Wednesday, 16 December 2015

অস্ত্র সমর্পণ

হেলাল হাফিজ

মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালোবাসা তোমার আমার।
নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে, কেবল তোমাকে।
বিরোধী নিধন শেষে কতোদিন অকারণে
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে দেখেছি তোমাকে বারবার কতোবার।

মনে আছে, আমার জ্বালার বুক
তোমার কঠিন বুকে লাগাতেই গর্জে উঠে তুমি
বিস্ফোরণে প্রকম্পিত করতে আকাশ, আমাদের ভালবাসা
মুহূর্তেই লুফে নিত অত্যাচারী শত্রুর নি:শ্বাস।

মনে পড়ে তোমার কঠিন নলে তন্দ্রাতুর কপালের
মধ্যভাগ রেখে, বুকে রেখে হাত
কেটে গেছে আমাদের জঙ্গলের কতো কালো রাত!
মনে আছে, মনে রেখো
আমাদের সেই সব প্রেম-ইতিহাস।

অথচ তোমাকে আজ সেই আমি কারাগারে
সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
মানুষকে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে।

যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।

Monday, 30 November 2015

উজানে সাঁতার কাটছি, পরাজিত হতে আসিনি

প্রিয় পাঠকগণ, আপনাদের অভিবাদন।
আমার সাংবাদিকতা জীবন খোলা বইয়ের মতো আপনাদের সামনে উন্মুক্ত। মানুষের জীবনে ভুল-ত্রুটি থাকে, কর্মজীবনে আমারও হয়তো ভুল-ত্রুটি ছিল। কিন্তু রিপোর্টার থেকে কলামিস্ট হিসেবে উঠে আসার পুরোটা সময় পেশাগত কাজকে আমি ইবাদতের মতো নেওয়ার চেষ্টা করেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে নিয়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আমার বেড়ে ওঠা। একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমার চিন্তা ও চেতনায় লালিতই হয়নি, অস্থিমজ্জায় বসত গেঁড়েছে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার-কাটা মানুষ আমি। পেশাগত জীবনে নানামুখী টানাপোড়েন ও ঝুঁকি মোকাবেলা করেছি ধৈর্য্য, সাহস ও সহনশীলতা নিয়ে। জীবন মানেই যে সংগ্রাম- এই পাঠ আমি নিয়েছি ইতিহাসের পূর্বসুরীদের আদর্শ থেকে।
মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার আদর্শ। শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার। আমার দলের নাম মানুষ। তাই কোনো দলীয় সংকীর্ণতা নয় দেশ ও মানুষের স্বার্থই আমার কাছে বড়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাণশক্তি যুগিয়েছেন বার বার। তার ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম’ পংক্তি আমার এগিয়ে চলার মূলমন্ত্র। পেশার তারে জড়ানো জীবনে ভলতেয়ারের হৃদয়-ছোঁয়া উক্তি ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি’ এই চিন্তা ও চেতনা লালন করে পথ হেঁটেছি। জীবনের উপলব্ধি থেকে কবি নজরুলের বাণী বিশ্বাস করতে শিখেছি ‘বিবেক বেঁচে থাকলে সুখ মরে যায়’।

জীবনের এই কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রথাগত চাকরি আর নয়। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, “পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরি”। যত জায়গায় কাজ করেছি, আন্তরিকতা নিয়েই করেছি। সেইসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞ।

কোনো শাসক বা ক্ষমতাবানের করুণাশ্রিত জীবন নয়, পেশাগত জীবনে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সুলুকসন্ধানীর মতো চোখ-কান খোলা রেখে সত্যের মুখোমুখি হবার চেষ্টা করেছি। দেশ ও মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে আপস করিনি। করপোরেট সংস্কৃতির এই যুগে চাকরি করা যত কঠিন, চাকরি না করে টিকে থাকার সংগ্রাম আরো কঠিন। আমি শেষ চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছি।

প্রিয় পাঠকগণ, আমি কখনো সম্পাদক হতে চাইনি। আপনাদের মতো আমিও জানি দলবাজি, সুবিধাবাজি, আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ে রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত আমাদের সমাজে আজ সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাও অন্যান্য পেশার বাইরে যেতে পারেনি। সাংবাদিকতা পেশায় আজকাল কেউ তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, জহুর চৌধুরী, কিংবা নিদেনপক্ষে এবিএম মুসা বা আতাউস সামাদ হতে চান না। সরকারি আনুকুল্য, রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে অনুকম্পা, আনুগত্য, সরকারি পদ পদবি নিতে চান। বরাবর ছোটখাটো সাধারণ মানুষ হয়েও নিজেকে সেই সব পূর্বসুরীদের উত্তরাধিকারীত্ব বহন করার চেষ্টা করেছি যারা এই মহান পেশাকে গৌরবের মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। একদম সাধু ফেরেস্তা নই, তবুও অন্তহীন বেদনা, দহন, নানামুখী টানপোড়েন, ঝুঁকির পথকেই বেছে নিতে হয়েছে।

কিছু কিছু মানুষেরা পৃথিবীতে আলো ঝলমলে পরিবেশে আসেন, ভোগ বিলাসের রঙ মাখতে মাখতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে চলে যান। কিছু কিছু মানুষ আসেন, সৃষ্টিশীলতার নেশায়। নতুনত্বের হাতছানিতে অন্তহীন বেদনা ও হাহাকার সয়ে হৃদয় ক্ষয়ে পথ হাঁটেন। লেখক, সাংবাদিক, কবি হন। যেমন আমাদের পূর্বসুরীরা জীবন ক্ষয়ে রাজনীতিবিদি হয়েছিলেন। এই সব মানুষেরা ঘোর অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি হয়ে দীর্ঘ সুরঙ্গ কেটে আলোর সন্ধান করেন। আমি তাদের পথটিই গ্রহণ করেছিলাম। দুই দুই বার হৃদযন্ত্র মেরামত করার পরেও আমার স্বাধীনচেতা জাগ্রত বিবেকের ক্রন্দন, আকুলতা, দগ্ধ করেছে জীবনের পরতে পরতে। তাই না পেয়েছি স্বস্তি, না পেয়েছি নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন। মত ও পথের অমিলের কারণে ৫২ বছরের জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পেশাগত জীবনে কাটালেও স্থায়ী ভাবে ঘর বাঁধতে পারিনি কোথাও। দশ বারেরও বেশি চাকরি ছেড়েছি।
জীবনে একবার এই বেলাতে এসে চাকরি খোয়াতে হয়েছে কেন তা অনেকেই জানেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাই না। জীবনের মধ্যগগনের সূর্য অতিক্রম করে নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকমের চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথ হাঁটতে শুরু করেছি আজ। একদল অভিজ্ঞ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সাংবাদিকদের ছায়ায় তৈরি হয়েছে একটি উদ্যমী সংবাদকর্মীর টিম। পূর্বপশ্চিম ক্রিয়েটিভস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুজ প্রতিম সৈয়দ সারওয়ার রহমান, নিউজ পোর্টালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মুহাম্মদ রায়হানুর রহমান পীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য প্রযুক্তিতে প্রথম শ্রেণী নিয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। সেটি ছেড়ে তারা তথ্য প্রযুক্তি খাতে নিজেদের মেধা ও মননশীলতাকে বিনিয়োগ করেন। তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এই পূর্বপশ্চিম পরিবার। পূর্বপশ্চিম পরিবারের চৌকস মেধাবী সদস্য এস. জি ফারুক কলিন্সের পরিচালনায় মহিউদ্দিন মারুফ, একে মোহাম্মদ শরিফুল আলম, তানজীর আহমেদ দ্রুত সময়ে অফিস সাজিয়ে দিয়ে অনন্য ভুমিকা রেখেছেন। প্রিন্স ও রায়হান, দিবারাত্রি পরিশ্রম করে ওয়েবপোর্টাল ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন করেছেন। পূর্বপশ্চিম বিডি ডটকমের উপদেষ্টা দেশবরেণ্য শিল্পী ধ্রুব এষ একুশের বইমেলা সামনে রেখেও তার ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে গভীর আন্তরিকতা দিয়ে নিউজ পোর্টালের লোগো তৈরি করে দিয়েছেন। মত ও পথের অমিলে নানাসময়ে গণমাধ্যমে বাহাস হলেও আমার বন্ধু লেখক সাংবাদিক এবং গবেষণা সংস্থা পরিপ্রেক্ষিত ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা ক্রিয়েটিভ মিডিয়ার চেয়ারম্যান সৈয়দ বোরহান কবীর পরামর্শ দিয়েছেন। দুটি নান্দনিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন তৈরি করে দিয়েছেন সৃষ্টিশীলতার সাক্ষর রেখে। অর্থমূল্য নেননি, হৃদয় মূল্য দিয়েছেন। পূর্ব পশ্চিম পরিবারের সঙ্গে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হয়ে ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জের সাবেক পরিচালক ও লেখিকা খুজিস্তা-নুর ই নাহরীন মুন্নী, অভিনেত্রী নির্মাতা রোকেয়া প্রাচী, সংগীত শিল্পী সেলিম চৌধুরী, রাকসুর সাবেক পত্রিকা সম্পাদক জাকিরুল হক টিটন, স্থপতি লেখক ও নাট্যকার শাকুর মজিদ, নিয়মিত মিটিংয়ে থেকে তাদের হৃদয় নি:সৃত আন্তরিকতাই দেননি, নানামুখি আইডিয়াও দিয়েছেন। চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও তার হৃদয় নিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাহী সম্পাদক দীপু হাসান, সহযোগী সম্পাদক শাকির আহমদ, উপ সম্পাদক সুবীর দাশ, শরীফ তালুকদার, প্রধান প্রতিবেদক প্রতীক ইজাজ, বার্তা সম্পাদক বিপুল হাসান, সিনিয়র সহকারী সম্পাদক রনজু রাইম, সমন্বয়কারী সেজুল হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি খোন্দকার সোহেল, সিনিয়র নিউজ রুম এডিটর নিপু বড়ুয়া, নতুনদের নিয়ে কর্মশালা থেকে টানা দু’মাসের প্রস্তুতি যুদ্ধে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।

প্রিয় পাঠকগণ, দেশবরেণ্য বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অনেকে এই চ্যালেঞ্জে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজের আলোকিত মুখগুলো যে ভাবে সাহায্য করেছেন তাতে আমি অভিভূত। বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব স্নেহের ঋণে বন্দী করেছেন। সারাদেশের প্রতিনিধিদের সম্মিলনে ও সংবাদকর্মীদের কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিয়ে বন্ধুবর সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সামিয়া রহমান, পলাশ আহসান ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আর রাজি সাহায্য করেছেন। প্রবাসের মুখগুলো স্বত:স্ফুর্তভাবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

প্রিয় পাঠকগণ, বাংলাদেশ প্রতিদিনে থাকাকালীন আমাদের ভাই বন্ধু, পরম আপনজন ডাক্তার জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ব্রেইন টিউমারে অকাল মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুকে ঘিরে তার প্রথম তারুণ্যের হাত ধরে বেড়ে ওঠা বন্ধু মোজাম্মেল বাবু এবং প্রয়াতের স্ত্রী খুজিস্তা নুর ই নাহরীন মুন্নীকে এই অকাল মৃত্যু নিয়ে লিখতে অনুরোধ করি। খুজিস্তা নুর ই নাহরীন মুন্নী তার ১৮ বছরের জীবনসঙ্গী ডাক্তার জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুকে নিয়ে একটি হৃদয়স্পর্শী লেখা পাঠান। সেটি ছাপা হওয়ার পর ক্যানসারে অকালে চলে যাওয়া আরেক চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম টেলিফোন করে লেখিকার টেলিফোন নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করেন। তিনি চেয়েছিলেন, এই লেখার ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। ঘাতক ক্যান্সার তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। টিংকুর বাড়ির মেঝেতে তার ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু শুধু দীর্ঘশ্বাসের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়েছে। সেই থেকে আমার দেখা এক আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী বিদুষী নারী খুজিস্তা নুর ই নাহরীন নিয়মিত লেখালেখিতে আসেন। একদিন তিনি আলাপকালে আগামীতে প্রিন্ট মিডিয়ার বদলে অনলাইন মিডিয়া জনপ্রিয়তা পাবে বলে মন্তব্য করেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া মুখ থুবড়ে পড়লেও দক্ষিন এশিয়ায় প্রিন্ট মিডিয়া মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বলে তর্কে জিতে যাই। সেই বিতর্কের অনেকদিন পর দেখা যায় পশ্চিমা দুনিয়াই নয় দক্ষিণ এশিয়া এমনকি বাংলাদেশেও অনলাইন মিডিয়া মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সরকার নীতিমালা প্রনয়ণের তোড়জোড় শুরু করেছে। অন্যদিকে প্রিণ্ট মিডিয়া থেকে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে ভেতরে তৈরি হওয়া একগুয়ে, ক্ষেপাটে, জেদি, সৃষ্টিশীল মনে নিজের মতো করে দাঁড়াবার তাড়া দেয়। নিজের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় আমার চিন্তায় নিউজ পোর্টাল ঠাঁই পায়। সেই বীজ ডালপালা মেলতে শুরু করে যখন গেল কোরবানীর ঈদে লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক সফরে যাই। প্রবাসী সতীর্থদের সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথাবার্তা হয়। দুনিয়াজুড়ে যেখানেই যাই বিমান বন্দর থেকে শপিং মল, হোটেল লবি সবখানেই মুঠোফোনে অনলাইনে খবরপাঠ এক চেনা দৃশ্য হয়ে গেছে।
দেশে ফিরে আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে বনানীতে স্থপতি শাকুর মজিদের অফিসে যাই। সেখানের আড্ডায় যেতে ফোনটি করেছিলেন সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। অস্থির পায়চারী করতে করতে বললাম, এবার নিজেই কিছু করবো। তারা দুজন তাকালেন। বললাম নিউজ পোর্টাল অনলাইন। শাকুর মজিদ একটি নাম বললেন। আমার পছন্দ হলো না। বললাম, পূর্বপশ্চিম। ইশতিয়াক রেজা ও তিনি সমর্থন দিলেন। সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠে পশ্চিমে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে তামাম দুনিয়ায় কত খবর ঘটে যায়! শুধু কি তাই? প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ব পশ্চিম নামে যে ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখেছেন সেটি আমাদের অহংকার। শাকুর মজিদ কাকে জানি ফোন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডে ডোমেইন কিনে দিলেন। তারপর প্রিন্স ও রায়হান হয়ে একটি স্বপ্নের পূর্ণতা পেলো ধীরে ধীরে। এইখানে সাবেক ছাত্র নেতা আব্দুল্লাহিল কাইয়ুম উৎসাহ দিয়ে বললেন নামেই অর্ধেক এগিয়ে গেছেন আপনি। আমার এই যাত্রাপথে ভালোবাসা ও হৃদয় দিয়ে যারা সাথী হয়েছেন তাদের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।

