Wednesday, 2 April 2014

সিরিয়া কি সাম্রাজ্যবাদের বলির পাঁঠা হবে?

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তার বিরোধী পক্ষ তথা বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে দামেস্কের উপকণ্ঠে নিরীহ পথচারী, শিশু ও নারীসহ সহস্রাধিক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে সিরীয় সরকার। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার অভিযোগে বাশারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেন সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে 'কঠোর জবাব' দেয়ার জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রস্তুতির মহড়া হিসেবে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ষ্ঠ নৌবহরের কমান্ডারের নির্দেশে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রবাহী কয়েকটি রণতরী সিরিয়া অভিমুখে ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্র, এজন্য সেখানে মোতায়েনকৃত ডেস্ট্রয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে তিনটির স্থলে চারটি করা হয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনীও ভূমধ্যসাগরে জড়ো হয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে। এছাড়া সিরিয়ার সীমান্তের আশপাশের অঞ্চলগুলোতে সৈন্য সংখ্যা ও সামরিক ঘাঁটি বৃদ্ধি করছে ন্যাটো জোট। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সিরিয়াগামী জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও পরিদর্শক দল যদি বিশ্বাসযোগ্য ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের দ্বারা বাশারের বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক হত্যায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারে তাহলে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান অবশ্যম্ভাবী। ওবামা প্রশাসনের সবুজ সংকেত পেলেই মাত্র সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এই অভিযোগ বাশার সরকার প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর প্রস্তুতির জবাবে বলেছে, 'সিরিয়ায় হামলা করার চেষ্টা করা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলবে।' পাশাপাশি বাশার সরকারের কৌশলগত মিত্র ইরান ও রাশিয়াও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক অভিযান বা হামলার ঘোর বিরোধিতা করছে। লিবিয়ায় হামলা করার পূর্বে আমেরিকা যেভাবে লিবিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ ফেলেছিল, এখন সেভাবেই চাপে রেখেছে সিরিয়াকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ সিরিয়ার ওপর আরও আগেই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। সম্ভবত লিবিয়ার মতো সিরিয়াও এখন সাম্রাজ্যবাদের বলির পাঁঠা হতে যাচ্ছে। সিরিয়ার জনগণকে সুরক্ষিত করতেই নাকি সামরিক অভিযান চালাতে চাচ্ছে আমেরিকা, অথচ আমেরিকা নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সাম্রাজ্যবাদী খায়েশ মেটাতে ইরাক-আফগানের মতো বহু দেশ দখলপূর্বক অগণিত হত্যাকা- চালানোর দায়ে ইতিহাস ও বিবেকের কাঠগড়ায় দ-ায়মান।

যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা কেন চায় সিরিয়ায় হামলা করতে? তাদের কী স্বার্থ নেপথ্যে কাজ করছে? সাধারণত কোন প্রকার স্বার্থ ছাড়া অন্য দেশ হামলা করে না সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্ররা। সিরিয়ায় বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদতদানের পেছনে যুক্তিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স দীর্ঘদিন থেকেই বলে এসেছে যে, সিরিয়ায় তারা একটি গণতন্ত্রপন্থি অভ্যুত্থান বা আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে। তথাকথিত মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে তারা 'মুক্তিকামী বিদ্রোহী'দের সহায়তা দিচ্ছে বলে নিজেদের পক্ষে স্টেটমেন্ট দিচ্ছে। আসলেই কি তাই? মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইসরায়েলের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের প্রভাব ও আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধনশীল। মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ ইরানের এই বর্ধিষ্ণু আধিপত্য ও প্রভাব ঠেকাতে হলে সিরায়ায় মার্কিন দাসানুদাস শাসক বা সরকার প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ ৩৩ বছর ধরে মার্কিন স্বার্থরক্ষা করে এলেও এক সময়ে আরব বসন্তের কোপানলে তথা বাশারবিরোধী তুমুল গণআন্দোলন সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্র বাশারকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে বাশার তার কৌশলগত মিত্র ইরান ও রাশিয়ার সার্বিক সহযোগিতায় বিদ্রোহীদের সফলভাবে দমনপূর্বক অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সেই সঙ্গে লেবাননের কট্টর শিয়াপন্থি হিজবুল্লাহর মতো জঙ্গি বা সশস্ত্র সংগঠনও আসাদের পক্ষে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান হুমকি ইরানকে কোণঠাসা করতে এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তেলস্বার্থ নিশ্চিত করতে হলে আসাদের পতন ঘটিয়ে সিরিয়ায় পুতুল শাসক বসানোর কোন বিকল্প নেই।

