Monday, 24 February 2014

সৃষ্টিলগ্নে ছিল ইলহামি ভাষা

মাহমুদ আহমদ সুমন
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
প্রত্যেক জাতির কাছে মাতৃভাষার মর্যাদা অপরিসীম। পবিত্র কোরআন পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে যত নবী রাসূলের আগমন ঘটেছে তারা সবাই নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই আল্লাহপাকের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছাতেন। এ ছাড়া পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সব ভাষাই আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা। সব জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গম্বর এসেছেন, তেমনি সব জাতির স্ব-স্ব ভাষাতেই আল্লাহতায়ালার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমাদের কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে (সূরা ইবরাহিম : ৪)। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সঙ্গে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আল্লাহপাক বলেন, আর তার নিদর্শনাবলীর মাঝে রয়েছে আকাশগুলোর ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতাও। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে (সূরা আর রূম : ২২)। ভাষা ও রঙের এ বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব জড়িত। আকাশ-মালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি। বর্ণের ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। কিন্তু তবুও এ বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। আর মানবতার এ ঐক্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সৃষ্টিকর্তাও একজনই। মানবজাতির সূচনালগ্নে ভাষা ছিল একটিই এবং তা ছিল ইলহামি ভাষা। এরপর মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে এলাকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবেই সূচনাতে মানুষের রংও ছিল একই রকম। এরপর গ্রীষ্ম, শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুযায়ী তার রঙেরও পরিবর্তন হতে থাকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্র“য়ারি অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি মাস। ১৯৫২ সালের এ মাসের ২১ তারিখে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই এ দাবিতে বাঙালিরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন পাকিস্তানিরা তার জবাব দিয়েছিল বুলেটের মাধ্যমে। বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। সেই রক্তের ছোঁয়া পেয়ে আশ্চর্য দ্রুততায় গোটা জাতি জেগে উঠেছিল তার শেকড়ের টানে। পাকিস্তানিদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোনো বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই।
বাংলা আমাদের দেশমাতৃকা বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে অবদান। আজ আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে যায়, পৃথিবীর সব দেশের জনগণ প্রতিবছর এ নদী বিধৌত পলি মাটির মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক সমর্থনে সাধারণ মানুষ কতটা নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক হতে পারে এবং কতটা আত্মত্যাগী হতে পারে এ বিষয়ে জানছে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত হারানো শাশ্বত এ বাঙালির রক্তের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ, আজ পরম শ্রদ্ধার দেদীপ্যমান সারা বিশ্বের জনগণের কাছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হজরত মূসা (আ.)-এর প্রতি তাওরাত হিব্র“ ভাষায়, হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ইঞ্জিল সুরিয়ানি ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি যাবুর ইউনানি ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর প্রতি আল কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়। হজরত রাসূল করিম (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তার কাছে মানবজাতির দিশারী এবং সৎ পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। এ ঐশী ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি। বিশ্ব নবীর মাতৃভাষায় পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ঘোষাণা করেছেন, নিশ্চয় আমরা এ কোরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তা দিয়ে মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহকারী জাতিকে সতর্ক করতে পার (সূরা মরিয়ম : ৯৭)। আরও বলা হয়েছে, আর এর পূর্বে মূসার কিতাব ছিল এক পথপ্রদর্শক ও কৃপা। আর এ কোরআন হল প্রাঞ্জল ও সমৃদ্ধ ভাষায় এক সত্যায়নকারী কিতাব যে তা জালেমদের সতর্ক করে এবং সৎকর্মপরায়ণদের সুসংবাদ দেয় (সূরা আহকাফ : ১২)। তাই আমরা বলতে পারি কোনো ভাষা অপবিত্র নয় বরং সব ভাষাই ঐশী ভাষা।
মহান অল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নিজ মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে দিক আর আজকের দিনে বাঙালি সংস্কৃতির নামে যে বেহায়াপনা করা হচ্ছে তা থেকে আমাদের রক্ষা করুক। গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেসব বীর শহীদ ও বীর সৈনিকদের যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন। আমরা যেন আমাদের লেখায়, কথায়, চলনে-বলনে মাতৃভাষাকে আরও বেশি করে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি আর আল্লাহপাকের এ বিশেষ দান সব ভাষাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তার তওফিক
দান করুন।
www.jugantor.com/islam-and-life/2014/02/21/71078#sthash.NxtD9ezK.dpuf