প্রিয় পাঠকগণ,
মার্কিন সংবাদপত্র এসোসিয়েশন জরিপ করে বলেছে ২০৫০ সালে পৃথিবীতে প্রিন্ট মিডিয়া থাকছে না। সানডে টাইমস জরিপ করে বলেছে ইংল্যান্ডে ৫ বছর পর প্রিন্ট মিডিয়া থাকবে না। আমাদের দেশে প্রিন্ট মিডিয়া কম হলেও আরো দুই যুগ থাকবে। যদিও অনেকে বাড়িয়ে বলছেন আগামী দিনে অনলাইন টিভির কাছে ইলেকট্রনিক মিডিয়াও মুখ থুবড়ে পড়বে।

প্রিয় পাঠকগণ,
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এখন অনলাইন মিডিয়াকে শক্তিশালী গণমাধ্যমে রূপ দিয়েছে। তারুণ্যের এই শক্তির ওপর ভর করে আমাদের চ্যালেঞ্জ পিছিয়ে না থাকার। একুশ শতকের কান সংবাদপ্রধান, এই শ্লোগান নিয়ে বহুরৈখিক সংবাদ, মতামত, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন, অপরাধ জগৎ নিয়ে সব মত পথের মহাসম্মিলনে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মুক্তচিন্তার প্লাটফর্ম হচ্ছে পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম।

আমাদের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। অর্ধেক জীবন পার করে নেয়া এই চ্যালেঞ্জে আপনারা পাশে থাকুন, সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন, আমরা আপনাদের নিয়ে পূর্বপশ্চিম বিডি ডটকমের পথ চলতে শুরু করেছি। আপনারা লিখুন, আপনারা মতামত দিন, আপনারা পরামর্শ দিন, মানুষের শক্তির চেয়ে কোন শক্তিকে আমরা বড় মনে করি না। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন অপর পক্ষের মতামত গ্রহণ করার মানসকিতা না থাকলে গণতন্ত্রেও বিবর্তন সম্ভব নয়।

একজন দার্শনিক বলেছেন সত্য কারো একার সম্পদ নয়। প্রিয় পাঠক, সত্য জানার আগ্রহ অধিকার প্রতিিিট নাগরিকের। প্রতিটি মানুষের। খবর বন্ধ রাখার কোন সুযোগ আজকের দুনিয়ায় নেই। আপনাদের কাছে অঙ্গীকার করছি আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসী। এমন সময়ে আমরা এসেছি যখন দেশ নয়, দুনিয়া জুড়েই ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিকুল পরিস্থিতি অতিক্রম করছে বিশ^। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আমাদের আপোস নেই। আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি আপনাদের মতামত আমরা প্রাধান্য দেব। আপনাদের সমালোচনার জবাব দেব। গালমন্দটুকু শুধু মুছে দেব। নির্মোহ সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন যেমন থাকবো, তেমনি কারো প্রতি ব্যক্তিগত রাগ ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নিয়ে মনগড়া রিপোর্টে যাবো না। বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে আপনাদের সামনে যেমন পূর্ণসত্য উপস্থাপন করবো তেমনি আমাদের সাফল্যের অংশীদার করবো দেশ ও মানুষকে। আপনারা আস্থা রাখুন, সঙ্গে থাকুন।


পীর হাবিবুর রহমান
প্রধান সম্পাদক: পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম

Sunday, 18 October 2015

শরণার্থী সমস্যা : -- আরব দেশগুলো কেন নিদায় নীরব?

ভূমধ্যসাগরতীরে মানবতার করুণ উপাখ্যান রচিত হচ্ছে প্রতিদিন। হাঙ্গেরিতেও কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটার বাহু কেটে রক্তাক্ত হলেও সীমান্তরক্ষীরা শুনবে বলে সে একটুও কাঁদেনি। গর্ব করে তার বাবা বলেন, আমার ছেলেটা বীর। সাগরতীরে আয়লান কুর্দির লাশ হৃদয় ভেঙে দেয়, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উদাসীনতার দুর্গ তবু ভাঙে না।
৪০ লাখের বেশি সিরীয় দেশ থেকে দেশে, সীমান্ত থেকে সীমান্তে আশ্রয়ের সন্ধানে ভুগছে ও ছুটছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একযোগে নির্বিকার। সভ্যতার আঁতুড়ঘর বলা হতো ইরাক ও সিরিয়াকে। এখন তারা বধ্যভূমি। এখন খবর বের হচ্ছে আইএস তাদেরই সৃষ্টি। আর আইএস সৃষ্টি করছে লাখ লাখ উদ্বাস্তু। পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট জঙ্গিরা পৃথিবীতেই দোজখের মডেল দেখাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবেও
আরব ধনকুবেরদের দানে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী এসব ধ্বংসের কারিগর। তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া সিরীয় ওমর হারিরির কণ্ঠে তাই তিক্ত হতাশা, ‘তারা বিদ্রোহীদের সাহায্য করে, শরণার্থীদের দেখে না।’
উপসাগরীয় সালতানাতগুলো বিশ্বের শীর্ষ ধনী, অথচ শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ। যে কুয়েতিরা ১৯৯০ সালে ইরাকি হামলায় শরণার্থী হয়েছিল, সিরীয় শরণার্থীরা তাদের চোখে ‘ভিন্ন, আতঙ্কগ্রস্ত ও মানসিকভাবে অসুস্থ, আমাদের জীবনধারায় তারা বেমানান!’ ইরাক আক্রমণের পক্ষে জর্জ বুশের যুক্তিও ছিল এমন: তারা আমাদের জীবনধারা ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু ভোগবিলাসে মত্ত থেকে স্বজাতি, স্বধর্মের আরবদের জীবন তছনছ করা কেমন সুস্থতা? ওদিকে ইয়েমেনে হামলা করে করে উদ্বাস্তুর ঢল প্রতিদিন বাড়িয়ে চলেছে সৌদি আরব। আরব উপদ্বীপ ও উপসাগরীয় দেশগুলোয় একজন সিরীয়ও আশ্রয় পায়নি। বরং আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে বলায় আরব আমিরাত থেকে এক ফিলিস্তিনি ব্লগারকে বহিষ্কার করা হয়।
সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করায় তুরস্কের ভূমিকাও কম নয়। তারপরও দেশটির ২০ লাখ আশ্রিত মানুষের মধ্যে ১৭ লাখ সিরীয় ও এক লাখ ইরাকি। লেবাননের প্রতি পাঁচজনের একজন সিরীয়। ইরাকেও আশ্রয় নিয়েছে আড়াই লাখ সিরীয়। আরবদের মধ্যে মিসর ও জর্ডানে রয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৩০ হাজার ও ৬৩ হাজার সিরীয়। তিউনিসিয়ায় রয়েছে ২২ লাখ লিবীয়। আলজেরিয়ায় আছে ৫৫ হাজার।
শরণার্থীদের ডুবন্ত হাত যখন আরব শাসকেরা ফিরিয়ে দেয়, তখনই অগতির গতি হয় ইউরোপ। এ বছর ভূমধ্যসাগর পেরিয়েছে সাড়ে তিন লাখ শরণার্থী, এদের ২ হাজার ৬০০ জনের সলিলসমাধি ঘটেছে। গত সপ্তাহে অস্ট্রিয়ায় এক লরির ভেতর ৭১ জনের গলিত লাশ মেলে। তুরস্কের উপকূলে শিশু আয়লানের মৃত্যুদৃশ্যের অভিঘাতে পরদিনই জার্মানি সীমান্ত খুলে দেয়। তিন বছরের সেই শিশুটিই হয়ে ওঠে মানবতার আপন সন্তান। ইউরোপীয় বিবেক নড়ে ওঠে। নিজেদের হাতেও রক্ত ও কালিমার দাগ দেখে বিব্রত হয় তারা। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অভিবাসনকামীদের ‘পঙ্গপাল’ বললেও জনমতের চাপে দ্রুত অবস্থান বদলান। অথচ আরব িলগ, ওআইসি ও জিসিসি যেন অবশ। এ দেশগুলোর কোনোটিই শরণার্থীর অধিকার–বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি।
সৌদি আরবের অবস্থান তবু বদলায় না। আরব বসন্তের পর থেকে শিয়া, ফিলিস্তিনি ও সিরীয়দের আশ্রয় দেওয়ায় সেখানে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাদের ভয়, এরা রাজতান্ত্রিক দুঃশাসন মানবে না বেশি দিন। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত একজন শরণার্থীকেও আশ্রয় না দেওয়াকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ‘চরম লজ্জাজনক’ আখ্যা দেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্রের ভাষায়, ‘দায়ের অংশীদার তারা হতে চায় না, তারা চায় অন্যরা বোঝা সামলাক, তারা কেবল চেক লিখে দিয়েই খালাস।’
সিরিয়ার বিপর্যয়ের দায় এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশি। অথচ তাদের ‘রাইট টু প্রটেক্ট’ কিংবা ‘মানবিক হস্তক্ষেপের’ হাত সিরিয়ায় পৌঁছায় না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কিছু সদস্যের ভাষ্য, শরণার্থীরা সন্ত্রাসীদের পাইপলাইন বানাবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই সেক্যুলার সিরিয়ায় গণতন্ত্র রপ্তানির নামে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়েছে জঙ্গিদের। হাজার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব দিয়ে সন্ত্রাসের পাইপলাইন এখনো চালু রেখেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার মহৎ দৃষ্টান্ত। জার্মানির এই উদারতার পেছনে রয়েছে অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। তাদের জনসংখ্যা কমতির দিকে। উন্নতি বজায় রাখতে আরও শ্রমিক চাই। প্রচলিত কোটায় এত শ্রমিক আনা সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, প্রধান দুই দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ও গ্রিন পার্টি একজোট হওয়ায় বর্ণবাদীদের আপত্তি ধোপে টিকছে না।
এই যুদ্ধের আগে সিরীয়রা কখনোই শরণার্থী হয়নি। পড়তে আসা সিরীয়রা আশ্রয়প্রার্থী হয়নি পাশ্চাত্যে। সেই সিরিয়ার এমন অবমাননায় আরবশাহির হাত থাকা লজ্জাজনক।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

মানুষ হত্যার এমন উৎসব আগে কখনো দেখা যায়নি

কোথাও যুদ্ধ হয়, বেশুমার মানুষ মরে। আমরা তার খবর পড়ি আর ভুলে যাই। বাড়ির পাশে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়, পরদিন খবরের কাগজ থেকে জানা যায়, আরও একটি লাশ পড়েছে। যুদ্ধে যে মারে তার জবাবদিহি হয় না। যাদের মারা যায়, তারাও জানে এসব হত্যার বিচার হবে না; হয় না কদাচিৎ। নিহত স্বজনের লাশ পাওয়ার আর আদরযত্নে আর শোকে তাকে দাফন করার সুযোগও থাকে না যুদ্ধের দিনে। যুদ্ধ থামলে হয়তো সুযোগ পেলে তারা স্বজনের শেষনিঃশ্বাস ছাড়ার জায়গাটা দেখে আসে। পারলে গণকবর খুঁজে বের করে ফুল দেয়। তারপর আবার ফিরে আসে যার যার জীবনে। জীবন এমন এক কঠিন কারাগার, যেখানে ফিরতেই হয়।
বাংলাদেশে অপঘাতে মৃত্যুও এক নাছোড় দানব, যার লাশের ক্ষুধা মেটাতে হয় প্রতিদিন। এখানে এখন গড়ে প্রতিদিন একজন মানুষ মারা যাচ্ছে ‘যুদ্ধে’। যুদ্ধই বলছি, কারণ সরকারি বাহিনীগুলো এসব হত্যাকাণ্ডকে যুদ্ধের পরিভাষা দিয়েই চিনিয়েছে: ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি। কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের একটি গল্পের নাম ছিল ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’। এখন আমাদের খবরের কাগজের শিরোনাম হয় ‘প্রতিদিন গড়ে একটি হত্যা’।
খুন করে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার ‘ঐতিহ্য’ আছে বাংলাদেশে। প্রায়ই নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে খুন করে লাশ ডোবানোর ঘটনা সংবাদে আসে। লঞ্চডুবির পরও অজস্র লাশ ভাসে। একাত্তর সালে, পাকিস্তানি বাহিনী নদীর ধারে সারবেঁধে বাঙালিদের দাঁড় করিয়ে গুলি করত। দেহগুলো নদীতে পড়ে ভাসতে ভাসতে কাক-শকুন আর মাছের খোরাক হতো। পুরাকালে সাপে কাটা কিংবা বেওয়ারিশ লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতিও ছিল। এখনকার রীতি হলো বন্দুকযুদ্ধ। সবাই জানে এসব আসলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
এত মৃত্যুর জন্য পেশাদার বাহিনী লাগে, প্রয়োজন হয় ‘ডেথ স্কোয়াডের’। আমাদেরই চারপাশে তারা থাকে, খায়, ঘুমায়, আনন্দ করে, টহল দেয়। তারপর তালিকা ধরে ধরে মধ্যরাত থেকে ভোরের কোনো সময়ে নদীর বাঁধ বা খেতের কিনারে নিয়ে শিকারকে হত্যা করে। এ রকম করে প্রতিদিন একটি রুমাল এখন কার প্রয়োজন?
এই মৃত্যুর চানমারি শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সহিংস প্রতিরোধের মাধ্যমে। যে সহিংসতা তারা শুরু করেছিল, আজ তা-ই বহুগুণে বড় হয়ে হয়ে তাদের বিনাশ করছে। সেই ককটেল, পেট্রলবোমা—যার শুদ্ধ নাম মলোটভ ককটেল খুবই গরিব-দরদি। বেছে বেছে মেহনতি মানুষকেই তারা হত্যা করত। সেটা এমন সময়, যখন সরকারি দলের সমর্থকদেরও কেউ কেউ বোমা-বারুদসহ জনতার হাতে ধৃত হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের লোকেরা তো আগুন নিয়ে খেলছিলই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর হঠাৎ সেই সব বোমাবাজ গায়েব হয়ে গেল। কোথায় গেল? এখন কেন আর তাদের প্রয়োজন হচ্ছে না?
এসব ককটেল আর পেট্রলবোমা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে সাধারণ মানুষের, দ্বিতীয় ক্ষতিগ্রস্ত বিরোধীদের ভাবমূর্তি। এর জন্য তাদের জনপ্রিয়তা কমেছে। অন্যদিকে হিসাব করলে বোঝা যায়, লাভবান হয়েছে ‘সরকার’। সেই লাভ এমনই লাভ যে নির্বাচন, গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিত্ব—সবকিছুই ওই ‘পেট্রলবোমার’ ভয়ে উবে গেল, তেমন কোনো আহাজারিও করল না কেউ।
আগুন দিয়ে চলন্ত বাস-গাড়ি-ট্রাকে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংসতা কি একাত্তরের পরে দেখেছে বাংলাদেশ? হ্যাঁ, কি স্বৈরশাসক, কি নির্বাচিত শাসক—সব আমলেই গুলি চলেছে। কিন্তু মানুষ হত্যার এমন উৎসব আগে কখনো দেখা যায়নি। ২০১৩ সালে এ রকম রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫০৭ জন নিহত হন। এখন শোনা যাচ্ছে, জামায়াতি সন্ত্রাসীদেরই নাকি খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন নেতা-নেত্রী পরোক্ষভাবে এসব হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমরা যাঁরা পকেটমারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে উচিত শিক্ষা দিই, তাঁদের অনেকেই এ রকম আইনবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করছেন। এই সমর্থনের শুরু হয়েছিল বিএনপি আমলের অপারেশন ক্লিন হার্টের সময়। তারপর এল ক্রসফায়ার। অনেকেই এটাকেই সন্ত্রাস দমনের ধন্বন্তরি পথ বলে বাহবা দিলেন। কিন্তু তাতে কি জনগণের নিরাপত্তাহীনতা কমেছে? রাজনীতি থেকে সহিংসতা দূর হয়েছে? নাকি তা আরও বহুগুণে বেড়েছে। এখন আর বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস হয় না। এখন হয় বেআইনি ও আইনি বাহিনীর সংঘবদ্ধ হত্যাযজ্ঞ। পৌরাণিক কাহিনিতে পরশুরাম পাপের বিনাশে কুঠার হাতে নিজের বংশকেই নাশ করেছিলেন। নদীর তীর ধরে তিনি হত্যা করতে করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। পরিণামে সেই কুঠার তাঁর হাতের অংশ হয়ে যায়, কোনোভাবেই তাকে ছাড়ানো যায় না। অবশেষে করতোয়া নদীর জলে হাত ধুলে সেই ঘাতক
কুঠার খসে। রাষ্ট্রের হাতে যাঁরা পরশুরামের কুঠার তুলে দিয়েছেন, আশা করছেন প্রতিপক্ষ বিনাশেই সেটা শেষ হবে, তাঁরা ভুল করছেন।
র‌্যাবের জন্ম দিয়েছিল বিএনপি, অথচ আজ তারাই এই বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সোচ্চার। যে আওয়ামী লীগ ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে ক্রসফায়ার বন্ধের কথা বলেছিল, আজ তারাই হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ প্রবর্তক। হত্যা আরও হত্যা ডেকে আনে; এই সত্য তারা ভুলে
যেতে পারে, কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য এমন বিস্মরণ হবে আত্মঘাতী।
যারা পেট্রলবোমায় মানুষ মেরেছে, তাদের বিচার করতে অসুবিধা কোথায়? এত মৃত্যু যাদের হাতে ঘটেছে, তাদের নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পনা ছিল, উদ্দেশ্য ছিল, সহায়-সরঞ্জাম ও তহবিল ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, তাদের ছিল ‘নিয়োগদাতা, হুকুমদাতা’। আটক করে বিচার করলে তাদের মুখ থেকে সম্পূর্ণ সত্যটা মানুষ জানতে পারত। যে রাজনীতি এ রকম হত্যার আয়োজন চালায়, তাদের মুখোশ খসে পড়ত। কিন্তু সরকার সেই জরুরি কাজটা কেন করছে না? সত্য উন্মোচনে তাদের কিসের ভয়? এ ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শেষাবধি রাজনীতিকেই হত্যা করে। হত্যা করে আইন, যুক্তি ও ন্যায়কে।
সত্য নেই, রয়েছে গুজব। ভূতের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি করে না আধুনিক কোনো সরকার; কিন্তু জগতে এমন সরকার কম যে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করে না। এ যেন হাওয়ায় তরবারি চালিয়ে গুজবের আগামাথা তরমুজের মতো ফালাফালা করার কারবার। যখন সত্য বিতর্কিত বা জানার অতীত, তেমন সময়ই গুজবের বসন্ত। সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোয় যে-ই হাত দিচ্ছে, তার হাতই পুড়ে যাচ্ছে। সরকারি প্রেসনোটের মধ্যিখানে ফোকর ধরা পড়লে জানবেন, সত্যটা ওই পথেই পগারপার। এমন দিনেই তারে বলা যায়: মতিঝিলে নাকি...রানা প্লাজার রেশমা নাকি...বিএনপি নাকি..., বন্দুকযুদ্ধ নাকি... ইত্যাদি। গুজবে উত্তর থাকে না, থাকে সময়ের সবচেয়ে জ্বলন্ত ও জরুরি প্রশ্ন। সবলের বিরুদ্ধে গুজব দুর্বলের অস্ত্র। যখন সত্যের কারবারিরা জনমনের আস্থা হারায়, তখন ‘নাকি’ শব্দটা আমাদের বাক্যের মধ্যে খিল গেড়ে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকে প্রশ্ন করে, ‘তোমরা নাকি...’। আমাদের কালের দুর্ধর্ষ গুজব রাশি সেসব প্রশ্নেরই উত্তর প্রস্তাব করে, একচক্ষু সরকার যার ওপর ধামা হয়ে চেপে বসেছে; যার উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে, প্রতিদিন একটি বা ততোধিক হত্যা নিয়েও গুজব ডানা মেলা শুরু করেছে।
তাহলেও সরকার নড়বে না চড়বে না। সাগর-রুনির মতো ব্যাখ্যাতীত অনেক মৃত্যুর প্রতিকারে ব্যাখ্যাতীত দায়িত্বহীনতা দেখিয়েই যাবে। কেবল নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো মায়ের মতো অসীম মমতায় অপঘাতে নিহত সন্তানদের লাশ বুকে নিয়ে বইতে থাকবে। বইতেই থাকবে। যারা বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার বা পেট্রলবোমায় নিহতদের লাশ আনতে যায়, সকালে বা সন্ধ্যায়, তাদের বোবা প্রতিবাদের ভাষা পড়ার ক্ষমতা জাতি হিসেবেই হয়তো আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
তুর্কি চলচ্চিত্রকার ইলমাজ গুনের ছবি ইওল। ছবির একটি দৃশ্যে কুর্দিস্তানের বিদ্রোহীদের লাশ নিয়ে আসতে দেখা যায় সেনাদের। তাদের ট্রাকের পেছনটায় সার সার লাশ। ট্রাকটা একের পর এক কুর্দি গ্রামে ঢোকে, আর গ্রামবাসীদের বলা হয় লাশ শনাক্ত করতে। তারা বাধ্য হয় সারবেঁধে নির্বিকার মুখে একে একে লাশগুলো দেখে যেতে। একটি লাশের সামনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াতে দেখা যায় এক বাবাকে। সেনারা এগিয়ে আসে, চোখে প্রশ্ন: আপনার? লোকটি নীরবে মাথা নাড়িয়ে সরে যায়। নিজের ছেলের লাশ শনাক্ত করাও যে বিপদ! বাংলাদেশে আমরা ধন্য, আমাদের বাবাদের নিহত ছেলের লাশ শনাক্ত করার সুযোগ আছে।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

সব বলে দিয়েছে শিশু আয়লান // ফারুক ওয়াসিফ

‘আমি খোদার কাছে সব বলে দেব’, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মুখে এই ছিল তিন বছর বয়সী অন্য এক সিরীয় শিশুর শেষ আর্তনাদ। বিশ্বের রাজাধিরাজেরা তখন শোনেননি। এরই সাড়ে তিন মাস পর একই বয়সী আরেকটি শিশুর নির্বাক প্রতিবাদ দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিল। যে মানবতা ভেসে গেছে, সেই অমানবতার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে শিশুটি এসে ঠেকেছিল তুরস্কের উপকূলে। সেই দৃশ্য কেউ তুললেন, কেউ তা ফেসবুকে দিলেন, কোনো পত্রিকা তা প্রকাশ করল, কোনো টেলিভিশনে তা প্রচারিত হলো। যে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা সান আগের দিন সিরীয় উদ্বাস্তুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক শিরোনাম করেছিল: উদ্বাস্তু ঠেকাও। পরদিন তারাই সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে থাকা আয়লানের ছবি ফলাও করে ছাপল। আবারও প্রমাণিত হলো, নিষ্পাপের মৃত্যু অসহনীয়, অবর্ণনীয়, ক্ষমার অযোগ্য। আয়লান একাই বিশ্বমানবতার ঘুম ভাঙিয়েছে, বিশ্বনেতাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দায়িত্বহীনতার কাঠগড়ায়, বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াবহ দোজখের দুর্দশার কথা।

আয়লানের ওই ছবিটা যেন অপার্থিব বিষাদের প্রতীক। যেন সে ঘুমিয়ে আছে এক শুভ্র বিছানায়। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন তার শীততাড়ানি কম্বলের ঝালর। পায়রার বুকের মতো কোমল গাল পেতেছে সে যে বেলাভূমিতে, তা যেন তার মায়ের পাতা সোহাগী বিছানা। তার লাল জামাটি যেন অতীতের কোনো যুদ্ধহীন দিনের স্মৃতির ঝলক। তার পায়ের জুতা জোড়াও তার মতোই আদুরে। জুতা নিয়ে সব শিশুরই দারুণ আমোদ, উৎসাহ আর গল্প থাকে। পৃথিবীতে যা সবচেয়ে সুন্দর, তার ধ্বংসই সবচেয়ে অসহনীয়। আয়লানের মৃত্যুর মর্মান্তিকতার আরেক পিঠে তাই দেখা যায় যুদ্ধবাজ রাজনীতির নৃশংসতা আর রাষ্ট্রনেতাদের স্বার্থপরতার প্রমাণচিত্র।

আয়লানের জুতাজোড়া মনে করিয়ে দেয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক বাক্যের এক গল্পের ধাক্কা, ‘বিক্রি হবে: কখনো না পরানো এক জোড়া পুরোনো জুতা।’ আয়লানের ওই ছবিটা ফিরিয়ে এনেছে ভিয়েতনামে মার্কিন নাপাম বোমায় পোড়া কিশোরীর ভয়ার্ত মুখ, ফিরিয়ে এনেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অসহায় ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের আকুতি। বিপন্ন শৈশব বিপন্ন মানবতার চিহ্ন, সেই চিহ্নই আজ ভাসছে ভূমধ্যসাগরে।
যখন ভূমিতে জল্লাদ, তখন দরিয়ায় কী ভয়! আয়লানের বাবা-মাও তাই মরিয়া ছিলেন দেশ ছাড়তে। ফেরাউনের ভয়ে শিশু মুসা (আ.)-এর প্রাণ বাঁচাতে তাঁর মাও তাঁকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নীল নদে, ছোট্ট একটি গামলায়। পরিণত বয়সে আবারও তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল মৃত্যু ও উত্তাল সমুদ্রের কিনারে। সমুদ্র সেদিন তাঁকে ও তাঁর জাতিকে পথ করে দিয়েছিল। কিন্তু এটা কলিকাল। আবদুল্লাহ কুর্দির মতো অসংখ্য সিরীয়-লিবীয়-ইয়েমেনীয় উদ্বাস্তুর ডাক শুনবে কে? ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই’।
মহান আরব ভ্রাতৃত্ব অন্ধ ও বধির। ধনী আরব শাসকেরা গরিব আরবদের ধ্বংসে মেতেছে। ইউরোপীয় সভ্যতা আর সেই সভ্যতার ত্রাতা যুক্তরাষ্ট্র দূর থেকে দেখছিল। জীবনের মায়া এমন, সন্তানের জীবনের ভয় এমন অদম্য যে হতভাগ্য আবদুল্লাহ কুর্দি দমে যাননি। তিনি কানাডায় বোনের কাছে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন কানাডীয় সরকারের কাছে। একদা অভিবাসীদের স্বর্গ কানাডায় এখন রক্ষণশীল সরকার। সেই সরকারের আমলারা কাগজপত্রের খুঁত দেখিয়ে পরিবারটিকে বারবার ফেরায়। অবশেষে টাকা জোগাড় করে তুর্কি দালালের কাছে ধরনা দেন আবদুল্লাহ। জাহাজের কথা বললেও পরিবারটিকে আরও অনেকের সঙ্গে তুলে দেওয়া হয় ছোট্ট একটি নৌকায়। (সাম্প্রতিক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মর্মান্তিক মৃত্যুর আখ্যান যেন) যথারীতি মাঝ দরিয়ায় তা ডুবে যায়। পিতা কেবল উঠতে পারেন তীরে। সমুদ্র নাকি সবই ফিরিয়ে দেয়। আবদুল্লাহর দুই সন্তান ও স্ত্রীকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জীবনটা কেড়ে নিয়ে।

আবদুল্লাহ কুর্দি ছিলেন এক সিরীয় কুর্দি নাপিত। বোনের দোহাই দিয়ে কুর্দি কানাডায় আবেদন করেছিলেন, ‘আমাদের খরচ সে জোগাবে’। বোনও কানাডীয় কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, ‘তারা আমার সঙ্গে চুল কাটার কাজ করতে পারবে। আমি তাদের কাজও খুঁজে দিতে পারব।’ থাকার, চলার অসুবিধা হতো না। তবু অনুমতি মিলল না। হলে আয়লান বেঁচে যেত। এখন কানাডীয় সরকার দেশবাসীর কাছে অনুতাপ করছে। আয়লানের ফুফুও কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘কেন আমি ওদের আসতে বললাম!’ এখানেই থামেননি তিনি, ‘আমি আজ সত্যিই যা চাই তা হলো যুদ্ধের অবসান। সারা পৃথিবীর মানুষের উচিত এগিয়ে এসে সিরীয় যুদ্ধ বন্ধ করা। তারাও তো মানুষ!’

যে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উচ্ছেদের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষক ঢেলেছিল, যে সৌদি আরব ইরান ও সিরিয়াকে এক ঢিলে ঘায়েল করতে জঙ্গি জিহাদি সৃষ্টি করেছিল, তারা জানত না যুদ্ধ মানেই গণহত্যা, দেশান্তর আর নিরীহ-নিষ্পাপের নিধন? কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলই বর্বর আইএসকে সৃষ্টি করেছে, যেমন করেছিল তালেবানদের। ব্রিটেনের জনপ্রিয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় সেই পত্রিকার নামজাদা প্রতিবেদক সিম্যাস মিলনে তথ্য–প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস অথবা আইসিসের উত্থানে জ্বালানি জুগিয়ে গেছে। আইএসের ধ্বংসযজ্ঞের সুবাদেই আজ তেলের দাম কম, জোগান বেশি আর তেল ব্যবসায়ীদের রমরমা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে বিরাট আকারের গণহত্যা চলে আসছে, তার দায়ও যেমন তারা স্বীকার করেনি, তেমনি বলকান অঞ্চলে যে ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ দেখা গিয়েছিল, এখানে তার দরকার মনে করেনি। কিন্তু চোখের আড়ে পাহাড় লুকানো যায় না। প্রতিবাদ, খবর, হুঁশিয়ারি যা পারেনি, এক আয়লানের লাশের ভাসান সেই মিথ্যার জারিজুরি ছিঁড়ে ফেলেছে। কোনো বুলেট যা পারেনি, আয়লান তা পেরেছে। সে বেহুঁশ বেবুঝ শাসকদের মুখোশ খুলে দিয়েছে।
আর তখনই দেখা গেল, মানুষের ভরসা আজও সাধারণ মানুষই। অভিবাসীদের যাত্রাপথের দেশের সাধারণ মানুষ সিরীয় উদ্বাস্তুদের বরণ করে নিতে রাস্তার পাশে খাবার, পানি ও ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করেছে। উদার জার্মানি দুয়ার খুলে দিয়েছে। ইউরোপীয় জাতগর্বী দুর্গের দেয়াল টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
কিন্তু কী করবেন আয়লানের বাবা? যে কানাডা তাঁর পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারাই এখন তাঁকে সাধছে। কিন্তু কী আসে যায় এখন? নিউইয়র্ক টাইমস-এ এসেছে তাঁর হাহাকার: ‘সারা দুনিয়ার সব দেশ দিয়ে দিলেও আমি তা চাই না। যা ছিল অমূল্য, তার সবই তো গেছে আমার!’
জীবনে আশ্রয় পায়নি আয়লান, মৃত্যুতে পেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। নিহত হয়েছে লাখো শিশু। অমানবিকতার পাষাণ পাথর তাতে নড়েনি। নতুন নতুন দেশে তেল দখলের, ভূমি দখলের, শাসক বদলের আর গণতন্ত্র রপ্তানির যুদ্ধ রপ্তানি চলছেই। শিশু আয়লানের ছোট্ট দেহটি এই যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক অর্থনীতিকেই প্রশ্ন করছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একাত্ম হয়ে কেঁদেছে আয়লানের বাবা আবদুল্লাহর সঙ্গে।

যে চলে গেছে তার যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। যিনি বেঁচে আছেন, আয়লানের সেই হতভাগ্য পিতা এখন রোজ উদ্বাস্তু শিবিরে যান, মানব পাচারকারীদের কাছে যেতে নিষেধ করেন শরণার্থীদের। এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর আরেক প্রতিবেদক শরণার্থী দলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সিরীয়-লিবীয়দের মধ্যে আবিষ্কার করেন এক বাংলাদেশিকে। যুদ্ধের বিশ্বায়ন মৃত্যুরও বিশ্বায়ন ঘটাচ্ছে।
একা এক আয়লান সত্যিই সব বলে গেছে

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

Friday, 16 October 2015

হিজরতের স্মৃতি সমুজ্জ্বল হিজরী সন

হিজরত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মুবারক জীবননেতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করেন। এই হিজরতের ফলে ইসলামের সুদূরপ্রসারী বিজয়ের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এই হিজরতের মাহাত্ম্য বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক যোসেফ হেল বলেছেন : ওঃ রং ধ ঃঁৎরহহু চড়রহঃ রহ ঃযব ষরভব ধহফ ড়িৎশ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ঢ়যবঃ ঃযব মৎবধঃ ঃঁৎহরহম ঢ়ড়রহঃ রহ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ওংষধস- এটা হচ্ছে মহানবী (সা) এর জীবন ও কর্মে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা আর ইসলামের ইতিহাসে মহাদিগন্ত উন্মোচনকারী অধ্যায়।
আমরা জানি, প্রিয়নবী (সা) ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে প্রথম ওহী লাভ করেন। প্রথম ওহী লাভের তিন বছর পর আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর আপনজনদেরকে দীনের পথে আহ্বানের নির্দেশ দেন। গুটিকয়েক ভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া মক্কায় কাফির মুশরিকরা তাঁর হিদায়াত গ্রহণ তো করলই না বরং তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করল। তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের ওপর নেমে এলো অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন। তিনি ধৈর্য ধারণ করে হিদায়াতের বাণী পৌঁছানোর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে বেশকিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তি একে একে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। কাফির মুশরিকদের অত্যাচারের মাত্রা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পেতে লাগল। কাফির মুশরিকরা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটল এবং একদিন রাতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ওঁৎ পেতে থাকল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি হযরত আলী (রা.) কে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে অতি সন্তর্পণে তাঁর কদম মুবারকের বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর ভর করে বেরিয়ে গেলেন। বের হওয়ার সময় এক মুষ্টি ধুলোতে সূরা ইয়াসীনের প্রথম কয়েক খানি আয়াতে কারীমা পাঠ করে ফুঁক দিয়ে তা ওঁৎ পেতে থাকা কাফির-মুশরিককের দিকে ছিটিয়ে দিলেন। কাফির মুশরিকদের শরীরে সে ধুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তন্দ্রাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সন্তর্পণে বের হয়ে এসে হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে নিয়ে ছত্তর পর্বত গুহায় এসে কয়েক দিন থাকলেন। তারপর তিনি মক্কা মুকাররমা থেকে প্রায় ২৯৬ মাইল দূরে অবস্থিত ইয়াসরীব নগরীর উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মক্কা থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি আঁসুসিক্ত চোখে বার বার কা‘বা শরীফের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, হে কা‘বা আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে বের করে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহর যমীনে তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। হে মক্কা, তোমার সন্তানরা আমাকে এখানে থাকতে দিল না। যদি আমার কওম আমাকে তোমার কাছ থেকে চলে যেতে বাধ্য না করত তাহলে আমি আদৌ তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। তিনি আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন আর বার বার চোখের পানি মুছছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব (সা) কে উদ্দেশ করে ইরশাদ করলেন : আপনি বলুন, হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং আমাকে বের করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং তোমার কাছ থেকে আমাকে দান করো সাহায্যকারী শক্তি (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৮০)।
প্রিয় নবী (সা) ইয়াসরীব নগরীর তিন মাইল দূরে অবস্থিত নগরীর প্রবেশ মুখ কুবা নামক স্থানে প্রায় ১৫ দিন পরে এসে পৌঁছলে ইয়াসরীবের মানুষ তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করে। তখন ইয়াসরীবের অধিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। সমগ্র জনতা তাঁকে গ্রহণ করার জন্য সমবেত হয়েছিল। ছোট ছোট বালক-বালিকারাও তাদের মা এবং অন্যরা সমবেত কণ্ঠে সুললিত উচ্চারণে যে কাসিদা পাঠ করেছিলেন তা আজও মিলাদ মাহফিলে পাঠ করা হয়। প্রিয়নবী (সা) কুবাতে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং এখানে স্থাপন করেন একটি মসজিদ যা বর্তমানে কুবা মসজিদ নামে খ্যাত। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল তিনি কুবা থেকে ইয়াসরীব নগরীর উদ্দেশে রওয়ানা হন। বিশাল জশ্নে জুলুস বা আনন্দ মিছিল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসরীবের জনগণ তাঁদের নগরীর নাম করেন মদীনাতুন নবীÑ নবীর শহর, যা আজকের মদীনা মনওয়ারা মদীনা শরীফ সোনার মদীনা।
মদীনা তশরীফ আনায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ওহী লাভ করার পর তাঁর মক্কী জীবনের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ১২ বছর। মক্কী জীবনের এই সময়কালে তাঁকে মুকাবিলা করতে হয়েছে বহু নির্যাতন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ওপরও নেমে এসেছে কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারের জগদ্দল পাথর। এমনকি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবননাশেরও চেষ্টা করা হয়েছে। মদীনায় তাঁর হিজরত করে আসার ফলে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে।
মদীনায় স্থাপিত হয়েছে মসজিদে নববী। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কায়েম হয়েছে। রমাদানের এক মাস সিয়াম পালনের বিধান নাযিল হয়েছে, যাকাত ও হজের বিধানও নাযিল হয়েছে। মদীনায় হিজরতের ফলে ইসলামের বিধি-বিধানসমূহ সামগ্রিকভাবে পালনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে, প্রণীত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র মদীনার সনদ।
মক্কার কাফির মুশরিকরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাফল্য সহ্য করতে পারেনি। তারা বার বার মদীনা আক্রমণ করেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আক্রমণই প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছেন। এক কথায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা সম্ভব হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসার ফলে। যে কারণে হিজরতের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরব দেশে মাস গণনার রীতি প্রচলিত থাকলেও সুনির্দিষ্ট সন বা বর্ষ গণনার রীতি ছিল না বললেই চলে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জন্মের ৫০ দিন পূর্বে ইয়েমেনের জালিম রাজা আবরাহা মক্কায় কা‘বা শরীফ ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে একটি হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে এসে ছাউনি স্থাপন করে। আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু ছোট ছোট পাখি বা আবাবীল পাঠিয়ে আবরাহার বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। কুরআন মজীদে সূরা ফীলে সেই ঘটনার কথা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তুমি কি দেখোনি তোমার রব্ হস্তি অধিপতিদের প্রতি কি করেছিলেন? ওদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছিলেন। যারা ওদের ওপর প্রস্তর কংকর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি ওদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন।
হস্তিবাহিনীর সেই ঘটনার বছর থেকে আরবরা আমুল ফীল বা হস্তিবর্ষ নামে একটি বর্ষ গণনার সূচনা করলেও তা স্থায়িত্ব পায়নি। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রথম ওহী লাভ করেন। তিনি নবুয়ত ও রিসালতপ্রাপ্ত হন। এর স্মরণে মুসলিম মননে নবুওতের প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর, তৃতীয় বছর এমনিভাবে বর্ষ গণনার রীতি কিছুদিন চালু ছিল। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে এলে হিজরতের হিসেবে বর্ষ গণনা চালু হলেও তা বিধিবদ্ধ সন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা আলা আনহুর খিলাফতকালে। জানা যায়, খিলাফতের কাজকর্ম, দলিল দস্তাবেজ, নথি, চিঠি খতিয়ান, ফরমান, রাজস্ব আদায় ইত্যাদি জরুরী ক্ষেত্রে সন-তারিখের গুরুত্ব অনুধাবন করেন।
খলীফা হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা আলা আনহু একটি খাঁটি ইসলামী ক্যালেন্ডার প্রণয়নের নির্দেশ দেন। খলীফাতুল মুসলিমীন আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত আবু মুসা আল আশআরী রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুর একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একটি নিজস্ব সন তারিখের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। একটি নতুন সনের উদ্ভাবনের বিষয়ে তিনি বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। এই নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশদ আলাপ আলোচনা হয়। হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরামর্শে তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য যে সনটি প্রবর্তন করলেন সেই সনটিই হিজরী সন। এতে প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে প্রচলিত বারোটি মাসই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মুনওয়ারায় হিজরত করেন। কিন্তু আরবে প্রচলিত মাসগুলোর প্রথম মাস হচ্ছে মুহররম যে কারণে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মুহররমকেই নববর্ষের প্রথম তারিখ ধরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। ঠিক এ সময়টাতেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরী সনেরও আগমন ঘটে। হিজরী সন বিশ্ব মুসলিম মননে অতি পবিত্র সন হিসেবে গণ্য হয়। তার কারণ এই সনের মুহররম মাসের দশ তারিখে পালিত হয় আশুরা, সফর মাসের শেষ বুধবারে পালিত হয় আখেরী চাহার শম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী, ১১ রবিউসসানী পালিত হয় ফাতেহায়ে ইয়াযদহম, ২৭ রজব রাতে পালিত হয় শবে মিরাজ, ১৫ শাবান রাতে পালিত হয় শবে বরাত, মাহে রমাদানের এক মাস পালিত হয় সিয়াম, ২৭ রমাদান রাতে পালিত হয় শবে কদর, শাওয়াল মাসের ১ তারিখে পালিত হয় ঈদুল ফিতর, জিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত পালিত হয় হজ, ১০ জিলহজ পালিত হয় ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ।
হিজরী সনের প্রতি মাসের সূচনা হয় চন্দ্র উদয়ের মাধ্যমে। এই চাঁদ দেখার মধ্যেও এক আনন্দ বৈভব রয়েছে। বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখা রীতিমতো এক সাংস্কৃতিক উপাদানে পরিণত হয়েছে। হিজরী সনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই সন মুসলিম জাহানের সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত।

লেখক : অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউ-েশন বাংলাদেশ

Thursday, 24 September 2015

আত্মোৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জনে কোরবানি

কোরবানি শব্দের অর্থ হলো আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, নৈকট্য অর্জন ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয় জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। কোরবানি প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘সব সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান (নিয়ম) দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা: হজ, আয়াত: ৩৪) কোরবানি মানব ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে চলে আসা একটি ইবাদত, যা মূলত স্রষ্টার উদ্দেশে সৃষ্টির নজরানা।
মানব ইতিহাসের প্রথম কোরবানিদাতা হলেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল (রা.) ও কাবিল। বাবা আদম (আ.) বললেন, তোমরা আল্লাহর নামে কোরবানি করো, যার কোরবানি কবুল হবে, তার দাবি গ্রহণযোগ্য হবে। অতঃপর তারা উভয়ে কোরবানি দিলেন। হাবিলের কোরবানি কবুল হলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা রাসুল (সা.)–কে বলেন, আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না।...অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন। (সূরা: মায়িদা, আয়াত: ২৭) এতে প্রতীয়মান হয়, কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া, অর্থাৎ খোদাভীতির প্রয়োজন। লোকদেখানো কোনো ইবাদত আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
আজকের মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রথা চলমান আছে, এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? এটা কোথা থেকে এসেছে?’ প্রিয় নবী (সা.) উত্তরে বললেন, ‘এটা হলো তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত বা আদর্শ। এই আদর্শ অনুসরণের জন্যই আল্লাহ পাক তোমাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে?’ উত্তরে মহানবী (সা.) বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমে তোমরা একটি করে নেকি পাবে।’ সাহাবায়ে কেরাম বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা যদি ভেড়া কোরবানি করি? ভেড়ার তো অনেক বেশি পশম, এর বিনিময়েও কি আল্লাহ আমাদের সওয়াব দেবেন?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর ভান্ডার অফুরন্ত। কেউ যদি তাকওয়ার সঙ্গে আল্লাহর নামে ভেড়া কোরবানি করে, তাহলে তার বিনিময়ে তাকে সে পরিমাণ সওয়াব আল্লাহ অবশ্যই দান করবেন।’
কোরবানির ইতিহাস পবিত্র কোরআনে এভাবে বিবৃত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক সহিষ্ণু পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে আমি জবাই করছি, তোমার অভিমত কী?” সে বলল, “হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” যখন তাঁরা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলেন! এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখে দিলাম। ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্য অভিবাদন! আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা।’ (সূরা: সাফফাত, আয়াত: ১০০-১১০)
প্রতিটি মানুষ ইবাদত করবে শুধু তার মহান মালিক আল্লাহ তাআলার। মুমিন বান্দা তার কোনো ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করবে না। অর্থাৎ ইবাদত হতে হবে সব ধরনের শিরকমুক্ত, শুধু এক আল্লাহর উদ্দেশে। মহান রাব্বুল আলামিন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে সে শিক্ষাই দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে: ‘বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।’ এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল কোরবানি শুধু আল্লাহর উদ্দেশেই হতে হবে। লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশে নয়। সুতরাং কেউ যদি লাখ টাকার গরু দিয়ে লোকদেখানোর জন্য অথবা নিজের দম্ভ-অহংকার প্রকাশের জন্য কোরবানি দেয়, তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা: হজ, আয়াত: ৩৭)
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্বাস্থ্য-চেহারা ও ধন-সম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি। সুতরাং কোরবানির আগেই কোরবানিদাতার নিয়ত বা সংকল্প শুদ্ধ করে নিতে হবে।
কোরবানি ইসলামি ঐতিহ্য। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, কোরবানি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। এখানে সুন্নত অর্থ তরিকা বা পদ্ধতি, আদর্শ বা অনুসৃত বিষয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘ফা ছল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সূরা: কাওসার, আয়াত: ২)। এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কোরবানি একটি ওয়াজিব (আবশ্যিক) বিধান। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে-কাছে না আসে। (ইবনে মাজা)
কোরবানির তিন দিনে (১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত) যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এ উভয়ের যেকোনো একটির মূল্য সমপরিমাণ ব্যবসাপণ্য বা নগদ অর্থ) থাকে, কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব। যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, একান্ত অপারগ না হলে কোরবানি করা তাদের জন্যও উত্তম। কারণ, হাদিস শরিফে আছে, কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল আর নেই। কোরবানির রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হয়ে যায়।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) জীবনের পড়ন্তবেলায় প্রিয় সন্তান, কলিজার টুকরা শিশু ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর নির্দেশে তাঁর রাস্তায় কোরবানির মাধ্যমে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী অনন্য যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, আল্লাহ তাআলার কাছে তা পছন্দ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত কোরবানিকে পরবর্তীদের জন্য অনুসরণীয় করে দেন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে এবং শিখতে পারে যে অর্থ-সম্পদ, টাকাপয়সা আল্লাহর রাস্তায় কীভাবে ব্যয় করতে হয়। এমনকি প্রয়োজনে আল্লাহর জন্য জীবন দিতেও যেন মানুষের কোনো দ্বিধা-সংশয় না থাকে। তা ছাড়া কোরবানি আত্মত্যাগের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। মানুষের ষড়্রিপু তথা হিংসা, লোভ, কাম, ক্রোধ, ত্যাগের মাধ্যমে মনের পশুবৃত্তি তথা কুপ্রবৃত্তিকে জবাই করতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে ধনলিপ্সা, যশলিপ্সা, লোভ-লালসা, জাগতিক কামনা-বাসনা ও দুনিয়াপ্রীতিকে কোরবানি করে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জন করা কোরবানির শিক্ষা।
ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা, সকালে গোসল করা, মিসওয়াক করা, সম্ভব হলে নতুন জামা অথবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পরিধান করা, আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা, ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া এবং অন্য রাস্তায় ফিরে আসা, আসা-যাওয়ার সময় তাকবির তাশরিক (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ) বলা, খোলা মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করা ইত্যাদি।
কোরবানির গোশত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা সুন্নত এবং অতি উত্তম আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে প্রকৃত মুমিন নয়, যে নিজে পেটপুরে খায় কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (তিরমিজি)

@ মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com

Friday, 18 September 2015

মুসলিম শরণার্থী বিষয়ে বয়ান হোক মিনায়

হজ ও কোরবানির ত্যাগের এ সময় একসময়ের সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক ও সিরিয়ার মুসলমানদের শরণার্থী হয়ে আপনভূমি ত্যাগ করে ইউরোপীয় দেশে চলে যাওয়ার দৃশ্য মুসলিম-অমুসলিম সারা দুনিয়াকে হতবাক করেছে। একসময় যে দেশের মানুষ লাব্বাইকা বলে কাবার পথে পাড়ি জমাত, তারা কেন আজ ইউরোপের দুয়ারে উদ্বাস্তু হল- মুসলিম দুনিয়ার কাছে এটাই আজ জিজ্ঞাসার বিষয়। আরব বিশ্ব, আরব লীগ, ওআইসি’র নীরবতা মুমিনের অন্তরকে ব্যথাতুর করে দিচ্ছে। আমরা জানি না, যে উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) উকুফে আরাফার প্রবর্তন করেছিলেন তার আলোকে এবারের আরাফার ময়দানে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হবে কিনা! মিনার ময়দানে কোরবানির দীক্ষা নিয়ে বিপদগ্রস্ত মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয়দানে কোনো ধনবান মুসলিম রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে কিনা? এ দেশের অনেক বুজুর্গই মনে করেন, মুসলমানদের ওই মহাসম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য আসা উচিত। যদি না হয় তবে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, চলমান হজ, মানবতা এবং আমাদের কোরবানি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এমনকি অনেক মুসলমানের মনেও নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে।

আপনজনকে কোরবানি দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হিসেবে হজরত ইবরাহিম (আ.) জগতের সবচেয়ে পরিচিত নবী। কোরবানি ছাড়াও তিনি মহান রবের পক্ষ থেকে আরও অন্তত ৪০টি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং সবক’টিতেই সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধি লাভ করেন। মুসলমান ছাড়াও অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের কাছে তিনি জাদ্দুল আম্বিয়া বা বহু নবীর পূর্ব পুরুষ হিসেবে খ্যাত। ১০ জিলহজ পশু জবাইয়ের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায় যে কোরবানি উদযাপন করে তার সঙ্গে হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.)-এর কোরবানির একটি বিশেষ যোগসূত্র আছে। হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি জগতের কাছে স্মরণীয় করার জন্য পরবর্তী উম্মতদের কাছে কোরবানির বিধান চালু রাখা হয়েছে; যেন মানুষ নিজের পশুত্বকে কোরবানি করে মানবতাবোধে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা পেতে পারে। বিদায় হজে রাসূল (সা.) ১০০টি উট কোরবানি করেন এবং এর মাধ্যমেই ৪০০০ বছর আগের ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।
পশু জবাই করার বিধানকে আজকাল অনেক মুসলমানও ‘পশুহত্যা’ এবং পশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা মনে করে। কোরআনিক নির্দেশনা সত্ত্বেও ইসলামের বিধান সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। ১৩২৭ সনে শ্রাবণ মাসে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের লেখা নিবন্ধে কোরবানির পশু জবাইকে পশুহত্যার সঙ্গে তুলনা করলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘কোরবানী’ কবিতা রচনার মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য বছরের বাকি দিনগুলোতে যে পশু জবাই করা হয় তার সংখ্যা ঈদুল আজহার চেয়ে অনেক বেশি। এসব যুক্তি উত্থাপন করে কবি নজরুল ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রশ্ন করেন, বছরের অন্যান্য দিনে পশু জবাই হয় সে ব্যাপারে কোনো নিবন্ধ লিখেছেন কিনা।
কোরবানির ঈদ আসে বছরে একবার। তাশরিকের দিনগুলোতে (১০, ১১ ও ১২ জিলহজ) হাজীরা মিনার ময়দানে কোরবানি দিয়ে থাকেন। এটি হজেরই অংশবিশেষ। হাজীদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একযোগে সারা মুসলিম দুনিয়ায় কোরবানির অনুষ্ঠান পালন করার অর্থ হল মুসলমানদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জাগ্রত করা। কিন্তু মুসলমানরা সে ত্যাগের স্পৃহা ও ভ্রাতৃত্বের প্লাটফর্ম আজও গড়ে তুলতে পারেনি। হজে না গিয়েও হজ কবুল হওয়ার কথা বিভিন্ন কিতাবাদিতে লেখা আছে। মানবতাবোধে উজ্জীবিত সেসব কাবার পথিকরা অপরের কল্যাণে নিজের প্রয়োজনকে কোরবান করতে পেরেছিলেন। আমরা সে ত্যাগ ও কোরবানি থেকে দূরে সরে গেছি। আমাদের হজ ও কোরবানি আজ কেবল আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে।
একশ্রেণীর মুসলমান কোরবানির ঈদে পশু কেনা ও পশু জবাইয়ের ঝামেলা এড়িয়ে চলে, তারা বরং পরিবারসহ ভ্রমণে লিপ্ত হয়। এদের মধ্যে অনেকেই আবার সমপরিমাণ অর্থ কোরবানির পরিবর্তে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে চায়। ব্যক্তিপর্যায়ের এসব উদ্যোগ কস্মিনকালেও ইসলামে অনুমোদনযোগ্য নয়। অবৈধ উপার্জনের নেশায় মত্ত আরেক শ্রেণীর মুসলমান নিজের স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও পশুসুলভ বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করতে পারে না, তারা বরং দামি ও হৃষ্টপুষ্ট পশু কেনার দৃশ্যমান প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। জবাইকৃত পশুর বড় বড় টুকরা বিজ্ঞানের বদৌলতে আর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ডিসকাউন্টের সুবাদে কেনা ডিপ ফ্রিজে জমানোর প্রতিযোগিতাও চলে। কোরবানিকৃত মাংস তিন ভাগ করে দুই-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার রেওয়াজ নিকট অতীতেও ছিল। আল্লাহর জিয়াফত হিসেবে খ্যাত কোরবানির ঈদে সে রেওয়াজ এখন আর চোখে পড়ে না। মঙ্গাপীড়িত, অনগ্রসর ও দরিদ্রকবলিত এলাকার মানুষ যারা ৫০০ টাকা কেজি দরে মাংস কিনে পুষ্টির জোগান দিতে পারে না, তাদের জন্য কোরবানির ঈদ এক আশার প্রতীক। কিন্তু যাদের প্রতি মহান আল্লাহ ত্যাগের (কোরবানি) নির্দেশ দিয়েছেন তাদের স্বার্থবাদিতা ও কুস্বভাবের কারণে গরিবরা চরম আশাহত হয়ে ফিরে যায়। কবি নজরুল এজন্য বলেছিলেন-
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ হালাল অর্থে কেনা পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজের পশুসুলভ চরিত্র ত্যাগ করে অপরের কল্যাণে উৎসর্গ করার সওগাত নিয়ে কোরবানির ঈদ বছর ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয়। কিন্তু আমরা সে শিক্ষা নিতে পারি না। বরং অনেক সময় পশুর চেয়েও হীনতর কাজ করে বসি। তখন তার বাহ্যিক পশু জবাই এক ভোগ-বিলাসের উৎসব, মাংস ভক্ষণ আর লৌকিকতার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। কাজেই, স্বার্থত্যাগের দৃঢ়তা ও স্পৃহা যে কোরবানির মাধ্যমে অর্জিত হয় বাস্তবজীবনে তার প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করে একজন হাজী কিংবা একজন মুমিনের পরহেজগারী ও তাকওয়া।

লেখক : মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন, ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক ।

Wednesday, 9 September 2015

শরণার্থী সংকট : যে কারণে উপসাগরের আরবরা নীরব


ইউরোপের পথে পথে সিরিয় শরণার্থী ঢলের ছবি দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে আরব দেশগুলো এদের জন্য কী করছে?
বিশেষভাবে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল বা জিসিসিভূক্ত দেশ – সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত – তাদের দরোজা এসব শরণার্থীর জন্য বন্ধ রেখেছে বলে অনেকেই এখন ক্ষুব্ধ।
যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস-এর মাইকেল স্টিভেন্স এক নিবন্ধে লিখছেন, তবে এত সমালোচনার পরও জিসিসি দেশগুলো সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য কিছুই করেনি এটা বলা যায় না।
ব্যক্তি পর্যায়ে এরা অনেক কিছুই করছেন। যেমন, কাতার পেট্রোলিয়াম-এর কর্মচারিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাদের বেতন থেকে প্রতি মাসে তারা কিছু অর্থ সিরিয় শরণার্থীদের জন্য দান করবেন।
দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলো এপর্যন্ত মোট ৯০ কোটি ডলার দিয়েছে।
কিন্তু খাদ্য বা ওষুধপত্রের মত সাহায্যের বাইরে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার প্রশ্নে আরব দেশগুলো বেশ নীরব। এর পেছনে কারণ কী?
স্থিতিশীলতা হারানোর ভয়
উপসাগরীয় দেশগুলো সিরিয়দের ঢুকতে দিয়েছে মূলত অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে। সৌদি আরব বলছে ২০১১ সাল থেকে তারা মোট ৫,০০,০০০ সিরিয় নাগরিককে চাকরি দিয়েছে।
কিন্তু দলে দলে শরণার্থী এসে হাজির হলে তারা কী করবে? উপসগারীয় দেশগুলিতে এ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই।
এর পেছনে একটা ব্যাখ্যা সম্ভবত হতে পারে এই যে এসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হারানোর প্রশ্নে একটা গভীর শঙ্কা কাজ করে।
২০১২ সালে সিরিয়ার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সুন্নি-প্রধান উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ইরান-পন্থী সিরিয় গোষ্ঠীগুলোর একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
বিশেষভাবে সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমীরাতের আশঙ্কা প্রেসিডেন্ট আসাদের অনুগত দলগুলো উপসাগরীয় দেশগুলোতে ঢুকে পড়ে গোলযোগ তৈরি করতে পারে।
জনসংখ্যার ভারসাম্য
হাজার হাজার সিরিয় শরনার্থীকে দেশে ঢুকতে দিলে উপসাগরীয় দেশগুলোর জনসংখ্যার ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে বলে একটা আশঙ্কা রয়েছে।
ইউএই এবং কাতারের নাগরিকদের মোট সংখ্যা এই দুটি দেশে যত বাসিন্দা রয়েছেন তার মাত্র ১০%। বাদবাকি সবাই বিদেশি।
পূর্ণকালীন চাকরির অনুমতি থাকলেই কেবলমাত্র বিদেশিদের এসব দেশে ঢুকতে দেয়া হয়। আর এই পদ্ধতির মাধ্যমেই উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের নাগরিকদের প্রাধ্যাণ্য বজায় রাখে। তা না হলে প্রতিবেশী আরব দেশ কিংবা দক্ষিণ এশীয় শ্রমিকরা এসে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
রাজনৈতিক আলোচনার অভাব
কাজের বৈধ অনুমতি ছাড়া, কিংবা নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই, হাজার হাজার বিদেশি চলে আসছে -- এই ভাবনাটাই উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য চরম অস্বস্তির ব্যাপার।
সিরিয়ান শরণার্থীরা উপসাগরীয় দেশগুলোর সামাজিক গঠনের প্রতি যে হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারেন, তার মোকাবেলা করার মত কোন পরিকল্পনা এই দেশগুলোর নেই।
আর পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্য কোন দেশ এই শঙ্কা দূরে করতে পারবে এমন সম্ভাবনাও কম।
উপসাগরীয় দেশের ক্ষমতাসীন রাজপরিবারগুলোর ওপর জনমতের প্রভাব যথেষ্ট সীমিত। ফলে সে ধরনের কোন চাপও যে খুব একটা কাজ করবে এমন সম্ভাবনাও কম। সূত্র : বিবিসি।

www.kalerkantho.com/online/world/2015/09/08/266159#sthash.GXqmJ1dG.dpuf

Saturday, 5 September 2015

Germans Welcome Migrants After Long Journey Through Hungary and Austria

MUNICH — Germans waving welcome signs in German, English and Arabic came to the train station here Saturday to greet the first group of what is expected to be about 8,000 migrants to arrive in Germany by early Sunday, after an arduous and emotional journey through Hungary and Austria.

Germans applauded and volunteers offered hot tea, food and toys as about 450 migrants arrived on a special train service from Austria, finally reaching Germany, which had held out an open hand to them.

“Thank you, Germany,” said one woman from the Kurdish part of northern Iraq who said she had been on the road for a month and a half with her two children. A German volunteer, Silvia Reinschmiedt, who runs a local school, could not stay at home. “I said to myself, I have to do something,” she said as she handed out warm drinks.

By Saturday evening, about 6,000 migrants had arrived here, and another 1,800 were expected to arrive in trains overnight, according to the German police.

It was the desired destination for an extraordinary march of migrants, who broke through Hungarian obstacles and reached Austria on Saturday morning after a night of frantic negotiations among German, Austrian and Hungarian officials cleared the way.

Overnight, some 4,500 exhausted migrants were bused to the Austrian border by a Hungarian government that gave up trying to stop them and instead decided to help them travel in safety. That help was temporary, however, as Hungary found itself struggling to cope with a new influx of migrants.

The arrival in Germany of the migrants was the culmination of 10 days of tragedy and emotion that at last caught the world’s attention, as war and chaos in Syria and elsewhere in the Middle East set off one of the largest emigrations since World War II.

The standoff in Hungary seemed to encapsulate the long and often deadly journeys that hundreds of thousands of people have made to try to reach some semblance of peace, security and prosperity in a Europe that, for the most part, did not much want them.
Even as the thousands made it to Austria on buses provided by the Hungarian government, on Saturday morning a new group of about 1,000 migrants set off on foot from the Budapest train station, Keleti, on their own march to the border.

At the same time, at least 2,000 more migrants were caught trying to enter Hungary on Friday alone, and Janos Lazar, chief of staff to Prime Minister Viktor Orban, said that Hungary would work to complete its border fence to stop further illegal entry.

Zoltan Kovacs, a government spokesman, told the state news agency that Budapest was not planning to send any more buses to Austria. The Hungarian authorities, worried that easing the migrants’ journey would just encourage more to attempt the passage, said Saturday that they would stick to their understanding of European regulations and try to stop and register new migrants, again leaving thousands stranded.

The drama highlighted some serious policy questions for European foreign ministers meeting in Luxembourg on Saturday. How many migrants would be welcome and for how long? How much has Germany’s “open door” encouraged more migrants to embark on the often-treacherous journey?

The meeting of the foreign ministers produced little agreement; the bloc’s foreign policy chief, Federica Mogherini, described the talks as “difficult.” Europe’s migrant crisis is “here to stay,” she said, and nations must act together. “In three months’ time, it will be other member states under the focus, and in six months, it could be again others,” she said.

The European Union, which operates by consensus among its 28 member states, is debating what to do, but considerable resistance remains among central European states like Poland, Slovakia and the Czech Republic, as well as from Britain, to accepting mandatory quotas of migrants, as France and Germany have proposed.


Chancellor Angela Merkel of Germany has been praised for her moral leadership for saying that all Syrian migrants would be allowed to come to Germany and apply for asylum.

But some have argued, like Mr. Orban and Prime Minister David Cameron of Britain, that simply opening the European door will cause many more thousands of migrants and asylum seekers to abandon refugee camps in Jordan, Lebanon and Turkey, and embark on the hazardous and expensive journey to Europe, promoting more people smuggling, and not less.

The Germans themselves emphasized that allowing the migrants to pass through without following European Union rules and registering in a European country through which they had already passed was a one-time response, and no permanent solution to the migrant wave. Neither Austria nor Germany were open for all refugees seeking a way out, an official said.




But Georg Streiter, a deputy spokesman for Ms. Merkel, said that Germany and Austria had decided late on Friday to allow migrants stranded in Budapest to enter their countries and apply for asylum there.

According to figures from the United Nations High Commissioner for Refugees, about 49 percent of the 320,000 or so migrants who have reached Europe this year are from Syria and only 3 percent from Iraq. About 12 percent are from Afghanistan and 8 percent from Eritrea.

In 2014, only about 45 percent of asylum applications made to European governments had a positive outcome — at least half were turned away for not being legal refugees but illegal migrants.


The European Union bureaucracy is trying to come up with a plan to set up reception centers for migrants in Greece and Italy, where they can be cared for and screened. The officials are also drawing up a plan to distribute up to 160,000 migrants and asylum seekers. But the countries must agree.

European interior ministers will meet on Sept. 14 to discuss the proposals and a summit meeting of bloc leaders is likely to follow — unless one is called sooner under the pressure of events.

“This has to be an eye-opener on how messed up the situation in Europe is now,” said the Austrian foreign minister, Sebastian Kurz. “I hope that this serves as a wake-up call that this cannot continue.”
The Austrian interior minister, Johanna Mikl-Leitner, appealed to the rest of Europe to help shoulder the burden of the mass influx and vowed that Austria would not use force against any migrant, all of whom would be welcome to apply for asylum there. But only 10 have done so thus far, she said. “The others want to continue, primarily to Germany,” she said.

All day Friday, migrants were pleading with Hungarian officials to restore international train service that would allow them to travel to Austria, so they could continue their journey to Germany. But train service was suspended, and the only transportation being provided to the migrants was to reception camps, where they would then be registered. Under European rules, they would then have to apply for asylum in Hungary, not the country of their choice.

Late Friday night, the Hungarian attitude appeared to have changed. With a main highway blocked by a defiant march of some 1,000 migrants who had decided to walk to Austria and then, if necessary, to Germany, and the railways closed, the country was on the brink of a shutdown.

In an abrupt about-face, the Hungarians provided dozens of buses from the Keleti station, where thousands were camped out in a subterranean series of passageways, as well as to the marchers on the highway. Altogether, they provided 104 buses for some 4,500 people.

The early morning scenes at the Austrian border at Nickelsdorf were chaotic, with the Hungarians making the migrants walk the final distance to the border, about 500 yards, in the rain.

By about 10 a.m., five trains with 400 migrants each had already left the border for Vienna and Salzburg.

After late-night negotiations between Austria and Germany, these migrants were to be offered the choice of remaining in Austria to file for asylum or to go to Germany to do the same.

The migrant encampment that had formed outside the Keleti station in Budapest on Saturday had shrunk to a quarter the size it had been before, but then people continued to arrive from the Serbian border and other places in Hungary. About 1,000 migrants, some with roller suitcases, others toting plastic bags, wandered around the train station and an underground concourse.


Katrin Bennhold reported from Munich, Steven Erlanger from London, and Alison Smale from Nickelsdorf, Austria. Reporting was contributed by Melissa Eddy from Berlin, Anemona Hartocollis from Vienna, Rick Lyman and Palko Karasz from Budapest.

www.nytimes.com/2015/09/06/world/europe/migrant-crisis-austria-hungary-germany.html?_r=0


Thursday, 3 September 2015

Refugee crisis: David Cameron lowered the flag for the dead king of Saudi Arabia - will he do the same honour for little Aylan Kurdi?

ROBERT FISK


In the ever-growing chasm between the people of Europe and their immoral leaders there is a far more serious challenge for the future

Little Aylan al-Kurdi was part of Dave’s “swarm”. A bit difficult to brush that one off for PR Dave, of course, because Aylan wasn’t black or brown or “blobbed” out by television’s techie-taste dictators, but looked – let’s face it, for this is what it is about – rather like our three-year-olds. He could have been an Alan or a John – or a David. Washed up at Hastings or Bexhill, you can just imagine the demands for a public inquiry by the good citizens of Sussex. But PR Dave had just told us that Britain couldn’t take on “more” Syrian refugees. Sorry, Aylan.

Yet at the risk of catching the Daily Mail cancer, there’s a bit of a wider picture here that we need to be aware of. Europe and the West – what was once called Christendom – are supposed to be the bad guys in the Middle East. It is we who bomb, corrupt and invade the Muslims of the Middle East. It is we who support the vicious dictators of the Middle East (unless they are disobedient to our wishes). It is we who suck out the fossil treasures of the Middle East, its oil and its natural gas. We are, are we not, the infidels?

And true, Syria’s refugees, in their millions, have settled into the squalor of camps on the edges of Lebanon, Turkey and Jordan. But the hundreds of thousands of poor and huddled masses who wish to flee further from their tormentors are not sailing in leaking boats to where you might expect them to go – to the ummah, to Islam’s beating heart, to the land where the Prophet lived and where he received the word of God which is known as the Koran. No, the destitute of the Middle East are not heading for Saudi Arabia , the wealthy kingdoms of the Gulf, to pray for help from the builders of great mosques and the Keepers of Holy Places.

The refugees are not storming ashore on the Red Sea coast at Jeddah, demanding asylum and freedom in the kingdom which supported the Taliban and from which Osama bin Laden sprang. They are not pleading with Saudi border guards to allow them to take the train from Dhahran to Riyadh, to seek solace and safety for their families within the arms of a regime whose Wahhabi-Salafist Sunni faith has provided recruits aplenty for Isis. And, it might be added, those Syrians fleeing Assad rather than his enemies, are not throwing themselves at the feet of the “Islamic Caliphate” whose videoclips reek of death and punishment rather than mercy.

A bit odd, you may say. Historians, indeed, will one day ponder the irony that while Jews in their hundreds of thousands fled Europe for the Middle East 70 years ago, Muslims in their hundreds of thousands are now fleeing the Middle East for Europe. But that’s the point, isn’t it? Why are they coming here?

It’s not because they think we’re a “soft touch”. It’s not because they want to scrounge on our generosity. I suspect it’s because they know enough about Europe and our history and about us – not our tin-pot politicians or Supermarket Dave or the noisy little Labour raptors who are snapping at Corbyn, but about the Germans and French and Italians and Swedes, and yes, the Greeks and even the Hungarians – and, yes indeed, even the British – to know that we are good people, that we are kind people. I think they know that, deep beneath our carapace of cynicism and materialism and our lack of religious faith, the idea of humanism is alive in Europe and that we can be decent, good, thoughtful, honest people.

The implications of all this are extraordinary. It means that despite our slovenly and cowardly leaders, our crazed Blairs, our Supermarket Daves, our silly Milibands and our crackpot East European Euro-allies, we are an honourable and humane society. I’m not just talking about the Angel of Germany but of the German volunteers, some of them unemployed, who are feeding and welcoming the refugees in Berlin. I’m referring to the 20,000 Hungarians who marched in support of those distraught foreigners who had arrived at our European frontiers. I’m pointing to the French men and women who are helping to feed Dave’s “swarm” as they rot in the “jungles” of Calais. I’m thinking of the young Médecins Sans Frontières workers with whom I travelled to the Greek-Macedonian border, who handed out food and water and clothing and kindness to the families from Aleppo and Idlib and Deraa – yes, and from Kandahar and Peshawar – for whom the refugees were rather like three-year old Aylan on his golden beach: for these young Europeans, the refugees were just like us. In fact, “they” were “us”.

In the darker and ever growing chasm between the people – the electors – of Europe and their cringingly ambitious and immoral leaders (Merkel excepted, of course), there is a far more serious challenge for the future. What happens when we realise that our representatives don’t represent us? What happens when we recall that PR Dave lowered the British flag for the dead king of Saudi Arabia. Will he – in our name, at least – perform the same honour for little Aylan?

www.independent.co.uk/voices/comment/refugee-crisis-david-cameron-lowered-the-flag-for-the-dead-king-of-saudi-arabia--will-he-do-the-same-honour-for-little-aylan-kurdi-10485261.html

Saturday, 18 July 2015

‘নায়ক আমরা নই, নায়ক মুক্তিযোদ্ধারা’

ছোট্ট একটা দেশ। ১৬ কোটি মানুষ। কিন্তু নায়ক কোথায়? কোথায় আশার আলো? মানুষের আশার, আকাঙ্ক্ষার, স্বপ্নের যাবতীয় বিনিয়োগ এখন ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের ঘিরে। ক্রিকেট দল জিতলে পুরো বাংলাদেশ জেতে। ক্রিকেট দল হারলে যেন পুরো বাংলাদেশ মুষড়ে পড়ে।
বাংলাদেশের মানুষদের এই আবেগকে বরাবরই শ্রদ্ধা করেন ক্রিকেটাররা। কখনো কখনো তাঁদের জাতীয় বীর হিসেবে তুলনা করা হয়। এটাও শ্রদ্ধার সঙ্গেই মেনে নেন। তবে মাশরাফি বিন মুর্তজা খুব বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলেন, দিন শেষে তাঁরা আসলে ‘এন্টারটেইনার’। মানুষকে বিনোদন দেওয়াই তাঁদের কাজ। বীর বা নায়ক তাঁরা নন। সত্যিকারের নায়ক একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা।
মাশরাফি আজ তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমাদের নিয়ে কিছু মোহ তৈরি হয়েছে। সেই মোহ আজ আমি ভেঙে চূর্ণ করে দিতে চাই। আমরা কিন্তু এন্টারটেইনার, বিনোদন দেওয়া আমাদের কাজ। আমরা নায়ক নই। সত্যিকারের নায়ক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীর লড়াকুরা। জাতির জন্য আমরা এমন কিছু আত্মত্যাগ করি না, যেটা করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আমাকে ভুল বুঝবেন না। ক্রিকেটই সবকিছু নয়। আমরা শুধু চেষ্টা করে যাই এই জাতির মুখে হাসি ফোটানোর।’
প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ করে চলা মাশরাফি আজ আরও একটি অসাধারণ কথা বলে মানুষের মন জিতে নিয়েছেন। তিন ঘণ্টার মধ্যে তাঁর সেই পোস্টে এক লাখেরও বেশি মানুষ লাইক দিয়ে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। ২ হাজারেও বেশি মন্তব্যও পড়েছে। এঁদের একজন আরেফিন শিমন লিখেছেন, “মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্যই হিরো। কিন্তু আরও কিছু মানুষ আছে এ দেশে, যাঁদের জন্য দেশের নাম উজ্জ্বল হয়। সেটা যে ক্ষেত্রেই হোক। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আপনারা হলেন সেই হিরো। হ্যাঁ আপনিও আমাদের হিরো মাশরাফি ভাই। আপনাদের জন্যই আজ আমাদের ‘ছোট দল’ বলে ডাকা লোকগুলোর মুখ কালো হয়ে গেছে। আমরা যে ছোট না তা বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনারাই। এটাও হিরোদেরই কাজ।”

Wednesday, 1 April 2015

জামায়াত যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার নেই


টানা অবরোধের ৬৬ তম দিনে এই লেখা লিখছি। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই জানতে চান, দেশে যা বলছে তার শেষ কোথায়, কীভাবে? কিন্তু এ জিজ্ঞাসার জবাব কে দেবেন বা দিতে পারবেন, আমার জানা নেই। ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের অবরোধ চলছে। এর সঙ্গে সপ্তাহে ‘তিন যোগ দুই’ দিন থাকছে হরতাল। পাঁচ দিনের হরতাল একবারে না ডেকে প্রথমে রবিবার ভোর ছয়টা থেকে বুধবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত; পরে আবার বুধবার ভোর ছয়টা থেকে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত– এ রকম ভেঙে ভেঙে ডাকা হচ্ছে।

এভাবে হরতাল ডেকে কী রাজনৈতিক ফায়দা হচ্ছে সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। এর তাৎপর্য কেবল খালেদা জিয়াই হয়তো জানেন। দেশের মানুষ কি বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধ-হরতাল মেনে নিচ্ছে? রাস্তায় বের হলে অবরোধ-হরতালের ছাপ কতটুকু দেখা যায়? নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা না-হওয়া ছাড়া হরতাল-অবরোধের কারণে আর কিছু বন্ধ থাকছে কি? এমন ফ্লপ রাজনৈতিক কর্মসূচি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় বিস্ময়কর ঘটনা আর কী হতে পারে!

দেশে প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক– এই দাবির প্রতি যত মানুষের সমর্থন আছে, এই দাবি আদায়ের জন্য অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচির প্রতি সমর্থন তার খুব কম অংশেরই আছে। কারণ এসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় দেখা যায় না। রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যানবাহনে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। রেল লাইন তুলে ফেলা হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ‘গণতন্ত্র উদ্ধারের চলমান’ আন্দোলনে ১২১ জন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ চিরদিনের মতো না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। এখনই এই সহিংস অবরোধ-হরতাল বন্ধ না হলে মৃত্যুর মিছিলে হয়তো আরও অনেককেই শামিল হতে হবে।

এখনই এই সহিংস অবরোধ-হরতাল বন্ধ না হলে মৃত্যুর মিছিলে হয়তো আরও অনেককেই শামিল হতে হবে, কারণ অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চললেও ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। প্রথমদিকে রাজধানী ঢাকার বাইরে এসবের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও, দিন যত যাচ্ছে ততই দেশের প্রায় সর্বত্র হরতাল-অবরোধ শিথিল হয়ে পড়ছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার ভয় উপেক্ষা করে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ঢাকার বাইরেও প্রতিদিনই বাড়ছে। ঢাকায় তো রীতিমতো যানজট দেখা যাচ্ছে।

শুধু কি সাধারণ মানুষই এসব উপেক্ষা করছে? বিএনপি নেতারাও নিজেদের ডাকা অবরোধ-হরতাল মানছেন না। ‘হরতালে সব চালু বিএনপি নেতাদের’ শিরোনামে দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ ১২ মার্চ প্রধান প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:

‘‘সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় টানা অবরোধ ও ঘন ঘন হরতাল ডাকলেও জোটের প্রধান শরিক বিএনপি নেতাদের হরতাল-অবরোধ পালনের কোনো বালাই নেই। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, পরিবহন, দোকানপাট, অফিস-প্রতিষ্ঠান– সবই চালু রয়েছে। অথচ অবরোধ-হরতালের নামে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে পেটের দায়ে, জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামা নিরীহ মানুষকে। পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।’’

প্রতিবেদনে বিএনপি নেতাদের কোন কোন শিল্পকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবহন স্বাভাবিকভাবে চলছে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির জেলা পর্যায়ের একজন নেতা ‘যেসব বিএনপি নেতার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে তাদের সশরীরে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রকৃত নেতাকর্মীরা আজ জেল-জুলুম ও হুলিয়ার শিকার। অথচ যারা নমিনেশন আনার জন্য টাকা-পয়সা খরচ করে দৌড়ঝাঁপ করেন, তারা আন্দোলন-সংগ্রামে তো থাকেনই না, বরং তাদের মিল-কারখানা খোলা রয়েছে। এটা তাদের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড।’

বেগম জিয়া এবং তাঁর উপদেষ্টারা কেন এটা বুঝতে পারছেন না যে, পেট্রোল বোমা, ককটেল ফাটিয়ে, সন্ত্রাস করে দাবি আদায় করা যাবে না। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো সরকার সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করে না, করতে পারে না। বিএনপির আহ্বানে যদি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসত, তাহলে সরকারের পক্ষে অনঢ় অবস্থানে থাকা সহজ হত না। প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেখানে হয় সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ কিংবা সরকারের পেটোয়া বাহিনী হামলা চালায়, অত্যাচার-নির্যাতন করে। আর এবার আমাদের এখানে ‘আন্দোলনকারীরা’ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে, তাদের পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মারছে। সরকারের জন্য এটা আবার বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। তারা সহজেই একে ‘জঙ্গিবাদী কার্যক্রম’ বলে প্রচার করতে পারছে।

নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করায় দেশে-বিদেশে কোনো মহল থেকেই বিএনপির পক্ষে সহানুভূতি পাওয়া সহজ হচ্ছে না। এই অবস্থায় কিছু না পেয়ে খালি হাতে বিএনপি কীভাবে সরে আসবে, এ প্রশ্ন বিএনপি-দরদিরা তুললেও সরকার তাতে কান দিচ্ছে না। তারা যদি এখন বিএনপি-জামায়াতের কাছে নতি স্বীকার করে তাহলে সেটা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি ‘অত্যন্ত বাজে’ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বলা হচ্ছে, মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এই অবস্থায় কেউ কেউ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের কথা বললেও সরকার আলোচনায় বসতে চাইছে না। পেট্রোল বোমা হাতে নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ জিম্মি করে সরকারকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা যায় না। এটা সঠিক রাজনৈতিক কৌশলও হতে পারে না।

প্রশ্ন আসে, সরকার যদি নমনীয়তা না দেখায় তাহলে বর্তমান অবস্থা কি চলতেই থাকবে? এই প্রশ্নের জবাবে এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার সুযোগ নেই। বর্তমান এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলবে না, আবার রাতারাতি এর পরিসমাপ্তিও ঘটবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও বেশি কঠোরতা এবং সক্রিয়তায় বোমাবাজরা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। মাঝেমধ্যে বোমাবাজি চললেও তা এক সময় মানুষের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কত রকম দুর্ঘটনাই তো ঘটতে পারে! মানুষ মারার রাজনীতিকেও একসময় ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবেই হয়তো দেখা হবে। তবে এ মুহূর্তে সরকারকে আরও ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আন্দোলনে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে প্রকাশ্যে কটাক্ষ বন্ধ করে ওদের পিছিয়ে আসার স্পেস তৈরি করে দিতে হবে।

বিএনপি নেতৃত্ব স্বীকার না করলেও এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট যে, তাদের রাজনীতি এখন পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতের প্রভাবে। তাদের মতো একটি বড় দল, যারা নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবি করে, তাদের জামায়াতনির্ভর হয়ে পড়াটা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। দেশে যেসব উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, তাদের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে। এটা নিয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, বিতর্ক করতে পারেন, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। বিষয়টি যারা এখনও অস্বীকার করেন, তারা জেনে বা না জেনে দেশটাকে ভয়াবহ বিপদের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?

ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না
ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না
২০-দলীয় জোটের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে না। কেন এই দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা? রাজনীতি-সচেতন সবারই এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা উচিত। রাজনীতির নামে প্রতিহিংসাপরায়ণতা, আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানোর কারণে মানুষের মনে বিএনপি সম্পর্কে এক ধরনের বিরূপতা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি যারা বিএনপিকে ভোট দেন, তারাও দলটির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছেন না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের ওপর বিএনপির অতিমাত্রায় নির্ভরতার বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে মানুষের সমর্থন যখন স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপির দিকেই যাওয়ার কথা, তারা তখন সাধারণ মানুষের ওপর আস্থা রেখে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা না ভেবে জামায়াত ও বিদেশনির্ভর হয়ে দ্রুত ফললাভের আশায় সন্ত্রাস-নাশকতার হঠকারিতার পথ গ্রহণ করেছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন সুশীল সমাজে এবং আওয়ামী বিরোধী মহলে যতটা অগ্রহণযোগ্য হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে ততটা নয়। ওই নির্বাচন নিয়ে মানুষ মারাত্মক ক্ষুব্ধ হলে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত ও উত্তপ্ত হয়ে উঠত, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। নির্বাচন হওয়া না-হওয়া নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশে যে অরাজক অবস্থা তৈরি করেছিল, সাধারণ মানুষ তা পছন্দ করেনি। নির্বাচন ভালো হয়েছে কী মন্দ হয়েছে, তার চেয়ে মানুষের কাছে বিবেচনার বিষয় ছিল জীবনের নিরাপত্তা, শান্তি, স্বস্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে দেশের বাইরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতার সংকটও অনেকটাই কেটে গেছে। দেশ যখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছিল, তখন অবরোধ-হরতালের মতো সহিংস কর্মসূচি কারও প্রত্যাশিত ছিল না।

জামায়াতের সমর্থন ও সহযোগিতায় সন্ত্রাস-নাশকতার পথে গিয়ে বিএনপি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা নিরাময়ের উপায় তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমেরিকা যার বন্ধু তার যেমন শত্রুর প্রয়োজন হয় না, তেমনি জামায়াত যে দলের মিত্র তার সর্বনাশের জন্য অন্য কারও শত্রুতার প্রয়োজন নেই।

বিএনপি নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে পারবে, দল ও দেশের ততই মঙ্গল।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এসো হে বৈশাখ :- পয়লা বৈশাখ বাঙালির মনের স্টিফেন কথা

নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী রূপান্তরপূর্বক অপভ্রংশ হয়ে "বৈশাখ" শব্দটি এসেছে। বৈশাখ আমাদের হূদয়ের অঙ্গীকারের মাস। হাসি-কান্নার আবর্তে ঝড়ে মন শক্ত হবার মহড়ার মাস। আর হলো সৃষ্টির রুদ্র লগন ও দামাল ছেলেদের কাঁচা-মিঠা আমের মাস এবং মধু মাস জ্যৈষ্ঠের আগমনী সারথী; কিন্তু এ বৈশাখ তথা বাংলা মাসের পিছনে কিছু জানা ও অজানা ইতিকথা আছে, যা বাঙালি হিসেবে জানা একান্ত আবশ্যক। স্মরণকালের অতিপ্রাচীন সেই সব নববর্ষের দিকে যদি ফিরে তাকাই, তাহলে মনের বাতায়নে উদ্ভাসিত হয় যে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে নববর্ষ উদযাপিত হতো, যার স্থায়িত্ব ছিল একটানা এগারো দিন। তাছাড়া পারস্যে নওরোজ নববর্ষ উত্সব কম প্রাচীন নয়। উল্লেখ্য যে, এর আগে আরবী ভাষা-ভাষিরা মুহাররমের প্রথম দিন নওরোজ হিসেবে নববর্ষ পালন করতো, যা অন্তর দিয়ে এখন পর্যন্ত পারস্যবাসীরা ধরে রেখেছে। এদিকে পাঞ্জাবীরা (শিখ) ১ বৈশাখের উপর অতীব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে যে কয়টি অব্দ (সন) প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো- হর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বল্লাব্দ ও গুপ্তাব্দ। এ সকল অব্দই সৌর বত্সর (Solar Year) ভিত্তিক। তবে সুদূর অতীত থেকে ভারতীয় বর্ষপঞ্জি যে দুইটি মৌলিক বিধি মেনে চলছে, তা হলো প্রথমত ফসলী, ধর্মীয় (সনাতনী) ও খাজনা আদায় সংক্রান্ত (এটি যেন ঋতুর নকিব) দ্বিতীয়ত যে কথাটি আসে, তাহলো ঋতুর আওতাধীন অনুষ্ঠানের দিন পল, লগন, প্রহর এবং তিথি দ্বারা স্থিরকৃত।
যাহোক, প্রাচীনকাল থেকে এ অবনীতে সময়-গণনা মানুষের একটি সহজাত (Co-herent) প্রবৃত্তি, যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন আঙ্গিকে নানা সময়ে একক হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। এ বিশ্বে গোষ্ঠী ভিত্তিক অসংখ্য সন ও তারিখ আছে, তন্মধ্যে সচরাচর হাতে গোনা কয়েকটি আমরা জানি। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন শকাব্দ সনের পথ ধরে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বত্, মঘী, নেপাল, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ, পরগণাতি, শাহুর, হিজরী, ঈসায়ী বা খৃস্টীয়, বঙ্গাব্দ, জালালী সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে, আবার কোন কোনটা চান্দ্রবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে। একটু গভীরে যদি যাই, তাহলে দেখি চতুর্থ মাত্রা (4th Dimension of Length, Breadth, Hight & Time) হিসেবে সময় (Time) আছে বলে গতি (Motion) আছে এবং নিউটনের সূত্রের আওতায় যোগ হয়েছে বস্তু (Matter)। সত্য কথা বলতে কি, সময় না থাকলে সবকিছু অচল তথা সীমাহীন ওজন নিয়ে চিরস্থির থাকতো। তখন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে কোন কিছু অর্থাত্ এমনকি "Nothing" বলেও কিছুই থাকতো না। এ বিষয়ে সময়ের ইতিহাস (History of the Time) সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডব্লিউ হকিংস কৃষ্ণ গহ্ববের (Black Hole) আলোকে অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। অবশ্য ইসলামী দশর্নের আলোকে সময় গণনার পিছনে যে, শাশ্বত কথাটি কাজ করেছে, তার সূত্রপাত হয়েছে পবিত্র কালামে, কেননা আল্লাহতালা বিশ্বজনীনভাবে ঘোষণা দিয়েছেন- "আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বছর গণনার মাস হবে বারটি"।
মূলত সনাতনীরা বাংলা সনকে যতটা গুরুত্ব দেন, মুসলিমরা ততটা নয়। যদিও বাংলা সনটির উত্পত্তি হিজরী (Muslim Oriented) সাল থেকে। এ দিকে সন এবং সাল শব্দ যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ থেকে এসেছে এ অঞ্চলে। উল্লেখ্য, ১২০১ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে মুসলীম শাসনের গোড়াপত্তন করলে হিজরী সাল রাষ্ট্রীয় সাল হিসেবে প্রচলিত হয়। উল্লেখ্য যে, তখন রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে হিজরী সালকে গুরুত্ব দেয়া হয়; কিন্তু এতে কৃষাণদের উপর ক্লেশকর ও যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি করে। কেননা চান্দ্র (Lunar) এবং সৌর (Solar) বর্ষের মধ্যে ব্যবধান স্বরূপ প্রতি বছর ১১/১২ দিন এগিয়ে আসার কারণে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কেননা হিজরী সালের ১২ মাস সৌর ৩৬ বছরে একটি চক্র (Circuit) রচনা করে। যাহোক, চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী খাজনা (ভূমি কর) আদায় অথচ ফসল কাটার সময় (Harvesting time) হলো সৌর বছরের অন্যতম শাশ্বত বাস্তবভিত্তিক প্রতিফল। এ জটিল বিষয়টি বিচক্ষণ মহামতী বাদশা আকবর অনুভব করেন এবং তা সুরাহা করার লক্ষ্যে তিনি হিজরী সালের (মহরম প্রথম মাস) পবিত্রতা রক্ষাকরণপূর্বক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অংকশাস্ত্রবিদ আমির ফতেহুল্লাহ্ সিরাজীকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেন। বিচক্ষণ বাদশা আকবর সভাসদসহ (নবরত্ব) ফতেপুুর সিক্রিতে রাজ সভায় বেশ কয়েক দফায় পর্যালোচনা করতঃ সবই ঠিক রাখেন; কেবল ঋতুর সাথে সম্পৃক্ততা রেখে গণনার নির্দেশ দেন এবং তদানুযায়ী বাংলা সনের সূচনা। উল্লেখ্য যে, এ দিন ছিল হিজরী ২ রবিউসসানি, রোজ শুক্রবার, ইংরেজি ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ইং সাল। আর তখন থেকেই প্রকারান্তরে পয়লা বৈশাখের পদচারণা শুরু।

মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব , লেখক :গবেষক
E-mail: abdulbaki85@yahoo.com

হলুদ সবুজ হেমন্তের নেয়ামত


কুয়াশার চাদরে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত শিশিরভেজা ধান ক্ষেতে সূর্যের পরশ। 
হালকা বাতাসের দোলায় চিকচিক করা শিশিরবিন্দু খসে পড়া। ধানের শীষে সারা বছরের খোরাকের বার্তা। এই তো কয়েক দিন পরই কৃষকের ঘরে উঠবে সোনারাঙা ধান। সবুজ ঘাসে শিশিরের কোমল স্পর্শ

সময়ের মালিক সময়কে আবর্তিত করেন; প্রকৃতির গায়ে এঁকে দেন দৃষ্টিনন্দন আল্পনা। সে আল্পনা একেক সময় একেক রূপে উদ্ভাসিত হয়। উদ্ভাসিত সেই অনন্য রূপকে আমরা দেখি নানা ঋতু হিসেবে। ১২ মাসের ছয় ঋতু নিয়ে আমাদের এ বাংলাদেশ। কালের আবর্তনে, প্রকৃতির বিবর্তনে সবুজের চাদরে নেমে আসে ষড়ঋতুর অনুপম রূপবৈচিত্র্য। ছয়টি প্রকৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ছয়টি অনিন্দ্য শিল্পকর্ম। সুন্দরপিয়াসী মনে নিয়ে আসে চঞ্চলতা। বোধের দিগন্তে হেসে ওঠে অনন্ত রূপের আধার ও রূপ-রস-ছন্দ-আনন্দের মালিকের অলোক সক্ষমতা। ঘোরলাগা অনুভবে ভাবুকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, 'তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর/না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর...'

এ সময়ের পালাবদলে প্রকৃতিতে আসে হেমন্তকাল। হেমন্ত হলুদের কাল, সবুজের কাল, মৌ মৌ আমন ধানের আগমনীর কাল। হলুদ চাদরে ঢাকা প্রকৃতির কাল। প্রভাতে সূর্যের কিরণে ধান গাছের সুচালো অগ্রে শিশির নামা হিরক দানার আনন্দ কাল। মায়াবি প্রকৃতির মনোলোভা রূপে পৃথিবীর সজীবতার কাল।

ছয় ঋতুর অন্যতম সুন্দর ও আরামদায়ক একটি হলো হেমন্ত। কবির ভাষায় ঋতুরানী। শুভ্র শরতের পরেই প্রকৃতিকে দৃষ্টিসুখ আনন্দে হাসাতে মাটির প্রতিবেশে জেগে ওঠে সরষে হলুদ হেমন্ত। কার্তিক আর অগ্রহায়ণের এ সময় দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে শুভ্রসজাগ থাকে রুপালি তারকারাজি। শুক্লপক্ষের চাঁদের নীলাভ জোছনা দেয় মন ভালো করা অনুভূতি। পূর্ণিমা হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রুপার থালা। মৃদু ছন্দ তুলে শিশির নেমে আসে ঘাসের ডগায়। সবুজ ধানের ক্ষেতে শুরু হয় শিশির আর দুধ-সাদা জোছনার মাখামাখি ভালোবাসা। প্রভুর প্রেমিক পুরো প্রতিবেশে শুনতে পায় রব্বে আলার গুণগান। শিশিরের ছন্দ-শব্দে মূর্ত হয় সুরেলা জিকির। আল্লাহর গোলাম ছুটে যায় জায়নামাজে। অবনত কপাল নেমে আসে তাঁর উদ্দেশে শুকরিয়া সেজদায়। প্রশংসার অনিন্দ সঙ্গীত সুর তোলে যায় ইন্দ্রীয় থেকে ইন্দ্রিয়ান্দরে।

প্রভাতি সমিরণে শীতের আগমন ধ্বনি। ঘাসের ডগায় শিশিরকণা মুক্তাদানা হয়ে হেসে ওঠে। সবুজ ধানের ক্ষেত কুয়াশাস্পর্শে হয়ে ওঠে আরও সজীব সুন্দর। রকমারি ধানের নানা ঘ্রাণে মনের ভেতর শুরু হয় মোহঘোর আন্দোলন। পোলাও ধানের ক্ষেতের আলে দাঁড়ালেই পেটের ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কৃতজ্ঞ বান্দার মুখে ও মনে অজান্তেই উচ্চারিত হয় 'আলহামদুলিল্লাহ'। মাঠের পর মাঠ সরিষার হলুদ ফুল দেখে মনে হয় প্রকৃতি তার হলুদ অাঁচলের আদরে ঢেকে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশ। সবুজ ধান আর সরষে হলুদ দিয়ে শুরু হওয়া হেমন্ত একসময় হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যের সোনালি রঙ সোপান। ধনি-গরিব সবার মুখে লেগে থাকে অকৃত্রিম হাসি। বাংলাদেশজুড়ে নেমে আসে এক ঐশী সুখের সুবাতাস।

হেমন্তের শেষের দিনগুলোয় সবুজ মাঠ ক্রমে সোনালি রঙে আর হলুদ সরষে ধূসর রঙে বদল হতে থাকে। কাঁচা সবুজ ধান ও হলুদ সরিষার ফুলে ভর করে রিজিক। ধানের পেটে চালের বেড়ে ওঠা আর সরিষার পেটে তেলের বেড়ে ওঠায় কৃষকের আকর্ণ হাসির আড়ালে জেগে ওঠে মহামহিমের কৃতজ্ঞতা। কাস্তে হাতে কৃষকের ধান কাটার অপরূপ দৃশ্যে ছবি হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত হয়ে ওঠে চারপাশ। বাদামি খড়ের বিচালিতে পথ-ঘাট-মাঠ হয়ে ওঠে কুদরতের বিছানা। আমনের ফলনে রিজিকের ফয়সালা হয় মানুষ, পশু আর পাখির। ভোরের নাশতায় হেসে ওঠে শুভ্র খই। সেই সঙ্গে খেজুর গুড় ও রসের শুরু হয় আগমনী গান।

হেমন্তের আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ। শেষের দিকে শুরু হয় শীতের আগমন। রাত হতে থাকে দীর্ঘ। প্রেমিক বান্দার ঘুম ভেঙে যায় রাতের শেষে। গ্রীষ্মকালে রাত ছোট থাকায় অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন না। হেমন্ত আসতেই রাত দীর্ঘ হতে শুরু করায় তাহাজ্জুদের সুবর্ণ সুযোগ এটি। সমগ্র ভালোবাসার নৈবেদ্য নিয়ে হাজির হয় প্রভুর দরবারে। চোখের জলে নেমে যায় পাপের অতীত। মহান আল্লাহ বান্দাকে এমন নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতি দেয়ার একটা উদ্দেশ্য, বান্দা শান্তি ও আরামের সঙ্গে মশগুল হবে ইবাদতে।

যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন, কোরআন তাদের মুহসেন ও মুত্তাকি নামে অভিহিত করে। তাদের আল্লাহর রহমত এবং আখেরাতে চিরন্তন সুখ সম্পদের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই মুত্তাকি লোক বাগ-বাগিচায় এবং ঝরনার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে এবং যে নিয়ামত তাদের পরোয়ারদিগার তাদের দিতে থাকবেন, সেগুলো তারা গ্রহণ করবে। (কারণ) নিঃসন্দেহে তারা এর আগে (দুনিয়ার জীবনে) বড় পুণ্যবান ছিল। তারা রাতের খুব অল্প অংশেই ঘুমাত এবং শেষ রাতে এস্তেগফার করত। (কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইত)'। (সূরা জারিয়াত : ১৫-১৮)।

রাসূল (সা.) বলেছেন, রাতের শেষ সময়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার দিকে নাজিল হন এবং বলেন, 'ডাকার জন্য কেউ আছে কি, যার ডাক আমি শুনব; চাওয়ার জন্য কেউ আছে কি, যাকে আমি দেব; গোনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে কি, যার গোনাহ আমি মাফ করব?' (বোখারি)।

হেমন্তের আগমনধ্বনি যখনই নেমে আসে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে, তখনই অতিথি পাখিরাও আসতে থাকে। হাজার মাইল দূরের সেই পাখিদের আগমনীতে প্রতিভাত হয় আল্লাহর অনন্যতা। তিনি প্রকৃতিতে নিয়ে আসেন নানা অবস্থা। আবার সে অবস্থায় নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে দেন তিনিই। তাই পাখিরাও তীব্র শীত থেকে বাঁচতে কম শীতের বাংলাদেশে চলে আসে। মুখর হয়ে ওঠে বাংলার বিল-ঝিল-সরোবর। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ, প্রাণী, পশুপাখির জীবনযাত্রায় আসে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের একমাত্র ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে। তিনি এসব পরিবর্তনের মধ্যেই বান্দার জন্য রাখেন প্রভূত কল্যাণ আর ইতিবাচক শিক্ষা। বান্দার অভিব্যক্তি হিসেবে ভাষা পায় তা কোরআনে করিমে, 'আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান।' (সূরা আলে ইমরান : ২৭)। কালের এমন বিবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহ আরও বলেন, 'নিশ্চয় আসমানগুলো ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।' (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)।

হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। প্রতি রাতেই কোথাও না কোথাও বসে ইসলামী আলোচনার আসর। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পরপরই শুরু হয় হালকা গরম কাপড় কাঁধে বয়স্কদের মাহফিলের দিকে হেঁটে চলা। চলতে থাকে কিশোর-যুবারাও। বৃষ্টি ও ঝড়ের সম্ভাবনা না থাকায় এ সময়ই আমাদের দেশে বসে নানা আনন্দ-উৎসবও। হেমেন্তের সমাপনী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নেমে আসে নবান্ন উৎসবের আনন্দ। রকমারি পিঠার আয়োজনে মেতে ওঠে পুরো দেশ। আল্লাহর গোলাম এসব আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যায়। সেজদায় অশ্রুপাতে দেয় শুকরিয়ার নজরানা। ষড়ঋতুর অন্যতম এ হেমন্ত আরাম-শান্তি-সুখ আর ইবাদতের ঋতু হয়ে ওঠুক আমাদের সবার মনে-অন্দরে।

লেখক : প্রভাষক, রাজঘাট দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসা, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা

চাটুকারিতা ভালো নয়

নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সত্য-মিথ্যা এবং কপটতার মিশেলে অন্যকে তুষ্ট করার অনৈতিক প্রয়াসকে এক কথায় চাটুকারিতা বলে অভিহিত করা যায়। এর সমার্থক শব্দ হলো তোষামোদি, মোসাহেবি, তেল মারা ইত্যাদি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যিনি এটা করছেন তিনি তা সজ্ঞানেই করছেন এবং যাকে করছেন তিনি এটা বুঝতে পেরেও বিষয়টি বেশ উপভোগ করেন এবং আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। প্রতিদানে তিনি তাকে অনৈতিকভাবে কিছু সুযোগও দিয়ে থাকেন।


উচ্চ লক্ষ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জীবনে বড় হওয়ার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করলে হয়তো প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন নিজের উচ্চ লক্ষ্য ও বড় হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ব্যক্তিমাত্রই সচেষ্ট হয়। কেউ সফল হয়, কেউ হয় না। গন্তব্যে পেঁৗছার পথ-পন্থা-পদ্ধতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। অনেকে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের কথা বলেন। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় অনেক কষ্টলব্ধ বিষয়। ধৈর্য ধরারও 'ধৈর্য' অনেকের থাকে না। তাই সাফল্য পেতে অনেকে সহজ পদ্ধতির সন্ধান করেন। এ জন্য বেছে নেন চাটুকারিতার মতো মন্দ পদ্ধতি।

কারও অহেতুক, অতিরিক্ত, কখনও বা অনুপস্থিত গুণাবলির প্রশংসা করে তার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার ব্যক্তিত্বহীন ও নির্লজ্জ প্রয়াসের নাম এটি। বলাবাহুল্য, এ সময় তোষামোদকৃত ব্যক্তির কোনো ব্যর্থতা বা দোষ তোষামোদকারীর দৃষ্টিগোচর হয় না কিংবা স্মরণে এলেও তা উল্লেখ করা হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে, স্বনামে-বেনামে এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তবে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সাধারণত অধস্তন ব্যক্তির তোষামোদের শিকার হন।
তোষামোদ সাধারণত ক্ষমতা ও অর্থের পিছু নেয়। কারও ক্ষমতা কিংবা অর্থ ফুরালে তোষামোদকারীও আর তার ছায়া মাড়ায় না। প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন এর শিকার হন, তখন তারা আমোদে গদগদ হন। আর নিজের দুর্বলতা, ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ক্ষতি বয়ে আনেন। সুন্দরের প্রশংসা, ভালো কাজের বাহবা অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু যখন মানুষের প্রশংসা কিংবা গুণকীর্তন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখনই এটা চাটুকারিতার পর্যায়ে পড়ে।

বর্তমান সময়ে অফিস-আদালতে চাটুকারিতার বিস্তার প্রকট। কারণ এখানে সবারই উপরস্থ কর্মকর্তা থাকেন। আর তাকে তুষ্ট করতে পারলেই তো পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সুবিধা। সেটা হতে পারে পছন্দসই নিয়োগ-বদলি কিংবা যে কোনো আনুকূল্য। আপনি কর্মে যতই পেশাদার হন না কেন; বড় কর্তাকে তুষ্ট করতে না পারলে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আপনি কেবলই পেছনে পড়তে থাকবেন। তাই নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আপনাকেও শামিল হতে হবে চাটুকারদের দলে। আর আপনার প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ যদি আপনাকে অবচেতন মনে এ কাজ করতে বাধা দেয় তবে শত দায়িত্বশীলতার পরও পদে পদে আপনি হবেন হয়রানির শিকার। সহকর্মীরা আপনাকে নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করবে, আপনাকে বাঁকা চোখে দেখবে, এমনকি কর্মকর্তার কাছে আপনার আনুগত্য হতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ! পরিণামে আপনার জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ। আপনি অনেক প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন বড় কর্তার আনুকূল্য না পাওয়ার কারণে। এক কথায় বলা যায়, ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আমরা চাটুকারিতার বিস্তার প্রতিনিয়ত অনুধাবন করি। ক্ষমতার পালাবদলে চাটুকারও আপন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য গিরগিটির মতো অনায়াসে রূপ পরিবর্তন করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের কোনো ধর্ম নেই। সময়ে এরা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, কোনো কোনো ইস্যুতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকদেরও দেখা যায় বেকায়দায় পড়ে গেছেন চাটুকারিতার কারণে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা অতীতে বহুবার দেখা গেছে।

ইসলাম চাটুকারিতা পছন্দ করে না। ইসলাম মনে করে, চাটুকারিতার বৃত্ত থেকে বের হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। পরিশুদ্ধ কোনো ব্যক্তি অযাচিত চাটুকারকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেয় না। উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে তার অধীনস্থের মূল্যায়ন হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তেল মারার ওপর নয়। এক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ববোধকে জাগ্রত করতে হবে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াতে হবে। মনে জাগ্রত করতে হবে দেশপ্রেম। তবেই সর্বস্তরে চাটুকারিতার বিস্তার রোধ সম্ভব। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে_ 'আপন ভালো তো জগৎ ভালো'। অতএব সবার আগে নিজের চরিত্র বদলাতে হবে। কারণ মানুষ হিসেবে আমরা কেউ দোষ-ত্রুটির ঊধর্ে্ব নই।

© কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, আলেম ও কলাম লেখক