১৯৯৬ সালে ইরান থেকে হারুন (যে মোহাম্মদ হাসান মোনতেকি নামেও পরিচিত ছিল) অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিল। এ ঘটনার পর ইরান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পালিয়ে আসার আগে সে ইরানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে আসায় তাকে ফেরত দেয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু সে অনুরোধ তখন রাখা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসার পর থেকে হারুন নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে বলা হচ্ছে। সে নিজেকে একজন ইসলামী ধর্মগুরু দাবি করে আধ্যাত্মিক চিকিৎসক বনে যায়। চিকিৎসা করার বিজ্ঞাপনে সে নিজেকে অ্যাসট্রোলজি, নিউমেরলজি, মেডিটেশন ও ব্ল্যাক ম্যাজিকের বিশেষজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছিল। চিকিৎসা করার নামে সে যৌন নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে পিস অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ করার সপক্ষে তার পেশ করা দরখাস্তে সে লিখেছে, মানবিক সাহায্য, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের প্রদান করব। সমাজে শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার প্রসার ঘটাব এবং মানুষকে শান্তির মধ্যে বসবাস করার জন্য উৎসাহিত করব। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত হতে দেখা যায় তাকে। তার প্রকাশ ঘটে আফগানিস্তানে অস্ট্রেলিয়ান সেনাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান দেখে। একদিকে সে নিহত সেনাদের নিয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অসম্মানজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় চিঠি লিখত, অন্যদিকে সিডনির এক আদালতের সামনে নিজেকে একবার শিকল দিয়ে বেঁধে হাতে ধরে রাখা ব্যানারে সৈন্যদের প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এ সময় সে সাংবাদিকদের বলেছিল, আমার কলম হচ্ছে আমার অস্ত্র এবং কথাগুলো হচ্ছে আমার বুলেট। আমি এ অস্ত্র দিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে শান্তির জন্য লড়াই করব। তার এসব কর্মকাণ্ডের পর ২০০৮ সালে তাকে আইএসও ওয়াচ লিস্টে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে সে তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্বেষপূর্ণ চিঠিপত্র লেখার অপরাধে তাকে গত বছর ৩০০ ঘণ্টা কমিউনিটি সার্ভিস করার জন্য দণ্ড দিয়েছিল আদালত।
১৫ ডিসেম্বর সকালে সিডনির মার্টিন প্লেসের লিন্ড্ৎ ক্যাফেতে ১৭ জনকে পণবন্দি করার পেছনে তার কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল, নাকি এটি তার মানসিক বিকৃতির প্রকাশ ছিল? নিরীহ মানুষের ওপর হামলা কি বর্তমান যুগে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাসী কাজকর্ম চলছে তার আওতাভুক্ত হবে? তার সঙ্গে কোনো ধর্মীয় চরমপন্থী গোষ্ঠীর সম্পর্কের কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত ওঠেনি। তবে হারুন তার যে তিনটি দাবি তুলেছিল, বলা হচ্ছে তার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অবশ্যই আছে। তার প্রথম দাবি ছিল তাকে ইসলামী স্টেটের একটি পতাকা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটিকে অস্ট্রেলিয়ার ওপর ইসলামী স্টেটের আক্রমণ হিসেবে সব সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। সর্বশেষ দাবি ছিল, টনি অ্যাবোটকে ঘটনাস্থলে আসতে হবে। অথচ তাকে সমর্থন করে কোনো ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীকে কোনো বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। পণবন্দি করার আগে হারুন শিয়া মতবাদের পরিবর্তে সুন্নি ইসলামী মতবাদ গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়। কট্টর সুন্নি ইসলামিক স্টেটের সমর্থন হয়তো সে আশা করেছিল এ পরিবর্তনের মাধ্যমে। ক্যাফের জানালায় যে পতাকা তুলে ধরতে সে বন্দিদের বাধ্য করেছিল, সেটা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর ছিল না, তাতে লেখা ছিল আরবিতে লেখা কলেমা। সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে অস্ট্রেলীয় একজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তার সঙ্গে কোনো পরিচিত গোপন সন্ত্রাসী দলের সংযোগ ছিল না। সে একজন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ছিল। এর অর্থ, একজন ব্যক্তি হিসেবে সে সংক্ষুব্ধ হয়ে এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে তার তাৎপর্য অবশ্য ক্ষতিকারক ও হুমকি হিসেবে বিবেচিত হবে। উল্লেখ করা দরকার, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী কোনো শিয়া বা সুন্নি মতবাদী গোষ্ঠী তাকে কখনোই সমর্থন করেনি।
ম্যান হারুন মনিসের অতীত সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাকে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি বলে মনে হয়। তবে তার ভেতর সহিংস কাজের ইচ্ছা যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেকে ইসলামী ক্লারিক বলে দাবি করা, আধ্যাত্মিক চিকিৎসার নামে যৌন হয়রানি করার চিরাচরিত দোষ, শান্তির সপক্ষে কাজ করার জন্য প্রচার, শিকল দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখে মিডিয়ায় প্রচার পাওয়া ইত্যাদি মানসিকভাবে সুস্থ কোনো মানুষের ছবি নয়। প্রথম স্ত্রীকে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল, যদিও তাকে জামিন দেয়া হয়েছিল। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও চটক ছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ছিল না সে কর্মকাণ্ড, যদিও নিজেকে সে শান্তির পক্ষের লোক বলে দাবি করেছিল। সবশেষে লিন্ড্ৎ ক্যাফের ঘটনাটি ছিল তার মানসিক অসুস্থতার চরম প্রকাশ। সন্দেহ নেই, সে তথাকথিত ইসলামী স্টেটের আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিল; কিন্তু পণবন্দি করে দাবি আদায় করার বাসনা চরম মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ বলেই মনে হয়।
পাশ্চাত্যের অনেক দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও এক বিরাট মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমানদের একটা বড় গন্তব্য হচ্ছে দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন থেকে আসা মুসলমানদের একটা অংশ নানা সময়ে এ দেশে সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ২০০৫ সালে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে এক বড় দাঙ্গায় এরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ আছে। অন্যদিকে ইসলামী স্টেটের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে এদের কেউ কেউ সিরিয়া গেছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের বড় অংশ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এবং সিডনির সন্ত্রাসী ঘটনার পর তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তা নিন্দা জানাতে ও পুলিশি ব্যবস্থাকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে।
কিন্তু হারুন মনিসের কর্মকাণ্ডে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি অস্ট্রেলীয়দের সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়বে কি-না, তা বোঝা কঠিন নয়। এবং সরকারের তরফ থেকে তাদের ব্যাপারে কঠিন নীতি গ্রহণ করা হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পররাষ্ট্রনীতিতে অস্ট্রেলিয়া বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখে। সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাথাব্যথা যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, তাই এসব কাজকে দেশটির সরকার কঠোরভাবে মোকাবেলা করবে বলেই ধরে নেয়া যায়। (অস্ট্রেলিয়া থেকে)
ড. আকমল হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
akmalhussainir@yahoo.com