Saturday, 5 April 2014

মিশরে কি আরব বসন্তের করুণ পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে

ভ্যালি অব দ্যা ভিজিটরস্ হিসেবে খ্যাত মিশর এখন অশান্ত ও অস্থিতিশীল এক জনপদ। অনিরাপদ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পশ্চিম আফ্রিকার ভাগ্যবরণের পথে কি আরবদের বিবেক ও বুদ্ধিভিত্তিক রাজধানী নীলনদের দেশ মিশর এগিয়ে যাচ্ছে? তিউনিসিয়া থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে যাওয়া আরব স্প্রিং মিশরের লৌহমানবের কপাট ভেঙ্গে চুরমার হয়ে তাহরীর স্কয়ারে লুটিয়ে পড়েছিল, মাত্র দেড় বছর পূর্বের সে জাগরণ কয়েকদিনের ব্যবধানে ইতিহাসে পরিণত হবে মিশর তথা বিশ্ববাসী কি জানতো? বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে সামরিক শাসনের অধীন স্থিতিশীল মিশর কিভাবে গণতন্ত্রের পথে হাঁটার শুরুতেই হোঁচট খেল, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসির বাড়াবাড়ি ধরনের ইসলামীকরণ নীতি কিভাবে সামরিক বাহিনীসহ বিশ্ব মোড়লদের প্রতিপক্ষ করে তুলল।

মোবারকের পোড়ানীতির কঠোর শাসনে মিশরে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সকল ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি রকমের সীমালংঘন বিশ্ববিবেককে দংশন করলেও মোবারক তাতে কর্ণপাত করেনি। পশ্চিমাশক্তির প্রকাশ্য সমর্থনেই মোবারক সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে দৌর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছে। জনসমর্থনহীন ও জীবনযাত্রার ব্যয়কে সাধারণ্যের সীমার মধ্যে রাখতে না পারলেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। মোবারক প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় সেনাবাহিনী ও সমাজের একশ্রেণির মানুষের অর্থ সম্পদের পাহাড় যেমন গড়েছে অপরদিকে অস্বাভাবিক হারে বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে এবং সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছে। এসব অন্যায় ও অবিচারের প্রতিকারে প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। কিন্তু ব্রাদারহুড বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের কাছাকাছি তাদের সেবা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছে। মোবারক বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পুরো নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণে রেখে পরবর্তীতে ক্ষমতায় যাওয়া পর্যন্ত মুরসির ব্রাদারহুড অত্যন্ত কৌশলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। কিন্তু যতবিপত্তি বাধে মুরসির ক্ষমতারোহণের পর। যে বেকারত্ব ও যুব সমাজের হতাশা এবং সামাজিক বৈষম্য অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ সে দিকে তেমন দৃষ্টি না দিয়ে, জনপ্রশাসনে মোবারকের সাজানো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে না এনে দ্রুততার সাথে শরিয়া আইন চালুর দিকে ঝুঁকে পড়েন। দীর্ঘ সময়ের সামাজিক অস্থিরতাকে কৌশলে সমাধানের চেষ্টা না করে সরাসরি শরিয়া আইনের দিকে মুরসির দৃষ্টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলকে ভাবিয়ে তোলে। নির্বাচনের পূর্বে সামাজিক সুবিচার ও নারী অধিকারের যে প্রতিশ্রুতি জনগণকে ব্রাদারহুড দিয়েছিল সে বিশ্বাসে জনসাধারণের মধ্যে যে চিড় ধরে একে কৌশলে সেনাবাহিনী ও মুরসি বিরোধীরা কাজে লাগায়। সাথে যোগ দেয় আন্তর্জাতিকমহলও। ইতোমধ্যে মুরসি সরকার মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তবাকের উপরও হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। অপরদিক থেকে সর্বদাই ব্রাদারহুডের সাথে শিথিল সম্পর্কের সৌদি আরবের সাথে মুরসির প্রথম সফরও সম্পর্কের তেমন উন্নতি তো করেইনি বরং ইরানের তত্কালীর রাষ্ট্রপতির মিসরে উষ্ণ সংবর্ধনা এবং মুরসির ইরান সফর সৌদি আরবকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলে। পশ্চিমাদের মৌন সমর্থন ও সৌদি আরবের মুরসি বিরোধিতার এ রকম সময়ের অপেক্ষায় ছিল জেনারেল আবুল ফাত্তাহ সিসি। গতবছরের জুলাইয়ে তাহরীর স্কয়ারের বিক্ষোভকে পুঁজি করে সেনা অভ্যুত্থান এবং মুরসির পতন এবং আগষ্টে মুরসি সমর্থকদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে আরব বসন্তের সে সুফলের কথা বলা হয়েছিল তার সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

মিশরের সিভিল প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠনগুলোর অপরাপর স্বৈরাচারী সরকারের মতই বেড়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের উদার চর্চা না থাকায় জনগণ অল্প কয়েকদিনের গণতান্ত্রিক পরিবেশের সাথে নিজেদের তেমন খাপখাওয়াতে পারেনি। সিসির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারো সেনা নিয়ন্ত্রিত সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্রাদারহুডের ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকে। মানুষের বাক স্বাধীনতার উপর আবারো নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয়, সেনা সরকারের অত্যাচারের রিপোর্ট করার অভিযোগে আল-জাজিরার সাংবাদিকসহ অনেকেই এখন পর্যন্ত জেলে অন্তরীণ হয়ে আছে। সরকার প্রথমে সন্ত্রাসী ও পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘোষণার কারণে ব্রাদারহুড ধীরে-ধীরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে কি না এটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক মাসের কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে। কায়রো শহরের দক্ষিণে অবস্থিত মিনায়া শহরের একটি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী আক্রমণে একজন পুলিশ কনস্টেবল মারা যাওয়ায় ব্রাদারহুডকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ২৪ মার্চ এক রায়ে ৫২৯ জনকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। একজন কনস্টেবল হত্যাকাণ্ডে এত লোক অংশ নিয়েছিল কি না এবং বিচারটি কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা এ বিষয়ে খোদ মিশরেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিতর্ক যাইহোক রায়ের মাধ্যমে সরকার ব্রাদার হুডের ব্যাপারে আরও কঠোর নীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্যে জেনারেল সিসি সেনা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পূর্বে তিনি সেনা সদরে তার উত্তরসূরীসহ সকল সিনিয়র আর্মি অফিসারদের সাথে মিলিত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স সেক্রেটারী চাক হ্যাগেলের সাথে টেলিফোনালাপ করেন। ইতোমধ্যেই স্থগিত দেড়শ' মিলিয়ন সামরিক সাহায্য ছাড়ের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনকেরী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখিত ঘটনাগুলো সিসির প্রতি সমর্থন হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আগামী ২৭ মে থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরিকল্পনা অনুযায়ী একক প্রার্থী এবং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তাহলে মিশরের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও জনগণের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা আবারো সামরিক উর্দির নিচে চাপা পড়বে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো বাড়বে বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন।

মিশরসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ব্রাদারহুড এক রাজনৈতিক বাস্তবতা। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি মিশরসহ সমগ্র আরবেই তাদের শাখা-প্রশাখা সম্প্রসারণ করে। সেনাশাসন, রাজতন্ত্র, আর পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশগুলোতে হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে দলটির ইসলামের রাষ্ট্রীয়দর্শনের আহবান জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ৮৫ বছরের পুরনো দলটিকে সন্ত্রাসবাদের সহযোগিতার অভিযোগে ১৯৫৪ সালে মিশরের সেনা সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। সৌদি সরকার এক আদেশে ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদেশগুলোকেও তাদের অনুসরণের আহবান জানিয়েছে। কেবল মুরসি সরকারকে সমর্থনের কারণে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিশর কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছে এবং মুরসির অপসারণের পর ১২ বিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়ে মিশরের সেনা সমর্থিত সরকারকে সহযোগিতা করেছে। অন্যান্য রাজতান্ত্রিক সরকারের মতামতও সৌদি আরবের মত। সুতরাং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্ শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের মৌন সমর্থনে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি কিভাবে আগামী নির্বাচন পরিস্থিতি সামাল দিবেন, নির্বাচন পরবর্তী মিশরকে কিভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবেন সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।


লেখক: ড.মো.ইকবাল হোছাইন, অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক