বজ্রকথন: নিহত গণতন্ত্র, নির্বাচনের ফাঁসি
গিনেস বুকে স্থান করার মতো ভোটারবিহীন এক নির্বাচনী প্রহসন হয়ে গেল। যার জন্য অনেক জীবন, সম্পদ ও সম্মান খোয়াতে হলো আমাদের। যাদের জন্য এসব, তারা নির্বিকার, বিবেকবোধহীন। একপক্ষ আওয়ামী লীগ, অন্যপক্ষ ১৮ দলীয় জোট। দেশের মালিক জনগণ, অথচ জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা মতামতের কোনো মূল্য নেই। সরকারের জেদ সংবিধান সমুন্নত রাখতে নির্বাচন করতেই হবে, বিরোধী দল কোনোমতেই নয়। দেশের মালিক জনগণ চায় কি, তাদের সুবিধা-অসুবিধা কি? কেউ ফিরেও তাকায় না। মানুষ যখন মায়া-মমতা, বুদ্ধি-বিবেকহীন হয়, সে যে তখন পশুরও অধম_ তার প্রমাণ তো আমরা হাতেকলমেই করলাম। আওয়ামী লীগের নির্বাচন সমন্বয়কারী এইচ টি ইমাম। ছেলেবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় নানার বাড়িতে মানুষ। এইচ টি ইমাম আর ড. রাজ্জাকের ছোটবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তারা দুজনই নানার বাড়িতে বড় হয়েছেন। তাই দেশটা তাদের মামা বাড়ি। এইচ টি ইমামের বাড়ি বাসাইলের সুন্যা, ড. রাজ্জাকের মধুপুর। এইচ টি ইমাম মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন, সে জন্য তাকে খুবই সম্মান করি। তিনি আমায় মামা বলে ডাকেন, আমিও তাকে একই সম্বোধন করি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমাদের বেশ ভালো। কিন্তু তার কাজকর্ম আমাকে বিরক্ত করে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ আয়োজনের সব করেছিলেন। যা সাধারণত কেবিনেট সচিবরা করেন। খুনি মোশতাকের কেবিনেট সচিব, জিয়া-এরশাদের সঙ্গে কাজ করেছেন_ যা সব চাকুরে করেন। এরপর কি জাদুই করেছেন একেবারে হলুদ, নেত্রীর সব কাজের অগ্রভাগে। তার মতো গুণধর মানুষ পাশে থাকলে আওয়ামী লীগকে ডুবাতে আর কাউকে লাগবে না। দলকানা আর কাকে বলে? '৬৯-এর গণআন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা বহু কষ্টে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তা অন্তর থেকে ধুয়ে গেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর যে কটি অমূল্য প্রাণ বিনষ্ট হয়েছে তার এবং যে বিপুল রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং জেদি অবৈধ সর্বদলীয় সরকারকে দায়ী হতে হবে। সর্বদলীয় সরকারপ্রধান জননেত্রী বারবার বিরোধী দলের নেতাকে হুকুমের আসামি করতে চান, ভালো কথা। জনতার আদালতে হয়তো একসময় দেশের এই অরাজকতার জন্য উভয়ই অভিযুক্ত হতে পারেন। আল্লাহ জানেন, কবে হবে; কিন্তু হবেন।
কি দুর্ভাগ্য! একটা নির্বাচন হলো আমিও ভোট দিতে পারলাম না, বঞ্চিত হলাম। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর '৫৪-এর নির্বাচনে অংশ নিতে পারিনি। বয়স সাহায্য করেনি। কিন্তু '৭০-এর নির্বাচন থেকে নিয়মিত ভোট দিয়েছি, নির্বাচনী প্রচারণা করেছি, যখন যেভাবে পেরেছি ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছি। কিন্তু এবার আমার সেই সৌভাগ্যও হলো না। আমার স্ত্রী পারল না। আমার এক ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। মেয়ে কুশিমনি সাত বছরের, তাই