Wednesday, 1 April 2015

জামায়াত যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার নেই


টানা অবরোধের ৬৬ তম দিনে এই লেখা লিখছি। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই জানতে চান, দেশে যা বলছে তার শেষ কোথায়, কীভাবে? কিন্তু এ জিজ্ঞাসার জবাব কে দেবেন বা দিতে পারবেন, আমার জানা নেই। ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের অবরোধ চলছে। এর সঙ্গে সপ্তাহে ‘তিন যোগ দুই’ দিন থাকছে হরতাল। পাঁচ দিনের হরতাল একবারে না ডেকে প্রথমে রবিবার ভোর ছয়টা থেকে বুধবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত; পরে আবার বুধবার ভোর ছয়টা থেকে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত– এ রকম ভেঙে ভেঙে ডাকা হচ্ছে।

এভাবে হরতাল ডেকে কী রাজনৈতিক ফায়দা হচ্ছে সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। এর তাৎপর্য কেবল খালেদা জিয়াই হয়তো জানেন। দেশের মানুষ কি বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধ-হরতাল মেনে নিচ্ছে? রাস্তায় বের হলে অবরোধ-হরতালের ছাপ কতটুকু দেখা যায়? নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা না-হওয়া ছাড়া হরতাল-অবরোধের কারণে আর কিছু বন্ধ থাকছে কি? এমন ফ্লপ রাজনৈতিক কর্মসূচি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় বিস্ময়কর ঘটনা আর কী হতে পারে!

দেশে প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক– এই দাবির প্রতি যত মানুষের সমর্থন আছে, এই দাবি আদায়ের জন্য অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচির প্রতি সমর্থন তার খুব কম অংশেরই আছে। কারণ এসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় দেখা যায় না। রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যানবাহনে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। রেল লাইন তুলে ফেলা হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ‘গণতন্ত্র উদ্ধারের চলমান’ আন্দোলনে ১২১ জন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ চিরদিনের মতো না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। এখনই এই সহিংস অবরোধ-হরতাল বন্ধ না হলে মৃত্যুর মিছিলে হয়তো আরও অনেককেই শামিল হতে হবে।

এখনই এই সহিংস অবরোধ-হরতাল বন্ধ না হলে মৃত্যুর মিছিলে হয়তো আরও অনেককেই শামিল হতে হবে, কারণ অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চললেও ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। প্রথমদিকে রাজধানী ঢাকার বাইরে এসবের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও, দিন যত যাচ্ছে ততই দেশের প্রায় সর্বত্র হরতাল-অবরোধ শিথিল হয়ে পড়ছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার ভয় উপেক্ষা করে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ঢাকার বাইরেও প্রতিদিনই বাড়ছে। ঢাকায় তো রীতিমতো যানজট দেখা যাচ্ছে।

শুধু কি সাধারণ মানুষই এসব উপেক্ষা করছে? বিএনপি নেতারাও নিজেদের ডাকা অবরোধ-হরতাল মানছেন না। ‘হরতালে সব চালু বিএনপি নেতাদের’ শিরোনামে দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ ১২ মার্চ প্রধান প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:

‘‘সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় টানা অবরোধ ও ঘন ঘন হরতাল ডাকলেও জোটের প্রধান শরিক বিএনপি নেতাদের হরতাল-অবরোধ পালনের কোনো বালাই নেই। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, পরিবহন, দোকানপাট, অফিস-প্রতিষ্ঠান– সবই চালু রয়েছে। অথচ অবরোধ-হরতালের নামে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে পেটের দায়ে, জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামা নিরীহ মানুষকে। পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।’’

প্রতিবেদনে বিএনপি নেতাদের কোন কোন শিল্পকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবহন স্বাভাবিকভাবে চলছে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির জেলা পর্যায়ের একজন নেতা ‘যেসব বিএনপি নেতার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে তাদের সশরীরে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রকৃত নেতাকর্মীরা আজ জেল-জুলুম ও হুলিয়ার শিকার। অথচ যারা নমিনেশন আনার জন্য টাকা-পয়সা খরচ করে দৌড়ঝাঁপ করেন, তারা আন্দোলন-সংগ্রামে তো থাকেনই না, বরং তাদের মিল-কারখানা খোলা রয়েছে। এটা তাদের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড।’

বেগম জিয়া এবং তাঁর উপদেষ্টারা কেন এটা বুঝতে পারছেন না যে, পেট্রোল বোমা, ককটেল ফাটিয়ে, সন্ত্রাস করে দাবি আদায় করা যাবে না। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো সরকার সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করে না, করতে পারে না। বিএনপির আহ্বানে যদি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসত, তাহলে সরকারের পক্ষে অনঢ় অবস্থানে থাকা সহজ হত না। প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেখানে হয় সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ কিংবা সরকারের পেটোয়া বাহিনী হামলা চালায়, অত্যাচার-নির্যাতন করে। আর এবার আমাদের এখানে ‘আন্দোলনকারীরা’ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে, তাদের পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মারছে। সরকারের জন্য এটা আবার বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। তারা সহজেই একে ‘জঙ্গিবাদী কার্যক্রম’ বলে প্রচার করতে পারছে।

নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করায় দেশে-বিদেশে কোনো মহল থেকেই বিএনপির পক্ষে সহানুভূতি পাওয়া সহজ হচ্ছে না। এই অবস্থায় কিছু না পেয়ে খালি হাতে বিএনপি কীভাবে সরে আসবে, এ প্রশ্ন বিএনপি-দরদিরা তুললেও সরকার তাতে কান দিচ্ছে না। তারা যদি এখন বিএনপি-জামায়াতের কাছে নতি স্বীকার করে তাহলে সেটা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি ‘অত্যন্ত বাজে’ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বলা হচ্ছে, মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এই অবস্থায় কেউ কেউ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের কথা বললেও সরকার আলোচনায় বসতে চাইছে না। পেট্রোল বোমা হাতে নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ জিম্মি করে সরকারকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা যায় না। এটা সঠিক রাজনৈতিক কৌশলও হতে পারে না।

প্রশ্ন আসে, সরকার যদি নমনীয়তা না দেখায় তাহলে বর্তমান অবস্থা কি চলতেই থাকবে? এই প্রশ্নের জবাবে এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার সুযোগ নেই। বর্তমান এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলবে না, আবার রাতারাতি এর পরিসমাপ্তিও ঘটবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও বেশি কঠোরতা এবং সক্রিয়তায় বোমাবাজরা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। মাঝেমধ্যে বোমাবাজি চললেও তা এক সময় মানুষের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কত রকম দুর্ঘটনাই তো ঘটতে পারে! মানুষ মারার রাজনীতিকেও একসময় ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবেই হয়তো দেখা হবে। তবে এ মুহূর্তে সরকারকে আরও ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আন্দোলনে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে প্রকাশ্যে কটাক্ষ বন্ধ করে ওদের পিছিয়ে আসার স্পেস তৈরি করে দিতে হবে।

বিএনপি নেতৃত্ব স্বীকার না করলেও এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট যে, তাদের রাজনীতি এখন পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতের প্রভাবে। তাদের মতো একটি বড় দল, যারা নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবি করে, তাদের জামায়াতনির্ভর হয়ে পড়াটা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। দেশে যেসব উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, তাদের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে। এটা নিয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, বিতর্ক করতে পারেন, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। বিষয়টি যারা এখনও অস্বীকার করেন, তারা জেনে বা না জেনে দেশটাকে ভয়াবহ বিপদের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?

ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না
ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না
২০-দলীয় জোটের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে না। কেন এই দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা? রাজনীতি-সচেতন সবারই এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা উচিত। রাজনীতির নামে প্রতিহিংসাপরায়ণতা, আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানোর কারণে মানুষের মনে বিএনপি সম্পর্কে এক ধরনের বিরূপতা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি যারা বিএনপিকে ভোট দেন, তারাও দলটির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছেন না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের ওপর বিএনপির অতিমাত্রায় নির্ভরতার বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে মানুষের সমর্থন যখন স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপির দিকেই যাওয়ার কথা, তারা তখন সাধারণ মানুষের ওপর আস্থা রেখে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা না ভেবে জামায়াত ও বিদেশনির্ভর হয়ে দ্রুত ফললাভের আশায় সন্ত্রাস-নাশকতার হঠকারিতার পথ গ্রহণ করেছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন সুশীল সমাজে এবং আওয়ামী বিরোধী মহলে যতটা অগ্রহণযোগ্য হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে ততটা নয়। ওই নির্বাচন নিয়ে মানুষ মারাত্মক ক্ষুব্ধ হলে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত ও উত্তপ্ত হয়ে উঠত, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। নির্বাচন হওয়া না-হওয়া নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশে যে অরাজক অবস্থা তৈরি করেছিল, সাধারণ মানুষ তা পছন্দ করেনি। নির্বাচন ভালো হয়েছে কী মন্দ হয়েছে, তার চেয়ে মানুষের কাছে বিবেচনার বিষয় ছিল জীবনের নিরাপত্তা, শান্তি, স্বস্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে দেশের বাইরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতার সংকটও অনেকটাই কেটে গেছে। দেশ যখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছিল, তখন অবরোধ-হরতালের মতো সহিংস কর্মসূচি কারও প্রত্যাশিত ছিল না।

জামায়াতের সমর্থন ও সহযোগিতায় সন্ত্রাস-নাশকতার পথে গিয়ে বিএনপি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা নিরাময়ের উপায় তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমেরিকা যার বন্ধু তার যেমন শত্রুর প্রয়োজন হয় না, তেমনি জামায়াত যে দলের মিত্র তার সর্বনাশের জন্য অন্য কারও শত্রুতার প্রয়োজন নেই।

বিএনপি নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে পারবে, দল ও দেশের ততই মঙ্গল।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এসো হে বৈশাখ :- পয়লা বৈশাখ বাঙালির মনের স্টিফেন কথা

নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী রূপান্তরপূর্বক অপভ্রংশ হয়ে "বৈশাখ" শব্দটি এসেছে। বৈশাখ আমাদের হূদয়ের অঙ্গীকারের মাস। হাসি-কান্নার আবর্তে ঝড়ে মন শক্ত হবার মহড়ার মাস। আর হলো সৃষ্টির রুদ্র লগন ও দামাল ছেলেদের কাঁচা-মিঠা আমের মাস এবং মধু মাস জ্যৈষ্ঠের আগমনী সারথী; কিন্তু এ বৈশাখ তথা বাংলা মাসের পিছনে কিছু জানা ও অজানা ইতিকথা আছে, যা বাঙালি হিসেবে জানা একান্ত আবশ্যক। স্মরণকালের অতিপ্রাচীন সেই সব নববর্ষের দিকে যদি ফিরে তাকাই, তাহলে মনের বাতায়নে উদ্ভাসিত হয় যে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে নববর্ষ উদযাপিত হতো, যার স্থায়িত্ব ছিল একটানা এগারো দিন। তাছাড়া পারস্যে নওরোজ নববর্ষ উত্সব কম প্রাচীন নয়। উল্লেখ্য যে, এর আগে আরবী ভাষা-ভাষিরা মুহাররমের প্রথম দিন নওরোজ হিসেবে নববর্ষ পালন করতো, যা অন্তর দিয়ে এখন পর্যন্ত পারস্যবাসীরা ধরে রেখেছে। এদিকে পাঞ্জাবীরা (শিখ) ১ বৈশাখের উপর অতীব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে যে কয়টি অব্দ (সন) প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো- হর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বল্লাব্দ ও গুপ্তাব্দ। এ সকল অব্দই সৌর বত্সর (Solar Year) ভিত্তিক। তবে সুদূর অতীত থেকে ভারতীয় বর্ষপঞ্জি যে দুইটি মৌলিক বিধি মেনে চলছে, তা হলো প্রথমত ফসলী, ধর্মীয় (সনাতনী) ও খাজনা আদায় সংক্রান্ত (এটি যেন ঋতুর নকিব) দ্বিতীয়ত যে কথাটি আসে, তাহলো ঋতুর আওতাধীন অনুষ্ঠানের দিন পল, লগন, প্রহর এবং তিথি দ্বারা স্থিরকৃত।
যাহোক, প্রাচীনকাল থেকে এ অবনীতে সময়-গণনা মানুষের একটি সহজাত (Co-herent) প্রবৃত্তি, যা ধীরে ধীরে বিভিন্ন আঙ্গিকে নানা সময়ে একক হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। এ বিশ্বে গোষ্ঠী ভিত্তিক অসংখ্য সন ও তারিখ আছে, তন্মধ্যে সচরাচর হাতে গোনা কয়েকটি আমরা জানি। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন শকাব্দ সনের পথ ধরে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বত্, মঘী, নেপাল, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ, পরগণাতি, শাহুর, হিজরী, ঈসায়ী বা খৃস্টীয়, বঙ্গাব্দ, জালালী সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে, আবার কোন কোনটা চান্দ্রবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে। একটু গভীরে যদি যাই, তাহলে দেখি চতুর্থ মাত্রা (4th Dimension of Length, Breadth, Hight & Time) হিসেবে সময় (Time) আছে বলে গতি (Motion) আছে এবং নিউটনের সূত্রের আওতায় যোগ হয়েছে বস্তু (Matter)। সত্য কথা বলতে কি, সময় না থাকলে সবকিছু অচল তথা সীমাহীন ওজন নিয়ে চিরস্থির থাকতো। তখন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে কোন কিছু অর্থাত্ এমনকি "Nothing" বলেও কিছুই থাকতো না। এ বিষয়ে সময়ের ইতিহাস (History of the Time) সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডব্লিউ হকিংস কৃষ্ণ গহ্ববের (Black Hole) আলোকে অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। অবশ্য ইসলামী দশর্নের আলোকে সময় গণনার পিছনে যে, শাশ্বত কথাটি কাজ করেছে, তার সূত্রপাত হয়েছে পবিত্র কালামে, কেননা আল্লাহতালা বিশ্বজনীনভাবে ঘোষণা দিয়েছেন- "আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বছর গণনার মাস হবে বারটি"।
মূলত সনাতনীরা বাংলা সনকে যতটা গুরুত্ব দেন, মুসলিমরা ততটা নয়। যদিও বাংলা সনটির উত্পত্তি হিজরী (Muslim Oriented) সাল থেকে। এ দিকে সন এবং সাল শব্দ যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ থেকে এসেছে এ অঞ্চলে। উল্লেখ্য, ১২০১ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে মুসলীম শাসনের গোড়াপত্তন করলে হিজরী সাল রাষ্ট্রীয় সাল হিসেবে প্রচলিত হয়। উল্লেখ্য যে, তখন রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে হিজরী সালকে গুরুত্ব দেয়া হয়; কিন্তু এতে কৃষাণদের উপর ক্লেশকর ও যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি করে। কেননা চান্দ্র (Lunar) এবং সৌর (Solar) বর্ষের মধ্যে ব্যবধান স্বরূপ প্রতি বছর ১১/১২ দিন এগিয়ে আসার কারণে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কেননা হিজরী সালের ১২ মাস সৌর ৩৬ বছরে একটি চক্র (Circuit) রচনা করে। যাহোক, চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী খাজনা (ভূমি কর) আদায় অথচ ফসল কাটার সময় (Harvesting time) হলো সৌর বছরের অন্যতম শাশ্বত বাস্তবভিত্তিক প্রতিফল। এ জটিল বিষয়টি বিচক্ষণ মহামতী বাদশা আকবর অনুভব করেন এবং তা সুরাহা করার লক্ষ্যে তিনি হিজরী সালের (মহরম প্রথম মাস) পবিত্রতা রক্ষাকরণপূর্বক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অংকশাস্ত্রবিদ আমির ফতেহুল্লাহ্ সিরাজীকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেন। বিচক্ষণ বাদশা আকবর সভাসদসহ (নবরত্ব) ফতেপুুর সিক্রিতে রাজ সভায় বেশ কয়েক দফায় পর্যালোচনা করতঃ সবই ঠিক রাখেন; কেবল ঋতুর সাথে সম্পৃক্ততা রেখে গণনার নির্দেশ দেন এবং তদানুযায়ী বাংলা সনের সূচনা। উল্লেখ্য যে, এ দিন ছিল হিজরী ২ রবিউসসানি, রোজ শুক্রবার, ইংরেজি ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ইং সাল। আর তখন থেকেই প্রকারান্তরে পয়লা বৈশাখের পদচারণা শুরু।

মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব , লেখক :গবেষক
E-mail: abdulbaki85@yahoo.com

হলুদ সবুজ হেমন্তের নেয়ামত


কুয়াশার চাদরে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত শিশিরভেজা ধান ক্ষেতে সূর্যের পরশ। 
হালকা বাতাসের দোলায় চিকচিক করা শিশিরবিন্দু খসে পড়া। ধানের শীষে সারা বছরের খোরাকের বার্তা। এই তো কয়েক দিন পরই কৃষকের ঘরে উঠবে সোনারাঙা ধান। সবুজ ঘাসে শিশিরের কোমল স্পর্শ

সময়ের মালিক সময়কে আবর্তিত করেন; প্রকৃতির গায়ে এঁকে দেন দৃষ্টিনন্দন আল্পনা। সে আল্পনা একেক সময় একেক রূপে উদ্ভাসিত হয়। উদ্ভাসিত সেই অনন্য রূপকে আমরা দেখি নানা ঋতু হিসেবে। ১২ মাসের ছয় ঋতু নিয়ে আমাদের এ বাংলাদেশ। কালের আবর্তনে, প্রকৃতির বিবর্তনে সবুজের চাদরে নেমে আসে ষড়ঋতুর অনুপম রূপবৈচিত্র্য। ছয়টি প্রকৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ছয়টি অনিন্দ্য শিল্পকর্ম। সুন্দরপিয়াসী মনে নিয়ে আসে চঞ্চলতা। বোধের দিগন্তে হেসে ওঠে অনন্ত রূপের আধার ও রূপ-রস-ছন্দ-আনন্দের মালিকের অলোক সক্ষমতা। ঘোরলাগা অনুভবে ভাবুকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, 'তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর/না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর...'

এ সময়ের পালাবদলে প্রকৃতিতে আসে হেমন্তকাল। হেমন্ত হলুদের কাল, সবুজের কাল, মৌ মৌ আমন ধানের আগমনীর কাল। হলুদ চাদরে ঢাকা প্রকৃতির কাল। প্রভাতে সূর্যের কিরণে ধান গাছের সুচালো অগ্রে শিশির নামা হিরক দানার আনন্দ কাল। মায়াবি প্রকৃতির মনোলোভা রূপে পৃথিবীর সজীবতার কাল।

ছয় ঋতুর অন্যতম সুন্দর ও আরামদায়ক একটি হলো হেমন্ত। কবির ভাষায় ঋতুরানী। শুভ্র শরতের পরেই প্রকৃতিকে দৃষ্টিসুখ আনন্দে হাসাতে মাটির প্রতিবেশে জেগে ওঠে সরষে হলুদ হেমন্ত। কার্তিক আর অগ্রহায়ণের এ সময় দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে শুভ্রসজাগ থাকে রুপালি তারকারাজি। শুক্লপক্ষের চাঁদের নীলাভ জোছনা দেয় মন ভালো করা অনুভূতি। পূর্ণিমা হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রুপার থালা। মৃদু ছন্দ তুলে শিশির নেমে আসে ঘাসের ডগায়। সবুজ ধানের ক্ষেতে শুরু হয় শিশির আর দুধ-সাদা জোছনার মাখামাখি ভালোবাসা। প্রভুর প্রেমিক পুরো প্রতিবেশে শুনতে পায় রব্বে আলার গুণগান। শিশিরের ছন্দ-শব্দে মূর্ত হয় সুরেলা জিকির। আল্লাহর গোলাম ছুটে যায় জায়নামাজে। অবনত কপাল নেমে আসে তাঁর উদ্দেশে শুকরিয়া সেজদায়। প্রশংসার অনিন্দ সঙ্গীত সুর তোলে যায় ইন্দ্রীয় থেকে ইন্দ্রিয়ান্দরে।

প্রভাতি সমিরণে শীতের আগমন ধ্বনি। ঘাসের ডগায় শিশিরকণা মুক্তাদানা হয়ে হেসে ওঠে। সবুজ ধানের ক্ষেত কুয়াশাস্পর্শে হয়ে ওঠে আরও সজীব সুন্দর। রকমারি ধানের নানা ঘ্রাণে মনের ভেতর শুরু হয় মোহঘোর আন্দোলন। পোলাও ধানের ক্ষেতের আলে দাঁড়ালেই পেটের ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কৃতজ্ঞ বান্দার মুখে ও মনে অজান্তেই উচ্চারিত হয় 'আলহামদুলিল্লাহ'। মাঠের পর মাঠ সরিষার হলুদ ফুল দেখে মনে হয় প্রকৃতি তার হলুদ অাঁচলের আদরে ঢেকে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশ। সবুজ ধান আর সরষে হলুদ দিয়ে শুরু হওয়া হেমন্ত একসময় হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যের সোনালি রঙ সোপান। ধনি-গরিব সবার মুখে লেগে থাকে অকৃত্রিম হাসি। বাংলাদেশজুড়ে নেমে আসে এক ঐশী সুখের সুবাতাস।

হেমন্তের শেষের দিনগুলোয় সবুজ মাঠ ক্রমে সোনালি রঙে আর হলুদ সরষে ধূসর রঙে বদল হতে থাকে। কাঁচা সবুজ ধান ও হলুদ সরিষার ফুলে ভর করে রিজিক। ধানের পেটে চালের বেড়ে ওঠা আর সরিষার পেটে তেলের বেড়ে ওঠায় কৃষকের আকর্ণ হাসির আড়ালে জেগে ওঠে মহামহিমের কৃতজ্ঞতা। কাস্তে হাতে কৃষকের ধান কাটার অপরূপ দৃশ্যে ছবি হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত হয়ে ওঠে চারপাশ। বাদামি খড়ের বিচালিতে পথ-ঘাট-মাঠ হয়ে ওঠে কুদরতের বিছানা। আমনের ফলনে রিজিকের ফয়সালা হয় মানুষ, পশু আর পাখির। ভোরের নাশতায় হেসে ওঠে শুভ্র খই। সেই সঙ্গে খেজুর গুড় ও রসের শুরু হয় আগমনী গান।

হেমন্তের আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ। শেষের দিকে শুরু হয় শীতের আগমন। রাত হতে থাকে দীর্ঘ। প্রেমিক বান্দার ঘুম ভেঙে যায় রাতের শেষে। গ্রীষ্মকালে রাত ছোট থাকায় অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন না। হেমন্ত আসতেই রাত দীর্ঘ হতে শুরু করায় তাহাজ্জুদের সুবর্ণ সুযোগ এটি। সমগ্র ভালোবাসার নৈবেদ্য নিয়ে হাজির হয় প্রভুর দরবারে। চোখের জলে নেমে যায় পাপের অতীত। মহান আল্লাহ বান্দাকে এমন নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতি দেয়ার একটা উদ্দেশ্য, বান্দা শান্তি ও আরামের সঙ্গে মশগুল হবে ইবাদতে।

যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন, কোরআন তাদের মুহসেন ও মুত্তাকি নামে অভিহিত করে। তাদের আল্লাহর রহমত এবং আখেরাতে চিরন্তন সুখ সম্পদের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই মুত্তাকি লোক বাগ-বাগিচায় এবং ঝরনার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে এবং যে নিয়ামত তাদের পরোয়ারদিগার তাদের দিতে থাকবেন, সেগুলো তারা গ্রহণ করবে। (কারণ) নিঃসন্দেহে তারা এর আগে (দুনিয়ার জীবনে) বড় পুণ্যবান ছিল। তারা রাতের খুব অল্প অংশেই ঘুমাত এবং শেষ রাতে এস্তেগফার করত। (কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইত)'। (সূরা জারিয়াত : ১৫-১৮)।

রাসূল (সা.) বলেছেন, রাতের শেষ সময়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার দিকে নাজিল হন এবং বলেন, 'ডাকার জন্য কেউ আছে কি, যার ডাক আমি শুনব; চাওয়ার জন্য কেউ আছে কি, যাকে আমি দেব; গোনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে কি, যার গোনাহ আমি মাফ করব?' (বোখারি)।

হেমন্তের আগমনধ্বনি যখনই নেমে আসে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে, তখনই অতিথি পাখিরাও আসতে থাকে। হাজার মাইল দূরের সেই পাখিদের আগমনীতে প্রতিভাত হয় আল্লাহর অনন্যতা। তিনি প্রকৃতিতে নিয়ে আসেন নানা অবস্থা। আবার সে অবস্থায় নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে দেন তিনিই। তাই পাখিরাও তীব্র শীত থেকে বাঁচতে কম শীতের বাংলাদেশে চলে আসে। মুখর হয়ে ওঠে বাংলার বিল-ঝিল-সরোবর। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ, প্রাণী, পশুপাখির জীবনযাত্রায় আসে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের একমাত্র ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে। তিনি এসব পরিবর্তনের মধ্যেই বান্দার জন্য রাখেন প্রভূত কল্যাণ আর ইতিবাচক শিক্ষা। বান্দার অভিব্যক্তি হিসেবে ভাষা পায় তা কোরআনে করিমে, 'আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান।' (সূরা আলে ইমরান : ২৭)। কালের এমন বিবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহ আরও বলেন, 'নিশ্চয় আসমানগুলো ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।' (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)।

হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। প্রতি রাতেই কোথাও না কোথাও বসে ইসলামী আলোচনার আসর। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পরপরই শুরু হয় হালকা গরম কাপড় কাঁধে বয়স্কদের মাহফিলের দিকে হেঁটে চলা। চলতে থাকে কিশোর-যুবারাও। বৃষ্টি ও ঝড়ের সম্ভাবনা না থাকায় এ সময়ই আমাদের দেশে বসে নানা আনন্দ-উৎসবও। হেমেন্তের সমাপনী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নেমে আসে নবান্ন উৎসবের আনন্দ। রকমারি পিঠার আয়োজনে মেতে ওঠে পুরো দেশ। আল্লাহর গোলাম এসব আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যায়। সেজদায় অশ্রুপাতে দেয় শুকরিয়ার নজরানা। ষড়ঋতুর অন্যতম এ হেমন্ত আরাম-শান্তি-সুখ আর ইবাদতের ঋতু হয়ে ওঠুক আমাদের সবার মনে-অন্দরে।

লেখক : প্রভাষক, রাজঘাট দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসা, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা

চাটুকারিতা ভালো নয়

নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সত্য-মিথ্যা এবং কপটতার মিশেলে অন্যকে তুষ্ট করার অনৈতিক প্রয়াসকে এক কথায় চাটুকারিতা বলে অভিহিত করা যায়। এর সমার্থক শব্দ হলো তোষামোদি, মোসাহেবি, তেল মারা ইত্যাদি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যিনি এটা করছেন তিনি তা সজ্ঞানেই করছেন এবং যাকে করছেন তিনি এটা বুঝতে পেরেও বিষয়টি বেশ উপভোগ করেন এবং আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। প্রতিদানে তিনি তাকে অনৈতিকভাবে কিছু সুযোগও দিয়ে থাকেন।


উচ্চ লক্ষ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জীবনে বড় হওয়ার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করলে হয়তো প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন নিজের উচ্চ লক্ষ্য ও বড় হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ব্যক্তিমাত্রই সচেষ্ট হয়। কেউ সফল হয়, কেউ হয় না। গন্তব্যে পেঁৗছার পথ-পন্থা-পদ্ধতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। অনেকে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের কথা বলেন। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় অনেক কষ্টলব্ধ বিষয়। ধৈর্য ধরারও 'ধৈর্য' অনেকের থাকে না। তাই সাফল্য পেতে অনেকে সহজ পদ্ধতির সন্ধান করেন। এ জন্য বেছে নেন চাটুকারিতার মতো মন্দ পদ্ধতি।

কারও অহেতুক, অতিরিক্ত, কখনও বা অনুপস্থিত গুণাবলির প্রশংসা করে তার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার ব্যক্তিত্বহীন ও নির্লজ্জ প্রয়াসের নাম এটি। বলাবাহুল্য, এ সময় তোষামোদকৃত ব্যক্তির কোনো ব্যর্থতা বা দোষ তোষামোদকারীর দৃষ্টিগোচর হয় না কিংবা স্মরণে এলেও তা উল্লেখ করা হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে, স্বনামে-বেনামে এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তবে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সাধারণত অধস্তন ব্যক্তির তোষামোদের শিকার হন।
তোষামোদ সাধারণত ক্ষমতা ও অর্থের পিছু নেয়। কারও ক্ষমতা কিংবা অর্থ ফুরালে তোষামোদকারীও আর তার ছায়া মাড়ায় না। প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন এর শিকার হন, তখন তারা আমোদে গদগদ হন। আর নিজের দুর্বলতা, ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ক্ষতি বয়ে আনেন। সুন্দরের প্রশংসা, ভালো কাজের বাহবা অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু যখন মানুষের প্রশংসা কিংবা গুণকীর্তন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখনই এটা চাটুকারিতার পর্যায়ে পড়ে।

বর্তমান সময়ে অফিস-আদালতে চাটুকারিতার বিস্তার প্রকট। কারণ এখানে সবারই উপরস্থ কর্মকর্তা থাকেন। আর তাকে তুষ্ট করতে পারলেই তো পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সুবিধা। সেটা হতে পারে পছন্দসই নিয়োগ-বদলি কিংবা যে কোনো আনুকূল্য। আপনি কর্মে যতই পেশাদার হন না কেন; বড় কর্তাকে তুষ্ট করতে না পারলে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আপনি কেবলই পেছনে পড়তে থাকবেন। তাই নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আপনাকেও শামিল হতে হবে চাটুকারদের দলে। আর আপনার প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ যদি আপনাকে অবচেতন মনে এ কাজ করতে বাধা দেয় তবে শত দায়িত্বশীলতার পরও পদে পদে আপনি হবেন হয়রানির শিকার। সহকর্মীরা আপনাকে নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করবে, আপনাকে বাঁকা চোখে দেখবে, এমনকি কর্মকর্তার কাছে আপনার আনুগত্য হতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ! পরিণামে আপনার জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ। আপনি অনেক প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন বড় কর্তার আনুকূল্য না পাওয়ার কারণে। এক কথায় বলা যায়, ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আমরা চাটুকারিতার বিস্তার প্রতিনিয়ত অনুধাবন করি। ক্ষমতার পালাবদলে চাটুকারও আপন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য গিরগিটির মতো অনায়াসে রূপ পরিবর্তন করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের কোনো ধর্ম নেই। সময়ে এরা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, কোনো কোনো ইস্যুতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকদেরও দেখা যায় বেকায়দায় পড়ে গেছেন চাটুকারিতার কারণে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা অতীতে বহুবার দেখা গেছে।

ইসলাম চাটুকারিতা পছন্দ করে না। ইসলাম মনে করে, চাটুকারিতার বৃত্ত থেকে বের হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। পরিশুদ্ধ কোনো ব্যক্তি অযাচিত চাটুকারকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেয় না। উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে তার অধীনস্থের মূল্যায়ন হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তেল মারার ওপর নয়। এক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ববোধকে জাগ্রত করতে হবে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াতে হবে। মনে জাগ্রত করতে হবে দেশপ্রেম। তবেই সর্বস্তরে চাটুকারিতার বিস্তার রোধ সম্ভব। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে_ 'আপন ভালো তো জগৎ ভালো'। অতএব সবার আগে নিজের চরিত্র বদলাতে হবে। কারণ মানুষ হিসেবে আমরা কেউ দোষ-ত্রুটির ঊধর্ে্ব নই।

© কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, আলেম ও কলাম লেখক

আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো

এখানে মানুষ থাকে, এই নির্দয় নিষ্প্রাণ দেশে,

এই লৌহপুরীতে?
এই শহরের ভিড়ে পাখিদের ওড়াউড়ি নেই,
গাভীর হাম্বা রব কখনো শুনি না;
শুধু অচেনা মানুষের কোলাহল, গাড়ির কর্কশ শব্দ

বাড়ির উঠানে এখানে ওঠে না চাঁদ, নদীময় তারাভরা
দেখি না আকাশ
জুড়ায় না ক্লান্ত দেহ দখিনা বাতাস

এখানে মানুষেরা এক সাথে হেঁটে যায় কেই কাউকে চেনে না, মানুষ
এখানে থাকে?
ঢের হয়েছে বিদ্যা, ঢের হয়েছে প্রাপ্তি, তবু যেটুকু জীবন
আছে, বুকে নিয়ে
এবার আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো, গলা
ছেড়ে ডাকবো বাহার কাকা,
কানু ভাই তোমরা কোথায়?
ছি, এখানে মানুষ থাকে, এই সোনার খাঁচায়, ইটের জঙ্গলে,
বন্দিশালায়
হোটেলের বদ্ধ ঘরে, ফ্ল্যাট বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে
বৈদ্যুতিক আলোর এই অন্ধকারে,
এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে?
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম,
এখানে কী পেয়েছি প্রচুর সুখ, পেয়েছি প্রচুর শান্তি,

এবার অর্ধেক মানুষ আমি খুইয়ে এখানে
সব অনুভুতি, শুদ্ধতা, আনন্দ
সেই আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো।
সেই বন্ধুগাছ, বন্ধুপাখি, ডোবার কচুরি ফুল,
সেই কাদামাটি জলে ভেজা বাড়ি
কাজলাদিদির কথা লেখা সেই পাঠ্যবই, তোমাদের কারো
কিছুই জানি না;
পাখিরা যেমন আপন পাখিদের সাথে মিশে যায়
আমিও তেমনি আপন মানুষদের মাঝে মিশে যাবো
প্রিয় বৃক্ষ, প্রিয় নদী, আপন মানুষ।

[মহাদেব সাহা]

আমাকে ও মনে রেখো 



পৃথিবী,সূর্য ও চাঁদ এরা জ্যোতিস্ক এবং
আকাশের তারাদের কাছে চলে যাবো ।
আমাকে ও মনে রেখো পৃথিবীর লোক
আমি খুব বেশী দেশে থাকি নি কখনো ।
আসলে তিনটি মাত্র দেশে আমি থেকেছি,এখন
আমি থাকি বঙ্গদেশে,আমাকেও মনে রেখো বঙ্গদেশ তুমি ।

[বিনয় মজুমদার]

আমার সকল আয়োজন 

আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?
কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,
দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের
একমাত্র মৌলিক কাহিনী।

আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত–হাতের আঙুন–আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।

আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুখী নই,
দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয়, যে আমাকে দুঃখ দেবে।
আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,
অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,
পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে
সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফ্‌টি-ম্যাচের মতো বুকে।


[হেলাল হাফিজ]

একজন রাষ্ট্রপতি হত্যার বিচার কেউ চাইল না!

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে রাতে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে নিহত হন ওই রাতে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থায় ভয়ানক ত্রুটি ছিল। তখনকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রটোকল অনুসারে ঢাকার বাইরে রাষ্ট্রপতি যেখানে রাত্রিযাপন করবেন সেখানে কমপক্ষে ১৩৯ জন ইউনিফর্মধারী পুলিশ নিয়োজিত হবেন এবং সাদা পোশাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের আরো ৩৯ জন থাকবেন। কিন্তু রাতে সার্কিট হাউসে ইউনিফর্মধারী পুলিশ ছিল মাত্র ৪৫ জন এবং সাদা পোশাকে ১২ জন। অর্থাৎ মাত্র তিনভাগের একভাগ। ওই রাতে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সার্কিট হাউসে বিএনপির সিনিয়র নেতা ও কয়েকজন মন্ত্রীও ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার বিচার প্রসঙ্গে সম্প্রতি তারেক জিয়া মালয়েশিয়ায় বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে একটি আক্রমণাত্মক ও ভিত্তিহীন অশিষ্ট অভিযোগ তুলেছেন। দুই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে জিয়া হত্যার বিচারের জন্য থানায় একটি জিডি পর্যন্ত না করে এখন তারেক জিয়া উল্টো কথা বলায় সংগত কারণেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শক্ত ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। চীন সফরের পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানের মন্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীও পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নির্মমভাবে নিহত হন। প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিএনপি এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো দিবসটি তাদের মতো করে দেশব্যাপী পালন করেছে। সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণসহ কয়েক ডজন আলোচনা অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের বহুবিধ গুণকীর্তন করা হয়েছে। এ সবের মাধ্যমে তারা তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে। এ রকম মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়া একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বপ্রথম ও সর্বোত্তম কাজ কোনটি? একজন সাধারণ মানুষ নিহত হলেও আমরা বলি হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পাবে না। আত্মার শান্তির কথা তো আছেই, শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বাহ্যিকভাবে যা কিছু করা হয় তার যথার্থতা কোথায়, যদি সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে আত্মার শান্তি হবে কি না তা বলা হয়তো কঠিন, তবে বিচার ব্যতিরেকে শ্রদ্ধা নিবেদন যে পরিপূর্ণ হয় না, তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে বিএনপি একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তাদের রাজনীতির প্রধান সম্বল হলো সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপি অত্যন্ত সফলভাবে জিয়াউর রহমানকে ঘিরে একটা মিথ বা কল্পকাহিনী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই মেয়াদে ১০ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০১-২০০৬ মেয়াদে হাওয়া ভবনে বসে অনেক ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন। এত সুযোগ থাকার পরও বিএনপি একটিবারের জন্য জিয়াউর রহমানের এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা তো করলই না, একটিবারের জন্য বিচারটি চাওয়ার কথা মুখে উচ্চারণ করল না। তাই মানুষের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, বিএনপি কেন জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না? এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপি কখনো দেয়নি। ফলে মানুষ যার যার নিজের অবস্থান থেকে নানা রকম অনুমান করতে পারে। তবে অনুমান তো অনুমানই। তা নিয়ে ড্রইং রুমে চায়ের আড্ডা জমানো যায়। ঝড় তোলা যায় চায়ের কাপে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পত্রিকার কলামে আলোচনা করা যথার্থ নয় বলে আমি মনে করি।

আমি আমার মূল প্রশ্নে আসতে চাই, তা হলো মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএনপির এত ঢাকঢোল পিটিয়ে, এত বড় অনুষ্ঠানাদি করার মানে কী? সেখানে কি মনের অন্তস্তল থেকে উদ্ভাসিত কোনো শ্রদ্ধা থাকে, নাকি তার সবই লোক দেখানো, কেবল জিয়া মিথের সর্বোত্তম রাজনৈতিক ব্যবহার। সব কিছুর উর্ধ্বে যে কথাটি, তা হলো মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে হবে। কোন কাজে ভবিতব্যের কী হাত আছে অথবা নেই, বা কোন কাজটি কী কারণে সংঘটিত হয়, মানুষের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। তবে মানুষের কাজই হলো জোড়াতালি দেওয়া এবং হিসাব মিলবে না জেনেও অনবরত হিসাব মেলানোর চেষ্টা করা। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হলেন। হত্যাকারীরা রেডিও-টেলিভিশনে নিজেরাই ঘোষণা দিলেন তাঁরা শেখ মুজিবুরকে হত্যা করেছেন। অর্থাৎ স্বঘোষিত হত্যাকারীরা সবাই তাঁদের পরিচয় দিলেন। সেই খুনিদের জন্য দায়মুক্তি আইনের ঘোষণা দিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং সেই আইনকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করলেন জিয়াউর রহমান। শুধু সেখানেই ক্ষান্ত হলেন না, ওই খুনিদের জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের দূতাবাসে চাকরি দিলেন, যা পরবর্তী সময় এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারও বজায় রাখে। জিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না- এমন কোনো আইন কেউ করেনি বা কাউকে দায়মুক্তিও দেওয়া হয়নি। তাই এখন সব কিছু দেখেশুনে কোনো কারণে চিত্ত যখন দুর্বল হয়ে যায় এবং মন থেকে যৌক্তিকতা তার শক্তি হারাতে থাকে তখন মনে হয় তাহলে কি ভবিতব্যই নিজের থেকে স্বউদ্যোগে কোনো দায়মুক্তি আইন করে রেখেছে!

প্রথমেই বলেছি, কোনো অনুমানভিত্তিক কথা বলব না। তাই পাঠকের দৃষ্টি এখন অন্যদিকে ফেরাতে চাই। এমন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষকে যেন আর দেখতে না হয় সে জন্য এই ঘটনার পূর্বাপর যে প্রেক্ষাপট ছিল তার কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করব। কলামের স্থান সীমাবদ্ধতার কারণে সব ঘটনার উল্লেখ করা যাবে না। অনেকে বলেন, রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসেন, তাঁর পুরো শাসনামল ছিল রক্তমাখা এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি, শেষমেশ তিনিও রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে চলে গেলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে খোন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করলেন। তারপর পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর আরেকটি ভয়াবহ রক্তপাতের ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন, যদিও বিচারপতি সায়েম কিছু দিনের জন্য নামেমাত্র রাষ্ট্রপতি ছিলেন। একসময় তিনি রাষ্ট্রের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদ একাই ধারণ করলেন- রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান এবং বিএনপির সভাপতি। তাঁর শাসনকালকে অন্যান্য সামরিক শাসকদের মতো দীর্ঘ বলা না গেলেও একেবারে কম নয়, একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। এই সময়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রায় ১৯-২০টি সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয় ও প্রতিটি ঘটনার জের ধরে সেনাবাহিনীর ভেতরের মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে অনেকের ফাঁসি হয় এবং অনেকের আবার ঠুনকো অজুহাতে চাকরি চলে যায়। জিয়াউর রহমান নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তাঁর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা চরম উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হন, যার ধারাবাহিকতা এরশাদও বহাল রেখেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর যথেষ্ট উপযুক্ত ও সিনিয়র অফিসার থাকা সত্ত্বেও জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান বানালেন এরশাদকে। বিএনপির পক্ষ থেকে এখন জিয়া হত্যার অভিযোগের আঙুল উঠছে এরশাদের দিকে। একজন অফিসার মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ঢাকায় থেকেও যুদ্ধে যোগদান করলেন না। তারপর মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি ছুটিতে এসে ছুটি শেষে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। অর্থাৎ অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন না। অন্য আরেকজন অফিসার নিজের ও পরিবার সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন। এই দুজনের তুলনামূলক মূল্যায়ন কি শুধু সিনিয়রিটির ভিত্তিতে হবে? মেধা, দেশপ্রেম, অসীম সাহস ও বীরত্বের কোনো মূল্য কি থাকবে না? ওই সময় সবচেয়ে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মেধা বিচারে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে কারো তুলনা ছিল না। এমন ঘটনাও আছে, একাত্তরের জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বাঙালি অফিসার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তারপর যুদ্ধের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে পোস্টিং নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। এই অফিসার পাকিস্তান থেকে মেজর হিসেবে ফেরত আসার পর বাংলাদেশে মেজর জেনারেল হয়েছেন। অথচ জিয়া হত্যাকাণ্ডের অজুহাতে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে স্ক্রিনিং বোর্ডের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল, কিন্তু বিএনপি ছিল একেবারে নিশ্চুপ। এরশাদকে সেনাপ্রধান করার পর মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মানসিক দ্বন্দ্বটির আরো বিস্তার ঘটে। বলা হয়ে থাকে, এরশাদ সেনাপ্রধান হিসেবে এই দ্বন্দ্বটির নিরসন না করে বরং তার সুযোগে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল′ নীতির আওতায় জিয়ার আশীর্বাদে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের আরো কোণঠাসা করার ব্যবস্থা করেন। এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমরা তখন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কনিষ্ঠ অফিসার ছিলাম। তাই ওই সময়ের সিনিয়র অফিসারদের খবর আমাদের পর্যন্ত খুব একটা পৌঁছাত না। বলা যায় পরবর্তী সময় এ ঘটনাবলি আমাদের কাছে ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হতে থাকে। তবে এই মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মানসিক দূরত্বের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এখনো ভীষণ পীড়া দেয়। আর জুনিয়র অফিসার থাকা অবস্থায় অনেক অমুক্তিযোদ্ধা অফিসার আমার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাঁদের কারো ভেতর এ রকম কোনো মানসিকতার বিন্দুমাত্র আমি কখনো দেখিনি বা অনুভবও করিনি। এখন এই পরিণত বয়সে মনে হয় পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের মধ্যে যাঁরা সিনিয়র ছিলেন তাঁরা সংকীর্ণ পদ-পদবির লোভে এবং হীনম্মন্যতার বশবর্তী হয়ে সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা হয়তো নিজের অবস্থানকে শক্ত করার জন্য পাকিস্তান প্রত্যাগত মধ্যপর্যায়ের অফিসারদের অনেককে নিজেদের বলয়ে টেনে এনেছেন। তা-ও ওই পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে। তখন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারসহ সেনাসদস্যের সংখ্যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে অনেক বেশি। তবে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করাসহ যাঁরা সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সংগঠক ও কমান্ডার ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলাদেশের গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনকে জিয়াউর রহমান মন্ত্রী বানালে সেনাবাহিনীর সব পদ ও শ্রেণির মধ্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৮০ সালের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস। তখন সেনাকুঞ্জ ছিল না এবং এখনকার মতো সব কিছু এত সুসংগঠিত ছিল না। ওই সময় সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিল কুর্মিটোলা গল্ফ ক্লাবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। আমি তখন জুনিয়র অফিসার হিসেবে ঢাকায় মিলিটারি পুলিশে কর্মরত। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত আমাদের লোকজনের সঙ্গে আমিও ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রপতি আসার আগেই সবাই আসছেন। একসময় পতাকাবাহী গাড়িতে এলেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। আমি নামার স্থান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারণ আমি মেহমানদের অভ্যর্থনাকারীদের মধ্যে নেই। দেখলাম, শাহ আজিজুর রহমানের গাড়ি আসছে দেখে অভ্যর্থনার দায়িত্বে নিয়োজিতসহ অন্য অফিসাররা অভ্যর্থনা জানানোর জায়গা থেকে যে যার মতো করে সরে গেলেন। এটা নিয়ে পরবর্তী সময় আর কোনো আলোচনা হয়েছিল কি না, তা আর জানতে পারিনি।

 এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থা মনিটরিং ও তদারক করার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থানে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন, যেমন- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান, পুলিশ প্রধান প্রভৃতি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ডিসি-এসপিসহ মোট ১৮ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। আর বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাসই ঢাকায় চাকরি করেছেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁরা সবাই ছিলেন জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। সুতরাং কথা থেকে যায়, ওই রাতে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থায় এমন ঘাটতি কি সবার চোখ এড়িয়ে গেল? মানুষ তাই-ই বিশ্বাস করবে, নাকি অন্য কিছু। এর সব কিছুই বের হয়ে আসত, যদি ওই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হতো এবং বিচার হতো। ৩০ মে ঘটনার পর রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের বিচার নয়, সেনা বিদ্রোহের (মিউটিনি) অভিযোগে কিছু অফিসারকে অভিযুক্ত করে তাদের বিচারের জন্য ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের আয়োজন করা হয়। তার আগে চার সদস্যবিশিষ্ট সেনা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গঠন করা হয় তিন সদস্যবিশিষ্ট সেনা প্রসিকিউশন টিম। অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি সেনা টিম। এত বড় একটা ঘটনার তদন্ত শেষ করা হয় মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে। সেই তদন্তের ওপর ভিত্তি করে কোর্ট মার্শাল পরিচালিত হয়। ১০ জুলাই ১৯৮১ থেকে ২৬ জুলাই ১৯৮১, মাত্র ১৭ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করে ১২ জন অফিসারকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তদন্ত ও বিচারের জন্য উপরোক্ত যে টিমগুলোর কথা উল্লেখ করলাম তাদের তালিকা দেখলে এবং পরবর্তী সময় সেনাবাহিনীতে তাদের প্রায় সবার শনৈঃশনৈঃ উন্নতির প্রতি নজর দিলে অনেক কিছু বোঝা যায়। ৭ জুন ১৯৮১, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি রুহুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন নড়াচড়ার পর তা ওই যে স্তব্ধ হয়ে গেল, আর কোনো দিন খবর হলো না। কেন? সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।

লেখক : মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.), কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক