Wednesday, 7 January 2015

মনের কোণে হীরে-মুক্তো 

তারুণ্যের নাম-পরিচয়, তারুণ্যের ঠিকানা 

সম্প্রতি প্রকাশিত কোনো এক বইয়ের উৎসর্গীকরণ পৃষ্ঠার একটি বাক্য আমার আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধিকে ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় ৫০ বছর আগের জায়গায় নিয়ে গেল। বাক্যাংশটি ছিল, (বইটি) উৎসর্গ (করা হলো) 'সেই সব জানা-অজানা সাহসী তরুণের উদ্দেশে, যারা মানুষের মুক্তির জন্য বুঝে কিংবা না বুঝে লড়াই করেছেন এবং জীবন দিয়েছেন অকাতরে।' এখানে 'না বুঝে' শব্দবন্ধটি আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে। এই শব্দবন্ধটি তারুণ্যের আবেগ-উচ্ছ্বাস, প্রেম-বিদ্রোহ, যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছাকে পূর্ণ অবয়বে ধারণ করে প্রকাশ-মুখর হয়েছে। স্মৃতি-প্রীতিতে (Nostalgia) আমি বারবার আচ্ছন্ন হচ্ছি।

পড়াশোনার সঙ্গে সারা গায়ে দুরন্তপনার ছাপ জড়িয়ে আমি মফস্বল শহরে বেড়ে উঠেছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা (বর্তমানে এসএসসি) পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি। জীবন কী, জগৎ কী, জীবন ও জগতের সম্পর্ক কী, এসব ভাবনা এ সময় পর্যন্ত আমার মনে আসেনি। আমি পড়া মুখস্থ করেছি, শরৎচন্দ্রের গল্পের বই গোগ্রাসে গিলেছি, সহপাঠী, সমবয়সীদের নিয়ে মাঠ-ঘাট-পাড়া মাড়িয়ে ফিরেছি, খবরের কাগজ আর রেডিওতে খেলার খবর জেনেছি। আমাদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রাচুর্য না থাকলেও বলা যায় মোটামুটি আনন্দময় পরিবেশে আমার স্কুলজীবন কেটেছে। স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ও কলেজের পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, এ পর্যন্তই ছিল আমার চিন্তার সীমানা। এবং এটি আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। আমাদের শহরে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মধ্যে দু-একবার মারামারি হয়েছে। এসব আমাদের কাছে মজার ঘটনা মনে হতো। নেহাত কৌতূহল ও আনন্দবশত আমরা হাসপাতালে আহতদের দেখতে গেছি, ভোটকেন্দ্রের আশপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি। এর গূঢ় অর্থ কিংবা সংশ্লেষ অন্তত আমার মনে কোনো রেখাপাত করেনি।

কলেজজীবনের প্রথম বর্ষে শুধু পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ে দেশে জোরেসোরে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় প্রায়ই ক্লাস বন্ধ থাকত। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার মিটিংয়ে হাজির হতাম। মিটিংয়ের বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগত। বক্তারা বড় মাপের ছাত্রনেতা। তাঁদের মতো হতে পারলে মন্দ হয় না- এ রকম একটা ধারণা মনে উঁকিঝুঁকি মারত। মাঝেমধ্যে আমরা মিছিলে কিছুটা 'না বুঝে' শামিল হতাম। অন্যদের দেখাদেখি স্লোগান দিতাম। এরই ভেতর দিয়ে বক্তৃতা দেওয়া, মিছিলে যাওয়া ও স্লোগান দেওয়ার কাজটি অল্পবিস্তর ভালো লাগতে শুরু করে। তখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক চিন্তা অর্থবহভাবে মনে আসেনি, কোনো সংগঠনের প্রতি একাত্মতা অনুভব করিনি। মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া ও স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-এমসিসির খেলা দেখতে যাওয়া দুটিই আনন্দ-ফুর্তির ব্যাপার হিসেবে মনে হয়েছে।

ছাত্ররাজনীতির প্রতি সাধারণ আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়াতে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আইএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি না হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক হল হচ্ছে একজন ছাত্রের মূল ঠিকানা বা 'রেফারেন্স পয়েন্ট' (Reference Point)। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলার আয়োজন- সব কিছু আবাসিক হলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। আনুষ্ঠানিক কোনো অনুশাসন না থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠন পছন্দ করার বিষয়টি হলের পরিবেশ ও পারিপাশ্বর্িকতার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতো। এসএম হলে চারটি দলের অস্তিত্ব লক্ষণীয় ছিল- ছাত্র ইউনিয়ন, এনএসএফ, ছাত্রলীগ ও ছাত্রশক্তি। ইসলামী ছাত্র সংঘের কয়েকজন সদস্য থাকলেও তারা কোনো উচ্চবাচ্য করত না। এই হলে সবচেয়ে বড় দল ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ও এনএসএফ। অন্য কয়েকটি হলে ছাত্রলীগের সদস্যসংখ্যা ও প্রভাব যথেষ্ট থাকলেও এসএম হলে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। এর সদস্যসংখ্যা যেমন কম ছিল, তেমনিভাবে সদস্যদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও ঔজ্জ্বল্য ছিল না বললেই চলে। এনএসএফকে সবাই সরকারের সমর্থক দালাল সংগঠন মনে করত। এটি তেমন একটা শক্তিশালী সংগঠন ছিল না।

যেহেতু প্রভাব-প্রতিপত্তি, খ্যাতি এবং ঔজ্জ্বল্যের প্রতি আমার সহজাত আকর্ষণ ছিল, তাই এসএম হলের বাসিন্দা হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান ছিল আমার জন্য একটি স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত। এখানে আলোকিত স্বার্থ (Enlightened self interest) মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তবে এনএসএফে যোগদান না করার পেছনে নৈতিক ও আদর্শিক বিবেচনা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তৎকালীন সামরিক সরকারের দালাল ছিল বলেই এ সংগঠনকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছি এবং এর থেকে দূরে থেকেছি; সুযোগ পেলেই বিরোধিতা করেছি। এসএম হলে ছাত্রলীগের সদস্যসংখ্যা ছিল নগণ্য। সদস্যদের মধ্যে এমন কোনো প্রভাবশালী অথবা চৌকস ছাত্র ছিল না, যাদের ব্যক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করতে পারে। মফস্বল শহরের কলেজ থেকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করা, ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে অক্ষম, বেশভূষায়, চলনে-বলনে অপরিপাটি ছাত্রলীগের সদস্যরা এসএম হলে কোণঠাসা হয়ে থাকত। সত্যি বলতে কী, এই হলের চৌকস ও কৃতী ছাত্রের মেলায় তারা অনেকটা নিষ্প্রভ অবস্থায় কিছুটা অবহেলিত ছিল। এ কারণে ছাত্রলীগে যোগদানের জন্য আমার কোনো আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি। হল ও অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্রদের সঙ্গে আমিও দল বেঁধে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিলাম। পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপ ও খ্যাতি-প্রতিপত্তির আকর্ষণই আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের দিকে টেনে নিয়েছিল। শুরুতে বাম-রাজনীতির নীতি-আদর্শ কিংবা দেশ, জাতি, সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে আমি ছাত্রসংগঠন বাছাই করিনি।

আমার মতো অনেকেই সচেতনভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করা ছাড়াই ছাত্রসংগঠন পছন্দ করে ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু করেছে। ব্যতিক্রমী দু-একজন ছাড়া বাকিরা কোনো মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট কিংবা আসক্ত হয়ে ছাত্রসংগঠনে যোগ দেয়নি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র ছাত্র, পরিচিতজনকে অনুসরণ করে মূলত তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর সংগঠনের নেতা-নেত্রী, বড় ভাই (সিনিয়র ছাত্র), সতীর্থ, সহকর্মীদের ভাবাদর্শ, ব্যক্তিত্ব, চলন-বলন, কর্মপদ্ধতি, পরামর্শ, উপদেশ, অনুশাসন তরুণ সদস্যের চিন্তা ও কর্মধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ধীরে ধীরে সংগঠনের স্বার্থের প্রতি তার আনুগত্য ও আসক্তি বাড়তে থাকে। নেতা-নেত্রীর অনুশাসন ও সিনিয়রদের বুদ্ধি-পরামর্শ মেনে চলা তার নবলব্ধ প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়। সংগঠনের স্বার্থে কঠিন কাজ সম্পাদন ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে সে গৌরব, মাহাত্ম্য খুঁজে পায়। তার উদ্দেশ্য সহকর্মী, সিনিয়র ও নেতা-নেত্রীর প্রশংসা কঠিনতর কর্মসম্পাদন ও অধিকতর ত্যাগের লক্ষ্যে তাকে অনুপ্রাণিত করে। কিছু স্লোগান, কিছু উচ্চারিত মন্ত্র, কিছু শব্দবন্ধ ও বাক্যাংশ তার চিন্তাচেতনা ও জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। যুক্তি-বুদ্ধির চাইতে আবেগ, আনুগত্য বড় হয়ে দাঁড়ায়।

তারুণ্যের নাম-পরিচয়, তারুণ্যের ঠিকানা

জাসদের ওপর লেখা বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, বামঘেঁষা ছাত্র ইউনিয়নে যোগদানের পর আমরা (তরুণ) বন্ধুবান্ধব যেভাবে ধীরে ধীরে বাম-রাজনীতির রীতি-পদ্ধতি, স্লোগান-সংস্কৃতিতে আবদ্ধ হয়েছিলাম, বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি হয়ে পড়েছিলাম অসহিষ্ণু, জাসদের তরুণ সদস্যরাও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল এক নিবিষ্ট সংগ্রামী সত্তায়। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ে পড়েছিল সহিংস ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। আমাদের সঙ্গে জাসদকর্মীদের একটি বড় পার্থক্য ছিল যে আমাদের ছাত্রাবস্থায় বাম-রাজনীতিতে শ্রেণিশত্রু খতম করার স্লোগান ওঠেনি। কমরেড চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল। তার ভিত্তিতে চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বহুধা বিভক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া চললেও সরাসরি শ্রেণিশত্রু খতম করার পক্ষে মূল কমিউনিস্ট পার্টির কোনো সিদ্ধান্ত ছাত্ররাজনীতিতে এসে পৌঁছায়নি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির দু-একটি অংশ যশোর, পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। জাসদের তরুণ সদস্যরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। এ ব্যাপারে চীন, রাশিয়া বা অন্য কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের অনুকরণ বা মতাদর্শ গ্রহণ করতে তারা সম্মত ছিল না। সম্পূর্ণভাবে নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের বুদ্ধি-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত বলে দলটি তাদের কর্মসূচি রচনা করেছিল। দলের তরুণ সদস্যরা পূর্ণ আনুগত্য দিয়ে, অনেকটা বিনা বাক্য ব্যয়ে এই সশস্ত্র কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে মাঠে নেমেছিল। সরকারের সশস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের সরাসরি মোকাবিলা করতে হয়েছিল। ফলে বহু তরুণ কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ উভয় দলই ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার (তখন 'বাজার অর্থনীতি' শব্দবন্ধ চালু হয়নি) সমর্থক। অনুসিদ্ধান্তক্রমে তাদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী তথা দালাল আখ্যায়িত করে আমরা রাস্তায় স্লোগান দিতাম। তারা আমাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিত 'চৌ-চৌ মাউ মাউ, চীনে যাও ব্যাঙ খাও।' এই বৈশিষ্ট্যের তরুণদের কিভাবে 'কাপালিক' নেতা সিরাজুল আলম খান ও তাঁর সহযোগী নেতারা সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে টেনে আনলেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ অবয়বের একাধিক গবেষণা হতে পারে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই, সিরাজুল আলম খানসহ, এখনো জীবিত আছেন, সক্রিয় আছেন। তাঁদের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করে, তাঁদের মন্তব্য সহযোগে গবেষণার ভিত রচনা করা যেতে পারে। আমি মনে করি, অবিলম্বে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করা সমীচীন হবে।

তারুণ্যের স্বাভাবিক প্রবণতা, তরুণ সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মোদ্যোগ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সংগঠনে যোগদানের প্রাক্কালে ওই সংগঠনের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচির প্রতি পূর্ব-আনুগত্য না থাকলেও যোগদানের পরবর্তীকালে নেতা-নেত্রীর 'কারিশমা' সিনিয়রদের সাহচর্য, সতীর্থ-সহকর্মীদের উৎসাহ ও কর্মসূচির চিত্তাকর্ষক আবেদন তরুণ সদস্যকে আস্তে আস্তে গ্রাস করতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়নে বলা হতো 'ইতিহাসের চাকা এগিয়ে নেওয়ার জন্য' প্রয়োজনবোধে আমাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে হবে। ফাঁকি দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে অথবা স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করলে আমরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হব। প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র রুখতে হবে, প্রগতির চাকাকে সচল রাখতে হবে। বুর্জোয়াদের বিনাশ করে শোষিতের শাসন কায়েম করতে হবে। এসব স্লোগান ও বাক্যাংশে আমরা, তরুণ বন্ধুবান্ধব সম্মোহিত হয়েছি। বড় রকমের আত্মত্যাগে প্রস্তুত হয়েছি। তবে আমাদের জন্য সম্মোহিত হওয়ার সময়কাল ছিল অতীব স্বল্প। ছাত্রজীবনের শেষ ভাগে এসে আমাদের মধ্যে মধ্যবিত্তের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চমকপ্রদ চাকরির লোভে দু-একজন সতীর্থ ছাড়া আমরা সব বন্ধু রাজনীতি থেকে সরে পড়ি। যে দু-একজন বন্ধু রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিল, তারাও পরবর্তীকালে চাকরি বা ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে।

অন্যান্য দলের যেসব তরুণ সদস্য তাদের নেতা-নেত্রীর নির্দেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল, তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বপ্নের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তাদের অনেকেই যেমন জানত না সমাজতন্ত্রের কার্যার্থক রূপ কী, আমরাও তেমনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি 'ইতিহাসের চাকা এগিয়ে গেলে' আমাদের বা আমাদের আশপাশের লোকের কী লাভ হবে। নিখাদ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আস্তাবলে নিক্ষেপ করলে দেশের আপামর জনসাধারণ কি সত্যি উপকৃত হবে- এ প্রশ্নের জবাব আজও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। এর প্রকৃত জবাব না জেনেও, এ ধরনের সংগ্রামের ক্রিয়াপদ্ধতি (Dynamics) পুরোপুরি না বুঝে আমরা তরুণ বন্ধুরা যেভাবে 'মিলিট্যান্ট' স্লোগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম, জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলাম, স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগানেও তেমনি হাজার হাজার তরুণ আকৃষ্ট হয়ে প্রকৃতপক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। এ ধরনের চমকপ্রদ চিত্তাকর্ষক স্লোগানে ভবিষ্যতেও যে প্রাণবন্ত তরুণরা আকৃষ্ট হবে না- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মনে রাখা প্রয়োজন : *Above all, youths have thirst for romance and violence.


লেখক : ড. সা'দত হুসাইন,
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান