আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিস্তম্ভ। এশফিল্ড পার্ক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ২০০৬ সালে এর উদ্বোধন করা হয়
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ভাষা শিক্ষার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। তবে স্থান-কাল-জাতিভেদে মানুষের ভাষা ব্যবহারের বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এ বৈচিত্র্যের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং মানবজাতির জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় নিদর্শন। আল্লাহ বলেছেন, 'আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম নিদর্শন আকাশ, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।' (সূরা রোম : ২২)। পবিত্র কোরআনের এ আয়াতে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই মানবজাতির মধ্যে ভাষার বৈচিত্র্য প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ যেহেতু এমনটি চেয়েছেন, তাই পৃথিবীর যে কোনো ভাষাই আল্লাহর বিশেষ উদ্দেশ্যেরই বাহক বলা চলে। তাই কোনো ভাষাকেই অমর্যাদা করা সঙ্গত নয়। তবে এক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রাধান্য স্বীকৃত। যে ভাষা যার মাতৃভাষা বা জন্মসূত্রে যে ভাষা অর্জন করেন, তার কাছে সে ভাষাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করতে হবে। এর পরে অন্য ভাষার অবস্থান।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক তা হলো, মুসলমান হিসেবে আমাদের কাছে আরবি ভাষার গুরুত্ব থাকা উচিত কিনা। এক্ষেত্রে আমার বিবেচনা হচ্ছে, নিশ্চয়ই আমাদের কাছে আরবি ভাষা একান্ত জরুরি; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মাতৃভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে নয়। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে এ সমাজে যদি বসবাস করতে হয়, তাহলে বাংলাকে ভালো করে আয়ত্ত করা জরুরি বলে মনে হয়। মনে রাখা দরকার, ভাষা একটি মাধ্যম মাত্র। আল্লাহর ভাষা বলতে কিছু নেই। আবার আল্লাহর ভাষার বাইরেও কিছু নেই। আল্লাহ সব ভাষাই জানেন ও বোঝেন। যে ভাষাতেই তাকে ডাকা হোক না কেন তিনি তা শুনবেন।
বিশেষ কারণে আল্লাহ বিশেষ কোনো ভাষাতে তাঁর বাণী বা প্রত্যাদেশ প্রদান করেছেন। কোনো বিশেষ ভাষার প্রতি দুর্বলতার কারণে নয়। আল্লাহ সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই তাঁর বার্তাবাহক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেক রাসূলের কাছেই তাঁর তথ্য রাসূলের স্বজাতির ভাষায়ই কিতাব বা প্রত্যাদেশ প্রদান করেছেন। হজরত ঈসা (আ.) এর মাতৃভাষা ছিল হিব্রু এরামাইক। এসব দেশের এক ধরনের আঞ্চলিক ভাষা। তথাপি ওই আঞ্চলিক ভাষাতেই তার কাছে ইঞ্জিল কিতাব অবতীর্ণ হয়। আগেই বলেছি, ভাষার মূল কাজ হচ্ছে মনোভাব প্রকাশ করা। এটি একটি মাধ্যম। আল্লাহ তাঁর রাসূলদের কাছে তাঁর মনোভাব জানিয়েছেন। আল্লাহ পরম জ্ঞানী। তিনি সব ভাষা জানেন। কিন্তু মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। তাই মানব সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্য থেকে তাঁর মনোনীত প্রতিনিধির মাতৃভাষাতেই আল্লাহ তার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। আল্লাহ তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি রাসূলের মাতৃভাষাতেই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন।
পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় কেন নাজিল হয়েছে, তার উত্তর স্বয়ং আল্লাহই প্রদান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা.) কে বলেন, 'আমি তোমার ভাষায় কোরআন সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তার দ্বারা সাবধানিদের সুসংবাদ দিতে পারো ও তর্কপ্রিয় সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারো।' (সূরা মরিয়ম : ৯৭)।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাই কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। মুহাম্মদ (সা.) নিজে যদি না বুঝতেন তাহলে তিনি মানবজাতিকে তা বোঝাতে পারতেন না। নিজে বোঝার পরে প্রাথমিকভাবে তাঁর জাতিকে বা চার পাশের লোকজনকে বোঝানো প্রয়োজন। তাদের ভাষাও যেহেতু আরবি, তাই তাদের বোঝানোর জন্যও কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার দরকার ছিল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, 'আমি যদি আজমি (অ-আরবি) ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করতাম, ওরা অবশ্যই বলতো এর আয়াতগুলো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হবে না কেন? কিতাবের ভাষা আজমি আর রাসূল আরবীয়'। (সূরা ফুসিলাত : ৪৪)
বস্তুত ইসলামের আদর্শ যদি বুঝতে হয় অথবা কাউকে বোঝাতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাকে তার মাতৃভাষাতেই তা বোঝা ও বোঝানো সুবিধাজনক।
লেখক : ড. মোঃ শওকত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পড়াই প্রথম বাণী । পড়ার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে আমার প্রচেষ্টা । কবিতা আমার ভীষণ প্রিয় । Poetry touches my mind, moves me and makes me and forget self. তাই আমার প্রিয় কিছু কবিতা, প্রবন্ধ ও আরো কিছু বিষয় দিয়ে সাজিয়েছি আমার এ বর্ণমালার ঊচ্চারনের ব্লগ । এখানে বেড়াতে এসে যদি আপনার মনে সামান্য প্রশান্তির ছোঁয়া লাগে, তবে ভাববো আমার প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে ।
Saturday, 28 February 2015
যুদ্ধাপরাধীদের কুকীর্তি : শিশুপাঠ্য হলে কেমন হয় ?
একঃ কারো বিরুদ্ধে আদালতে ‘বিচারাধীন অভিযোগ’ এবং সেই অভিযোগ শুনানির শেষে ‘আদালতের রায়’, -এ দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ‘অভিযোগ’ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে। কিন্তু ‘আদালতের রায়’ প্রতিষ্ঠিত সত্য, তা অস্বীকার, উপেক্ষা বা সমালোচনা করাটা অপরাধ। আধুনিক কালে পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই এই রীতি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ এ রাজাকার, আল-বদরেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করতে যেয়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল। খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্মান্তর, বাড়ীঘর জ্বালানো-পোড়ানো আরো কত কি! এই সত্যগুলো একশ্রেণীর মতলববাজ-দেশদ্রোহী-কুরাজনীতিক গত তেতাল্লিশ বছর অস্বীকার করতে চেয়েছে। সেই ‘সত্য-অস্বীকারের’ রাজনীতিতে (!) তাদের সাফল্যও কিছু কম নয়। কিন্তু আজ আর সেটা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধ বিচার মামলার রায়গুলো এ সত্যকে আইনি ও সামাজিকভাবে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উদাহরণস্বরূপ বলি, মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল রাজাকার শিরোমনি গোলাম আজমের মামলার রায়ে উল্লেখ করেছেন, গোলাম আজম একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের পেছনের মূলব্যাক্তি, তিনি শান্তিবাহিনী গঠনের নেপথ্য নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বাংলাদেশে যে ‘ম্যাসিভ জেনোসাইড’ হয়েছে, গোলাম আজম তার ‘মাস্টার মাইন্ড’। তার বিরুদ্ধে আদালতে সন্দেহাতীতভাবে যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ৩৮জনকে একসাথে হত্যার নির্দেশদান অন্যতম। সিরু মিয়াদের অপরাধ ছিল, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিতে আগ্রহী যুবকদের এবং জীবনের ভয়ে ভীত সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভারতে যেতে সহযোগীতা করেছিল। তো গোলাম আজমের বিরুদ্ধে এই কথাগুলো এখন আর নালিশ নয়, ঐ অপকর্মগুলো সে করেছে, এটা আদালতের রায়ে এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য।
ঢাকার মিরপুরের কসাই নামে খ্যাত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্যার বিরুদ্ধে আদালতে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত ঐ অভিযোগগুলোর মধ্যে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে হত্যার নির্দেশ, কবি মেহেরুন্নেচ্ছা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্পহাউজে নিয়ে জবাই করে হত্যা, মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যা, হজরত আলী লস্করকে তার স্ত্রী, দুইকন্যা এবং দুই বছরের শিশুপূত্রসহ হত্যা ছাড়াও আলী লস্করের মেয়েদের ধর্ষণের অভিযোগগুলো রয়েছে। তো কাদের মোল্যা একজন ধর্ষক, হত্যাকারী, এটাই এখন দিবালোকের মত সত্য!
পিরোজপুরের দেল্যু রাজাকার ওরফে মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী’র বিরুদ্ধে আদালতে ৮টি অভিযোগ সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম, (১) ১৯৭১ সালের ৭ই মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে পারেরহাট বাজারে হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের দোকান ও বাড়ীতে লুটপাট চালায় এবং মাখনলাল সাহার দোকান থেকে ২ কেজি স্বর্ণ লুট করে। (২) ১৯৭১ সালের ৮ই মে সাঈদী বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খান ও তার ছেলেকে পাকিস্থানী সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়, যারা আর কখনও বাড়ী ফেরেনি। (৩) ১৯৭১ সালের ২রা জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার চিত্তরঞ্জন, জহর তালুকদার, হরেন ঠাকুর, অনিল মন্ডল, বিসাবালি, শুকাবালী, সতীশ বালাসহ প্রায় ২৫টি বাড়ীতে আগুন দেয় এবং বিসাবালিকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। (৪) তখনকার টগবগে যুবক দেল্যু রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে হোগলাবুনিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় শেফালী ঘরামির ঘরে ঢুকে তাকে উপর্যুপরি গণধর্ষণ করে। পরবর্তীতে অন্য আরেকদিন সাঈদীর নেতৃত্বে ১০/১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ী থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কমল রাণীকে ধরে পাকিস্তানী সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে টানা তিনদিন গণধর্ষণের পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। (৫) পারেরহাট ও আশপাশের গ্রামের মধুসুদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, অজিত শীল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, হরি রায়সহ প্রায় ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় এবং তাদেরকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হয়। এগুলো হলো সাঈদী কু-কীর্তির ‘আদালতে প্রমাণিত’ কয়েকটি নমুনা।
১৯৭১ এ মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকেরই বিচার শেষ হয়েছে বা চলছে। যাঁদের বিচার শেষ হয়েছে এবং যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণ হয়েছে, সেগুলো আর অভিযোগ নয়, তা প্রমাণিত সত্য।
দুইঃ “আম্মার হাতের তালের পাখা” আর “যাদব বাবুর পাটিগণিত” -এই দুটোর ডরে শৈশবে সদা টটস্থ থেকেছি। নানান অজুহাত তৈরী করে আম্মা তালের পাখাগুলো আমার পিঠে ভেঙ্গেছেন। ‘জামার বোতাম উপরেরটা খোলা কেন’, ‘পড়ার টেবিলের নিচে ফুটবল কেন’, ‘পশ্চিমপাড়ার ঐ দুষ্টু ছেলেগুলোর সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলি কেন’, ‘হাঁটার সময়ে পায়ের গোড়ালি মাটিতে ঠিকমত পড়লোনা কেন’, ইত্যাদি নানান কারণ সৃষ্টি করে আম্মা পেটাত। সন্তান শাসনে (পেটানোতে) আম্মার উদ্ভাবনী ক্ষমতা নোবেল পাওয়ার দাবী রাখে। শৈশব-কৈশরে মায়ের ঐ পিটুনিগুলো অত্যাচার মনে হলেও আজ মধ্য বয়সে এসে বেশ বুঝতে পারি, জীবন গঠনে ঐ ‘তালের পাখার পিটুনি’ কতটা সহায়ক ভুমিকা রেখেছে।
পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিশেষ যন্ত্রণা দিতে পারেনি, তবে ক্লাশ সিক্স থেকে শুরু হলো ‘পাটিগণিত আতঙ্ক’! বৎসর ঘুরে শ্রেণী যত এগোয় অর্থাৎ ক্লাস সেভেন, এইট, নাইন, -পাটিগণিত ততই জটিল আকার ধারণ করে। ল.সা.গু, গ.সা.গু, সরল অঙ্ক, সুদকষা, ঐকিক নিয়ম, চলিত নিয়ম, আরো কত জটিল সব অঙ্ক। ‘অঙ্কে কম নম্বর পেলে তালের পাখা আস্ত থাকবেনা’, আম্মার এটা প্রকাশ্য ঘোষণা। ‘যাদব বাবু’ দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন, তাঁর বাবা-মায়ের গৃহশিক্ষক রাখবার ক্ষমতা ছিল না। তিনি যদি পাটিগণিতে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পারেন, তবে ‘আম্মার ছেলে’ পারবে না কেন ? অকাঠ্য যুক্তি মায়ের!
আমিও আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি পাটিগণিতের লাগাম ধরতে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দিস্তা দিস্তা কাগজ অঙ্ক কষে শেষ করেছি। ইতিহাস, ভুগোল, ইংরেজী, বাংলা (দ্বিতীয়পত্র) ইত্যাদি সাবজেক্টগুলোতে যতটা সময় ব্যয় করেছি, তার দশগুন সময় ঢেলেছি পাটিগণিতের পেছনে। কিন্তু গণিত অধরাই থেকেছে সব সময়। সকালে মিললো তো রাতে ভুলেছি, সুদকষাটি পারলাম তো ঐকিক নিয়মটি মিলছেনা। শৈশব-কৈশরে ‘পাটিগণিত’ ছিল এক অসহনীয় মানষিক চাপ ও যন্ত্রণা, যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক!
পাঠক, ‘পাটিগণিত আতঙ্কে’ কি শুধু আমারই শৈশব কেটেছে, আপনাদের নয়? নিশ্চয়ই আপনাদেরও আমারই মত অভিজ্ঞতা আছে (কিছু কমবেশী)। আজকের এই পরিনত বয়সে গণিতের সেই নিয়ম-কানুনগুলো হুবহু আপনার স্মরণে আছে কি? শৈশবের সেই ‘সরল অঙ্কটি’ যে নিয়ম মেনে শিখেছিলেন, তা কি আজ হুবহু মনে করতে পারেন? পারবেন কি আজ সেই ঐকিক নিয়মের অঙ্কটি মিলিয়ে দিতে? আসলে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা পাটিগণিতের শাখায় শাখায় বিচরণ করেছি, আজ আর হুবহু তা মনে নেই।
পাটিগণিত গ্রন্থখানির প্রণেতা যাঁরা, অর্থাৎ যাঁরা গ্রন্থখানি পাঠ্য তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন, তাঁরা কি জানতেন না যে গনিতের ঐ ফরম্যাটগুলো পরিনত বয়সে আমরা বেমালুম ভুলে যাবো? নিশ্চয়ই তাঁরা তা জানতেন। তাহলে কেন গ্রন্থপ্রণেতারা পাটিগনিতকে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে আমাদের শৈশব-কৈশর যন্ত্রণাদায়ক করে তুলেছিলেন? আমি বলবো তাঁরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই সঠিক কাজটি করেছিলেন। শৈশবে ঐ অঙ্ক শেখানোর নাম করে ‘সমস্যাগুলোকে’ আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং তা ঐকিক, চলিত, সুদকষা ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে আমাদের দিয়ে সমাধান করিয়ে নিয়েছেন। আসলে ঐ শৈশবেই তাঁরা আমাদের মগজ-ধোলাই করে দিয়েছেন। অঙ্কশাস্ত্রের মাধ্যমে ‘কঠিন সমস্যাগুলো’ সমাধান করিয়ে মস্তিস্কের চিন্তাগ্রন্থিগুলোকে খুলে দিয়েছেন। আজ আর আমাদের সুদকষা বা চলিত নিয়মের প্রথাগত নিয়ম স্মরণে নেই, কিন্তু জীবনের জটিল অঙ্কগুলো মেলাবার জন্য মস্তিস্ক তৈরী হয়ে আছে। শৈশবের সেই ‘গাণিতিক জ্ঞান’ আজ আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। ‘গণিতের সমাধান’ বা ‘মায়ের তালের পাখার পিটুনি’র মত শৈশবের শিক্ষাগুলো আমাদের অবচেতন মনকে তাড়িত করে এবং বর্তমান জীবন-চলার পথকে নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। মোটাদাগে বলা যায়, পরিনত বয়সে ব্যক্তির বিচার-বোধ, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান, তার শৈশবের বেড়ে উঠার ধারাবাহিকতা মাত্র।
শেষকথা ঃ
পাঠক, বলছিলাম ‘পাটিগণিত’ এবং ‘মাতৃশাসনের’ কথা। অর্থাৎ শৈশবেই নিয়ম-শৃংখলা, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ এগুলো মগজে-মমনে ঢুকিয়ে দেবার প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে আজকের যারা শিশু-কিশোর, তারাও কিন্তু আপনার আমার মতই ‘গণিত’ ও ‘পারিবারিক শাসন’ কাঠামোর মধ্যেই বড় হচ্ছে। ভবিষ্যত জীবনের জন্য তারা একটু একটু করে অভিজ্ঞতা ও জীবন-দর্শন প্রতিদিন অর্জন করছে। আজকের দিনের শিশুকে যেটা শেখানো হচ্ছে, আগামী দিনে সে তার পথচলায় তারই প্রতিফলন ঘটাবে।
আমরা প্রায়সই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অদর্শতো মূর্তিমান নয়, তাতো দেখা যায়না, হাত দিয়ে স্পর্শও করা যায় না, -সেতো বিমূর্ত, অনুভব করবার বিষয়! চেতনাটি আসলে মননে থাকতে হবে, এটি অন্তরে ধারণ করার বিষয়। কিন্তু কেমন করে সেটি সম্ভব?
আজকের যারা শিশু-কিশোর ভবিষ্যত বাংলাদেশের তারাই চালক। আমরা যদি শৈশবেই এই ভবিষ্যত চালকদের মগজে যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মগুলো ঢুকিয়ে দিতে পারি, তাহলে শিশুদের মনে ঐ কুলঙ্গারদের প্রতি ঘৃণা স্থায়ীভাবে গেঁথে যাবে। আপনি আর আমি আজ যেমন পাটিগণিতের নিয়ম হুবহু মনে করতে পারি না কিন্তু জীবনের অংক ঠিকই বুঝতে পারি অথবা মায়ের পিটুনির ব্যাথা আজ আর অনুভব করি না, কিন্তু তাঁর শেখানো সেই শৃংখলাবোধ দিয়েই আজও প্রতিনিয়ত জীবন পরিচালনা করি।
আদালতে প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের ঐ অপকর্মগুলো পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করে শিশুদের মগজে যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধটি কি এবং কেন, এর বিপক্ষে কারা ছিল, তারা কি ধরণের অপকর্মগুলো করেছিলো, -শিশুদের মননে সেগুলো স্থায়ীভাবে গেঁথে যাবে। একই সাথে কেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছিল, কাঁরা তা করেছিল, তাঁদের কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল, -আগামী দিনের ভবিষ্যত নাগরিকেরা ঐ পাঠ্যপুস্তক থেকেই সেই জ্ঞানও অন্তরে ধারণ করবে। বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলের পাশাপাশি ‘নিজ দেশের জন্ম ইতিহাস’ জ্ঞানধারী ঐ শিশুকে আর দেশপ্রেম শেখাতে হবেনা। সে তার পরিনত বয়সে কখনওই ‘দলবাজি’ করবেনা, শুধুই ‘দেশবাজি’ করবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যুদ্দাপরাধীদের অপকর্ম, নির্যাতন, ধর্ষণ, বাড়ীঘর জ্বালানো-পোড়ানোর ঘটনাগুলি যদি পেশাদার লেখকদের দিয়ে সুখপাঠ্য করে লিখিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘অবশ্য পাঠ্য’ করা হয়, তাহলে অবশ্যই ভবিষ্যত বাংলাদেশে ‘অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে’ -এমন একটি জাতি গঠন করা সম্ভব। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত কর্তাব্যাক্তিরা বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তকের প্রণেতারা এবং এই নিবন্ধের পাঠকেরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
(লেখক :- সাজ্জাদ আলী, বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র অন্যতম নির্বাহী কর্মী)
উদাহরণস্বরূপ বলি, মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল রাজাকার শিরোমনি গোলাম আজমের মামলার রায়ে উল্লেখ করেছেন, গোলাম আজম একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের পেছনের মূলব্যাক্তি, তিনি শান্তিবাহিনী গঠনের নেপথ্য নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বাংলাদেশে যে ‘ম্যাসিভ জেনোসাইড’ হয়েছে, গোলাম আজম তার ‘মাস্টার মাইন্ড’। তার বিরুদ্ধে আদালতে সন্দেহাতীতভাবে যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ৩৮জনকে একসাথে হত্যার নির্দেশদান অন্যতম। সিরু মিয়াদের অপরাধ ছিল, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিতে আগ্রহী যুবকদের এবং জীবনের ভয়ে ভীত সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভারতে যেতে সহযোগীতা করেছিল। তো গোলাম আজমের বিরুদ্ধে এই কথাগুলো এখন আর নালিশ নয়, ঐ অপকর্মগুলো সে করেছে, এটা আদালতের রায়ে এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য।
ঢাকার মিরপুরের কসাই নামে খ্যাত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্যার বিরুদ্ধে আদালতে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত ঐ অভিযোগগুলোর মধ্যে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে হত্যার নির্দেশ, কবি মেহেরুন্নেচ্ছা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্পহাউজে নিয়ে জবাই করে হত্যা, মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যা, হজরত আলী লস্করকে তার স্ত্রী, দুইকন্যা এবং দুই বছরের শিশুপূত্রসহ হত্যা ছাড়াও আলী লস্করের মেয়েদের ধর্ষণের অভিযোগগুলো রয়েছে। তো কাদের মোল্যা একজন ধর্ষক, হত্যাকারী, এটাই এখন দিবালোকের মত সত্য!
পিরোজপুরের দেল্যু রাজাকার ওরফে মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী’র বিরুদ্ধে আদালতে ৮টি অভিযোগ সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম, (১) ১৯৭১ সালের ৭ই মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে পারেরহাট বাজারে হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের দোকান ও বাড়ীতে লুটপাট চালায় এবং মাখনলাল সাহার দোকান থেকে ২ কেজি স্বর্ণ লুট করে। (২) ১৯৭১ সালের ৮ই মে সাঈদী বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খান ও তার ছেলেকে পাকিস্থানী সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়, যারা আর কখনও বাড়ী ফেরেনি। (৩) ১৯৭১ সালের ২রা জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার চিত্তরঞ্জন, জহর তালুকদার, হরেন ঠাকুর, অনিল মন্ডল, বিসাবালি, শুকাবালী, সতীশ বালাসহ প্রায় ২৫টি বাড়ীতে আগুন দেয় এবং বিসাবালিকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। (৪) তখনকার টগবগে যুবক দেল্যু রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে হোগলাবুনিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় শেফালী ঘরামির ঘরে ঢুকে তাকে উপর্যুপরি গণধর্ষণ করে। পরবর্তীতে অন্য আরেকদিন সাঈদীর নেতৃত্বে ১০/১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ী থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কমল রাণীকে ধরে পাকিস্তানী সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে টানা তিনদিন গণধর্ষণের পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। (৫) পারেরহাট ও আশপাশের গ্রামের মধুসুদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, অজিত শীল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, হরি রায়সহ প্রায় ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় এবং তাদেরকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হয়। এগুলো হলো সাঈদী কু-কীর্তির ‘আদালতে প্রমাণিত’ কয়েকটি নমুনা।
১৯৭১ এ মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকেরই বিচার শেষ হয়েছে বা চলছে। যাঁদের বিচার শেষ হয়েছে এবং যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণ হয়েছে, সেগুলো আর অভিযোগ নয়, তা প্রমাণিত সত্য।
দুইঃ “আম্মার হাতের তালের পাখা” আর “যাদব বাবুর পাটিগণিত” -এই দুটোর ডরে শৈশবে সদা টটস্থ থেকেছি। নানান অজুহাত তৈরী করে আম্মা তালের পাখাগুলো আমার পিঠে ভেঙ্গেছেন। ‘জামার বোতাম উপরেরটা খোলা কেন’, ‘পড়ার টেবিলের নিচে ফুটবল কেন’, ‘পশ্চিমপাড়ার ঐ দুষ্টু ছেলেগুলোর সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলি কেন’, ‘হাঁটার সময়ে পায়ের গোড়ালি মাটিতে ঠিকমত পড়লোনা কেন’, ইত্যাদি নানান কারণ সৃষ্টি করে আম্মা পেটাত। সন্তান শাসনে (পেটানোতে) আম্মার উদ্ভাবনী ক্ষমতা নোবেল পাওয়ার দাবী রাখে। শৈশব-কৈশরে মায়ের ঐ পিটুনিগুলো অত্যাচার মনে হলেও আজ মধ্য বয়সে এসে বেশ বুঝতে পারি, জীবন গঠনে ঐ ‘তালের পাখার পিটুনি’ কতটা সহায়ক ভুমিকা রেখেছে।
পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিশেষ যন্ত্রণা দিতে পারেনি, তবে ক্লাশ সিক্স থেকে শুরু হলো ‘পাটিগণিত আতঙ্ক’! বৎসর ঘুরে শ্রেণী যত এগোয় অর্থাৎ ক্লাস সেভেন, এইট, নাইন, -পাটিগণিত ততই জটিল আকার ধারণ করে। ল.সা.গু, গ.সা.গু, সরল অঙ্ক, সুদকষা, ঐকিক নিয়ম, চলিত নিয়ম, আরো কত জটিল সব অঙ্ক। ‘অঙ্কে কম নম্বর পেলে তালের পাখা আস্ত থাকবেনা’, আম্মার এটা প্রকাশ্য ঘোষণা। ‘যাদব বাবু’ দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন, তাঁর বাবা-মায়ের গৃহশিক্ষক রাখবার ক্ষমতা ছিল না। তিনি যদি পাটিগণিতে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পারেন, তবে ‘আম্মার ছেলে’ পারবে না কেন ? অকাঠ্য যুক্তি মায়ের!
আমিও আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি পাটিগণিতের লাগাম ধরতে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দিস্তা দিস্তা কাগজ অঙ্ক কষে শেষ করেছি। ইতিহাস, ভুগোল, ইংরেজী, বাংলা (দ্বিতীয়পত্র) ইত্যাদি সাবজেক্টগুলোতে যতটা সময় ব্যয় করেছি, তার দশগুন সময় ঢেলেছি পাটিগণিতের পেছনে। কিন্তু গণিত অধরাই থেকেছে সব সময়। সকালে মিললো তো রাতে ভুলেছি, সুদকষাটি পারলাম তো ঐকিক নিয়মটি মিলছেনা। শৈশব-কৈশরে ‘পাটিগণিত’ ছিল এক অসহনীয় মানষিক চাপ ও যন্ত্রণা, যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক!
পাঠক, ‘পাটিগণিত আতঙ্কে’ কি শুধু আমারই শৈশব কেটেছে, আপনাদের নয়? নিশ্চয়ই আপনাদেরও আমারই মত অভিজ্ঞতা আছে (কিছু কমবেশী)। আজকের এই পরিনত বয়সে গণিতের সেই নিয়ম-কানুনগুলো হুবহু আপনার স্মরণে আছে কি? শৈশবের সেই ‘সরল অঙ্কটি’ যে নিয়ম মেনে শিখেছিলেন, তা কি আজ হুবহু মনে করতে পারেন? পারবেন কি আজ সেই ঐকিক নিয়মের অঙ্কটি মিলিয়ে দিতে? আসলে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা পাটিগণিতের শাখায় শাখায় বিচরণ করেছি, আজ আর হুবহু তা মনে নেই।
পাটিগণিত গ্রন্থখানির প্রণেতা যাঁরা, অর্থাৎ যাঁরা গ্রন্থখানি পাঠ্য তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন, তাঁরা কি জানতেন না যে গনিতের ঐ ফরম্যাটগুলো পরিনত বয়সে আমরা বেমালুম ভুলে যাবো? নিশ্চয়ই তাঁরা তা জানতেন। তাহলে কেন গ্রন্থপ্রণেতারা পাটিগনিতকে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে আমাদের শৈশব-কৈশর যন্ত্রণাদায়ক করে তুলেছিলেন? আমি বলবো তাঁরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই সঠিক কাজটি করেছিলেন। শৈশবে ঐ অঙ্ক শেখানোর নাম করে ‘সমস্যাগুলোকে’ আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং তা ঐকিক, চলিত, সুদকষা ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে আমাদের দিয়ে সমাধান করিয়ে নিয়েছেন। আসলে ঐ শৈশবেই তাঁরা আমাদের মগজ-ধোলাই করে দিয়েছেন। অঙ্কশাস্ত্রের মাধ্যমে ‘কঠিন সমস্যাগুলো’ সমাধান করিয়ে মস্তিস্কের চিন্তাগ্রন্থিগুলোকে খুলে দিয়েছেন। আজ আর আমাদের সুদকষা বা চলিত নিয়মের প্রথাগত নিয়ম স্মরণে নেই, কিন্তু জীবনের জটিল অঙ্কগুলো মেলাবার জন্য মস্তিস্ক তৈরী হয়ে আছে। শৈশবের সেই ‘গাণিতিক জ্ঞান’ আজ আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। ‘গণিতের সমাধান’ বা ‘মায়ের তালের পাখার পিটুনি’র মত শৈশবের শিক্ষাগুলো আমাদের অবচেতন মনকে তাড়িত করে এবং বর্তমান জীবন-চলার পথকে নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। মোটাদাগে বলা যায়, পরিনত বয়সে ব্যক্তির বিচার-বোধ, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান, তার শৈশবের বেড়ে উঠার ধারাবাহিকতা মাত্র।
শেষকথা ঃ
পাঠক, বলছিলাম ‘পাটিগণিত’ এবং ‘মাতৃশাসনের’ কথা। অর্থাৎ শৈশবেই নিয়ম-শৃংখলা, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ এগুলো মগজে-মমনে ঢুকিয়ে দেবার প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে আজকের যারা শিশু-কিশোর, তারাও কিন্তু আপনার আমার মতই ‘গণিত’ ও ‘পারিবারিক শাসন’ কাঠামোর মধ্যেই বড় হচ্ছে। ভবিষ্যত জীবনের জন্য তারা একটু একটু করে অভিজ্ঞতা ও জীবন-দর্শন প্রতিদিন অর্জন করছে। আজকের দিনের শিশুকে যেটা শেখানো হচ্ছে, আগামী দিনে সে তার পথচলায় তারই প্রতিফলন ঘটাবে।
আমরা প্রায়সই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অদর্শতো মূর্তিমান নয়, তাতো দেখা যায়না, হাত দিয়ে স্পর্শও করা যায় না, -সেতো বিমূর্ত, অনুভব করবার বিষয়! চেতনাটি আসলে মননে থাকতে হবে, এটি অন্তরে ধারণ করার বিষয়। কিন্তু কেমন করে সেটি সম্ভব?
আজকের যারা শিশু-কিশোর ভবিষ্যত বাংলাদেশের তারাই চালক। আমরা যদি শৈশবেই এই ভবিষ্যত চালকদের মগজে যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মগুলো ঢুকিয়ে দিতে পারি, তাহলে শিশুদের মনে ঐ কুলঙ্গারদের প্রতি ঘৃণা স্থায়ীভাবে গেঁথে যাবে। আপনি আর আমি আজ যেমন পাটিগণিতের নিয়ম হুবহু মনে করতে পারি না কিন্তু জীবনের অংক ঠিকই বুঝতে পারি অথবা মায়ের পিটুনির ব্যাথা আজ আর অনুভব করি না, কিন্তু তাঁর শেখানো সেই শৃংখলাবোধ দিয়েই আজও প্রতিনিয়ত জীবন পরিচালনা করি।
আদালতে প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের ঐ অপকর্মগুলো পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করে শিশুদের মগজে যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধটি কি এবং কেন, এর বিপক্ষে কারা ছিল, তারা কি ধরণের অপকর্মগুলো করেছিলো, -শিশুদের মননে সেগুলো স্থায়ীভাবে গেঁথে যাবে। একই সাথে কেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছিল, কাঁরা তা করেছিল, তাঁদের কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল, -আগামী দিনের ভবিষ্যত নাগরিকেরা ঐ পাঠ্যপুস্তক থেকেই সেই জ্ঞানও অন্তরে ধারণ করবে। বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলের পাশাপাশি ‘নিজ দেশের জন্ম ইতিহাস’ জ্ঞানধারী ঐ শিশুকে আর দেশপ্রেম শেখাতে হবেনা। সে তার পরিনত বয়সে কখনওই ‘দলবাজি’ করবেনা, শুধুই ‘দেশবাজি’ করবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যুদ্দাপরাধীদের অপকর্ম, নির্যাতন, ধর্ষণ, বাড়ীঘর জ্বালানো-পোড়ানোর ঘটনাগুলি যদি পেশাদার লেখকদের দিয়ে সুখপাঠ্য করে লিখিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘অবশ্য পাঠ্য’ করা হয়, তাহলে অবশ্যই ভবিষ্যত বাংলাদেশে ‘অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে’ -এমন একটি জাতি গঠন করা সম্ভব। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত কর্তাব্যাক্তিরা বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তকের প্রণেতারা এবং এই নিবন্ধের পাঠকেরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
(লেখক :- সাজ্জাদ আলী, বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র অন্যতম নির্বাহী কর্মী)
Sunday, 22 February 2015
ভাষার বৈচিত্র্য ও মাতৃভাষা চর্চা : প্রেক্ষিত ইসলাম
তর্কশাস্ত্রের ভাষায় বাক ও বোধশক্তিসম্পন্ন প্রাণীকে মানুষ বলা হয়। মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ভূষিত হওয়ার পেছনে বাক ও বোধশক্তির ক্ষমতা এবং ভাষাগত দক্ষতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা, যা বাকসংকেতে রূপায়িত হয়ে সমাজের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে। প্রকৃতিগত এ ভাষাগত দক্ষতা ও সক্ষমতার কারণেই শিশুরা অল্প বয়সেই ভাষা শেখার প্রক্রিয়া আত্মস্থ করতে পারে। বংশগতভাবে ভাষাজ্ঞান আহরণ, ভাব বিনিময় ও বাক্যব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে বলে বধির শিশুরা প্রতীকী ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও অনুরূপ দক্ষতা দেখায়। ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। কেবল সাংকেতিক ধ্বনির নামই ভাষা নয়; মানব মনের ভাব-আবেগ অনুভূতি চিন্তা ও কল্পনা-জল্পনার অনুবাদই ভাষার কাজ। তাই মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির ভাষা অর্থহীন। প্রতিটি দেশ, শহর ও অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। সাধারণ অর্থে মায়ের মুখ থেকে বাল্যকাল থেকে যে ভাষা শিক্ষা করা হয়, তা-ই মাতৃভাষা। ব্যাপক অর্থে স্বজাতির ভাষাই মাতৃভাষা। বাঙালি জাতির জন্য বাংলাই মাতৃভাষা। ভৌগোলিক, আঞ্চলিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। শাশ্বত, জীবন্ত ও চিরন্তন ধর্ম ইসলামেও মাতৃভাষায় জ্ঞান আহরণ, মাতৃভাষার চেতনা লালন ও সাহিত্যপূর্ণ বিশুদ্ধ শব্দ উচ্চারণে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ভাষার বৈচিত্র্য স্রষ্টার বিস্ময়কর নিদর্শন ও বিশেষ নিয়ামত : যে শিশুটি নিজ হাতে খাওয়ার শক্তি রাখে না, এমনকি শক্ত খাবার গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না, আধো আধো বুলি দিয়ে সে শিশুই খুবই দ্রুত ভাষাকে রপ্ত করে ফেলে। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শেখার সঙ্গে ভাষাকেও সে শিখে নেয়। শিশুর কোমল সত্তায় এ শক্তি কে সঞ্চার করল? নিশ্চয়ই মহা ক্ষমতাবান আল্লাহ। যিনি সুবিশাল মাটির স্তূপে পতিত বীজের মধ্য থেকে সুন্দর, প্রকাণ্ড ও মহা-উপকারী বৃক্ষ বের করে নিয়ে আসেন। যিনি ডিম থেকে বাচ্চা, বীর্য থেকে সন্তান, বীজ থেকে বৃক্ষ- জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন। 'আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের করো'- (সুরা আলে ইমরান : ২৭)। ভাব প্রকাশক ভাষা সে স্রষ্টারই দান। তাঁরই ভাষায় শুনুন- 'করুণাময় আল্লাহ! শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানবপ্রাণ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বয়ান'- (সুরা আর-রাহমান: ১-৪)। সাধারণ মানুষকে তিনি ভাষা শিখিয়েছেন পরোক্ষভাবে, শক্তি সঞ্চার করে। কিন্তু মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে তিনি এ ভাষা শিখিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে, অকৃত্রিম উপায়ে। আল্লাহ বলেন, 'আর আল্লাহ আদমকে শিখালেন সব বস্তুসামগ্রীর নাম'- (সুরা বাকারা : ৩১) ভাব প্রকাশের মৌখিক পদ্ধতি ছাড়াও রয়েছে লিখিত পদ্ধতি। সে পদ্ধতিটিও আল্লাহর শেখানো। আল্লাহ বলেন, 'পড়ো, তোমার প্রভু মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন'- (সুরা আলাক : ৩-৪)। লক্ষণীয় যে উল্লিখিত আয়াতগুলোতে কোথাও কোনো বিশেষ ভাষার কথা বলা হয়নি। তাই সব ভাষাই আল্লাহর নিয়ামত। আদি পিতা আদমের সন্তান হয়েও মানুষের যেমনি গোত্র-গাত্রবর্ণ, স্বর ও সুরের রুক্ষতা-কোমলতা ও দেহের উচ্চতা ও খর্বতা রয়েছে তেমনি রয়েছে ভাষার ভিন্নতাও। ইথনোলোগ (Ethnologoue) নামের ভাষা বিশ্বাকোষের হিসাব মতে, পৃথিবীর মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯)। বিবিসির তথ্যমতে, পৃথিবীর ভাষা সংখ্যা ৭,০০০। এশিয়ায় ২২০০ ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। (সূত্র : www.bbc.uk.languages/guide/languages.shtml) বৈচিত্র্য ভাষার সমাহার স্রষ্টার অপার বিস্ময়কর নিদর্শন। কেবল ভাষাই নয়; একই ভাষাভাষীর মধ্যে পৃথক ধ্বনি ও স্বর লক্ষ করা যায়। চেহারা না দেখেও কেবল আওয়াজ শুনেই মানুষকে চেনা যায় ধ্বনির ভিন্নতার কারণে। এসবই আল্লাহর দান। 'আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য'- (সুরা রুম : ১২)
ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার তাগিদ : হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, বন্ধুতা-বৈরিতা, আশা-নিরাশা ও ঘৃণা-ভালোবাসার সব কিছুই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। ছন্দের গাঁথুনিতে, ভাষার লালিত্যে শব্দসৈনিক ও ভাষাশিল্পীদের যে নৈপুণ্য ও কুশলতা, তা মাতৃভাষায়ই সহজ-সাবলীলভাবে উপস্থাপন সম্ভব। মনের ভাব ব্যক্ত করার জন্য মাতৃভাষা সর্বোত্তম পথ, পন্থা ও পদ্ধতি। তাই যুগে যুগে নবী-রাসুলদের পাঠানো হয়েছে স্বজাতির ভাষাভাষী করে। আল্লাহ বলেন, 'আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন'- (সুরা ইবরাহিম : ৪)। ইসলামের দাওয়াত ও ধর্মপ্রচারে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার রয়েছে সম্মোহনী শক্তি। রয়েছে কারো হৃদয় জয় করার, কাউকে মুগ্ধ-আবিষ্ট করার আশ্চর্য ক্ষমতা।
একটি কালজয়ী বক্তৃতা, একটি সফল বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। তাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হজরত মূসা (আ.) ভাষিক জড়তা দূর হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন। বলেছেন, 'হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন।' তিনি আরো বলেন, 'হে আমার রব, আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে'- (সুরা ত্বা-হা : ২৫-২৮)।
শুধু তাই নয়; খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কাছে অমোঘ সত্যের বাণী পৌঁছানোর জন্য তিনি তাঁর বাগ্মী, স্পষ্টভাষী ভাই হারুন (আ.)-এর সহযোগিতা চেয়েছেন। 'আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বাগ্মী। তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন করবে'- (সুরা আল কাসাস : ৩৪)। শুভেচ্ছামূলক, কোমল ও সবলীল ভাষা কারো জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই ঐশী নির্দেশ এসেছে, 'তোমার পালনকর্তার পথে আহ্বান করো, প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পন্থায়'- (সুরা নাহল : ১২৫)।
বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব : কেবল মাতৃভাষা গ্রহণই নয়; ভাষাটি শিল্পমানসম্পন্ন হওয়াও শরিয়তের কাম্য। রাসুল (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতা, উপযুক্ত শব্দচয়নের প্রতি বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজেও সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি আরবের সবচেয়ে বাগ্মী। তা ছাড়া আমি বিশুদ্ধভাষী কোরাইশের বংশধর। একদিন এক সাহাবি দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, 'আ-আলিজু?' প্রবেশ করার অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার আরবিতে রয়েছে। কিন্তু প্রমিত ও সাহিত্যপূর্ণ শব্দ হলো 'আ-আদখুলু'?- আমি কি প্রবেশ করব? রাসুল (সা.) তাঁকে শেষোক্ত শব্দটি প্রয়োগ করতে বলেছেন। ভাষার মানোন্নয়নে ও ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে আঞ্চলিক ভাষা ও ভিন্ন ভাষার শব্দ গ্রহণ দোষনীয় নয়। কিন্তু সেটি যদি শব্দ সন্ত্রাস ও ভাষিক আগ্রাসনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, কোনো ভাষার জন্য তা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। এশার নামাজকে বিদ্রূপ করে কাফিররা 'আতামা' বলত। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা আতামা বলো না, 'এশা' বলো। শব্দসন্ত্রাস নির্মূলের শিক্ষা কোরআনেও দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মুমিনগণ, তোমরা (কাফিরদের ন্যায় নবীকে ব্যঙ্গ করে) 'রায়িনা' (আমাদের রাখাল) বলো না। তোমরা 'উনজুরনা' (আমাদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন) শব্দটি ব্যবহার করো'- (সুরা বাকারা : ১০৪)। হিন্দি সিরিয়াল ও ইংলিশ মিডিয়ামের এ যুগে বাংলাভাষীদের জন্য উল্লিখিত আয়াতে বিশেষ শিক্ষা রয়েছে।
ভাষিক সৌজন্যবোধ ও ইসলাম : ইসলাম কেবল বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেনি; বরং গালাগাল, ব্যঙ্গাত্মক ও কটুবাক্য ব্যবহারে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'তোমরা তাদের গালি দিও না, আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের উপাসনা করে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখিয়ে অজ্ঞাতবশত আল্লাহকে গালি দেবে'- (সুরা আনআম : ১০৮)। কাউকে উপহাস করা, অপমানিত করা, ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, 'মুমিনগণ, কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে.....তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না'- (সুরা হুজরাত : ১১)। কারো সঙ্গে অহেতুক ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। অগত্যা যদি কারো সঙ্গে বিতর্ক করতে হয়, তথাপি ভাষিক সৌজন্যবোধ বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, 'তোমরা আহলে কিতাবের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে না; অগত্যা যদি করতে হয়, তবে উৎকৃষ্ট পন্থায় করবে'- (সুরা আনকাবুত : ৪৬)। প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য; ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সঙ্গেও সৌজন্যমূলক আচরণ ও শুভেচ্ছাসূচক বিনম্র উচ্চারণ ইসলামী দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। হজরত মুসা ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের কাছে পাঠিয়ে এ বিশেষ হেদায়েতই দেওয়া হয়েছিল। 'অতঃপর তোমরা তাকে কোমল কথা বলো, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।' (সুরা ত্বহা)। রাসুল (সা.) ছিলেন মিষ্টভাষী। জীবনে কাউকে তিনি একটি কটুবাক্যও বলেননি। হাদিস শরিফে এসেছে, 'রাসুল (সা.) গালাগালকারী, অশ্লীলভাষী ছিলেন না।' হাদিসে মুনাফিকের অন্যতম নিদর্শন বলা হয়েছে, 'যখন সে বিবাদে লিপ্ত হয়, সীমালঙ্ঘন করে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে' (বোখারি : ২৩২৭)
প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষাও শিখতে হবে : একটি ভিনদেশি ভাষা পর্যটকের জন্য একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ন্যায়ই কাজে আসতে পারে। তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু মুক্তা-মানিক্য, রত্নভাণ্ডার ভিনদেশি ভাষায়ও পাওয়া যায়। বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষা, তথ্যসম্ভার ও বৈশ্বিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর এ বিষয়টিকেও ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি। রাসুল (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের 'ইবরানি' ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে তা আত্মস্থ ও কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। মুফতি রশিদ আহমদ গঙ্গুহি (রহ.) লিখেছেন, 'ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করা বৈধ।' (ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, পৃ. ৫৭৪)। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতবি (রহ.) শেষ জীবনে ইচ্ছা পোষণ করেছেন, 'আমি যদি ইংরেজি ভাষা জানতাম, তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে, তোমরা যাকে জ্ঞান মনে করো, তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হলো যা নবীদের সিনা থেকে বের হয়ে আলোকিত হৃদয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছে।' (মাসিক আর রশিদ, উর্দু, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪)। আরবি একটি জীবন্ত ভাষা। সাহিত্যবিচারেও এ ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কোরআন সুন্নাহর ভাষা আরবি। তাই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, ঘনিষ্ঠ ও হৃদয়ঘটিত। সুতরাং আরবি ভাষা জ্ঞান অর্জন করাও মুসলমানদের অন্যতম কর্তব্য। এ ছাড়াও পার্থিব-অপার্থিব যেকোনো প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। আর মাতৃভাষার প্রতি মমতা- সেতো মায়ের শেখানো বুলি থেকেই নিঃসরিত ও আহরিত এক প্রাণস্পন্দন। যা আজ বিশ্বের সব ভাষার মানুষকে একই সম্মান ও মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
ভাষার বৈচিত্র্য স্রষ্টার বিস্ময়কর নিদর্শন ও বিশেষ নিয়ামত : যে শিশুটি নিজ হাতে খাওয়ার শক্তি রাখে না, এমনকি শক্ত খাবার গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না, আধো আধো বুলি দিয়ে সে শিশুই খুবই দ্রুত ভাষাকে রপ্ত করে ফেলে। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শেখার সঙ্গে ভাষাকেও সে শিখে নেয়। শিশুর কোমল সত্তায় এ শক্তি কে সঞ্চার করল? নিশ্চয়ই মহা ক্ষমতাবান আল্লাহ। যিনি সুবিশাল মাটির স্তূপে পতিত বীজের মধ্য থেকে সুন্দর, প্রকাণ্ড ও মহা-উপকারী বৃক্ষ বের করে নিয়ে আসেন। যিনি ডিম থেকে বাচ্চা, বীর্য থেকে সন্তান, বীজ থেকে বৃক্ষ- জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন। 'আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের করো'- (সুরা আলে ইমরান : ২৭)। ভাব প্রকাশক ভাষা সে স্রষ্টারই দান। তাঁরই ভাষায় শুনুন- 'করুণাময় আল্লাহ! শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানবপ্রাণ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বয়ান'- (সুরা আর-রাহমান: ১-৪)। সাধারণ মানুষকে তিনি ভাষা শিখিয়েছেন পরোক্ষভাবে, শক্তি সঞ্চার করে। কিন্তু মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে তিনি এ ভাষা শিখিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে, অকৃত্রিম উপায়ে। আল্লাহ বলেন, 'আর আল্লাহ আদমকে শিখালেন সব বস্তুসামগ্রীর নাম'- (সুরা বাকারা : ৩১) ভাব প্রকাশের মৌখিক পদ্ধতি ছাড়াও রয়েছে লিখিত পদ্ধতি। সে পদ্ধতিটিও আল্লাহর শেখানো। আল্লাহ বলেন, 'পড়ো, তোমার প্রভু মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন'- (সুরা আলাক : ৩-৪)। লক্ষণীয় যে উল্লিখিত আয়াতগুলোতে কোথাও কোনো বিশেষ ভাষার কথা বলা হয়নি। তাই সব ভাষাই আল্লাহর নিয়ামত। আদি পিতা আদমের সন্তান হয়েও মানুষের যেমনি গোত্র-গাত্রবর্ণ, স্বর ও সুরের রুক্ষতা-কোমলতা ও দেহের উচ্চতা ও খর্বতা রয়েছে তেমনি রয়েছে ভাষার ভিন্নতাও। ইথনোলোগ (Ethnologoue) নামের ভাষা বিশ্বাকোষের হিসাব মতে, পৃথিবীর মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯)। বিবিসির তথ্যমতে, পৃথিবীর ভাষা সংখ্যা ৭,০০০। এশিয়ায় ২২০০ ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। (সূত্র : www.bbc.uk.languages/guide/languages.shtml) বৈচিত্র্য ভাষার সমাহার স্রষ্টার অপার বিস্ময়কর নিদর্শন। কেবল ভাষাই নয়; একই ভাষাভাষীর মধ্যে পৃথক ধ্বনি ও স্বর লক্ষ করা যায়। চেহারা না দেখেও কেবল আওয়াজ শুনেই মানুষকে চেনা যায় ধ্বনির ভিন্নতার কারণে। এসবই আল্লাহর দান। 'আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য'- (সুরা রুম : ১২)
ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার তাগিদ : হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, বন্ধুতা-বৈরিতা, আশা-নিরাশা ও ঘৃণা-ভালোবাসার সব কিছুই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। ছন্দের গাঁথুনিতে, ভাষার লালিত্যে শব্দসৈনিক ও ভাষাশিল্পীদের যে নৈপুণ্য ও কুশলতা, তা মাতৃভাষায়ই সহজ-সাবলীলভাবে উপস্থাপন সম্ভব। মনের ভাব ব্যক্ত করার জন্য মাতৃভাষা সর্বোত্তম পথ, পন্থা ও পদ্ধতি। তাই যুগে যুগে নবী-রাসুলদের পাঠানো হয়েছে স্বজাতির ভাষাভাষী করে। আল্লাহ বলেন, 'আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন'- (সুরা ইবরাহিম : ৪)। ইসলামের দাওয়াত ও ধর্মপ্রচারে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার রয়েছে সম্মোহনী শক্তি। রয়েছে কারো হৃদয় জয় করার, কাউকে মুগ্ধ-আবিষ্ট করার আশ্চর্য ক্ষমতা।
একটি কালজয়ী বক্তৃতা, একটি সফল বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। তাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হজরত মূসা (আ.) ভাষিক জড়তা দূর হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন। বলেছেন, 'হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন।' তিনি আরো বলেন, 'হে আমার রব, আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে'- (সুরা ত্বা-হা : ২৫-২৮)।
শুধু তাই নয়; খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কাছে অমোঘ সত্যের বাণী পৌঁছানোর জন্য তিনি তাঁর বাগ্মী, স্পষ্টভাষী ভাই হারুন (আ.)-এর সহযোগিতা চেয়েছেন। 'আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বাগ্মী। তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন করবে'- (সুরা আল কাসাস : ৩৪)। শুভেচ্ছামূলক, কোমল ও সবলীল ভাষা কারো জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই ঐশী নির্দেশ এসেছে, 'তোমার পালনকর্তার পথে আহ্বান করো, প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পন্থায়'- (সুরা নাহল : ১২৫)।
বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব : কেবল মাতৃভাষা গ্রহণই নয়; ভাষাটি শিল্পমানসম্পন্ন হওয়াও শরিয়তের কাম্য। রাসুল (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতা, উপযুক্ত শব্দচয়নের প্রতি বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজেও সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি আরবের সবচেয়ে বাগ্মী। তা ছাড়া আমি বিশুদ্ধভাষী কোরাইশের বংশধর। একদিন এক সাহাবি দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, 'আ-আলিজু?' প্রবেশ করার অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার আরবিতে রয়েছে। কিন্তু প্রমিত ও সাহিত্যপূর্ণ শব্দ হলো 'আ-আদখুলু'?- আমি কি প্রবেশ করব? রাসুল (সা.) তাঁকে শেষোক্ত শব্দটি প্রয়োগ করতে বলেছেন। ভাষার মানোন্নয়নে ও ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে আঞ্চলিক ভাষা ও ভিন্ন ভাষার শব্দ গ্রহণ দোষনীয় নয়। কিন্তু সেটি যদি শব্দ সন্ত্রাস ও ভাষিক আগ্রাসনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, কোনো ভাষার জন্য তা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। এশার নামাজকে বিদ্রূপ করে কাফিররা 'আতামা' বলত। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা আতামা বলো না, 'এশা' বলো। শব্দসন্ত্রাস নির্মূলের শিক্ষা কোরআনেও দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মুমিনগণ, তোমরা (কাফিরদের ন্যায় নবীকে ব্যঙ্গ করে) 'রায়িনা' (আমাদের রাখাল) বলো না। তোমরা 'উনজুরনা' (আমাদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন) শব্দটি ব্যবহার করো'- (সুরা বাকারা : ১০৪)। হিন্দি সিরিয়াল ও ইংলিশ মিডিয়ামের এ যুগে বাংলাভাষীদের জন্য উল্লিখিত আয়াতে বিশেষ শিক্ষা রয়েছে।
ভাষিক সৌজন্যবোধ ও ইসলাম : ইসলাম কেবল বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেনি; বরং গালাগাল, ব্যঙ্গাত্মক ও কটুবাক্য ব্যবহারে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'তোমরা তাদের গালি দিও না, আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের উপাসনা করে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখিয়ে অজ্ঞাতবশত আল্লাহকে গালি দেবে'- (সুরা আনআম : ১০৮)। কাউকে উপহাস করা, অপমানিত করা, ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, 'মুমিনগণ, কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে.....তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না'- (সুরা হুজরাত : ১১)। কারো সঙ্গে অহেতুক ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। অগত্যা যদি কারো সঙ্গে বিতর্ক করতে হয়, তথাপি ভাষিক সৌজন্যবোধ বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, 'তোমরা আহলে কিতাবের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে না; অগত্যা যদি করতে হয়, তবে উৎকৃষ্ট পন্থায় করবে'- (সুরা আনকাবুত : ৪৬)। প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য; ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সঙ্গেও সৌজন্যমূলক আচরণ ও শুভেচ্ছাসূচক বিনম্র উচ্চারণ ইসলামী দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। হজরত মুসা ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের কাছে পাঠিয়ে এ বিশেষ হেদায়েতই দেওয়া হয়েছিল। 'অতঃপর তোমরা তাকে কোমল কথা বলো, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।' (সুরা ত্বহা)। রাসুল (সা.) ছিলেন মিষ্টভাষী। জীবনে কাউকে তিনি একটি কটুবাক্যও বলেননি। হাদিস শরিফে এসেছে, 'রাসুল (সা.) গালাগালকারী, অশ্লীলভাষী ছিলেন না।' হাদিসে মুনাফিকের অন্যতম নিদর্শন বলা হয়েছে, 'যখন সে বিবাদে লিপ্ত হয়, সীমালঙ্ঘন করে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে' (বোখারি : ২৩২৭)
প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষাও শিখতে হবে : একটি ভিনদেশি ভাষা পর্যটকের জন্য একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ন্যায়ই কাজে আসতে পারে। তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু মুক্তা-মানিক্য, রত্নভাণ্ডার ভিনদেশি ভাষায়ও পাওয়া যায়। বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষা, তথ্যসম্ভার ও বৈশ্বিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর এ বিষয়টিকেও ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি। রাসুল (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের 'ইবরানি' ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে তা আত্মস্থ ও কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। মুফতি রশিদ আহমদ গঙ্গুহি (রহ.) লিখেছেন, 'ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করা বৈধ।' (ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, পৃ. ৫৭৪)। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতবি (রহ.) শেষ জীবনে ইচ্ছা পোষণ করেছেন, 'আমি যদি ইংরেজি ভাষা জানতাম, তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে, তোমরা যাকে জ্ঞান মনে করো, তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হলো যা নবীদের সিনা থেকে বের হয়ে আলোকিত হৃদয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছে।' (মাসিক আর রশিদ, উর্দু, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪)। আরবি একটি জীবন্ত ভাষা। সাহিত্যবিচারেও এ ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কোরআন সুন্নাহর ভাষা আরবি। তাই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, ঘনিষ্ঠ ও হৃদয়ঘটিত। সুতরাং আরবি ভাষা জ্ঞান অর্জন করাও মুসলমানদের অন্যতম কর্তব্য। এ ছাড়াও পার্থিব-অপার্থিব যেকোনো প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। আর মাতৃভাষার প্রতি মমতা- সেতো মায়ের শেখানো বুলি থেকেই নিঃসরিত ও আহরিত এক প্রাণস্পন্দন। যা আজ বিশ্বের সব ভাষার মানুষকে একই সম্মান ও মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
লেখক : সিইও, সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিক্স বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা।
ahmanictg@gmail.com
গণতন্ত্রের মধ্যপন্থা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঝুঁকি
কেউ কেউ বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। কেউ কেউ দলটিকে মধ্যপন্থার দল বলেও দাবি করেন। অনেকেই এসব অভিধার সঙ্গে আংশিকভাবে একমত পোষণ করলেও পুরোপুরি পারছেন না। তবে বিএনপির মতো দলটি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি নিশ্চিত অবস্থানে যাওয়ার পর উদারবাদী একটি দলে পরিণত হলে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ অনেক বেশি সহজ হতো। কিন্তু বিএনপির উত্থান যে প্রক্রিয়ায় হয়েছিল, তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়নি, তার পরও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মহলের আশা ছিল, দলটি নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক মতাদর্শের উদার বা রক্ষণশীল মধ্যপন্থা অনুসরণ করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ইতিহাস হলো, দলটি ক্রমেই সাম্প্রদায়িক ধারার কাছে আত্মসমর্পণ করছে, সর্বশেষ জঙ্গিবাদী শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। দলটিতে উদারবাদী ভাবাদর্শের প্রচুর নেতা-কর্মী থাকলেও জামায়াতের মতো গণতন্ত্রবিরোধী ভাবাদর্শের দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দলটি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক আদর্শবিরোধী সব শক্তির নেতৃত্ব প্রদানকারী দলে পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যতে কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে বা টিকে থাকতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বিএনপির এমন প্রান্তিক দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসীদের নির্ভরশীল দলে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়, বরং ঐতিহাসিক, অর্থাৎ জন্মত্রুটি নিয়েই বেড়ে ওঠা রাজনীতির সুনির্দিষ্ট অবস্থান বললে খুব একটা ভুল হবে না।
১৯৭৮ সালে কোন রাজনৈতিক অবস্থার বিপরীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন, তা কমবেশি সবারই জানা। দলটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়নি, এটি দলটির মৌলিক দুর্বলতা। সাধারণত একটি গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের দলের অভ্যন্তরে থাকা বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী মূল দলের সঙ্গে বা নেতৃত্বের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আলাদা একটি দল গঠন করলে তাতে আদর্শের মহা বিপর্যয় ঘটে না, বরং অধিকতর বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। গণতন্ত্রে এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ইংল্যান্ডে টোরি দল থেকে লেবার পার্টির জন্ম হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রেও ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির জন্ম হয়েছে একের ভেতর থেকে অন্যের। ভারতে কংগ্রেস পার্টির অভ্যন্তর থেকেই বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ও সর্বভারতীয় দলের জন্ম হয়েছে। পাকিস্তানের শুরুতে মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ থেকে ন্যাপ, স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ ইত্যাদি দলের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সে ধরনের কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপস্থিতি ছিল না। আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে কেউ বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-উত্তর সময়ে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে হত্যার পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, আওয়ামী লীগসহ সব প্রগতিশীল দলকে রাজনৈতিকভাবে বৈরী অবস্থায় ঠেলে দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে নানা ধরনের সুবিধা বিতরণ করে এমন সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে দিয়ে একটি দল গঠন করা হয়, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করেছিল, সেখানে অতিডান, অতিবাম পন্থায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের সামনে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৯৭৫-৮১ সালে দুটি পথ খোলা ছিল- এক. মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সব দলমত নিয়ে একটি রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা; সেখানে তিনি নিজে নেতৃত্বের অংশেও থাকতে পারতেন অথবা অন্যদের সেই সুযোগ করে দিতে পারতেন। দ্বিতীয় পথটি হলো, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামীবিরোধী সব শক্তিকে দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। প্রথম ধারায় দেশের রাজনীতিকে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দেওয়া হলে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতাকে সশরীরে হারালেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া অচিরেই প্রাণ ফিরে পেত, বাংলাদেশ আজকের এমন পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্বে বা সংকটে হয়তো পড়ত না; তিনি যে দ্বিতীয় ধারাটি চালু করেন, তা শুধু দল হিসেবেই আওয়ামী লীগবিরোধী ছিল না, আদর্শগতভাবেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মতাদর্শবিরোধী ও ভাবাদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভাবাদর্শের ভিত্তিতে বিএনপির নেতৃত্ব প্রদান শুরু করেন। ফলে তা বাংলাদেশের সমাজজীবনে চাপা পড়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের পুনরুত্থান ঘটার সুযোগ করে দেয়, যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ পরিত্যাগ করেছিল। একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির মাঠে ছেড়ে দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা কতটা সচেতন ছিলেন, তা জানা কষ্টকর। তবে রাজনীতির বাইরের মানুষ হিসেবে আবির্ভূত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পক্ষে রাজনীতির জটিল তত্ত্ব ও প্রয়োগ পরিণতি বোঝা খুব সহজ কাজ ছিল না- এটি নিশ্চিত। একই অবস্থা ছিল সামরিক শাসক হু. মু. এরশাদের জন্যও। তিনিও একই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেছিলেন। তবে অনেকেই আশা করেছিলেন, জিয়াউর রহমান শেষ পর্যন্ত তাঁর দলটিকে একটি মধ্যপন্থার দলে পরিণত করবেন। সেটি তাঁর জীবদ্দশায় ঘটেনি। ১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়া দলের হাল ধরার পর অনেকেই ঠাঁই নিয়েছিল এরশাদের গড়া দলে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, উভয় দলে অতিবাম, অতিডান এবং সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তি, আমলা ও সামরিক কর্মকর্তা রাজনীতির এমন ভাঙ্চুরে সবচেয়ে বেশি দুই সামরিক শাসকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও রাজনীতির বাস্তবতায় তত দিনে সাম্প্র্রদায়িকতা বেশ শক্ত আসন গেড়ে বসে। তারা এরশাদের লাঙলেও চাষাবাদ বসিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, আবার সাতদলীয় জোটের মাধ্যমেও গণতান্ত্রিক চরিত্রের বৈধতা নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করে। এটি মোটেও বুঝতে পারেনি আওয়ামী লীগ, বাম মোর্চা তথা ১৫ দলীয় ঐক্যজোট, যারা অচিরেই ভেঙে আট ও পাঁচ দলে আলাদা হয়ে পড়ে। ১৯৮৩-৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে লড়াকু অবস্থান ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং আট ও পাঁচ দলের; কিন্তু কৌশলে হেরে গেল তারা ১৯৯১-এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবিরোধিতা, ধর্ম চলে যাওয়ার প্রচার-প্রচারণা গোটা নির্বাচনকেই নিয়ে গেল অন্য এক ভুবনে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, শোষণহীন সমাজ, অসাম্প্রদায়িকতা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক বৈধতা লাভের সুযোগটি পেয়ে যায় বিএনপি এককভাবেই, তবে এর পেছনে ভোটের রাজনীতিতে কুশীলবদের পরিকল্পনা সফল হয়। শুরুতে বিএনপির মধ্যে মধ্যপন্থার রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য থাকলেও অচিরেই ডান, বাম সুবিধাবাদ এবং ক্ষমতার সুবিধা গ্রহণকারীদের প্রভাব বেড়ে যায়। বিএনপিতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দ্বন্দ্বের শুরু। আওয়ামী লীগ কৌশলের যুদ্ধে এগিয়ে যায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদায় করে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার সুযোগ পায়। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় গিয়ে অসাম্প্রদায়িক শক্তি নির্মূল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নীলনকশা এঁটে রেখেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সেটিই দেখা গেল। আগে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি বিভক্ত ছিল, ১৯৯৯ সালে তারা আদর্শগতভাবে কাছাকাছি আসে, ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের নির্মূর্ল পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছিল, তা সবারই জানা। এই শক্তিই ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার আসনে বসিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার নীলনকশা করেছিল। সেটি ব্যর্থ করতে চারদলীয় জোটের বাইরে মহাজোট গঠন করে সবাই মাঠে নেমে পড়ে। সেই অবস্থায় চারদলীয় জোট সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দেশে ১/১১ সংঘটিত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের পরাজয়ের পেছনে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের ভয়াবহ রাজনীতির প্রতিক্রিয়া কাজ করেছিল। ২০০৯ সালে গঠিত সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করলে এই প্রেক্ষাপটে জামায়াত ও বিএনপির ঐক্য আরো নিবিড় হতে থাকে। চারদলীয় জোট ১৮ দলে রূপান্তরিত হয়। বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে হেফাজতসহ অন্যান্য শক্তিকেও মাঠে নামায়। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার আড়ালে সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের এনে তাহরির স্কয়ার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতিদের সমাবেশ ঘটিয়ে আবার সরকার উৎখাতের একটা পরিকল্পনা আঁটে। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করে দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা আঁটা হয়। সর্বশেষ এ বছরের ৫ জানুয়ারি বড় ধরনের কিছু একটা সংঘটিত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে বলে এখন বিশ্বাস করার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
লক্ষণীয় বিষয়, বিএনপি ২০০৯ সালের পর থেকে ক্রমেই জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেকে সমর্পণ করতে থাকে। জামায়াত যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে ক্ষমতা থেকে সরকার উচ্ছেদের ধারায় অগ্রসর হয়। অন্যদিকে বিএনপি ২০ দলীয় জোটের জনসভায় জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে থাকে। বিষয়গুলো নিয়ে বেশ ভাববার রয়েছে। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের ৫ মে এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার মতো সিদ্ধান্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগেরই জানা ছিল না। খালেদা জিয়া এবং লন্ডনে বসবাসকারী দলের সিনিয়র সহসভাপতি তারেক রহমান ছাড়া অন্য কেউ খুব একটা জানতেন না। দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থক এবং ভোটাররা শীর্ষ নেতাদ্বয়ের সিদ্ধান্তের গূঢ় রহস্য জানার কথা নয়। অথচ বিএনপিতে লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক রয়েছে, যারা বিএনপি করে শীর্ষ দুই নেতাকে ভালোবাসা থেকে। রাজনীতির গভীর আলোচনা-পর্যালোচনা, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়গুলো তাদের খুব একটা জানা নেই। অথচ দলটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চরমপন্থায় সরকার উৎখাতের যেসব বিষয় গভীরে নিহিত থাকে, তা কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলের রাজনীতির জন্য মোটেও সহায়ক হয় না। কেননা বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পথেই জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারে, এর পক্ষে সেই পরিমাণ ভোট রয়েছে। এমন বাস্তবতা বিরাজ করার পর সরকার উৎখাতের হিসাব-নিকাশে বিএনপির অংশ নেওয়ার, দলকে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি দল ও দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ৫ জানুয়ারির পর থেকে দেশে যে পেট্রলবোমার ধারা চালু হয়েছে, তা ২০১৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ঘটানো হয়েছিল। তাতে ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি ছাত্রদলেরও সম্পৃক্ততা ঘটেছে। এবারও তা-ই ঘটেছে। ফলে ২০ দলীয় জোটের রাজনীতি গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিবাদী ধারায় পা ফেলেছে। তাতে বিএনপির মতো এত বড় দলের অংশগ্রহণ ও সমর্থন দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ২০১০ সাল থেকে যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে, তা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিএনপি গোটা সময়টা জামায়াতের পাশে ছিল। তবে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হচ্ছে না। কেননা যেসব উদারবাদী নেতা ও কর্মী দলটিতে রয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা জানার সুযোগ নেই, এ ধরনের জঙ্গিবাদী রাজনীতির সহায়ক শক্তি হওয়ার কল্পনাও তারা করেছে- এমনটি ভাবা কষ্টকর। ২০১৪-পরবর্তী সময় থেকে বিএনপির ক্রমস্খলন, দক্ষিণের প্রান্তিক অবস্থান ছাড়িয়ে চরমপন্থায় যাওয়ার বিষয়টি তাদের নজর এড়িয়ে যায়নি। জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাটি বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শে বেড়ে ওঠার বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিচ্ছে; ২০০১-০৬ সালে সেটি দেখা গেছে একভাবে, কিন্তু ২০১০ সাল থেকে বিএনপির অবস্থান আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই বিপদ শুধু আওয়ামী লীগের জন্যই নয়, গণতন্ত্রের ধারায় বাংলাদেশকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে মহাবিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে। আওয়ামীবিরোধিতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতাকে উন্মুক্ত করে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী সব শক্তিকে নিয়ে একটি ভাবাদর্শ তৈরি করা, যা চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হতেই সাহায্য করবে। বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং ভোটারদের সেই সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদী কাফেলায় যুক্ত করে যে রাজনীতিকে সুযোগ করে দিতে ভূমিকা রাখছে, তার ক্ষতি পূরণ করার শক্তি বাংলাদেশের নেই। এত বড় একটি দল এবং এর সঙ্গে যুক্ত থাকা অথবা না বুঝে সমর্থন দেওয়া মানুষজন নিয়ে দেশের রাজনীতি একটি রাজনৈতিক সুনামির মতো মহাবিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তা থেকে মুক্ত হতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিএনপির ভেতরে মধ্যপন্থায় বিশ্বাসীদের রাজনীতির ভেতরের এসব ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে হবে, অবস্থান নিতে হবে। আমরা একটি মধ্যপন্থার বিএনপিকে দেখতে চাই; তাহলে গণতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা থাকবে, শত্রুতা হবে না। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের প্রতিযোগিতার রাজনীতি বুঝতে হবে, করতে হবে।
Saturday, 21 February 2015
ইসলামের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব-তাৎপর্য ও ভাষাশহীদদের মর্যাদা
আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য-অগনিত দান আর নিয়ামতে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন-সংসার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জীবনের শুরু থেকে বিদায় পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ মহানের দান-নিয়ামতের মুখাপেক্ষি আমরা। মহান আল্লাহর নিয়ামতভোগী মাখলুক আমরা মানুষ। ভাষা আল্লাহ তায়ালার অনন্য একটি দান।অন্যন্য একটি নিয়ামত। মানব জাতিকে প্রদান করা বিশেষ নিয়ামত। ভাষা জীবনের এমন একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়; যা ছাড়া সুস্থ ও সম্পূর্ণ জীবন কল্পনা করা যায় না। ভাষার ব্যবহার, ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম। পবিত্র কোরানের সুরা আর-রহমানের প্রথমদিকে আল্লাহ তায়ালা বলেছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছি বয়ান বা উপস্থাপনজ্ঞান’। আলোচ্য আয়াতের মাঝে মানুষকে উপস্থাপনজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করার কথা বলার মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা মানবকূলকে যত নিয়ামত দিয়েছেন তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। মানুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে। মনের মণিকোঠায় লুকানো সুখানুভূতি দু:খানুভূতি নিমিষেই প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন, যা অন্য কোন প্রানীকে দেননি। পশু-প্রানীরা কখনো তাদের মনের বেদনা কারে কাছে বলতে পারেনা; আনন্দ উল্লাস অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে পারে না। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ তাঁদের সব অনুভুতি অন্যের সাথে আদান প্রদান করতে পারে। এ এক অপূর্ব নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য কুদরত ও নিদর্শন আমাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে। এইসব নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে কথা বলা বা ভাষার নিদর্শনটিই আমরা অনুভব করি এবং ব্যবহার করি। পবিত্র কোরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হল- আসমান জমিন সৃষ্টি, তোমাদের বিভিন্ন রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা’। (সূরা রূম: ২২)
আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় কোটি কোটি মানুষ তৈরী করেছেন। তিনি নিপূণতার সাথে প্রত্যেকটি মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে তৈরী করেছেন। তাদের মধ্যে দিয়েছেন রংয়ের ভিন্নতা; ভাষার ভিন্নতা; দিয়েছেন রুচীর বৈচিত্র্য। কোটি কোটি মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন ধরণ, রূপ-সৌন্দর্য্যে ও ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ তায়ালার অপরূপ মহিমা ও কুদরতকে সাক্ষ্য দেয়। প্রমাণ করে আল্লাহ কতো সুনিপূণ কারিগর। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে আলাদা আলাদা ভাষা দিয়েছেন। সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি; আল্লাহর দান। সব ভাষাই আল্লাহর কাছে সমান। আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.) -কে সৃষ্টির পর তাঁকে সব ধরণের ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।
ইসলামের আলোকে ভাষার মর্যাদা : আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকুলকে। তার কোনো নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভূক্ত। মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষা। ভাষাকে আল্লাহ তাআলা তার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন, ‘তার এক নিদর্শন হলো, তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার ভিন্নতা। (সূরা রূম: ২২) ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাকহীন নিথর কোনো ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামত। সব প্রাণীরই স্ব স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বাচ্ছন্দ্য, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মহাত্ম্য।
প্রথম মানুষ হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে, ‘হজরত আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন। (সূরা বাকারা : ৩১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘মানব জাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বর্ণনা করার জ্ঞান দিয়েছেন। (সূরা আর রহমান: ৪) মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবি-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবিদের মাতৃভাষায় করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে’। (সূরা ইবরাহিম: ৪ ) প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সাথে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য আকুল প্রয়াস চালানো। তবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে; স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করায় আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হব।
বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব : ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌছে দিতে বাঙ্গালী মুসলমানের বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আরবের অধিবাসী তাই কোরান অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়। পবিত্র কোরানের বাণীসমূহ ও রাসূলের হাদিসকে তাই বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌছে দিতে হবে এবং এটাই সময়ের অনিবার্য দাবী। কারণ আমাদের ভাষা আরবি নয়। কোরান বোঝার স্বার্থে মুসলমানদের আরবি ভাষা জানা আবশ্যক হলেও আরবিভাষী না হওয়ার কারণে সকলের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। তাই কোরান, হাদিস ও ইসলামি ফিকহ, তাফসির, বিধি-বিধান ও ইসলামি সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এদেশের মুসলমানদের হাতে পৌছে দিতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মপ্রাণ; কিন্তুশুধুমাত্র বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের সঠিক চেতনা তাঁদের কাছে পৌছে দেয়ার অভাবে তাঁদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন না। একসময় ফার্সি ভাষাকে অমুসলিমদের ভাষা মনে করা হত। রুমি, জামি, শেখ শাদিরা সে ভাষায় অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য রচনা করে ফার্সি ভাষাকে জয় করে ফেলেন। এতে ইসলামের বিশাল উপকার হয়। আল্লামা ইকবাল উর্দু ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা ইসলামি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষায়ও আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই তাদের কবিতা ও সাহিত্যে ইসলামকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন; কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর। ইসলামের সব বিষয়, সব দিক ও অধ্যায় নিয়ে রচিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ হলে, বাংলা ভাষী মুসলমানরা নিমিষেই ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলেঅচনা বুঝতে পারবে এবং আমল করতে পারবে। বাংলা ভাষায় ইসলামের এস গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনো বই বা রচনা না থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে পারে না। বাংলঅ ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবশে করা এখন যুগের একান্ত চাহিদা। প্রত্যেকজন নবি তার সময়ের ভাষায় ধর্ম প্রচার করেছে। আমাদের দেশে আমাদের এই সময় যদি কোনো নবির আগমন ঘটতো, অকশ্যই তিনি হতে বাংলা ভাষী। বাংলা হতো তাঁর ভাষা। যেহেতু নবি বা রাসুল আর আসবেন না, তাই নবি-রাসুলদের যারা উত্তরসূরি রয়েছেন তাদের উচিত বাংলণা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে এগিয়ে আসা।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মর্যাদা : ইসলামে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। শহীদ দুই প্রকার। এক. ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন যারা অথবা যাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। দুই. কোনো মহামারীতে, পানিতে ডুবে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে অথবা কোনো ভবন বা স্থাপনা ধসে তার নিচে চাপা পড়ে যদি কোনো মুসলমান প্রাণ হারায়; ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ বলে বিবেচিত হবেন তারা। এমনিভাবে সন্তান প্রসবের সময় কোনো স্ত্রীলোক যদি মৃত্যুবরণ করেন সেও শহীদ বলে গণ্য হবেন। বাংলাদেশের মুসলমানগণ ভাষার জন্য যে আÍত্যাগ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। ছালাম, জব্বার, রফিক, বরকতেরা মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। অন্যের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তারা। ইসলামের আলোচনা অনুযায়ী ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা শহীদ। স¤পদের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ দেশে দেশে লড়াই করে কিন্তু মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশীরাই তৈরী করেছে।
শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন আলোচনা এসেছে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ কেননা শাহাদাত তথা অন্যান্য নেক আমল দ্বারা কেবল আল্লাহর হক মাফ হয়। কিন্তু ঋণ তথা বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত হকদার ব্যক্তি ক্ষমা না করেন। জামে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘শহীদকে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই ক্ষমা করে দেন। এরপর জান্নাতে তার আবাসস্থল দেখানো হয়, কবরের ভয়াবহ আজাব থেকে হেফাজত রাখবেন। কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদে থাকবে। এবং তার মাথায় বিশেষ মুকুট পরিধান করানো হবে।’ মহান আল্লাহ তায়ালা শহীদদের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাদের (শহীদদের) মৃত বলো না। তারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে রিজিকপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং ভাষা শহীদ কিংবা যে কোনো ধরনের শহীদ হোক না কেন, আল্লাহ মহানের কাছে রয়েছে তার জন্য আলাদা মর্যাদা এবং ইসলাম তাকে প্রদান করেছে বিশেষ গুরুত্ব। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের জন্য আল্লাহ মহানের কাছে দোয়া-প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভাষা শহীদদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
© মাওলানা মিরাজ রহমান
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায় – আব্দুল লতিফ

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
ওরা কথায় কথায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমাদেরই হাতে-পায়ে
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়
কও দেহি ভাই
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
সইমু না আর সইমু না, অন্য কথা কইমু না
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান, আহা যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,
এই জানের বদল রাখুম রে ভাই, বাব-দাদার জবানের মান
ও হো..হো..হো….বাব-দাদার জবানের মান
যে শুইনাছে আমার দেশের গাঁওগেরামের গান
নানান রঙয়ের নানান রসে, ভইরাছে তার প্রাণ
যে শুইনাছে আমার দেশের গাঁওগেরামের গান
নানান রঙয়ের নানান রসে, ভইরাছে তার প্রাণ
যপ-কীর্তন, ভাসান-জারি, গাজীর গীত আর কবি সারি
যপ-কীর্তন, ভাসান-জারি, গাজীর গীত আর কবি সারি
আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা নাইচা নাইচা কেমন গায়
বাংলাদেশের
আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা নাইচা নাইচা কেমন গায়
ওরা কাদের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা কাদের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
তারি তালে তালে হৈ ঢোল করতাল বাজে ঐ
বাশি কাশি খঞ্জনি সানাই, (আহা) বাশি কাশি খঞ্জনি সানাই
এখন কও দেখি ভাই এমন শোভা কোথায় গেলে দেখতে পাই
ও হো..হো..হো….কোথায় গেলে দেখতে পাই
পূবাল বায়ে বাদাম দিয়া লাগলে ভাটির টান
গায়রে আমার দেশের মাঝি
ভাটিয়ালি গান, (ভাইরে) ভাটিয়ালি গান
তার ভাটিয়াল গানের সুরে মনের দুসখু যায়রে দূরে
বাজায় বাশি সেইনা সুরে রাখাল বনের ছায়
রাখাল বনের ছায়
ওরা যদি না দেয় মান আমার দেশের যতই যাক
তার সাথে মোর নাড়ীর যোগাযোগ, আছে তার সাথে মোর নাড়ীর যোগাযোগ
এই আপদ-বিপদ দুঃখে কষ্টে এ গান আমার ভোলায় শোক
ও হো..হো..হো….এ গান আমার ভোলায় শোক
এই ঠুং ঠুংয়া ঠুং দোতারা আর সারিন্দা বাজাইয়া
গায়ের যোগী ভিক্ষা মাগে প্রেমের সারি গাইয়াগো
প্রেমের সারি গাইয়া
এই ঠুং ঠুংয়া ঠুং দোতারা আর সারিন্দা বাজাইয়া
গায়ের যোগী ভিক্ষা মাগে প্রেমের সারি গাইয়াগো
প্রেমের সারি গাইয়া
একতারা বাজাইয়া বাউল ঘুচায় মনের সকল আউল
একতারা বাজাইয়া বাউল ঘুচায় মনের সকল আউল
তারা মার্ফতি মুর্শিদি তত্ত্বে পথের দিশা দিয়া যায়
মার্ফতি মুর্শিদি তত্ত্বে পথের দিশা দিয়া যায়
ওরা তাদের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা তাদের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরে আমার বাংলারে, ওরে সোনার ভান্ডারে
আরো কত আছে যে রতন আহা আরো কত আছে যে রতন
মূল্য তাহার হয়না দিলেও মনি মুক্তা আর কাঞ্চন
ও হো..হো..হো….মনি মুক্তা আর কাঞ্চন
আরেক কথা মনে হইলে আঁখি ঝইড়া যায়
ঘুমপাড়াইনা গাইত যে গান মোর দুঃখিনী মায়
আরেক কথা মনে হইলে আঁখি ঝইড়া যায়
ঘুমপাড়াইনা গাইত যে গান মোর দুঃখিনী মায়
ওমায় সোনা মানিক যাদু বলে চুমা দিয়া লইত কোলে
সোনা মানিক যাদু বলে চুমা দিয়া লইত কোলে
আরো আদর কইরা কইত মোরে আয় চান আমার বুকে আয়
আদর কইরা
আরো আদর কইরা কইত মোরে আয় চান আমার বুকে আয়
ওরা মায়ের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা মায়ের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
কও আমার মায়ের মত গান, আমার মায়ের মত প্রাণ
বাংলা বিনে কারো দেশে নাই, বাংলা বিনে কারো দেশে নাই
এই মায়ের মুখের মধুর বুলি কেমন কইরা ভুলুম ভাই
ও হো..হো..হো….কেমন কইরা ভুলুম ভাই
এই ভাষারই লাইগা যারা মায়ের দেয় ভুলান
দেশের মাটি বুকের খুনে কইরা গেছে লাল
এই ভাষারই লাইগা যারা মায়ের দেয় ভুলান
দেশের মাটি বুকের খুনে কইরা গেছে লাল
মনে কইরা তরার কথা কান্দে বনের তরু লতা
মনে কইরা তরার কথা কান্দে বনের তরু লতা
তাইতো ঘরে ঘরে কত মা তায় চোখের জলে বুক ভাসায়
ওরা মায়ের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
ওরা মায়ের মুখের কথা কাইরা নিতে চায়
কইরো না আর দুঃখ শোক শোনরে গাঁও গেরামের লোক
শোন শোন গঞ্জের সোনা ভাই, তোমরা শোন শোন গঞ্জের সোনা ভাই
একবার বুক ফুলাইয়্যা কও দেখি ভাই
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই………
Friday, 20 February 2015
মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর সেরা সৃষ্টি মানুষ। তিনি মানুষকে দান করেছেন বুদ্ধি-বিবেক-জ্ঞান, দান করেছেন সুন্দর অবয়ব, কথা বলার শক্তি, দান করেছেন উদ্ভাবনী শক্তি, কলাকুশলতা, মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা দান করেছেন। নানা জনের নানা ভাষা চেষ্টা করে আয়ত্ত করার মেধা ও যোগ্যতা দান করেছেন, সকল সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। দৈহিক ও মানসিক দিক দিয়ে মানুষকে তিনি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন : লাকাদ খালাক্ নাল ইন্ সানা ফী আহ্ সানি তাক্ ভীম- আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে (সূরা তীন : আয়াত ৪) । ওয়া লাকাদ কাররামনা বনী আদাম- আদম সন্তানকে আমি মর্যাদা দান করেছি। কুরআন মজীদে আরও ইরশাদ হয়েছে : খালাকাল ইন্ সানা আল্লামাহুল বাইয়্যান- তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে ভাব প্রকাশ করার শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা র্আ রহ্মান : আয়াত ৩-৪)
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃস্তন থেকে যাতে সুষম খাদ্য হিসেবে দুগ্ধ পান করতে পারে সে জন্য সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। র্কুআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (সূরা লুকমান : আয়াত-১৪)
মাতৃদুগ্ধ যেমন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর এক অনন্য নি’আমত, এক অপরিসীম মহাদান, তেমনি মাতৃভাষাও আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর মহাদান। পৃথিবীতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী সরদারে দো আলম সাইয়্যিদুল র্মুসালীন নুরে মুজাস্সম পর্যন্ত এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী- রসূল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন মানুষকে সৎপথের দিশা দিবার জন্য, পথভ্রষ্ট মানুষকে হিদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত করে আলোকিত মানুষে পরিণত করার জন্য, ইন্সানে কামিল গড়ে তুলবার জন্য, শয়তানের ধোঁকা, প্রবঞ্চনা ও খপ্পর থেকে মানুষকে উদ্ধার করে সহজ, সরল, সত্য সুন্দরে পথে মানুষকে পরিচালিত করার জন্য। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ছাড়া অন্য সকল নবী-রসূল যুগে যুগে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়ে এসেছন নিজ নিজ কওমকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য কিংবা কোন নির্দিষ্ট জনপদ বা অঞ্চলের মানুষকে হিদায়াত দান করার জন্য। তাঁরা যে যুগ যে কওমের জন্য প্রেরিত হয়ে এসেছেন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁদেরকে সেই কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়ামা র্আসালনা কাওমিহী লিইউবায়ইনা লাহুম্- আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রসূলকে তাঁর নিজ কওমের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪)।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা) সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তিন রহমাতুল্লিল আলামীন- বিশ্বজগতের জন্য রহমত। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর মাতৃভাষা আরবীতে কুরআন মজীদ নাযিল করলেন। হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামের নিকট তওরাত নাযিল হয়েছিল তাঁর মাতৃভাষাতে। আবার ঈসা (আ)-এর নিকট ইঞ্জিন নাযিল হয়েছিল, হযরত ঈসা (আ)-এর মাতৃভাষাতেই।
কুরআন মজীদ প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষায় নাযিল হলো সে সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ফাইন্নামা ইয়াস্ সারুনাহু বিলিসানিকা লিতুবাশ্ শিরা বিহিল্ মুত্তাকীনা ওয়া তুন্ যিরা বিহী কাওমাল্লুদ্্দা-আমি তো আপনার ভাষায় র্কুআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে আপিন এর দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পারেন এবং বিত-াপ্রবণ সম্প্রদায়কে এর দ্বারা সর্তক করে দিতে পারেন (সূরা মারইয়াম : আয়াত ৯৭)।
পৃথিবীতে কয়েক হাজার ভাষা রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও কয়েকটি ভাষা রয়েছে আবার এখানে উচ্চারণের বিভিন্নতার কারণে বাংলাভাষাই আঞ্চলিক ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেছে। নানান ভাষা এবং ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কুদ্রতের ও নি‘আমতের অপূর্ব নিদর্শন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া মিন আয়াতিহী খাল্কুস্ সামাওয়াতি ওয়াল র্আদি ওয়াখ্তিলাফু আল্ সিনাতিকুম্ ওয়া আল্ওয়ানিকুম্, ইন্না ফী যালিকা লা আয়াতিল্লিল্ আলামীন- আর তাঁর নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে (সূরা রুম : আয়াত ২২)।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময় এক ভাষণে বলেছিলেন : শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ। কবির এই কথার সঙ্গে আরও যোগ করা যায় যে, দীক্ষার ক্ষেত্রেও ঐ কথাটি প্রযোজ্য। যে কারণে ফুরফুরা শারীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান মওলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রহ) বয়আত, তালীম, তালকীন সব বাংলায় করতেন। তাঁর খলিফাগণ সেটাই অনুসরণ করেন। বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক ও প্রামাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য তাসাওউফ গ্রন্থ রচনা করেন যশোরের খড়কীর আলা হযরত পীর মওলানা শাহ্ আবদুল করিম (রহ)। গ্রন্থটির নাম এরশাদে খানেকীয়া বা খোদা প্রাপ্তিতত্ত্ব।আমরা অন্যের মাতৃভাষা অনেক চেষ্টা করে যথাযথ তালীম নিয়ে হয়ত আয়ত্ত করতে পারি। কিন্তু সেই ভাষায় যত নির্বিঘেœই কথা বলি না কেন, কিংবা লিখিনা কেন ঐ বলার সময় কিংবা লেখার সময় নিজ মাতৃভাষা তখন মস্তিস্কতন্ত্রে সক্রিয় থেকে অনুবাদকের কাজ করে অর্থাৎ নিজ মাতৃভাষা দ্বারাই আমরা অন্য ভাষা বুঝি, বোধগম্যতায় আনয়ন করি।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে এক দীর্ঘ অভিভাষণে বলেছিলেন,... আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্ব শাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় সাহিত্য ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে ষশস্বী হতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকেই পারস্য আরব্য কর্তৃক বিজিত হয়েছিল, আরবী সাহিত্যের চর্চা করেছিল। কিন্তু তাঁর নিজের সাহিত্য ছাড়েনি। তাই ফিরদৌসী, নিজামী, সাদী, হাফিজ, খাকানী, বুআলী সীনা, গাজ্জালী, খায়্যাম প্রমুখ কবি, ভাবুক, সুফী ও দার্শনিক, লেখকগণের রচনায় পারস্য সাহিত্য গৌরবে সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশ যখন দিল্লীর অধীনতা নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে গৌড়ে এক স্বাধীন সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করে তখন থেকে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির দিকে রাজার মনোযোগ পড়ে। ইউসুফ শাহ্, হোসেন শাহ, নসরত শাহ্, ফিরোজ শাহ্, নিজাম শাহ্ শূর, ছুটী খাঁ, পরাগল খাঁ প্রমুখ রাজা ও রাজপুরুষ বাংলা সাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ফুরফুরা শরীফের পীর আবু বকর সিদ্দিকী (রহ)-এর খলীফা ছিলেন। এক সময় তিনি খড়কী শরীফের পীর আবদুল করিম (রহ)-এরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন।
প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা) ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে যাবার ৭ বছর পূর্বে হযরত জাফর ইবনে আবু তালিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেন। তখন সেখানকার রাজা ছিলেন খ্রিস্টান, যাঁর নাম নাজ্জাসী। প্রিয় নবী (সা) হযরত জাফর রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহুকে নির্দেশ দেন, আবিসিনিয়ায় যাবার আগে সেখানকার ভাষা শিখে নাও। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ আলিম ছিলেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি আবিসিনীয়দের হাবসী ভাষা শিখে নিলেন। আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবারে উপস্থিত হয়ে হাবসী ভাষায় ইসলামের মর্মবাণী বুঝিয়ে বললে সম্রাট নাজ্জাসী অভিভূত হয়ে যান।
আমাদের বাংলাদেশে আরব, ইয়ামন, তুরস্ক (রুম), মিসর, পারস্য, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চলের ইসলাম প্রচারক দল সেই সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এখানে যাঁরাই ইসলাম প্রচার করতে এসেছেন তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এ দেশে এসে এ দেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে এই দেশী ভাষায় ইসলাম প্রচার করেন। তাই বাংলা ভাষায় তাঁদের অনেক শব্দ সংযোজিত হওয়ার ফলে এই ভাষা নবরূপ লাভ করে এক অপরূপ সত্তা নিয়ে বিকশিত হতে থাকে। মাতৃভাষা আল্লাহ্র মহাদান। মাতৃভাষায় যত সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্যের মাতৃভাষায় তা তত সহজে করা যায় না। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ (সা)কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন- ফাইন্নামা ইয়াস্ র্সানাহু বিলিসানিকা লা আল্লাহুম ইয়াতাযাক্ কারূন- আমি তো আপনার কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা দুখান- আয়াত ৫৮)এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে একখানি মাত্রই গ্রন্থ রয়েছে যে গ্রন্থখানির গোটাটাই লাখ লাখ মানুষ হিফ্জ করে হাফিজ হয়েছে এবং হচ্ছে। এই বিশাল এবং বৃহত্তম আসমানী কিতাব প্রতিদিন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পঠিত হচ্ছে। সালাতে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রিয় নবী (সা) মাতৃভাষা আরবীতে নাযিলকৃত আল-কুরআন সব ভাষাভাষীর মুসলিমদের অতি প্রিয় কিতাব, আরবী ভাষাও প্রিয় ভাষা।
ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি খুবই গুরুত্ব আরোপ করায় ইসলাম যেখানেই গিয়েছে সেখানকার জনগণের মাতৃভাষাকে আপন করে নিয়েছে। সব ভাষাই তো আল্লাহর দান। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার দুয়ার উন্মোচিত করে দেন বাংলার সুলতানগণ। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কতঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। প-িতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং তৈলাধার পাত্র কিংবা পাত্রাধার তৈল- এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গ ভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বঙ্গভাষাকে প-িতম-লী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন। হাড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষাও তেমনই সুধী মহলে অপাঙক্তেয় ছিল তেমনই ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই শুভদিন শুভক্ষণের প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাংলাভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের আনয়ন করিল।
বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এই আল্লাহর মহাদানের ওপর যখনি কোনরূপ আঘাত এসেছে বাংলাদেশের মানুষ তা সহ্য করেনি এবং করবেও না। এই ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার সুলতানগণ। এই ভাষার মান রক্ষার জন্য, এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যারা ১৯৫২তে জান কুরবান করলেন তাঁরা মহান শহীদ। সেই বরকত, সালাম, আবদুল জব্বার প্রমুখ মহান শহীদানের নাম এখন বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। তাঁদের রক্তভেজা একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী হচ্ছে প্রায় ২৪ কোটি, যার মধ্যে প্রায় ১৮ কোটিই হচ্ছে মুসলিম। যার যার মাতৃভাষা তাঁর তাঁর কাছে অবশ্যই প্রিয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই ভাষা আমার প্রিয় ভাষা। এই ভাষায় আমি আমার মনের কথা খুলে বলতে পারি। আল্লাহর মহাদান মাতৃভাষাকে সঠিক মর্যাদা দেয়ার শিক্ষা আমরা কুরআন মজীদ থেকে পাই। হাদিস শরীফ থেকেও পাই।
পরিশেষে সপ্তদশ শতাব্দীর কবি আবদুল হাকিম রচিত নুরনামা পুঁথির কয়েকটি পঙ্ক্তি প্রণিধানযোগ্য। কবি বলেন, যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
লেখক : অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা
ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃস্তন থেকে যাতে সুষম খাদ্য হিসেবে দুগ্ধ পান করতে পারে সে জন্য সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। র্কুআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (সূরা লুকমান : আয়াত-১৪)
মাতৃদুগ্ধ যেমন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর এক অনন্য নি’আমত, এক অপরিসীম মহাদান, তেমনি মাতৃভাষাও আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর মহাদান। পৃথিবীতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী সরদারে দো আলম সাইয়্যিদুল র্মুসালীন নুরে মুজাস্সম পর্যন্ত এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী- রসূল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন মানুষকে সৎপথের দিশা দিবার জন্য, পথভ্রষ্ট মানুষকে হিদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত করে আলোকিত মানুষে পরিণত করার জন্য, ইন্সানে কামিল গড়ে তুলবার জন্য, শয়তানের ধোঁকা, প্রবঞ্চনা ও খপ্পর থেকে মানুষকে উদ্ধার করে সহজ, সরল, সত্য সুন্দরে পথে মানুষকে পরিচালিত করার জন্য। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ছাড়া অন্য সকল নবী-রসূল যুগে যুগে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়ে এসেছন নিজ নিজ কওমকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য কিংবা কোন নির্দিষ্ট জনপদ বা অঞ্চলের মানুষকে হিদায়াত দান করার জন্য। তাঁরা যে যুগ যে কওমের জন্য প্রেরিত হয়ে এসেছেন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁদেরকে সেই কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়ামা র্আসালনা কাওমিহী লিইউবায়ইনা লাহুম্- আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রসূলকে তাঁর নিজ কওমের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪)।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা) সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তিন রহমাতুল্লিল আলামীন- বিশ্বজগতের জন্য রহমত। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর মাতৃভাষা আরবীতে কুরআন মজীদ নাযিল করলেন। হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামের নিকট তওরাত নাযিল হয়েছিল তাঁর মাতৃভাষাতে। আবার ঈসা (আ)-এর নিকট ইঞ্জিন নাযিল হয়েছিল, হযরত ঈসা (আ)-এর মাতৃভাষাতেই।
কুরআন মজীদ প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষায় নাযিল হলো সে সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ফাইন্নামা ইয়াস্ সারুনাহু বিলিসানিকা লিতুবাশ্ শিরা বিহিল্ মুত্তাকীনা ওয়া তুন্ যিরা বিহী কাওমাল্লুদ্্দা-আমি তো আপনার ভাষায় র্কুআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে আপিন এর দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পারেন এবং বিত-াপ্রবণ সম্প্রদায়কে এর দ্বারা সর্তক করে দিতে পারেন (সূরা মারইয়াম : আয়াত ৯৭)।
পৃথিবীতে কয়েক হাজার ভাষা রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও কয়েকটি ভাষা রয়েছে আবার এখানে উচ্চারণের বিভিন্নতার কারণে বাংলাভাষাই আঞ্চলিক ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেছে। নানান ভাষা এবং ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কুদ্রতের ও নি‘আমতের অপূর্ব নিদর্শন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া মিন আয়াতিহী খাল্কুস্ সামাওয়াতি ওয়াল র্আদি ওয়াখ্তিলাফু আল্ সিনাতিকুম্ ওয়া আল্ওয়ানিকুম্, ইন্না ফী যালিকা লা আয়াতিল্লিল্ আলামীন- আর তাঁর নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে (সূরা রুম : আয়াত ২২)।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময় এক ভাষণে বলেছিলেন : শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ। কবির এই কথার সঙ্গে আরও যোগ করা যায় যে, দীক্ষার ক্ষেত্রেও ঐ কথাটি প্রযোজ্য। যে কারণে ফুরফুরা শারীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান মওলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রহ) বয়আত, তালীম, তালকীন সব বাংলায় করতেন। তাঁর খলিফাগণ সেটাই অনুসরণ করেন। বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক ও প্রামাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য তাসাওউফ গ্রন্থ রচনা করেন যশোরের খড়কীর আলা হযরত পীর মওলানা শাহ্ আবদুল করিম (রহ)। গ্রন্থটির নাম এরশাদে খানেকীয়া বা খোদা প্রাপ্তিতত্ত্ব।আমরা অন্যের মাতৃভাষা অনেক চেষ্টা করে যথাযথ তালীম নিয়ে হয়ত আয়ত্ত করতে পারি। কিন্তু সেই ভাষায় যত নির্বিঘেœই কথা বলি না কেন, কিংবা লিখিনা কেন ঐ বলার সময় কিংবা লেখার সময় নিজ মাতৃভাষা তখন মস্তিস্কতন্ত্রে সক্রিয় থেকে অনুবাদকের কাজ করে অর্থাৎ নিজ মাতৃভাষা দ্বারাই আমরা অন্য ভাষা বুঝি, বোধগম্যতায় আনয়ন করি।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে এক দীর্ঘ অভিভাষণে বলেছিলেন,... আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্ব শাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় সাহিত্য ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে ষশস্বী হতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকেই পারস্য আরব্য কর্তৃক বিজিত হয়েছিল, আরবী সাহিত্যের চর্চা করেছিল। কিন্তু তাঁর নিজের সাহিত্য ছাড়েনি। তাই ফিরদৌসী, নিজামী, সাদী, হাফিজ, খাকানী, বুআলী সীনা, গাজ্জালী, খায়্যাম প্রমুখ কবি, ভাবুক, সুফী ও দার্শনিক, লেখকগণের রচনায় পারস্য সাহিত্য গৌরবে সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশ যখন দিল্লীর অধীনতা নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে গৌড়ে এক স্বাধীন সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করে তখন থেকে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির দিকে রাজার মনোযোগ পড়ে। ইউসুফ শাহ্, হোসেন শাহ, নসরত শাহ্, ফিরোজ শাহ্, নিজাম শাহ্ শূর, ছুটী খাঁ, পরাগল খাঁ প্রমুখ রাজা ও রাজপুরুষ বাংলা সাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ফুরফুরা শরীফের পীর আবু বকর সিদ্দিকী (রহ)-এর খলীফা ছিলেন। এক সময় তিনি খড়কী শরীফের পীর আবদুল করিম (রহ)-এরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন।
প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা) ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে যাবার ৭ বছর পূর্বে হযরত জাফর ইবনে আবু তালিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেন। তখন সেখানকার রাজা ছিলেন খ্রিস্টান, যাঁর নাম নাজ্জাসী। প্রিয় নবী (সা) হযরত জাফর রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহুকে নির্দেশ দেন, আবিসিনিয়ায় যাবার আগে সেখানকার ভাষা শিখে নাও। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ আলিম ছিলেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি আবিসিনীয়দের হাবসী ভাষা শিখে নিলেন। আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবারে উপস্থিত হয়ে হাবসী ভাষায় ইসলামের মর্মবাণী বুঝিয়ে বললে সম্রাট নাজ্জাসী অভিভূত হয়ে যান।
আমাদের বাংলাদেশে আরব, ইয়ামন, তুরস্ক (রুম), মিসর, পারস্য, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চলের ইসলাম প্রচারক দল সেই সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এখানে যাঁরাই ইসলাম প্রচার করতে এসেছেন তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এ দেশে এসে এ দেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে এই দেশী ভাষায় ইসলাম প্রচার করেন। তাই বাংলা ভাষায় তাঁদের অনেক শব্দ সংযোজিত হওয়ার ফলে এই ভাষা নবরূপ লাভ করে এক অপরূপ সত্তা নিয়ে বিকশিত হতে থাকে। মাতৃভাষা আল্লাহ্র মহাদান। মাতৃভাষায় যত সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্যের মাতৃভাষায় তা তত সহজে করা যায় না। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ (সা)কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন- ফাইন্নামা ইয়াস্ র্সানাহু বিলিসানিকা লা আল্লাহুম ইয়াতাযাক্ কারূন- আমি তো আপনার কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা দুখান- আয়াত ৫৮)এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে একখানি মাত্রই গ্রন্থ রয়েছে যে গ্রন্থখানির গোটাটাই লাখ লাখ মানুষ হিফ্জ করে হাফিজ হয়েছে এবং হচ্ছে। এই বিশাল এবং বৃহত্তম আসমানী কিতাব প্রতিদিন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পঠিত হচ্ছে। সালাতে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রিয় নবী (সা) মাতৃভাষা আরবীতে নাযিলকৃত আল-কুরআন সব ভাষাভাষীর মুসলিমদের অতি প্রিয় কিতাব, আরবী ভাষাও প্রিয় ভাষা।
ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি খুবই গুরুত্ব আরোপ করায় ইসলাম যেখানেই গিয়েছে সেখানকার জনগণের মাতৃভাষাকে আপন করে নিয়েছে। সব ভাষাই তো আল্লাহর দান। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার দুয়ার উন্মোচিত করে দেন বাংলার সুলতানগণ। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কতঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। প-িতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং তৈলাধার পাত্র কিংবা পাত্রাধার তৈল- এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গ ভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বঙ্গভাষাকে প-িতম-লী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন। হাড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষাও তেমনই সুধী মহলে অপাঙক্তেয় ছিল তেমনই ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই শুভদিন শুভক্ষণের প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাংলাভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের আনয়ন করিল।
বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এই আল্লাহর মহাদানের ওপর যখনি কোনরূপ আঘাত এসেছে বাংলাদেশের মানুষ তা সহ্য করেনি এবং করবেও না। এই ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার সুলতানগণ। এই ভাষার মান রক্ষার জন্য, এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যারা ১৯৫২তে জান কুরবান করলেন তাঁরা মহান শহীদ। সেই বরকত, সালাম, আবদুল জব্বার প্রমুখ মহান শহীদানের নাম এখন বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। তাঁদের রক্তভেজা একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী হচ্ছে প্রায় ২৪ কোটি, যার মধ্যে প্রায় ১৮ কোটিই হচ্ছে মুসলিম। যার যার মাতৃভাষা তাঁর তাঁর কাছে অবশ্যই প্রিয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই ভাষা আমার প্রিয় ভাষা। এই ভাষায় আমি আমার মনের কথা খুলে বলতে পারি। আল্লাহর মহাদান মাতৃভাষাকে সঠিক মর্যাদা দেয়ার শিক্ষা আমরা কুরআন মজীদ থেকে পাই। হাদিস শরীফ থেকেও পাই।
পরিশেষে সপ্তদশ শতাব্দীর কবি আবদুল হাকিম রচিত নুরনামা পুঁথির কয়েকটি পঙ্ক্তি প্রণিধানযোগ্য। কবি বলেন, যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
লেখক : অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা
ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি প্রদান করা অবৈধ’ : আল-কুরাআন
মানুষকে দুই ধরনের আগুনে দগ্ধ করে- এক. প্রতিহিংসার আগুন; এই আগুনে হিংসুক নিজেই জ্বলেপুড়ে দগ্ধ হতে থাকে। দুই. বারুদ থেকে সৃষ্ট আগুন; এই আগুন মানুষের জন্য উপকারী বটে, তবে প্রজ্বালনকারী নির্বোধ হলে নিজেও জ্বলতে পারে, আবার অন্যকেও জ্বালাতে পারে। ‘নিজে জ্বলো এবং অন্যকে জ্বালাও’- ইসলাম যেহেতু এর কোনো নীতিকে কোনো অবস্থায়ই সমর্থন করে না, তাই ইসলাম হিংসা-বিদ্বেষকেও হারাম করেছে। আবার বারুদের সৃষ্ট আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো নীতিকেও কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। আর এটাকে মানবতাবিরোধী গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে।
ইসলামে মানব মর্যাদার ধারণা
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য প্রাণীর ওপর স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি। তাদের উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমার বহু সৃষ্টজীবের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা ইসরা ৭০)
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই শ্রেষ্ঠত্ব কোন গুণাবলির ওপর নির্ভরশীল? উদাহরণস্বরূপ দেখুন, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সুশ্রী চেহারা, সুঠাম দেহ, সুষম প্রকৃতি এবং অঙ্গসৌষ্ঠব দান করেছেন, যা অন্যান্য সৃষ্টজীবের মধ্যে নেই। বাকশক্তি ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে নৈপুণ্য মানুষ লাভ করেছে, তা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজের ভাব ব্যক্ত করা এবং আক্ষরিক জ্ঞান সবই মানুষের স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কারের মূলেও রয়েছে এই বিবেকবুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি। এরই সাহায্যে সে কত কিছুই না আবিষ্কার করেছে, না জানি আরো কত কিছু আবিষ্কার করে! এই বিবেকবুদ্ধির মাধ্যমেই সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার পরিচয় ও তার পছন্দ-অপছন্দ জেনে পছন্দের অনুগমন ও অপছন্দ থেকে বিরত থাকে।
মানব হত্যা বিষয়ে ইসলাম
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না; বরং এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইসলাম সব সময় সোচ্চার, সরব এবং হত্যাকারীর জন্য রেখেছে কঠিন শাস্তির বিধান। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হচ্ছে, ‘হত্যার বদলে হত্যা ও পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ছাড়া কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল, আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। (সুরা মায়িদা ৩২)
ভেবে দেখার বিষয় হলো, বিনা কারণে একজন ব্যক্তির হত্যাকারীকে সব মানুষের হত্যাকারী আর রক্ষাকারীকে সবার প্রাণ রক্ষাকারী সমতুল্য বলা হলো কেন? কারণ কোনো ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নরহত্যায় কেবল তখনই লিপ্ত হয়, যখন তার অন্তর থেকে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত অনুভূতি লোপ পেয়ে যায়। আর এ অবস্থায় নিজ স্বার্থের খাতিরে সে আরেকজনকেও হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করবে না। এভাবে গোটা মানবতা তার অপরাধপ্রবণ মানসিকতার টার্গেট হয়ে থাকবে। তা ছাড়া এজাতীয় মানসিকতা ব্যাপক আকারে ধারণ করলে সব মানুষই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং অন্যায় হত্যার শিকার যে-ই হোক না কেন, দুনিয়ার সব মানুষকে মনে করতে হবে, এ অপরাধ আমাদের সবারই প্রতি করা হয়েছে।’ (তাওজিহুল কোরআন ১/৩১৬)। বিপরীতে একজনের প্রাণ রক্ষাকারী গোটা মানবতার রক্ষাকর্তা হিসেবেই স্বীকৃতি পাবে।
মানব মর্যাদা যেহেতু নরঘাতকদের প্রাপ্য নয়, তাই ইসলাম তাদের শাস্তির ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দেয়নি; বরং তাদের জন্য রেখেছে জাগতিক ও পারলৌকিক শাস্তি। জাগতিক শাস্তি হলো হত্যার বদলায় হত্যা, অঙ্গের বদলায় অঙ্গ। (সুরা মায়িদাহ ৪৫) পরকালীন শাস্তির ব্যাপারে ঘোষণা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জেনেশুনে কোনো মুসলমানকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন এবং তাকে লা’নত করবেন। আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা ৯৩)
প্রাণী পোড়ানোর শরয়ি বিধান
হত্যা যেভাবেই করা হোক, এটা যে কতটুকু কষ্টদায়ক তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আর জীবন্ত জ্বলেপুড়ে মরা কী পরিমাণ যন্ত্রণাদায়ক, তা প্রকাশের ভাষাও কোনো মানব-মানবীর পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ইসলাম তো বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু ও কীটপতঙ্গকেও পুড়িয়ে মারতে বারণ করে। তাহলে নিরপরাধ মানুষ পোড়ানোর বৈধতার তো প্রশ্নই আসে না।
এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিপীলিকার একটি বসতি পিপীলিকাসহ পোড়ানো দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কারা পিঁপড়ার বসতিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে? সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, আমরা। এতদ্শ্রবণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি প্রদান করা অবৈধ।’ (আবু দাউদ হা. ২৬৭৫)
অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘একমাত্র আগুনের সৃষ্টিকর্তাই আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি দিতে পারেন।’ (আবু দাউদ হা. ২৬৭৩)
আরেক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে জিনিস দ্বারা (আগুন) স্বয়ং আল্লাহ শাস্তি প্রদান করবেন, তা দ্বারা তোমরা কাউকে শাস্তি প্রদান করো না।’ (বুখারি হা. ৩০১৭)
ইতিহাসে জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর কয়েকটি ঘটনা
ইতিহাসের পাতায় মানুষ পোড়ানোর ঘটনা অনুসন্ধান করলে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কয়েকটি ঘটনা এখানে প্রদত্ত হলো-
ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা : নমরুদ ও তার দোসররা যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে যুক্তিতর্কে হেরে গেল, তখন তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে ইবরাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হোক। ঐতিহাসিক রেওয়াতসমূহে বর্ণিত রয়েছে, এক মাস পর্যন্ত সমগ্র শহরবাসী জ্বালানি কাঠ ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এরপর তাতে অগ্নিসংযোগ করে সাত দিন পর্যন্ত প্রজ্বলিত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অগ্নিশিখা আকাশচুম্বী হলে তারা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নিক্ষেপণযন্ত্রের মাধ্যমে অগ্নিসাগরে নিক্ষেপ করে। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য উত্তপ্ত আগুন শান্তির বাগানে পরিণত হয়ে গেল!
আসহাবে উখদুদের ঘটনা : পবিত্র কোরআনে আসহাবে উখদুদের (গর্তওয়ালা) ঘটনা সম্পর্কেও সুরা বুরুজে আলোকপাত করা হয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা মুসলিম শরিফের ৩০০৫ নম্বর হাদিসে বর্ণিত আছে। এখানে এটাই স্পষ্ট করা হয়েছে যে একদল লোককে আল্লাহর ওপর ইমান আনার কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্নিগর্তে নিক্ষেপ করার পর অগ্নি আরো বেশি প্রজ্বলিত হয়ে তার লেলিহান শিখা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যারা ইমানদারদের অগ্নিতে দগ্ধ করে তামাশা দেখছিল, তারাও এই আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। কেবল নরাধম বাদশাহ ইউসুফ জুনওয়াস পালিয়ে যায়। সে অগ্নি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেখানেই সলিলসমাধি লাভ করে। এর থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো, দঙ্কারীকেও দহন যন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে।
আবু মুসলিম খাওলানি (রা.)-এর ঘটনা : আবু মুসলিম তাঁর উপনাম। তাঁর আসল নাম আব্দুল্লাহ। তিনি ইয়ামানের অধিবাসী। মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার আসওয়াদ আল আনাসি যখন ইয়ামনের ওপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তখন সে হজরত আবু মুসলিম খাওলানি (রা.)-কে তাঁর মত গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তিনি তা সাহসিকতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। আসওয়াদ তাঁকে হত্যা করার জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে অগ্নি প্রজ্বালিত করে এবং তাতে তাঁকে নিক্ষেপ করে। তবে আল্লাহর রহমতে তিনি নিরাপদে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। অতঃপর তিনি মদিনায় আগমন করলে হজরত উমর (রা.) বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ আমাকে উম্মতে মুহাম্মদির মধ্য থেকে এমন একজন ব্যক্তিকে দর্শন করার সৌভাগ্য দান করেছেন, যার সঙ্গে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো আচরণ করা হয়েছে। (তারিখে দামেস্ক)
ইসলামে অঙ্গহানি ও অঙ্গবিকৃতি নিষিদ্ধ : দগ্ধ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে সে অনেক বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু যে প্রাণে বেঁচে যায়, তাকে দিনের পর দিন দহনযন্ত্রণায় ভুগতে হয় আর বিকৃত-বীভৎস আকৃতি নিয়েই এই ধরায় বাঁচতে হয়। অথচ এভাবে মানবাকৃতির বিকৃতি সাধন ইবলিশ শয়তানের প্রতিজ্ঞারই প্রতিফলন। দেখুন, শয়তান আল্লাহ তায়ালাকে চ্যালেঞ্জ করে কী প্রতিজ্ঞা করেছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদের সরল পথ থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত করব। তাদের অনেক আশা-ভরসা দেব এবং তাদের আদেশ করব, ফলে তারা চতুষ্পদ জন্তুর কান চিরে ফেলবে এবং তাদের আদেশ করব, যাতে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। (সুরা নিসা, আয়াত ১১৯)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াজিদ আনসারি (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিনতাই ও প্রাণীর বিকৃত করা থেকে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি ৩/১৩৫ হাঃ ২৪৭৪)
মূলত কাউকে পেট্রলবোমা মেরে দগ্ধ করাও কারো অঙ্গহানি ও অঙ্গবিকৃতির শামিল। ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে দেখা যায়, মানবাকৃতির বিকৃতি সাধন করার মতো ঘৃণিত কাজ তদানীন্তন মক্কার পৌত্তলিকরা উহুদ যুদ্ধের মুসলিম শহীদদের সঙ্গে করেছিল। অতএব, নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ পোড়ানোর মতো মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ ত্যাগ করতে হবে। ন্যূনতম ইমানের অধিকারী একজন মুসলিম এজাতীয় কাজে মেতে উঠতে পারে না। আগুন নিয়ে খেলা করা কোনো মানুষের কাজ নয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক কথা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
ইসলামে মানব মর্যাদার ধারণা
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য প্রাণীর ওপর স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি। তাদের উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমার বহু সৃষ্টজীবের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা ইসরা ৭০)
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই শ্রেষ্ঠত্ব কোন গুণাবলির ওপর নির্ভরশীল? উদাহরণস্বরূপ দেখুন, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সুশ্রী চেহারা, সুঠাম দেহ, সুষম প্রকৃতি এবং অঙ্গসৌষ্ঠব দান করেছেন, যা অন্যান্য সৃষ্টজীবের মধ্যে নেই। বাকশক্তি ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে নৈপুণ্য মানুষ লাভ করেছে, তা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজের ভাব ব্যক্ত করা এবং আক্ষরিক জ্ঞান সবই মানুষের স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কারের মূলেও রয়েছে এই বিবেকবুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি। এরই সাহায্যে সে কত কিছুই না আবিষ্কার করেছে, না জানি আরো কত কিছু আবিষ্কার করে! এই বিবেকবুদ্ধির মাধ্যমেই সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার পরিচয় ও তার পছন্দ-অপছন্দ জেনে পছন্দের অনুগমন ও অপছন্দ থেকে বিরত থাকে।
মানব হত্যা বিষয়ে ইসলাম
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না; বরং এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইসলাম সব সময় সোচ্চার, সরব এবং হত্যাকারীর জন্য রেখেছে কঠিন শাস্তির বিধান। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হচ্ছে, ‘হত্যার বদলে হত্যা ও পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ছাড়া কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল, আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। (সুরা মায়িদা ৩২)
ভেবে দেখার বিষয় হলো, বিনা কারণে একজন ব্যক্তির হত্যাকারীকে সব মানুষের হত্যাকারী আর রক্ষাকারীকে সবার প্রাণ রক্ষাকারী সমতুল্য বলা হলো কেন? কারণ কোনো ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নরহত্যায় কেবল তখনই লিপ্ত হয়, যখন তার অন্তর থেকে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত অনুভূতি লোপ পেয়ে যায়। আর এ অবস্থায় নিজ স্বার্থের খাতিরে সে আরেকজনকেও হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করবে না। এভাবে গোটা মানবতা তার অপরাধপ্রবণ মানসিকতার টার্গেট হয়ে থাকবে। তা ছাড়া এজাতীয় মানসিকতা ব্যাপক আকারে ধারণ করলে সব মানুষই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং অন্যায় হত্যার শিকার যে-ই হোক না কেন, দুনিয়ার সব মানুষকে মনে করতে হবে, এ অপরাধ আমাদের সবারই প্রতি করা হয়েছে।’ (তাওজিহুল কোরআন ১/৩১৬)। বিপরীতে একজনের প্রাণ রক্ষাকারী গোটা মানবতার রক্ষাকর্তা হিসেবেই স্বীকৃতি পাবে।
মানব মর্যাদা যেহেতু নরঘাতকদের প্রাপ্য নয়, তাই ইসলাম তাদের শাস্তির ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দেয়নি; বরং তাদের জন্য রেখেছে জাগতিক ও পারলৌকিক শাস্তি। জাগতিক শাস্তি হলো হত্যার বদলায় হত্যা, অঙ্গের বদলায় অঙ্গ। (সুরা মায়িদাহ ৪৫) পরকালীন শাস্তির ব্যাপারে ঘোষণা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জেনেশুনে কোনো মুসলমানকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন এবং তাকে লা’নত করবেন। আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা ৯৩)
প্রাণী পোড়ানোর শরয়ি বিধান
হত্যা যেভাবেই করা হোক, এটা যে কতটুকু কষ্টদায়ক তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আর জীবন্ত জ্বলেপুড়ে মরা কী পরিমাণ যন্ত্রণাদায়ক, তা প্রকাশের ভাষাও কোনো মানব-মানবীর পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ইসলাম তো বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু ও কীটপতঙ্গকেও পুড়িয়ে মারতে বারণ করে। তাহলে নিরপরাধ মানুষ পোড়ানোর বৈধতার তো প্রশ্নই আসে না।
এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিপীলিকার একটি বসতি পিপীলিকাসহ পোড়ানো দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কারা পিঁপড়ার বসতিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে? সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, আমরা। এতদ্শ্রবণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি প্রদান করা অবৈধ।’ (আবু দাউদ হা. ২৬৭৫)
অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘একমাত্র আগুনের সৃষ্টিকর্তাই আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি দিতে পারেন।’ (আবু দাউদ হা. ২৬৭৩)
আরেক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে জিনিস দ্বারা (আগুন) স্বয়ং আল্লাহ শাস্তি প্রদান করবেন, তা দ্বারা তোমরা কাউকে শাস্তি প্রদান করো না।’ (বুখারি হা. ৩০১৭)
ইতিহাসে জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর কয়েকটি ঘটনা
ইতিহাসের পাতায় মানুষ পোড়ানোর ঘটনা অনুসন্ধান করলে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কয়েকটি ঘটনা এখানে প্রদত্ত হলো-
ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা : নমরুদ ও তার দোসররা যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে যুক্তিতর্কে হেরে গেল, তখন তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে ইবরাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হোক। ঐতিহাসিক রেওয়াতসমূহে বর্ণিত রয়েছে, এক মাস পর্যন্ত সমগ্র শহরবাসী জ্বালানি কাঠ ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এরপর তাতে অগ্নিসংযোগ করে সাত দিন পর্যন্ত প্রজ্বলিত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অগ্নিশিখা আকাশচুম্বী হলে তারা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নিক্ষেপণযন্ত্রের মাধ্যমে অগ্নিসাগরে নিক্ষেপ করে। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য উত্তপ্ত আগুন শান্তির বাগানে পরিণত হয়ে গেল!
আসহাবে উখদুদের ঘটনা : পবিত্র কোরআনে আসহাবে উখদুদের (গর্তওয়ালা) ঘটনা সম্পর্কেও সুরা বুরুজে আলোকপাত করা হয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা মুসলিম শরিফের ৩০০৫ নম্বর হাদিসে বর্ণিত আছে। এখানে এটাই স্পষ্ট করা হয়েছে যে একদল লোককে আল্লাহর ওপর ইমান আনার কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্নিগর্তে নিক্ষেপ করার পর অগ্নি আরো বেশি প্রজ্বলিত হয়ে তার লেলিহান শিখা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যারা ইমানদারদের অগ্নিতে দগ্ধ করে তামাশা দেখছিল, তারাও এই আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। কেবল নরাধম বাদশাহ ইউসুফ জুনওয়াস পালিয়ে যায়। সে অগ্নি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেখানেই সলিলসমাধি লাভ করে। এর থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো, দঙ্কারীকেও দহন যন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে।
আবু মুসলিম খাওলানি (রা.)-এর ঘটনা : আবু মুসলিম তাঁর উপনাম। তাঁর আসল নাম আব্দুল্লাহ। তিনি ইয়ামানের অধিবাসী। মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার আসওয়াদ আল আনাসি যখন ইয়ামনের ওপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তখন সে হজরত আবু মুসলিম খাওলানি (রা.)-কে তাঁর মত গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তিনি তা সাহসিকতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। আসওয়াদ তাঁকে হত্যা করার জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে অগ্নি প্রজ্বালিত করে এবং তাতে তাঁকে নিক্ষেপ করে। তবে আল্লাহর রহমতে তিনি নিরাপদে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। অতঃপর তিনি মদিনায় আগমন করলে হজরত উমর (রা.) বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ আমাকে উম্মতে মুহাম্মদির মধ্য থেকে এমন একজন ব্যক্তিকে দর্শন করার সৌভাগ্য দান করেছেন, যার সঙ্গে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো আচরণ করা হয়েছে। (তারিখে দামেস্ক)
ইসলামে অঙ্গহানি ও অঙ্গবিকৃতি নিষিদ্ধ : দগ্ধ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে সে অনেক বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু যে প্রাণে বেঁচে যায়, তাকে দিনের পর দিন দহনযন্ত্রণায় ভুগতে হয় আর বিকৃত-বীভৎস আকৃতি নিয়েই এই ধরায় বাঁচতে হয়। অথচ এভাবে মানবাকৃতির বিকৃতি সাধন ইবলিশ শয়তানের প্রতিজ্ঞারই প্রতিফলন। দেখুন, শয়তান আল্লাহ তায়ালাকে চ্যালেঞ্জ করে কী প্রতিজ্ঞা করেছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদের সরল পথ থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত করব। তাদের অনেক আশা-ভরসা দেব এবং তাদের আদেশ করব, ফলে তারা চতুষ্পদ জন্তুর কান চিরে ফেলবে এবং তাদের আদেশ করব, যাতে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। (সুরা নিসা, আয়াত ১১৯)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াজিদ আনসারি (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিনতাই ও প্রাণীর বিকৃত করা থেকে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি ৩/১৩৫ হাঃ ২৪৭৪)
মূলত কাউকে পেট্রলবোমা মেরে দগ্ধ করাও কারো অঙ্গহানি ও অঙ্গবিকৃতির শামিল। ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে দেখা যায়, মানবাকৃতির বিকৃতি সাধন করার মতো ঘৃণিত কাজ তদানীন্তন মক্কার পৌত্তলিকরা উহুদ যুদ্ধের মুসলিম শহীদদের সঙ্গে করেছিল। অতএব, নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ পোড়ানোর মতো মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ ত্যাগ করতে হবে। ন্যূনতম ইমানের অধিকারী একজন মুসলিম এজাতীয় কাজে মেতে উঠতে পারে না। আগুন নিয়ে খেলা করা কোনো মানুষের কাজ নয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক কথা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
© www.uttaranbarta.com/site2/?p=55988
আল্লাহর কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়
ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান। প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা যেমন অপরিসীম, তেমনি আল্লাহতায়ালার কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়। তিনি সব ভাষা জানেন ও বোঝেন। যে যেভাবেই তাকে ডাকেন না কেন তিনি বোঝেন, উত্তর দেন, তার সঙ্গে কথা বলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি, যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমাদের কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)। সব জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গাম্বর এসেছেন, তেমনি সব জাতির স্ব-স্ব ভাষাতেই আল্লাহতায়ালার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব অথবা কিতাববিহীন ওহি পাঠিয়েছেন। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা। আর না হয় মানুষ ভাষার মর্যাদা বুঝত না। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সঙ্গে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলীর মাঝে রয়েছে আকাশসমূহের ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতাও। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা আর রূম : ২২)। ভাষা ও রঙের এই বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আকাশ-মালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি। বর্ণের ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। কিন্তু তবুও এই বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। আর মানবতার এই ঐক্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সৃষ্টিকর্তাও একজনই। মানবজাতির সূচনালগ্নে ভাষা ছিল একটিই এবং তা ছিল ইলহামি ভাষা। এরপর মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে এলাকা এলাকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবেই সূচনাতে মানুষের রঙও ছিল একই রকম। এরপর গ্রীষ্ম, শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুযায়ী তার রঙেরও পরিবর্তন হতে থাকে।
আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা, কেউ যদি ভাবেন যে, বাংলাতে আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি কি তা শুনবেন? এর উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই আল্লাহপাক শুনবেন, কেননা তিনি বলেছেন, সব ভাষাই তার সৃষ্ট এবং সব ভাষাতেই নবী-রসূল পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভাষাই আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদার দিক থেকে খাটো নয়। আর এ জন্য সবাই নিজ নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু বড় কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি আমার প্রিয় মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে। আমরা আজ এতই আধুনিক হয়ে গেছি যে, মাতৃভাষায় কথা বলতেও নাকি লজ্জা লাগে। এফএম রেডিওগুলোতে দেখা যায়, একটি বাক্য বাংলা বললে সঙ্গে চারটি বাক্য বলে অন্য ভাষায়, এটার নামই কি আধুনিকতা? অথচ আল্লাহপাকের কাছে সব ভাষার মর্যাদা সমান। আমরা কি পারি না সর্বত্রে আমাদের দেশমাতৃকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে? আমাদের ওয়াজ-নসিহতগুলো হবে মাতৃভাষায়, আমাদের জুমার খুতবা হবে নিজ ভাষায়, নামাজে নির্ধারিত দোয়ার পর নিজ ভাষায় আল্লাহপাকের কাছে মন খুলে কিছু চাইতে কি পরি না?
আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব না দেই তাহলে আল্লাহপাকের দরবারেও আমাদের কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে না। কেননা বাংলাভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষারজ মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীর রয়েছে অবদান। আমাদের সবার দায়িত্ব, আমাদের লেখায়, কথায়, চলনে-বলনে মাতৃভাষাকে আরও বেশি করে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা। আমাদের ভাষাকে এমন সুন্দর ও মাধুর্যের সঙ্গে ত্র“টিহীনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে কেউ এর কোনো ত্র“টি খুঁজে না পায়। আমরা যদি আমাদের ভাষাকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং জুমার খুতবাগুলোতে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর ও মাধুরভাবে উপস্থাপন করতে পারি তবে অন্যরাও এর প্রতি আসক্ত হতে বাধ্য। জুমার দিনগুলোতে দেখা যায়, মসজিদ ভরে থাকে বর্ষিয়ান মুসল্লিতে, কিন্তু হাতেগনা যে ক’জন যুবক জুমার নামাজে যোগ দেন তারা হয়তো ইমাম সাহেব কি খুতবা দিচ্ছেন তা কানে না নিয়ে মোবাইলে গেমস খেলছেন অথবা চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছেন। এর কারণ কি? এর একটাই কারণ, আর তা হল তারা খুতবায় কোনো স্বাদ পাচ্ছেন না, ইমাম সাহেব আরবিতে যা বলছেন তাও তারা বুঝেন না, তাই তারা দু’রাকাত নামাজের জন্য মসজিদে আসেন আর নামাজ শেষ হলেই সপ্তাহের জন্য ছাড় পেয়েছেন বলে মনে করেন। আজ ছেলে-মেয়েদের নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হল তারা মসজিদমুখি নয় আর ইমাম সাহেবদের সঙ্গে তাদের বন্ধুসুলভ সম্পর্কও নেই। তাই প্রতিটি মসজিদে যদি নিজ মাতৃভাষায় যুগোপযোগী জুমার খুতবা দেয়া হয় আর তা যদি খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে উপস্থাপন করা হয় তাহলে মুসল্লিরা যেমন ঝিমুবেন না, তেমনি যুবকরাও মসজিদ থেকে আধ্যাত্মিক খাদ্য গ্রহণ করে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার চেষ্টা করবেন। তাই সর্বত্রে বাংলা প্রচলনের বিষয়ে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে আর এ কাজ সবচেয়ে বেশি আলেম সমাজই ভূমিকা রাখতে পারে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে নিজ ভাষার গুরুত্ব বোঝার তৌফিক দান করুন, আমিন।
© মাহমুদ আহমদ
masumon83@yahoo.com
মাতৃভাষা খোদার সেরা দান
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান। কবি ফররুখ আহমদ গানে গানে বলেছেন-
ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া। এভাবে রক্ত দিয়ে ভাষার প্রেমকে কালজয়ী করা যেন মাতৃপ্রেমেরই জ্বলন্ত প্রকাশ। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে- “আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তাঁর জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি, যাতে করে সে তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।” (সূরা ইবরাহীম, আয়াত নং-৪)।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের অর্জন যে বিশ্বের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো আমাদের ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ২১ ফেব্র“য়ারিকে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে ২১ ফেব্র“য়ারি পৃথিবীর সব দেশেই উদযাপিত হচ্ছে নিজ নিজ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলা দাবি করায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক যাদের শহীদ করা হল তারা হলেন- রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। আমাদের জানা মতে, তারা সবাই ছিলেন মুসলিম, যাদের নাম আমরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি, এরা মুসলিম ও মজলুম হওয়ার কারণে আমরা তাদের শহীদ হিসেবে অভিহিত করে থাকি। শুধু মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য জীবন দিলে বা মজলুম অবস্থায় ঘাতকের হাতে কোনো মুসলিম জীবন দিলেই কেবল তাকে ইসলামী পরিভাষায় শহীদ বলা হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের এ কৃতী সন্তানরা শহীদ, আর তাই তাদের স্মরণে যে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হল তাকে ‘শহীদ মিনার’ বলে থাকি।
গোটা বাংলাদেশে আনুমানিক হাজারদশেক শহীদ মিনার আছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দু’একটা শহীদ মিনার গড়ে উঠেনি। ভাষাকে নিয়ে এ ধরনের নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই, কখনওই ছিল না। কিন্তু নবীর সবচেয়ে বড় ওয়ারিশ হওয়ার দাবিদার, আমাদের দেশের জনসাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র ওলামায়ে কেরাম এ ভাষা দিবস উদযাপনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন না, এটি একটি অস্বস্তির বিষয়। কত সাধারণ কারণে ও তুচ্ছ ঘটনায় নিহতদের স্মরণে আমাদের ওলামায়ে কেরাম কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, দেয়া-মোনাজাত করে থাকেন। কিন্তু ভাষাশহীদদের জন্য কি আমাদের ওলামায়ে কেরাম এমনটি করতে পারেন না? এ শহীদদের ত্যাগ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই ওলামায়ে কেরামদের উচিত কোরআনখানি, মিলাদ-মাহফিল, আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাত করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করা। আমাদের ভাষাশহীদরা তাদের টগবগে যৌবনকে বিসর্জন দিয়ে, ইহকালীন সব ভোগ-বিলাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষার জন্য তাজা জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা আমাদের ওলামায়ে কেরামের এবং মুসলমানের দোয়া পাওয়ার যোগ্য।
যদি ওলামায়ে কেরাম ভাষাদিবস উদযাপনের প্রতীকী দিকগুলোকে শরিয়ত গর্হিত কাজ বলে এর প্রতি অনাগ্রহ দেখান, তাহলে বলব এর জন্যও সম্মানীত ওলামায়ে কেরামই দায়ী। কেননা ভাষাশহীদদের প্রাপ্য পরিশোধে ওলামায়ে কেরামের অমনোযোগী হওয়ার সুযোগে শূন্য ময়দানে শরিয়ত গর্হিত কাজগুলো স্থান করে নিয়েছে। অথচ আমরা আমাদের মৃত পূর্ব পুরুষদের জন্য ঠিকই কোরআন মজিদ তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল. দোয়া ইত্যাদি করে থাকি। পক্ষান্তরে ভাষাশহীদদের প্রতি জুলুম করেই যাচ্ছি। যা তাদের সঙ্গে একরকম বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। আমাদের ভাবতে হবে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম মাতৃভাষার জন্য কী আবদান রেখে গেছেন। এ ব্যাপারে মরুহুম মাওলানা আকরাম খাঁর কথা গর্বভরে উচ্চরণ করা যায়। তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সফল করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন। তাছাড়া হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও (রহ.) ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। সুতরাং আমাদের ওলামায়ে কেরাম ভাষাশহীদদের অবদানের প্রতি শ্রাদ্ধা জ্ঞাপন করে নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
প্রথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের সব শহীদ মিনারে কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া উচিত। আমাদের দেশের সব সরকার প্রধান তাদের আপনজনদের জন্য কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া-মোনাজাত ইত্যাদির মাধ্যমে মাগফিরত কামনা করে থাকেন। তবে ভাষাশহীদদের মাগফিরাতের জন্য অবশ্যই এসব কাজে সরকার প্রধান সহযোগিতা করবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম এ দেশের ওলামায়ে কেরামকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বিশ্বাস দেশের শহীদ মিনারগুলোতে একবার কোরআনুল কারিমের আওয়াজ তুলতে পারলে তা প্রতি বছরই চলতে থাকবে এবং তা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করবে। সমর্থন বাড়বে সাধারণ মানুষের এবং তারাও এ মহৎ কাজে শরিক হবেন। গোটা দেশ একসঙ্গে কোরআন মাজিদের সুর তুলবে। এভাবেই ভাষাদিবসের সত্যিকার চেতনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়াও আমাদের ওলামায়ে কেরাম ভাষাশহীদদের জন্য সাওয়াব রেসানিমূলক অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। মাতৃভাষা দিবসে দেশের প্রতিটি মাদ্রাসায় মাতৃভাষার ওপর আলোচনা সভা, রচনা প্রতিযোগিতা ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাও করা যেতে পারে। বস্তুত মহান ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সত্যিকার চেতনা তার বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত বাংলাদেশ ও তার ১৬ কোটি মানুষের নাজাতের মহামন্ত্র। ভাষাদিবসকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অপসংস্কৃতি যেমন কাম্য নয়, তেমনি কম্য নয় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে প্রতিহত করাও।
পরিশেষে এ দেশের ওলামায়ে কেরামের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আসুন না এ দেশের জনগণের ভালোবাসার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে দেশের সব শহীদ মিনারে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শহীদদের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে মাগফিরাত কামনা করি। তবে সাধারণ মুসলমান বিভিন্ন ইসলাম গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহবোধ করবেন এবং সর্বক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব মেনে নিতে আগ্রহ দেখাবেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সেই তওফিক দান করুন আমিন।
লেখক : মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী, সিনিয়র প্রভাষক, মাইলস্টোন কলেজ, ঢাকা
“ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা
খোদার সেরা দান
বিশ্বভাষার সবই তোমার
রূপ যে অনির্বাণ।”
প্রত্যেক জাতিরই কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যে এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন, তা হল আমাদের নিখাদ মাতৃভাষা প্রীতি।ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া। এভাবে রক্ত দিয়ে ভাষার প্রেমকে কালজয়ী করা যেন মাতৃপ্রেমেরই জ্বলন্ত প্রকাশ। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে- “আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তাঁর জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি, যাতে করে সে তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।” (সূরা ইবরাহীম, আয়াত নং-৪)।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের অর্জন যে বিশ্বের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো আমাদের ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ২১ ফেব্র“য়ারিকে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে ২১ ফেব্র“য়ারি পৃথিবীর সব দেশেই উদযাপিত হচ্ছে নিজ নিজ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলা দাবি করায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক যাদের শহীদ করা হল তারা হলেন- রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। আমাদের জানা মতে, তারা সবাই ছিলেন মুসলিম, যাদের নাম আমরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি, এরা মুসলিম ও মজলুম হওয়ার কারণে আমরা তাদের শহীদ হিসেবে অভিহিত করে থাকি। শুধু মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য জীবন দিলে বা মজলুম অবস্থায় ঘাতকের হাতে কোনো মুসলিম জীবন দিলেই কেবল তাকে ইসলামী পরিভাষায় শহীদ বলা হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের এ কৃতী সন্তানরা শহীদ, আর তাই তাদের স্মরণে যে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হল তাকে ‘শহীদ মিনার’ বলে থাকি।
গোটা বাংলাদেশে আনুমানিক হাজারদশেক শহীদ মিনার আছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দু’একটা শহীদ মিনার গড়ে উঠেনি। ভাষাকে নিয়ে এ ধরনের নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই, কখনওই ছিল না। কিন্তু নবীর সবচেয়ে বড় ওয়ারিশ হওয়ার দাবিদার, আমাদের দেশের জনসাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র ওলামায়ে কেরাম এ ভাষা দিবস উদযাপনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন না, এটি একটি অস্বস্তির বিষয়। কত সাধারণ কারণে ও তুচ্ছ ঘটনায় নিহতদের স্মরণে আমাদের ওলামায়ে কেরাম কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, দেয়া-মোনাজাত করে থাকেন। কিন্তু ভাষাশহীদদের জন্য কি আমাদের ওলামায়ে কেরাম এমনটি করতে পারেন না? এ শহীদদের ত্যাগ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই ওলামায়ে কেরামদের উচিত কোরআনখানি, মিলাদ-মাহফিল, আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাত করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করা। আমাদের ভাষাশহীদরা তাদের টগবগে যৌবনকে বিসর্জন দিয়ে, ইহকালীন সব ভোগ-বিলাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষার জন্য তাজা জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা আমাদের ওলামায়ে কেরামের এবং মুসলমানের দোয়া পাওয়ার যোগ্য।
যদি ওলামায়ে কেরাম ভাষাদিবস উদযাপনের প্রতীকী দিকগুলোকে শরিয়ত গর্হিত কাজ বলে এর প্রতি অনাগ্রহ দেখান, তাহলে বলব এর জন্যও সম্মানীত ওলামায়ে কেরামই দায়ী। কেননা ভাষাশহীদদের প্রাপ্য পরিশোধে ওলামায়ে কেরামের অমনোযোগী হওয়ার সুযোগে শূন্য ময়দানে শরিয়ত গর্হিত কাজগুলো স্থান করে নিয়েছে। অথচ আমরা আমাদের মৃত পূর্ব পুরুষদের জন্য ঠিকই কোরআন মজিদ তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল. দোয়া ইত্যাদি করে থাকি। পক্ষান্তরে ভাষাশহীদদের প্রতি জুলুম করেই যাচ্ছি। যা তাদের সঙ্গে একরকম বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। আমাদের ভাবতে হবে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম মাতৃভাষার জন্য কী আবদান রেখে গেছেন। এ ব্যাপারে মরুহুম মাওলানা আকরাম খাঁর কথা গর্বভরে উচ্চরণ করা যায়। তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সফল করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন। তাছাড়া হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও (রহ.) ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। সুতরাং আমাদের ওলামায়ে কেরাম ভাষাশহীদদের অবদানের প্রতি শ্রাদ্ধা জ্ঞাপন করে নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
প্রথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের সব শহীদ মিনারে কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া উচিত। আমাদের দেশের সব সরকার প্রধান তাদের আপনজনদের জন্য কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া-মোনাজাত ইত্যাদির মাধ্যমে মাগফিরত কামনা করে থাকেন। তবে ভাষাশহীদদের মাগফিরাতের জন্য অবশ্যই এসব কাজে সরকার প্রধান সহযোগিতা করবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম এ দেশের ওলামায়ে কেরামকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বিশ্বাস দেশের শহীদ মিনারগুলোতে একবার কোরআনুল কারিমের আওয়াজ তুলতে পারলে তা প্রতি বছরই চলতে থাকবে এবং তা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করবে। সমর্থন বাড়বে সাধারণ মানুষের এবং তারাও এ মহৎ কাজে শরিক হবেন। গোটা দেশ একসঙ্গে কোরআন মাজিদের সুর তুলবে। এভাবেই ভাষাদিবসের সত্যিকার চেতনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়াও আমাদের ওলামায়ে কেরাম ভাষাশহীদদের জন্য সাওয়াব রেসানিমূলক অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। মাতৃভাষা দিবসে দেশের প্রতিটি মাদ্রাসায় মাতৃভাষার ওপর আলোচনা সভা, রচনা প্রতিযোগিতা ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাও করা যেতে পারে। বস্তুত মহান ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সত্যিকার চেতনা তার বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত বাংলাদেশ ও তার ১৬ কোটি মানুষের নাজাতের মহামন্ত্র। ভাষাদিবসকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অপসংস্কৃতি যেমন কাম্য নয়, তেমনি কম্য নয় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে প্রতিহত করাও।
পরিশেষে এ দেশের ওলামায়ে কেরামের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আসুন না এ দেশের জনগণের ভালোবাসার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে দেশের সব শহীদ মিনারে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শহীদদের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে মাগফিরাত কামনা করি। তবে সাধারণ মুসলমান বিভিন্ন ইসলাম গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহবোধ করবেন এবং সর্বক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব মেনে নিতে আগ্রহ দেখাবেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সেই তওফিক দান করুন আমিন।
লেখক : মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী, সিনিয়র প্রভাষক, মাইলস্টোন কলেজ, ঢাকা
Thursday, 19 February 2015
মহানবীকে বিদ্রূপকারীরা মানবতাবিরোধী

ভাষা শহীদদের স্মরণে ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা বাঙালি ভাষাভাষীদের জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ একটি জ্ঞাননির্ভর জাতি গঠনে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। কিন্তু এবারের গ্রন্থমেলায় প্রকাশনা সংস্থা 'রোদেলা' কর্তৃক নিষিদ্ধ ইরানি লেখক আলি দস্তি একটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা বাঙালির সুস্থ জ্ঞানচর্চা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। 'নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর' নামক গ্রন্থটি অশোভন উক্তি, ভ্রান্ত যুক্তি ও নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে ভরা। ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের প্রতি আঘাত হানার জন্য গ্রন্থটির অনুবাদক, প্রকাশককে আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত বলে মনে করি।
ইসলাম একটি প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) একজন নবী ও রাসূল- এ সত্যটি বিশ্বের কোনো ধর্মতাত্তি্বক, ধর্ম দার্শনিক অস্বীকার করেননি। সেমেটিক ধর্মগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ধর্ম ইসলাম এবং সবচেয়ে পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে পবিত্র কোরআনের গুরুত্ব ও এর আধ্যাত্মিকতাকে কোনো অমুসলিম ধর্মতাত্তি্বকও সামান্য পরিমাণে অবজ্ঞা করেননি। যারা কোরআন ও নবী মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে অশোভন কথা বলেছে, তারা কেউ ধর্মতত্ত্ববিদ নয়। নাস্তিক, স্বল্পজ্ঞানী ও বিকৃত মনের লোকই শুধু কোরআন ও নবী মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করতে পারে। এ পর্যন্ত যারাই এ অপকর্ম করেছে, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ নিলে এ বিষয়টির প্রমাণ মিলবে। কেউ একজন নানামুখী জ্ঞানের ধারক হতে পারেন, পন্ডিত হতে পারেন, ভালো লেখকও হতে পারেন, তাই বলে তিনি ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে যা বলবেন তাকেই গুরুত্বপূর্ণ বা গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিতে হবে এর কোনো যুক্তি নেই।
মানবীয় জ্ঞান সীমিত। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীও স্রষ্টার লীলা বুঝতে হোঁচট খেয়েছেন। তিনি তার এক বন্ধুকে ১৯২৪ সালে লিখিত এক পত্রে বলেন, '... ইলেকট্রনের ওপর আলোক রশ্মি ফেলা হলে তা আপনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, সে কখন এবং কোনদিকে ঝাঁপ দেবে। এটাই যদি আসল ব্যাপার হয়, তবে পদার্থবিজ্ঞানী না হয়ে মুচি বা জুয়াখেলার আড্ডার সহকারী হওয়াই আমার উচিত ছিল।' (এএম হারুন-অর-রশীদ, বিজ্ঞান ও দর্শন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ৩)।
বিজ্ঞানও এখন আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। কেননা বিজ্ঞানে 'কোয়ার্ক' নামক এক বিষয়কে বস্তুর আদি উপাদান হিসেবে স্বীকার করা হচ্ছে। এ কোয়ার্কের বর্ণনা দিতে গিয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক হারুন-অর-রশীদ বলেন, 'এ নেপথ্যবাসিনীর লাস্যময়ী নূপুরধ্বনি শোনা যাবে, তার দেহপল্লবীর সুষমায় আর অঙ্গহীন আলিঙ্গনে গড়ে উঠবে দৃশ্যমান জগৎ কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে না। বস্তুকণার মধ্যে সে চিরকালের জন্য বন্দি, তার মুক্তি নেই, তার প্রত্যক্ষ প্রকাশ নেই।' (এএম হারুন-অর-রশীদ, পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ৬৭)।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি কণার জ্ঞান বা পরমাণুর জ্ঞানই যেখানে মানুষের পূর্ণাঙ্গ নয়, সেখানে এ মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান, এর স্রষ্টা ও প্রতিপালক তথা আল্লাহর জ্ঞান অর্জন করা মানুষের জন্য কতটা কঠিন হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে কেউ বৈজ্ঞানিক তথা পরীক্ষাগারের প্রমাণ খুঁজলে এটা হবে ক্যাটাগরিক্যাল মিসটেক বা শ্রেণী বিভ্রান্তি। তবে বাস্তবভিত্তিক, যুক্তিভিত্তিক অনেক প্রমাণই উপস্থাপন করা যায়; যাতে করে স্রষ্টা ও তাঁর আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রমাণ হাজির করা যায়। স্রষ্টা নেই- এ কথা বলা চরম মূর্খতা। বিজ্ঞান ভর ও বেগকে একসঙ্গে পরিমাপ করতে পারে না। তাই জগৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো ফয়সালা তার হাতে নেই। বিজ্ঞানেরই যখন এ অবস্থা তখন কোনো সাধারণ লেখক কিংবা কল্পনাবিলাসী সাহিত্যিক যদি আধ্যাত্মিক জগৎ তথা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করেন; নবী-রাসূলদের অস্বীকার করেন, তাহলে এটা হবে অজ্ঞতারই পরিচায়ক। তাঁর এসব বিষয় সম্পর্কে যে বা যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে পারে, তারা বিকৃত মানসিকতার অথবা স্বঘোষিত সর্বজ্ঞানী এবং বাস্তবিক পক্ষে ভ-।
'নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর' বইয়ের লেখক আলি দস্তি মহানবী (সা.) কে 'স্বঘোষিতভাবে ঈশ্বরের' প্রতিনিধি বলেছেন। তিনি বা তার মতো কিছু অপতৎপরতাকারী ব্যক্তিই এ মন্তব্য করতে পারেন। কেননা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মহানবী (সা.) কে নবী-রাসূল এবং মানবতার শান্তির দিশারি হিসেবে স্বীকার করেন। উপরন্তু তারা সগৌরবে এ ঘোষণা ও সাক্ষ্য প্রদান করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত, আইয়ামে জাহেলিয়ার অবস্থাকে পরিবর্তন করে তিনি তৎকালীন আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর চরিত্র মাধুরী দ্বারা তিনি মানুষের অন্তরের ভালোবাসা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। আজও সব ধর্ম-বর্ণের বিবেকবান কোটি কোটি মানুষ তাঁকে মহামানব বলে স্বীকার করেন। নারীপ্রীতির যে অভিযোগ বইটিতে করা হয়েছে, তার জবাবে একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপন করাই যথেষ্ট, তিনি কোনো যুবতী-কুমারী নারীকে বিবাহ করেননি। অথচ তাঁর আদর্শ প্রচার থেকে বিরত থাকার বিনিময়ে তৎকালীন সমাজপতিরা তাঁকে যথাইচ্ছা সুন্দরী নারীর প্রলোভনও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মহান নবী (সা.) বলেছেন, তাঁর এক হাতে চন্দ্র ও আর এক হাতে সূর্য এনে দিলেও তিনি সত্য প্রচার থেকে বিরত হবেন না। তাঁর দরিদ্র জীবনযাপন প্রমাণ করে তিনি অর্থবিত্ত বা সম্পদের লোভী ছিলেন না। আরবের মরুভূমি থেকে মুহাম্মদ (সা.) এর ভূত দেখার মতো বিভ্রাট ঘটত বলে গ্রন্থটির লেখক যে দাবি করেছেন, তার জবাবে বলা যায় লেখক কি মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক? অন্যদিকে কোরআনকে তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর রচনা বলেছেন। যদি মুহাম্মদ (সা.) কে লেখক মনোবৈকল্যে ভোগা মানুষ মনে করেন, তাহলে তাঁর দ্বারা এত চমৎকার এবং বহুল পঠিত ও অনুশীলনীয় আদর্শের ধারক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান রচনা সম্ভব হলো কীভাবে? আর পবিত্র কোরআনে এমন অনেক তথ্য আছে, যা একমাত্র ঐশী প্রত্যাদেশনির্ভর ছাড়া কোনো মানুষ দ্বারা প্রাপ্ত হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত বিধিবিধান সম্পর্কে লেখক যেসব মন্তব্য করেছেন, তা তার মূর্খতার পরিচায়ক। আধুনিক বিজ্ঞান কোরআনের একটি বাণীকেও অপ্রমাণ করতে পারেনি। বরং কোরআনের অনেক তথ্য বিজ্ঞান ক্রমে ক্রমেই প্রমাণ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণায়মানের কথা কোরআনে আছে, যা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। মহাবিশ্ব প্রসারমান, এ তথ্য সূরা আর রাহমানে রয়েছে, যা বিজ্ঞান সাম্প্রতিক যুগে এসে স্বীকার করছে। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণও কোরআনে রয়েছে, যা হজরত মুহাম্মদ (সা.) বা তৎকালীন মানুষ জানতেন না।
যা হোক, কোরআনের আধ্যাত্মিকতা, আল্লাহর অস্তিত্ব এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নবুয়ত সম্পর্কে অনেক প্রমাণই উপস্থাপন করা যায়। এর চেয়েও বড় কথা, এসব তো কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসের বিষয়। একে ব্যঙ্গ করা বিশ্বমানবতারই অবমাননা করা। এ ধরনের গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক এবং প্রকাশক সবাই মানবতাবিরোধী। আর এ ধরনের মানবতাবিরোধী গ্রন্থ বাংলা একাডেমির বইমেলায় যাতে কোনো দিনই ঠাঁই না পায়, সেদিকে প্রতিষ্ঠানটির বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন মনে করি।
লেখক : ড. মোঃ শওকত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মানবীয় জ্ঞান সীমিত। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীও স্রষ্টার লীলা বুঝতে হোঁচট খেয়েছেন। তিনি তার এক বন্ধুকে ১৯২৪ সালে লিখিত এক পত্রে বলেন, '... ইলেকট্রনের ওপর আলোক রশ্মি ফেলা হলে তা আপনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, সে কখন এবং কোনদিকে ঝাঁপ দেবে। এটাই যদি আসল ব্যাপার হয়, তবে পদার্থবিজ্ঞানী না হয়ে মুচি বা জুয়াখেলার আড্ডার সহকারী হওয়াই আমার উচিত ছিল।' (এএম হারুন-অর-রশীদ, বিজ্ঞান ও দর্শন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ৩)।
বিজ্ঞানও এখন আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। কেননা বিজ্ঞানে 'কোয়ার্ক' নামক এক বিষয়কে বস্তুর আদি উপাদান হিসেবে স্বীকার করা হচ্ছে। এ কোয়ার্কের বর্ণনা দিতে গিয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক হারুন-অর-রশীদ বলেন, 'এ নেপথ্যবাসিনীর লাস্যময়ী নূপুরধ্বনি শোনা যাবে, তার দেহপল্লবীর সুষমায় আর অঙ্গহীন আলিঙ্গনে গড়ে উঠবে দৃশ্যমান জগৎ কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে না। বস্তুকণার মধ্যে সে চিরকালের জন্য বন্দি, তার মুক্তি নেই, তার প্রত্যক্ষ প্রকাশ নেই।' (এএম হারুন-অর-রশীদ, পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ৬৭)।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি কণার জ্ঞান বা পরমাণুর জ্ঞানই যেখানে মানুষের পূর্ণাঙ্গ নয়, সেখানে এ মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান, এর স্রষ্টা ও প্রতিপালক তথা আল্লাহর জ্ঞান অর্জন করা মানুষের জন্য কতটা কঠিন হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে কেউ বৈজ্ঞানিক তথা পরীক্ষাগারের প্রমাণ খুঁজলে এটা হবে ক্যাটাগরিক্যাল মিসটেক বা শ্রেণী বিভ্রান্তি। তবে বাস্তবভিত্তিক, যুক্তিভিত্তিক অনেক প্রমাণই উপস্থাপন করা যায়; যাতে করে স্রষ্টা ও তাঁর আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রমাণ হাজির করা যায়। স্রষ্টা নেই- এ কথা বলা চরম মূর্খতা। বিজ্ঞান ভর ও বেগকে একসঙ্গে পরিমাপ করতে পারে না। তাই জগৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো ফয়সালা তার হাতে নেই। বিজ্ঞানেরই যখন এ অবস্থা তখন কোনো সাধারণ লেখক কিংবা কল্পনাবিলাসী সাহিত্যিক যদি আধ্যাত্মিক জগৎ তথা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর প্রত্যাদেশকে অস্বীকার করেন; নবী-রাসূলদের অস্বীকার করেন, তাহলে এটা হবে অজ্ঞতারই পরিচায়ক। তাঁর এসব বিষয় সম্পর্কে যে বা যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে পারে, তারা বিকৃত মানসিকতার অথবা স্বঘোষিত সর্বজ্ঞানী এবং বাস্তবিক পক্ষে ভ-।
'নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর' বইয়ের লেখক আলি দস্তি মহানবী (সা.) কে 'স্বঘোষিতভাবে ঈশ্বরের' প্রতিনিধি বলেছেন। তিনি বা তার মতো কিছু অপতৎপরতাকারী ব্যক্তিই এ মন্তব্য করতে পারেন। কেননা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মহানবী (সা.) কে নবী-রাসূল এবং মানবতার শান্তির দিশারি হিসেবে স্বীকার করেন। উপরন্তু তারা সগৌরবে এ ঘোষণা ও সাক্ষ্য প্রদান করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত, আইয়ামে জাহেলিয়ার অবস্থাকে পরিবর্তন করে তিনি তৎকালীন আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর চরিত্র মাধুরী দ্বারা তিনি মানুষের অন্তরের ভালোবাসা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। আজও সব ধর্ম-বর্ণের বিবেকবান কোটি কোটি মানুষ তাঁকে মহামানব বলে স্বীকার করেন। নারীপ্রীতির যে অভিযোগ বইটিতে করা হয়েছে, তার জবাবে একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপন করাই যথেষ্ট, তিনি কোনো যুবতী-কুমারী নারীকে বিবাহ করেননি। অথচ তাঁর আদর্শ প্রচার থেকে বিরত থাকার বিনিময়ে তৎকালীন সমাজপতিরা তাঁকে যথাইচ্ছা সুন্দরী নারীর প্রলোভনও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মহান নবী (সা.) বলেছেন, তাঁর এক হাতে চন্দ্র ও আর এক হাতে সূর্য এনে দিলেও তিনি সত্য প্রচার থেকে বিরত হবেন না। তাঁর দরিদ্র জীবনযাপন প্রমাণ করে তিনি অর্থবিত্ত বা সম্পদের লোভী ছিলেন না। আরবের মরুভূমি থেকে মুহাম্মদ (সা.) এর ভূত দেখার মতো বিভ্রাট ঘটত বলে গ্রন্থটির লেখক যে দাবি করেছেন, তার জবাবে বলা যায় লেখক কি মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক? অন্যদিকে কোরআনকে তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর রচনা বলেছেন। যদি মুহাম্মদ (সা.) কে লেখক মনোবৈকল্যে ভোগা মানুষ মনে করেন, তাহলে তাঁর দ্বারা এত চমৎকার এবং বহুল পঠিত ও অনুশীলনীয় আদর্শের ধারক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান রচনা সম্ভব হলো কীভাবে? আর পবিত্র কোরআনে এমন অনেক তথ্য আছে, যা একমাত্র ঐশী প্রত্যাদেশনির্ভর ছাড়া কোনো মানুষ দ্বারা প্রাপ্ত হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত বিধিবিধান সম্পর্কে লেখক যেসব মন্তব্য করেছেন, তা তার মূর্খতার পরিচায়ক। আধুনিক বিজ্ঞান কোরআনের একটি বাণীকেও অপ্রমাণ করতে পারেনি। বরং কোরআনের অনেক তথ্য বিজ্ঞান ক্রমে ক্রমেই প্রমাণ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণায়মানের কথা কোরআনে আছে, যা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। মহাবিশ্ব প্রসারমান, এ তথ্য সূরা আর রাহমানে রয়েছে, যা বিজ্ঞান সাম্প্রতিক যুগে এসে স্বীকার করছে। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণও কোরআনে রয়েছে, যা হজরত মুহাম্মদ (সা.) বা তৎকালীন মানুষ জানতেন না।
যা হোক, কোরআনের আধ্যাত্মিকতা, আল্লাহর অস্তিত্ব এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নবুয়ত সম্পর্কে অনেক প্রমাণই উপস্থাপন করা যায়। এর চেয়েও বড় কথা, এসব তো কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসের বিষয়। একে ব্যঙ্গ করা বিশ্বমানবতারই অবমাননা করা। এ ধরনের গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক এবং প্রকাশক সবাই মানবতাবিরোধী। আর এ ধরনের মানবতাবিরোধী গ্রন্থ বাংলা একাডেমির বইমেলায় যাতে কোনো দিনই ঠাঁই না পায়, সেদিকে প্রতিষ্ঠানটির বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন মনে করি।
লেখক : ড. মোঃ শওকত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Wednesday, 18 February 2015
পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম বিদ্বেষের মূল কারণ অজ্ঞতা
ড. মুনীর উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
ইসলাম বা মুসলমান সম্পর্কে পশ্চিমাদের বৈরিতা বা দ্বিমুখী নীতি নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে এ বৈরিতা, ঘৃণা, অবজ্ঞা ও দ্বিমুখী নীতি চলে আসছে। কয়েক বছর আগে ইরানে বিরোধী দলের গণআন্দোলনের সময় কোনো এক অজ্ঞাত ঘাতকের হাতে নেদা সোলতানা নামের একজন অল্পবয়সী নারী প্রাণ হারায়। সঙ্গে সঙ্গে এ খবর বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে। পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের মধ্যে এই মর্মান্তিক ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করা ছাড়াও তাদের মনকে আন্দোলিত করে তোলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নেদা সোলতানার মৃত্যুদৃশ্য দেখে ও শুনে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন, ঘটনাটি হৃদয়বিদারক। কয়েক সপ্তাহ পর জার্মানির ড্রেসডেন শহরে আরও মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটে। মারওয়া-এল-শেরবিনি নামের এক মিসরীয় ভদ্রমহিলাকে হিজাব পরার কারণে এক জার্মান সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গালাগাল করেন। মারওয়া-এল-শেরবিনিকে অপমান করার কারণে ওই চরমপন্থী জার্মান নাগরিককে আদালত ২ হাজার ৮০০ ইউরো জরিমানা করেন। আদালতে উপস্থিত মারওয়া ও তার স্বামীকে উগ্রপন্থী এ জার্মান নাগরিক ক্রোধান্ধ হয়ে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। মারওয়া তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে মৃত্যুবরণ করেন।
জার্মানিতে মারওয়া ও ইরানে নেদা হত্যাকাণ্ডকে সমান বর্বরোচিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা দরকার ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে মিসরের হিজাব পরা মারওয়া-এল-শেরবিনির নির্মম হত্যাকাণ্ড বারাক ওবামার চোখে পানি আনতে পারেনি এবং ঘটনাটি তার মনে তেমন কোনো প্রভাবও ফেলতে পারেনি। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা বিশ্বে এত বড় একটি মর্মান্তিক ঘটনা প্রচার মাধ্যমে শিরোনাম তো দূরের কথা, তেমন কোনো প্রচারও পায়নি। নেদা হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করে পশ্চিমা দেশগুলো সম্পূর্ণ দোষ ইরানের রক্ষণশীল ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বেশ কয়েক মাস বিশ্ববাসীর কাছে ইরানকে হেয় করার অপতৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মারওয়ার হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, সন্ত্রাস শুধু আরব বা মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সাদা চামড়ার একজন জার্মানও সন্ত্রাসী হতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলো প্রায়ই বলে থাকে, মুসলমান সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে। মারওয়া কি একজন নিরীহ মানুষ ছিলেন না? মারওয়ার কী অপরাধ ছিল? তিনি হিজাব পরতেন, তিনি মুসলমান ছিলেন- এই কি তার অপরাধ? মুসলমান হিসেবে হিজাব পরার কারণে জার্মানির মতো একটি দেশে একজন নিরীহ মহিলাকে হত্যা এবং তার স্বামীকে হত্যার চেষ্টার ঘটনা পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে তেমন কোনো প্রচার পায়নি বললেই চলে। কেন এই বৈরিতা, কেন এই বৈষম্য বা দ্বৈতনীতি? পশ্চিমা দেশগুলোতে ওইসব খবরই ফলাও করে প্রচার করা হয়, যা আরব বা মুসলমানদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। কিন্তু আরব বা মুসলমানরা কি সত্যিকার অর্থে সব পশ্চিমা নাগরিকের পক্ষপাতমূলক আচরণের নিরীহ শিকার? তা অবশ্যই নয়। আমরা পশ্চিমা শব্দটি অবশ্যই ওই অর্থে ব্যবহার করব না, যার অর্থ একচেটিয়ার পর্যায়ে চলে যায়। পাশ্চাত্যের লাখো কোটি মানুষ রয়েছে যারা ইসলামকে ভালোবাসে না, ঘৃণাও করে না। এর কারণ ইসলাম সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই।
পাশ্চাত্যের মানুষদের কাছে মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃত ইমেজ বা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পারছে না। মুসলমানরা যা করে ও যা বলে এবং সেটাকে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা থেকে যদি একজন পশ্চিমা নাগরিক প্রকৃত সত্যটি জানতে চেষ্টা করে, তাহলে তিনি উপসংহারে আসবেন? তিনি মনে করবেন, ওসামা বিন লাদেন বা বোকো হারাম অনুসারীরা মধ্যযুগীয় কোনো গুহা থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দেবেন- ইসলাম তাকে যত বেশি সম্ভব ইসলামবিরোধী পশ্চিমা ক্রুসেডারকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে, যদিও তারা শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেনি। হয়তো বা তাদের সামনে ফুটে উঠবে- বিশ্বের সব মুসলমান তালেবান মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে গেছে, যারা মেয়েদের সব স্কুল বন্ধ করে দিতে সচেষ্ট। কারণ মহিলারা ধর্মীয় বা বৌদ্ধিকভাবে (Intellectually) পুরুষের সমকক্ষ নয় বলে ইসলাম তাদের শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করেছে। তারপর পশ্চিমারা কিছুসংখ্যক স্বঘোষিত আইন বা ইসলাম বিশেষজ্ঞের বাণী পড়বেন এবং জানবেন, কোনো মুসলমান ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে তাকে অনুশোচনা করতে হবে অথবা তার গলা কেটে ফেলতে হবে। অনেক তথাকথিত ইসলাম আইনজ্ঞের ভাষায় তারা পড়বেন- ইসলাম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং একজন মুসলমানের দায়িত্ব হল তার শাসককে মেনে চলা, হোন তিনি শোষক বা প্রজা নিষ্পেষণকারী। তারা চান মহিলারা নেকাবের মাধ্যমে তাদের চেহারা ঢেকে রাখবে, যাতে করে তাদের দেখে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা জন্ম না নেয়।
কিন্তু পশ্চিমারা জানে না- ইসলামে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং কর্তব্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা এও খুঁজে পাবে না, ইসলামের দৃষ্টিতে কেউ যদি একজন মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সে মূলত পুরো মানব সভ্যতাকে হত্যা করল। পশ্চিমারা কখনও পড়েনি- ইসলামের মূলমন্ত্র হল মুক্তি, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার। ইসলাম স্বাধীন চিন্তার ধারক-বাহক। যার ইচ্ছা সে ইসলাম গ্রহণ করবে, যার ইচ্ছা সে তা বর্জন করবে। ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অনুসারীদের মতামত বা স্বীকৃতি ছাড়া কোনো শাসক ক্ষমতায় আসীন হতে পারেন না। এরপরও কি ইসলামকে পশ্চাৎপদ, সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে আমরা পশ্চিমাদের দোষ দেব না?
গত বছর একজন ধর্মবিশেষজ্ঞ অস্ট্রিয়ায় বাস্তবতার নিরিখে ইসলামের ওপর একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন অতি দয়ালু ও সহনশীল মানুষ। নামাজ পড়ার সময় তিনি যখন সেজদায় যেতেন, তখন তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.) খেলাচ্ছলে লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসতেন। তারা স্বেচ্ছায় না নামা পর্যন্ত তিনি সেজদায় পড়ে থাকতেন, যাতে করে নাতিদের খেলাধুলায় বিঘœ না ঘটে। তারা নেমে গেলে তিনি নামাজ চালিয়ে যেতেন। সেই বিশেষজ্ঞ শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনারা কি বিশ্বাস করেন, যে মানুষটি শিশুদের খেলাধুলায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করার জন্য নামাজ পড়া বন্ধ রাখতেন, তিনি নিরীহ মানুষকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করার জন্য ওকালতি করবেন? অনেকেই বক্তৃতাটি শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন এবং পরে তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে কী করতে হবে? এটা সত্য, পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের ঔপনিবেশিক প্রজা বলে মনে করে। সুতরাং নাগরিক হিসেবে আমাদের কোনো অধিকার প্রত্যাশা করা তাদের দৃষ্টিতে শোভনীয় নয়।
এটাও সত্য, এসব সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশ তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোকে পক্ষপাতমূলক ও ইসলাম বা মুসলমানবিদ্বেষী ভাবধারায় গড়ে তুলেছে। এসব প্রচার মাধ্যমে অনেক বিকৃত ও অসত্য ধারণা দীর্ঘদিন ধরে বারবার উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনগণের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা- চেতনায় এর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জোর চেষ্ট চালানো হয়। এসব ধারণার মধ্যে থাকে- মুসলমানরা সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিপন্থী। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে মুসলমানদের ভিন্নধর্মী মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধকে মূল্যায়নপূর্বক যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের বসবাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের ৭ জুলাই লন্ডনে বোমা হামলার পর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০০৫ সালের জুলাই থেকে যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশদের সঙ্গে মুসলমানদের বৈরীভাব ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৬ শতাংশ মুসলমান জানিয়েছেন, তারা বা তাদের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকে অপমানের শিকার হতে হয়েছে।
ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি ইসলাম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে সব সময়ই ফায়দা লুটতে সচেষ্ট থাকে। এ দলের নেতা নিক প্রিফিন বলেন, আমরা ইসলাম ও মুসলমানদের আঘাত করি কেন জানেন? সাধারণ মানুষ ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ অতি সহজে বোঝে ও গ্রহণ করে। পত্রিকার সম্পাদকরা ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষকে পুঁজি করে অতি সহজে মুনাফা লুটতে সক্ষম হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকার প্রতিবাদে ফ্রান্সের কার্টুন ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর কার্যালয় ও অন্যান্য স্থানে ইসলামপন্থী বন্দুকধারীদের গুলিতে সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা আরও বেড়েছে। ১১ ফেব্র“য়ারি পত্রিকায় পড়লাম, নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপল হিল শহরে একই পরিবারের তিনজন মুসলমান সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুধু মুসলমান হওয়াই ছিল তাদের অপরাধ!
পাশ্চাত্যের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় বিশ্বের বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে উসকে দিয়েছে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এ প্রচার মাধ্যমগুলোকে কোনোমতেই গণতন্ত্র, সাম্য, মুক্তির সহায়ক শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
আজকাল মুসলমানদের এক কথায় সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সাধারণ ভাষায় সন্ত্রাস কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্ট নয়- সন্ত্রাস হল পলিটিক্যাল অ্যাক্ট, যা পাশ্চাত্যে সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক দ্বৈতনীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্যের দেশগুলো যতদিন তাদের সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক দ্বৈতনীতি পরিহার না করবে, ততদিন ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ও সংঘাত বাড়তে থাকবে। এই দূরত্ব ও সংঘাত বিশ্বশান্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়- এ কথা পশ্চিমা দেশগুলো যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@gmail.com
Subscribe to:
Posts (Atom)