Wednesday, 7 January 2015

রাজনীতিতে বিএনপির দ্বিমুখী ভাবনা

রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার ভালো অবস্থানে এবং বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি খারাপ অবস্থানে রয়েছে এমনটি সাধারণ মানুষের ভাবনা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী সব ঘটনাপ্রবাহ এবং সময়কাল ক্ষমতাসীন দল হয়তো ভিন্ন ভেবেছিল; কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের মৌন সমর্থন এবং সহিংসতার পরিবর্তে একটু শান্তিতে থাকাটা মন্দের ভালো মনে করে এক ধরনের স্বস্তি ও মেনে নেওয়ার মনোভাব তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। দেশ কিভাবে চলছে, নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়েছিল ইত্যাদি বিষয় বড় না হয়ে সহিংস আচরণ থেকে আমরা যে মুক্তি পেয়েছি তা কম বড় নয়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাশালী দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত ও বিকাশমান সম্পর্কোন্নয়ন ক্ষমতাসীনদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত করেছে এবং বিএনপিকে একা হয়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করছে। বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বিভিন্ন জনসভা ও পত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য প্রদান করেছেন।

বিএনপির এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাজনীতিতে তাদের কোনো কূল-কিনারা না পাওয়ার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। ধরে নিলাম তাদের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন দিলে জামানত হারাবে, কিন্তু ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনকে নির্বাচনে বাধ্য করার মতো পরিবেশ তৈরিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কথাটি ঘুরিয়ে বললে জনসমর্থনপুষ্ট আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়া কিংবা ঝিমিয়ে পড়া নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করতে আপাতত এবং দ্রুত সম্ভব হচ্ছে না বিধায় নেতা-কর্মীরাও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন কিংবা হতাশায় দিন অতিবাহিত করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সুস্পষ্ট ও বিকাশমান বক্তব্য উপস্থাপনেও বিএনপি পুরোপুরি ব্যর্থ। মানুষের বোধোদয়ের জায়গায় এখন আর মাঝামাঝি অবস্থান, চালাকি কিংবা ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানেও বিএনপি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা প্রভৃতি জাতীয় ইস্যুতে তাদের অবস্থান নীরব, অস্পষ্ট ও ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো। জনসমর্থনের উপাদানগুলোর মধ্যে অর্থনীতি ও দুর্নীতি বড় উপাদান হলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে মৌলিক পার্থক্য বিরল। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষিত ও ধীশক্তিসম্পন্ন জনগণ রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে জড়িত উপাদান এবং এর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ককে বড় করে দেখে। ফলে জনসমর্থনের পরিবর্তনে, রাস্তার আন্দোলনের পরিবর্তে বা রাস্তার আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিপরীতে নিজেদের মনে পরিবর্তনের বীজ বুনে মোক্ষম সময়ে তার প্রকাশ ঘটাতে চায়।

বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভারত অন্যতম। নির্বাচন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে বড় দুটো দলই নিজেদের প্রয়োজনে ভারতের কাছে সমর্পণ করতে কার্পণ্য করে না। বিএনপি ভেবেছিল, ভারতে যেহেতু বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, সেহেতু তাদের লাভ হবে। সরল, সাধারণভাবে চিন্তা করলে এমনটি ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না।

বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের চিন্তাধারা ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তাদের সরকারের পরিবর্তন হয়; কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন কম হয়। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখবে এবং যে সরকারের কাছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে, তাদের তারা সমর্থন দেবে। তারা চায় বাংলাদেশের মাটি যেন তাদের দেশের অপরাধীরা ব্যবহার করতে না পারে, যা তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়েও তারা ভাবে। এসব কারণে কংগ্রেস কিংবা বিজেপি যেই হোক না কেন, তারা আওয়ামী লীগ সরকারকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করবে। তাদের ভুলে থাকার কথা নয় যে ২০০১ সালের নির্বাচনে পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কী চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল।

নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন দেওয়া যায়, ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা যায়; কিন্তু প্রভাবিত করা যায় না। এখন ভারতের নিরপেক্ষ থাকার ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে পারে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। প্রভাব খাটিয়ে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতেও পারে ভারত। এ ক্ষেত্রে বিএনপির লাভ বেশি। কোনটি ভারত সরকার করবে সেটি তাদের বিষয়। তবে আন্দোলন করতে হবে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের। আর আন্দোলন সফল হতে পারে একমাত্র সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আন্দোলন হতে হবে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা ১৯৯৬ সালের আন্দোলন বা ২০০৬ সালের আন্দোলনের মতো। ছোটখাটো এবং সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন হয় না, হওয়া সম্ভব নয়। ভারত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে আন্দোলনের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না তা বিশ্লেষণের বিষয়।



লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/12/20/165098#sthash.79xXz2rn.dpuf