতর্ককারী (পথপ্রদর্শক, নবী-রাসূল) সূরা রাদের-৭ আয়াত। এ ছাড়াও আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক রাসূলকেই আমি স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি যেন তাদের (জাতিকে) পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে (সূরা ইব্রাহিম-৪ আয়াত)। যেহেতু আল্লাহ পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিতে রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাদের কণ্ঠে মাতৃভাষা দিয়ে বা জাতিসত্তার ভাষা দিয়েই পাঠিয়েছেন, সেহেতু প্রমাণ হয়েই যায় যে এ পৃথিবীর যে কোনো ভাষাই কোনো না কোনো নবী-রাসূলেরই জাতিসত্তার ভাষা এবং নবী রাসূলেরই ভাষা। আর যেহেতু সব নবী-রাসূলদের ধর্মই ছিল ইসলাম সুতরাং পৃথিবীর যে কোনো ভাষা অর্থাৎ প্রতিটি ভাষাই দ্বীন ইসলামের ভাষা বা ইসলামী ভাষা এবং এটাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েই যায় যে পৃথিবীর সব জাতিতে যেহেতু নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে সেহেতু দূর অতীতে নবী-রাসূলদের যুগে বাঙালি জাতিতেও এক বা একাধিক নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে এবং তাদের জাতিসত্তার ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলা ভাষা দিয়েই পাঠানো হয়েছে এবং তারা মাতৃভাষা বা জাতিসত্তার ভাষা বাংলা ভাষা দ্বারাই আল্লাহর একাত্মবাদ প্রচার করেছেন এবং নিজেরাও মাতৃভাষা দ্বারাই নামাজ-কিতাব পাঠ করেছেন। এটাই যুক্তির কথা এবং কোরআনের বাণীর মর্মার্থ ও শিক্ষা। যুক্তিই যাদের চলার পথের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। যুক্তির আলোকেই যারা করে থাকেন বিচার-বিশ্লেষণ তারা এ আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখুন। যুক্তির আলোকেই না হয় চলুক সত্যের প্রমাণে বিতর্কপ্রেমীদের যুক্তির প্রতিযোগিতা। বিতর্কচর্চা ও যুক্তির প্রতিযোগিতা যেমন আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে দেয় তেমনি এনে দেয় সফলতাও। যুক্তির জোয়ারে ভেসে যায় মিথ্যা ও বিভ্রান্তি। সত্যের হয় জয়। তাই তো ইসলামের বিধিবিধান যুক্তির কষ্টিপাথরে ঘষা। আল্লাহ মানুষের ভাষা বৈচিত্র্যতাকে যেমন তার সৃষ্টির নিদর্শন করেছেন তেমনি তার নবী-রাসূলদের কণ্ঠে বিচিত্র ভাষা দিয়ে এবং তারই বিভিন্ন কিতাব ও সহিফা বিভিন্ন ভাষায় নাজিল করে দ্বীন ইসলামের বুকে ভাষা বৈচিত্র্যতার নিদর্শন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানুষের ভাষার অধিকার ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং দ্বীন ইসলামকে ভাষাবৈচিত্র্যতার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন এবং বান্দাদের মাতৃভাষা চেতনায় সমৃদ্ধ করে দিয়েছেন ইসলামকে। তাই তো দ্বীন ইসলাম মাতৃভাষা চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, (হে মানুষ) আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য সেই দ্বীনকেই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছেন নুহকে এবং যা আমি তোমার (মুহাম্মদ) কাছে ওহি করে পাঠিয়েছি। উপরন্তু যার আদেশ ইব্রাহিম, মুসা ও ঈশাকে (আ.) দিয়েছিলাম। এদের সবাইকেই আমি বলেছিলাম, তোমরা এ জীবন বিধান (সমাজে) প্রতিষ্ঠিত কর এবং কখনও এতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না। (সূরা শুরা, আয়াত-১৩)। এখানে স্পষ্ট হয়েই যায় এদের সবাইকেই আল্লাহ দ্বীন ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং নুহ, ইব্রাহিম, মুসা, ঈশা ও রাসূলুল্লাহর কাছে নাজিল করা সব কিতাবই ইসলামী কিতাব। তবে এসব কিতাব একেকটি একেক ভাষায় অর্থাৎ যার যার কাছে তার ভাষায় কিতাব নাজিল করা হয়েছে একেক কিতাব একেক ভাষায় নাজিল করার কারণে দ্বীন ইসলামের ঐক্য নষ্ট হয়নি। দ্বীন ইসলামের বুকে আল্লাহ ভাষাগত ঐক্যের প্রাচীর গড়ে দেননি। তিনি দ্বীন ইসলামকে সব জাতির ও সব ভাষার জন্য মুক্ত করে দিয়েছেন। দ্বীন ইসলামকে তিনি আরবি ভাষার প্রাচীরে রুদ্ধ করেননি। তাই তো তার কিতাবের মাঝে আরবি ভাষার ঐক্য সৃষ্টি করেননি।
নুহ, ঈসা, মুসা, ইব্রাহিম, রাসূল্লাহ তারা সবাই যারযার ভাষায় নামাজ-কোরআন পাঠ করেছেন। কাজেই ইসলামের ভাষাগত ঐক্যের কোনো বাধ্যতা ও অপরিহার্যতা নেই। আল্লাহর নবী-রাসূলরা যদি তাদের কণ্ঠের আরবি ভাষা দিয়েই নামাজ-কিতাব পড়তে পেরেছেন, তবে আমরা পারব না কেন? ইসলামের প্রচলিত উম্মাহর ভাষাগত ঐক্যের কোনো যুক্তি ভিত্তি নেই। এ ঐক্য অন্যায় অবৈধ এবং অযৌক্তিক ও অকল্যাণকর। তাই তো স্বয়ং আল্লাহই ভাষাগত ঐক্যের পথকে পরিহার করেছেন। কিন্তু মানবতার ভাষাগত ঐক্য যদি কল্যাণকরই হতো তবে আল্লাহ তার সব কিতাবই এক আরবি ভাষায় নাজিল করতেন এবং কিতাবের মাঝে (আরবি ভাষা) ভাষাগত ঐক্য সৃষ্টি করতেন এবং রাসূলদের কণ্ঠেও আরবি ভাষার ঐক্য সৃষ্টি করতেন।
mahmuda1959@yahoo.com

www.jugantor.com/islam-and-life/2014/02/21/71081#sthash.N50vZUQ3.dpuf

Friday, 21 February 2014

একুশের কবিতা – মহাদেব সাহা


ভিতরমহলে খুব চুনকাম, কৃষ্ণচূড়া
এই তো ফোটার আয়োজন
বাড়িঘর কী রকম যেন তাকে হলুদ অভ্যাসবশে চিনি,
হাওয়া একে তোলপাড় করে বলে, একুশের ঋতু!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার সময় সমস্ত রঙ মনে পড়ে, সূর্যাস্তের
লীন সরলতা
হঠাৎ আমারই জামা সূর্যাস্তের রঙে ছেয়ে যায়,
আর আমার অজ্ঞাতে কারা আর্তনাদ করে ওঠে রক্তাক্ত রক্তিম
বলে তাকে!

আমি পুনরায় আকাশখানিরে চেয়ে দেখি
নক্ষত্রপুঞ্জের মৌনমেলা,
মনে হয় এঁকেবেঁকে উঠে যাবে আমাদের
ছিন্নভিন্ন পরাস্ত জীবন,
অবশেষে বহুদূরে দিগন্তের দিকচিহ্ন মুছে দিয়ে
ডাক দেবে আমরাই জয়ী!

মোদের বাংলা ভাষা

-সুফিয়া কামাল

মোদের দেশের সরল মানুষ
কামার কুমার জেলে চাষা
তাদের তরে সহজ হবে
মোদের বাংলা ভাষা।

বিদেশ হতে বিজাতীয়
নানান কথার ছড়াছড়ি
আর কতকাল দেশের মানুষ
থাকবে বল সহ্য করি।

যারা আছেন সামনে আজও
গুণী, জ্ঞানী, মনীষীরা
আমার দেশের সব মানুষের
এই বেদন বুঝুন তারা।

ভাষার তরে প্রাণ দিল যে
কত মায়ের কোলের ছেলে
তাদের রক্ত-পিছল পথে
এবার যেন মুক্তি মেলে।
সহজ সরল বাংলা ভাষা
সব মানুষের মিটাক আশা।


'আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি...'


ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য আলাওলের ঐতিহ্য

কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য,
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।

আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো
যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে
পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই সব মৃতদের নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।



যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসি দাবি করছি
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।

পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন ছিল
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
তার সাধনা করার,

যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।

যদিও অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ
ঘোষণা করবে।


যদিও ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবু তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।
খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।

কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতাঃ চট্টগ্রাম, ১৯৫২


একুশের কবিতা -- সৈয়দ শামসুল হক 

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল--
তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে

নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল--
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।।

একুশের কবিতা--আল মাহমুদ


ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !


প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।

চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে ?

পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, 
আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।

একুশ রাঙানো প্রভাত 

আকাশের মেরুতে রঙধনু জেগেছে
অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে কেটেছে রাত
পাখির কিচিরমিচির সবই চুপচাপ
ভোরের সূয ভেঙেছে কুসুম
আজ একুশ রাঙানো প্রভাত ।

বাগানের সব ফুল ফুটে সারা
ফুলে ফুলে ভরা শহীদ বেদি
ভাষার মেরুদন্ড দাড়িয়ে স্মৃতিস্তম্ভ
অমর হোক একুশের পদাবলি

ভাষার আকুতি প্রাণের সেজুতি জ্বেলে
দিয়ে গেছে যারা প্রাণ
ধন্য মায়ের সন্তান তারা ভাষার প্রতিদান ।

-জোসেফ আখতার-

একুশ শিরোনাম 



প্রেরণার একুশ তুমি কৃষ্ণচূড়ার ফুল
আত্মত্যাগে পেলাম মোরা মাতৃভাষার কুল,
জীবন নেয়া একুশ তুমি বীর শহীদের স্মৃতি
রক্ত দিয়ে চালু হল বাংলা ভাষার রীতি,

ফেব্রুয়ারির একুশ তুমি অগ্নিঝরা দিন
জীবন দিলেও শোধ হবে না শহীদ ভাইয়ের ঋণ,
নগ্ন পায়ে একুশ তুমি ভোর বিহঙ্গের গান
জীবন দিয়েও রাখবো মোরা মাতৃভাষার মান,
স্মৃতি পাতায় একুশ তুমি রক্তে লেখা নাম
মাতৃভাষার বিজয় আমার একুশ শিরোনাম ।

-জসিম মারুফ-

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী



আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু
গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।।
আমার সোনার দেশের
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।।

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।

সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

-আব্দুল গাফফার চৌধুরী-

Friday, 14 February 2014

চতুর্দশপদী কবিতাবলী 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।


ভালবাসার সময় তো নেই – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ


ভালবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।

ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।

নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।


 আকাঙ্খা 

 তুমি কি আমার আকাশ হবে?
 মেঘ হয়ে যাকে সাজাব
 আমার মনের মত করে ।
 তুমি কি আমার নদী হবে?
 যার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে
 তরী বেশে ভেসে যাব কোন অজানা গন্তব্যের পথে ।
 তুমি কি আমার জোছনা হবে?
 যার মায়াজালে বিভোর হয়ে
 নিজেকে সঁপে দেব সকল বাস্তবতা ভুলে ।
 তুমি কি আমার কবর হবে?
 যেখানে শান্তির শীতল বাতাসে
 বয়ে যাবে আমার চিরনিদ্রার অফুরন্ত প্রহর ।

  - আবুল হাসান-



বসন্তচিত্র 

একজন চিত্রক্রেতার সবিনয় অনুরোধে
আমি আঁকতে বসেছি একটি আমগাছের ছবি—
যে তার দেহচ্ছায়া রামসুন্দর পাঠাগারের
সবুজ টিনের চালের ওপরে বিছিয়ে দিয়েছে।

গাছের সবুজ পাতারা সবইপ্রায় ঢাকা পড়েছে
হালকা হলুদ রঙের অজস্র বোলের আড়ালে।
এত আমের বোল আমি আমার জন্মে দেখিনি।
একটা মদির-গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।
ফুলে ফুলে, ডালে ডালে, পল্লবে পল্লবে
মৌমাছি ও লক্ষ-কোটি কীট-পতঙ্গের ভিড়।
তারা মধুর সমুদ্রে অবগাহনের আনন্দে অস্থির।

বসন্তের ঝড় আর শিলাবৃষ্টির ঝাপটা থেকে
যদি অমৃতফলের এ-মঞ্জরিগুলি বেচে যায়—,
আসন্ন গ্রীষ্ম ও বিষণ্ন বর্ষায়
তবে আর আমাদের আমের অভাব হবে না।

হে বসন্ত, তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো—
আমি তোমাকে আমার পরান ভরিয়া আঁকি।

নির্মলেন্দু গুণ-


কল্যাণী


শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়েছ জোছনায়,
রাঙা অনুরাগ ছড়ায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়!
কার আঙিনার ধূলি রাঙা হল চুমি ওই পদতল,
কারে দিলে তুমি সুশীতল ছায়া প্রসারিয়া অঞ্চল!

তুমি আকাশের চাঁদ হয়েছিলে, কাহার ফুলের শরে,
বিদ্ধ হইয়া হে নভচারিনী নেমেছ মাটির ঘরে!
কোন্ সে তমাল মেঘের মায়ায় ওগো বিদ্যুৎলতা!
ভুলিলে আজিকে বিরামবিহীন গতির চঞ্চলতা।

চির সুদূরিকা! কহ কহ তুমি, কাহার বাঁশীর সুরে
গ্রহতারকার অনাহত বাণী আনিয়াছ দেহপুরে।
সে কি জানিয়াছে যুগান্তপারে মহামন্থর শেষে,
নীলাম্বুদির তরঙ্গ পরে লক্ষ্মী দাঁড়াল এসে!
সে কি জানিয়াছে, মানস-সরের রাঙা মরালীর বায়,
সন্ধ্যা-সকাল এক দেহ ধরি দাঁড়ায়েছে নিরালায়!

ওগো কল্যাণী! কহ কহ মোরে, সে কি জানিয়াছে হায়!
ও ইন্দ্রধনু তনুখানি তব জড়াতে শ্যামল গায়,
তপস্যা-রত জল-ভরা মেঘ গগনে গগনে ঘোরে,
কামনা-যজ্ঞে লেলিহা বহ্নি মহাবিদ্যুতে পোড়ে!
সে কি জানিয়াছে, বাণীর ভ্রমরী ও অধর ফুল হতে
উড়িয়া আসিয়া হিয়ারে যে বেড়ে চিরজনমের ক্ষতে!
সে কি শিখিয়াছে, বাসক শয়নে ওই তনুদীপ জ্বালি
পতঙ্গ সম প্রতি পলে পলে আপনারে দিতে ঢালি!
ও অধর ভরা লাল পেয়ালার দ্রাক্ষারসের তরে,
জায়নামাজের বেচিয়াছে পাটি সুরা-বিক্রেতা ঘরে!
সে কি জপিয়ায়ে ওই নাম তব তবসী-মালার সনে,
সে কি ও নামের কোরান লিখিয়া পড়িয়াছে মনে মনে!

ওগো কল্যাণী! কহ কহ তুমি কেবা দরবেশ,
তোমার লাগিয়া মন-মোমবাতি পুড়ায়ে করিল শেষ!
কত বড় তার প্রসারিত বুক, আকাশে যে নাহি ধরে,
সেই বিদ্যুৎ বিহ্নরে আনি লুকাল বুকের ঘরে!

জসীম উদ্‌দীন-

তাহারেই পড়ে মনে


“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।”

কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”

কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”

“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”

- সুফিয়া কামাল-

Thursday, 13 February 2014


বসন্ত বন্দনা


হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সঙ্গীতে যতো আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে । আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা,--দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক ।

এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরণ,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায় । হায় কী আনন্দ জাগানিয়া ।

এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,
যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য ।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্য খানি
নবীন পল্ববে, ফুলে ফুলে । বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে ।

আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরুপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার ।

নির্মলেন্দু গুণ--

ভালোবাসা সীমিত করা অপরাধ


আগামীকাল ১৪ ফেব্র“য়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব নিয়ামত। সৃষ্টিকুলকে সজীব করে রাখার এ এক সঞ্জীবনী শক্তি। ভালোবাসা না থাকলে এ জগৎ সংসার টিকে থাকত না। সৃষ্টির আদিকাল থেকে ভালোবাসাই সৃষ্টিকুলকে প্রাণময় ও উপভোগ্য করে রেখেছে। মানুষকে করে রেখেছে উদ্দীপ্ত ও স্বপ্নময়। ভালোবাসার বন্ধন সিমেন্টের মতো সমাজবাসীর পারস্পরিক বন্ধন ও সম্পর্ককে অটুট করে রাখে। সব প্রাণীর মধ্যেই ভালোবাসার উপস্থিতি সক্রিয়। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা না থাকলে হয়তো মানুষ হিংস রোবটে পরিণত হতো। পৃথিবীকে বাসযোগ্য, শান্তিময় ও স্বপ্নময় করার ক্ষেত্রে ভালোবাসার অবদান অনস্বীকার্য।

