কবি, সাংবাদিক ও গবেষক সাইফুর রহমান তারিক সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিএনপি সম্পর্কে বলেছেন, সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিনাশ ও সর্বনাশের জন্যই বিএনপির জন্ম। প্রথমেই গণতন্ত্রহত্যা, বিচারপতি সায়েমের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সামরিক শাসন জারি; পরে সায়েমকে সরিয়ে জিয়ার নিজেকেই নিজে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা। তারিক এরপরের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে এর আরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কর্নেল তাহেরের সঙ্গে জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা; বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পালন-পোষণ-নিরাপত্তা বিধান; রাষ্ট্রের মূলনীতির বিনাশ ও পঞ্চম সংশোধনী ইত্যাদির মাধ্যমে বিএনপি বিনাশের রাজনীতি করেছে।
সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিনাশ ও সর্বনাশের জন্যই বিএনপির জন্ম
সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিনাশ ও সর্বনাশের জন্যই বিএনপির জন্মসামগ্রিক পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিনাশ ও সর্বনাশের জন্যই বিএনপির জন্ম
রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিনাশ, দল ভাঙা-গড়া, রাজনীতিকদের চরিত্রহনন প্রভৃতি বিনাশমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে পরের ধাপে। সংস্কৃতি-হত্যা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে জগাখিচুড়ি এক রাষ্ট্রদর্শনের জন্ম দেওয়া, বাঙালি-বাঙালিত্বের বিপরীতে ইসলামি জজবার আমদানি এবং মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের নিয়ন্ত্রকের আসনে বসানো ইত্যাদি ছিল তাদের পরের ধাপের বিনাশমূলক কাজ।
এরপর এসেছে ছাত্ররাজনীতির বিনাশ, হিজবুল বাহার, অভি এবং একটি পিস্তল; অতঃপর ছাত্রদল। ধর্মকেই হুমকির মুখে ফেলা, জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো এবং ধর্মান্ধ জঙ্গিদের পালন-পোষণ, জামায়াতের সঙ্গে স্থায়ী গাঁটছাড়া বাঁধা– সবই বিনাশের পথে যাত্রা। রাজনৈতিক কলা-কৌশল ধ্বংস করা, আন্দোলন-সংগ্রামের বহু প্রচলিত ও কার্যকর উপায়গুলোর বিনাশ, অবরোধ, হরতাল প্রভৃতি।
তারিক মনে করেন, এভাবে চলতে থাকলে বাকি থাকে একটাই– আত্মবিনাশ! আমরা কি সে রকম কিছু দেখার অপেক্ষায় রয়েছি কিনা সে প্রশ্ন তার।
যুক্তিবিদ্যা মানলে তারিকের কথাই ‘সহি’ মানতে হয়। বিএনপির বর্তমান গতিধারা দলটিকে স্ববিনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে! আমাদের দেশে অবশ্য যুক্তিবিদ্যা ঠিকঠােক কাজ করে না। এখানে ‘কার্যকারণ’ দিয়ে সব কিছু বিবেচনা করা যায় না। এখানে মানুষ হুজুগে মাতে বেশি। তাই এত কিছুর পরও বিএনপিকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো লোকের অভাব নেই। বিএনপি যেভাবে একের পর এক ব্যর্থ এবং প্রহসনের হরতাল-অবরোধ দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, চুপচাপ ঘরে বসে বিভিন্ন ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার ‘উৎসব’ চালাচ্ছে, তাতে দল হিসেবে বিএনপির আত্মহননই ত্বরান্বিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কি?
সবার মনে প্রশ্ন, এভাবে আর কতদিন চলবে? এরপরও যদি সরকার পদত্যাগ না করে (সে সম্ভাবনা মোটেও দেখা যাচ্ছে না), তাহলে বিএনপি কী করবে? এত হত্যা, পেট্রোল বোমার পরও যে দোকানপাট খুলছে, গাড়িঘোড়া অফিস-আদালত চলছে, তারপরও বিএনপি কি এই কর্মসূচি চালিয়েই যাবে? এত হত্যা, পেট্রোল বোমার পরও বিএনপি কি এই কর্মসূচি চালিয়েই যাবে?
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মান্ধরা ক্রমেই নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাবে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব ও ধর্ম নিয়ে উগ্রতা বাড়ছে। বাড়ছে ধর্মান্ধতা; ধর্মমতে দেশ শাসনের আকাঙ্ক্ষা। ধর্মীয় মিথ অনুযায়ী যারা ধর্ম মানবে না তাদের গর্দান নিতে হবে। যারা অনুশাসন মানবে না তাদের কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। সব চলবে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী। ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য বোমা মারতে হবে। প্রয়োজনে ছুরি কিংবা চাপাতি দিয়ে অবিশ্বাসীদের মাথা থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন করতে হবে! আমরা যেন ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের’ যুগে প্রবেশ করছি!
আমাদের দেশের ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো আগাগোড়াই ছিল পাকিস্তানপন্থী। তারা স্বাধীন বাংলাদেশ মোটেও মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করে, আ্ওয়ামী লীগসহ এদেশের বামপন্থী প্রগতিশীলরা হচ্ছে, ‘হিন্দুয়ানী’, ইসলামবিরোধী। এদের ধ্বংস ছাড়া এদেশে প্রকৃত ধর্মমত প্রচার ও প্রকাশ করা কঠিন। তাই তারা সারাক্ষণ তাদের দৃষ্টিতে যারা শত্রু, সেই শত্রুকে বিনাশের চেষ্টা ও অপপ্রচারে যাবতীয় শক্তি ব্যয় করে থাকে।
বিএনপি ধর্মের লেবাসধারী অপশক্তির প্রধান আশ্রয়দাতা। আগে কিছুটা পরোক্ষ ইন্ধন দিয়ে গেলেও গত এক যুগে এই অপশক্তির সঙ্গে বিএনপির বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছে। ধর্মবাদী দলগুলোর প্রধান মুখপাত্র জামায়াত এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি। অনেকটা ‘তামাক আর ফিল্টার দুজনে দুজনার’ মতো। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত একই মায়ের পেটের দুই ভাই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাম্প্রতিকের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির যে রাজনৈতিক বিপর্যয়, তার প্রধান কারণ জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আর দেশ ও সম্পদ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড যা প্রায় দু’ বছর ধরে চলছে। আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড বিএনপিকে সমর্থন করার ন্যূনতম যুক্তির জায়গা থেকে অনেককে সরিয়ে দিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর অস্তিত্বের স্বার্থেই জামায়াত পুরোপুরি বিএনপি-নির্ভর হয়ে গেছে। জামায়াতের খপ্পরে পড়ে বিএনপি নিজের পাকা ধানে মই দিয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেকে তাদের ধারণা দিয়েছিল, নির্বাচনে অংশ নিলে ভালো করবে, এমনকি হয়তো সরকারও গঠন করতে পারে। কিন্তু জামায়াত নির্বাচনে যাওয়া থেকে বিএনপিকে বিরত রাখতে পেরেছে। বিএনপির ‘বুদ্ধুরা’ জামায়াতি ‘ফাঁদ’ ধরতে পারেনি। বিএনপির ‘আন্দোলন’ আর জামায়াতের ‘আন্দোলন’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বিএনপি চাইছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করা। আর জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো উপায়ে মহাজোট সরকারকে উৎখাত করে বিএনপির সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা।
বিএনপির প্রত্যক্ষ সহায়তার কারণে মৌলবাদী রাজনীতির আজ বাড়বাড়ন্ত। নানা কারণে বিএনপি এই রাজনীতির কাছে পুরোপুরি সমর্পিত। বর্তমানে যে ‘পেট্রোল-বোমার আন্দোলন’ চলছে, তাকে সমর্থন করা যায় কোন যুক্তিতে? এটা তো স্রেফ ক্ষমতার লোভ। সম্প্রতি মাহমুদুর রহমানের মান্নার যে টেলিসংলাপ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, পেট্রোল বোমা বিএনপি-জামায়াতের কাজ। ‘বান কি মুনের চিঠির পর এটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে’, বলেছেন মান্না! এটি কী প্রমাণ করে?
তাহলে কী দাঁড়াল? বিএনপি-জামায়াতকে কি ‘গণতান্ত্রিক শক্তি’ বলা যায়? মানুষ পুড়িয়ে মেরে শেখ হাসিনাকে ব্ল্যাকমেইল করে আলোচনার টেবিলে তাঁকে বসতে বাধ্য করতে চাওয়া হচ্ছে এই শক্তির লক্ষ্য্। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তারা যে ‘ব্লান্ডার’ বা রাজনৈতিক মূর্খতার পরিচয় দিয়েছে, তা এই নাশকতার মাধ্যমে পুষিয়ে নেবে, তার সুযোগ আদৌ আছে কি? আন্দোলন এবং জনসমর্থনই ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় বলে ভাবছে না তারা। নাশকতার মাধ্যমে দেশের স্বাভাবিক জীবন অস্থির ও অচল করতে পারলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং আমেরিকা এদেশে ছুটে আসবে এবং সরকারকে বাধ্য করবে তাদের সুবিধা দিতে, এই আকাঙ্ক্ষা থেকে লাগাতার আত্মঘাতী কর্মসূচি দিয়েছে তারা।
সন্দেহ নেই, দল দুটির এ রাজনীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমাদের ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের অসহায় গরিব মানুষদের আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ‘মানবতাবাদী’ পশ্চিমাদের বিচলিত করতে পারেনি। কিছু বিমূর্ত কূটনৈতিক বোলচাল দিয়েই তারা দায় সেরেছেন। উপরতলার নাগরিক সমাজের একটা অংশ পশ্চিমাদের ‘প্রভুত্ব’ আশীর্বাদ বলে মনে করেন। তাদের ‘মানসিক দাসত্ব’ স্বাধীন জাতির জন্য অপমানজনক। আরও অপমানজনক, যখন কিছু খ্যাতিমান মানুষও পশ্চিমা প্রভুদের দেশীয় বরকন্দাজের ভূমিকা পালন করেন!
এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার, যারা বলেন বর্তমান সংকট ‘দু’ দলের ক্ষমতার লড়াই’, তারা কি ঠিক কথা বলেন? দু’ দল বা দু’ নেত্রীকে এক করে দেখার মধ্য দিয়ে বিএনপিকে যাবতীয় অন্যায় থেকে কি দায়মুক্তি দেওয়া হয় না কি? সামরিক ছাউনির নিচে গড়ে ওঠা বিএনপি কখনও গণতন্ত্রচর্চার দল হয়ে ওঠেনি; হওয়ার সম্ভাবনাও তিরোহিত হচ্ছে। বিএনপির গায়ে যারা ‘গণতন্ত্রের লেবেল’ লাগিয়ে উদ্ধারকারীর ভূমিকায় মাঠে আছেন তারা আজ যে তত্ত্ব দিচ্ছেন সেটা একাত্তরে উচ্চারিত ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ তত্ত্বেরই নতুন সংস্করণ। তারা খুব কৌশলে বলছেন ‘হাসিনা-খালেদার গদির লড়াইয়ে’ জনগণ প্রাণ দিচ্ছে!
দু’ দল বা দু’ নেত্রীকে এক করে দেখার মধ্য দিয়ে বিএনপিকে যাবতীয় অন্যায় থেকে কি দায়মুক্তি দেওয়া হয় না কি
দু’ দল বা দু’ নেত্রীকে এক করে দেখার মধ্য দিয়ে বিএনপিকে যাবতীয় অন্যায় থেকে কি দায়মুক্তি দেওয়া হয় না কি
এ বাক্যে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট হয় না। চলমান রাজনৈতিক সংকট ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে সৃষ্ট যারা বলছেন, তারা প্রকৃত সত্য বলছেন না। প্রধান সমস্যা এখানে ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ সমস্যা। রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্ব এখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের দ্বন্দ্ব– যার মীমাংসা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয়েছিল। সেই মীমাংসিত বিষয় জামায়াত-বিএনপি জোট নতুন করে সামনে টেনে আনায় সমস্যা সংকটে পরিণত হয়েছে।
তাই সংকট থেকে উদ্ধার পেতে হলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে আগে মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে। মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা। একই সঙ্গে মানতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারপ্রক্রিয়া। বিএনপি যদি জামায়াতকে ত্যাগ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার মেনে নেয় এবং আন্দোলনের নামে মানুষ-হত্যার জন্য ক্ষমা চায়, তাহলে মানুষই উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে বিএনপিকে বসানোর জন্য স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতেও আগ্রহী হবে। পাকিস্তানতন্ত্রের মোহ ত্যাগ করে ‘সব ধর্মমতের মানুষের বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত’ বিএনপির আদর্শিক পরিবর্তনই পারে চলমান সংকট থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে।
বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা বিজয়ী রাজনৈতিক দল হতে চায়, নাকি জামায়াত ও সন্ত্রাসনির্ভর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে আত্মবিনাশের পথে যেতে চায়!
© চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।