Wednesday, 30 April 2014

আমি এখনো বহু বিষয়ে মন ঠিক করতে পারিনি
যেমন কোনোদিন আমি বিয়ে করবো কি করবো না
অথবা কোনোদিন যাবো কি না বেশ্যালয়ে
কাউকে কখনো খুন করবো কি,
কোনোদিন চরস খেয়ে পড়ে থাকবো কিনা রাস্তায়
অথবা কিনা কোনো ফকির দরবেশের সাথে চলে
যাবো ধর্মশালায়
কোনো একদিন লাটভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের এই দুঃখ-
ধান্ধার জন্যে
খুব চেঁচিয়ে গালাগাল করবো কি না
একদিন সারারাত ঢিল ছুঁড়ে ভাঙবো কিনা ডিআইটি-র ঘরি
কোনোদিন সন্ধ্যেবেলা
পাওয়ার হাউসের সুইচটা টিপে
সারা শহরে বাধিয়ে দেবো কি না ভুতুরে কান্ড
……………………………….
……………………………….

মতিঝিলের বাণিজ্য এলাকায় পর পর কয়েক সপ্তাহ চালাবো
কিনা হরতাল
অথবা সস্তা জনসেবার বক্তৃতা দিয়ে নিজের আখের গোছাবো কিনা
নাকি হুজুর হুজুর করে কাটিয়ে দেবো জীবনটা
সত্যি কোনোদিন আমি এই দায়িত্বশীল লোকটা
যাচ্ছেতাই একটা কিছু করে বসবো কিনা
এমনি বহু বিষয়ে আমি এখনো মন ঠিক করতে পারিনি-

[~মহাদেব সাহা~]

আদি উপাসনালয় --
উঠিল আবার নূতন করিয়া -- ভূত প্রেত সমুদয়
তিনি শত ষাট বিগ্রহ আর মূর্তি নূতন করি'
বসিল সোনার বেদীতে যে হায় আল্লার ঘর ভরি।

সহিতে না পারি এ দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান,
ধেয়ানে মুক্তি-পথ খোঁজে নবী, কাঁদিয়া ওঠে পরান।
খদিজারে কন-- "আল্লাতালার কসম, কাবার ঐ
"লাৎ" "ওজ্জা"র করিব না পূজা, জানি না আল্লা বই।
নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া
কোন্‌ নির্বোধ পূজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া!"

সাধ্বী পতিব্রতা খাদিজাও কহেন স্বামীর সনে--
"দূর কর ঐ লাত্‌ মানাতেরে, পূজে যাহা সব-জনে।
তভ শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতির্ময়ের দিশা
পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার আঁধার নিশা।"

ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল -- মোহাম্মদ আমিন
করে না কো পূজা কাবার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন।

© কাজী নজরুল ইসলাম

Friday, 25 April 2014

এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না 

এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর...
কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;

তোমাকে একটিবার
দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।

যদি জানি একবার দেখা পাবো
তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে,
লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;

একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।

তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না


— মহাদেব সাহা

Thursday, 24 April 2014

বিএনপি দিয়েছে অপশাসন, আওয়ামী লীগ সুশাসন দিতে পারছে না

বাংলাদেশ থেকে যাঁরাই এখন লন্ডনে আসেন না কেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের পক্ষের লোক হোন, বিপক্ষের লোক হোন কিংবা নিরপেক্ষ হোন, তাঁদের অধিকাংশের মুখে একটাই শঙ্কার কথা শুনি, দেশ ঠিকমতো চলছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে তো আর দুই বছরও নেই। যদি ক্ষমতায় থাকার অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা দেশবাসীর প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে চমকপ্রদ কিছু দেখাতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে কী হবে তা বলা যায় না।
একটু শঙ্কিতভাবেই তাদের জিজ্ঞেস করি, সম্প্রতি পাশের ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে সিপিএমের ভাগ্যে যা ঘটেছে, তা কি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বেলায় ঘটতে পারে? এ ব্যাপারে আবার তাঁরা সহমত পোষণ করেন না। কেউ কেউ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেন, না, পুরোপুরি তা ঘটবে না। কারণ বিএনপির গত সরকার দেশকে শুধু অপশাসন উপহার দিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে অপশাসন উপহার দেয়নি। তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং হতাশ দেশবাসী আগামী নির্বাচনে কী করবে এখনো তা স্পষ্ট নয়। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন বা দেশের পৌরসভাগুলোর নির্বাচনের ফলও তার প্রকৃত দিকনির্দেশনা নয়।

লন্ডনে বসে এসব কথাবার্তা শুনি, আর ঢাকার বন্ধুবান্ধব, যাঁদের সঙ্গে আবার নিত্য যোগাযোগ, তাঁদের কাছে সংশয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি তাঁরা এ সম্পর্কে কী ভাবছেন? আমার এক রাজনীতিক-কাম-কলামিস্ট বন্ধু বলেছেন, 'বিএনপির গায়ে এত কালি যে তারা আগামী নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারবে না। তা জেনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কোনো অজুহাতে নির্বাচন বর্জন করে তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টির দ্বারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবে।'

তাদের সহযোগী ও মিত্র যুদ্ধাপরাধীদের দলটি তো নিশ্চিতভাবে জানে, আগামী নির্বাচনে তাদের বিলুপ্তি নিশ্চিত। তারা ১৯৭৫ সালের মতো আরেকটি ঘটনা ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জঙ্গিদের উসকে দিয়ে তারা যে এই চেষ্টা করতে পারে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তার প্রমাণ। এর সঙ্গে বিএনপির হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ তো এখন উঠে আসছে। আমার এই বন্ধুর ভয় আগামী নির্বাচনের ফল নিয়ে নয়; তাঁর ভয় শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে।

অন্যদিকে আমার এক প্রবীণ কলামিস্ট বন্ধু, যিনি এখনো আওয়ামী লীগপন্থী, কিন্তু 'প্রথম আলোর' নিরপেক্ষ কলামিস্ট, তাঁর মতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬০টি আসন পেলেও তিনি বিস্মিত হবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি, তাহলে কি আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল জয় (massive victory) নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসবে? তিনি সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত।

বন্ধুদের কথা থাক, আমাকেও অনেকে জিজ্ঞেস করেন, দেশের আশু ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছি? নির্বাচন তো দ্রুত এগিয়ে আসছে। কী হতে পারে? আমার জবাব, আরো কয়েকটা মাস না গেলে কী হবে, তা বলা মুশকিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানেও যেভাবে দেশ চালাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রী যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তার যদি পরিবর্তন না হয় এবং যথাসময়ে নির্বাচন হলে যদি বিএনপি তাতে যোগ দেয়, তাহলে হ্যাং পার্লামেন্ট বা ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়ে যেতে পারে। তাতে ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির মতো সুবিধা হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির। এরশাদ তাহলে রাষ্ট্রপতি অথবা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদটি কোয়ালিশন গঠনের শর্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে দল এই শর্তে রাজি হবে, তাদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন।
তবে পরিস্থিতি অন্যদিকেও গড়াতে পারে। বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে, তবে দৃশ্যান্তর ঘটতে পারে অন্যভাবে। সে কথায় পরে আসছি। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কী আসবে না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের এখনকার বক্তব্য অত্যন্ত পরস্পরবিরোধী। এক মুখে তারা বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন এবং সেই সরকারের তদারকি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে স্বয়ং খালেদা জিয়া দাবি করছেন, এখনই মধ্যবর্তী নির্বাচন চাই। যদি হাসিনা সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়; তাহলে বিএনপি কি এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যাবে? এই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না এবং তার জবাবও বিএনপি দিচ্ছে না।

আমার ধারণা, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার দাবিতে যতই দরকষাকষি করুক, শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় এসে (সরকারকেও সমঝোতায় আসতে হবে) নির্বাচনে যোগ দিতে হবে। নির্বাচনে জেতা সম্পর্কে তাদের মনে এখন ক্ষীণ হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। ফলে সাংগঠনিকভাবে ভাঙা ঘর জোড়া দিতে পারলে তারা নির্বাচনে আসবে। আওয়ামী লীগকে সহজ ওয়াকওভার দেবে না।

তারা জানে, এই ওয়াকওভার দেওয়ার অর্থ হবে মুসলিম লীগের মতো বিএনপির অস্তিত্বের বিলুপ্তি। বিএনপি কোনো আদর্শের ঐক্যে বাঁধা দল নয়। ক্ষমতা ও বিভিন্ন স্বার্থ-সুবিধার লোভে বিভিন্ন দলের এবং দলবিহীন সুযোগসন্ধানী নেতা-কর্মীরা এসে বিএনপিতে জুটেছিলেন। এই দলের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে 'আপসহীন নেত্রী'র প্রতি কোনো প্রকার আনুগত্য বা ভালোবাসা থেকে তাঁরা নেত্রীকে বা তাঁর দলকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন, তার কোনো সম্ভাবনা নেই।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তাতে দলের অনেকেরই টনক নড়ে উঠেছে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখলে মওদুদ আহমদ এবং তাঁর মতো আরো অনেকে 'দেশনেত্রী'কে ছেড়ে দিয়ে 'পল্লীবন্ধুর' দলে আবার চলে গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমাকে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, বিএনপি যদি আগামী সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে অবশিষ্ট যে দু-তিনজন শীর্ষ নেতা এখনো আছেন, তাঁরা জে. এরশাদের জাতীয় পার্টিতে চলে যেতে পারেন। যদি তাঁরা না-ও যান, তাহলেও তাঁদের আনুগত্যের ওপর বেগম জিয়া আর ষোল আনা নির্ভর করতে পারছেন না। বিশেষ করে মওদুদ আহমদের চরিত্র তিনি ভালোভাবে জানেন।

সম্ভবত এসব কারণেই বিএনপি নেত্রী দল থেকে অপসারিত ড. বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, কর্নেল অলি আহমদ (অব.) প্রমুখ পুরনো নেতাদের কাছে আবার ধরনা দিচ্ছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, সেই কাদের সিদ্দিকীকেও ডেকে এনে তাঁর দেওয়া গামছা উপহার হিসেবে গ্রহণ করছেন। যদি নির্বাচনের আগে তাঁর দলে ভাঙন দেখা দেয়, তাহলে দলে নেতৃত্বশূন্যতা ঠেকাতেও বিতাড়িতদের আবার সেধে দলে আনা তাঁর প্রয়োজন। তাঁর সুপুত্র তারেক রহমান যতই বিদেশে নাটের গুরু সেজে বসে থাকুন, গুরুতর দুর্নীতি থেকে শুরু করে হত্যা-ষড়যন্ত্রের মামলার আসামি হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসার সাহস দেখিয়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াবেন, সে সম্ভাবনা কম।


