সৃষ্টিজগতে মানবজাতি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি আছে, যা অন্য কোনো সৃষ্টির মাঝে নেই। ফলে জ্ঞান ও বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ অপর সৃষ্টিগুলোকে নিজের প্রয়োজনে ও স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখ-শান্তি তথা ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য। ইসলামে ঐক্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ঐক্য ও সম্প্রীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতীয় ঐক্যের ওপর ইসলাম প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু (কোরআন) দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।' -সূরা আন নিসা : ১০৩
এ আয়াতে জাতীয় ঐক্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সে সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এর পরও কিছু দুর্বৃত্ত ঐক্য, সহমর্মিতা ও মানবিকতার কথা ভুলে গিয়ে যাত্রীসমেত বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। আগুনে দগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ অপরিসীম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে। প্রতিদিনই বাড়ছে দগ্ধ মানুষের সংখ্যা, অনেকে হাসপাতাল থেকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে, খালি হচ্ছে অনেক মায়ের বুক, নারী হচ্ছে বিধবা, সন্তান হচ্ছে পিতৃহারা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, বিনাশ হচ্ছে সম্পদের, সর্বনাশ ঘটছে অর্থনীতির। আর এসবই ইসলাম-বিরুদ্ধ কাজ। ইসলাম এমন কাজকে তীব্রভাবে ঘৃণা করে।
প্রত্যেক মানুষই শান্তি চায়। তাই আমরা কি পারি না সহিংসতা পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে ঐক্য, সম্প্রীতি ও মানবপ্রেমের পথ মসৃণ করতে? বস্তুত পরামর্শ ও সমঝোতা করে কাজ করার মধ্যে বহু কল্যাণ নিহিত আছে। কেননা ইসলামের মর্মবাণী হলো_ শান্তি, সাম্য, সহনশীলতা ও মানবতাবোধ। কোরআন শরিফে মুসলমানদের গুণাবলি ও কার্যপদ্ধতির আলোচনা প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, 'এবং তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।' _সূরা আশ শূরা : ৩৮
বস্তুত পরামর্শ বা পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যে আল্লাহতায়ালা রহমত ও বরকত রেখেছেন। এই কারণেই রাসূল (সা.) তার ওপর পরামর্শ গ্রহণ করা অপরিহার্য না হওয়া সত্ত্বেও সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, 'রাসূলুল্লাহর (সা.) চেয়ে নিজ সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে অধিক পরামর্শকারী আমি আর কাউকে দেখিনি।'
ইসলাম সর্বধরনের হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বিভেদ, সহিংসতা ও বৈষম্য দূরীভূত করে দুনিয়ার সব মানুষকে ঐক্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের সম্প্রীতিতে আবদ্ধ করে। আমরা জানি, ঐক্য শব্দের অর্থ হলো একতা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়েও মানুষের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পারস্পরিক ঐক্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতি যে প্রশংসনীয় এবং মানবজাতির একান্ত কাম্য, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও দেশ-কাল নির্বিশেষে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করে। এ কারণে বিশ্বের সব দল ও গোত্রই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানায়। এজন্য ইসলাম শুধু মৈত্রী, একতা, শৃঙ্খলা ও দলবদ্ধ হওয়ার দিকনির্দেশনা প্রদান করেনি, বরং তা অর্জন করা এবং অটুট রাখার জন্য একটি ন্যায়ানুগ মূলনীতিও ঘোষণা করেছে। অতএব, উম্মতে মুহাম্মদী পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানূভূতিশীল হবে। পারস্পরিক হিংসা, বিদ্ধেষ, কুৎসা রটনা, শত্রুতামূলক আচরণ ইত্যাদি ঐক্য বিনষ্টকারী দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে কথা ও ব্যবহারে সম্প্রীতিমূলক আচরণ করতে হবে, তাহলে সমাজ বা রাষ্ট্রে সহিংসতার পরিবর্তে ঐক্য ও সম্প্রীতির অনূকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সে সঙ্গে ইসলামের শিক্ষা অনুসারে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অনুসারীরা দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করলে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
© মুহাম্মদ মাহবুবুল আলমশিক্ষক ও কলাম লেখক