
উচ্চ লক্ষ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জীবনে বড় হওয়ার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করলে হয়তো প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন নিজের উচ্চ লক্ষ্য ও বড় হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ব্যক্তিমাত্রই সচেষ্ট হয়। কেউ সফল হয়, কেউ হয় না। গন্তব্যে পেঁৗছার পথ-পন্থা-পদ্ধতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। অনেকে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের কথা বলেন। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় অনেক কষ্টলব্ধ বিষয়। ধৈর্য ধরারও 'ধৈর্য' অনেকের থাকে না। তাই সাফল্য পেতে অনেকে সহজ পদ্ধতির সন্ধান করেন। এ জন্য বেছে নেন চাটুকারিতার মতো মন্দ পদ্ধতি।
কারও অহেতুক, অতিরিক্ত, কখনও বা অনুপস্থিত গুণাবলির প্রশংসা করে তার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার ব্যক্তিত্বহীন ও নির্লজ্জ প্রয়াসের নাম এটি। বলাবাহুল্য, এ সময় তোষামোদকৃত ব্যক্তির কোনো ব্যর্থতা বা দোষ তোষামোদকারীর দৃষ্টিগোচর হয় না কিংবা স্মরণে এলেও তা উল্লেখ করা হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে, স্বনামে-বেনামে এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তবে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সাধারণত অধস্তন ব্যক্তির তোষামোদের শিকার হন।
তোষামোদ সাধারণত ক্ষমতা ও অর্থের পিছু নেয়। কারও ক্ষমতা কিংবা অর্থ ফুরালে তোষামোদকারীও আর তার ছায়া মাড়ায় না। প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন এর শিকার হন, তখন তারা আমোদে গদগদ হন। আর নিজের দুর্বলতা, ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ক্ষতি বয়ে আনেন। সুন্দরের প্রশংসা, ভালো কাজের বাহবা অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু যখন মানুষের প্রশংসা কিংবা গুণকীর্তন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখনই এটা চাটুকারিতার পর্যায়ে পড়ে।
বর্তমান সময়ে অফিস-আদালতে চাটুকারিতার বিস্তার প্রকট। কারণ এখানে সবারই উপরস্থ কর্মকর্তা থাকেন। আর তাকে তুষ্ট করতে পারলেই তো পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সুবিধা। সেটা হতে পারে পছন্দসই নিয়োগ-বদলি কিংবা যে কোনো আনুকূল্য। আপনি কর্মে যতই পেশাদার হন না কেন; বড় কর্তাকে তুষ্ট করতে না পারলে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আপনি কেবলই পেছনে পড়তে থাকবেন। তাই নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আপনাকেও শামিল হতে হবে চাটুকারদের দলে। আর আপনার প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ যদি আপনাকে অবচেতন মনে এ কাজ করতে বাধা দেয় তবে শত দায়িত্বশীলতার পরও পদে পদে আপনি হবেন হয়রানির শিকার। সহকর্মীরা আপনাকে নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করবে, আপনাকে বাঁকা চোখে দেখবে, এমনকি কর্মকর্তার কাছে আপনার আনুগত্য হতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ! পরিণামে আপনার জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ। আপনি অনেক প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন বড় কর্তার আনুকূল্য না পাওয়ার কারণে। এক কথায় বলা যায়, ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আমরা চাটুকারিতার বিস্তার প্রতিনিয়ত অনুধাবন করি। ক্ষমতার পালাবদলে চাটুকারও আপন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য গিরগিটির মতো অনায়াসে রূপ পরিবর্তন করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের কোনো ধর্ম নেই। সময়ে এরা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, কোনো কোনো ইস্যুতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকদেরও দেখা যায় বেকায়দায় পড়ে গেছেন চাটুকারিতার কারণে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা অতীতে বহুবার দেখা গেছে।
ইসলাম চাটুকারিতা পছন্দ করে না। ইসলাম মনে করে, চাটুকারিতার বৃত্ত থেকে বের হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। পরিশুদ্ধ কোনো ব্যক্তি অযাচিত চাটুকারকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেয় না। উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে তার অধীনস্থের মূল্যায়ন হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তেল মারার ওপর নয়। এক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ববোধকে জাগ্রত করতে হবে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াতে হবে। মনে জাগ্রত করতে হবে দেশপ্রেম। তবেই সর্বস্তরে চাটুকারিতার বিস্তার রোধ সম্ভব। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে_ 'আপন ভালো তো জগৎ ভালো'। অতএব সবার আগে নিজের চরিত্র বদলাতে হবে। কারণ মানুষ হিসেবে আমরা কেউ দোষ-ত্রুটির ঊধর্ে্ব নই।
© কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, আলেম ও কলাম লেখক