Sunday, 4 January 2015

ফাতেহায়ে দোয়াজদাহম 
মিলাদুন্নবী-সিরাতুন্নবী (সা.)  

মসজিদে নববি ও মহানবী (সা.) এর রওজা শরিফ, ট্রাওসেট এনসাক্লোপেডিয়া (১৮৮৬-১৮৯১)

বিশ্বের বিস্ময়, নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। যাঁর গুণকীর্তনে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান এমনকি কমিউনিস্ট-নাস্তিকরা পর্যন্ত পঞ্চমুখ; কাফের মোশরেক-জানের দুশমনরাও যাঁকে আল আমিন বা মহা সত্যবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি; তাঁর সে শুভাগমনকে বিশ্ব বিবেক ক্ষণিকের তরেও ভুলতে পারে না। বছরের ৩৬৫ দিবসই যদি তাঁর পবিত্র মহামিলাদ বা জন্ম স্মরণ করা হয় তথাপিও রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস পাবে না। তাই তো সারা দুনিয়া প্রতি মুহূর্তে গেয়ে যাচ্ছে_ 'সাল্লু আলাইহি ওয়া সালি্লমু তাসলিমা।'

এ দিবসটি মুসলিম সমাজে ফাতেহায়ে দোয়াজদাহম নামে পরিচিত। 'ফাতেহায়ে দোয়াজদাহম' কথাটি ফারসি ভাষা থেকে আগত। দোয়াজদাহম মানে ১২, ফাতেহায়ে দোয়াজদাহম অর্থ হলো ১২ তারিখের ফাতেহা অনুষ্ঠান। কালক্রমে এ দিনটি মিলাদুন্নবী (সা.) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর অর্থ হলো নবী (সা.) এর জন্ম অনুষ্ঠান। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে 'ঈদ' শব্দ যোগ হয়ে 'ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)' রূপলাভ করে। যার অর্থ হলো মহানবী (সা.) এর জন্মোৎসব। এ পর্যায়ে আরেকটি পরিভাষাও প্রচলিত হতে থাকে 'সিরাতুন্নবী (সা.)' অর্থাৎ নবী (সা.) এর জীবনচরিত বা জীবনী আলোচনা অনুষ্ঠান। এ দিবসে অনেকে জশনে জুলুস বা শোভাযাত্রা ও আনন্দ র‌্যালি করে থাকেন।

এ মহামানবের জন্মতারিখ নিয়ে সিরাত গ্রন্থ, জীবনীকার, ইতিহাসবেত্তা ও জ্যোতির্বিদদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসের শুক্লপক্ষে সোমবার প্রত্যুষে বা ভোরে তথা ঊষালগ্নে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, সেদিন ছিল ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল। জ্যোতির্বিদদের হিসাব মতে, এ দিন ১, ২ বা ৮, ৯ অথবা ১০, ১১ রবিউল আউয়াল হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। আর তিনি ইহধাম থেকে চিরবিদায় নেন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ দ্বিতীয় সোমবার অপরাহ্নে বা গোধূলি লগ্নে। অনেকের মতে, নবীজি (সা.) শুক্রবার ১৭ রবিউল আউয়াল বসন্তের সুরভি ও অমিয় বারতা নিয়ে ধরাধামে শুভাগমন করেন এবং কৃষ্ণপক্ষের শেষ সোমবার ২৮ সফর পৃথিবীকে শূন্য করে চিরবিদায় নেন। তবুও তাঁর বেলাদাত ও ওফাত ১২ রবিউল আউয়াল প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তদুপরি প্রিয় নবী (সা.) এর আগমন ও প্রস্থান একই দিনে একই সময়ে এ কথাও সর্বজন বিদিত। তাহলে এ দিনে জন্মোৎসব পালন করা হবে নাকি প্রস্থানের শোক পালন করা হবে? কথায় আছে_ সৃষ্টির জন্য যাঁদের সৃষ্টি, তাঁরা চির অমর। প্রিয় নবী (সা.) আজ দুনিয়ার বুকে নেই, সেটিই ভাববার বিষয়। যাই হোক, উৎসব বা শোক পালন বড় কথা নয়; আসল কথা হলো তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা; কোরআন ও সুন্নাহ অাঁকড়ে ধরা; একমাত্র ইসলামকেই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির অনন্য পথ হিসেবে গ্রহণ করা। তবেই আমাদের এ আনন্দ ও বেদনা উভয়ই সার্থক হবে।

অতি পরিতাপের বিষয় যে, রবিউল আউয়াল মাস এলে আমরা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করি। বাণী আর বিবৃতি প্রচার করি; কিন্তু ফরজ নামাজও নিয়মিত আদায় করি না, সুদ পরিত্যাগ করতে পারি না, ঘুষ ছাড়তে পারি না, মিথ্যা বর্জন করতে পারি না, লোভ-হিংসা-মোহমুক্ত হতে পারি না। এমন হয় কেন? তবে কি নবীপ্রেমের তাৎপর্য আমাদের অন্তরে স্থান পেয়েছে?

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। নবী-রাসূল প্রেরণের লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তাই আল্লাহকে পেতে রাসূল (সা.) এর পথ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাসূল (সা.) যা যা করেছেন বা করতে বলেছেন, তা করতে হবে। আর যা করেননি বা করতে বারণ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা_ 'যা দিয়েছেন তোমাদের রাসূল (সা.) তা ধারণ কর; আর যা থেকে বারণ করেছেন, তা থেকে বিরত থাক।' আরও বলা হয়েছে_ 'বলুন হে রাসূল (সা.), যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে, তবে আমার অনুকরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।' হাদিস শরিফে আছে_ 'তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি হবো তার কাছে তার পিতাপুত্র ও যাবতীয় সবকিছু থেকে প্রিয়।' এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসূল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের পূর্বশর্ত। আর এ ভালোবাসা তাঁর নির্দেশ পালন ও অনুকরণের মাঝেই প্রকাশ পাবে। আমরা যখন উৎসব বা দুঃখ প্রকাশ করি তখন কি আমরা সে প্রকৃত ভালোবাসা ও আনুগত্যের কথা চিন্তা করি?

হ্যাঁ, মিষ্টি খাওয়াও সুন্নত বটে! তবে কথা হলো আমরা বর্তমানে শুধু মিষ্টিজাতীয় সুন্নতগুলো পালনে অতিমাত্রায় যত্নশীল হয়ে পড়েছি। যেমন_ দুপুরে খাওয়ার পরে শোয়া, হাদিয়া গ্রহণ করা, দাওয়াত কবুল করা ইত্যাদি। কিন্তু কতগুলো সুন্নতের কথা আমরা একেবারেই ভুলতে বসেছি। যেমন_ হাদিয়া দেয়া, দুস্থ ও আর্তের সেবা করা, গরিব-দুঃখীর দেখাশোনা করা ও মানব কল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরও বহু বিষয় রয়েছে, যা রাসূল (সা.) করেছেন ও করতে বলেছেন; সেগুলো আমাদের জন্য সুন্নত এমনকি অনেকগুলো ফরজও বটে। কিন্তু আমরা সে সম্পর্কে উদাসীন। যা কিছু করি তাও কি পরিপূর্ণ করতে পারি? না; বরং শুধু যে কোনো একটা দিক নিয়েই আত্মপ্রসাদ লাভ করি। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ নিজের কর্মপরিধি বাড়ানোর পরিবর্তে অন্যসবার সমালোচনা করে তৃপ্তি লাভ করি। যার দরুন নিজের অসম্পূর্ণতা ও অন্যের অসহযোগিতার ফলে আমরা বাতিলের কাছে পরাভূত হই বারবার।

মিলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো জন্মলগ্ন বা জন্ম সম্পর্কে আলোচনা। আমাদের পরিভাষায় মিলাদ বলতে বুঝি, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও জীবনী আলোচনা এবং তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে বর্ণিত হয়েছে_ 'নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (সা.) এর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারা তাঁর প্রতি রহমতের দোয়া করেন; হে বিশ্বাসীরা তোমরা তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ ও যথাযথরূপে সালাম পেশ করো।'

এ বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ, পুঁথি-পুস্তক, গল্প-উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ছড়া, ছন্দ, পদ্য, গান, লিখিত হয়েছে; লেখা হচ্ছে আরও বহু লিখিত হবে। এর তাৎপর্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আরও হবে। তবুও এটা নিশ্চিত যে, সব ব্যাখ্যার সার ব্যাখ্যা, সব কথার সার কথা যাতে সবাই একমত যে, মিলাদুন্নবী (সা.) এর মূল শিক্ষা হলো একমাত্র কালিমা তাইয়েবা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'। আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রেরিত।' এ কালেমার গূঢ়ার্থ হাজারোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ঈমানে মুজমাল_ 'বিশ্ব প্রভু আল্লাহর প্রতি আমি ঈমান আনলাম, তাঁর সব আদেশাবলি মেনে নিলাম।'

মোদ্দা কথা, মিলাদুন্নবী (সা.) এর আসল শিক্ষা হলো_ মহানবী (সা.) এর ২৩ বছরের ভালোবাসার, কঠোর সাধনার, দাঁতভাঙ্গা, রক্তঝরা, পরিপূর্ণ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বা জীবনবিধান ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সব আল্লাহদ্রোহী শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে শান্তির ধর্ম ইসলামকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এটাই নবী বা রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য; যা পবিত্র কোরআনে বাববার বিবৃত হয়েছে_ 'তিনি সে মহান প্রভু যিনি রাসূল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও সত্য ধর্ম সহযোগে, যাতে সে ধর্মকে প্রকাশ করতে পারেন সবধর্মের শিখরে, যদিও কাফের-মোশরেকরা তা অপছন্দ করে।'

[লেখক : মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম, ঢাকা]