Wednesday, 10 December 2014




সত্যিকার এক দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা। যেখানে আছে শুধুই আত্মকেন্দ্রিকতা। স্বার্থপরতা। ব্যক্তিতান্ত্রিকতা। ছোট মন নিয়ে কখনও একটি জাতি বড় হতে পারে না। আমাদের লড়াইটাও যেন এমনই। এক অসম সংগ্রাম। যেখানে মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই। সম্পর্ক যেখানে আজ ঠুনকো। মানবিকতা যেখানে হাস্যকর পরিহাসের বিষয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের প্রাক্কালে এই কথাটি মস্তিষ্কে বার বার ফিরে আসছে। গত ২৯শে নভেম্বর সন্ধ্যায় বাসের ধাক্কায় নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন খ্যাতিমান সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী। দুঃখজনক হচ্ছে, মানুষটি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ অনেকটা সময় রাস্তায় কাতরেছেন। হয়তো দ্রুততম সময়ে সঠিক চিকিৎসা দেয়া হলে এভাবে আমরা হারাতাম না তাকে। নাগরিক জীবনের ছুটে চলা মানুষগুলো জগলুল ভাইয়ের অসহায় মুহূর্তে তাৎক্ষণিক এগিয়ে আসেনি। হাজারো মানুষের ভিড়ে যে দুই যুবক ওনাকে হাসপাতালে নিলেন। দেখা গেল সেই হাসপাতালটি ভুয়া; যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকরা পরবর্তীতে সিলগালা করেছেন। কিন্তু কি আশ্চর্য এই মোহনা নামক ক্লিনিকটি বন্ধের জন্য জগ্‌লুল আহমেদ চৌধূরীকে জীবন দিতে হলো। যদি জগ্‌লুল ভাই না হয়ে অন্য কোনও এক ব্যক্তি একই কায়দায় দুর্ঘটনা আক্রান্ত হয়ে এই মোহনায় হাতুড়ে চিকিৎসার কবলে পড়ে মরতেন, তাহলে হয়তো মোহনা তাদের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকরা এতদিন যেভাবে ঘুমিয়েছিলেন হয়তো এখনও তাই করতেন। এরপর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে এক ক্লিনিকের সন্ধান মিলেছে, যেখানে ডাক্তার, নার্স সবই ভুয়া। এই শহরের বুকে বসে নিরাপদে তারা অবৈধভাবে চিকিৎসার কারবার করে যাচ্ছে। যারা এই অনৈতিক পেশায় হাজারো মানুষের জীবন নষ্ট করছে, তাদের শাস্তি রাষ্ট্র কবে নিশ্চিত করবে? সেলুকাস, কি বিচিত্র আমাদের দেশ। যখন মিশুক মুনির আর তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা পড়েন তখন দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাস্তায় নামে নাগরিক সমাজ। কিন্তু এই যে অগণিত লাশের মিছিল চলছে প্রতিদিন দুর্ঘটনায়, তাতে কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই রাষ্ট্রের। আরও কিভাবে এই হত্যার দায়ে কাঠগড়ায় না গিয়ে আমাদের সম্মানিত চালকরা দায়মুক্তি পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতেই বদ্ধপরিকর রাষ্ট্র। দুনিয়াজুড়ে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে আজ। কিন্তু আমাদের এখানে ন্যূনতম মানবিকতাও দেখা যাচ্ছে না। গুম, খুনতো স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত। গত ক’দিনে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা খুবই পীড়া দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা আমাদের নাগরিকদের বাঁচার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। ৪ঠা ডিসেম্বরের একটি খবর হঠাৎ করেই সংবাদ কক্ষে হইচই ফেলে দেয়। ঢাকা মেডিক্যালে মৃত রোগীর নড়াচড়া। তা-ও আবার ডেথ ঘোষণার তিন ঘণ্টা পর, যখন ডোম লাশঘরে তা ব্যবচ্ছেদ করতে আনতে যান, সে সময়ের ঘটনা এটি। সেদিন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নিলুফার রোগীর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন না করেই ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। কি আজব দেশ হলে এখনও নীরবে এই নিয়ে সবাই কথ বলছি। নামকাওয়াস্তে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে দায়িত্বও সেরেছি। অথচ এ দেশের দেশপ্রেমিক জনদরদি রাজনীতিক আর নাগরিক সমাজ এ নিয়ে একটি  বাক্যও ব্যয় করলেন না। হয়তো সবাই ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। না হলে এক নারী পুষ্টিহীনতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে, ঢাকা মেডিক্যালে প্রবেশপথে পড়ে থাকা অবস্থায় হাসপাতালের পরিচালককে কেন চিকিৎসা প্রদানের নির্দেশ দিতে হবে? যেখানে সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক অধিকার অনুযায়ী এই নারীর চিকিৎসা পাওয়ার কথা। এ তো গেল সংবিধানের কথা। কিন্তু পরিচালকের নির্দেশে যেখানে ভাল চিকিৎসা পাওয়ার কথা সেখানে ঘটলো উল্টোটি। তাকে কোনও চিকিৎসা না দিয়েই ডেথ ঘোষণা করা হলো। পত্রিকার খবরে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল ৪৫ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক নারীকে। মৃত্যুর প্রমাণপত্রও (ডেথ সার্টিফিকেট) ইস্যু করা হয়েছিল তার নামে। কিন্তু ঘণ্টা তিনেক পর মর্গের দায়িত্বে থাকা ডোম যখন ওই নারীর লাশ নিতে গেলেন, তখনই ঘটে বিপত্তি। নড়ে উঠলো মৃতদেহটি। চিৎকার করে উঠলেন ডোম। খবর দেয়া হলো চিকিৎসককে। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন ওই নারীর হৃৎস্পন্দন রয়েছে। শুরু হলো নতুন করে চিকিৎসা। ঢাকা মেডিক্যালের নতুন ভবনের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে। গত মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় এক নারীকে সেখানে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর নির্দেশ দেন অধস্তন কর্মকর্তাদের। অজ্ঞাত নারী হিসেবে তাকে ভর্তি করা হয় ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ নম্বর ইউনিটে। অপুষ্টির কারণে ওই নারী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। চলমান চিকিৎসার এক পর্যায়ে গতকাল দুপুর ২টার দিকে ওই নারীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা একজন নারী চিকিৎসক। ওই মহিলার নামে একটি ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। ওয়ার্ডবয় বেলাল সেই ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে যান মর্গের অফিসে। মর্গের দায়িত্বে থাকা নূর আলম বাবু লাশটি আনার জন্য তার সহকারী আজিজকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে পাঠান। বেলালকে সঙ্গে নিয়ে ডোম আজিজ বিকাল ৫টার দিকে ওয়ার্ড থেকে ওই নারীর লাশ আনতে যান। মৃতদেহটি ট্রলিতে তোলার সময় আজিজ খেয়াল করেন তার হাত-পা নড়ছে। মৃতদেহের নড়ে ওঠা দেখে চিৎকার করে ওঠেন আজিজ। পুরো ওয়ার্ডে এ সময় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। তার পরের ঘটনাতো সকলেরই জানা। এ প্রতিবেদন পড়ে বিমর্ষ কাল কাটছে। বৃদ্ধাকে শেষ বেলায় বেওয়ারিশ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো হলো। আমরা প্রতিনিয়ত বড় বড় কথা বলি। কিন্তু কাজের বেলায় ঠিক তার উল্টো। একটি জাতির কতটা ধৈর্য শক্তি থাকলে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলা আর খামখেয়ালিকে নীরবে মেনে নিয়েছে দেশবাসী। জনগণের করের টাকায় যে হাসপাতাল পরিচালিত হয় তা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। গত চার দশকের সংবাদপত্র ঘাঁটলেই অসংখ্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট বেরিয়ে আসবে ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে। কি দুর্ভাগা জাতি আমরা। আমাদের এ বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় আছে। আছেন একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক যিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পত্রিকার খবরে দেখা যায়, তিনি একটি দলের নেতা, তাই জেলায় জেলায় সম্মেলনে ছুটে যেতে হচ্ছে ওনাকে। ষোল কোটি মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে এত যে তুঘলকি কারবার চলছে তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট সময় কি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের আছে? ঢাকা মেডিক্যালে নিজে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখেছি কিভাবে দালালরা পিছু নেয় রোগীদের। আর স্যালাইন, ইনজেকশন রোগীর দেহে পুশ করছে ওয়ার্ডবয়রা। করিডরের বাইরে সবসময় পড়ে থাকছে রোগীর দল। মাছি ভনভন করছে। আইসিইউ বা সিসিইউ বলে যে ওয়ার্ড আছে, তাতে বেশির ভাগ সময়ই প্রয়োজনীয় রোগীদের নেয়ার আগে পরপারে চলে যান। অনেকের সিটই মেলে না, আর যদিও বা মেলে তা-ও অবৈধ লেনদেনে।  দুর্ভাগ্য সেই বৃদ্ধার। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে তিনি চিকিৎসা না পেয়ে, খাদ্য না পেয়ে জীবন দিয়েছেন। তা-ও আবার বেঁচে থাকা অবস্থাতেই আরেক চিকিৎসক ওই বৃদ্ধার মৃত্যুর সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করে দায়িত্ব সেরেছেন। প্রথম দফায় হাসপাতালে নেয়ার পর অবহেলায় আরও অবনতি ঘটে রোগীর আর দ্বিতীয় দফায় যখন লাশঘর থেকে ফিরিয়ে আনা হলো তখনও তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়নি। বলাবলি আছে, নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে এই বৃদ্ধাকে চিকিৎসা দেয়া হলে হয়তো এই মানুষটি আরও কিছুদিন পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় বেঁচে থাকতেন। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ, সহানূভূতিপ্রবণা ও সেবামূলক মানসিকতার এতটাই অবনতি ঘটেছে, যেখানে মানুষকে এখনও অযত্নে-অবহেলায় মরতে হচ্ছে। অথচ এই সেদিনই আমাদের প্রেসিডেন্ট সিনিয়র সিটিজেন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।


শেষ করতে চাই কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ উপন্যাসের কিছু অংশ উদ্ধৃত করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষত-বিক্ষত ইরাবতি অঞ্চলের এক রেলস্টেশনে পথ চলতে গিয়ে চোখে পড়লো একটি খণ্ডিত হাত রাস্তায় পড়ে আছে। হাতটি নিয়ে কৃষণ চন্দর লিখছেন, কেবল একটি মাত্র বাহু, একটি মাত্র হাত, সে হাত খোলা, আকাশের দিকে ছড়ানো অঙ্গুলি। এই হাত হয়তো কখনও হালচাষ করেছে, কখনও হয়তো ডাণ্ডাগুলি খেলেছে, কখনও কারও কোমর বেষ্টন করেছে, কখনও হয়তো আদর করে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়েছে... এই হাত হয়তো পুল বানিয়েছে, ইমারত তৈরি করেছে, ফুলের গাছ রোপণ করেছে, প্রিয়তমার গালে এই হাত সোহাগের স্পর্শ দিয়েছে আর ভবিষ্যৎ জীবনের সোনালি ছবি এঁকেছে। আলোকচিত্রীর তোলা নামহীন ওই বৃদ্ধার মুখাবয়ব এভাবেই অনেক না বলা কথা নিয়েই চলে গেছেন। অনেক স্বপ্ন আর সাধের চাপা মৃত্যু ঘটেছে এভাবেই।

@ কাজল ঘোষ | ১০ ডিসেম্বর ২০১৪, বুধবার