রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে রাতে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে নিহত হন ওই রাতে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থায় ভয়ানক ত্রুটি ছিল। তখনকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রটোকল অনুসারে ঢাকার বাইরে রাষ্ট্রপতি যেখানে রাত্রিযাপন করবেন সেখানে কমপক্ষে ১৩৯ জন ইউনিফর্মধারী পুলিশ নিয়োজিত হবেন এবং সাদা পোশাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের আরো ৩৯ জন থাকবেন। কিন্তু রাতে সার্কিট হাউসে ইউনিফর্মধারী পুলিশ ছিল মাত্র ৪৫ জন এবং সাদা পোশাকে ১২ জন। অর্থাৎ মাত্র তিনভাগের একভাগ। ওই রাতে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সার্কিট হাউসে বিএনপির সিনিয়র নেতা ও কয়েকজন মন্ত্রীও ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার বিচার প্রসঙ্গে সম্প্রতি তারেক জিয়া মালয়েশিয়ায় বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে একটি আক্রমণাত্মক ও ভিত্তিহীন অশিষ্ট অভিযোগ তুলেছেন। দুই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে জিয়া হত্যার বিচারের জন্য থানায় একটি জিডি পর্যন্ত না করে এখন তারেক জিয়া উল্টো কথা বলায় সংগত কারণেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শক্ত ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। চীন সফরের পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানের মন্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীও পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নির্মমভাবে নিহত হন। প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিএনপি এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো দিবসটি তাদের মতো করে দেশব্যাপী পালন করেছে। সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণসহ কয়েক ডজন আলোচনা অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের বহুবিধ গুণকীর্তন করা হয়েছে। এ সবের মাধ্যমে তারা তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে। এ রকম মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়া একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বপ্রথম ও সর্বোত্তম কাজ কোনটি? একজন সাধারণ মানুষ নিহত হলেও আমরা বলি হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পাবে না। আত্মার শান্তির কথা তো আছেই, শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বাহ্যিকভাবে যা কিছু করা হয় তার যথার্থতা কোথায়, যদি সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে আত্মার শান্তি হবে কি না তা বলা হয়তো কঠিন, তবে বিচার ব্যতিরেকে শ্রদ্ধা নিবেদন যে পরিপূর্ণ হয় না, তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে বিএনপি একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তাদের রাজনীতির প্রধান সম্বল হলো সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপি অত্যন্ত সফলভাবে জিয়াউর রহমানকে ঘিরে একটা মিথ বা কল্পকাহিনী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই মেয়াদে ১০ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০১-২০০৬ মেয়াদে হাওয়া ভবনে বসে অনেক ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন। এত সুযোগ থাকার পরও বিএনপি একটিবারের জন্য জিয়াউর রহমানের এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা তো করলই না, একটিবারের জন্য বিচারটি চাওয়ার কথা মুখে উচ্চারণ করল না। তাই মানুষের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, বিএনপি কেন জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না? এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপি কখনো দেয়নি। ফলে মানুষ যার যার নিজের অবস্থান থেকে নানা রকম অনুমান করতে পারে। তবে অনুমান তো অনুমানই। তা নিয়ে ড্রইং রুমে চায়ের আড্ডা জমানো যায়। ঝড় তোলা যায় চায়ের কাপে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পত্রিকার কলামে আলোচনা করা যথার্থ নয় বলে আমি মনে করি।
আমি আমার মূল প্রশ্নে আসতে চাই, তা হলো মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএনপির এত ঢাকঢোল পিটিয়ে, এত বড় অনুষ্ঠানাদি করার মানে কী? সেখানে কি মনের অন্তস্তল থেকে উদ্ভাসিত কোনো শ্রদ্ধা থাকে, নাকি তার সবই লোক দেখানো, কেবল জিয়া মিথের সর্বোত্তম রাজনৈতিক ব্যবহার। সব কিছুর উর্ধ্বে যে কথাটি, তা হলো মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে হবে। কোন কাজে ভবিতব্যের কী হাত আছে অথবা নেই, বা কোন কাজটি কী কারণে সংঘটিত হয়, মানুষের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। তবে মানুষের কাজই হলো জোড়াতালি দেওয়া এবং হিসাব মিলবে না জেনেও অনবরত হিসাব মেলানোর চেষ্টা করা। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হলেন। হত্যাকারীরা রেডিও-টেলিভিশনে নিজেরাই ঘোষণা দিলেন তাঁরা শেখ মুজিবুরকে হত্যা করেছেন। অর্থাৎ স্বঘোষিত হত্যাকারীরা সবাই তাঁদের পরিচয় দিলেন। সেই খুনিদের জন্য দায়মুক্তি আইনের ঘোষণা দিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং সেই আইনকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করলেন জিয়াউর রহমান। শুধু সেখানেই ক্ষান্ত হলেন না, ওই খুনিদের জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের দূতাবাসে চাকরি দিলেন, যা পরবর্তী সময় এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারও বজায় রাখে। জিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না- এমন কোনো আইন কেউ করেনি বা কাউকে দায়মুক্তিও দেওয়া হয়নি। তাই এখন সব কিছু দেখেশুনে কোনো কারণে চিত্ত যখন দুর্বল হয়ে যায় এবং মন থেকে যৌক্তিকতা তার শক্তি হারাতে থাকে তখন মনে হয় তাহলে কি ভবিতব্যই নিজের থেকে স্বউদ্যোগে কোনো দায়মুক্তি আইন করে রেখেছে!
প্রথমেই বলেছি, কোনো অনুমানভিত্তিক কথা বলব না। তাই পাঠকের দৃষ্টি এখন অন্যদিকে ফেরাতে চাই। এমন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষকে যেন আর দেখতে না হয় সে জন্য এই ঘটনার পূর্বাপর যে প্রেক্ষাপট ছিল তার কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করব। কলামের স্থান সীমাবদ্ধতার কারণে সব ঘটনার উল্লেখ করা যাবে না। অনেকে বলেন, রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসেন, তাঁর পুরো শাসনামল ছিল রক্তমাখা এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি, শেষমেশ তিনিও রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে চলে গেলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে খোন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করলেন। তারপর পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর আরেকটি ভয়াবহ রক্তপাতের ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন, যদিও বিচারপতি সায়েম কিছু দিনের জন্য নামেমাত্র রাষ্ট্রপতি ছিলেন। একসময় তিনি রাষ্ট্রের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদ একাই ধারণ করলেন- রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান এবং বিএনপির সভাপতি। তাঁর শাসনকালকে অন্যান্য সামরিক শাসকদের মতো দীর্ঘ বলা না গেলেও একেবারে কম নয়, একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। এই সময়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রায় ১৯-২০টি সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয় ও প্রতিটি ঘটনার জের ধরে সেনাবাহিনীর ভেতরের মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে অনেকের ফাঁসি হয় এবং অনেকের আবার ঠুনকো অজুহাতে চাকরি চলে যায়। জিয়াউর রহমান নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তাঁর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা চরম উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হন, যার ধারাবাহিকতা এরশাদও বহাল রেখেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর যথেষ্ট উপযুক্ত ও সিনিয়র অফিসার থাকা সত্ত্বেও জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান বানালেন এরশাদকে। বিএনপির পক্ষ থেকে এখন জিয়া হত্যার অভিযোগের আঙুল উঠছে এরশাদের দিকে। একজন অফিসার মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ঢাকায় থেকেও যুদ্ধে যোগদান করলেন না। তারপর মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি ছুটিতে এসে ছুটি শেষে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। অর্থাৎ অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন না। অন্য আরেকজন অফিসার নিজের ও পরিবার সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন। এই দুজনের তুলনামূলক মূল্যায়ন কি শুধু সিনিয়রিটির ভিত্তিতে হবে? মেধা, দেশপ্রেম, অসীম সাহস ও বীরত্বের কোনো মূল্য কি থাকবে না? ওই সময় সবচেয়ে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মেধা বিচারে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে কারো তুলনা ছিল না। এমন ঘটনাও আছে, একাত্তরের জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বাঙালি অফিসার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তারপর যুদ্ধের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে পোস্টিং নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। এই অফিসার পাকিস্তান থেকে মেজর হিসেবে ফেরত আসার পর বাংলাদেশে মেজর জেনারেল হয়েছেন। অথচ জিয়া হত্যাকাণ্ডের অজুহাতে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে স্ক্রিনিং বোর্ডের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল, কিন্তু বিএনপি ছিল একেবারে নিশ্চুপ। এরশাদকে সেনাপ্রধান করার পর মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মানসিক দ্বন্দ্বটির আরো বিস্তার ঘটে। বলা হয়ে থাকে, এরশাদ সেনাপ্রধান হিসেবে এই দ্বন্দ্বটির নিরসন না করে বরং তার সুযোগে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল′ নীতির আওতায় জিয়ার আশীর্বাদে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের আরো কোণঠাসা করার ব্যবস্থা করেন। এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমরা তখন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কনিষ্ঠ অফিসার ছিলাম। তাই ওই সময়ের সিনিয়র অফিসারদের খবর আমাদের পর্যন্ত খুব একটা পৌঁছাত না। বলা যায় পরবর্তী সময় এ ঘটনাবলি আমাদের কাছে ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হতে থাকে। তবে এই মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মানসিক দূরত্বের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এখনো ভীষণ পীড়া দেয়। আর জুনিয়র অফিসার থাকা অবস্থায় অনেক অমুক্তিযোদ্ধা অফিসার