কিন্তু বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কোনো অজুহাতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে না যায়, তাহলে বিকল্প থেকে লিবারেল, লিবারেল থেকে ব্রিজ সিদ্দিকীর গামছা পার্টি পর্যন্ত ছোটাছুটি করে লাভ কী? বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তাঁরা কী আশায় ওই দলের সঙ্গে জোট বাঁধবেন? ডা. বি. চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, তিনি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। এটা তো তাঁর মুখের কথা। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি না যায় এবং আওয়ামী লীগ থেকে যদি তাঁকে বা তাঁর দলকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়, তাহলে ডা. বি. চৌধুরী কী করবেন, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যত দূর জানি, আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদেরও বিকল্পধারার নেতাদের সঙ্গে যথেষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

আমার গণনা যদি ভুল না হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছাড়াই সরকারের সঙ্গে কোনো একধরনের সমঝোতা করে বিএনপিকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই নির্বাচনে যেতে হবে। সরকারকেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ ধরনের সমঝোতায় যেতে হবে। নইলে নির্বাচন যত অবাধ ও সুষ্ঠু হোক দেশবাসীর কাছে তা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আবার নির্বাচনে না গিয়ে কোনো ধরনের অশুভ শক্তির সহায়তায় বিএনপি দেশে কোনো অঘটন ঘটাতে পারবে বা আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে পারবে_সে পরিস্থিতি দেশে নেই এবং সে ক্ষমতাও তাদের কোমরে নেই। মির্জা ফখরুল ইসলামের বাগাড়ম্বর অসারের তর্জন-গর্জন মাত্র।

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে সুচতুর রাজনীতিক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ সম্ভবত এই আশায় দিন গুনছেন যে বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে, তাহলে আওয়ামী লীগের মহাজোট ত্যাগ করে তিনি তাঁর দল নিয়ে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সংসদের ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবেন। তাঁর মনে হয়তো ক্ষীণ আশা, দেশের মানুষ বড় দুটি দল সম্পর্কে এতই ক্ষুব্ধ ও হতাশ যে তারা হয়তো আগামী সাধারণ নির্বাচনে সেই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে জাতীয় পার্টির ভোটের বাঙ্ইে বেশি ভোট দিয়ে ফেলতে পারে। যদি দেয়, তাহলে এককভাবে বা দুই দলের কোনোটার সঙ্গে কোয়ালিশন করে তাঁরই আবার সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি। আর তা যদি না হয়, তাহলে নির্বাচনে তিনি পর্যাপ্ত আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল গঠন করতে পারবেন এবং তিনি হবেন বিরোধী দলের নেতা।

এ সবই এখন পর্যন্ত স্বপ্নপূরাণ, কী হবে তা এখন বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, বিএনপি আগামী নির্বাচনে না এলে তার অস্তিত্ব যেমন সংকটাপন্ন হবে, তেমনি বিএনপিকে নির্বাচনে না আনতে পারলে সেই নির্বাচন দেশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অনেক ভালো কাজ করেছে। যেটা পারেনি তা হলো, দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়া। এর বড় কারণই হলো যে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে শেখ হাসিনা এবার সরকার গঠন করেছিলেন, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপযুক্ত, দক্ষ ও যোগ্য মন্ত্রী দ্বারা তিনি সরকার গঠন করতে পারেননি। তার কাফ্ফরা এখন তিনি দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক সরকার দক্ষ ও যোগ্য না হলে যা হয়, আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। বাংলাদেশেও এখন তা-ই হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে আমাদের আমলাতন্ত্রও আবার ব্রিটিশ আমলের (এমনকি পাকিস্তান আমলের) মতো সুশিক্ষিত ও দক্ষ নয়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর মনে যত আন্তরিক ইচ্ছাই থাকুক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্য মন্ত্রী এবং অদক্ষ আমলাদের কর্তৃত্বে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে, তা দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারছে না। পদে পদে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এখন বর্তমান সরকারের হাতে সময় খুবই কম। অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী যদি মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটিয়ে দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়ার মতো দক্ষ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার পুনর্গঠন না করেন, তাহলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে কী আসবে না, সেটা বড় কথা হবে না, আওয়ামী লীগ তার নিজের ভ্রান্তি ও একগুঁয়েমির জন্য এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে। তাকে বিপর্যস্ত করার জন্য কোনো বড় শত্রুর দরকার হবে না।

© আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

Tuesday, 22 April 2014

আরব বসন্ত লিবিয়ার জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ


আরব বসন্তের ছোঁয়ায় উজ্জীবিত লিবিয়ায় ঘটেছিল গণবিপ্লব। লৌহমানব গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের কঠোর শাসনের হয় অবসান। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পালিয়েও বাঁচতে পারেননি গাদ্দাফি। বিপ্লবীদের হাতে নির্মমভাবে মরতে হয় তাকে। গৃহযুদ্ধে মারা যায় অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। এরপর কেটে গেছে দু'দুটো বছর। শৃঙ্খলতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনতার মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল লিবিয়ার মানুষ, সেই স্বপ্ন কী তাদের পূরণ হয়েছে? না, হয়নি। বরং ঘটছে ঠিক উল্টোটা। সারাক্ষণ হত্যা, গুম, বোমা হামলা, অপহরণের আশংকায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে তাদের। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। আরব বসন্ত তাদের জন্য আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ বয়ে এনেছে- এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ। তবে অধিকাংশ লিবিয়ান এখনও গণবিপ্লবের চেতনা বুকে ধারণ করে আছেন। আশায় বুক বেঁধে তারা স্বপ্ন দেখছেন নতুন এক দেশ গড়ার। যেখানে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি থাকবে না, সকলে সম্মিলিতভাবে দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু গত দু'বছরে সেখানে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে শান্তির আশা ক্রমেই সুদূরপরাহত হতে চলেছে।

গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তার জের আজও চলছে। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আজও দাঁড় করানো যায়নি। দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ দূর করে জাতীয় ইস্যুতে তাদের একাত্ম করতেও ব্যর্থ হয়েছে লিবিয়ার বর্তমান সরকার। দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার করা যায়নি। অর্থনীতি বলা যায় 'ব্যাক ফুটে' চলে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত্ দেশের তেলক্ষেত্রগুলো অবরোধ করে রেখেছে বঞ্চিত শ্রমিকরা। তাদের সমর্থন দিচ্ছে সশস্ত্র মিলিশিয়ারা। সপ্তাহখানেক আগে ত্রিপলির বিদ্যুত্ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় জঙ্গিরা। গত ১৩ মে বেনগাজি শহরে অবস্থিত একটি হাসপাতালের সামনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়। ১১ সেপ্টেম্বর বেনগাজি শহরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

লিবিয়ায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত গতবছরের মাঝামাঝি থেকে। ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট অজ্ঞাত পরিচয় সশস্ত্র জঙ্গিরা ত্রিপলির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুফি মসজিদ প্রকাশ্য দিবালোকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এর একদিন আগে অপর একটি সুফি স্থাপনায় হামলা চালায় জঙ্গিরা। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর বেনগাজি শহরে। আমেরিকান কনস্যুলেট অফিসে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা লিবিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জে. ক্রিস্টোফার স্টিফেন্সকে হত্যা করে। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পদত্যাগ করেন যু্ক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের দূত সুসান রাইস।

বর্তমানে লিবিয়ায় সহিংসতা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আগে কেউ অপহূত হলে মনে করা হতো গাদ্দাফিবাহিনীই ঐ অপকর্মটি করেছে। কিন্তু সমপ্রতি গাদ্দাফির সাবেক গোয়েন্দা প্রধান আব্দুল্লাহ আল-সেনুসির সুন্দরী মেয়ে অপহরণের ঘটনা সেই ধারণাকে বদলে দিয়েছে। কারণ ঐ অপহরণের পেছনে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী নিজেই জড়িত ছিল। কয়েকদিন পরই অবশ্য মেয়েটি মুক্তি পায়। আর নিরাপত্তা বাহিনী খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করায় যে 'নিরাপত্তার' প্রয়োজনেই মেয়েটিকে নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থাও অনেক কমে গেছে।

গাদ্দাফির পতনের পর স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু হয় লিবিয়ার। ২০১২ সালের ৭ জুলাই লিবিয়ার মানুষ প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ২০১২ সালের ৮ আগস্ট ন্যাশনাল ট্রানসিশনাল কাউন্সিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। কংগ্রেস কর্তৃক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আলী জিদান গতবছরের অক্টোবরে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন, যার উপর দায়িত্ব দেয়া হয় দেশের জন্য একটি সংবিধান তৈরি এবং ২০১৩ সালে নতুন করে একটি সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। কিন্তু তারা এ কাজ করবেন কি, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই তাদের জন্য এখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাদ্দাফির বাহিনীর সাথে যুদ্ধশেষে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই অস্ত্র জমা দিতে রাজি হচ্ছেন না, যার ফলে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। এছাড়া কিছু নতুন বাহিনীও গজিয়ে উঠেছে। এ সমস্ত সশস্ত্র শক্তির সঙ্গে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে আপসও করতে হচ্ছে। যেমনটি করতে হয়েছে গত মে মাসে। বন্দুকধারীদের চাপের মুখে সরকারি অফিসগুলো থেকে গাদ্দাফির আমলে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের অপসারণ সংক্রান্ত একটি বিল পার্লামেন্টে পাস করতে বাধ্য হয় দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। 'লিবিয়ান থিংক ট্যাংক' হিসেবে খ্যাত আনাস আল-গোমাতি এ প্রসঙ্গে বলেন, 'পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে অনেকে বলতে শুরু করেছেন যে বর্তমান সরকার মিলিশিয়াদের জন্যই কাজ করছে।' সরকার অবশ্য পশ্চিমাদের সহায়তায় মিলিশিয়াদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের অনেকেই নতুন নেতৃত্বের অধীনে কাজ করতে রাজি হচ্ছে না। তাদের ধারণা নতুন নেতৃত্বের অধীনে গেলে তারা গাদ্দাফীর আমলের মতোই দমন-নির্যাতনের শিকার হবেন।

উদারপন্থি এবং উগ্রপন্থি ইসলামি শক্তিগুলোর বিরোধও বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতবছর সাধারণ জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনে উদারপন্থি ইসলামিরাই বেশিরভাগ ভোট জিতে নেন। কিন্তু কংগ্রেসের অনেক স্বতন্ত্র সদস্য একজোট হয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের লিবিয়ান সংস্করণ জাস্টিস এন্ড কনস্ট্রাকশন পার্টিসহ কয়েকটি উগ্রপন্থি ইসলামি দলকে সমর্থন দেন। এতে উগ্রপন্থিদের আধিপত্য বেড়ে গেলে সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে উদারপন্থি সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী আলী জিদান পড়েছেন মহা সমস্যায়। কিছুদিন আগে মিশরের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠকের কারণে জিদানের পদত্যাগই দাবি করে বসে উগ্রপন্থি লিবিয়ানস জাস্টিস এন্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি। কারণ তাদের সতীর্থ মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা প্রেসিডেন্ট মোরসিকে উত্খাতের পেছনে জেনারেল ফাত্তাহর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।

আঞ্চলিক বিরোধও দেশটির অন্যতম সমস্যা। লিবিয়ার দীর্ঘ-অবহেলিত পূর্বাঞ্চলেই গোলযোগ সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই আততায়ীদের হাতে নিহত হচ্ছেন অসামপ্রদায়িক লিবিয়ানরা। এজন্য তারা প্রধানত উগ্রপন্থি ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে দুষছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ার পর বেনগাজি থেকে বিতাড়িত হয় ইসলামি উগ্রপন্থি জিহাদি গ্রুপ আনসার আল-শরিয়া। বর্তমানে তারা আবার সেখানে ফিরতে শুরু করেছে। এলাকাবাসীকে খুশি করতে তারা সেখানে ক্লিনিক খুলে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। তারা ত্রিপোলি ও বেনগাজির মাঝে আজদাবিয়াতেও ঘাঁটি খুলে বসেছে। নিরাপত্তার অভাবে লিবিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। একটি কোম্পানি হিসেব করে দেখেছে লিবিয়ায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের কোন প্রকল্প স্থাপন করতে হলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে তাদের আরও বাড়তি ২ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। তবে সরকার হতোদ্যম হয়ে পড়লেও হাল ছাড়েননি লিবিয়ার সাধারণ মানুষ। পূর্বাঞ্চলের মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন। টাউন কাউন্সিলগুলো হাসপাতাল ও স্কুল চালু রেখে জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া তারা আরও নানা জনহিতকর কাজ করছেন যেসব করার কথা ছিল সরকারের।

-[ আশেক খান আলেখীন]-

Wednesday, 16 April 2014

কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তাই।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে র্ভৎসনা ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নাই দাতঁ?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
“তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে
দংশি কেমন করে?”
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?

## মূল: শেখ সা’দী অনুবাদ : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

মজার দেশ 

এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !
       আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
       ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় 'ক্যাস্টর-অয়েল' -রসগোল্লা রেখে !
       মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
       অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
       ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
       বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !

জিলিপি সে তেড়ে এসে, কামড় দিতে চায়;
কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায় !
       পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ, গাড়ি ছোটে জলে !

মজার দেশের মজার কথা বলবো কত আর;
চোখ খুললে যায় না দেখা মুদলে পরিষ্কার !

[যোগীন্দ্রনাথ সরকার]

Monday, 14 April 2014

আলোয় আলোকময় ক'রে হে


আলোয় আলোকময় ক'রে হে
       এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার
       মিলালো মিলালো।
             সকল আকাশ সকল ধরা
             আনন্দে হাসিতে ভরা,
             যে দিক-পানে নয়ন মেলি
                    ভালো সবই ভালো।
তোমার আলো গাছের পাতায়
       নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
তোমার আলো পাখির বাসায়
       জাগিয়ে তোলে গান।
               তোমার আলো ভালোবেসে
               পড়েছে মোর গায়ে এসে,
              হৃদয়ে মোর নির্মল হাত
                    বুলালো বুলালো।

[ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর--
বোলপুর, ২০ অগ্রহায়ণ, ১৩১৬]

বৈশাখ একটি পাঠের নাম

সবুজ পাঠের মধ্যে মাথা দিচ্ছে বৈশাখ
আকাশ ছুটছে—তলপেটে ফুলকো মেঘ
কখন যে কি, আরো একটি খই ফোটানো চাল-বালি
তরমুজের ডোরা শরীরে ডুবে যাচ্ছে কাকের চঞ্চু … যে ডাকে সে ভোর। ভোর একটি নদী।
প্রাথমিক হাওয়ার তোড়ে পাঁচের ঘরের নামতা শেষে
পাতা উল্টিয়ে গ্রামখানি ফুটলে
কুমোর যায় তো পদ্মে স্বরস্বতী
ময়রা যায় তো সংক্রান্তির বাতাসা
শীল যায় তো মাতৃদায় নামে
কামার যায় তো লাঙ্গলের ঈষে মাটি
সোনালি পাঠের মধ্যে হাত বাড়ায় এক লহমা বৈশাখ …
ডালে ফুটেছে বার্ষিক রং
একটি চুক্তি মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছুলে
যা মেলে তা দুপুর। দুপুর একটি বন্দরের নাম।
পঞ্জিকা খুলে মিলিয়ে নিচ্ছে
পেশকার আসে তো কালো ছাতা উল্টায়
দর্জি আসে তো জামার বোতাম লটকায়
কবিরাজ আসে তো বাসক পাতার শরীর চূর্ণ হয়
বাবুর্চি আসে তো লবঙ্গের ধুম ঘ্রাণ ছোটে
গোলাপী পাঠের মধ্যে চোখ দেয় বৈশাখ …
বৈশাখ একটি বটমূলের নাম
বৈশাখ একটি ফোয়ারার নাম
বৈশাখ একটি কৌশলের নাম
বৈশাখ একটি সুনীল পাঠের নাম হ’লে
ছুটি কাটাতে সন্ধ্যায় কুয়াকাটা যাবো।

[হাবীবুল্লাহ সিরাজী ]


বৈশাখের প্রথম দিবসে


তোমাকে আকাঙ্ক্ষা করি। ছায়াস্মৃতি ওড়ে
আমি যদি দুকদম হাঁটি, তুমি হাঁট একশ মিটার
বরফের দাহ্যক্রোধ– নিভন্তকে পোড়ে

এত পুঞ্জ। এত রূঢ়। প্রতিবন্ধী ঘ্রাণে
দূরত্ব বাড়ছে দ্রুত। তখনো কি সত্য নয় চিরলোকাচার
প্রেমের বশ্যতা শেখা– হয় কিছু মানে?

ক্লান্তির ঝলক মুখে। পাতা ঝরে যাবে
মেঘের আলস্য থেকে কেউ কেউ খুঁজে নেবে জলবহ্নিধারা
স্থায়ী চাকরির মতো ভালোবাসা পাবে!ইচ্ছে আলো স্রোততৃষ্ণা কখনো কি বসে!
হৃদয়ে প্রশান্তি চাই। ভুলে যাও অর্থহীন দ্রবণের তাড়া
দেখা হোক বৈশাখের প্রথম দিবসে

[ফারুক মাহমুদ ]

Thursday, 10 April 2014

সত্য ফেরারীআসাদ চৌধুরী--   


কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।

গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,
নকশী পাতিল, চৌকির তলা,
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!

সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,
কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,
ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,
ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে
ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে
সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!

কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই
রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই
পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই
নাটকের কোন সংলাপে নেই
শাসনেও নেই, ভাষণে নেই
আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই
রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,
উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই
লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই
পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই
হতাশায় নেই, আশাতেও নেই
প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই
এমন কি কালোবাজারেও নেই
কোথায় গেলেন সত্য?

Saturday, 5 April 2014

মিশরে কি আরব বসন্তের করুণ পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে

ভ্যালি অব দ্যা ভিজিটরস্ হিসেবে খ্যাত মিশর এখন অশান্ত ও অস্থিতিশীল এক জনপদ। অনিরাপদ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পশ্চিম আফ্রিকার ভাগ্যবরণের পথে কি আরবদের বিবেক ও বুদ্ধিভিত্তিক রাজধানী নীলনদের দেশ মিশর এগিয়ে যাচ্ছে? তিউনিসিয়া থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে যাওয়া আরব স্প্রিং মিশরের লৌহমানবের কপাট ভেঙ্গে চুরমার হয়ে তাহরীর স্কয়ারে লুটিয়ে পড়েছিল, মাত্র দেড় বছর পূর্বের সে জাগরণ কয়েকদিনের ব্যবধানে ইতিহাসে পরিণত হবে মিশর তথা বিশ্ববাসী কি জানতো? বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে সামরিক শাসনের অধীন স্থিতিশীল মিশর কিভাবে গণতন্ত্রের পথে হাঁটার শুরুতেই হোঁচট খেল, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসির বাড়াবাড়ি ধরনের ইসলামীকরণ নীতি কিভাবে সামরিক বাহিনীসহ বিশ্ব মোড়লদের প্রতিপক্ষ করে তুলল।

মোবারকের পোড়ানীতির কঠোর শাসনে মিশরে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সকল ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি রকমের সীমালংঘন বিশ্ববিবেককে দংশন করলেও মোবারক তাতে কর্ণপাত করেনি। পশ্চিমাশক্তির প্রকাশ্য সমর্থনেই মোবারক সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে দৌর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছে। জনসমর্থনহীন ও জীবনযাত্রার ব্যয়কে সাধারণ্যের সীমার মধ্যে রাখতে না পারলেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। মোবারক প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় সেনাবাহিনী ও সমাজের একশ্রেণির মানুষের অর্থ সম্পদের পাহাড় যেমন গড়েছে অপরদিকে অস্বাভাবিক হারে বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে এবং সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছে। এসব অন্যায় ও অবিচারের প্রতিকারে প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। কিন্তু ব্রাদারহুড বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের কাছাকাছি তাদের সেবা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছে। মোবারক বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পুরো নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণে রেখে পরবর্তীতে ক্ষমতায় যাওয়া পর্যন্ত মুরসির ব্রাদারহুড অত্যন্ত কৌশলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। কিন্তু যতবিপত্তি বাধে মুরসির ক্ষমতারোহণের পর। যে বেকারত্ব ও যুব সমাজের হতাশা এবং সামাজিক বৈষম্য অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ সে দিকে তেমন দৃষ্টি না দিয়ে, জনপ্রশাসনে মোবারকের সাজানো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে না এনে দ্রুততার সাথে শরিয়া আইন চালুর দিকে ঝুঁকে পড়েন। দীর্ঘ সময়ের সামাজিক অস্থিরতাকে কৌশলে সমাধানের চেষ্টা না করে সরাসরি শরিয়া আইনের দিকে মুরসির দৃষ্টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলকে ভাবিয়ে তোলে। নির্বাচনের পূর্বে সামাজিক সুবিচার ও নারী অধিকারের যে প্রতিশ্রুতি জনগণকে ব্রাদারহুড দিয়েছিল সে বিশ্বাসে জনসাধারণের মধ্যে যে চিড় ধরে একে কৌশলে সেনাবাহিনী ও মুরসি বিরোধীরা কাজে লাগায়। সাথে যোগ দেয় আন্তর্জাতিকমহলও। ইতোমধ্যে মুরসি সরকার মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তবাকের উপরও হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। অপরদিক থেকে সর্বদাই ব্রাদারহুডের সাথে শিথিল সম্পর্কের সৌদি আরবের সাথে মুরসির প্রথম সফরও সম্পর্কের তেমন উন্নতি তো করেইনি বরং ইরানের তত্কালীর রাষ্ট্রপতির মিসরে উষ্ণ সংবর্ধনা এবং মুরসির ইরান সফর সৌদি আরবকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলে। পশ্চিমাদের মৌন সমর্থন ও সৌদি আরবের মুরসি বিরোধিতার এ রকম সময়ের অপেক্ষায় ছিল জেনারেল আবুল ফাত্তাহ সিসি। গতবছরের জুলাইয়ে তাহরীর স্কয়ারের বিক্ষোভকে পুঁজি করে সেনা অভ্যুত্থান এবং মুরসির পতন এবং আগষ্টে মুরসি সমর্থকদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে আরব বসন্তের সে সুফলের কথা বলা হয়েছিল তার সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

মিশরের সিভিল প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠনগুলোর অপরাপর স্বৈরাচারী সরকারের মতই বেড়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের উদার চর্চা না থাকায় জনগণ অল্প কয়েকদিনের গণতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে নিজেদের তেমন খাপখাওয়াতে পারেনি। সিসির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারো সেনা নিয়ন্ত্রিত সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্রাদারহুডের ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকে। মানুষের বাক স্বাধীনতার উপর আবারো নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয়, সেনা সরকারের অত্যাচারের রিপোর্ট করার অভিযোগে আল-জাজিরার সাংবাদিকসহ অনেকেই এখন পর্যন্ত জেলে অন্তরীণ হয়ে আছে। সরকার প্রথমে সন্ত্রাসী ও পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘোষণার কারণে ব্রাদারহুড ধীরে-ধীরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে কি না এটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক মাসের কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে। কায়রো শহরের দক্ষিণে অবস্থিত মিনায়া শহরের একটি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী আক্রমণে একজন পুলিশ কনস্টেবল মারা যাওয়ায় ব্রাদারহুডকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ২৪ মার্চ এক রায়ে ৫২৯ জনকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। একজন কনস্টেবল হত্যাকাণ্ডে এত লোক অংশ নিয়েছিল কি না এবং বিচারটি কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা এ বিষয়ে খোদ মিশরেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিতর্ক যাইহোক রায়ের মাধ্যমে সরকার ব্রাদার হুডের ব্যাপারে আরও কঠোর নীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্যে জেনারেল সিসি সেনা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পূর্বে তিনি সেনা সদরে তার উত্তরসূরীসহ সকল সিনিয়র আর্মি অফিসারদের সাথে মিলিত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স সেক্রেটারী চাক হ্যাগেলের সাথে টেলিফোনালাপ করেন। ইতোমধ্যেই স্থগিত দেড়শ' মিলিয়ন সামরিক সাহায্য ছাড়ের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনকেরী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখিত ঘটনাগুলো সিসির প্রতি সমর্থন হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আগামী ২৭ মে থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরিকল্পনা অনুযায়ী একক প্রার্থী এবং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তাহলে মিশরের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও জনগণের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা আবারো সামরিক উর্দির নিচে চাপা পড়বে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো বাড়বে বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন।

মিশরসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ব্রাদারহুড এক রাজনৈতিক বাস্তবতা। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি মিশরসহ সমগ্র আরবেই তাদের শাখা-প্রশাখা সম্প্রসারণ করে। সেনাশাসন, রাজতন্ত্র, আর পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশগুলোতে হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে দলটির ইসলামের রাষ্ট্রীয়দর্শনের আহবান জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ৮৫ বছরের পুরনো দলটিকে সন্ত্রাসবাদের সহযোগিতার অভিযোগে ১৯৫৪ সালে মিশরের সেনা সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। সৌদি সরকার এক আদেশে ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদেশগুলোকেও তাদের অনুসরণের আহবান জানিয়েছে। কেবল মুরসি সরকারকে সমর্থনের কারণে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিশর কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছে এবং মুরসির অপসারণের পর ১২ বিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়ে মিশরের সেনা সমর্থিত সরকারকে সহযোগিতা করেছে। অন্যান্য রাজতান্ত্রিক সরকারের মতামতও সৌদি আরবের মত। সুতরাং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্ শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের মৌন সমর্থনে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি কিভাবে আগামী নির্বাচন পরিস্থিতি সামাল দিবেন, নির্বাচন পরবর্তী মিশরকে কিভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবেন সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।


লেখক: ড.মো.ইকবাল হোছাইন, অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

Thursday, 3 April 2014

শিক্ষাঙ্গনে লাশ ও শিক্ষার নির্বাসন


আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নানা জন নানাভাবে অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু এদেশে ভাল কাজের মূল্যায়ন খুব একটা হয় না। বিশেষ করে 'স্বেচ্ছাব্রতী মনোভাব' নিয়ে যারা এগিয়ে আসেন, ভূমিকা পালন করেন—তাদের ব্যাপারে আমরা ক্ষমাহীন উদাসীনতা প্রদর্শন করি। যেমন করছি ছাত্র-রাজনীতির লবকুশদের। তাদের কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক লাশ পড়ছে। ঝরে যাচ্ছে একেকটি মূল্যবান প্রাণ! কমছে দেশের জনসংখ্যর বোঝা। যাদের সুমহান অবদানের কারণে এভাবে লাশ পড়ছে, দেশের জনসংখ্য কমছে, তাদের আমরা সম্মান জানাচ্ছি না, প্রশংসা করছি না! এক সপ্তাহের ব্যবধানে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই কর্মী সায়াদ ইবনে মোমতাজ ও রুস্তম আলী আকন্দ দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন। এসব মৃত্যুর পেছনে ছাত্র-রাজনীতির বীরদের একক কৃতিত্ব রয়েছে। এহারে খুনোখুনি ও লাশ ফেলা অব্যাহত থাকলে আগামীদিনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কার নিঃসন্দেহে ছাত্র-রাজনীতির বীর সেনানীদেরই হাতে উঠবে! শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেই নয়, আমাদের দেশে শিক্ষার বারোটা বাজাতে বৃহত্ ছাত্র সংগঠনগুলো অপরিমেয় ভূমিকা পালন করছে। আমাদের শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই। আর মনীষীরা বলেছেন, যে শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই তার সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্পর্কচ্ছেদ হয় ততই মঙ্গল। 'আনন্দহীন' শিক্ষার সঙ্গে 'সম্পর্কচ্ছেদ' ঘটাতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্র শিবির প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে বিরোধী অবস্থানে থেকে এবং ছাত্রলীগ ও পুলিশের দাবড়ানির কারণে ছাত্রদল-শিবির তেমনভাবে সুবিধে করতে পারছে না। কারণ 'ক্ষমতার কাবাব-পরোটা' আর জোর-জুলুম-ভয় দেখানো ছাড়া বর্তমানে ছাত্র-রাজনীতিতে সমর্থন বাড়ানো যায় না। সুবিধাবাদিতা ও নগদ-নারায়ণের প্রতি আসক্তি বর্তমানে ছাত্র-যুবসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চারদশক ধরে আমাদের সমাজে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই আদর্শেরই তালিম দেয়া হয়েছে। 'মার-কাট-খাও, গুণ্ডামি কর, প্রয়োজনে খুন কর'—এই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের অঘোষিত 'রাষ্ট্রীয় আদর্শ'। এই 'আদর্শ' বৃহত্ রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠনগুলো অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করছে। মূল রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে তার অঙ্গ সংগঠনগুলো হাইব্রিড জন্তু-জানোয়ারের মত বাড়তে থাকে। সঙ্গত কারণেই এখন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। তবে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল সবক্ষেত্রে একেবারে দুর্বল হয়ে যায়নি। তারা মাঝে মাঝে 'গেরিলা কায়দায়' প্রতিপক্ষের উপর ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়ছে!

আমাদের দেশে যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, শাখা-প্রশাখার বিস্ফোরণ ঘটে। বিচিত্র নামে ও রূপে তাদের অসুরিক আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন পুরোপুরি 'ন্যাটো-বাহিনী' হিসেবে আবির্ভূত হয়। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে প্রতিপক্ষ কিংবা তাদের 'বশ্যতা স্বীকারে অনিচ্ছুক' সবাইকে উচিত শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে 'শিক্ষা'-কে মোটামুটি ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন চলতে থাকে। গত দুই দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল-শিবিরের বাড়াবাড়ি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগের তাণ্ডব আমরা দেখে এসেছি।

আমাদের অর্থনীতিতে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) তেমন সফল না হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অঙ্গসংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ দমন, নিজেদের মধ্যে 'বীরত্ব চর্চা', নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নিজেরা করা, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে সহায়তা করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে ছাত্রলীগ দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করছে। তারা এখন দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, হত্যা, দখলদারীসহ নানারকম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। তাদের 'সন্ত্রাস-উত্সবের' কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ছুটি পাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এমন 'অবসর বিনোদনের' ব্যবস্থা করে ছাত্রলীগের 'সোনার ছেলেরা' সত্যিই কৃতজ্ঞভাজন হয়েছেন! এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে খুব একটা চাকরি পাওয়া যায় না। তাছাড়া এই একঘেয়ে ক্লান্তিকর লেখাপড়ায় আনন্দও নেই। এ অবস্থায় শিক্ষাজীবন যদি প্রলম্বিত হয়, মাঝে মাঝে আনন্দহীন শিক্ষার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে—তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এই ইতিবাচক কাজটিই করছেন!

আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বীর-পাণ্ডবদের দখলে চলে গেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় এ লৌকিক বীরদের অবদান দেশের উন্নয়নের অভিযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের দখলদারিত্ব, আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। একে অপরকে দাবড়ে বেড়ানো। মাঝে মধ্যে দলীয় কোন্দল। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় রাজনৈতিক দলের 'জমিদারদের' হাত ধরে জাতীয় জীবনে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর জ্ঞান-তত্ত্ব-গবেষণা এসবে সীমাবদ্ধ নেই। জ্ঞানের ব্যাপ্তি বেড়েছে, বিদ্যার সীমান্ত বিস্তৃৃত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় রাজনীতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং এই রাজনীতি প্রসারের জন্য প্রাণপাত করাই হচ্ছে 'জ্ঞান'। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, হত্যা, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, ফাও খাওয়া, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোন্দল, উপদলীয় সংঘাত, প্রতিপক্ষকে মেরে তক্তা বানানো, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কবরে পাঠানো, বিভিন্ন নেতানেত্রীর নামে মাতম, সন্ত্রাস নৈরাজ্য সৃষ্টিই 'নলেজ'। বিদ্যাচর্চায় ও জ্ঞান অনুশীলনে এগুলোই মূল সিলেবাস। এই পাঠ যারা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে সমাজে তারাই সফল হয়। এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যায়।

এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের দলীয় রাজনীতি। এ রাজনীতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার। যুক্তি বা আদর্শ নয়, অর্থ, অস্ত্র আর পেশিশক্তিই হচ্ছে এ রাজনীতির চালিকাশক্তি। মার-কাট-খাও। সন্ত্রাস-অস্ত্রবাজি-দখল। খুন-মামলা-হামলা। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্রশিবির। শিক্ষার আঙিনায় এখন আর ছাত্র নেই। থাকলেও তাদের কেউ পোছে না। নতুন ব্যবস্থায় এখন শক্তিশালী ও দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক অসংখ্য ক্যাডার। তারাই দাপিয়ে-লাফিয়ে বেড়ায়। তাদের দখলেই ক্যাম্পাস। ছাত্রের অনুষঙ্গ বই, খাতা-কলম। আর এসব ক্যাডারের উপাচার হচ্ছে, অস্ত্র-মাদক-পারভারসান-দলবাজি। লেজ ছাড়া যেমন কুকুর হয় না, পারভারসান ছাড়া ক্যাডারও দেখা যায় না। হিংস্র পশু যেমন যে কাউকেই প্রতিপক্ষ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন যুক্তি-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ ছাড়াই, ক্যাডাররাও প্রতিপক্ষের ওপর একই কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদল অপর দলের ওপর ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধ হলে নিজেরাই নিজেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ অপশক্তির গর্জন আর হুঙ্কারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর এখন ছাত্র-রাজনীতির আচ্ছাদনে ঢাকা দুর্বৃত্ত এবং পুলিশের পার্টনারশিপে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কারো তেমন কোন অনুশোচনা নেই, নেই কোন বিকার!

ছাত্রদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন আর কোন কাঙ্ক্ষিত স্থান নয়। জ্ঞান, শিক্ষা, কর্ম, অনুশীলনের সমন্বয়ে জীবনযুদ্ধের প্রকৃত সৈনিক হতে এখন আর কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসে বলে মনে হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ কেউ আসে অনন্যোপায় হয়ে। আর বাকিরা আসে লাঠিয়াল বা ক্যাডার হতে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল অথবা ছাত্রশিবির নামে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর সদস্য হয়ে তারা খুবই আনন্দে থাকে। একবার ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরে নাম লেখাতে পারলে জীবন একেবারে ফকফকা। তাদের কোন অভাব থাকে না। পাওয়া যায় যা খুশি তাই করার অবাধ স্বাধীনতা। যেভাবে খুশি টাকা উপার্জনের সুযোগ। অস্ত্রবাজি, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি করার লাইসেন্স। এ দুর্বৃত্তরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জিম্মি করে রাখবে আর অন্য সবাই তাদের দয়া বা মর্জির দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মালিক। খোলা রাখার মালিকও তারাই। এমন যারা বীর, তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাদের নতুন নতুন দায়িত্ব দিয়ে কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া যায়—তা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে। দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য সেনানী হিসেবেই তারা গড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হল দখলের ব্যাপারে অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এখন তাদের নেতৃত্বে আমরা অন্য কোন দেশ বা ভূখণ্ড দখল করতে পারি কিনা—তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। ইতিহাসে অনেক বীর অন্য দেশ দখলের কৃতিত্ব দেখিয়ে অমর হয়েছেন। বৃহত্ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ইতিহাস নির্দেশিত সে পথ অবলম্বন করে আমরা আবারো শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পারেন!

নিদান যেখানে অনুপস্থিত, প্রতিবিধানের সম্ভাবনা যেখানে তিরোহিত, সেখানে উপহাস কিংবা বিলাপ ছাড়া আমাদের আর কী ই-বা করার আছে?

লেখক: চিররঞ্জন সরকার, কলামিস্ট

Wednesday, 2 April 2014

লিবিয়ায় এ নয় আরব বসন্ত


এক. হরর মুভি লিবিয়ার মিসরাতা শহরের এক হিমায়িত মাংসের দোকান। দোকানটির সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত মানুষ। তারা দোকানটিতে ঢোকার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। খিড়কির দুই পাশে রয়েছে সশস্ত্র প্রহরী; তারা একসঙ্গে বেশি মানুষকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।

কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত, অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত লিবিয়ার একটি শহরে হঠাৎ এক মাংসের দোকানে এত ভিড় জমে উঠল কেন? আকাশ থেকে কি টাকা ছিটানো হয়েছে, আর সেই টাকা কুড়িয়ে নিয়ে সবাই ছুটেছে মাংসের দোকানে?
না। সে রকম কিছু নয়। বরং অতিশয় অস্বাভাবিক আর নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক একটি দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে ওই মাংসের দোকানে: সস্তা চাটাইয়ের ওপর পড়ে আছে রক্তমাখা একটি মানবদেহ, পরনে শুধু খাকি ট্রাউজার, পা দুটি খালি। মাথার বাম পাশে ক্ষতচিহ্ন—বুলেটের। বুক ফুটো করে দিয়েছে আরেকটি বুলেট, সেই ফুটো থেকে চুইয়ে আসা লাল রক্ত শুকিয়ে গিয়ে এখন কালচে।

প্রহরীদের অনুমতিক্রমে কয়েকজন করে মানুষ ঢুকছে দোকানটির ভেতরে। ক্ষতবিক্ষত দেহটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে তারা, ক্যামেরার সামনে হাত তুলে দুই আঙুলে বানাচ্ছে বিজয়চিহ্ন, আর স্লোগান দিচ্ছে: আল্লাহু আকবর।
স্বৈরশাসকের চূড়ান্ত পতন ‘উদ্যাপনের’ সুযোগ করে দিতে এই আয়োজন করেছে লিবিয়ার বর্তমান কর্তৃপক্ষ। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত প্রাণহীন দেহটি এখন এক ঐতিহাসিক স্মারক। গত বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সিরত শহরে গাদ্দাফিকে আটক করে জীবিত অবস্থায়, তারা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে তোলে একটি ট্রাকে। প্রথমে তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। সিরত গাদ্দাফির জন্মের শহর, তিনি শেষ আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই শহরকে, যেখানে তাঁর অনেক জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বাস। বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে ছেলে মুতাসিমকেও হত্যা করেছে বিদ্রোহীরা। তারপর গাদ্দাফির মৃতদেহ নিয়ে গেছে মিসরাতা শহরে, সেখানে প্রকাশ্যে ‘বিজয়-প্যারেড’ করেছে তারা; বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন করেছে গাদ্দাফির মৃতদেহ। গাদ্দাফির জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজন গাদ্দাফি ও তাঁর ছেলের লাশ চেয়েছিল ইসলামি পন্থায় সিরতেই কবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাশ তাদের দেওয়া হয়নি। তারা এমনকি জাতিসংঘ, ওআইসি আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছেও আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন শাসকেরা, স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের ‘নেতারা’ গাদ্দাফির আত্মীয়স্বজনের আবেদন-নিবেদনের প্রতি কর্ণপাত না করে মাথা ঘামাতে লেগেছেন—এই লাশ নিয়ে কী করা যায়। একটা সিদ্ধান্তে সবাই অটল, গাদ্দাফি বা তাঁর ছেলে মুতাসিমের লাশ তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে দেওয়া হবে না। তাহলে লাশ নিয়ে কী করা যায়—ত্রিপোলি তাড়াতাড়ি ওই ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলতে চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল ছুটে গেলেন মিসরাতা শহরে, সেখানকার ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে। মিসরাতার নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তাঁরা নিজেদের শহরে স্বৈরশাসকের কবর দিতে দেবেন না। এখন পর্যন্ত যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, গাদ্দাফিকে ভূমিতে কবর দেওয়া হবে না, সাগরে ফেলে দেওয়া হবে তাঁর লাশ, ওসামা বিন লাদেনের বেলায় যেমনটি করা হয়েছে বলে শোনা যায়। জীবিত অবস্থায় নির্যাতন, নিরস্ত্র ও বন্দী অবস্থায় খুন এবং প্রাণহীন অবস্থায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির দেহটিকে যেভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত করা হচ্ছে, পশ্চিমের ‘সভ্য দুনিয়া’র লোকেরা তা উপভোগ করছে, যেমন করে তারা উপভোগ করে হলিউডের হরর মুভি।

দুই. বসন্ত নয়, কালবৈশাখী
লিবিয়ার শুকনো মাটি মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তে ভিজে উঠল। পশ্চিমা শক্তিগুলো আর তাদের সমর্থনপুষ্ট লিবীয় বিদ্রোহীরা মেতে উঠল বিজয়ের উল্লাসে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বললেন, ‘লিবিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের [গাদ্দাফি যুগ] অবসান হলো।’ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক-বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ‘ওবামা ডকট্রিন’-এর আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো লিবিয়ায়। ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করতে হলো না, শত শত মার্কিন সেনাকে প্রাণ দিতে হলো না, লিবীয় বিদ্রোহীদের দিয়েই পতন ঘটানো গেল গাদ্দাফির, করে ফেলা হলো ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার পরিবর্তন। এমনই কেউ কেউ বলছেন, আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় ফলটি সবার আগেই ফলল লিবিয়ায়, যেখানে বসন্ত এসেছে সবার পরে।

কিন্তু গাদ্দাফির লিবিয়ায় আসলে আরব বসন্তের হাওয়া লাগেনি। ওই দেশে সেই বসন্ত আসেনি, যা এসেছে তিউনিসিয়ায়, মিসরে, সিরিয়ায়, জর্ডানে; এমনকি পেয়েছে ইয়েমেনের মতো দেশেও। তিউনিসিয়ায় ও মিসরে যে বিপুল গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, তাতে অংশ নিয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। বিশেষত, মিসরে মোবারকবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী। আন্দোলনকারীদের হাতে অস্ত্র ছিল না, তাঁরা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। তাঁরা শান্তিপূর্ণ পন্থায় মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন, মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে দিন-রাত অবস্থান করেছেন কায়রোর তাহরির স্কয়ারে।

কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একদম শুরু থেকেই দেখা গেছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ বা মিছিল দেখা যায়নি লিবিয়ার কোনো শহরে, দেখা যায়নি কোনো নারীকেও। সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হলে অবশ্যই নারীদের অংশগ্রহণ থাকত, যেমনটি দেখা গেছে তিউনিসিয়ায় ও মিসরে। প্রতিবাদী ব্যানার-ফেস্টুন নয়, একে ৪৭ রাইফেল আর রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেডের মতো ভারী ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গাদ্দাফিবিরোধী একদল যুবক ‘বিদ্রোহ’ শুরু করে দেয় বেনগাজি শহর থেকে। এই যুবকেরা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোথায় পেয়েছে? লিবিয়ার মতো কঠোর পুলিশি রাষ্ট্রে, যেখানে গাদ্দাফির সমালোচনা করে একটা শব্দ উচ্চারণ করতেও লোকে ভয় পেত, সেখানে হঠাৎ করে বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ-যুবকের হাতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র এসেছিল কোথা থেকে?

