Wednesday, 7 January 2015

অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয় বিবেচ্য নয়



স্কুলশিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। এমন নিষ্ঠুর হত্যালীলা কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেই সম্ভব হতে পারে। যেখানে প্রতিপক্ষকে চরম শত্রু হিসেবে গণ্য করা হয়। হত্যা করে চিরতরে মানুষকে নিঃশেষ করাই সেসব অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য থাকে। পেশোয়ারের এই স্কুলশিশুরা পাকিস্তানের বাসিন্দা। আত্মঘাতী হামলাকারীরাও একই দেশের অধিবাসী। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে। তাদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনা অভিযানে যেভাবে তাদের পরিবার নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে তারই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এ হামলা।

স্কুলটি সেনাবাহিনী পরিচালিত। সেখানকার ছাত্ররা সেনাসদস্যদের সন্তান। শিক্ষক কর্মকর্তারাও সেনাবাহিনীর পরিবার থেকে আসা। তালেবানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে এখান থেকে। এটি পেশোয়ার সেনাবাহিনীর কোর হেডকোয়ার্টার। জায়গাটি আফগান যুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদ’ প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে তখন ‘মুজাহিদ’ সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের কাজ চলেছে জোরেশোরে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তখন দেখানো হয়েছিল ইসলামের শত্রু হিসেবে। নিজেদের প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে আমেরিকা এ প্রচারণা চালায়। পাকিস্তানও তাতে সায় দেয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে গড়ে তোলা হয় ‘মুজাহিদ’ বাহিনী। তাদের সৃষ্ট এ বাহিনী নানা বিকৃত রূপ ধারণ করে এখন নিষ্ঠুর আত্মকলহে লিপ্ত হয়েছে। তার কুফল হিসেবে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটেছে। এ অপরাধের দায় সন্ত্রাসীদের হলেও স্বার্থান্বেষীরা কৌশলে তা ইসলামের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে স্বার্থান্বেষীরা। ইসলামের কথা বলে উত্তেজিত করা হলেও মূলত এদের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা সহজ হয়ে গেছে। টিটিপি প্রধান মুফতি ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে বাইরে থেকে এ অভিযানে মদদ দেয়ার অভিযোগ এনেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ঘটনার পরপরই পাকিস্তান সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দাপ্রধান আফগানিস্তানে যান। আফগান প্রেসিডেন্টের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, টিটিপিকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল রাখার জন্য তারা ব্যবহার হচ্ছে। পাকিস্তানি পত্রিকাগুলো খবর দিয়েছে, অস্থিতিশীল কার্যক্রম চালানোর জন্য আফগান ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে টিটিপি অর্থ ও কৌশলগত সহায়তা পাচ্ছে। 

‘মূল ধারার ইসলামের’ সাথে এ ধরনের জঙ্গি কর্মকাণ্ডের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। উপমহাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কঠোরভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রতিটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে তারা। তবে তাদের নিন্দা প্রতিবাদ সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করতে অনীহা দেখায়। অনেকে সেগুলো প্রকাশ করার গরজ বোধ করে না। কিন্তু সেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে এই ইসলামপন্থীদের যেভাবেই হোক সম্পৃক্ততা দেখানোর চেষ্টা করে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যে জঙ্গিতৎপরতা দেখা গেছে তার সাথে ইসলামি দলগুলোর কখনো কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে।

প্রতিটি সন্ত্রাসী ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায় দু’টি পক্ষ পাওয়া যাচ্ছে। একটি পক্ষ সরাসরি এর সুবিধাভোগী। এরা ‘ইসলাম’, ‘মুসলিম’ এ শব্দগুলোকে আক্রমণ করতে সদা প্রস্তুত হয়ে থাকে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো। অন্য দিকে যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা সব সময় থেকে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে। তাদের পরিচয় কখনো স্পষ্ট হচ্ছে না। এই বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর ‘ইসলামি’ নামটিই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠছে।

মানুষ হত্যা সবচেয়ে বড় অপরাধ। যারা এ অপকর্ম করছে তারা সবচেয়ে বড় অপরাধী। একজন মানুষ হত্যা মানে সমগ্র মানবতাকে নিঃশেষ করে দেয়া। অন্য দিকে একজন মানুষের জীবন রক্ষার মাধ্যমে বাঁচিয়ে দেয়া যায় সমগ্র মানবতাকে। কোনো ধর্ম মানুষ হত্যার মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামে কঠোরভাবে হত্যার বিরুদ্ধে বলা আছে। হত্যাকারীর বিরুদ্ধে হত্যার দণ্ড (কেসাস) কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। খুনিদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। বরাবরই দেখা গেছে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেয়ে এ ধরনের প্রতিটি ঘটনাকে ব্যবহার করা হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণার কাজে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি ক্যাফেতে ১৭ জনকে জিম্মি করে হারুন মনিস নামে এক সন্ত্রাসী। সে ইরানি বংশোদ্ভূত ‘মুসলিম’।

এ ঘটনাকে দেখা হয়েছে ইসলামি সন্ত্রাস হিসেবে। ঘটনার পরপর সেখানকার মুসলিম কমিউনিটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তারা রাস্তায় বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। নয়-এগারোর ঘটনার পর ইউরোপে মুসলিমরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। দাড়ি-টুপিওয়ালারা এ উছিলায় সারা বিশ্বে হেনস্তা হয়েছেন। একজন মুসলিম ওসামা বিন লাদেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে এমন প্রচারণার কারণে সে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তখন সৃষ্ট হিংসাত্মক মনোভাবের এখনো অবসান হয়নি। টুইন টাওয়ার ধ্বংস ও পেন্টাগনে হামলার পরিকল্পনা হয়েছে আফগানিস্তানের অন্ধকার কোনো গুহায় এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ এর ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে কত রক্তপাত হয়ে গেল।

একজন অপরাধীকে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দেখাই এ ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়ার কারণ। অথচ পৃথিবীতে হিংসাত্মক ঘটনা কম ঘটছে না। ক’দিন পরপরই আমেরিকায় স্কুলে হামলা করে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। কানাডা সুইডেনের মতো দেশে সাম্প্রদায়িক কারণে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। এমন ঘটনা খ্রিষ্টান ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষের মধ্যে ঘটছে। ভারতে মাওবাদীরা মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা পরিচয়ে হিন্দু। ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করার লাইন্সেসপ্রাপ্ত। ওই সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্ববাসীকে ধর্মীয় মোড়কে দেখতে অভ্যস্ত করানো হয়নি। পেশোয়ারের ঘটনাটিকে কিছু সন্ত্রাসীর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখতে হবে। এর পেছনে যারা কাজ করেছে তাদের পরিচয় হতে হবে অপরাধী। নামে তারা কোন ধর্মের বিবেচনা হিসেবে সেটা কোনোভাবেই অগ্রগণ্য হতে পারে না। 

হারুন মনিসের বিরুদ্ধে খোদ তার স্ত্রীকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে। ওই নারীকে ১৮টি ছুরিকাঘাত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৪০টির বেশি যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। সে নানা অপরাধের কারণে ইরানে অভিযুক্ত হয়। দেশ থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। ইরানের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব থাকায় একজন অপরাধীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্ট্রেলিয়া বাছবিচার করেনি। অথচ মালয়েশিয়াতেও নানা অপরাধ সে করে এসেছিল। হারুনকে একজন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিচারে সহযোগিতা করা সবার আগে দরকার ছিল। অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পর যখন সে আরো বড় অপরাধ করে বসল, তখন সামনে আনা হলো তার মুসলিম পরিচয়। অথচ সুন্নি শিয়া উভয় গ্রুপ হারুনকে নিজেদের কমিউনিটির লোক নয় বলে বিবৃতি দিয়েছে।

পেশোয়ার হামলার পরদিন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ একটি সর্বদলীয় সভার ডাক দিয়েছেন। সে সভায় উপস্থিত হয়েছে সব দল। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খান এতে যোগ দিয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তিনি এত দিন চলা তার আন্দোলন বাতিল করেছেন। সব ধর্মভিত্তিক দলও নওয়াজ শরিফের সাথে সহযোগিতার হাত মিলিয়েছে। দৃশ্যমান সব রাজনৈতিক শক্তি এক প্ল্যাটফর্মে এসেছে। এ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা পাকিস্তানের পক্ষে অসম্ভব হবে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অপরাধের অসাম্প্রদায়িক বিবেচনা। মনে রাখতে হবে সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকতে পারে না। কোনো ধর্মকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে না। নামে খ্রিষ্টান কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসী হলে তাকে খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী বলা যেমন বিবেচ্য হতে পারে না একইভাবে হিন্দু, মুসলিম নামে কেউ এ কাজ করলে তাকে ধর্মের আবরণ দেয়া যাবে না। বিচ্ছিন্ন গ্রুপের অন্যায় কর্মকাণ্ডের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যথায় সন্ত্রাস নির্মূল অভিযান কিছু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে সন্ত্রাস নির্মূল হবে না। যেমনটি এখন ঘটছে।

# জসিম উদ্দিন
jjshim146@yahoo.com