এখন কথা হলো, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সীমাবদ্ধ সহযোগিতা দিয়েও বাশারের পতন ঘটানো যাচ্ছে না। 'সীমাবদ্ধ সহযোগিতা' বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরিয়ার বিদ্রোহীদের যে অস্ত্র সহযোগিতা দিয়েছিল তা বাশারের সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলভাবে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কারণ বাশারের বিপক্ষে আল কায়দার মতো সশস্ত্র সংগঠন যুদ্ধ করছে। যদি আল কায়দা ও এর সমমনা সশস্ত্র সংগঠনকে যথার্থভাবে অস্ত্র ও সামরিক সহযোগিতা দেয়া হয়_ সেটা হয়তো বাশার আল আসাদের পতন নিশ্চিত করবে বটে, তবে একই সঙ্গে সেটি আমেরিকার জন্য সুদূরপ্রসারী বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুদূরপ্রসারী বিপদ মানে, আল কায়দার মতো সশস্ত্র সংগঠনের হাতে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র চলে গেলে সেটি আমেরিকার জন্য পরবর্তীতে বিপজ্জনক ভবিষ্যৎ বয়ে আনতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সীমাবদ্ধ বা সীমিত সামরিক সহযোগিতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু এভাবে কার্যসিদ্ধি লাভে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন চাইছে সরাসরি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাশারের পতন ঘটিয়ে সেখানে পুতুল শাসক প্রতিষ্ঠা করা। তাই এতদিন ধরে আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তিরা সিরিয়ায় সামরিক হামলা করার জন্য মোক্ষম ছুতো খুঁজছিল। অভিযোগ সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, বাশারের বিরুদ্ধে আনীত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগটি হয়তো সামরিক অভিযানের জন্য একটি অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে আমেরিকা। এই অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সিরিয়ায় সামরিক হামলার সমর্থন ও ন্যায্য আদায় করে নেয়ার ফিকির করছে আমেরিকা। পরদেশে সামরিক হামলার জন্য সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার এই অজুহাত দাঁড় করানোর কৌশল আজকে নতুন নয়। ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়াসহ যত দেশে আমেরিকা সামরিক হামলা করেছিল, প্রায় সব দেশের সঙ্গেই গায়ে পড়ে যুদ্ধ শুরু করার জন্য যুদ্ধবাজ আমেরিকা এই 'অজুহাত কৌশল' দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন জোগাড় করে নিয়েছিল। আর যদি সিরিয়ায় বাশারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগটি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এটি অবশ্যই নিন্দনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এটিকে যে সিরিয়ায় হামলার জন্য অজুহাতসন্ধানী আমেরিকার মতো যুদ্ধবাজ পরাশক্তি কাজে লাগাতে চাইবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র সদ্য প্রকাশিত এক গোপন নথিতে জানা যায়, ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরানে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রাসায়নিক গ্যাস হামলা চালাতে যাচ্ছেন জেনেও আমেরিকা তাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। এমনকি ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে যখন ইরানে চারটি বড় ধরনের হামলার পূর্বে মাস্টার্ড ও সারিন গ্যাস দিয়ে হামলা চালানো হয়, তখন আমেরিকা এই হামলার কাজে ইরাককে স্যাটেলাইট ইমেজ ও মানচিত্রসহ আরও বহু গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। আমেরিকা তার স্বার্থের জন্য সবকিছুই করতে পারে। শুধু স্বার্থের জন্যই আগে যেটাকে সে ভালো বলত পরে সেটাকে খারাপ বলে প্রত্যাখ্যান করে। শুধু স্বার্থের জন্যই কালকে যাকে বন্ধু বানায় পরে তাকেই আবার শত্রুতে পরিণত করতে দ্বিধা করে না। এটাই হলো সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নৈতিক চরিত্র। তাই বলা বাহুল্য সিরিয়ায় হামলা করার জন্য আমেরিকা উপযুক্ত অজুহাত খুঁজে পেয়ে নতুন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজানোর অপেক্ষায় আছে।

আমি যা বলার নির্মোহভাবেই বলতে চেষ্টা করছি। আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য যৌথ সামরিক হামলার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমি বাশার আল আসাদের পক্ষ নিচ্ছি ব্যাপারটা এমন নয়। একজন প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রেমী হিসেবে আমিও চাই বাশার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার আন্দোলনরত জনগণের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন পূরণ হোক। কিন্তু আমি কোনভাবেই এটি যুদ্ধবাজ ও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য সামরিক হস্তক্ষেপে হোক তা চাইব না। কেননা লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় যদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বাশার সরকারের পতন ঘটে তাহলে প্রকারান্তরে সেখানে নিশ্চিতভাবেই সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত হবে। ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদি চক্রের স্বার্থই শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হবে। এখানে যেটা হওয়া দরকার ছিল বলে আমি মনে করি, সেটি হচ্ছে, পশ্চিমা শক্তি এতদিন ধরে সিরিয়ায় শিয়া-সুনি্নর মধ্যে মারাত্মক গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলে তৎপর ছিল। এমতাবস্থায় সুনি্ন ও শিয়া উভয় পক্ষকে সচেতন হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করে নিজেদের মধ্যে উদারতা পোষণপূর্বক বিরোধ ও লড়াই অবসানের জন্য শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি কারণ সরষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। এখানে প্রথমত সুনি্নদের পক্ষে সৌদি রাজতন্ত্রের ভূমিকাই তো প্রশ্নবিদ্ধ। পশ্চিমাদের বশংবদ সৌদি আরব তো মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মকভাবে সাম্রাজ্যবাদী ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদি চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর থাকে। শিয়াপন্থি বাশার ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়াইরত সুনি্ন পক্ষ তথা আল কায়দা ও এর সহযোগী সংগঠন আল-নুসরাহ ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও শামস নামক দলগুলোকে ইতোমধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে রাজতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্রের শাসকরা। সৌদি আরবের কাছে এই অর্থ দেয়া হয় এবং তা দিয়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। বস্তুতপক্ষে সিরিয়ায় শিয়া-সুনি্ন দ্বন্দ্ব ও বিরোধ উসকে দিতে এবং অব্যাহত রাখতে সৌদি রাজতন্ত্রের এহেন নগ্ন ভূমিকাই প্রধানত দায়ী।

না বললেই নয়, আরব লীগের একচ্ছত্রাধিপত্যকারী সৌদি আরব ২০১১ সালের মার্চে লিবিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য ন্যাটো বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এখন সিরিয়াতেও পশ্চিমা শক্তির সামরিক হামলার ব্যাপারে আরও নগ্নভাবে সরাসরি সক্রিয় সৌদি আরব। সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে যে কোন মূল্যে বাশার সরকারের পতন চায় মার্কিন তাঁবেদার সৌদি আরবও। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও যাবতীয় স্বার্থরক্ষা করতে আমেরিকা যেমন বদ্ধপরিকর, ঠিক তেমনি সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকরাও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার যাবতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে এক পায়ে খাড়া। সেজন্যই বুঝি সিরিয়ার পক্ষ ত্যাগ করতে রাশিয়াকে প্রকারান্তরে ঘুষই দিতে চেয়েছিল সৌদি আরব। গত জুলাইয়ের শেষ দিকে সৌদি আরবের গোয়েন্দাপ্রধান রাশিয়ার সঙ্গে ১৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুুক্তির বিনিময়ে পুতিনকে সিরিয়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছিল। এমনকি সৌদি প্রিন্স বন্দর তার নিজস্ব তহবিল থেকেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে আরও কিছু দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু পুতিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয়ায় সৌদিদের মনোবাসনা ও ষড়যন্ত্র ব্যাহত হয়। এটি নিঃসন্দেহ যে, সৌদি আরব ও পশ্চিমা শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে মূলত ইরানের প্রভাব ঠেকাতেই বাশারের পতন ঘটাতে মরিয়া। আর বাশার আল আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র নয়, রিয়াদের অধীন পুতুল সরকার অধিষ্ঠিত হবে সিরিয়ায়। ফলে কার্যত সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে আমেরিকা। এভাবেই ইরানের বিরুদ্ধে একটি সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে সৌদি আরবের তেল রপ্তানি ও সরবরাহকে নির্বিঘ্ন ও ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য ইরানের হরমুজ প্রণালির বিকল্প হিসেবে সিরিয়াকে রিয়াদের তাঁবে বা নিয়ন্ত্রণে রাখা অতি প্রয়োজন। কিন্তু শিয়াপন্থি বাশারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তা সম্ভব নয়। সম্প্রতি প্রখ্যাত আইরিশ সাংবাদিক ফিনিয়ান কানিংহাম সিরিয়ার পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় সৌদি আরবের দালালির ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন, 'পুতিনকে তেল দিতে গিয়ে প্রিন্স বন্দর প্রকাশ করে দিয়েছেন, কেন বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো এতটা মরিয়া। হিসাবটা অনেক পুরনো। এসব দেশ বিশ্ববাজারে তেল রপ্তানির জন্য হরমুজ প্রণালির একচিলতে সরু পথের ওপর নির্ভরশীল। এই সমুদ্র এলাকার বেশির ভাগ ইরানি ভূখ- এবং দেশটির নিয়ন্ত্রণে। প্রতিদিন ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল নিয়ে এ পথ দিয়ে জাহাজ ছুটে যায় বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে। এই পথের নিরাপত্তা অনেকাংশে ইরানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা ও উপসাগরীয় দেশগুলো জানে, কখনো ইরানের সঙ্গে তাদের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে হরমুজ প্রণালি পথে তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে_ যা পেট্রো ডলারনির্ভর পশ্চিমা অর্থনীতির জন্য হবে একটি বড় আঘাত।' সুতরাং এই ভূ-কৌশলগত সমস্যার দরুন সৌদি আরব, কাতারসহ উপসাগরীয় সুনি্ন শাসিত আরব দেশগুলোর তেল-গ্যাস রপ্তানির বিকল্প পথ ও উপায় হলো সিরিয়া। যদি বাশারকে উৎখাত করে সিরিয়ায় রিয়াদের তল্পিবাহক পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় তাহলে পাইপলাইনের মাধ্যমে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে এই তেল-গ্যাস ভূমধ্যসাগরীয় কোন বন্দরে নিয়ে যেতে পারলেই ইউরোপ-আমেরিকার বিশাল বাজার তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো করে ইরানকেও কোণঠাসা করা সম্ভব হবে। তাহলে কি সৌদি আরবের তেল রপ্তানির স্বার্থ আর ইঙ্গ-মার্কিন-ইহুদির সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা যৌথভাবে পূরণ করার জন্য সিরিয়ায় সামরিক হামলা বা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তিরা? কিন্তু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ইরান কি এই ষড়যন্ত্র ও সামরিক হামলা মেনে নেবে? মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান রণাঙ্গনখ্যাত পারস্য উপসাগর মূলত ইরানই নিয়ন্ত্রণ করে। সিরিয়ায় হামলা হলে ইরান পড়বে অস্তিত্ব সংকটে। সেক্ষেত্রে ইরান চুপ করে বসে থাকবে না। সিরিয়াকে অবশ্যই সামরিক সহায়তা দেবে ইরান। আর রাশিয়া এখন বাশারের পক্ষে বিবৃতি দিলেও পরবর্তীতে আমেরিকা ও তার মিত্রপক্ষ যদি হামলা করে সিরিয়ায়, সেক্ষেত্রে রাশিয়া তখনো বাশারের পক্ষে থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। কারণ ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাকে হামলা করার সময় রাশিয়া একইভাবে সাদ্দাম হোসেনের পাশে থাকার কথা বলে বিবৃতি দিলেও পরে আর সাদ্দাম প্রশাসনের পাশে থাকেনি। তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সিরিয়ায় সামরিক অভিযান বা হামলা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সেই যুদ্ধের লেলিহান অগি্ন দাউ দাউ করে জ্বলবে। কার্যত মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে বাধ্য। কেননা এখানে শুধু সিরিয়াই নয়, ইরানের অস্তিত্বও সংকটের মুখে পড়বে। তাই ইরান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মার্কিনবিরোধী শক্তিদেরও কৌশলে যুদ্ধে টেনে এনে সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ঠেকাতে চাইবে। এই যুদ্ধ থেকে ইসরায়েলও বিযুক্ত থাকতে পারবে না। কেননা বার্তা সংস্থা ফার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সিরীয় সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'দামেস্ক আক্রান্ত হলে তেলআবিবও হামলার লক্ষ্যবস্তু হবে এবং সিরিয়ার ওপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার অর্থ হবে বাস্তবে ইসরায়েলের ওপর হামলার লাইসেন্স দেয়া।' সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এর পরিণতিতে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে হয়তো বহুমুখী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে যেতে পারে।

[লেখক : তারেকুল ইসলাম, কবি ও কলামিস্ট।]