এত দিনে আর কোনো সন্দেহ নেই যে পশ্চিমা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগরের ওপারের দেশ ফ্রান্সের একটা বড় হাত ছিল একদম গোড়া থেকেই। ব্রিটিশরাও এসে ফ্রান্সের সঙ্গে হাত মেলায়। আর আটলান্টিকের ওপারের বড় সর্দার যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই। তারা লিবিয়ার ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গোয়েন্দা তথ্য ও কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু গাদ্দাফির বিপুল ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা যখন পেরে উঠছিল না, তখন ন্যাটো জোটের মাধ্যমে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে দেয়। লিবিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের দিকে তাদের বড্ড লোভ। তিউনিসিয়া-মিসরে যে আরব বসন্ত এসেছে, লিবিয়ায় তা আসবে না জেনে দেশটিতে তারা কালবৈশাখীর আয়োজন করেছিল।

তিন. কে থামাবে এই ঝড়
স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে লিবিয়ায় একদল মানুষের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকাপয়সা আর কূটবুদ্ধি দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো লিবিয়ায় যে লন্ডভন্ড কাণ্ড ঘটিয়ে দিল, তার পরিণতি কী হতে পারে? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, গাদ্দাফির অনুসারী লোকজনের ওপর বর্বরতা শুরু হয়ে গেছে।

লিবিয়া বহু গোত্রে বিভক্ত একটি দেশ, যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাটি এখনো স্বচ্ছ নয়। গণতন্ত্র, আইনের শাসন—এ ধরনের পশ্চিমা ধারণার প্রেক্ষাপটে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করা যাবে না। ইতিহাসের কোনো কালেই সেখানে গণতন্ত্র ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলও দেশটিতে নেই। যারা গাদ্দাফিকে হটিয়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ গুন্ডাপান্ডা ধরনের মানুষ। বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত বিভিন্ন গোত্রে। মানুষের হাতে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আর রাজনৈতিক ওলট-পালটের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। এসব দেখেশুনে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পরের কথা, আগে কীভাবে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই ভাবনার বিষয়।

গাদ্দাফি জবরদস্ত স্বৈরশাসক ছিলেন বটে। কিন্তু তিনি বহু গোত্রে বিভক্ত লিবীয় সমাজকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন; লৌহদৃঢ় শাসনদণ্ড ব্যবহার করে হলেও জনজীবনে মোটামুটি শান্তি আনতে পেরেছিলেন। অবশ্য ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সে দেশে ছিল না। কিন্তু গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে গিয়ে যে রক্তপাতের সূচনা ঘটানো হলো, তা বন্ধ করা খুব সহজ হবে না। এ মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে ন্যাটো বাহিনী লিবিয়া ছেড়ে চলে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল এখন দেশটির এই লন্ডভন্ড পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই দেখার বিষয়। ইরাকিদের মতো লিবীয় জনগণের জীবনেও যেন রক্তপাত, নিরাপত্তাহীনতা আর আর্থিক দুর্দশার দীর্ঘ প্রহর নেমে না আসে।


© মশিউল আলম

সিরিয়া কি সাম্রাজ্যবাদের বলির পাঁঠা হবে?

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তার বিরোধী পক্ষ তথা বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে দামেস্কের উপকণ্ঠে নিরীহ পথচারী, শিশু ও নারীসহ সহস্রাধিক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে সিরীয় সরকার। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার অভিযোগে বাশারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেন সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে 'কঠোর জবাব' দেয়ার জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রস্তুতির মহড়া হিসেবে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ষ্ঠ নৌবহরের কমান্ডারের নির্দেশে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রবাহী কয়েকটি রণতরী সিরিয়া অভিমুখে ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্র, এজন্য সেখানে মোতায়েনকৃত ডেস্ট্রয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে তিনটির স্থলে চারটি করা হয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনীও ভূমধ্যসাগরে জড়ো হয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে। এছাড়া সিরিয়ার সীমান্তের আশপাশের অঞ্চলগুলোতে সৈন্য সংখ্যা ও সামরিক ঘাঁটি বৃদ্ধি করছে ন্যাটো জোট। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সিরিয়াগামী জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও পরিদর্শক দল যদি বিশ্বাসযোগ্য ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের দ্বারা বাশারের বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক হত্যায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারে তাহলে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান অবশ্যম্ভাবী। ওবামা প্রশাসনের সবুজ সংকেত পেলেই মাত্র সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এই অভিযোগ বাশার সরকার প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর প্রস্তুতির জবাবে বলেছে, 'সিরিয়ায় হামলা করার চেষ্টা করা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলবে।' পাশাপাশি বাশার সরকারের কৌশলগত মিত্র ইরান ও রাশিয়াও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক অভিযান বা হামলার ঘোর বিরোধিতা করছে। লিবিয়ায় হামলা করার পূর্বে আমেরিকা যেভাবে লিবিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ ফেলেছিল, এখন সেভাবেই চাপে রেখেছে সিরিয়াকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ সিরিয়ার ওপর আরও আগেই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। সম্ভবত লিবিয়ার মতো সিরিয়াও এখন সাম্রাজ্যবাদের বলির পাঁঠা হতে যাচ্ছে। সিরিয়ার জনগণকে সুরক্ষিত করতেই নাকি সামরিক অভিযান চালাতে চাচ্ছে আমেরিকা, অথচ আমেরিকা নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সাম্রাজ্যবাদী খায়েশ মেটাতে ইরাক-আফগানের মতো বহু দেশ দখলপূর্বক অগণিত হত্যাকা- চালানোর দায়ে ইতিহাস ও বিবেকের কাঠগড়ায় দ-ায়মান।

যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা কেন চায় সিরিয়ায় হামলা করতে? তাদের কী স্বার্থ নেপথ্যে কাজ করছে? সাধারণত কোন প্রকার স্বার্থ ছাড়া অন্য দেশ হামলা করে না সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্ররা। সিরিয়ায় বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদতদানের পেছনে যুক্তিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স দীর্ঘদিন থেকেই বলে এসেছে যে, সিরিয়ায় তারা একটি গণতন্ত্রপন্থি অভ্যুত্থান বা আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে। তথাকথিত মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে তারা 'মুক্তিকামী বিদ্রোহী'দের সহায়তা দিচ্ছে বলে নিজেদের পক্ষে স্টেটমেন্ট দিচ্ছে। আসলেই কি তাই? মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইসরায়েলের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের প্রভাব ও আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধনশীল। মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ ইরানের এই বর্ধিষ্ণু আধিপত্য ও প্রভাব ঠেকাতে হলে সিরায়ায় মার্কিন দাসানুদাস শাসক বা সরকার প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ ৩৩ বছর ধরে মার্কিন স্বার্থরক্ষা করে এলেও এক সময়ে আরব বসন্তের কোপানলে তথা বাশারবিরোধী তুমুল গণআন্দোলন সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্র বাশারকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে বাশার তার কৌশলগত মিত্র ইরান ও রাশিয়ার সার্বিক সহযোগিতায় বিদ্রোহীদের সফলভাবে দমনপূর্বক অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সেই সঙ্গে লেবাননের কট্টর শিয়াপন্থি হিজবুল্লাহর মতো জঙ্গি বা সশস্ত্র সংগঠনও আসাদের পক্ষে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান হুমকি ইরানকে কোণঠাসা করতে এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তেলস্বার্থ নিশ্চিত করতে হলে আসাদের পতন ঘটিয়ে সিরিয়ায় পুতুল শাসক বসানোর কোন বিকল্প নেই।

এখন কথা হলো, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সীমাবদ্ধ সহযোগিতা দিয়েও বাশারের পতন ঘটানো যাচ্ছে না। 'সীমাবদ্ধ সহযোগিতা' বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরিয়ার বিদ্রোহীদের যে অস্ত্র সহযোগিতা দিয়েছিল তা বাশারের সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলভাবে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কারণ বাশারের বিপক্ষে আল কায়দার মতো সশস্ত্র সংগঠন যুদ্ধ করছে। যদি আল কায়দা ও এর সমমনা সশস্ত্র সংগঠনকে যথার্থভাবে অস্ত্র ও সামরিক সহযোগিতা দেয়া হয়_ সেটা হয়তো বাশার আল আসাদের পতন নিশ্চিত করবে বটে, তবে একই সঙ্গে সেটি আমেরিকার জন্য সুদূরপ্রসারী বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুদূরপ্রসারী বিপদ মানে, আল কায়দার মতো সশস্ত্র সংগঠনের হাতে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র চলে গেলে সেটি আমেরিকার জন্য পরবর্তীতে বিপজ্জনক ভবিষ্যৎ বয়ে আনতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সীমাবদ্ধ বা সীমিত সামরিক সহযোগিতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু এভাবে কার্যসিদ্ধি লাভে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন চাইছে সরাসরি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাশারের পতন ঘটিয়ে সেখানে পুতুল শাসক প্রতিষ্ঠা করা। তাই এতদিন ধরে আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তিরা সিরিয়ায় সামরিক হামলা করার জন্য মোক্ষম ছুতো খুঁজছিল। অভিযোগ সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, বাশারের বিরুদ্ধে আনীত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগটি হয়তো সামরিক অভিযানের জন্য একটি অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে আমেরিকা। এই অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সিরিয়ায় সামরিক হামলার সমর্থন ও ন্যায্য আদায় করে নেয়ার ফিকির করছে আমেরিকা। পরদেশে সামরিক হামলার জন্য সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার এই অজুহাত দাঁড় করানোর কৌশল আজকে নতুন নয়। ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়াসহ যত দেশে আমেরিকা সামরিক হামলা করেছিল, প্রায় সব দেশের সঙ্গেই গায়ে পড়ে যুদ্ধ শুরু করার জন্য যুদ্ধবাজ আমেরিকা এই 'অজুহাত কৌশল' দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন জোগাড় করে নিয়েছিল। আর যদি সিরিয়ায় বাশারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগটি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এটি অবশ্যই নিন্দনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এটিকে যে সিরিয়ায় হামলার জন্য অজুহাতসন্ধানী আমেরিকার মতো যুদ্ধবাজ পরাশক্তি কাজে লাগাতে চাইবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র সদ্য প্রকাশিত এক গোপন নথিতে জানা যায়, ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরানে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রাসায়নিক গ্যাস হামলা চালাতে যাচ্ছেন জেনেও আমেরিকা তাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। এমনকি ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে যখন ইরানে চারটি বড় ধরনের হামলার পূর্বে মাস্টার্ড ও সারিন গ্যাস দিয়ে হামলা চালানো হয়, তখন আমেরিকা এই হামলার কাজে ইরাককে স্যাটেলাইট ইমেজ ও মানচিত্রসহ আরও বহু গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। আমেরিকা তার স্বার্থের জন্য সবকিছুই করতে পারে। শুধু স্বার্থের জন্যই আগে যেটাকে সে ভালো বলত পরে সেটাকে খারাপ বলে প্রত্যাখ্যান করে। শুধু স্বার্থের জন্যই কালকে যাকে বন্ধু বানায় পরে তাকেই আবার শত্রুতে পরিণত করতে দ্বিধা করে না। এটাই হলো সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নৈতিক চরিত্র। তাই বলা বাহুল্য সিরিয়ায় হামলা করার জন্য আমেরিকা উপযুক্ত অজুহাত খুঁজে পেয়ে নতুন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজানোর অপেক্ষায় আছে।

আমি যা বলার নির্মোহভাবেই বলতে চেষ্টা করছি। আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য যৌথ সামরিক হামলার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমি বাশার আল আসাদের পক্ষ নিচ্ছি ব্যাপারটা এমন নয়। একজন প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রেমী হিসেবে আমিও চাই বাশার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার আন্দোলনরত জনগণের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন পূরণ হোক। কিন্তু আমি কোনভাবেই এটি যুদ্ধবাজ ও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য সামরিক হস্তক্ষেপে হোক তা চাইব না। কেননা লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় যদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বাশার সরকারের পতন ঘটে তাহলে প্রকারান্তরে সেখানে নিশ্চিতভাবেই সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত হবে। ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদি চক্রের স্বার্থই শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হবে। এখানে যেটা হওয়া দরকার ছিল বলে আমি মনে করি, সেটি হচ্ছে, পশ্চিমা শক্তি এতদিন ধরে সিরিয়ায় শিয়া-সুনি্নর মধ্যে মারাত্মক গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলে তৎপর ছিল। এমতাবস্থায় সুনি্ন ও শিয়া উভয় পক্ষকে সচেতন হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করে নিজেদের মধ্যে উদারতা পোষণপূর্বক বিরোধ ও লড়াই অবসানের জন্য শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি কারণ সরষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। এখানে প্রথমত সুনি্নদের পক্ষে সৌদি রাজতন্ত্রের ভূমিকাই তো প্রশ্নবিদ্ধ। পশ্চিমাদের বশংবদ সৌদি আরব তো মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মকভাবে সাম্রাজ্যবাদী ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদি চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর থাকে। শিয়াপন্থি বাশার ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়াইরত সুনি্ন পক্ষ তথা আল কায়দা ও এর সহযোগী সংগঠন আল-নুসরাহ ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও শামস নামক দলগুলোকে ইতোমধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে রাজতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্রের শাসকরা। সৌদি আরবের কাছে এই অর্থ দেয়া হয় এবং তা দিয়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। বস্তুতপক্ষে সিরিয়ায় শিয়া-সুনি্ন দ্বন্দ্ব ও বিরোধ উসকে দিতে এবং অব্যাহত রাখতে সৌদি রাজতন্ত্রের এহেন নগ্ন ভূমিকাই প্রধানত দায়ী।

না বললেই নয়, আরব লীগের একচ্ছত্রাধিপত্যকারী সৌদি আরব ২০১১ সালের মার্চে লিবিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য ন্যাটো বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এখন সিরিয়াতেও পশ্চিমা শক্তির সামরিক হামলার ব্যাপারে আরও নগ্নভাবে সরাসরি সক্রিয় সৌদি আরব। সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে যে কোন মূল্যে বাশার সরকারের পতন চায় মার্কিন তাঁবেদার সৌদি আরবও। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও যাবতীয় স্বার্থরক্ষা করতে আমেরিকা যেমন বদ্ধপরিকর, ঠিক তেমনি সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকরাও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার যাবতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে এক পায়ে খাড়া। সেজন্যই বুঝি সিরিয়ার পক্ষ ত্যাগ করতে রাশিয়াকে প্রকারান্তরে ঘুষই দিতে চেয়েছিল সৌদি আরব। গত জুলাইয়ের শেষ দিকে সৌদি আরবের গোয়েন্দাপ্রধান রাশিয়ার সঙ্গে ১৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুুক্তির বিনিময়ে পুতিনকে সিরিয়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছিল। এমনকি সৌদি প্রিন্স বন্দর তার নিজস্ব তহবিল থেকেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে আরও কিছু দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু পুতিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয়ায় সৌদিদের মনোবাসনা ও ষড়যন্ত্র ব্যাহত হয়। এটি নিঃসন্দেহ যে, সৌদি আরব ও পশ্চিমা শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে মূলত ইরানের প্রভাব ঠেকাতেই বাশারের পতন ঘটাতে মরিয়া। আর বাশার আল আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র নয়, রিয়াদের অধীন পুতুল সরকার অধিষ্ঠিত হবে সিরিয়ায়। ফলে কার্যত সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে আমেরিকা। এভাবেই ইরানের বিরুদ্ধে একটি সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে সৌদি আরবের তেল রপ্তানি ও সরবরাহকে নির্বিঘ্ন ও ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য ইরানের হরমুজ প্রণালির বিকল্প হিসেবে সিরিয়াকে রিয়াদের তাঁবে বা নিয়ন্ত্রণে রাখা অতি প্রয়োজন। কিন্তু শিয়াপন্থি বাশারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তা সম্ভব নয়। সম্প্রতি প্রখ্যাত আইরিশ সাংবাদিক ফিনিয়ান কানিংহাম সিরিয়ার পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় সৌদি আরবের দালালির ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন, 'পুতিনকে তেল দিতে গিয়ে প্রিন্স বন্দর প্রকাশ করে দিয়েছেন, কেন বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো এতটা মরিয়া। হিসাবটা অনেক পুরনো। এসব দেশ বিশ্ববাজারে তেল রপ্তানির জন্য হরমুজ প্রণালির একচিলতে সরু পথের ওপর নির্ভরশীল। এই সমুদ্র এলাকার বেশির ভাগ ইরানি ভূখ- এবং দেশটির নিয়ন্ত্রণে। প্রতিদিন ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল নিয়ে এ পথ দিয়ে জাহাজ ছুটে যায় বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে। এই পথের নিরাপত্তা অনেকাংশে ইরানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা ও উপসাগরীয় দেশগুলো জানে, কখনো ইরানের সঙ্গে তাদের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে হরমুজ প্রণালি পথে তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে_ যা পেট্রো ডলারনির্ভর পশ্চিমা অর্থনীতির জন্য হবে একটি বড় আঘাত।' সুতরাং এই ভূ-কৌশলগত সমস্যার দরুন সৌদি আরব, কাতারসহ উপসাগরীয় সুনি্ন শাসিত আরব দেশগুলোর তেল-গ্যাস রপ্তানির বিকল্প পথ ও উপায় হলো সিরিয়া। যদি বাশারকে উৎখাত করে সিরিয়ায় রিয়াদের তল্পিবাহক পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় তাহলে পাইপলাইনের মাধ্যমে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে এই তেল-গ্যাস ভূমধ্যসাগরীয় কোন বন্দরে নিয়ে যেতে পারলেই ইউরোপ-আমেরিকার বিশাল বাজার তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো করে ইরানকেও কোণঠাসা করা সম্ভব হবে। তাহলে কি সৌদি আরবের তেল রপ্তানির স্বার্থ আর ইঙ্গ-মার্কিন-ইহুদির সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা যৌথভাবে পূরণ করার জন্য সিরিয়ায় সামরিক হামলা বা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তিরা? কিন্তু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ইরান কি এই ষড়যন্ত্র ও সামরিক হামলা মেনে নেবে? মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান রণাঙ্গনখ্যাত পারস্য উপসাগর মূলত ইরানই নিয়ন্ত্রণ করে। সিরিয়ায় হামলা হলে ইরান পড়বে অস্তিত্ব সংকটে। সেক্ষেত্রে ইরান চুপ করে বসে থাকবে না। সিরিয়াকে অবশ্যই সামরিক সহায়তা দেবে ইরান। আর রাশিয়া এখন বাশারের পক্ষে বিবৃতি দিলেও পরবর্তীতে আমেরিকা ও তার মিত্রপক্ষ যদি হামলা করে সিরিয়ায়, সেক্ষেত্রে রাশিয়া তখনো বাশারের পক্ষে থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। কারণ ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাকে হামলা করার সময় রাশিয়া একইভাবে সাদ্দাম হোসেনের পাশে থাকার কথা বলে বিবৃতি দিলেও পরে আর সাদ্দাম প্রশাসনের পাশে থাকেনি। তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সিরিয়ায় সামরিক অভিযান বা হামলা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সেই যুদ্ধের লেলিহান অগি্ন দাউ দাউ করে জ্বলবে। কার্যত মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে বাধ্য। কেননা এখানে শুধু সিরিয়াই নয়, ইরানের অস্তিত্বও সংকটের মুখে পড়বে। তাই ইরান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মার্কিনবিরোধী শক্তিদেরও কৌশলে যুদ্ধে টেনে এনে সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ঠেকাতে চাইবে। এই যুদ্ধ থেকে ইসরায়েলও বিযুক্ত থাকতে পারবে না। কেননা বার্তা সংস্থা ফার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সিরীয় সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'দামেস্ক আক্রান্ত হলে তেলআবিবও হামলার লক্ষ্যবস্তু হবে এবং সিরিয়ার ওপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার অর্থ হবে বাস্তবে ইসরায়েলের ওপর হামলার লাইসেন্স দেয়া।' সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এর পরিণতিতে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে হয়তো বহুমুখী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে যেতে পারে।

[লেখক : তারেকুল ইসলাম, কবি ও কলামিস্ট।]

Tuesday, 1 April 2014

আদর্শচ্যুত পথভ্রষ্ট ছাত্র রাজনীতি 



উচ্চশিক্ষা প্রসারে বড় বাধা ছাত্র রাজনীতি। যদিও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব থেকেই ছাত্র রাজনীতির বিকাশ। শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিরতামুক্ত রাখাই ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ছাত্রনেতারা ওই লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে বহুগুণ দূরে সরে যায়। কতিপয় ছাত্রনেতার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্যগত কৃতিত্ব ব্যবহার করাতে পুরো ছাত্র রাজনীতিই একসময় পথ হারায়। কয়েক যুগ আগে ছাত্র রাজনীতির ট্রেন লাইনচ্যুত হলেও কোনো সরকারই ছাত্রনেতাদের লাইনে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং সব সরকারই নিজেদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করেছে। মিছিল-মিটিংয়ে লোক সমাগম নিশ্চিত করতে অথবা হরতাল-অবরোধে পিকেটিংয়ের দায়িত্ব ছাত্রনেতাদের দিয়ে নিশ্চিত থেকেছে। ছাত্রনেতারাও ব্যক্তিগত লাভের আশায় সরকার বা বিরোধী দলের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। উপরতলার আশীর্বাদ নিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, অস্ত্রবাজি করে গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে।

ছাত্র রাজনীতি পথ হারানোর কারণে অধিকাংশ শিক্ষাঙ্গন অস্থির হয়ে ওঠা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন একেকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে বারুদের মতো জ্বলে উঠছে ক্যাম্পাস, মৃত্যুপুরীতে পরিণত করাই যেন সময়ের ব্যাপার। আদর্শচ্যুত ও পথভ্রষ্ট ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বগুণে (!) প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসই কারণে-অকারণে অস্থির হওয়াই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। অছাত্রদের কাঁধে ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব থাকাও এই অস্থিরতার অন্যতম কারণ বটে। গত কয়েক দশকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ছাত্র নেতৃত্ব অছাত্রদের হাতে চলে গেছে। বাবা-দাদা-নানারা এখন তাদের নাতি-পুতিদের নেতা। যদিও এক্ষেত্রে কয়েকটি বাম সংগঠনে নিয়মিত ছাত্ররাই ছাত্রনেতার দায়িত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগও তাদের আগের ‘বয়স্ক নেতৃত্বে’র ধারা পরিহার করে গত কয়েক বছর ধরে ছাত্রনেতাদের বয়সের ফ্রেম বেঁধে দিয়েছে। অন্য সংগঠনগুলোর তুলনায় ছাত্রলীগের এ উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য হলেও নিয়মিত ছাত্রদের হাতে ছাত্র নেতৃত্ব তুলে দেয়ার জন্য এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। কারণ এখন একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকায় ২৩-২৫ বছরের মধ্যে। সেখানে ছাত্রলীগের নেতা হওয়া যায় ২৯ বছর বয়সেও। ফলে এখনও অনিয়মিত ছাত্ররা এ সংগঠনের নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নিয়মিত ছাত্রদের হাতে ছাত্র নেতৃত্ব তুলে দিতে ছাত্রলীগের বয়সের ফ্রেম আরও কমিয়ে আনা উচিত। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন : ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ করা হয়েছে।... কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশ ছাত্র নয়... আমরা এই কমিটি মানতে চাইলাম না’ (পৃ.৮৮)। যেখানে বঙ্গবন্ধু অছাত্র নেতৃত্ব মানতে চাননি; সেখানে অছাত্র নেতৃত্বে ছাত্রলীগ পরিচালিত হওয়াটা কতটুকু শোভনীয়? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনা সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একজন নেতৃত্ব পাওয়ার আগেই ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য অস্ত্র হাতে গুলি চালানোর কুখ্যাতিও তার রয়েছে। কিন্তু নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেল অস্ত্রবাজ-ডাকাতকেই ওই ইউনিটের ছাত্রলীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। ডাকাতি মামলার আসামি ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তেড়ে যাওয়াই যদি শীর্ষ পদ পাওয়ার যোগ্যতা হয়ে থাকে; তবে অন্য জুনিয়র কর্মীরাও সে পথেই হাঁটবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? আজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বর্তমান ঘটনার কোনো দায় নিতে রাজি নয়। নামকাওয়াস্তে দুই-একজনকে বহিষ্কার করে নিজেদের দায় এড়াতে চায়। কিন্তু কোনোভাবেই তারা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনার দায়ভার এড়াতে পারে না। যদি সেদিন ডাকাত-অস্ত্রবাজকে শীর্ষ নেতা হিসেবে মনোনীত না করা হতো; তবে ওই সংগঠনের কর্মীরা নিশ্চয়ই এই বার্তা পেত যে, ছাত্রলীগের নেতা হতে হলে ডাকাত-অস্ত্রবাজ হওয়া চলবে না। আজ যতই বহিষ্কার নাটক করা হোক না কেন, বহিষ্কৃতরা ঠিকই জানে যে, এটা আইওয়াশ। আগামী দিনে নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের এই অস্ত্রবাজির যোগ্যতা ঠিকই কাজে লাগবে! আগের ইতিহাসই তাদের এমন সাহস জোগাবে!
দুই.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ছাত্রলীগ তাদের কোনো সহযোগী সংগঠন নয়। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। অনেক দিন পর আওয়ামী লীগের এমন বোধোদয় হওয়াতে ভালোই লাগছে। শুধু মুখে নয়, কাজেও আমরা প্রমাণ দেখতে চাই যে, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সহযোগী নয়; ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। আওয়ামী লীগের অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয়, ছাত্রলীগের সঙ্গেও ওই রকম আচরণ করা হচ্ছে, অচিরেই সেই বিষয়টি যেন প্রমাণিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরে অথবা আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী ঘোষণার অনুষ্ঠানে আমরা আওয়ামী লীগের অন্য কোনো ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে উপস্থিত থাকতে দেখিনি। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাদের ওই সব অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে বহুবার দেখেছি। প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ অধিবেশনে অন্য ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা সফরসঙ্গী না হলেও ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। আমরা ভবিষ্যতে ওই সব বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্য ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মতো ছাত্রলীগের নেতাদেরও একই দাঁড়িপাল্লায় মাপা হবে এমনটি আশা করি। যাতে ছাত্রলীগের নেতারাও উপলব্ধি করতে পারে যে, ছাত্রলীগ সরকারের কোনো সহযোগী সংগঠন নয়। অন্য সংগঠনের মতো অপরাধ করলে তাদেরও পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ গ্রন্থে হারুন-অর-রশিদ বলেন : ‘ছাত্রলীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র চার মাস উনিশ দিন পর এর প্রতিষ্ঠা (৪ জানুয়ারি ১৯৪৮)’ [পৃ. ৪৫]। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ওই রকমই। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন এনএসএফের গুণ্ডারা লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতিতে মেতে উঠে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল; তখন ছাত্রদের কল্যাণার্থেই ছাত্রলীগের সৃষ্টি। এই কারণে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাত্র সমাজকে জানাতে প্রচারিত মেনিফেস্টোতে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি পরিহার করে নিয়মিত ছাত্রদের হাতে ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি স্থান পেয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ ছাত্রলীগসহ সামগ্রিক ছাত্র রাজনীতিই লেজুড়বৃত্তি করছে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক তার আজ্ঞাবহ হয়ে ক্যাম্পাস দখল ও সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নই ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মাত্র। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে প্রশাসনের ইচ্ছায় ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। চার সহকারী প্রক্টরের গোপন তৎপরতায় বিষয়টি ধরা পড়েছে। ছাত্রলীগের এমন হীন কর্মের লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খুশি করা। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য ও আদর্শ সেখানে স্থান পায়নি। প্রকৃতপক্ষে, ছাত্রনেতাদের লেজুড়বৃত্তি মানসিকতাই এই সংকটের জন্ম দিয়েছে।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রেও ২৪ (ক)-তে বলা হয়েছে যে, ‘ছাত্রলীগের স্বার্থে, প্রার্থীদের উপযুক্ততা ও স্ব-স্ব এলাকার সদস্যদের মনোভাবের ভিত্তিতে তারা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী সংসদের কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করবেন’ (পৃ. ১৭)। গঠনতন্ত্রের এই ধারা সংশোধন করে যদি ছাত্রলীগের স্বার্থের পরিবর্তে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থে নেতা নির্বাচন করা যায়; তবে ভবিষ্যতে অনেক সংকট থেকে এই সংগঠন মুক্ত হবে। সামগ্রিক ছাত্র রাজনীতিও পরিশুদ্ধতার পথ খুঁজে পাবে। নেতাকর্মীরা যদি প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হয়ে থাকে; তবে তাদের উচিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মনেপ্রাণে ধারণ করে ছাত্রলীগের স্বার্থে নয়, ছাত্রদের ও দেশের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আÍজীবনীতে বলেছেন : ‘আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালোবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম’ (পৃ. ৩৫)। ছাত্রলীগকেও কোনো সরকারের স্বার্থে অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ না করে বঙ্গবন্ধুর মতো দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। আর সত্যিকার অর্থে ছাত্রলীগ যদি দেশের জন্য, ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করতে পারে; তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না।

[মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@gmail.com]
নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস এবং যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় দেশের সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। ছাত্রদের ভবিষ্যত্ নিয়ে সবাই শঙ্কিত। আমরা জানি ছাত্র যার অভিধা, অধ্যয়ন তার তপস্যা। ভবিষ্যত্ জীবন সুন্দরভাবে গড়তে অধ্যয়নের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনই ছাত্রসমাজের প্রধান কাজ। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি—রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে পড়েছে ছাত্রসমাজ। ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য বিলীন হতে বসেছে। শিক্ষার্থীদের কাছে নিয়মানুবর্তিতা, শৃংখলা ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ যেখানে কাঙ্ক্ষিত, সেখানে এর বিপরীত চিত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশি।
ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশে এখন ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। অথচ এ দেশেই রয়েছে ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় অতীত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রসমাজ গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন ছাত্ররা দেশের স্বার্থের কথা ভাবে না, ভাবে নিজেদের স্বার্থের কথা। রাজনীতিতে তাদের যে আদর্শ ছিল তা আজ ভূলুণ্ঠিত। স্বার্থ যেখানে মুখ্য, সংঘাত সেখানে অনিবার্য। ছাত্রসংগঠনগুলো শুধু যে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে থাকে তা নয় সংগঠনের ভেতরেও সংঘাত দানা বেঁধে ওঠে—স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলেই।
ছাত্রসংগঠনগুলো অতিমাত্রায় দলীয় রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়ায় তাদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে। সংগঠনগুলো সামান্য কারণেই প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হচ্ছে। অনেক মেধাবী ছাত্রের জীবন এভাবে অকালে ঝরে পড়ছে। সংঘাতের কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ।
ছাত্রজীবন হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের সময়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-দর্শন নিয়ে ভাবতে হবে, অধ্যয়ন করতে হবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা পত্রিকার পাতা খুলে দেখতে পাই ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের খবর। অশুভ রাজনীতির হাতছানিতে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে তারা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ নষ্ট করছে। দলীয় রাজনীতির অশুভ স্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে দিলে বিদ্যার্জন ব্যাহত হতে বাধ্য।
এ অবস্থা আর কতদিন চলবে? যে ছাত্রসমাজের ওপর দেশ ও জাতির অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা, যারা একদিন দেশের হাল ধরবে, তাদের মধ্যে এ হানাহানি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ না হলে দেশ কীভাবে উন্নত হবে? অনেক বাবা-মা কষ্ট করে তাঁদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান। অনেক আশা ও স্বপ্ন থাকে তাঁদের মনে—একদিন সন্তান মানুষ হয়ে তাদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু সন্ত্রাসের কারণে যখন তাঁদের সন্তান লাশ হয়ে বাড় আসে, তখন সব স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্যই রাজনীতি এবং তা নিশ্চিত করতে হলে ছাত্রসমাজকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনকে যেসব সমস্যা গ্রাস করেছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতি হবে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের উন্নয়নে। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি নয়—ছাত্রসংগঠনগুলো চলবে তাদের নিজস্ব ধারায়। প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আদর্শগত কিছু অমিল থাকলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, প্রতিযোগিতা আর প্রতিহিংসা এক জিনিস নয়। তাহলেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ হবে।
ছাত্রসংগঠনকে রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার ও শক্তির উত্স হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একইসঙ্গে ছাত্রসংগঠনগুলোয় অছাত্রদের অনুপ্রবেশ এবং তাদের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। আর এ কাজে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য থাকতে হবে। কারণ রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ছাড়া শান্ত ও সুন্দর শিক্ষাঙ্গন আশা করা যায় না। শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিক্ষাঙ্গনের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যত্ গড়তে পরিহার করতে হবে নেতিবাচক রাজনীতি।