এরপরও পবিত্র ইসলামের নামে এহেন জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো হল। নিষ্পাপ, নিরপরাধ শিশুদের হত্যা করা হল। এই হত্যার পিপাসা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ধারার মধ্যেও আছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মনে পড়ল। এ ভাষণের প্রথমেই তিনি বলেছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। তারপর আবার বলেছেন, আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কীভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।পাকিস্তানের জঙ্গি তালেবানরা জিঘাংসাপরায়ণ হয়ে শতাধিক শিশুকে হত্যা করে মায়ের কোল খালি করে দিয়েছে। ওই সন্তানহারা মায়েরা এখন পাকিস্তানের মাটিতে বুক চাপড়াচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না মনীষী বার্নাড শর কথাটি, ঈশ্বর যার আকাশে তার সম্পর্কে সাবধান। সে হয় নিষ্ঠুর। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে ইসলামের পতাকা ব্যবহারকারী জঙ্গিরা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জনপদে শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহারকারী জঙ্গিরা মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, বুকের তাজা রক্ত ঝরাচ্ছে, মায়ের কোল খালি করছে। বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছেন, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। একই কথা অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁও বলেছেন, মানুষের জন্যই ধর্ম। বাঙালি মুসলমান লেখকরা কম ইহজাগতিকতার কথা বলেননি। আজ এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গি, জেএমবি, তালেবান ও মওদুদীপন্থীরা ইসলামের সেবক নন। জঙ্গিবাদের সঙ্গে ইহজাগতিকতার যে সম্পর্ক, পারলৌকিকতার সে সম্পর্ক নেই। আজকাল জঙ্গিরা তাদের টার্গেট পূরণ করার জন্য আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে কোটি কোটি ডলারের মাফিয়া ব্যবসা জড়িত। যেখানে ইসলামের ইতিহাসে সগৌরবে বলা হয়েছে, তরবারির দ্বারা ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেখানে জঙ্গিরা স্বধর্মী ভিন্ন মতাবলম্বীর ওপর তরবারি প্রয়োগ করছে। ইসলামে যেখানে গণতন্ত্রের কথা, সহিষ্ণুতার কথা, ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে, সেখানে জঙ্গিরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেজীবন কেড়ে নিতে দ্বিধাবোধকরছে না।এই জঙ্গিবাদ, এই নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসেও আছে। মূলত ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ার হয়। ইসলামের ইতিহাসে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একজন নিষ্ঠুরতম শাসক ছিলেন। এই নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিলেন তিনি স্বধর্মী প্রতিপক্ষের ওপর। পবিত্র ইসলামের নামে অধর্ম কম হয়নি। কবর থেকে হাড়গোড় উঠিয়ে আগুন দিয়ে জ্বালানোর জিঘাংসামূলক ইতিহাসও আছে। ভারতের সুলতান ও মোগল ইতিহাস নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ। ধর্মীয় মূল্যবোধ সেখানে কোনো কাজে লাগেনি।জঙ্গিরা এক ধরনের কাপুরুষও। আমেরিকার টুইন টাওয়ার যারা ধ্বংস করেছে, তাদের কাপুরুষ ছাড়া আর কী বলা যায়? কোনো অপশক্তির মুখোমুখি হওয়ার সৎ সাহস তাদের নেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ইসরাইলি জায়নবাদ- কোন অপশক্তিকে এরা মোকাবেলা করার সৎ সাহস রাখে? টুইন টাওয়ারে যারা জীবন দিয়েছিল, তারা অত্যন্ত অসহায় মানুষ ছিল। তারা ছিল নিরস্ত্র। তাদের কী দোষ ছিল? তদ্রুপ ইসরাইলি জায়নবাদীরা নিরীহ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লাগাতারভাবে হত্যা করে যাচ্ছে। পারলে ইসলামী জঙ্গিরা আসুক না ফিলিস্তিনিদের বাঁচানোর জন্য!মালালা ইউসুফ জাই তো বয়সে কিশোরী। তাকে কেন হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল তালেবানরা? কী দোষ ছিল তার? জঙ্গিবাদের সঙ্গে বিবেকের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, যদি থাকত তাহলে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে তারা হত্যা করতে পারত না। তিনি তো পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মান্ধ, সেনাশাসিত রাষ্ট্রে গণতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নেই, তা বর্বর রাষ্ট্র হতে বাধ্য। জঙ্গিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার জন্য গোপনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। তারা বাংলাদেশকেও পাকিস্তানের ওয়ারিজিস্তানে পরিণত করতে চায়। বাংলাদেশেও শিশুরা জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। শিশুরা কি ফুলের মতো পবিত্র নয়? আল্লাহর রাসূল কি ফুলের গুরুত্ব দেননি? তিনি কি বলেননি, জোটে যদি মোটে দুটি পয়সা, ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী? তাহলে কেমন করে পেট্রোল বোমা মেরে জঙ্গিরা চলন্ত বাসের নারী ও শিশু যাত্রীদের অগ্নিদগ্ধ করতে পারল?পাকিস্তানের পেশোয়ারের তালেবানরা শিশু শিক্ষার্থীদের হত্যা করে যে পাশবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তার নিন্দা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছে বিশ্বের সব সভ্য মানুষ। পৃথিবীতে সব শিশুই এক, তাদের মুখের হাসি এক, চোখের পানি এক, তাদের আর্তনাদ এক, অসহায়ত্ব এক। তারা বিশ্ব নাগরিক, বিশ্বের সম্ভাবনাময় ফলবান বৃক্ষ। কে বলবে যারা পেশোয়ারে অকালে ঝরে গেল, তাদের মধ্যে মহামানবের প্রতিচ্ছায়া নেই?মহামতি মার্কসের একটি স্বপ্ন যেভাবেই হোক পূরণ হচ্ছে; তা হল, বিশ্ব আজ একটি মহারাষ্ট্র। তাই পেশোয়ারের ঝরে পড়া শিশুরা আমাদের সবার অস্তিত্ব নিংড়ানো সন্তান।এই জঘন্য জঙ্গি-পশুদের দমন করার জন্য বিশ্ববাসীকে গণতন্ত্রের পতাকা হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। না হলে পাকিস্তানের জঙ্গিবাদ, পশুত্ব, নরাধমযজ্ঞ বিশ্বমঞ্চের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে।
@মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, গবেষক