আমার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাঁদের কারো ভেতর এ রকম কোনো মানসিকতার বিন্দুমাত্র আমি কখনো দেখিনি বা অনুভবও করিনি। এখন এই পরিণত বয়সে মনে হয় পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের মধ্যে যাঁরা সিনিয়র ছিলেন তাঁরা সংকীর্ণ পদ-পদবির লোভে এবং হীনম্মন্যতার বশবর্তী হয়ে সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা হয়তো নিজের অবস্থানকে শক্ত করার জন্য পাকিস্তান প্রত্যাগত মধ্যপর্যায়ের অফিসারদের অনেককে নিজেদের বলয়ে টেনে এনেছেন। তা-ও ওই পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে। তখন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারসহ সেনাসদস্যের সংখ্যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে অনেক বেশি। তবে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করাসহ যাঁরা সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সংগঠক ও কমান্ডার ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলাদেশের গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনকে জিয়াউর রহমান মন্ত্রী বানালে সেনাবাহিনীর সব পদ ও শ্রেণির মধ্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৮০ সালের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস। তখন সেনাকুঞ্জ ছিল না এবং এখনকার মতো সব কিছু এত সুসংগঠিত ছিল না। ওই সময় সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিল কুর্মিটোলা গল্ফ ক্লাবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। আমি তখন জুনিয়র অফিসার হিসেবে ঢাকায় মিলিটারি পুলিশে কর্মরত। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত আমাদের লোকজনের সঙ্গে আমিও ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রপতি আসার আগেই সবাই আসছেন। একসময় পতাকাবাহী গাড়িতে এলেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। আমি নামার স্থান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারণ আমি মেহমানদের অভ্যর্থনাকারীদের মধ্যে নেই। দেখলাম, শাহ আজিজুর রহমানের গাড়ি আসছে দেখে অভ্যর্থনার দায়িত্বে নিয়োজিতসহ অন্য অফিসাররা অভ্যর্থনা জানানোর জায়গা থেকে যে যার মতো করে সরে গেলেন। এটা নিয়ে পরবর্তী সময় আর কোনো আলোচনা হয়েছিল কি না, তা আর জানতে পারিনি।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থা মনিটরিং ও তদারক করার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থানে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন, যেমন- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান, পুলিশ প্রধান প্রভৃতি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ডিসি-এসপিসহ মোট ১৮ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। আর বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাসই ঢাকায় চাকরি করেছেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁরা সবাই ছিলেন জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। সুতরাং কথা থেকে যায়, ওই রাতে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থায় এমন ঘাটতি কি সবার চোখ এড়িয়ে গেল? মানুষ তাই-ই বিশ্বাস করবে, নাকি অন্য কিছু। এর সব কিছুই বের হয়ে আসত, যদি ওই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হতো এবং বিচার হতো। ৩০ মে ঘটনার পর রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের বিচার নয়, সেনা বিদ্রোহের (মিউটিনি) অভিযোগে কিছু অফিসারকে অভিযুক্ত করে তাদের বিচারের জন্য ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের আয়োজন করা হয়। তার আগে চার সদস্যবিশিষ্ট সেনা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গঠন করা হয় তিন সদস্যবিশিষ্ট সেনা প্রসিকিউশন টিম। অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি সেনা টিম। এত বড় একটা ঘটনার তদন্ত শেষ করা হয় মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে। সেই তদন্তের ওপর ভিত্তি করে কোর্ট মার্শাল পরিচালিত হয়। ১০ জুলাই ১৯৮১ থেকে ২৬ জুলাই ১৯৮১, মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করে ১২ জন অফিসারকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তদন্ত ও বিচারের জন্য উপরোক্ত যে টিমগুলোর কথা উল্লেখ করলাম তাদের তালিকা দেখলে এবং পরবর্তী সময় সেনাবাহিনীতে তাদের প্রায় সবার শনৈঃশনৈঃ উন্নতির প্রতি নজর দিলে অনেক কিছু বোঝা যায়। ৭ জুন ১৯৮১, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি রুহুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন নড়াচড়ার পর তা ওই যে স্তব্ধ হয়ে গেল, আর কোনো দিন খবর হলো না। কেন? সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক : মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.), কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক