Tuesday, 22 April 2014

আরব বসন্ত লিবিয়ার জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ


আরব বসন্তের ছোঁয়ায় উজ্জীবিত লিবিয়ায় ঘটেছিল গণবিপ্লব। লৌহমানব গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের কঠোর শাসনের হয় অবসান। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পালিয়েও বাঁচতে পারেননি গাদ্দাফি। বিপ্লবীদের হাতে নির্মমভাবে মরতে হয় তাকে। গৃহযুদ্ধে মারা যায় অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। এরপর কেটে গেছে দু'দুটো বছর। শৃঙ্খলতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনতার মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল লিবিয়ার মানুষ, সেই স্বপ্ন কী তাদের পূরণ হয়েছে? না, হয়নি। বরং ঘটছে ঠিক উল্টোটা। সারাক্ষণ হত্যা, গুম, বোমা হামলা, অপহরণের আশংকায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে তাদের। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। আরব বসন্ত তাদের জন্য আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ বয়ে এনেছে- এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ। তবে অধিকাংশ লিবিয়ান এখনও গণবিপ্লবের চেতনা বুকে ধারণ করে আছেন। আশায় বুক বেঁধে তারা স্বপ্ন দেখছেন নতুন এক দেশ গড়ার। যেখানে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি থাকবে না, সকলে সম্মিলিতভাবে দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু গত দু'বছরে সেখানে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে শান্তির আশা ক্রমেই সুদূরপরাহত হতে চলেছে।

গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তার জের আজও চলছে। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আজও দাঁড় করানো যায়নি। দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ দূর করে জাতীয় ইস্যুতে তাদের একাত্ম করতেও ব্যর্থ হয়েছে লিবিয়ার বর্তমান সরকার। দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার করা যায়নি। অর্থনীতি বলা যায় 'ব্যাক ফুটে' চলে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত্ দেশের তেলক্ষেত্রগুলো অবরোধ করে রেখেছে বঞ্চিত শ্রমিকরা। তাদের সমর্থন দিচ্ছে সশস্ত্র মিলিশিয়ারা। সপ্তাহখানেক আগে ত্রিপলির বিদ্যুত্ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় জঙ্গিরা। গত ১৩ মে বেনগাজি শহরে অবস্থিত একটি হাসপাতালের সামনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়। ১১ সেপ্টেম্বর বেনগাজি শহরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

লিবিয়ায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত গতবছরের মাঝামাঝি থেকে। ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট অজ্ঞাত পরিচয় সশস্ত্র জঙ্গিরা ত্রিপলির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুফি মসজিদ প্রকাশ্য দিবালোকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এর একদিন আগে অপর একটি সুফি স্থাপনায় হামলা চালায় জঙ্গিরা। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর বেনগাজি শহরে। আমেরিকান কনস্যুলেট অফিসে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা লিবিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জে. ক্রিস্টোফার স্টিফেন্সকে হত্যা করে। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পদত্যাগ করেন যু্ক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের দূত সুসান রাইস।

বর্তমানে লিবিয়ায় সহিংসতা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আগে কেউ অপহূত হলে মনে করা হতো গাদ্দাফিবাহিনীই ঐ অপকর্মটি করেছে। কিন্তু সমপ্রতি গাদ্দাফির সাবেক গোয়েন্দা প্রধান আব্দুল্লাহ আল-সেনুসির সুন্দরী মেয়ে অপহরণের ঘটনা সেই ধারণাকে বদলে দিয়েছে। কারণ ঐ অপহরণের পেছনে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী নিজেই জড়িত ছিল। কয়েকদিন পরই অবশ্য মেয়েটি মুক্তি পায়। আর নিরাপত্তা বাহিনী খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করায় যে 'নিরাপত্তার' প্রয়োজনেই মেয়েটিকে নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থাও অনেক কমে গেছে।

গাদ্দাফির পতনের পর স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু হয় লিবিয়ার। ২০১২ সালের ৭ জুলাই লিবিয়ার মানুষ প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ২০১২ সালের ৮ আগস্ট ন্যাশনাল ট্রানসিশনাল কাউন্সিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। কংগ্রেস কর্তৃক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আলী জিদান গতবছরের অক্টোবরে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন, যার উপর দায়িত্ব দেয়া হয় দেশের জন্য একটি সংবিধান তৈরি এবং ২০১৩ সালে নতুন করে একটি সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। কিন্তু তারা এ কাজ করবেন কি, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই তাদের জন্য এখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাদ্দাফির বাহিনীর সাথে যুদ্ধশেষে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই অস্ত্র জমা দিতে রাজি হচ্ছেন না, যার ফলে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। এছাড়া কিছু নতুন বাহিনীও গজিয়ে উঠেছে। এ সমস্ত সশস্ত্র শক্তির সঙ্গে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে আপসও করতে হচ্ছে। যেমনটি করতে হয়েছে গত মে মাসে। বন্দুকধারীদের চাপের মুখে সরকারি অফিসগুলো থেকে গাদ্দাফির আমলে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের অপসারণ সংক্রান্ত একটি বিল পার্লামেন্টে পাস করতে বাধ্য হয় দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। 'লিবিয়ান থিংক ট্যাংক' হিসেবে খ্যাত আনাস আল-গোমাতি এ প্রসঙ্গে বলেন, 'পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে অনেকে বলতে শুরু করেছেন যে বর্তমান সরকার মিলিশিয়াদের জন্যই কাজ করছে।' সরকার অবশ্য পশ্চিমাদের সহায়তায় মিলিশিয়াদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের অনেকেই নতুন নেতৃত্বের অধীনে কাজ করতে রাজি হচ্ছে না। তাদের ধারণা নতুন নেতৃত্বের অধীনে গেলে তারা গাদ্দাফীর আমলের মতোই দমন-নির্যাতনের শিকার হবেন।

উদারপন্থি এবং উগ্রপন্থি ইসলামি শক্তিগুলোর বিরোধও বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতবছর সাধারণ জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনে উদারপন্থি ইসলামিরাই বেশিরভাগ ভোট জিতে নেন। কিন্তু কংগ্রেসের অনেক স্বতন্ত্র সদস্য একজোট হয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের লিবিয়ান সংস্করণ জাস্টিস এন্ড কনস্ট্রাকশন পার্টিসহ কয়েকটি উগ্রপন্থি ইসলামি দলকে সমর্থন দেন। এতে উগ্রপন্থিদের আধিপত্য বেড়ে গেলে সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে উদারপন্থি সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী আলী জিদান পড়েছেন মহা সমস্যায়। কিছুদিন আগে মিশরের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠকের কারণে জিদানের পদত্যাগই দাবি করে বসে উগ্রপন্থি লিবিয়ানস জাস্টিস এন্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি। কারণ তাদের সতীর্থ মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা প্রেসিডেন্ট মোরসিকে উত্খাতের পেছনে জেনারেল ফাত্তাহর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।

আঞ্চলিক বিরোধও দেশটির অন্যতম সমস্যা। লিবিয়ার দীর্ঘ-অবহেলিত পূর্বাঞ্চলেই গোলযোগ সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই আততায়ীদের হাতে নিহত হচ্ছেন অসামপ্রদায়িক লিবিয়ানরা। এজন্য তারা প্রধানত উগ্রপন্থি ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে দুষছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ার পর বেনগাজি থেকে বিতাড়িত হয় ইসলামি উগ্রপন্থি জিহাদি গ্রুপ আনসার আল-শরিয়া। বর্তমানে তারা আবার সেখানে ফিরতে শুরু করেছে। এলাকাবাসীকে খুশি করতে তারা সেখানে ক্লিনিক খুলে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। তারা ত্রিপোলি ও বেনগাজির মাঝে আজদাবিয়াতেও ঘাঁটি খুলে বসেছে। নিরাপত্তার অভাবে লিবিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। একটি কোম্পানি হিসেব করে দেখেছে লিবিয়ায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের কোন প্রকল্প স্থাপন করতে হলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে তাদের আরও বাড়তি ২ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। তবে সরকার হতোদ্যম হয়ে পড়লেও হাল ছাড়েননি লিবিয়ার সাধারণ মানুষ। পূর্বাঞ্চলের মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন। টাউন কাউন্সিলগুলো হাসপাতাল ও স্কুল চালু রেখে জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া তারা আরও নানা জনহিতকর কাজ করছেন যেসব করার কথা ছিল সরকারের।

-[ আশেক খান আলেখীন]-