ভোটার হয়নি। কিন্তু কুঁড়ির বয়স তো ২২. কত আশা করে প্রথম ভোটার হয়েছিল, ল' পাস করেছে। নিশ্চয়ই ভোট দেওয়ার যোগ্য হয়েছে। সে ভোট দিতে পারল না, বঞ্চিত হলো। মেয়েরা পরের ধন। হয়তো আবার যেদিন স্বাভাবিক ভোট হবে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে নিশ্চয়ই ভোট দিতে পারবে। কিন্তু সেটা হয়তো বাপের বাড়িতে হলো না। ওর এ দুঃখ কি করে ঘুচবে। আমি যেখানে ভোটার সেখানে '৯৯-এর ভোট ডাকাতির প্রধান আপনা-আপনিই নির্বাচিত হয়ে গেছে। দেশের রাষ্ট্রপতি ভোট দিতে পারেননি। রাষ্ট্র চালান প্রধানমন্ত্রী, তিনিও ভোট দিতে পারেননি। এরশাদের কথা বলতে চাই না, তবুও বলতে হয়, তিনি যেখানে ভোটার সেখানেও ভোট নেই, অটো পাস। সবাই খালি মাঠে গোল দিয়ে ম্যারাডোনা। এমন ম্যারাডোনারা আসল খেলায় মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গোল দেওয়া তো দূরের কথা, খালি পায়ে যেতেও ৯৯ বার হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। জগতের সবচেয়ে হতাশাজনক বিরক্তিকর নির্বাচন দেখে আমি খুবই মর্মাহত। নির্বাচনী চিত্র ইতোমধ্যে অনেকে অনেকভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরেছেন। তাই ওসব নিয়ে তেমন কিছু বলছি না। প্রথম দিকে শুনছিলাম রংপুরের ১০ কেন্দ্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভোট পেয়েছেন এক হাজার, নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন পাঁচশ'. স্বাভাবিক ভোট হলে যেখানে হয়তো এক কেন্দ্রেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পেতেন দুই-আড়াই হাজার। ভোট কাস্টিং হয়েছে বড়জোর দুই-আড়াই শতাংশ। দুই তিন হাজার কেন্দ্রে দুই চার দশটা থেকে চার-পাঁচশ'। ৫০ কেন্দ্রে তো একটাও পড়েনি। তারপরও নির্বাচন কমিশন যেভাবে ভোটের ফলাফল দেখাচ্ছে তাতে তাদের নামে প্রতারণার মামলা হওয়া উচিত। কোনো কোনো চোরের বেটা নাকি একাই চার-পাঁচশ' ভোট দিয়েছে বলে পত্রিকায় এসেছে। দেশবাসী যদি হিসাব চায় আজীবনেও কমিশন হিসাব দিতে পারবে না। তাই এ নিয়ে কি বলব?
মানুষ খুবই বিরক্ত। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। কোনো ব্যবসা নেই, বাণিজ্য নেই। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ইতোমধ্যে ক্ষতি হয়ে গেছে প্রায় লাখ কোটি, মানে জাতীয় বাজেটের অর্ধেক। হয়তো এই ক্ষতি পোষাতে আরও দুই লাখ কোটির প্রয়োজন হবে_ সেটা আমরা পাব কোথায়? এই এক লাখ কোটি যে আরও দুই চার লাখ কোটিতে উন্নতি হতে পারত, সেটা তো আর পাব না। ভোটের নামে গ্রামের স্কুল জ্বালানো হয়েছে। গৌরী সেনের মালে আবার সেগুলো ঠিকঠাক করা যাবে। কিন্তু যে শিশু তার স্কুল পোড়া দেখে হৃদয় ভাঙল, তার ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগাবে কি করে? কাচ ভাঙলে জোড়া দিলেও দাগ থাকে। হৃদয় ভাঙা দাগ নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুর যন্ত্রণা কে বুঝবে? সত্যকে সত্য বলার, মিথ্যাকে অস্বীকার করার কেন যেন মানুষের অভাব হয়ে যাচ্ছে। যা সত্য যা অন্যায়, তা বলার একজন লোকও কি আওয়ামী লীগে নেই; যে বুক চিতিয়ে বলতে পারে, আত্দসমালোচনা করতে পারে?
