আলিফ বাতে আব্বা। আলিফ মিমে আম্মা। এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় সবচেয়ে মধুর নাম্মা।জ্ঞান-আলোর উত্স আলিফের আল্লাহ। মা আমিনার মিম থেকে মুহাম্মদের বিচরণ হলে মুসলিম হচ্ছে মুহাম্মদী সুইচের একেকটি বাল্ব। আম্মা, আমিনা, মুহাম্মদ, মুসলিম। শব্দগুলো মিম হরফের ছন্দে গাঁথা। ভরা ছন্দের গন্ধে মাখা এ জগতের সবচেয়ে বড় ছান্দসিক হচ্ছেন মমতাময়ী মা। মায়ের ছন্দে ছন্দায়িত হয় মানবশিশু। তাই তো মা আমিনার মুখের ভাষায় ওহি বয়ে জিব্রিল আসে হেরা গুহায়। মুহাম্মদের মিমের মাতম ঐশী আলো বিলিয়ে বেড়ায়। মায়ের ভাষার ধারক-বাহক ঐশী আলোর ধারক-বাহক দুটোই হচ্ছে মুসলমান। মহান মা’বুদ মায়ের ভাষাকে কতটা প্রাধান্য দিয়েছেন কোরআনে চোখ বুলানো যাক— ওয়ামা আরসাল্নামির রাসুলিনইল্লাবিলীসানি কাওমিহিলিউ বাইয়িনা লাহুমসুরা ইবরাহিম, ৪ নম্বর আয়াতের প্রথম অংশ। ভাবতরজমা : ‘প্রত্যেক নবী-রাসুলের কাছেই আমরা যে উপদেশ বাণী পাঠিয়েছি সে বাণী পাঠিয়েছি তাঁর মমতাময়ী মায়ের ভাষায়। যেন সে ষ্পষ্ট করে আমাদের উপদেশ বাণী স্বজাতিকে বুঝিয়ে বলতে পারে।’এই মানবগ্রহের সৃষ্টিলগ্ন থেকে মা’বুদ যত নবী-রাসুল মনোনীত করেছেন সবাইকেই তিনি বাণী প্রেরণ করেছেন। কারও জন্য প্রেরণ করেছেন ছোট বাণী। কাউকে দান করেছেন বড় বাণী। সবার জন্যই মা’বুদ মনোনীতজনের মায়ের ভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ পৃথিবীর যে-কোনও শিশু মাতৃকলি থেকে ফুল হয়ে ফোটার পরে মাতৃজমিনে মায়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠে। মায়ের স্নেহ আদর আর বুকভরা ভালবাসা শিশুর জীবনের প্রথম সবক। সব শিশুর মা জননী মানব শিশুর প্রথম গুরু। মাতৃগুরুর শিশু শিষ্য মাকেই বোঝে বেশি। খুঁজে ফেরে মাকেই। অনুসরণ করে মায়ের কথা বলা, মায়ের হাঁটাচলা। মা গুরু যে ভাষায় কথা বলেন শিশু শিষ্যকে তাই শেখান। (‘রাব্বি জিদনি ইলমা’। হে রব তুমি জগতের জ্ঞান বাড়িয়ে দাও।) মাতