Wednesday, 1 April 2015

এসো হে বৈশাখ :- পয়লা বৈশাখ বাঙালির মনের স্টিফেন কথা

নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী রূপান্তরপূর্বক অপভ্রংশ হয়ে "বৈশাখ" শব্দটি এসেছে। বৈশাখ আমাদের হূদয়ের অঙ্গীকারের মাস। হাসি-কান্নার আবর্তে ঝড়ে মন শক্ত হবার মহড়ার মাস। আর হলো সৃষ্টির রুদ্র লগন ও দামাল ছেলেদের কাঁচা-মিঠা আমের মাস এবং মধু মাস জ্যৈষ্ঠের আগমনী সারথী; কিন্তু এ বৈশাখ তথা বাংলা মাসের পিছনে কিছু জানা ও অজানা ইতিকথা আছে, যা বাঙালি হিসেবে জানা একান্ত আবশ্যক। স্মরণকালের অতিপ্রাচীন সেই সব নববর্ষের দিকে যদি ফিরে তাকাই, তাহলে মনের বাতায়নে উদ্ভাসিত হয় যে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে নববর্ষ উদযাপিত হতো, যার স্থায়িত্ব ছিল একটানা এগারো দিন। তাছাড়া পারস্যে নওরোজ নববর্ষ উত্সব কম প্রাচীন নয়। উল্লেখ্য যে, এর আগে আরবী ভাষা-ভাষিরা মুহাররমের প্রথম দিন নওরোজ হিসেবে নববর্ষ পালন করতো, যা অন্তর দিয়ে এখন পর্যন্ত পারস্যবাসীরা ধরে রেখেছে। এদিকে পাঞ্জাবীরা (শিখ) ১ বৈশাখের উপর অতীব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে যে কয়টি অব্দ (সন) প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো- হর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বল্লাব্দ ও গুপ্তাব্দ। এ সকল অব্দই সৌর বত্সর (Solar Year) ভিত্তিক। তবে সুদূর অতীত থেকে ভারতীয় বর্ষপঞ্জি যে দুইটি মৌলিক বিধি মেনে চলছে, তা হলো প্রথমত ফসলী, ধর্মীয় (সনাতনী) ও খাজনা আদায় সংক্রান্ত (এটি যেন ঋতুর নকিব) দ্বিতীয়ত যে কথাটি আসে, তাহলো ঋতুর আওতাধীন অনুষ্ঠানের দিন পল, লগন, প্রহর এবং তিথি দ্বারা স্থিরকৃত।
যাহোক, প্রাচীনকাল থেকে এ অবনীতে সময়-গণনা মানুষের একটি সহজাত (Co-herent) প্রবৃত্তি, যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন আঙ্গিকে নানা সময়ে একক হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। এ বিশ্বে গোষ্ঠী ভিত্তিক অসংখ্য সন ও তারিখ আছে, তন্মধ্যে সচরাচর হাতে গোনা কয়েকটি আমরা জানি। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন শকাব্দ সনের পথ ধরে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বত্, মঘী, নেপাল, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ, পরগণাতি, শাহুর, হিজরী, ঈসায়ী বা খৃস্টীয়, বঙ্গাব্দ, জালালী সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে, আবার কোন কোনটা চান্দ্রবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে। একটু গভীরে যদি যাই, তাহলে দেখি চতুর্থ মাত্রা (4th Dimension of Length, Breadth, Hight & Time) হিসেবে সময় (Time) আছে বলে গতি (Motion) আছে এবং নিউটনের সূত্রের আওতায় যোগ হয়েছে বস্তু (Matter)। সত্য কথা বলতে কি, সময় না থাকলে সবকিছু অচল তথা সীমাহীন ওজন নিয়ে চিরস্থির থাকতো। তখন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে কোন কিছু অর্থাত্ এমনকি "Nothing" বলেও কিছুই থাকতো না। এ বিষয়ে সময়ের ইতিহাস (History of the Time) সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডব্লিউ হকিংস কৃষ্ণ গহ্ববের (Black Hole) আলোকে অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। অবশ্য ইসলামী দশর্নের আলোকে সময় গণনার পিছনে যে, শাশ্বত কথাটি কাজ করেছে, তার সূত্রপাত হয়েছে পবিত্র কালামে, কেননা আল্লাহতালা বিশ্বজনীনভাবে ঘোষণা দিয়েছেন- "আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বছর গণনার মাস হবে বারটি"।
মূলত সনাতনীরা বাংলা সনকে যতটা গুরুত্ব দেন, মুসলিমরা ততটা নয়। যদিও বাংলা সনটির উত্পত্তি হিজরী (Muslim Oriented) সাল থেকে। এ দিকে সন এবং সাল শব্দ যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ থেকে এসেছে এ অঞ্চলে। উল্লেখ্য, ১২০১ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে মুসলীম শাসনের গোড়াপত্তন করলে হিজরী সাল রাষ্ট্রীয় সাল হিসেবে প্রচলিত হয়। উল্লেখ্য যে, তখন রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে হিজরী সালকে গুরুত্ব দেয়া হয়; কিন্তু এতে কৃষাণদের উপর ক্লেশকর ও যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি করে। কেননা চান্দ্র (Lunar) এবং সৌর (Solar) বর্ষের মধ্যে ব্যবধান স্বরূপ প্রতি বছর ১১/১২ দিন এগিয়ে আসার কারণে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কেননা হিজরী সালের ১২ মাস সৌর ৩৬ বছরে একটি চক্র (Circuit) রচনা করে। যাহোক, চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী খাজনা (ভূমি কর) আদায় অথচ ফসল কাটার সময় (Harvesting time) হলো সৌর বছরের অন্যতম শাশ্বত বাস্তবভিত্তিক প্রতিফল। এ জটিল বিষয়টি বিচক্ষণ মহামতী বাদশা আকবর অনুভব করেন এবং তা সুরাহা করার লক্ষ্যে তিনি হিজরী সালের (মহরম প্রথম মাস) পবিত্রতা রক্ষাকরণপূর্বক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অংকশাস্ত্রবিদ আমির ফতেহুল্লাহ্ সিরাজীকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেন। বিচক্ষণ বাদশা আকবর সভাসদসহ (নবরত্ব) ফতেপুুর সিক্রিতে রাজ সভায় বেশ কয়েক দফায় পর্যালোচনা করতঃ সবই ঠিক রাখেন; কেবল ঋতুর সাথে সম্পৃক্ততা রেখে গণনার নির্দেশ দেন এবং তদানুযায়ী বাংলা সনের সূচনা। উল্লেখ্য যে, এ দিন ছিল হিজরী ২ রবিউসসানি, রোজ শুক্রবার, ইংরেজি ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ইং সাল। আর তখন থেকেই প্রকারান্তরে পয়লা বৈশাখের পদচারণা শুরু।

মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব , লেখক :গবেষক
E-mail: abdulbaki85@yahoo.com