নির্বাচন শেষ হয়ইনি, বিএনপি বা ১৮ দলের অবরোধের পাশাপাশি আবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল। দেশটা কি ১৮ দলের? ১৮ দলের লোকজনের ছেলেমেয়ে নেই? তাদের লেখাপড়া নেই? বাড়িতে অসুখ-বিসুখ নেই, যাদের চিকিৎসার দরকার? বিএনপি, ১৮ দল বা শুধু আওয়ামী লীগ_ তারাই কি দেশ? দেশে আর কোনো মানুষ নেই। এই সপ্তাহে মাত্র তো তিনটা দিন। এই তিনটা দিন কি অপেক্ষা করা যেত না। ছোটখাটো দু'চারজন আমরাও তো আছি, একটু আলাপ করা যেত না? ১০টা শিক্ষক, পাঁচজন সাংবাদিক, কৃষক, শ্রমিক, জজ-ব্যারিস্টার, রাজনৈতিক-বুদ্ধিজীবী_ যারাই আছেন, তাদের নিয়ে বিরোধী দল কি সামান্য একটু আলাপ-আলোচনা করতে পারত না? দেশ যেমন সরকারি দলের পৈতৃক সম্পত্তি নয়, প্রধান বিরোধী দল বা ১৮ দলীয় জোটেরও নয়_ তাহলে এমন আচরণ কেন? একদিকে সরকারদলীয় স্বৈরাচার, অন্যদিকে বিরোধীদলীয় স্বৈরাচার_ দেশের মানুষ এসব আর মেনে নেবে না।
মাত্র কদিন হলো আমরা বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ মিলে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট করেছি। আমার এ বক্তব্য ফ্রন্টের নয়, এ বক্তব্য আমার এবং আমাদের দল কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের। দেশের মানুষ এভাবে পড়ে পড়ে আর বেশি দিন মার খাবে না, তারা নিজেরাই বিকল্প বেছে নেবে। বাইরের কেউ এসে জনবিচ্ছিন্ন নেতানেত্রী বা রাজনৈতিক দলকে পাহারা দেবে_ এটা কোনো কাজের কথা নয়। সে জন্য সময় থাকতে দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আজ যারা মধ্য গগনে তারা ভাববেন না, গগন তাদের জন্য সদাসর্বদা একই রকম থাকবে। সাধারণ মানুষ চালাকি ধরে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে সব জায়েজ, না থাকলে নাজায়েজ এই থিউরি আর বেশি দিন চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের মুরগি সাপ্লাইয়ারদের নিয়ে আর যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হবে না। কুষ্টিয়ায় মাহাবুব-উল আলম হানিফের হাত ধরে জামায়াতি যদি আওয়ামী লীগার হতে পারে, তাহলে শেখ হাসিনার হাত ধরে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আযম কেন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবেন না? ডিজিটাল জামানায় সবই সম্ভব। কিন্তু একটা সাদা কথা মনে রাখতে হবে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। ধান্ধাবাজ চতুররা ক্ষণস্থায়ী। ছোটখাটো যুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারে, কিন্তু শেষ বা চূড়ান্ত যুদ্ধে সব সময় সত্যের জয় হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হবে। দীর্ঘদিনের ঘুণে ধরা অসুস্থ রাজনীতির হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করতে পথ চলছি অনেক দিন। কিন্তু পদে পদে ব্যর্থ হয়েছি। দিনের পর দিন রাস্তাঘাটে হাজার হাজার মানুষের সমর্থন-সহযোগিতা বেড়েছে কিন্তু বড় বড় রথী-মহারথীদের মন পাইনি, পাশে দাঁড়ায়নি। যারা এক সময় আমাদের দয়ায় চলত, তারা পাশে এসে সৌজন্যও দেখায়নি। কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ করেছি ১৪ বছর। আমার এক সময়ের ধনবান সহকর্মীরা প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দিলে দল চলত রকেটের মতো। কিন্তু তারা ৫০০ টাকা দিয়েও সহযোগিতা করেনি। কিন্তু কত অজানা-অচেনা কর্মী-সমর্থকরা প্রতি মাসে ১০, ২০, ১০০, ২০০, ৫০০ দিয়ে দলকে প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আমাদের অলসতায়ই হয়তো আরও বেগবান হয়নি। এটাই যদি হাজার থেকে লাখে যায় তখন আর গরিব দল