Saturday, 31 January 2015

বাঁচতে হলে চিনতে হবে জামায়াতে ইসলামীকে

হাইস্কুলে পড়ার দিনগুলোর বার্ষিক পরীক্ষার আগে আগে মনে ক্লাসে সেকেন্ডে হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করত। মাঝে মাঝে বাজারের মসজিদের ঈমাম হুজুরের সঙ্গে নামাজ শেষে মনের আশঙ্কা-অস্থিরতা শেয়ার করতাম। হুজুর সব কথা শুনে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা কথাই বলতেন, ‘মিয়া সাব (সাহেব), ফল দেওনের (দেয়ার) মালিক আল্লাহ, আফনে (আপনি) মন দিয়া শুধু পড়েন।’ শীতের রাতগুলোতে খেলার মাঠে, ফাঁকা ধানী জমিতে ওয়াজ মাহ্ফিল হত। আখেরী মোনাজাতের রাতে বাড়ির বাইরে রাত কাটানোর সুযোগ মিলত। কিছুক্ষণ হুজুরদের ওয়াজ শুনে, বন্ধুরা মিলে ছোলা, বুট, মুরালি, জিলাপি খেয়ে কাছের কোনো মসজিদের কার্পেট, পাটিতে নাতিদীর্ঘ ঘুম দিয়ে, কখনো ফজর নামাজ পড়ে, কখনো ঘুমের জন্য নামায মিস করে (আল্লাহ্ ক্ষমা করুন) সকালে বাড়ি ফেরে আবার ঘুমিয়ে উঠতাম। কলেজ, ইউনিভার্সিটি পাশ দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মস্থান মক্কা, স্মৃতি বিজড়িত মানব প্রেমের শহর মদিনা সফর করেছিলাম। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার অফিসিয়াল মিডিয়া টিমের সদস্য হয়ে সৌদি আরব (জাজিরাতুল আরব) সফর করেছিলাম ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তায়ালার ঘর, কাবা শরিফ তাওয়াফ করার সময় একটি স্মৃতি অমলিন থাকবে আজীবন। প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা, জাতির জনকের নাতি সজীব ওয়াজেদ জয় এবং অন্যান্যরা আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে ঘুরছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরা পারসন তাওয়াফ করার পাশাপাশি উল্টো হেঁটে পেশাগত দায়িত্ব পালনে হজ্ব ভিডিও ধারণ করছিলেন। আমরা কেউই সেদিন ধর্মপরায়ণ আরেক ভাইয়ের উল্টো হেঁটে তাওয়াফ করার তক্লিফ অনুভব করিনি। করেছিলেন শেখ হাসিনা। ক্যামেরাপারসনকে স্পষ্ট ভাষায় বললেন- ক্যামেরা রেখে মহান আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হতে। আল্লাহ্র বান্দাকে যিনি ভালোবাসেন, তিনিই তো প্রকৃত আল্লাহ্-প্রেমিক।

গ্রামের মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা, ইমাম হুজুর, ঠনঠনে শীতের রাতে বহুদূর হেঁটে ফজরের নামাজ আদায় করতে আসা মুরুব্বীদের দেখে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)’র জীবনী পড়ে, খলিফাদের শাসনামলের ইতিহাস জেনে তাবলীগ জামাতের মেহমানদের আচরণ দেখে, বয়ান শুনে, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা সুফী-সাধকদের মানবতাবাদী কর্মকান্ড জেনে জেনে জন্মসূত্রে মুসলিম হওয়ায় মনে মনে মানুষকে, জন্মভূমিকে ভালোবেসে স্বদেশ প্রেমকে ঈমানের অঙ্গ জেনে, মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ শোধ করে সবধরনের বৈষম্য বিলুপ্ত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ব্রতী হয়েছি। একই ব্রত নিয়ে, ধর্ম, সংস্কার, শ্রম, উৎপাদন, মেধা, মনন, সাধনা দিয়ে জন্মভূমিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, আমলা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ীসহ সমস্ত শ্রেণী-পেশার মানুষ।

একাত্তরে ৩০ লাখ দেশপ্রেমিক মানুষের নির্মম হত্যা, দু’লাখ মা-বোনের হারানো সম্ভ্রম, ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের প্রায় সকলের হত্যাকান্ড, ৩ নভেম্বরের জাতীয় চার নেতা হত্যার শোক, পরবর্তীতে স্বাধীনতার বিরোধী ও সামরিক শাসকদের আঁতাত ও নানামুখী ষড়যন্ত্রের ধকল কাটিয়ে উঠে দেশ যখন উন্নয়নের সঠিক পথে এগিয়ে চলেছে, তখনই আবার জন্মভূমি মোকাবেলা করছে স্মরণকালের ভয়াবহতম সঙ্কট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ঐতিহাসিক কলঙ্ক দূর করে বাংলাদেশ যখন প্রকৃত সমৃদ্ধির দিকে যাত্রা শুরু করেছিল, তখনই সৃষ্টি করা হয়েছে সঙ্কট। পেট্রোল বোমা মেরে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে, বন্দর-বাজার অচল করে, দেশের উৎপাদন কাঠামোকে ধ্বংস করে অর্থনীতিকে স্থবির করে রেললাইন, রেলগাড়িসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ধ্বংস করে, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে জন্মভূমির কোমড় ভেঙ্গে দেয়ার অপপ্রয়াসে সুতীব্রতায় সক্রিয় অন্ধকারের শক্তি। এই ধ্বংসযজ্ঞে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ৭১’র পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিকভাবে সর্বতোভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী হল (বিএনপি)। বুদ্ধিবৃত্তিক ও কৌশলগত সহায়তা করছে প্রগতিশীল নামে কথিত, একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক। নেপথ্যে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করছে সা¤্রাজ্যবাদী, পুঁজিতন্ত্রের ধারক ও বাহক পশ্চিমা শক্তি। এই সম্মিলিত অশুভ শক্তির মূল অস্ত্র হয়ে উঠেছে, ‘ধর্ম’ মূলত, শান্তির ধর্ম ইসলাম। পীর-আউলিয়া, ওলামা মাশায়েখদের দেশ বাংলাদেশের শান্তি প্রিয় মানুষের বিশেষ করে তরুণ-সমাজের সামনে তাই জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত চেহারা উম্মোচন করে ভয়াল জাতীয় শত্রুকে চিহ্নিত করাই এখন আমাদের জিহাদ।

বিগত ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শাসন ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছরের মেয়াদে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয় তৎকালীন সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ বছরে উত্তীর্ণ হয় ৪৩০০ মেগাওয়াটে এরপরেও ২০০১ এর নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি আওয়ামী লীগকে। একদিকে বিএনপি-জামাত জোট অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বধীন এই পশ্চিমা বেনিয়া শক্তি। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির সর্বোচ্চ চাপেও দেশের মানুষের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে গ্যাস রপ্তানিতে রাজি না হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় আমেরিকা। আর ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে কুকুরের মাথায় ‘টুপি’ পড়িয়ে ছবি তুলে সারাদেশে ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে তুলে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় দালাল গোষ্ঠী সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী তৎপরতায় সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে। সহজ সরল জনগণকে বোকা বানিয়ে তাদের ভোটাধিকারকে চুরি করে ক্ষমতায় আনা হয় বিএনপি-জামায়াত জোটকে। তার পরবর্তী ঘটনাবলী কোনো সচেতন নাগরিকের ভুলে যাওয়ার বলা নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষগুলোকে হত্যা করতে থাকে স্বাধীনধা বিরোধী শক্তি। দলীয় পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ২১ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীরা। অর্থনীতিবিদ এস এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ বহু মেধাবী সন্তানকে হারায় বাংলাদেশ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে কয়েকটি উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান, মুফতি হান্নানের মত ভয়ঙ্কর সব জঙ্গী দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর তান্ডব চালায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা বাংলাদেশ কখনো ভুলবে না। শেখ হাসিনা আল্লাহর রহমতে প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হয় ২৪ জন নেতা-কর্মী। হত্যাকান্ড, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগের সহ অপরাধের তালিকা এত দীর্ঘ যে বড় বড় বই আকারে প্রকাশ করলেই হয়তো ঐ অন্ধকার যুগের কালো ইতিহাস লেখা সম্ভব হবে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসন শেষে বাংলাদেশ ২ বছর শাসিত হয় সামরিক বাহিনী সমর্থিত অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া জনমতের চাপে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বেধীন মহাজোট নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০০১-২০০৮Ñ ৭ বছরের অনুন্নয়ন, পশ্চাদপদতা, বিশৃঙ্খলা, গণতন্ত্রহীনতা, সহিংসতা, ভয়, আতঙ্ককে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ যখন সমৃদ্ধি অর্জনের পথে পা বাড়িয়েছে, তখনই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ঘটায়। এবার তারা বেছে নেয় জন্মভূমির অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ রাইফেলস্ (বিডিআর)এর সদরদপ্তর পিলখানাকে। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখালাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে অশুভ ঐ শক্তি। পথ হারানো বিডিআর জওয়ানরা তাদেরই কর্মকর্তা ও সহকর্মীসহ মোট ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নজিরবিহীন সাহস প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন জাতিকে চরম সঙ্কট থেকে রক্ষা করেছিলেন। গত প্রায় পাঁচ বছরে বিএনপি-জামায়াত জোট সংসদে গিয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের সদস্যপদ রক্ষা করার জন্য। গণস্বার্থ-বিরোধী সংবাদ মাধ্যমগুলোও আওয়ামী লীগকে বস্তুনিষ্ঠতার সাথে মূল্যায়ন করেনি। সুশীল সমাজের সদস্য হিসেবে পরিচিত শিক্ষিত দালাল গোষ্ঠী সরকারের নেতিবাচকতায় এত বেশি মুখর ছিল যে, জামায়াত-শিবির ও বিএনপি তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথে নিঃসঙ্গ বোধ করেনি। শত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেও অশুভ শক্তি বাংলাদেশের সুষম ও টেকসই অর্থনীতিক উন্নয়নকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার হার, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, ব্যাংক রিজার্ভ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুশাসন, নারীর ক্ষমতায়ন, শান্তিপূর্ণ ধর্মচর্চাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মিত হয়েছে দেশজুড়ে। মেট্রোপলিটন সিটিগুলোতে শত শত সরকারি বাস নেমেছে, রেললাইন বেড়েছে, লোকোমোটিভ সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়, মানুষের আয় বেড়েছে, বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় চোখে সর্ষে ফুল দেখছে, তখন বাংলাদেশের মানুষ খেয়ে পড়ে হেসে পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তির জীবন যাপন করেছে; ঢাকা শহরের বিশাল অংশ অত্যাধুনিক অবকাঠামোর নগরীতে রূপ নিয়েছে। মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয়ের সামরিক ও আইনী লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছে মূল ভূখন্ডের সমান জলভাগ অধিকার করেছে বাংলাদেশ। টানা পাঁচ বছর জানুয়ারির প্রথম দিনে কোটি কোটি পাঠ্যবই সরবরাহ করে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন দশ হাজার মেগাওয়াট। সাফল্যের কথা এত কম লেখায় বলে শেষ করা সম্ভব না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে উচ্চ আদালত অগণতান্ত্রিক বলে বাতিল সাব্যস্ত করলে সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। সরকারি সহযোগিতায় নির্বাচন কমিশন প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন করলো এবং প্রায় সবকটিতেই জিতলো বিরোধী জোট! এত কিছুর পরও জামায়াত, বিএনপি, ছদ্মবেশী সুশীল সমাজ, শীর্ষস্থানীয় ২/১টি সংবাদপত্র যেমন দৈনিক প্রথম আলো, সা¤্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহচর সুদখোর ড. মুহাম্মদ ইউনুস সবাই এক দাবিতে যার যার স্টাইলে কাজ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। সর্বশেষ যখন উচ্চ আদালত জামায়াতে ইসলামীকে অবৈধ ঘোষণা করল এবং নির্বাচন কমিশন এদেরকে অযোগ্য ঘোষণা করল তখনই উপরোক্ত শক্তিগুলোর সম্মিলন প্রকটভাবে প্রকাশ পেল। সবাই বুদ্ধি দেয়, আর সেটা বাস্তবায়ন করে জামায়াত। একটাই টার্গেট আওয়ামী লীগকে ব্যর্থ প্রমাণ কর; তাহলে বাংলাদেশও ব্যর্থ হবে। তাহলে এই জামায়াতে ইসলামীকে চেনার প্রয়োজন আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি। কারণ প্রিয় ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করে এরা রাজনীতির নামে সন্ত্রাস করে; আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে মডারেট ইসলামিক পার্টি বলে, আদর-সোহাগ করে; বাংলাদেশের পুলিশকে পিটিয়ে মেরে জিহাদ ভেবে উল্লাস করে, কিন্তু ভুলে মার্কিন দূতাবাসের গাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে ওয়েবসাইটে দুঃখ প্রকাশ করে; বিএনপি-জামায়াতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি, প্রথম আলো পত্রিকাটির অবস্থান ও তার পক্ষে ড. ইউনুস ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার তাহলে পরিষ্কার হল জামায়াত হল এই গণবিরোধী শক্তির সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ইসলাম ধর্মের ছদ্মবেশে জামায়াত-শিবিরের প্রকৃত পরিচয়ের সন্ধানে আমাদেরকে নামতে হবে ইতিহাসের মোটামুটি গভীরে। আমি এক্ষেত্রে সহয়তা নিয়েছি বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম শহীদুল হক সাহেবের সুযোগ্য পুত্র, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’র বিশেষ সংবাদদাতা শাহরিয়ার শহীদ রচিত ‘ইসলামে বিভ্রান্তি ও বৃটিশ গোয়েন্দার স্বীকারোক্তি’ শীর্ষক গ্রন্থের। বিলম্ব না করে এই সুফী সাংবাদিকের গ্রন্থ (দ্বিতীয় অধ্যায়ে) থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘হ্যামফায়ার একজন বৃটিশ গোয়েন্দা। ইসলামকে ধ্বংসের জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে বৃটিশ সরকারের নীল নকশা বাস্তবায়নের অন্যতম রূপকার হ্যামফায়ার। তিনি ১৭১০ সাল থেকে মিসর, ইরাক, ইরান, হিজায ও ইস্তামবুলে মিশনারির ছদ্মবেশে গোয়েন্দাগিরির মিশনে নিয়োজিত ছিলেন। হ্যামফায়ার ১৭১৩ সালে বসরার নজদে মুহাম্মদ বিন আবদ উল ওয়াহাব নজদি নামে একজন মুসলমান বিপথগামীকে হাত করে তাকে দিয়ে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে একটি নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন, সমসাময়িক ইতিহাসে তথাকথিত ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

ওয়াহাবি আন্দোলন সংগঠনে হ্যামফায়ার একজন মুসলমানের ছদ্মবেশ ধারণ করে তৎকালীন অটোমান সা¤্রাজ্যের অন্তর্গত বিভিন্ন মুসলিম দেশের মনীষীদের সংস্পর্শে আসেন এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তার স্বোপার্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অনিষ্ট সাধনের অপপ্রায়াস চালান। তার মিশনের কার্যকালে তিনি যেসব ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন বা যা প্রত্যক্ষ করেন তার আনুপূর্বিক বিবরণ লিখে রাখেন ডায়রিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম জার্মানির সংবাদপত্র ইসপিগল এতার ডায়রি-ও বিস্তারিত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। হ্যামফায়ার -এর ডায়রি ঈড়হভবংংরড়হং ড়ভ ধ ইৎরঃরংয ংঢ়ু-এর ইংরেজি সংস্করণটি ঐওতগঊঞ ইঙঙকঝ-এর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত। ঐওতগঊঞ ইঙঙকঝ-এর ওয়েবসাইট এর ঠিকানা :যঃঃ://িি.িযরুসবঃনড়ড়শং.ড়ৎম,

১১২৫ হিজরি মোতাবেক ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে হ্যামফায়ার ওয়াহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৫০ হিজরিতে তারা মতবাদ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। হ্যামফায়ার তার ডায়ারিতে বলছেন: ‘মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য উপনিবেশসমূহের তথ্য সংগ্রহের জন্য আমাকে গোয়েন্দা হিসেবে হিজরি ১১২২ মোতাবেক ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে মিসর, ইরাক, হিজায ও ইস্তাম্বুলে প্রেরণ করেন। মন্ত্রণালয় একই মিশনে কাজ করার জন্য একই সময়ে আরো ৯ জন লোককে নিয়োগ করে। ... আমি ইসলামী খেলাফতের কেন্দ্রবিন্দু ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম... একটি অত্যন্ত ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর আমি ইস্তাম্বুলে পৌছালাম। আমি আমার নাম মুহাম্মদ বললাম এবং মসজিদে যাতায়াত শুরু করলাম।’

তিন বছরের দীর্ঘ সময়ে তুরস্ক, ইরাক, মিশর, হিজায ভ্রমণ করে, অবস্থান করে অবশেষে ১৭১৩ সালে সবরার নজদে মুহাম্মদ বিন আবদ উল ওয়াহাব নজদি নামের ভন্ড মুসলমানকে দিয়ে ওয়াহাবী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় হ্যাম্পফায়ার। ব্রিটিশ সরকার নজদে মোহাম্মদের বিষয়ে নি¤েœাক্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করে :
১. সে সকল মুসলমানকে অবিশ্বাসী হিসেবে ঘোষণা করে বলবে যে, তাদের হত্যা করা হালাল, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত; সংশোধনের জন্য শাস্তি, তাদের লোকজনকে দাস ও মহিলাদের উপপতœীতে পরিণত এবং বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা যাবে।
২. সে কাবাকে দেবমূর্তি হিসেবে বর্ণনা করবে এবং তারপর এটা ধ্বংস করা হবে। হজ্বের মতো ধর্মীয় আচারকে বাতিল করার জন্য সে উপজাতিদের দ্বারা হাজীদের দলকে ঘেরাও করে তাদের হত্যা করতে বলবে।
৩. সে খলিফাকে অমান্যের জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দেবে। সে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য উস্কানি দেবে। সে লক্ষ্য সাধনে সে সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি নেবে। সে হেজাযের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের যুদ্ধ করার সুযোগ সকল সুযোগ কাজে লাগাবে।
৪. সে অভিযোগ উত্থাপন করবে যে, মুসলমান দেশসমূহে সমাধি ক্ষেত্র, গম্বুজ এবং পবিত্র স্থানসমূহ হচ্ছে দেবমূর্তি এবং বহু দেব দেবীর প্রতীক এবং এগুলো ধ্বংস করতে হবে। সে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ), তাঁর খলিফাবৃন্দ ও মাজহাবের প্রখ্যাত মনীষীদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করবে।
৫. মুসলিম দেশসমূহে সে বিদ্রোহ, নিপীড়ন ও স্বেচ্ছাচারিতার উস্কানি দেবে।
৬. সে একটি মেকী রচনা সম্বলিত কোরআন এর কপি তৈরি করবে এবং হাদিসের ক্ষেত্রে ও তাই করবে।
এভাবে প্রকৃত ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমা বৃটিশ শক্তি গোয়েন্দা হ্যামফায়ারকে কাজে লাগিয়ে ওয়াহাবি মতবাদ সৃষ্টি করেছিল। ওয়াহাবি মতবাদ মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি, বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও কালের বিচারে ইসলামকে বৃহৎ ভাবে বিকৃত করতে সক্ষম হয়নি। আল্লাহতায়ালা সূরা ইউসুফের ১১ ও ৬৩তম এবং হিজর সূরার ৯ম আয়াতে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি স্বয়ং মানব জাতির উপর এই কোরআন নাজিল করেছি এবং প্রকৃতই আমি এর রক্ষাকারী।’

ইংরেজরা যেখানে যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, সেখানেই হ্যামফায়ারদের মত লোকদের নিয়োগ দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত মানব প্রেম ও স্বচ্ছতার ইসলামকে ধ্বংস করতে ইসলামের নামে বিপথগামী মুসলমান পন্ডিত ব্যক্তিদেরকে দিয়ে নতুন নতুন মতবাদ সৃষ্টি করেছে। তেমনিই আরেকটি মতবাদ হল মওদুদীবাদ।

ব্রিটিশরা নজদে মোহাম্মদের ওয়াহাবি মতবাদ দিয়ে ইসলাম ধর্মে বিকৃতি এনে ইরাক, মিশর, তুরস্ক, তথা মধ্যপ্রাচ্যে অর্থাৎ ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তার পরবর্তী ফলাফল আমরা সবাই বিভিন্ন সময়ে নানা মাত্রায় দেখেছি, দেখছি। আর উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানদের একতাবদ্ধতায় ভীত হয়ে বৃটিশরা বিভ্রান্তি আর কলহ সৃষ্টির জন্য তৈরি করে আবুল আলা মওদুদীকে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় অগ্রগামী, কুটবুদ্ধি সম্পন্ন মওদুদী ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি। মওদুদীর জীবনের কিছু কথা ইসলাম ও দেশপ্রেমিক জনতাকে জানাতে চাই। পাঠক নিজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন, জামায়াত কীভাবে ইসলামের নামে ইসলামকে ধ্বংস করে। আর উদ্দেশ্য পূরণে সহযোগিতা করে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে। ১৯০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন হায়দারাবাদ অঞ্চলের আত্তরঙ্গবাদে জন্ম হয় আবুল আলা মওদুদীর। ফোরকানিয়া মাদ্রাসা থেকে মওদুদী মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন হায়দারাবাদ শহরের দারুল উলুম মাদ্রাসায়। ধর্ম, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ বিদ্যাসহ নানা ক্ষেত্রে জ্ঞানের অধিকারী মওদুদী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। তিনি মদিনা বাজনোর, তাজ যাবালপুর এবং জমিয়াত উলামা হিন্দের আল-জমিয়াত, ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেন। ঐ সময়কার একটি ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ। শহীদে কারবালা হযতে হোসাইন (রাঃ) এর বংশধর, শায়খুল ইসলাম মাওলানা সৈয়দ আহমদ মাদানী (১৮৭৮-১৯৫৭) জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দে যোগ দিয়ে অখন্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছিলেন। ১৯২৯ সালে কলকাতার সম্মেলনে জমিয়তে ওলামা পরিষ্কার ঘোষণা করে, দেশকে পূর্ণ স্বাধীন ঘোষণা করার পূর্ব পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। জাতীয় কংগ্রেসকে দেশাত্মবোধের এ পর্যায়ে পৌঁছতে আরও ছয় বছর বিলম্ব করতে হয়েছে। (ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন, ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৪)। মাওলানা মাদানী ‘রিসালা-এ মুত্তাহাদা কাওমিয়্যাহ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। বইতে তিনি অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা চেয়ে চলমান আন্দোলনের পেছনে ইসলামী দর্শন ব্যাখ্যা করে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর আলোচনার সারমর্ম হলো :
‘মহানবী (সাঃ) মদীনায় পৌছে যে সম্মিলিত জাতি গঠন করেছিলেন আমরা সম্মিলিত জাতি বলে সে কাঠামোকেই বুঝাতে চেষ্টা করেছি। আমাদের ইচ্ছা হলো, ভারতবর্ষের অধিবাসীগণ যে যেই ধর্মের অনুসারী হোক না কেন সকলেই ভারতীয় নাগরিক হিসাবে এবং একই স্থানে বসবাসকারী হিসেবে এক ও অভিন্ন হয়ে নিজেদের সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করে বিদেশী উপনিবেশকারীদেরকে এদেশ থেকে উৎখাত করে নিজেরা যেন নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত করবে। কাজেই কোনো সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়ে কোনোরুপ আঘাত করতে পারবেনা। বরং ভারতবর্ষে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায় নিজ নিজ আক্বিদা ও বিশ্বাস, ধর্মীয় উপাসনা ও কাজ কর্মের ক্ষেত্রে স্বধীন থাকবে। প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে নিজ ধর্মীয় কাজ কর্ম উৎসব অনুষ্ঠান চালিয়ে যাবে এবং যথাসম্ভব দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিবে। সকলেই ধর্মীয় সম্প্রচার অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের পার্সোনাল সংস্কৃতি ও সভ্যতার যথা সংরক্ষণ করে যাবে, যেন কোনো সংখ্যালঘুকে অন্য সংখ্যালঘুর হাতে কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে নিগৃহীত হতে না হয়। কংগ্রেসে সব সময় এ নীতিই গ্রহণ করে আসছে।” প্রথম দিকে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ ও পরবর্তীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’র কর্ম তৎপরতায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রগতিশীল মানুষ যখন সবার জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্নে ক্রমশ অনুপ্রেরণা অর্জন করছে তখন ব্রিটিশ শাসকদের অপকৌশলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষও বড় হতে থাকে। ফলশ্রতিতে আমরা ১৯৪৭-এ দেখি ধর্মের নামে উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান এ দু’রাষেট্রর ভাগ করা হয়। সামপ্রদায়িকতার দানবকে বড় করে তোলার কাজে ব্রিটিশ শাসকদের হয়ে যে সমস্ত জ্ঞানপাপী কাজ করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন, আবুল আলা মওদুদী। অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের সাথে মিলে এলায়েনস গড়ে তুললে এর প্রতিবাদে মওদুদী ১৯২৫ সালে আল-জমিয়াত প্রত্রিকার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। হিন্দু ও মসুলমানের জন্য এক দেশ হতে পারেনা বলে মওদুদী মানুষকে বোঝাতেন। ইংরেজদের আশীর্বাদপুষ্ট মওদুদী সচেতনভাবে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতেন যা ছিল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’র সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ঐ সনদে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শান্তিপূর্ণ ও সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার জাতি গঠনে ৪৭টি শর্ত দিয়েছিলেন।
প্রধান দুটি শর্ত হল :
১. সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইহুদি, খৃষ্টান এবং পৌত্তলিক সম্প্রদায় সমূহ সমান অধিকার ভেগে করবে এবং একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে।
২. মুসলমান এবং অমসুলমান বিভিন্ন সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মীয় ব্যপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

এতটাই আধুনিক, প্রগতিশীল, উদার ও মহানুভবতার ধর্ম ইসলাম। কিন্তু সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সৃষ্ট জামায়াত ইসলামের মত ছদ্মবেশী, অশুভ শক্তির তৎপরতায় ইসলামকে কলংকিত করা হচ্ছে। মওদুদী এবং জামায়াত ইসলামকে নিয়ে পন্ডিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে মসুলমানদেরকে সতর্ক করে গেছেন। জামাতে ইসলাম’র ব্যানারে মওদুদী’র ইসলামবিরোধী তৎপরতা ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে যোগসাজশ শুরু থেকে ইসলামী চিন্তাবিদ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫১ সালের আগস্ট ১ তারিখে ভারতবর্ষের ওলামা-মাশায়েখরা দিল্লিতে এক সম্মেলনে মিলিত হন। দীর্ঘ আলোচনার পর তারা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মওদুদী, জামায়াত ইসলামী ও প্রকৃত ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। প্রায় একই সময়ে পাকিস্তানে ইসলামী চিন্তাবিদরা সম্মিলিত ভাবে বলেন, মওদুদী নিজে একজন বিভ্রান্ত মনুষ এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করতে চায়। দেওবন্দী ইসলামী চিন্তাবিদরা সব সময়ই মওদুদী বিষয়ে আওয়ামকে সর্তক করেছেন। প্রখ্যাত আল্লামাহ্ ইউসুফ লুধিয়ান্বি এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। তিনি তার বহু লেখা ও বক্তৃতায় প্রমাণ করেছেন কীভাবে মওদুদী নবী-রাসুল এবং সাহাবাদের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। শায়খ সাফি-উর-হেমান মোবারকপুরী, রহিমাহুল্লাহ্, শায়খ হামাদ-আল-আনসারি ও সানাউল্লাহ্ অমৃতসরি সাহেবদের মত পন্ডিত ব্যক্তিরা ওদের জীবনভর মওদুদী’র ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সমালোচনা করেছেন, তরুণ সমাজকে সচেতন হয়ে চলার উপদেশ দিয়েছেন। মওদুদীকে ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’র এজেন্ট হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ, বাংলাদেশ তাদের বিভিন্ন প্রকাশনায় জামাত-শিবির কে ইহুদি এবং খ্রিস্টান অপশক্তির দোসর আখ্যায়িত করেছেন। মানবতার শত্রু জামায়াত ইসলাম বৃটিশ আমলে যেমন সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে বিদেশী শোষকদের পক্ষে কাজ করেছে, তেমনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নজিরবিহীন হত্যাকান্ড, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজসহ নানাবিধ মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়। ৩০ লাখ মানুষকে দেশকে ভালোবাসার অপরাধে হত্যা করা হয়, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হরণ করা হয়। এ ভয়াল পাশবিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে, প্রত্যক্ষভাবে অপরাধ করেছে জামায়াত ইসলাম। ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামি লীগ’র নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বহুল আকাক্সিক্ষত আন্তর্জাািতক ট্রাইবুনালের মাধ্যমে ৭১’র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার অটল নেতৃত্বে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার যজ্ঞ এগিয়ে চলেছে। জামায়াত নেতা, ৭১’এ কসাই কাদের নামে পরিচিত কাদের মোল্লা’র ফাঁসি কার্যকর হতে দেখেছে জাতি। ১৯৭১ এ পাকিস্তান জান্তার পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত গণহত্যাকে বৈধতা দিয়ে গেছে তৎকালীন মার্কিন সরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে না দাঁড়ালে বিজয় আরও প্রলম্বিত হতে পারত। ১৯৭৫ এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’কে সপরিবারে হত্যা করার আগে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে জানি। ৯৬-২০০১ মেয়াদে অভূতপূর্ব জাতীয় উন্নয়ন সাধন করার পরও বিএনপি-জামায়াত জোট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোট পেয়েও পরাজয় বরণ করতে হয় আওয়ামিলীগকে। গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র চরম নাখোশ হয় শেখ হাসিনার উপর। অন্যদিকে দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের সরকার গঠনের বিষয়টি জামায়াতকে ভাবিয়ে তোলে। এই ইসলামবিরোধী শক্তি পশ্চিমা প্রভুদের আশীর্বাদ নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তৎপর হয়। সরকারে জামায়াত সরাসরি অংশগ্রহণ করে গোপনে বিভিন্ন সশস্ত্র জঙ্গী গঠন করে। দেশব্যাপী নাশকতা চালাতে থাকে জামায়াত ও তার ছাত্রসংগঠন শিবির। শিবিরের রাজনীতির সাথে একসময় সম্পৃক্ত শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই এবং মুফতি হান্নান’র মত বিভ্রান্ত, সন্ত্রাসী লোকজনকে দিয়ে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় সমাবেশস্থলে ৭০ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করে জামায়াতের জঙ্গীরা। রমনার বটমুলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে, সিনেমা হলে, মাজার-দরগাহ-গির্জায় বোমা হামলা চালিয়ে, ঘরে ঢুকে জবাই করে দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা করে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গিরা।কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দেশজুড়ে তাফসির মাহ্ফিলের নামে মওদুদীবাদ প্রচার করতে থাকে। মদীনা সনদে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) স্বয়ং ঘোষণা করেছিলেন- ‘‘মুসলমান ও অমুসলমান বিভিন্ন সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।” যুদ্ধপরাধী সাঈদী ইসলামের শান্তিময় রুপকে বিকৃত করতে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ‘কুফরি মতবাদ” আখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মহানুভব মুসলমানদেরকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার অপপ্রয়াস চালাতে থাকে। সাঈদীর ওয়াজ মাহ্ফিলে বিভ্রান্ত হয়ে শায়খ আব্দুর রহমানের পরিচালিত জেএমবি নামের জঙ্গি দলে সম্পৃক্ত হয়ে কথিত জেহাদি কার্যক্রমে অংশ নেয় বলে পরবর্তীকালে কেউ কেউ স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আগেই বলেছি, ৯৬-২০০১ মেয়াদে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেও জামায়াত বিএনপি’র ধর্মাশ্রিত ষড়যন্ত্রের সাথে পেরে উঠেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজয় মেনে নিতে হয় আওয়ামীলীগকে। ক্ষমতায় এসে লাগামহীন সন্ত্রাস আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে মহান মানবতার ধর্ম ইসলামকে বদনাম করতে জঙ্গি তৎপরতা পুরোদমে শুরু করে ধর্মের লেবাসধারী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। জামাতুল মোজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহরির ইত্যাদি নানা নামে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো নিজেদেরকে সংগঠিত করে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমীর মতিউর রহামান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহ্সান মোহাম্মদ মুজাহিদ যথাক্রমে শিল্প ও সমাজকল্যান মন্ত্রালয়ের মন্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়। আগে থেকে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত-শিবির’র লোকজন স্বরুপে আত্মপ্রকাশ করে। দেশব্যাপী প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এই অশুভ শক্তি। দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির মানুষের উপর হামলা শুরু হয়। শুধু আওয়ামীলীগেরই ২১,০০০ নেতাকর্মীকে হত্যা করে বিএনপি-জামাত জোট। ২০০৪ সালোর ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা করে সন্ত্রাসীরা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার রাজপথে যা ঘটে, তার নজির আর দ্বিতীয়টি নেয়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভাষন দিচ্ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালায়ে ইসলামের শত্রু বিভ্রান্ত জঙ্গিরা। এমন হামলা আগে দেখেনি নতুন প্রজন্মের নগরবাসীরা। আল্লাহ্র রহমতে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও নির্মমভাবে নিহত হন ২৪ জন দেশপ্রেমিক। এদের মধ্যে ছিলেন নারীর সমঅধিকারের আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তদন্তে বের হয়ে এসেছে তৎকালীন সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু’র নাম। বাংলাদেশ সারাবিশ্বে একটি জঙ্গি ও দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিচিত হয় বিএনপি-জামাত জোট আমলে। বিদ্যুৎ উৎপদান কমে যায়, শিক্ষার হার হ্রাস পায়, দেশের খাদ্য উৎপাদন ভয়ংকর ভাবে হ্রাস পায়। প্রায় ১.২৩ কোটি ভুয়া ভোটার ঢুকানো হয় জাতীয় ভোটার তালিকায়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করতে শেষপর্যন্ত তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে নজিরবিহীনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ’র নেতৃত্বে আপামর জনতার সুতীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি-জামাত অশুভ শক্তির নীল নকশা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু যা ঘটে তাও বেশ গভীর রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। অভাবনীয় সব ঘটনা-দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় থাকে সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুর্নীতি বিরোধী নানা অভিযান, উদ্যেগে প্রথম দিকে বেশ চমক সৃষ্টি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার দুই পুত্র মানি লন্ডারিংসহ নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন। আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভারসাম্য আনার জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও গ্রেফতার করে,যদিও তাকে গ্রেফতারের কোন যুক্তি দেখাতে পারেনি তৎকালীন সরকার। তাঁকে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখলেও তাঁর সততা ও ব্যক্তিত্বের কাছে নতি স্বীকার করে তৎকালীন প্রশাসন। গণতন্ত্রের বৃহৎ স্বার্থে খালেদা জিয়াকে সাথে নিয়েই মুক্ত হন শেখ হাসিনা। অনেক বিতর্কিত কাজের বদনাম থাকলেও ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি কাজের জন্য সর্ব সচেতন মহলের প্রশংসা অর্জন করে; প্রায় ১.২৩ কোটি ভুয়া ভোটার চিহ্নিত করে একটি নিখুত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে সক্ষম হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার; সে ভোটার তালিকার উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত ডিসেম্বর ২৯, ২০০৮ তারিখের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। পাঁচ বছর পেরিয়ে নির্বাচনকালীন গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। স্বাধীনতা বিরোধী, পশ্চিমা অশুভ শক্তির দোসর, ইসলামের শত্রু জামায়াতের খপ্পরে পড়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ঐ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বিরোধীদলকে অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে নির্বাচিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনা স্বয়ং খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন। কিন্তু জামায়াতের ভূত খালেদা জিয়ার উপর এমনভাবেই ভর করে ছিল যে, তিনি শেখ হাসিনার সাথে নির্মম-কর্কশ ভাষায় কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। গণভবনে যাওয়ার দাওয়াত রক্ষা না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থাকেন। যেকোনো দাবিত্ েঅটল থাকায় অধিকার রাজনৈতিক দলের আছে। দাবি আদায়ের জন্য পদ্ধতিগত, রাজনৈতিক আন্দোলন করা যেতে পারে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে বিএনপি-জামায়াত জোট যে পদ্ধতি বেছে নেয় তাকে রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যায়না কোনোমতেই । ¯্রফে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। হরতাল-অবরোধ ডেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পেট্রোল দিয়ে মানুষসহ গাড়ি পুড়িয়ে, জবাই করে মানুষ হত্যা করে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের দাবি আদায়ের অপপ্রয়াস চালায়। সামাজিক শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অগ্রসরমান অর্থনীতি, মহামূল্যবান বিশাল বিশাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংস করার মরণ খেলায় মেতে উঠে বিএনপি-জামায়াত জোট। প্রথম দিকে সাধারণ মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে রাস্তা-ঘাটে কম থাকলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। আন্তঃজেলা সড়ক যোগাযোগও শেষের দিকে নিরাপত্তাবাহিনীর সহযোগিতায় শুরু হয়। তবে অর্থনৈতিক যে ক্ষতি বাংলাদেশের হয়েছে তা পূরণে কতদিন লাগবে তা কেউ বলতে পারছেনা। প্রশ্ন হলো বিএনপি’র মত একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসল না কেন? সব দিক বিশ্লেষণ করে যে কারণটি পাওয়া যায় সেটি হল জামায়াত ইসলাম। জামায়াতকে যেহেতু আদালত ও নির্বাচন কমিশন অবৈধ ঘোষণা করেছে, সেহেতু এর পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ৭১’র মানবতাবিরোধী অপরাধী তথা জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার হচ্ছে, জামায়াত যদি অস্তিত্ব হারায় তাহলে ইসলামকে ধ্বংস করার বড় অস্ত্র হাতছাড়া হবে, বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারলে সুশাসনকে ধ্বংস করা যাবেনা, ইত্যাদি কারণে সমস্ত অপশক্তি একজোট হয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

বিএনপি’র প্রতিষ্ঠতা, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর থাকাকালীন চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক ইস্যুকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। তিনি পরে মুক্তিযুদ্ধের একটি সেক্টরের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। সে হিসেবে জিয়াউর রহমান সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু জিয়াউর রহমান কি প্রকৃত চেতনাকে ধারণ করেছিলেন? নাকি ‘বাই চান্স’ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? তরুণ প্রজন্মের এ প্রশ্ন দেখে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ হয়তো বিরক্ত হবেন; রাগান্বিতও হতে পারেন। কিন্তু ১৯৭৫ এবং ৭৫- পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান’র কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলে উপরের প্রশ্ন দুটো খুবই যৌক্তিক মনে হবে। ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার আগে হত্যাকারী বিভ্রান্ত সেনা কর্মকর্তারা জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেছিলেন ‘গো এহেড’। এ সংক্রান্ত ভিডিও চিত্রটি ইয়োটিউবে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। ১৯৭৬ সনে জিয়াউর রহমান অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে তার আসল চেহারা বের হয়ে আসে। ২০১৩ সালে এসে আমরা জামায়াতের যে রাষ্ট্রবিরোধী বিধ্বংসী রুপ দেখছি, তার মূল কারণ কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান। বিস্তারিত জানতে একটু পেছনে যেতে হবে।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলে পাক বাহিনীর সহযোগী জামায়াতের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয় এবং রাজাকার ও আলবদর ক্যাডারদের একাংশ আত্মগোপনে চলে যায়। তারা ছদ্মবেশে ওয়াজ মাহ্ফিল, তাবলিগ জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। এ সময়ে গোলাম আযম এবং বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত জামায়াত নেতারা সংঘবদ্ধ ভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলীম বিশ্বে প্রচার চালাতে থাকে। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে গোলাম আযম পাকিস্তানে অবস্থান করে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’ পালন করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে। গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে ১৯৭২ সালে হজ্ব করতে সৌদি আরবে যায় এবং ডিসেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম যুব সংস্থা’র আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সারা বিশ্বের মুসলমানদের আহ্বান জানায়। গোলাম আযম ১৯৭২ সালে সৌদি আরব, দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, বৈরুত, লিবিয়া হয়ে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে লন্ডন গমন করে এবং উল্লিখিত দেশসমূহে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার চালায়। লন্ডনে বসে গোলাম আযম বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যায়। এ সময় তার তত্ত্বাবাধানে জামায়াতের মুখপাত্র 'সংগ্রাম' পত্রিকা লন্ডন থেকে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে ১৯৭২-এর পর থেকে বিভিন্ন সময় গোলাম আযম লন্ডন, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানে অবস্থান করে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধারের নামে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় নিয়োজিত থাকে। .......... ১৯৭৩ এর পর গোলাম আযম মোট সাতবার সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেবার অনুরোধ করে। সে সময় থেকে সৌদি শাসকদের সাথে জামায়াতের একটি সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে জামায়াত দেশে, বিদেশে গোপনে, কৌশলে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুর্নগঠনের কাজ চালিয়ে যান। পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া যেমন কঠিন ছিল, তার পুর্নগঠনের কাজও সহজ ছিলনা। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মোক্ষম সুযোগ খুঁজছিলো পরাজিত শক্তি। শেষপর্যন্ত ১৯৭৫ এর আগস্ট দেশ-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতায় আসে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। স্বাধীন বাংলাদেশের ‘মীর জাফর’ খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় আরোহন করেন। খালেদ মোশাররফ চেষ্টা করেছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আবার আনার জন্য। জিয়াউর রহমানসহ বিভ্রান্ত অফিসারদের বন্দী করেছিলেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের মরীচিকায় ধোঁকা খেয়ে কর্ণেল তাহের পাল্টা ‘বিপ্লবে’ জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে আনেন। জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে কর্ণেল তাহেরসহ বহু সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করেন। ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করেন এবং হাজার হাজার কারাবন্দী জামায়াত ও পাকিস্তান বাহিনীর দালালদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষিত হলে জামায়াতের নেতা ‘মওলানা’ রহিমের নেতৃত্বে জামায়াত ও কয়েকটি বিভ্রান্ত ‘ইসলামি’ দলের নেতারা একত্র হয়ে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। নবগঠিত আইডিএল দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতের ক্যাডাররা নিজেদের সংগঠন করতে থাকে। এ সময় লন্ডনে অবস্থানকারী গোলাম আযম ১৯৭৬, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে তিন দফায় তার নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করে। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই গোলাম আযম পাকিস্তানি পার্সপোর্ট তিন মাসের ভিসা নিয়ে অসুস্থ মাকে দেখতে বাংলাদেশে আসে। তিন মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গোলাম আযম বাংলাদেশে অবস্থান করে এবং দেশজুড়ে গোপন সফর কর্মসূচিতে দলকে সংগঠিত করতে থাকে। ১৫, ২৬ ও ২৭ মে ১৯৭৯ ঢাকায় তিন দিনের সম্মেলনে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং গোলাম আযমকে গোপনে আমির নির্বাচিত করা হয় নাগরিকত্ত লাভ সাপেক্ষে। দলের ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত হয় আব্বাস আলী খান।

ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ থেকে জামায়াতে ইসলামী তৎকালীন জিয়া সরকারের মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী জোরালো তৎপরতার মাধ্যমে দৃঢ় সাংগঠনিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। এ সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ‘গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল কমিটি’ দেশব্যাপী ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৮০ জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান বলে, ‘১৯৭১ সালে দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য যা করেছি তা ঠিকই করেছি। ভারতীয় আগ্রাসন থেকে জনগণকে হেফাজত করার জন্য কাজ করেছি।’ তার এ ধরণের ঔদ্ধতপূর্ণ বক্তব্যের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দেশব্যাপী ‘রাজাকার প্রতিরোধ সপ্তাহ’ কর্মসূচি পালনকালে রংপুরে জামায়াতের সন্ত্রাসীরা মুক্তিযোদ্ধা অফিস আক্রমন করে। ২৯ মার্চ ১৯৮১ আব্বাস আলী খান সংবাদ সম্মেলনে আবারো বলে, ১৯৭১ সালে আমরা যা করেছি তা ঠিকই করেছি এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কনসেপ্ট সঠিক ছিলনা।’

জিয়াউর রহমান সাহেবের শাসনামলে জামায়াত যে শক্ত ভিত্তি পেয়েছিল তা আরো সুদৃঢ় হয় আরেক সামরিক শাসক, ১৯৮২ সালে ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা জেনারেল হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সাহেবের আমলে। নব্বই’র গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলে ‘গণতন্ত্র’র ভার সইতে পারেনি জাতি। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৮৪টি আসনে জামায়াত নিজেদের প্রার্থী না দিয়ে বিএনপিকে অকুন্ঠ সমর্থন দেয়। ১৩৮টি আসনে জয়ী হয় বিএনপি। জামায়াত সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিলে প্রতিদানে ২টি সংরক্ষিত আসনে সদস্যপদ পায়। বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে পুরস্কৃত করে। জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বোধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সম্মিলিত প্রয়াসে গণ আদালতে’ ২৬ মার্চ ফাঁসির প্রতীকী রায় দেওয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম ক্রমশ সংগঠিত হতে থাকে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করে। চতুর জামায়াত জনমত টের পেয়ে নির্বাচন বিরোধী অবস্থান নেয়। এভাবেই জামায়াতের সময় সুযোগ বুঝে নিজেদেও ভোল পাল্টে টিকে থেকেছে।

জামায়াত ইসলামী কি এবং কিভাবে তারা বাংলাদেশে টিকে থাকল এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আমরা জানলাম। এখন জানব পৃথিবীর এমন একটি নেটওয়ার্ক বা দল সম্পর্কে যারা জামায়াতের মতই আরব বিশ্বে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইবুনাল গঠন করে ১৯৭১’র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তুরস্ক থেকে মুসলীম ব্রাদারহুড নামের সংগঠনটির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কে বিচারকার্য থেকে অব্যহতি দিতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। মিশরের হোসনে মোবারক সরকারের যখন পতন হল, তখন বিশ্ববাসী নড়ে চড়ে বসল; পশ্চিমা শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট সৈরশাসকের পতন হলে আমজনতার সামাজিক ও অর্থীনতিক মুক্তির আশায় সবাই অনুপ্রানিত হল। নির্বাচন হল। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসল মুসলীম ব্রাদারহুড। মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হলেন মুহাম্মদ মুরসি। পশ্চিমা গণমাধ্যমসমূহে ফলাও করে প্রচার করা হল মিশরে ইসলামিক গণজাগরণ হয়েছে! ইসলামিক গণজাগরণ হয়েছিল নাকি জনতার স্বঃস্ফুর্ত সৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে ক্ষমতায় এসেছিল ইহুদী নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিরই কোনো দোসর? এর উত্তর আমরা খুঁজব খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে। এ সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা করা দরকার। এখানে সবকিছু লেখার সুযোগ কম। মিশরের প্রখ্যাত পত্রিকা আল-বালাদ এ জুলাই ২২,২০১৩ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ আমরা করতে পারি। প্রতিবেদনে বলা হয় মুসলিম ব্রাদারহুড দীর্ঘদিন থেকে মিশরকে ভেঙ্গে দিতে ইসরাইলী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিলো। মুহাম্মদ মুরসি কখনোই প্রতিবেশী ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের উপর পরিচালিত জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি। অধিকন্তু সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতন উত্তরনে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। মিশরীয় জনগণ ষঢ়যন্ত্র টের পেয়ে মুরসি বিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তোলে। তাতে সমর্থন দিয়ে মরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী। ক্ষতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে মুসলীম ব্রাদারহুড ফ্রি সিরিয়ান আর্মির আদলে ‘ফ্রি মিশরীয় আর্মি’ নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সামরিক বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করেছিল। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র অর্থ ও অস্ত্রের উৎস অুসন্ধান করলে আমরা বাশার বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের পেছনে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা দোসরদের হাত দেখতে পাব। রাশিয়া ও চীন বাধা না দিলে আমরা হয়ত আরেকটি মার্কিন আগ্রাসন প্রত্যক্ষ করতাম।

প্রিয় পাঠক, এত কিছু বলার একটাই উদ্দেশ্য জামায়াত ইসলামকে মানুষকে চেনানো। এরা ইসলামের ছদ্মবেশে ইসলামের শত্রু। মানবতার শত্রু। বাংলাদেশ যেখানে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলীম, সেখানে জামায়াত ইসলাম’কে সঠিকভাবে না চিনতে পারলে আমাদের সম্প্রীতি ও শান্তির বাংলাদেশ একদিন জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের দেশে পরিণত হবে। সন্ত্রাসবাদের স্লোগানে তুলে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাদেশে ইরাক ও আফগানিস্থানের মত আগ্রাসন চালাবে। ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের থাকা বাংলাদেশের প্রতি সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির শ্যান দৃষ্টি বহুদিনের। আফগানিস্থানে তালেবান বাহিনীর সৃষ্টি করেছিল কারা? আল-কায়েদা বাহিনী’র প্রধান ওসামা বিন্ লাদেনের পরিবার যে মার্কিন বুশ পরিবারের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলো, সে খবর আমরা কজন রাখি? তাই সাবধান থাকতে হবে। আমাদের পবিত্র ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ছদ্মবেশী জামায়াত যেনো আর কোনোদিন ক্ষমতায় না আসতে পারে সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই জামায়াত ইসলাম ও তাদের অপকর্ম নিয়ে প্রচুর গবেষণা কাজ হওয়া দরকার। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে জামায়াতের গাঁটবন্ধন গণমানুষের সামনে খোলাশা করতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তাদেরকে শতভাগ সততা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। সুদ-ঘুষ খাওয়া চলবেনা, টেন্ডারবাজি, তদ্বির বাণিজ্য, জায়গা-জমি দখল করা চলবেনা। সদা সর্বদা দেশ ও জাতির স্বার্থকে সবকিছুর উপরে স্থান দিতে হবে। বিদেশী কোনো দেশ বা শক্তির তাবেদার হয়ে কাজ করা যাবেনা। স্থানীয় স্বার্থ, চেতনা ও সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দিয়ে সতর্ক ও সচেতন এবং বিচক্ষণ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে দেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে।


লেখক: শেখ আদনান ফাহাদপ্রভাষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.dhakatimes24.com/2014/02/26/16137#sthash.ZY6zcBPL.dpuf

Friday, 30 January 2015

সহিংসতা নয়, ঐক্য ও সম্প্রীতি চাই

সৃষ্টিজগতে মানবজাতি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি আছে, যা অন্য কোনো সৃষ্টির মাঝে নেই। ফলে জ্ঞান ও বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ অপর সৃষ্টিগুলোকে নিজের প্রয়োজনে ও স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখ-শান্তি তথা ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য। ইসলামে ঐক্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ঐক্য ও সম্প্রীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতীয় ঐক্যের ওপর ইসলাম প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু (কোরআন) দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।' -সূরা আন নিসা : ১০৩


এ আয়াতে জাতীয় ঐক্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সে সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এর পরও কিছু দুর্বৃত্ত ঐক্য, সহমর্মিতা ও মানবিকতার কথা ভুলে গিয়ে যাত্রীসমেত বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। আগুনে দগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ অপরিসীম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে। প্রতিদিনই বাড়ছে দগ্ধ মানুষের সংখ্যা, অনেকে হাসপাতাল থেকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে, খালি হচ্ছে অনেক মায়ের বুক, নারী হচ্ছে বিধবা, সন্তান হচ্ছে পিতৃহারা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, বিনাশ হচ্ছে সম্পদের, সর্বনাশ ঘটছে অর্থনীতির। আর এসবই ইসলাম-বিরুদ্ধ কাজ। ইসলাম এমন কাজকে তীব্রভাবে ঘৃণা করে।

প্রত্যেক মানুষই শান্তি চায়। তাই আমরা কি পারি না সহিংসতা পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে ঐক্য, সম্প্রীতি ও মানবপ্রেমের পথ মসৃণ করতে? বস্তুত পরামর্শ ও সমঝোতা করে কাজ করার মধ্যে বহু কল্যাণ নিহিত আছে। কেননা ইসলামের মর্মবাণী হলো_ শান্তি, সাম্য, সহনশীলতা ও মানবতাবোধ। কোরআন শরিফে মুসলমানদের গুণাবলি ও কার্যপদ্ধতির আলোচনা প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, 'এবং তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।' _সূরা আশ শূরা : ৩৮

বস্তুত পরামর্শ বা পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যে আল্লাহতায়ালা রহমত ও বরকত রেখেছেন। এই কারণেই রাসূল (সা.) তার ওপর পরামর্শ গ্রহণ করা অপরিহার্য না হওয়া সত্ত্বেও সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, 'রাসূলুল্লাহর (সা.) চেয়ে নিজ সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে অধিক পরামর্শকারী আমি আর কাউকে দেখিনি।'

ইসলাম সর্বধরনের হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বিভেদ, সহিংসতা ও বৈষম্য দূরীভূত করে দুনিয়ার সব মানুষকে ঐক্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের সম্প্রীতিতে আবদ্ধ করে। আমরা জানি, ঐক্য শব্দের অর্থ হলো একতা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়েও মানুষের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পারস্পরিক ঐক্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতি যে প্রশংসনীয় এবং মানবজাতির একান্ত কাম্য, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও দেশ-কাল নির্বিশেষে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করে। এ কারণে বিশ্বের সব দল ও গোত্রই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানায়। এজন্য ইসলাম শুধু মৈত্রী, একতা, শৃঙ্খলা ও দলবদ্ধ হওয়ার দিকনির্দেশনা প্রদান করেনি, বরং তা অর্জন করা এবং অটুট রাখার জন্য একটি ন্যায়ানুগ মূলনীতিও ঘোষণা করেছে। অতএব, উম্মতে মুহাম্মদী পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানূভূতিশীল হবে। পারস্পরিক হিংসা, বিদ্ধেষ, কুৎসা রটনা, শত্রুতামূলক আচরণ ইত্যাদি ঐক্য বিনষ্টকারী দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে কথা ও ব্যবহারে সম্প্রীতিমূলক আচরণ করতে হবে, তাহলে সমাজ বা রাষ্ট্রে সহিংসতার পরিবর্তে ঐক্য ও সম্প্রীতির অনূকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সে সঙ্গে ইসলামের শিক্ষা অনুসারে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অনুসারীরা দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করলে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।

© মুহাম্মদ মাহবুবুল আলমশিক্ষক ও কলাম লেখক

উৎসর্গ -- হেলাল হাফিজ



আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?

কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।
কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,–
পথিক এ পথে নয়
‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

Tuesday, 20 January 2015

পাকিস্তান আরও কাঁদবে, বাংলাদেশকেও শিক্ষা নিতে হবে 



পেশাওয়ারে জঙ্গিদের হামলায় শিশুহত্যার পর কাঁদছে পাকিস্তান। কাঁদছে মানবতা। কাঁদছে বিশ্বসম্প্রদায়। কারণ শিশুরা কোনো ব্যক্তি, দল বা দেশের নয়। তারা পৃথিবীর সন্তান। তারা আগামীর। পাকিস্তানকে আরও কাঁদতে হবে। কাঁদতে হবে বাংলাদেশকেও যদি পাকিস্তানের ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়, তাহলে।
লাখ লাখ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়িনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পরাজয় মেনে নিয়েছিল বাঙালি জাতির কাছে। তার ঠিক তেতাল্লিশ বছর পর, ২০১৪ সালের এই দিন তালেবান জঙ্গিরা বেছে নিয়েছে সেনাকর্মকর্তাদের শিশুসন্তানদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার জন্য। যে দিন তারা এতদিন ধরে পালন করেছে পরাজয়ের গ্লানি দিবস হিসেবে, এবার থেকে সেটি হয়ে উঠল শোকের দিন।
এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের ডাকে এক টেবিলে বসে আলোচনা করেছে। সন্ত্রাসবাদ বিন্দুমাত্র সহ্য করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেওয়াজ শরিফ। সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিন হাজারের বেশি জঙ্গিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এরই মধ্যে জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর শুরু হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী জঙ্গিবিরোধী অভিযানও শুরু করেছে। গত রোববার পর্যন্ত অভিযানে ৯৬ জঙ্গি নিহত হয়েছে।
নেওয়াজ শরীফের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে তালেবানপন্থী তেহরিক ইনসাফ দলের প্রধান ইমরান খানের উপস্থিতি তাৎপর্যমূলক মনে করেছেন অনেকেই। কারণ, ইমরান তালেবানদের প্রতি সহানুভুতিশীল হিসেবে পরিচিত। আর তার দলও পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থনপুষ্ট। সর্বদলীয় বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক সিরাজুল হক দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির প্রধান আসফান্দিয়ার ওয়ালি খান বলেছেন, ‘‘সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদের সবার অহংবোধ চিরদিনের জন্য ধ্বংস করতে হবে।’’
ওদিকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কায়েদে আযম) নেতা মুশাহিদ হোসেইন সাইয়্যেদ প্রশ্ন রেখেছেন, ‘‘যদি তামিলনাড়ুতে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হতে পারে তবে পাকিস্তানে নয় কেন?’’
ওই বৈঠকে উপস্থিত প্রত্যেকের কথাই তাৎপর্য বহন করে। পাকিস্তানের ক্ষমতার নিয়ামক শক্তিগুলোর অবশ্যই অহঙ্কার ঝেড়ে ফেলতে হবে, সবাই মিলে উদ্যোগ নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে, জঙ্গিদের ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে, তামিলনাড়ু পারলে পাকিস্তানও পারবে। সব কথাই সত্য এবং কার্যকর উপায়। কিন্তু, প্রশ্ন হল, দেশটা হচ্ছে পাকিস্তান। আমি মনে করি, কোনো উদ্যোগই সফল হবে না যতদিন পর্যন্ত না পাকিস্তানিদের মনোজগতে আমূল পরিবর্তন না হয়। বিশেষ করে, যারা ক্ষমতার স্টেক হোল্ডার– যেমন, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ও পাক সেনাবাহিনী– বদলাতে হবে তাদের।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই গণতন্ত্র সেখানে অকার্যকর। সেনাবাহিনী আর ভুস্বামীদের কথায় দেশ চলেছে। একই সঙ্গে ভারতের জন্ম হলেও রাজনৈতিক নেতাদের দূরদর্শিতায় সেখানে জনগণের শাসন কায়েম হয়েছে। ভালো, মন্দ যে রকমই হোক, দেশ চালিয়েছেন রাজনীতিবিদরা। একটি বারের জন্যও সেনাবাহিনী অনুভব করেনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কথা, তারা দেশসেবাই করে যাচ্ছে।
বিপরীতে, পাকিস্তানে সামন্তবাদী মন-মানসিকতার ক্ষমতাধর এক শ্রেণির মানুষ আর সেনাবাহিনী মনে করেছে, জনগণ হল প্রজা, তাদের সেবা নয়, শাসন করতে হবে। তাই দেশটিতে গণতান্ত্রিক কাঠামো কখনওই গড়ে তুলতে দেওয়া হয়নি। যার খেসারত সবসময় দিতে হচ্ছে, হয়েছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে।
এসব কারণেই আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে জঙ্গিবাদের চাষ হয়েছে। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগ, তারা জঙ্গিদের শুধু প্রশিক্ষণই নয়, বিপুল অংকের অর্থও দিয়ে থাকে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী তালেবানদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতাই শুধু নয়, প্রশিক্ষণও দিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, ‘আইএসআই’। এই হচ্ছে পাকিস্তানের বাস্তবতা।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী তালেবানদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ দিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, ‘আইএসআই’
অন্যদিকে, অনেক রাজনৈতিক দলই তালেবানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জঙ্গিদের সঙ্গে আপোষ করেছে। গত ছ’ বছর ধরে পাকিস্তান সরকার জঙ্গিদের ফাঁসির আদেশ কার্যকরে স্থগিতাদেশ দিয়ে রেখেছিল এই আপোষের কারণেই। এখন তাদের সন্তানদের হত্যার পর সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হল। ৬ হাজার জঙ্গির বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ রয়েছে। এতদিনে সেগুলোর কিছু কিছু কার্যকর হলেও হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।
এ তো গেল একটি দিক। সরকার ও সেনাবাহিনীর বাইরে পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক দলেরও জঙ্গিবিরোধী কোনো কর্মসূচি নেই। দিনের পর দিন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে পাকিস্তানের সর্বত্র জঙ্গিবাদ শিকড় গেড়ে বসেছে। পাকিস্তান হয়ে উঠেছে জঙ্গি রপ্তানিকারক দেশ। এ জন্য শুধু পাকিস্তানের জনগণই নয়, সারা বিশ্বের মানুষকেই ভুগতে হচ্ছে। ওদের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আস্তানা বানিয়েছে। সেখান থেকে ওরা সারা বিশ্বে ‘জেহাদ’এ যোগ দিচ্ছে। তাদের জঙ্গিরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে এসেও জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা-‘আইএসআই’ গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটা নতুন তথ্য নয় যে, ভারতে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাতে তারা বাংলাদেশের ভুখণ্ডও ব্যবহার করেছে।
বর্তমান প্রেক্ষপটে জঙ্গি দমনে যদি পাকিস্তানের সরকার, রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কথা তাৎপর্যপূর্ণ হয়, তাহলে লাল মসজিদের খতিবের কথাও স্মরণ রাখতে হবে। সেখানকার ইসলামপন্থী কতিপয় প্রভাবশালী মানুষের চিন্তা-চেতনার রূপটিও বুঝতে হবে। শিশুহত্যার এত বড় জঘন্য ঘটনার নিন্দা যখন সারা বিশ্বের মানুষ করছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যখন শোকার্ত, তখন পাকিস্তানের লাল মসজিদের খতিব আবদুল আজিজ তালেবানের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে পরিচালিত সেনা অভিযানকে ‘অনৈসলামিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, তালেবানের ওপর বিমান হামলার প্রতিশোধ নিতেই পেশাওয়ারের স্কুলে ১৩৩ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। কত বড় নিষ্ঠুর ও বর্বর মানসিকতা হলে এ কথা বলা যায়?
২০০৭ সালে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায় তৎকালীন পারভেজ মোশাররফ সরকার। এতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। ওই অভিযানে আবদুল আজিজের ভাই আবদুল রশিদ গাজী নিহত হন। আবদুল আজিজ বোরকা পরে পালানোর সময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তিনি মুক্তি পান।
দিনের পর দিন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে পাকিস্তানের সর্বত্র জঙ্গিবাদ শিকড় গেড়ে বসেছে
তবে আশার কথা হচ্ছে, ইসলামী চরমপন্থার একটা ‘অস্পৃশ্য’ (ছোঁয়া যাবে না এ অর্থে) দূর্গ হিসেবে পরিচিত ওই লাল মসজিদের সামনে শত শত মানুষ ইমামের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্য ও সেনাবাহিনী ধাক্কা খাওয়ার পর সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদ তালেবানবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। পাকিস্তানের মতো নানা ভাগে বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর জঙ্গি চাষাবাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, শতাধিক শিশুহত্যার ঘটনা পাকিস্তানের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হবে কিনা, এখনই বলা মুশকিল। তারপরেও বিক্ষোভ তো শুরু হয়েছে। এই বিক্ষোভ পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতি এবং তথাকথিত রক্ষকদের মধ্যে অন্তত ধাক্কা দিতে পারবে।
তবে খুব কঠিন পুরানো এই পাপমোচন। কারণ, তা করতে হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকেই ১৮০ ডিগ্রি উল্টাতে হবে। এরই মধ্যে তালেবানরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পরিবারসহ দেশটির রাজনীতিবিদ ও সেনাকর্মকর্তাদের সন্তানদের হত্যার হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘‘যদি আমাদের কোনো সহযোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তোমাদের শিশুদের ওপর আমরা প্রতিশোধ নেব। সেনাবাহিনীর জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতাদের ঘর শোকের আধারে পরিণত করব।’’
পাকিস্তানে বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেরও শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। কারণ, এই দেশেও এক সময় জঙ্গিবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। বিশেষ করে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল ছিল জঙ্গিদের ‘ফলনের বছর’। এর আগে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই জঙ্গিরা সংগঠিত হতে থাকে। সে সময় তারা সারাদেশে একের পর এক বোমা হামলা চালিয়ে প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা করেছে। জঙ্গিবাদে আওয়ামী লীগের সমর্থন না থাকলেও তারা তা দমনে সেবার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
এরপর, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিরা রীতিমতো উল্লসিত হয়; কারণ, গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিরা এ সময় একে একে ছাড়া পেয়ে যায়। এক পর্যায়ে জেএমবি বা জমিয়াতুল মুজাহিদিন নামে সংগঠন খুলে জঙ্গিরা শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভা্‌ইয়ের নেতৃত্বে মিছিলও করেছে। আর সেই মিছিলে পাহারা দিয়েছে পুলিশ, রসদ জুগিয়েছেন বিএনপির নেতারা!
বিএনপি-জামাতের শাসনামালে দিনের পর দিন জঙ্গি তৎপরতার রিপোর্ট লিখে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে আমাদের। তখনকার সরকার শুধু জঙ্গিবাদের কথা অস্বীকারই করেনি, তারা এ সব ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা ফাটিয়ে তাদের ব্যাপক উপস্থিতির কথা যখন জানান দেয় জঙ্গিরা, তখন দেশি-বিদেশি চাপে সরকার বাধ্য হয় জঙ্গি সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেও তাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখার অভিযোগ ছিল।

ইসলামী চরমপন্থার ‘অস্পৃশ্য’ দুর্গ হিসেবে পরিচিত লাল মসজিদের সামনে শত শত মানুষ ইমামের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গিবাদের বিস্তার রোধে ভুমিকা রেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিললেও তাদের করণীয় রয়েছে আরও অনেক কিছু। জঙ্গি দমনে সরকারের কার্যকর ভূমিকা আসলে দেখা যাচ্ছে না। যতটা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখার কথা তা হচ্ছে বলা যাবে না কিছুতেই। আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির উপমহাদেশে তাদের শাখা খোলার ঘোষণা, ময়মনসিংহে ফাঁসির আসামিসহ চার জঙ্গি ছিনতাই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জেএমবির জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা এবং সর্বশেষ ড্রোন তৈরি করে দেশের শীর্ষনেতাদের হত্যা করার পরিকল্পনা জঙ্গি তৎপরতার ভয়াবহতার দিকটিতে ইঙ্গিত করে।
সরকার এসব দমনে চেষ্টা করছে বললেও এখন পর্যন্ত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এখনও র‌্যাব, ডিবি বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য শাখাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ধরা পড়ার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়াদের খোঁজও তাদের কাছে নেই।
এ জন্য বিভিন্ন সময় সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এভাবে যে, জঙ্গি দমনে একটা টাস্কফোর্স বা এমন একটা সংস্থা তৈরি করা হোক, যেখানে সেনাবাহিনী পুলিশ, র‌্যাব, বিডিআর, আইনজীবী, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ, গবেষকসহ যাদেরই প্রয়োজন হবে সবাইকে রাখা হবে। এই সংস্থা সার্বক্ষণিক ভিত্তিতে জঙ্গি তৎপরতা মনিটর করবে। জঙ্গিদের দমন থেকে শুরু করে জঙ্গি সংগঠনে যোগদানে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা, যারা ধরা পড়বে তাদের সংশোধন করার ব্যবস্থাগ্রহণ, বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি করা– এ সব বিষয়ে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা করবে এই টাস্ক ফোর্স।
তবে তার আগে দরকার রাজনৈতিক ঐক্য। শত শিশুহত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানেও এমন ধারা ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে সে পরিস্থিতি হওয়ার আগেই এ ঐক্য দরকার। যদিও অনেকে বলবেন যে, এ দেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি নেই, তবু সাবধানের মার নেই। কারণ, আনসারউল্লা বাংলা টিম, আনসার-উল-জিহাদ-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ-হুজি, হিযবুত তাহরির এখনও সক্রিয়। এই সংগঠনগুলোর ভয়াবহ কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ্ করেছে।
এসব জঙ্গির বাইরেও সম্প্রতি গজিয়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবও বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। তাদের প্রতি নমনীয় মনোভাব বা রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার প্রতিযোগিতাই আমাদের উদ্বেগের কারণ। তাই জঙ্গিদের নির্মূলে সরকার যতক্ষণ না সমন্বিত কঠোর ব্যবস্থা নিবে, আশঙ্কার জায়গাটা থেকেই যাবে।

@ জায়েদুল আহসান পিন্টু

Monday, 19 January 2015

সিডনি সন্ত্রাস কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয় -- আকমল হোসেন

গত ১৫ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সন্ত্রাসী ঘটনার পর দেশটির নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্নের পাশাপাশি ঘটনাটির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার নায়ক ম্যান হারুন মনিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, এমন এক ব্যক্তি যার অতীত সহিংস কাজের রেকর্ড আছে সে কীভাবে এ দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়, নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্রীয় ওয়েলফেয়ারের সুবিধা পেয়েছিল? অস্ত্র রাখার লাইসেন্সই বা কীভাবে সে পেয়েছিল? সংবাদ মাধ্যমে এমন প্রশ্নও উঠেছে যে, এমন একজন ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ আছে, সে কীভাবে অপরাধীদের ওয়াচ লিস্ট থেকে বাদ পড়ে ও জামিন পায়? নাগরিকদের নিরাপত্তা শক্ত করার যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো অবাধে অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার দাবিও উঠেছে। অন্যদিকে নাগরিকদের মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব বাড়ার প্রবণতা বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা মুসলমানদের এক অংশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সহিংসতার অভিযোগ থাকায় সিডনির ঘটনায় নেতিবাচক মনোভাব বাড়তে থাকা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় না।

১৯৯৬ সালে ইরান থেকে হারুন (যে মোহাম্মদ হাসান মোনতেকি নামেও পরিচিত ছিল) অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিল। এ ঘটনার পর ইরান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পালিয়ে আসার আগে সে ইরানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে আসায় তাকে ফেরত দেয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু সে অনুরোধ তখন রাখা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসার পর থেকে হারুন নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে বলা হচ্ছে। সে নিজেকে একজন ইসলামী ধর্মগুরু দাবি করে আধ্যাত্মিক চিকিৎসক বনে যায়। চিকিৎসা করার বিজ্ঞাপনে সে নিজেকে অ্যাসট্রোলজি, নিউমেরলজি, মেডিটেশন ও ব্ল্যাক ম্যাজিকের বিশেষজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছিল। চিকিৎসা করার নামে সে যৌন নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে পিস অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ করার সপক্ষে তার পেশ করা দরখাস্তে সে লিখেছে, মানবিক সাহায্য, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের প্রদান করব। সমাজে শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার প্রসার ঘটাব এবং মানুষকে শান্তির মধ্যে বসবাস করার জন্য উৎসাহিত করব। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত হতে দেখা যায় তাকে। তার প্রকাশ ঘটে আফগানিস্তানে অস্ট্রেলিয়ান সেনাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান দেখে। একদিকে সে নিহত সেনাদের নিয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অসম্মানজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় চিঠি লিখত, অন্যদিকে সিডনির এক আদালতের সামনে নিজেকে একবার শিকল দিয়ে বেঁধে হাতে ধরে রাখা ব্যানারে সৈন্যদের প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এ সময় সে সাংবাদিকদের বলেছিল, আমার কলম হচ্ছে আমার অস্ত্র এবং কথাগুলো হচ্ছে আমার বুলেট। আমি এ অস্ত্র দিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে শান্তির জন্য লড়াই করব। তার এসব কর্মকাণ্ডের পর ২০০৮ সালে তাকে আইএসও ওয়াচ লিস্টে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে সে তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্বেষপূর্ণ চিঠিপত্র লেখার অপরাধে তাকে গত বছর ৩০০ ঘণ্টা কমিউনিটি সার্ভিস করার জন্য দণ্ড দিয়েছিল আদালত।

১৫ ডিসেম্বর সকালে সিডনির মার্টিন প্লেসের লিন্ড্ৎ ক্যাফেতে ১৭ জনকে পণবন্দি করার পেছনে তার কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল, নাকি এটি তার মানসিক বিকৃতির প্রকাশ ছিল? নিরীহ মানুষের ওপর হামলা কি বর্তমান যুগে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাসী কাজকর্ম চলছে তার আওতাভুক্ত হবে? তার সঙ্গে কোনো ধর্মীয় চরমপন্থী গোষ্ঠীর সম্পর্কের কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত ওঠেনি। তবে হারুন তার যে তিনটি দাবি তুলেছিল, বলা হচ্ছে তার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অবশ্যই আছে। তার প্রথম দাবি ছিল তাকে ইসলামী স্টেটের একটি পতাকা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটিকে অস্ট্রেলিয়ার ওপর ইসলামী স্টেটের আক্রমণ হিসেবে সব সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। সর্বশেষ দাবি ছিল, টনি অ্যাবোটকে ঘটনাস্থলে আসতে হবে। অথচ তাকে সমর্থন করে কোনো ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীকে কোনো বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। পণবন্দি করার আগে হারুন শিয়া মতবাদের পরিবর্তে সুন্নি ইসলামী মতবাদ গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়। কট্টর সুন্নি ইসলামিক স্টেটের সমর্থন হয়তো সে আশা করেছিল এ পরিবর্তনের মাধ্যমে। ক্যাফের জানালায় যে পতাকা তুলে ধরতে সে বন্দিদের বাধ্য করেছিল, সেটা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর ছিল না, তাতে লেখা ছিল আরবিতে লেখা কলেমা। সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে অস্ট্রেলীয় একজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তার সঙ্গে কোনো পরিচিত গোপন সন্ত্রাসী দলের সংযোগ ছিল না। সে একজন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ছিল। এর অর্থ, একজন ব্যক্তি হিসেবে সে সংক্ষুব্ধ হয়ে এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে তার তাৎপর্য অবশ্য ক্ষতিকারক ও হুমকি হিসেবে বিবেচিত হবে। উল্লেখ করা দরকার, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী কোনো শিয়া বা সুন্নি মতবাদী গোষ্ঠী তাকে কখনোই সমর্থন করেনি।

ম্যান হারুন মনিসের অতীত সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাকে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি বলে মনে হয়। তবে তার ভেতর সহিংস কাজের ইচ্ছা যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেকে ইসলামী ক্লারিক বলে দাবি করা, আধ্যাত্মিক চিকিৎসার নামে যৌন হয়রানি করার চিরাচরিত দোষ, শান্তির সপক্ষে কাজ করার জন্য প্রচার, শিকল দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখে মিডিয়ায় প্রচার পাওয়া ইত্যাদি মানসিকভাবে সুস্থ কোনো মানুষের ছবি নয়। প্রথম স্ত্রীকে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল, যদিও তাকে জামিন দেয়া হয়েছিল। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও চটক ছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ছিল না সে কর্মকাণ্ড, যদিও নিজেকে সে শান্তির পক্ষের লোক বলে দাবি করেছিল। সবশেষে লিন্ড্ৎ ক্যাফের ঘটনাটি ছিল তার মানসিক অসুস্থতার চরম প্রকাশ। সন্দেহ নেই, সে তথাকথিত ইসলামী স্টেটের আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিল; কিন্তু পণবন্দি করে দাবি আদায় করার বাসনা চরম মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ বলেই মনে হয়।

পাশ্চাত্যের অনেক দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও এক বিরাট মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমানদের একটা বড় গন্তব্য হচ্ছে দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন থেকে আসা মুসলমানদের একটা অংশ নানা সময়ে এ দেশে সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ২০০৫ সালে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে এক বড় দাঙ্গায় এরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ আছে। অন্যদিকে ইসলামী স্টেটের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে এদের কেউ কেউ সিরিয়া গেছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের বড় অংশ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এবং সিডনির সন্ত্রাসী ঘটনার পর তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তা নিন্দা জানাতে ও পুলিশি ব্যবস্থাকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে।

কিন্তু হারুন মনিসের কর্মকাণ্ডে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি অস্ট্রেলীয়দের সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়বে কি-না, তা বোঝা কঠিন নয়। এবং সরকারের তরফ থেকে তাদের ব্যাপারে কঠিন নীতি গ্রহণ করা হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পররাষ্ট্রনীতিতে অস্ট্রেলিয়া বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখে। সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাথাব্যথা যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, তাই এসব কাজকে দেশটির সরকার কঠোরভাবে মোকাবেলা করবে বলেই ধরে নেয়া যায়। (অস্ট্রেলিয়া থেকে)
ড. আকমল হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
akmalhussainir@yahoo.com

আমরা এসেছি -- সুকান্ত ভট্টাচার্য


কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল,
মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল।
দুঃখ-যুগের দারায় দারায়
যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায়
তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল।
তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল-

কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল,
তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল।
আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা
হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা,
হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল
তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল-

আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল
জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল।
উধাও আলোর নিচে সমারোহ ,
মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ!
ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল!
সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল-
একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল,
দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল।
সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার,
থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়,
ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল।
আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।


Sunday, 18 January 2015

শার্লি হেবদো : বিকারগ্রস্ত বিবেক

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে প্রকাশিত রম্যপত্রিকা 'শার্লি হেবদো'র একটি ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে কিছু ঘটনা ও অঘটন বিশ্বের প্রচারমাধ্যমগুলোর প্রধান সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি পত্রিকাটির অফিসে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের জেরে জানা যায়, পত্রিকাটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাপা নিয়ে কতিপয় অস্ত্রধারী পত্রিকার অফিসে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে ১২ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পরপর জিম্মি নাটকের একটি ঘটনাও ঘটে এবং রক্তাক্ত পন্থায় এর অবসান হয়। স্বভাবতই এমন লোমহর্ষক ঘটনায় কেঁপে ওঠে গোটা ফ্রান্স, পশ্চিমা জগৎ ও বিশ্ব। ফরাসি প্রেসিডেন্টের আহ্বানে এ ঘটনার নিন্দায় লাখ লাখ লোকের প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। এ মিছিলে হত্যাকা-ের নিন্দায় শার্লির প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বহু মুসলমান অংশ নেয়ার দৃশ্য সিএনএনের দর্শকরা দেখেছে। মিছিলে যোগদানকারী ৪০ জন বিশ্বনেতার মধ্যে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মতো মুসলিম নেতারাও অংশ নিয়ে ফ্রান্সের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তারা বাস্তবে প্রমাণ দেন, কোনো সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ের সঙ্গে ইসলাম বা মুসলমানদের সম্পর্ক নেই।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ফরাসি নেতারা এবং পশ্চিমা মিডিয়া এ ঘটনাকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। তার একটি প্রমাণ_ ঘটনার পরপর শার্লি হেবদোর যে সংখ্যাটি প্রকাশ হলো, তাতে আবার মহানবী (সা.) কে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলমানের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করবে এবং তা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও উত্তেজনাকে উসকে দিতে পারে। বলা হচ্ছে, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত আইএসকে ব্যঙ্গ করার মানসে পত্রিকাটি এ কাজ করেছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, আইএসকে কি বিশ্বের সব মুসলমান সমর্থন করে? আমাদের জানা মতে, বিশ্বের কোনো মুসলিম ফোরাম থেকে আইএসকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বা তাদের কর্মকা-ের প্রতি কারও অনুমোদন নেই। তাহলে এর জন্য কেন মুসলিম উম্মাহকে দায়ী করা হবে। তদুপরি যেখানে আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বরকে দুনিয়ার সব জ্ঞানী-মনীষী একবাক্যে বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলে স্বীকার করেন, সেখানে তাকে কেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হলো। আইএসের কর্মকা-ের জন্য তাকে কেন দায়ী করা হবে? অথচ তিনি দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে। এ ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে তারা বাকস্বাধীনতার কথা বলেন। অর্থাৎ পশ্চিমা সভ্যতায় নাকি প্রত্যেকের চিন্তা করা, লেখা ও কথা বলার অবাধ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অন্যের প্রতি সীমা লঙ্ঘন কোন ধরনের স্বাধীনতা, তা আমরা বুঝি না। স্বাধীনতার তো একটা সীমারেখা থাকতে হবে। আপনি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু অন্যের অধিকার খর্ব করার স্বাধীনতা তো আপনি পেতে পারেন না। আত্মরক্ষার জন্য আপনি আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবেন; কিন্তু এলোপাতাড়ি গুলি করে মানুষ হত্যা করার স্বাধীনতা আপনি পেতে পারেন না। এ সাদা কথাটুকু পশ্চিমা মিডিয়া, সভ্যতা ও বিবেক না বোঝার ভান করছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। আপনি শারীরিকভাবে আঘাত করে কাউকে আহত করতে পারেন। আবার মানসিকভাবে আঘাত করেও আহত করতে পারেন। উভয় আঘাতই অন্যায় ও নিন্দনীয়। কারও সামনে দাঁড়িয়ে তার বাবা-মাকে গালমন্দ করলে সে যে আঘাত পাবে, তা শারীরিক আঘাতের চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), যাঁর সম্মান ও মর্যাদা প্রত্যেক মুসলমানের কাছে নিজের বাবা-মায়ের চেয়ে অনেক বেশি, তাঁকে যখন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সম্মানহানি করা হয়, তখন তার আঘাত মুসলিম বিশ্বের ওপর চতুর্মুখী আক্রমণ পরিচালনার চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব জ্ঞানী-মনীষী, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও নেতা এবং বিশ্ববিবেককে এ ব্যাপারে জাগ্রত ও সোচ্চার হওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মুসলমানদের যথেষ্ট কুশলী হতে হবে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ মানুষ যখন ব্যাপক হারে ইসলামের দিকে ঝুঁকছে, তখন তাদের ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করার অসৎ উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় উগ্রবাদী তৎপরতা চালালে তারা নতুন প্রচারণার সুযোগ নিয়ে বলে, এ হলো ইসলাম। ইসলাম মানে সন্ত্রাস। তখন এরা নিজেদের পক্ষে বিশ্বজনমতের সহানুভূতি আকৃষ্ট করার সুযোগ পেয়ে যায়।

আমরা ভেবে হতবাক হই, বিশ্বসভ্যতার রূপকার মহানবীকে (সা.) নিয়ে এহেন গর্হিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বেলায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বা পশ্চিমা নেতাদের কোনো মন্তব্য প্রচারমাধ্যমে কেন এলো না। তার মানে গণতান্ত্রিক অধিকার ও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কি মুসলামানদেরও বলা হচ্ছে, তারাও ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তকের অবমাননা করে এর সমুচিত জবাব দিক? তা তো কিছুতেই হতে পারে না। কারণ মুসলমানদের কাছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর যে সম্মান, মর্যাদা ও ভালোবাসা, ইহুদি সম্প্রদায়ের নবী মুসা (আ.) ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নবী ঈসা (আ) এর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

আসুন বিকারগ্রস্ত বিবেকের পচন রোধ করে মহামানব নবী-রাসূলদের আদর্শ, শিক্ষা ও মহানুভবতায় আলোকিত মহিমান্বিত সত্য ও সুন্দরের পথে এগিয়ে যাই। বিশ্বকে ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, উত্তেজনা ও অশান্তির হাত থেকে রক্ষা করি।

আঠারো বছর বয়স : সুকান্ত ভট্টাচার্য


আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।

আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।

তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়–
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।


মানুষ হত্যা হয়। মানুষে মানুষ মারে। রাগে, লোভে, প্রতিশোধে—প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষ মারে। পুলিশ সহজে হিসাব দেয় না। ধারণা করি, বছরে সারা দেশে তিন থেকে চার হাজার মানুষ খুন হয়। বিচার বোধ হয় ৩০০-এর বেশি হত্যাকারীর হয় না। পুলিশ-রাষ্ট্র হিসাব দেয় না। আমরাও হিসাব চাই না। যার নিকটজন খুন হয়, সে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘোরে। একসময় হাল ছেড়ে দেয়। অন্য অনেক কিছুর মতো বেশির ভাগ খুনেরই হয়তো বিচার হয় না।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ৪২-৪৩ বছরে যত খুন হয়েছে, তার বোধ হয় ৫ শতাংশেরও বিচার হয়নি। যদিও এসব খুনের প্রতিটি ঘটনা ফলাওভাবে সংবাদমাধ্যমে আসে। বছর দশেক ধরে প্রথমে র্যা ব আর ক্রমান্বয়ে পুলিশ মানুষ মেরেই যাচ্ছে। গ্রাম পুলিশ, আনসার হত্যাযজ্ঞে এখনো যোগ দেয়িন। তাদের বন্দুক দিলে তারাও হয়তো পিছপা হবে না।
অবশ্য এর আগে ২০০২-এর অক্টোবর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ অভিযানে তৎকালীন সেনা, পুলিশ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর হাতে যাঁরা নিহত, আহত, পঙ্গু এবং অন্যান্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁরা কোনো আদালতে কোনো ধরনের বিচার চাইতে পারবেন না বলে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩ (২০০৩ সালের ১ নম্বর আইন) সংসদ পাস করেছিল। এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না বলে যে দায়মুক্তি আইনটি হয়েছিল, সেটা ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ, সংসদে পাস করা আইন নয়। বলা বাহুল্য, যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনটি পাস হয়েছিল গত বিএনপি সরকারের আমলে। সে সময়ের পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী সেই ‘অপারেশন ক্লিনহার্টে’ নিহত হয়েছিলেন ৫৭ অথবা ৫৮ জন।
ওপরের কথাগুলো প্রকারান্তরে অতীতের লেখায়ও উল্লেখ করেছি। কিছু কিছু ব্যাপারে পুনরাবৃত্তি দোষণীয় নয়, সে বিশ্বাস থেকেই পুনরাবৃত্তি।
২.
মানুষ মারা সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ। ঠান্ডা মাথায় মাঝরাতে কোনো নির্জন মাঠে নিয়ে গুলি করে মারা আরও নিকৃষ্ট। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন এবং খুন করে লাশ যেভাবে গুমের চেষ্টা হয়েছিল, সেটা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে যে সম্ভব, সেটা সেই ঘটনার আগে বেশির ভাগ মানুষই হয়তো বিশ্বাস করতে পারত না।
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী-রাজাকারদের দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাড়া ঘেরাও করে পেট্রল-কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য দেখেছিলাম। কিন্তু এখন নির্বিচারে বাস-ট্রাকের যাত্রী, চালক, হেলপারদের যেভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তাতে অতীতের সব বর্বরতা-নৃশংসতা প্রায় ম্লান হতে যাচ্ছে; পাকিস্তানি বাহিনী-রাজাকারদের পশুত্ব ছাড়া।
শিশুও রেহাই পাচ্ছে না, রেহাই পাচ্ছে না কেউই। রিয়াজ রহমানের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল তাঁকে গুলি করার পর। কয়েক মাস আগে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে গাড়িতে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
যারা নির্বিচারে আগুনে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারে, তারা তো মানুষ হতে পারে না। এ দেশে এত পশু কোথা থেকে এল?
তবু, দোহাই তোমাদের, এভাবে মানুষ মেরো না!
সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন, দয়া করে সমস্বরে বলুন, ‘এভাবে পুড়িয়ে মানুষ মারাকে আমরা ঘৃণা করি। এটা আমাদের রাজনীতি না।’
‘আমরা যাচ্ছি কোথায়’ শিরোনামে লেখায় মিজানুর রহমান খান (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি, পৃষ্ঠা ১০) গত কয়েক বছরের রাজনীতির হানাহানি, খুনের কিছু হিসাব তুলে ধরেছেন। সব খুনই জঘন্য, তবে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পুড়িয়ে মারা জঘন্যতম অপরাধ। দোহাই, এটা বন্ধ করো।
৩.
তবে এটাও ঠিক, হানাহানি বাড়বে। প্রশ্ন বা অমীমাংসিত ব্যাপার অন্য জায়গায়, হানাহানি কতটা বাড়বে। যা আছে, আগামী দু-চার সপ্তাহে তার তুলনায় অনেক কমে যাবে, অল্পস্বল্প কমবে, নাকি বেড়ে যাবে? আর যদি বেড়েই যায়, তাহলে সেটা কি অল্পস্বল্প বাড়বে, নাকি বাড়বে অনেক বেশি। ইদানীং বলাবলি, লেখালেখির জন্য অকাতরে মামলা হচ্ছে। রোগবালাইতে জীর্ণ ষাটোর্ধ্ব শরীর নিয়ে জেলবাসের কোনো বাসনাই অধমের নেই। তাই বলে বলা-কওয়া, লেখালেখি, সেমিনার-আলোচনা বাদ দিয়ে ঘরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকব, সেটাও সম্ভব নয়। তাই আগেভাগে ব্যাখ্যা।
সহিংসতা বাড়বে। তথ্য আছে, জানি, আমাকে কেউ বলে গিয়েছে, অতএব রিমান্ডে নিয়ে আচ্ছা করে ধোলাই দিলে সব জানা যাবে, বাবারে এসব কিছু না। বহু বছর ধরে বুঝে না–বুঝে ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি পড়েছি, কিছু কিছু আইনও। সেই সুবাদে তাত্ত্বিকবিদ্যা, যার সবটাই ভুল হতে পারে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত প্রধান দুই দলের (আওয়ামী লীগ আর বিএনপি) অবস্থান স্পষ্ট। তৃতীয় যে দল, অর্থাৎ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির ব্যাপারে এ কথা বলা যায় না। কেননা, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাদের অবস্থান এত ঘন ঘন পাল্টায় যে কোনো ব্যাপারে তাদের পজিশনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। অবশ্য একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়, কোনো ব্যাপারে আজকে তাদের যে অবস্থান, সেটা আগামীকাল না হলেও পরশু নিশ্চিতভাবে বদলাবে। এমন বিচিত্র দল খুব কম দেশেই পাওয়া যাবে। আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
মূল দলগুলোতে ফিরে যাই। মূল দুটি দল তাদের নিজ নিজ অবস্থান সার্বিক সর্বতো ও সর্বাঙ্গীণভাবে সঠিক বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এ কথায় বড় দাগে বলতে হলে অবস্থানগুলো এরূপ: আওয়ামী লীগ সর্বতোভাবে মনে করে যে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা পাঁচ বছর দেশ চালানোর ম্যান্ডেট জনগণের কাছ থেকে নিঃশর্তভাবে লাভ করেছে। তদুপরি বিএনপি-জামায়াত গং ক্ষমতা পেলে দেশের বারোটা বাজাবে। অতএব, শুধু ক্ষমতায় আসতে না দেওয়াই নয়, বরং দল হিসেবে ক্রমাগতভাবে দুর্বল করার চেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত একটা নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অন্যদিকে বিএনপি ও শরিক দলগুলো সর্বতোভাবে বিশ্বাস করে যে ৫ জানুয়ারিতে কোনো নির্বাচনই হয়িন। সরকার অবৈধ ও ফ্যাসিবাদী। অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক বা তত্ত্বাবধায়ক গোছের কোনো ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে হবে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ‘সঠিক’ নির্বাচন হলে তারা জিতবে। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ প্রতিদিনই ঘোষণা দিচ্ছে যে মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পরবর্তী নির্বাচন ২০১৯ সালে।
দুই দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রয়াত আব্দুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়া একসময় বেশ কয়েক সপ্তাহব্যাপী ‘সংলাপ-সংলাপ’ খেলা খেলেছিলেন। সে সময় ছাগলের তৃতীয় ছানার মতো ‘লাইভ টেলিভিশন’-এ অধম ধারাবিবরণী দিয়েছিলাম।
জলিল সাহেব আলোচনাকক্ষে প্রবেশ করছেন, মান্নান সাহেব আসছেন। এই তো মান্নান সাহেবকে দরজার সামনে দেখা যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি কত কী।
সুদূর অতীতে প্রায় ২০ বছর আগে কমনওয়েলথের স্যার নিনিয়ান, ২০১৩-এর শেষ দিকে জাতিসংঘের তারানকো প্রমুখ মধ্যস্থতাকারীও চেষ্টা-চরিত করেছিলেন। ফলাফল শূন্য।
অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় উভয় দলের অবস্থান এখন আরও অনেক বেশি অনড়। তার থেকেও বড় কথা, উভয়েই তাদের নিজ নিজ অবস্থানের যৌক্তিকতা ও সঠিকতা নিয়ে আরও বেশি দৃঢ়। এবং উভয়েই মনে করছে যে তাদের নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে প্রচুর জনসমর্থন রয়েছে। আর শেষত, এখন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে গেলে বা ছাড় দিলে সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল।
সংলাপ হবে না, কেউ ছাড়ও দেবে না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, নাইজেরিয়া, মিসর, কলম্বিয়া অনেক দেশে যে সহিংসতা দৈনন্দিন ব্যাপার, সেসব দেশের সরকারই কিন্তু ‘নির্বাচিত’। বিবিসি হিসাব দিয়েছিল, ওই সব দেশে শুধু নভেম্বর মাসে বোমা ইত্যাদি সহিংসতায় পাঁচ হাজারের বেশি নিরীহ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল।
এক কথায় বলতে হলে বলতে হবে, মূল কারণ হলো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অনড় অবস্থান। সরকারগুলো মনে–প্রাণে বিশ্বাস করে, দেশ রক্ষা করতে তাদের ক্ষমতায় থাকতেই হবে। আর তাদের বিরোধীরা সমদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সরকারকে হটাতেই হবে। আর হটানোর জন্য গণতান্ত্রিক পথ বন্ধ প্রায়। তাই যেকোনো পন্থাই জায়েজ। ফলাফল, অনবরত সহিংসতা। আর প্রধান দলগুলোর হানাহানির কিছু সময় পর ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান। ফলে আরও বেশি রক্ত। গত মাসে পাকিস্তানে স্কুলে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় এক এক করে গুলি করে প্রায় ১৫০ ছাত্রছাত্রী হত্যা।
অনড় অবস্থানে থাকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। সেই অনড় অবস্থা জন্ম দেয়, সুযোগ করে দেয় সন্ত্রাসী জঙ্গিদের।
যারা সরকারে থাকে, তারা সব সময়ই মনে করে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগানো যাবে। আর এত ন্যক্কারজনকভাবে ফৌজদারি বিচার ্যবস্থার অপব্যবহার, অপপ্রয়োগ অতীতে কখনোই হয়নি। লোকমুখে শুনেছি, সত্য-মিথ্যা জানি না, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে নাকি এখন ৭৮টি মামলা আছে। অর্থাৎ সরকার সর্বতোভাবে বিশ্বাস করে উনি চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, বোমাবাজ, বোমার কারিগর, পেট্রলবোমা মেরে লোক পোড়ান, দেশদ্রোহী এবং আরও অনেক কিছু। না-হলে এত মামলা কীভাবে হয়?
অবস্থান অনড় থেকে অনড়তর হচ্ছে। আলাপ-আলোচনা, ছাড়, মধ্যস্থতা—এসবের সব সম্ভাবনা এখন তিরোহিত। ঠিক একই রকম অবস্থা বহু দেশে হয়েছে। ফলাফল, ক্রমবর্ধমান সহিংসতা।
তাই শেষের কথা, সহিংসতা আমাদের পিছু ছাড়বে না, যত দিন অবস্থান অনড় থাকবে।
তাই প্রশ্ন শুধু মাত্রা নিয়ে। তবু আবেদন করজোড়ে—দোহাই, মানুষ পোড়াবেন না। মানুষ পোড়ালে দেশ পুড়বে। আমরা সবাই ছারখার হয়ে যাব।
এটাও সত্য, পুলিশ এই আগুন নেভাতে বা সামাল দিতে পারবে না।

@ ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, স্কুল অব ল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

Friday, 16 January 2015

Still I Rise 

                        © Maya Angelou 
You may write me down in history
With your bitter, twisted lies,
You may trod me in the very dirt
But still, like dust, I'll rise.

Does my sassiness upset you?
Why are you beset with gloom?
'Cause I walk like I've got oil wells
Pumping in my living room.

Just like moons and like suns,
With the certainty of tides,
Just like hopes springing high,
Still I'll rise.

Did you want to see me broken?
Bowed head and lowered eyes?
Shoulders falling down like teardrops.
Weakened by my soulful cries.

Does my haughtiness offend you?
Don't you take it awful hard
'Cause I laugh like I've got gold mines
Diggin' in my own back yard.

You may shoot me with your words,
You may cut me with your eyes,
You may kill me with your hatefulness,
But still, like air, I'll rise.

Does my sexiness upset you?
Does it come as a surprise
That I dance like I've got diamonds
At the meeting of my thighs?

Out of the huts of history's shame
I rise
Up from a past that's rooted in pain
I rise
I'm a black ocean, leaping and wide,
Welling and swelling I bear in the tide.
Leaving behind nights of terror and fear
I rise
Into a daybreak that's wondrously clear
I rise
Bringing the gifts that my ancestors gave,
I am the dream and the hope of the slave.
I rise
I rise
I rise.

Thursday, 15 January 2015

প্রহসন ও পোড়ামাটি নীতির রাজনীতি -- ড. রাশিদ আসকারী

খালেদা জিয়া ও অমিত শাহ’র কথিত ফোনালাপ নিঃসন্দেহে জনমত জরিপে বছরের সেরা রাজনৈতিক প্রহসন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠবে। বিএনপি নেত্রীর প্রেস সেক্রেটারির বরাতে সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকভাবে বিধৃত এই ফোনালাপের সংবাদ কেবলমাত্র চায়ের কাপে ঝড়ই তোলেনি, পুরো দেশের অবরোধ-উত্তপ্ত রাজনীতির আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়ার উপক্রম করতে বসেছিলো। কম কথা নয়! ভারতের সরকারি দলের খোদ সভাপতি স্বপ্রণোদিত হয়ে পিপার স্প্রে পীড়িত প্রতিবেশী দেশনেত্রী’র শারীরিক কুশলাদির খোঁজ-খবর নিয়েছেন, তাঁর দ্রুতারোগ্য কামনা করেছেন। এটা কেবলই রাজনৈতিক সৌজন্য নয়, এর ভেতরে সুস্পষ্ট সমর্থনের আলামত আছে- যা বর্তমানে ‘অবরুদ্ধ’ বিএনপি নেত্রীর জন্যে অক্সিজেনের মতো কাজ করবে বলে মনে করা হয়েছিলো। কিন্তু পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। ‘ছিদ্রান্বেষী মিডিয়াম্যানেরা’ কারো মঙ্গল সহ্য করতে পারে না। দুই রাজনৈতিক নেত্রীর সৌজন্যমূলক ফোনালাপের মধ্যেও তারা সত্যাসত্যের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করেছেন এবং অনুসন্ধান শেষে কোনো রকম রাখ ঢাক না করেই একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছেন। দু-দুটো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংযোগে ভেসে-এসেছে খোদ অমিত শাহের কণ্ঠস্বর: ‘It’s a rumour’, ‘It’s fake news’. কল্পনার হাওয়ায় ফোলানো বেলুন সত্যের খোঁচায় সশব্দে ফেটে গেলো। এই বেলুন না ফাটলে কতোটুকু লাভ হতো জানি না, কিন্তু ফেটে যাওয়ায় সীমাহীন ক্ষতি হলো বেলুন আয়োজকদের। একেই বলে প্রহসনের রাজনীতি। এই হাস্যকর প্রহসন একটি রাজনৈতিক দলের চরম অসহায়ত্ব এবং দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। কি দরকার ছিলো এমনটি করার? বিএনপির রাজনৈতিক অর্জন কি এমনি তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে যে কর্মী-সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে কল্পকাহিনীর আশ্রয় নিতে হবে। আর এটি কেবল একমাত্র ঘটনা নয় যে, অত্যুত্সাহী অর্বাচীন প্রেস সেক্রেটারির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারতো। বস্তুত, দীর্ঘ ক্ষমতা-উপোসী, সংক্ষুব্ধ, অনন্যোপায় বিএনপি চেইন বিক্রিয়ায় এরকম প্রহসনের জন্ম দিয়ে চলেছে। অবরুদ্ধ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস যে সংবাদ পরিবেশন করেছিলো তাও পরে অসত্য প্রমাণিত হয়েছে এবং পত্রিকাটি দুঃখ প্রকাশ করে তা প্রত্যাহার করেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিও উক্ত বিবৃতিকে বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছে। এ ধরনের মিথ্যে-বিবৃতির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে জনমত সৃষ্টির যে অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে যে উচ্চ বেতনভুক গোয়েবল্সীয় প্রোপাগাণ্ডা চক্র জড়িত- তারাই যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখেছিলেন এবং কাবাঘরের গিলাফ নিয়ে তার মুক্তিমিছিলের কাহিনী রচনা করেছিলেন। খালেদা-অমিত শাহ’র ফোনালাপ কাহিনীও যে এই চক্রেরই উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত তা ভাবা মোটেও অসঙ্গত নয়। “All is fair in love and war”. প্রেমে এবং যুদ্ধে নাকি-সবই সুন্দর, সবই সমর্থনযোগ্য। বিএনপি জামায়াত যৌথভাবে যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে যে যাই বলুক না কেনো, ক্ষমতার প্রেমে, কিংবা ক্ষমতা পুনর্দখলের যুদ্ধে জোটবদ্ধ বিএনপি সুন্দরই জ্ঞান করছে। তাই ফোনালাপের প্রহসন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও বেগমের প্রেস সচিব তা প্রত্যাখ্যানের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিএনপিকে কেনো এই প্রহসন নাটক মঞ্চস্থ করতে হচ্ছে? স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক ধারা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে দলটির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাও রয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা একজন বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এইসব বিবেচনা এখন দলটির বর্তমান প্রেক্ষাপটে, একেবারে গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে নির্বাচনী ঐক্য দলটিকে এমনই এক অসহায় অবস্থানে নিয়ে গেছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রায় ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার প্রশ্নেও দলটিকে মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে হচ্ছে। সম্পূর্ণ জামায়াত নির্ভরতার কারণে বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা দলটির এ যাবত্কালের সবচেয়ে বড়ো ভুল বলে গণ্য করা হচ্ছে ।বস্তুত, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ভূত বিএনপির ঘাড়ে স্থায়ীভাবে চেপে বসেছে। তাই নব্বইয়ের গণআন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজপথ উত্তপ্ত করার যে ঐতিহ্য, তা ভুলে আন্ডারগ্রাউন্ড জঙ্গি জিহাদীদের মতো চোরাগুপ্তা হামলার রাজনীতিতে মুক্তির পথ খোঁজা বিএনপির রাজনীতির জন্যে কতোটুকু লাভজনক হচ্ছে— তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। আর গণবিচ্ছিন্ন এবং সন্ত্রাসনির্ভর গুপ্ত রাজনীতির একটি বিশেষ দিক হলো প্রোপাগান্ডা। আত্মশক্তি এবং প্রকাশ্য রাজনীতির ক্ষমতা হারিয়ে, বিএনপি যদি ক্রমাগত এ ধরনের প্রোপাগান্ডা রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে তা হলে বিএনপির জন্যে তো বটেই, দেশের রাজনৈতিক চরিত্র ও গণতন্ত্রের জন্যে তা অমঙ্গল বয়ে আনবে। সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে, কিংবা কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানিয়ে রাখা যায়। কিন্তু, সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।

প্রোপাগান্ডায় ইন্ডিয়া কার্ড ব্যবহার বিএনপি-জামায়াতের যৌথ রাজনীতি চর্চার একটা পুরনো দিক। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর থেকেই বাংলাদেশি রাজনীতির একটি অংশ জনগণকে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে আসছে। ভারত সমর্থিত রাজনীতি এ দেশে ক্ষমতায় বসলে বাংলাদেশ ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিগণিত হবে; মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। এরকম প্রোপাগান্ডা শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পরও সেই প্রোপাগান্ডার বাস্তবায়ন দেখেছে, এমন মানুষও পাওয়া যাবে না। এবং সম্ভবত যে কারণেই রাজনীতি ভারত কার্ড প্রদর্শনকারীরা এবারে কার্ডের উল্টো পিঠ দেখানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। কংগ্রেসাধীন ভারতীয় জুজু এখন বিজেপি-অধীন শুভানুধ্যায়ীতে পরিণত হয়েছে। অসুস্থ নেত্রীর খোঁজখবর নিচ্ছে। বস্তুত, ভারতের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে পালাবদল প্রত্যাশীরা নতুন সমীকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সমীকরণ স্বাভাবিক নিয়মে না মেলায় তারা কাল্পনিক সংখ্যাযোগে হিসাবে মেলাতে চায়। বিজেপি কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ, কংগ্রেস আওয়ামী লীগের মিত্র, আবার বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ, অতএব বিএনপি কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ এবং বিজেপি’র মিত্র। এই সরল সমীকরণ মিলিয়ে ‘সত্য হওয়া স্বাভাবিক’ ধরনের একটি কল্পকাহিনী তারা প্রচার করে। কিন্তু গোয়েবলসে্র যুগ আর এখন নেই। ঘটনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের রকমারি পন্থা এখন সাধারণ মানুষের হাতে। তবে খালেদা-অমিত প্রোপাগাণ্ডা ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ায় দল বিশেষের রাজনৈতিক সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জটিল ডিনামিক্স্ নিয়ে সৃষ্ট অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। ভারতের মতো উদীয়মান একটি পরাশক্তির অভ্যন্তর ক্ষমতা বদল যে তাদের প্রতিবেশী নীতি বা পররাষ্ট্র নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনে না তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আরেকটি জিনিস স্পষ্টীকৃত হয় যে, বাংলাদেশে ‘ভারত কার্ড’ ব্যবহারের দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে স্বদেশের নীতি-আদর্শ মূল্যবোধের আলোকেই, আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েই রাজনীতি করতে হবে। ভিন্নদেশের দারস্থ হয়ে নয়।

প্রোপাগান্ডার রাজনীতি আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে, কিন্তু তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ক্ষতি হয় হরতাল অবরোধের রাজনীতিতে। গণস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কারণে হরতাল অবরোধ করার সকল অধিকার সংরক্ষণ করে একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেই রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের নামে সীমাহীনভাবে অবরোধ চালিয়ে যাওয়া, যাত্রীপূর্ণ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঘটানো, বিশ্ব ইজতেমার মতো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করা কোন রাজনৈতিক অধিকার পদবাচ্য তা অবরোধকারীরাই জানেন। বাংলাদেশের টপ বিজনেস চেম্বারের হিসাবমতে, অবরোধ শুরুর পর থেকে কেবলমাত্র পরিবহন খাতেই প্রতিদিন প্রায় ২৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতি হচ্ছে। সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে দূরপাল্লার যাত্রীরা। বিলাপে মেতেছে কৃষকেরা ক্ষেতভর্তি পচা সবজি নিয়ে। আতংকের প্রহর গুনছে অভিভাবকেরা স্কুল-পড়ুয়া সন্তানদের ফেরার পথ চেয়ে । অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ আর আশংকার পাশাপাশি চলমান হরতাল ও অবরোধের কারণে অর্থনীতির সবখাত মিলে প্রতিদিন অন্তত ষোল ’শ থেকে দু’হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে গত দশ দিনের রাজনৈতিক সংঘাতে দেশের আর্থিকখাতেই ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমানের আশাতীত প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় নিয়ে কতোক্ষণ তুষ্ট থাকা যাবে? গার্মেন্টস খাতে ইতোমধ্যেই অশনি সংকেত দেখা দিতে যাচ্ছে। শত সংকটের ভেতরেও ধীরে ধীরে মধ্য আয়ের দেশের দিকে অগ্রসরমান একটি দেশের জন্য- এই অনন্তকালব্যাপী অবরোধ কি আত্মহত্যার শামিল নয়?

কিন্তু কিভাবে রোধ করা যায় এই জাতীয় আত্মহনন? অবরোধকারীদের দাবি মেনে নিলেই কি সব সমস্যার তেলেসমাতি সমাধান হবে? ‘নিহত গণতন্ত্র’ পুনরুদ্ধারের যে শ্লোগান তারা তুলেছে তার পুরোটা জুড়ে আছে তাদের ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি। দেশে উন্নয়নের প্লাবন এলেও তারা সন্তুষ্ট হবে না। নির্বাচিত হওয়ার অধিকার তাদের আছে। আবার জনমত সংগঠিত করে নির্বাচন এগিয়ে আনার অধিকারও তাদের আছে। এ-দুটোই নির্ভর করবে তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর, কোনো হঠকারি, দায়িত্বহীন সহিংস কর্মসূচির ওপর নয়। যারা এই নকশালী ধারার আন্দোলনের চালিকাশক্তি— তারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চায় বলে মনে হয় না।  বিএনপি’র নিজেদের ভেতরেও অনেকের এই স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি দৌরাত্ম নিয়ে অস্বস্তি আছে। সব মিলে গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উভয়কেই একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় এখন জাতির। সে প্রশ্নে জাতির সামনে এক ক্রান্তিকাল-বিরাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধ চর্চার নামে যেমন- গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না, আবার গণতন্ত্র চর্চার নামে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায়িত করা যাবে না। এই দায় সরকারের ওপরই বর্তায় বেশি। সরকারেরই উচিত একদিকে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে একেবারে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা। প্রোপাগান্ডা ও পোড়ামাটি নীতির সহিংস রাজনীতি ছেড়ে এবং এসবের হোতা-স্বাধীনতাবিরোধী-জামায়াত-শিবিরের সঙ্গ ছেড়ে বিএনপিকে যেমন একাত্ম হতে হবে মুক্তিযুদ্ধ-প্রিয় গণমানুষের সাথে, করতে হবে প্রকাশ্য রাজপথের রাজনীতি, সরকারি দল আওয়ামী লীগকেও তেমনি উদার গণতন্ত্র চর্চার পথ সুগম করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য অহিংস বিরোধী রাজনীতির অনিবার্যতার কথা বলা আছে। গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ এই অহিংস রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের বিকাশের পথ রচনা- সরকারি ও অসরকারি উভয় ঘরানার রাজনীতির- আশু কর্তব্য।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক