আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নানা জন নানাভাবে অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু এদেশে ভাল কাজের মূল্যায়ন খুব একটা হয় না। বিশেষ করে 'স্বেচ্ছাব্রতী মনোভাব' নিয়ে যারা এগিয়ে আসেন, ভূমিকা পালন করেন—তাদের ব্যাপারে আমরা ক্ষমাহীন উদাসীনতা প্রদর্শন করি। যেমন করছি ছাত্র-রাজনীতির লবকুশদের। তাদের কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক লাশ পড়ছে। ঝরে যাচ্ছে একেকটি মূল্যবান প্রাণ! কমছে দেশের জনসংখ্যর বোঝা। যাদের সুমহান অবদানের কারণে এভাবে লাশ পড়ছে, দেশের জনসংখ্য কমছে, তাদের আমরা সম্মান জানাচ্ছি না, প্রশংসা করছি না! এক সপ্তাহের ব্যবধানে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই কর্মী সায়াদ ইবনে মোমতাজ ও রুস্তম আলী আকন্দ দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন। এসব মৃত্যুর পেছনে ছাত্র-রাজনীতির বীরদের একক কৃতিত্ব রয়েছে। এহারে খুনোখুনি ও লাশ ফেলা অব্যাহত থাকলে আগামীদিনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কার নিঃসন্দেহে ছাত্র-রাজনীতির বীর সেনানীদেরই হাতে উঠবে! শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেই নয়, আমাদের দেশে শিক্ষার বারোটা বাজাতে বৃহত্ ছাত্র সংগঠনগুলো অপরিমেয় ভূমিকা পালন করছে। আমাদের শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই। আর মনীষীরা বলেছেন, যে শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই তার সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্পর্কচ্ছেদ হয় ততই মঙ্গল। 'আনন্দহীন' শিক্ষার সঙ্গে 'সম্পর্কচ্ছেদ' ঘটাতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্র শিবির প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে বিরোধী অবস্থানে থেকে এবং ছাত্রলীগ ও পুলিশের দাবড়ানির কারণে ছাত্রদল-শিবির তেমনভাবে সুবিধে করতে পারছে না। কারণ 'ক্ষমতার কাবাব-পরোটা' আর জোর-জুলুম-ভয় দেখানো ছাড়া বর্তমানে ছাত্র-রাজনীতিতে সমর্থন বাড়ানো যায় না। সুবিধাবাদিতা ও নগদ-নারায়ণের প্রতি আসক্তি বর্তমানে ছাত্র-যুবসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চারদশক ধরে আমাদের সমাজে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই আদর্শেরই তালিম দেয়া হয়েছে। 'মার-কাট-খাও, গুণ্ডামি কর, প্রয়োজনে খুন কর'—এই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের অঘোষিত 'রাষ্ট্রীয় আদর্শ'। এই 'আদর্শ' বৃহত্ রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠনগুলো অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করছে। মূল রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে তার অঙ্গ সংগঠনগুলো হাইব্রিড জন্তু-জানোয়ারের মত বাড়তে থাকে। সঙ্গত কারণেই এখন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। তবে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল সবক্ষেত্রে একেবারে দুর্বল হয়ে যায়নি। তারা মাঝে মাঝে 'গেরিলা কায়দায়' প্রতিপক্ষের উপর ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়ছে!
আমাদের দেশে যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, শাখা-প্রশাখার বিস্ফোরণ ঘটে। বিচিত্র নামে ও রূপে তাদের অসুরিক আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন পুরোপুরি 'ন্যাটো-বাহিনী' হিসেবে আবির্ভূত হয়। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে প্রতিপক্ষ কিংবা তাদের 'বশ্যতা স্বীকারে অনিচ্ছুক' সবাইকে উচিত শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে 'শিক্ষা'-কে মোটামুটি ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন চলতে থাকে। গত দুই দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল-শিবিরের বাড়াবাড়ি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগের তাণ্ডব আমরা দেখে এসেছি।
আমাদের অর্থনীতিতে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) তেমন সফল না হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অঙ্গসংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ দমন, নিজেদের মধ্যে 'বীরত্ব চর্চা', নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নিজেরা করা, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে সহায়তা করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে ছাত্রলীগ দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করছে। তারা এখন দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, হত্যা, দখলদারীসহ নানারকম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। তাদের 'সন্ত্রাস-উত্সবের' কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ছুটি পাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এমন 'অবসর বিনোদনের' ব্যবস্থা করে ছাত্রলীগের 'সোনার ছেলেরা' সত্যিই কৃতজ্ঞভাজন হয়েছেন! এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে খুব একটা চাকরি পাওয়া যায় না। তাছাড়া এই একঘেয়ে ক্লান্তিকর লেখাপড়ায় আনন্দও নেই। এ অবস্থায় শিক্ষাজীবন যদি প্রলম্বিত হয়, মাঝে মাঝে আনন্দহীন শিক্ষার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে—তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এই ইতিবাচক কাজটিই করছেন!
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বীর-পাণ্ডবদের দখলে চলে গেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় এ লৌকিক বীরদের অবদান দেশের উন্নয়নের অভিযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের দখলদারিত্ব, আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। একে অপরকে দাবড়ে বেড়ানো। মাঝে মধ্যে দলীয় কোন্দল। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় রাজনৈতিক দলের 'জমিদারদের' হাত ধরে জাতীয় জীবনে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর জ্ঞান-তত্ত্ব-গবেষণা এসবে সীমাবদ্ধ নেই। জ্ঞানের ব্যাপ্তি বেড়েছে, বিদ্যার সীমান্ত বিস্তৃৃত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় রাজনীতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং এই রাজনীতি প্রসারের জন্য প্রাণপাত করাই হচ্ছে 'জ্ঞান'। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, হত্যা, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, ফাও খাওয়া, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোন্দল, উপদলীয় সংঘাত, প্রতিপক্ষকে মেরে তক্তা বানানো, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কবরে পাঠানো, বিভিন্ন নেতানেত্রীর নামে মাতম, সন্ত্রাস নৈরাজ্য সৃষ্টিই 'নলেজ'। বিদ্যাচর্চায় ও জ্ঞান অনুশীলনে এগুলোই মূল সিলেবাস। এই পাঠ যারা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে সমাজে তারাই সফল হয়। এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যায়।
এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের দলীয় রাজনীতি। এ রাজনীতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার। যুক্তি বা আদর্শ নয়, অর্থ, অস্ত্র আর পেশিশক্তিই হচ্ছে এ রাজনীতির চালিকাশক্তি। মার-কাট-খাও। সন্ত্রাস-অস্ত্রবাজি-দখল। খুন-মামলা-হামলা। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্রশিবির। শিক্ষার আঙিনায় এখন আর ছাত্র নেই। থাকলেও তাদের কেউ পোছে না। নতুন ব্যবস্থায় এখন শক্তিশালী ও দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক অসংখ্য ক্যাডার। তারাই দাপিয়ে-লাফিয়ে বেড়ায়। তাদের দখলেই ক্যাম্পাস। ছাত্রের অনুষঙ্গ বই, খাতা-কলম। আর এসব ক্যাডারের উপাচার হচ্ছে, অস্ত্র-মাদক-পারভারসান-দলবাজি। লেজ ছাড়া যেমন কুকুর হয় না, পারভারসান ছাড়া ক্যাডারও দেখা যায় না। হিংস্র পশু যেমন যে কাউকেই প্রতিপক্ষ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন যুক্তি-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ ছাড়াই, ক্যাডাররাও প্রতিপক্ষের ওপর একই কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদল অপর দলের ওপর ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধ হলে নিজেরাই নিজেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ অপশক্তির গর্জন আর হুঙ্কারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর এখন ছাত্র-রাজনীতির আচ্ছাদনে ঢাকা দুর্বৃত্ত এবং পুলিশের পার্টনারশিপে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কারো তেমন কোন অনুশোচনা নেই, নেই কোন বিকার!
ছাত্রদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন আর কোন কাঙ্ক্ষিত স্থান নয়। জ্ঞান, শিক্ষা, কর্ম, অনুশীলনের সমন্বয়ে জীবনযুদ্ধের প্রকৃত সৈনিক হতে এখন আর কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসে বলে মনে হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ কেউ আসে অনন্যোপায় হয়ে। আর বাকিরা আসে লাঠিয়াল বা ক্যাডার হতে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল অথবা ছাত্রশিবির নামে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর সদস্য হয়ে তারা খুবই আনন্দে থাকে। একবার ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরে নাম লেখাতে পারলে জীবন একেবারে ফকফকা। তাদের কোন অভাব থাকে না। পাওয়া যায় যা খুশি তাই করার অবাধ স্বাধীনতা। যেভাবে খুশি টাকা উপার্জনের সুযোগ। অস্ত্রবাজি, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি করার লাইসেন্স। এ দুর্বৃত্তরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জিম্মি করে রাখবে আর অন্য সবাই তাদের দয়া বা মর্জির দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মালিক। খোলা রাখার মালিকও তারাই। এমন যারা বীর, তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাদের নতুন নতুন দায়িত্ব দিয়ে কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া যায়—তা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে। দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য সেনানী হিসেবেই তারা গড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হল দখলের ব্যাপারে অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এখন তাদের নেতৃত্বে আমরা অন্য কোন দেশ বা ভূখণ্ড দখল করতে পারি কিনা—তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। ইতিহাসে অনেক বীর অন্য দেশ দখলের কৃতিত্ব দেখিয়ে অমর হয়েছেন। বৃহত্ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ইতিহাস নির্দেশিত সে পথ অবলম্বন করে আমরা আবারো শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পারেন!
নিদান যেখানে অনুপস্থিত, প্রতিবিধানের সম্ভাবনা যেখানে তিরোহিত, সেখানে উপহাস কিংবা বিলাপ ছাড়া আমাদের আর কী ই-বা করার আছে?
লেখক: চিররঞ্জন সরকার, কলামিস্ট
আমাদের দেশে যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, শাখা-প্রশাখার বিস্ফোরণ ঘটে। বিচিত্র নামে ও রূপে তাদের অসুরিক আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন পুরোপুরি 'ন্যাটো-বাহিনী' হিসেবে আবির্ভূত হয়। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে প্রতিপক্ষ কিংবা তাদের 'বশ্যতা স্বীকারে অনিচ্ছুক' সবাইকে উচিত শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে 'শিক্ষা'-কে মোটামুটি ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন চলতে থাকে। গত দুই দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল-শিবিরের বাড়াবাড়ি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগের তাণ্ডব আমরা দেখে এসেছি।
আমাদের অর্থনীতিতে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) তেমন সফল না হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অঙ্গসংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ দমন, নিজেদের মধ্যে 'বীরত্ব চর্চা', নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নিজেরা করা, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে সহায়তা করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে ছাত্রলীগ দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করছে। তারা এখন দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, হত্যা, দখলদারীসহ নানারকম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। তাদের 'সন্ত্রাস-উত্সবের' কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ছুটি পাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এমন 'অবসর বিনোদনের' ব্যবস্থা করে ছাত্রলীগের 'সোনার ছেলেরা' সত্যিই কৃতজ্ঞভাজন হয়েছেন! এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে খুব একটা চাকরি পাওয়া যায় না। তাছাড়া এই একঘেয়ে ক্লান্তিকর লেখাপড়ায় আনন্দও নেই। এ অবস্থায় শিক্ষাজীবন যদি প্রলম্বিত হয়, মাঝে মাঝে আনন্দহীন শিক্ষার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে—তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এই ইতিবাচক কাজটিই করছেন!
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বীর-পাণ্ডবদের দখলে চলে গেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় এ লৌকিক বীরদের অবদান দেশের উন্নয়নের অভিযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের দখলদারিত্ব, আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। একে অপরকে দাবড়ে বেড়ানো। মাঝে মধ্যে দলীয় কোন্দল। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় রাজনৈতিক দলের 'জমিদারদের' হাত ধরে জাতীয় জীবনে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর জ্ঞান-তত্ত্ব-গবেষণা এসবে সীমাবদ্ধ নেই। জ্ঞানের ব্যাপ্তি বেড়েছে, বিদ্যার সীমান্ত বিস্তৃৃত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় রাজনীতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং এই রাজনীতি প্রসারের জন্য প্রাণপাত করাই হচ্ছে 'জ্ঞান'। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, হত্যা, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, ফাও খাওয়া, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোন্দল, উপদলীয় সংঘাত, প্রতিপক্ষকে মেরে তক্তা বানানো, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কবরে পাঠানো, বিভিন্ন নেতানেত্রীর নামে মাতম, সন্ত্রাস নৈরাজ্য সৃষ্টিই 'নলেজ'। বিদ্যাচর্চায় ও জ্ঞান অনুশীলনে এগুলোই মূল সিলেবাস। এই পাঠ যারা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে সমাজে তারাই সফল হয়। এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যায়।
এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের দলীয় রাজনীতি। এ রাজনীতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার। যুক্তি বা আদর্শ নয়, অর্থ, অস্ত্র আর পেশিশক্তিই হচ্ছে এ রাজনীতির চালিকাশক্তি। মার-কাট-খাও। সন্ত্রাস-অস্ত্রবাজি-দখল। খুন-মামলা-হামলা। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্রশিবির। শিক্ষার আঙিনায় এখন আর ছাত্র নেই। থাকলেও তাদের কেউ পোছে না। নতুন ব্যবস্থায় এখন শক্তিশালী ও দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক অসংখ্য ক্যাডার। তারাই দাপিয়ে-লাফিয়ে বেড়ায়। তাদের দখলেই ক্যাম্পাস। ছাত্রের অনুষঙ্গ বই, খাতা-কলম। আর এসব ক্যাডারের উপাচার হচ্ছে, অস্ত্র-মাদক-পারভারসান-দলবাজি। লেজ ছাড়া যেমন কুকুর হয় না, পারভারসান ছাড়া ক্যাডারও দেখা যায় না। হিংস্র পশু যেমন যে কাউকেই প্রতিপক্ষ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন যুক্তি-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ ছাড়াই, ক্যাডাররাও প্রতিপক্ষের ওপর একই কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদল অপর দলের ওপর ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধ হলে নিজেরাই নিজেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ অপশক্তির গর্জন আর হুঙ্কারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর এখন ছাত্র-রাজনীতির আচ্ছাদনে ঢাকা দুর্বৃত্ত এবং পুলিশের পার্টনারশিপে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কারো তেমন কোন অনুশোচনা নেই, নেই কোন বিকার!
ছাত্রদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন আর কোন কাঙ্ক্ষিত স্থান নয়। জ্ঞান, শিক্ষা, কর্ম, অনুশীলনের সমন্বয়ে জীবনযুদ্ধের প্রকৃত সৈনিক হতে এখন আর কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসে বলে মনে হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ কেউ আসে অনন্যোপায় হয়ে। আর বাকিরা আসে লাঠিয়াল বা ক্যাডার হতে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল অথবা ছাত্রশিবির নামে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর সদস্য হয়ে তারা খুবই আনন্দে থাকে। একবার ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরে নাম লেখাতে পারলে জীবন একেবারে ফকফকা। তাদের কোন অভাব থাকে না। পাওয়া যায় যা খুশি তাই করার অবাধ স্বাধীনতা। যেভাবে খুশি টাকা উপার্জনের সুযোগ। অস্ত্রবাজি, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি করার লাইসেন্স। এ দুর্বৃত্তরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জিম্মি করে রাখবে আর অন্য সবাই তাদের দয়া বা মর্জির দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মালিক। খোলা রাখার মালিকও তারাই। এমন যারা বীর, তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাদের নতুন নতুন দায়িত্ব দিয়ে কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া যায়—তা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে। দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য সেনানী হিসেবেই তারা গড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হল দখলের ব্যাপারে অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এখন তাদের নেতৃত্বে আমরা অন্য কোন দেশ বা ভূখণ্ড দখল করতে পারি কিনা—তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। ইতিহাসে অনেক বীর অন্য দেশ দখলের কৃতিত্ব দেখিয়ে অমর হয়েছেন। বৃহত্ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ইতিহাস নির্দেশিত সে পথ অবলম্বন করে আমরা আবারো শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পারেন!
নিদান যেখানে অনুপস্থিত, প্রতিবিধানের সম্ভাবনা যেখানে তিরোহিত, সেখানে উপহাস কিংবা বিলাপ ছাড়া আমাদের আর কী ই-বা করার আছে?
লেখক: চিররঞ্জন সরকার, কলামিস্ট