বলে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। একজন দোকানি, একজন রিকশাওয়ালা কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগকে যদি ভালোবেসে ১০টা টাকা দেয়, সেদিন ইনশাল্লাহ দেখব কত ধানে কত চাল। যেখানেই যাই গলায় গামছা না থাকলে প্রশ্ন করে। আগে যেখানে রাস্তাঘাটে দু'চারজন ছুটে আসত, এখন সেখানে ২০-৫০ জন ছুটে আসে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ এবং সম্পৃক্ততা বেড়েছে অনেক। কিন্তু যাদের জন্য অনেক সময় ব্যয় করেছি, তাদের তেমন খেয়াল নেই। এদের মধ্যে গণফোরামের প্রধান ড. কামাল হোসেনের নাম আসে সবার আগে। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় সবাই তাকে সিআইএর দালাল এবং পাকিস্তানের এজেন্ট ভাবত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন। কারাগারে, না বাইরে, অতটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা ধরে নিয়েছি, তিনি কারাগারে এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই ছিলেন। কারণ তার সঙ্গে একই বিমানে লন্ডন থেকে দিলি্লর রামলীলা হয়ে ঢাকা ফেরায় নয় মাস যাকে ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানের প্রেতাত্দা বলে গালাগাল করা হতো, একদিনে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তারপর তার ওপর দায়িত্ব পড়ে দেশের সংবিধান রচনার। আইনমন্ত্রী হিসেবে '৭৩-এ একবার দিলি্ল গিয়েছিলেন। আমিও ওই একই বিমানে ছিলাম। সামান্য কয়েক সিটের ব্যবধানে বসেছিলাম কিন্তু কোনো খোঁজখবর করেননি। ক্ষমতাবানদের তখন ওরকমই ব্যবহার ছিল। তার সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমার একটা বড় দোষ বড়কে সম্মান না করে থাকতে পারি না। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে অনেক দিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এই যে গওহর রিজভী এখন এত ক্ষমতাবান, তিনি তখন রাজনীতিতে শিশুর মতো ছিলেন। ড. কামাল হোসেন স্যার, গওহর রিজভী ছাত্র। '৮৯-এ লন্ডনে গওহর রিজভী আমাকে যে যত্ন করেছেন তা লিখে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে জার্মানিতে খোঁজখবর করেছিলেন, সে জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে স্পিকার করা হয়েছিল। আমাদের মতো অকৃতজ্ঞদের জন্য কোনো জায়গা হয়নি। ড. কামাল হোসেন দেশে ফিরে আওয়ামী লীগকে বিভক্তির হাত থেকে বাঁচাতে ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে শেখ হাসিনাকে এনেছিলেন, যখন জননেত্রী হাসিনা ১০টা মানুষের সামনেও গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন না। এখন গুছিয়ে না পারুন ১০ লাখ লোককে বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো ভেংচি দিতে পরোয়া করেন না। এর পর '৯৩ না, '৯৪-এ গণফোরামের জন্ম দেন। ভালো মানুষের বিপুল সাড়া পান। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার কনভেনশনে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভুখা নাঙ্গা দরিদ্র-অসহায় জনগোষ্ঠীর মা কবি বেগম সুফিয়া কামাল। 'আমার স্বপ্নের রাজনীতি' এমন একটি ধারণাপত্র পাঠ করেছিলেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। তখন তিনি অত নাম করেননি, নোবেলও পাননি। আমাদের কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের জন্ম '৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ড. কামাল হোসেন ছিলেন প্রধান ধাত্রী। আস্তে আস্তে কাছে আসা। এরপর তিনি সুষ্ঠু রাজনীতির জন্য ঐক্যমঞ্চের ডাক দেন। সেখানে হাজার হাজার কর্মী নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। সে প্রচেষ্টা প্রশিকার ড. কাজী ফারুকের জন্য ভেস্তে যায়। তারপর কত চেষ্টা, কখনো রাজনৈতিক, কখনো বুদ্ধিজীবী, কখনো আইনজীবী নানাদিক থেকে তার যখন যেটা সুবিধা সেটাই করেছেন। হঠাৎ একদিন র্যাডিসন হোটেলে দুই প্রবীণ নেতা সুস্থ রাজনীতির পয়গাম দিলেন। তারপর অন্যদের নিয়ে আবার কি প্রচেষ্টা চালালেন? বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আ. মান্নান অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের নিয়ে গেলেন বরিশালে। পাঁচ-সাত হাজার লোকের সামনে আমরা পাঁচজন হাত তুললাম। বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আমি। ছয়-সাত দিন পর ৫ অক্টোবর গেলাম নারায়ণগঞ্জে। আবার হাত তুললাম একইভাবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে বাবর রোডে ফিরেই শুনি ড. কামাল হোসেন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আসবেন ২৩ তারিখ। ২৩ তারিখে এলেন না, ২৪ তারিখেও এলেন না। তিনি এলেন এক মাস ১০ দিন পর পরের মাসের ১৫ তারিখ। তিন-চার দিন পর আবার বিদেশ গেলেন। দেশ জ্বলে-পুড়ে ছারখার তিনি নিরাপদে বিদেশে আছেন। তারপরও আমাদের নেতা, দেশের নেতা। উপায় কি? মানতেই হবে তারা যে নামকরা শিক্ষিত মানুষ। কত দেশের কত সমস্যা নিয়ে মধ্যস্থতা করেন, নিজের দেশের সমস্যায় কোনো ভূমিকা নেই। এ কী টাকার জন্য, নাকি অন্য কিছু? উম্মি মানুষ বুঝতে পারি না।
অন্যদিকে আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্মানী বাঙালি যার দ্যুতি সর্বত্র আকাশে-বাতাসে অন্তরীক্ষে। তিনি সম্পূর্ণ নীরব। তিনি আছেন তাকে নিয়ে। আমরা মরি কি বাঁচি, জ্বলে-পুড়ে ছারখার হই, সে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। তিনি জাতীয় নন, বাংলাদেশের নন, তিনি আন্তর্জাতিক, বিশ্ব নাগরিক, খ্যাতির শীর্ষে। এ যেন সর্বস্বহারা গ্রামের মেধাবী সন্তানের পিতা-মাতার মতো। গ্রামের কোনো দরিদ্র পিতা-মাতা তার সন্তানকে যখন উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে পাঠায়, রাতদিন পরিশ্রম করে সন্তানের ভরণপোষণ জোগায়। সেই মেধাবী সন্তান কোনো বিত্তশালীর আহ্লাদি মেয়ে জীবনসঙ্গী করে যখন আসমানে উড়ে, তখন গ্রামের গরিব মা-বাবার কথা তার আর মনে থাকে না। ঠিক তেমনি হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের। ভদ্রলোকের সঙ্গে ভদ্রলোকের লড়াই চলে, কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলে না। ওই সময় আমরা রে রে করে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশে না দাঁড়ালে ক'টা শাখা অক্ষত থাকত? অধ্যাপক ইউনূসের লোকজন কতজন দুনিয়ায় থাকতেন, পণ করে বলা যায় না। অথচ জাতীয় এই দুঃসময়ে তিনি মুখে কলুপ এঁটে বসে আছেন। আমরা কথায় কথায় বলি, রোম যখন পোড়ে নিরো তখন বাঁশি বাজায়। সবাই ভাবে সম্রাট নিরো তখনো রোমের সম্রাট। আসলে তেমন নয়। রোম যখন পুড়ছিল তখন সম্রাট নিরো ছিলেন না, নিরো নির্বাসিত। তাই অন্য সম্রাটের রোম যখন পুড়ছিল তখন শত্রুর রাজধানী পুড়ছে সেই আনন্দে নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষেত্রে তো তেমন হওয়ার কথা নয়। তিনিও তো একজন বাঙালি। আন্তর্জাতিক পরিচয় যাই থাকুক, আমার দেশেই তার শিকড়। টাঙ্গাইলের আকুর টাকুর পাড়া থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম। তবে কেন তিনি নির্বিকার? নাকি অন্য কোনো কলাকৌশল অথবা পরিকল্পনা আছে, যা আমরা সাধারণরা জানি না, বুঝি না।
লেখক : - বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, রাজনীতিক।
লেখক : - বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, রাজনীতিক।