ভালোবাসা এক ধরনের সহজাত মানবীয় গুণ। জন্মগতভাবে মানুষ এ গুণাবলী অর্জন, লালন ও ধারণ করে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়, ভালোবাসার গুণাবলী অর্জনে তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। ভালোবাসার বিশ্বখ্যাত আইকনরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভালোবাসা শেখেননি। লায়লী-মজনু, শিরী-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা বা রোমিও-জুলিয়েটকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা প্রশিক্ষণ একাডেমিতে গিয়ে ভালোবাসা শিখতে হয়নি। কাজেই অনুষ্ঠান করে নিজেকে অধিক ভালোবাসা-সমৃদ্ধ করা যায় মনে করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। সৃষ্টির আদিকাল থেকে ভালোবাসা পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সহজাতভাবে সক্রিয় ও প্রবাহমান রয়েছে। নাচ-গান বা অভিনয় শেখানোর মতো ভালোবাসা শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠান বা প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়ে ওঠেনি। পাশ্চাত্য জনশ্র“তি অনুযায়ী জাজক ভ্যালেন্টাইন ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ভালোবাসার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রোম সম্রাট কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় ১৪ ফেব্র“য়ারি দিনটিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রায় সোয়া যুগ হল বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমিত আকারে এ দিবসটির পালন শুরু হয়েছে।
ভালোবাসা দিবস পালিত না হওয়া দেশগুলোর নাগরিকরা যে ভালোবাসায় দরিদ্র, এমন নয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ভালোবাসা দিবস পালন করে ওইসব দেশের নাগরিকরা অধিক ভালোবাসাপ্রবণ হতে পেরেছেন মনে করলে ভুল হবে। স্মর্তব্য, এ উপমহাদেশে যখন ভালোবাসা দিবস পালিত হতো না, তখন এ অঞ্চলের দেশগুলোতে ভালোবাসার মোটেও ঘাটতি ছিল না। অসুস্থ মায়ের চিঠি পেয়ে মায়ের ভালোবাসার টানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিপজ্জনক জেনেও বর্ষার খরস্রোতা নদী সাঁতরে মাকে দেখতে গিয়েছিলেন। শত শত বছর আগে থেকে ভালোবাসা দিবস পালনকারী ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিকরা তাদের মাকে আমাদের মতোই গভীরভাবে ভালোবাসলেও মায়ের ভালোবাসার টানে তাদের কারও টেমস বা মিসিসিপি নদী সাঁতার কেটে পার হওয়ার ঘটনা আমাদের জানা নেই।
এ উপমহাদেশে ভালোবাসা দিবস পালন শুরু হলে প্রথম দিকে সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকে এর বিরোধিতা করেছিলেন। ভারতে ২০০৩ সালে শিবসেনার হুমকিতে মুম্বাই ও দিল্লির দোকানিরা ভ্যালেন্টাইন কার্ড বিক্রি করতে পারেননি। ওই বছর ১৩ ফেব্র“য়ারি ভালোবাসা দিবসকে ‘খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ’ হিসেবে প্রচার করে শিবসেনার সদস্যরা ভ্যালেন্টাইন কার্ড বিক্রি করায় দিল্লির দুটি দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতবাসীকে এ দিবস পালন না করতে আহ্বান জানিয়েছিল। ঢাকায় সংস্কৃতি ফোরাম ২০০২ সালে ‘অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই’ থিম সংবলিত পোস্টার প্রকাশ করেছিল। একই বছর জাতীয় মসজিদের খতিব সাহেব ‘মুসলমানদের অনুষ্ঠান নয়’ এমন ব্যাখ্যা করে ভালোবাসা দিবস পালন থেকে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য মোনাজাত করেছিলেন। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সীমিত আকারে প্রথমে ভালোবাসা দিবস পালন শুরু করলেও বাংলাদেশে পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে শহরাঞ্চলের শিক্ষিত সমাজ এবং তরুণ ও যুব সমাজের অনেককে এ দিবস পালন করতে দেখা যাচ্ছে। দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ লেখাসহ শহুরে সমাজে ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে।
ভালোবাসা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ভালোবাসার বিস্তারিত পরিধি ও এর বহুমাত্রিকতাকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। স্মরণ রাখা ভালো, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিটি সম্পর্কই ভালোবাসার উষ্ণতা ও শক্তির ওপর টিকে আছে। ভালোবাসায় ফাটল ধরলে এসব সম্পর্ক ধরে রাখা যায় না। মায়ের সঙ্গে সন্তানের, পিতার সঙ্গে পুত্রের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, ভাইয়ের সঙ্গে বোনের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের, গুরুর সঙ্গে শিষ্যের, আদর্শের সঙ্গে বিপ্লবীর, শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর, ধর্মের সঙ্গে ধার্মিকের, ফুল বাগানের সঙ্গে মালীর, শিল্পকর্মের সঙ্গে শিল্পীর- এমন সব সামাজিক সম্পর্কই ভালোবাসার বন্ধনে অটুট হয়ে আছে। ভালোবাসার উষ্ণতাই এসব সম্পর্ককে সজীব ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, যারা ভালোবাসা দিবস পালন করছেন, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা, তারা তাদের ভালোবাসাকে ভ্যালেন্টাইন ডে-তে কেবল ভ্যালেন্টাইন কার্ড ও পুষ্প বিনিময়ের মধ্যে সীমিত করে ফেলেছে। ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণকারী বয়স্করাও তাদের যুব বয়সের প্রেম-ভালোবাসার আবেগপ্রবণ রসালো গল্পের স্মৃতিচারণ করছেন। এর ফলে যেসব এলাকায় ভালোবাসার চর্চা তুলনামূলকভাবে কম, ওইসব এলাকার নাগরিকরা ভালোবাসার শক্তিজাত মুনাফা লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ কারণে দেশের সব শ্রেণীর সাধারণ মানুষ ভালোবাসা দিবস পালনে আকৃষ্ট হচ্ছেন না। পরিবর্তে, এ দিবসটি শহরাঞ্চলের স্বচ্ছল তরুণ-তরুণীর মধ্যেই অধিক মাত্রায় পালিত হতে দেখা যাচ্ছে।
ভালোবাসা দিবস পালনকারী দেশগুলো যদি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভালোবাসার চর্চা করত তাহলে কি পৃথিবীর চেহারা আরও প্রাণময় হয়ে উঠত না? তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র দেশগুলোর দিকে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলো একটুখানি ভালোবাসার দৃষ্টিতে সহযোগিতার হাত বাড়ালে গরিব-দুঃখী মানুষের জীবন কিছুটা হলেও স্বস্তিময় হতে উঠত। বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যদি তুলনামূলকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি শোষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করার চিন্তা থেকে বেরিয়ে ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে ওই দেশগুলোকে স্বচ্ছল হতে সহযোগিতা করত, তাহলে পৃথিবীর আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য অনেকটাই হ্রাস পেত। উন্নত দেশগুলোর ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভালোবাসা দিবস পালনকারী শিক্ষিত সুশীল সমাজের মানুষদের এসব বিষয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। তাদের উচিত ভালোবাসাকে বিশ্ব মানবতার জন্য কল্যাণকারী টনিক হিসেবে কার্যকর ও প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন পরিকল্পনা ও গঠনমূলক আঙ্গিকে ভালোবাসা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠান সাজানো।
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসকে একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করতে হলে এ দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজকদের উন্নত দেশগুলোর আদলে আলোচ্য দিবস পালন না করে স্বদেশী বাস্তবতা ও গণমানুষের সংস্কৃতি বিবেচনায় নিয়ে এ দিবস পালনের আয়োজন পরিকল্পনা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রেম-ভালোবাসার স্মৃতিজাগানিয়া গল্প আর পারস্পরিক উপহার ও পুষ্প বিনিময়ের মধ্যে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠান সীমিত না রেখে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে এ অনুষ্ঠানে আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে শ্রমিকের প্রতি মালিকের ভালোবাসা জাগ্রত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এ প্রক্রিয়ায় রাজধানীর একটি ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে একজন গার্মেন্ট মালিক-শিল্পপতিকে সসম্মানে প্রধান অতিথি করে ওই অনুষ্ঠানে তার গার্মেন্টে কর্মরত শ্রমিদেরও দাওয়াত দিয়ে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে পুষ্প বিনিময় করিয়ে সম্মানিত শিল্পপতিকে দিয়ে যদি শ্রমিকদের ওপর তার ভালোবাসার নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সামান্য পরিমাণে মাসিক মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ানো যায়- তাহলে শ্রমিক সমাজ এরকম অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে ভালোবাসার শক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব হ্রাস পেয়ে ওই সম্পর্ক মিত্রতাপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনীতি ও রুগ্ণ গণতন্ত্রের উন্নয়নে ভালোবাসার শক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ কোথায়? এ দেশের রাজনীতিতে যেহেতু পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসা খুবই সক্রিয়, সে কারণে এহেন রাজনীতিকে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে ভালোবাসার উষ্ণতাকে ব্যবহার করতে অসুবিধা কোথায়? জাতীয় রাজনীতিতে দুটি বড় দলের দুই প্রধান নেতার মধ্যে অনেকটা এলার্জিক সম্পর্ক বিরাজ করছে। তারা একে অপরের মুখ দেখেন না, পরস্পরের সঙ্গে বাধ্য না হলে কথাও বলতে চান না। জাতীয় সংকটে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন না। বড় দলগুলোর অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যকার সম্পর্কও সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। এখানে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে কোণঠাসা ও পর্যুদস্ত করতে এবং বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নিজেরা ক্ষমতায় যেতে চায়। অথচ গণতন্ত্রকে অর্থবহ করার জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ভালোবাসার সম্পর্ক। কাজেই ভালোবাসা দিবসের আয়োজকদের উচিত রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সুস্থতার লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভালোবাসার সঞ্জীবনী টনিক ব্যবহার করে এ ক্ষেত্রে সুস্থতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে ভালোবাসা দিবসের কোনো একটি অনুষ্ঠানে আয়োজকরা দেশের দুই প্রধান নেতাকে অতিথি করে তাদের মধ্যে পুষ্প বিনিময় করাতে পারলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিহিংসার মাত্রা কমানো সম্ভব হতো। এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন বিবদমান সংগঠনের নেতাদের মধ্যে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন, মাল্য ও পুষ্প বিনিময় সম্পন্ন করে গণমাধ্যমে সেসবের প্রচার করাতে পারলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত হ্রাস পেত। এমন গঠনমূলক চিন্তা না করে ভালোবাসা দিবসের সম্মানিত আয়োজকরা ভালোবাসার বহুমাত্রিকতা উপেক্ষা করে কেবল তরুণ-তরুণীদের চলমান বাক-বাকুম প্রেমে উষ্ণতা সঞ্চারের উদ্যোগ নিয়ে এ দিবস পালন করে ভালোবাসার মতো একটি সম্ভাবনাময় শক্তিকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে কেবল শহরাঞ্চলের সচ্ছল পরিবারের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সীমিত করে ফেলছেন। এভাবে ভালোবাসার বহুমাত্রিক ব্যবহার উপেক্ষা করে কেবল একটি এলাকায় এ শক্তির ব্যবহার সীমিত করা আহাম্মকি ও অপরাধ। ভালোবাসা দিবস উদযাপনে এমন উদাহরণ সৃষ্টি করা উচিত, যার মধ্য দিয়ে মানুষ সমাজের সব ক্ষেত্রে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে, ভালোবাসার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘৃণা, প্রতিহিংসা, অন্ধকার ও অসুস্থতা দূর করতে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীকে অধিকতর সুস্থ, সুন্দর, প্রাণবন্ত, মানবিক ও ভালোবাসাময় করে
তুলতে পারেন।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

Thursday, 6 February 2014


স্বরচিত নির্জনতা

স্বরচিত নির্জনতা, সযত্ন-সৃজিত নির্জনতা
তুমি আছ পার্শ্ববর্তী,কী অপুর্ব সুখ।
বাইরে ভুলের হাওয়া বইছে বহুক।
পল্লবেরা মরে শুধু পল্লবেরা অবেলায় ঝরে
পল্লবেরা কাঁপে গায়ে হতাশার জর
বনস’লী ভুলে গেছে নিজস্ব মর্মর।

আদিম চীৎকার তুলে
কাপালিক মগ্ন মন্ত্র পাঠে
অশ্রুধ্বনি নাভীমূলে
অবনত শোকে যারা হাঁটে।

কেউ যদি চায়
বিশ্বটাকে কিনে নেবে এক ভাঁড় বিশৃঙ্খলতায়,
ভাবে তো ভাবুক।
স্বরচিত নির্জনতা,সযত্ন-সৃজিত নির্জনতা
তুমি থাকো পার্শ্ববর্তী স্বর্গে ভরি
শূন্যের সিন্দুক।

পূর্ণেন্দু পত্রী-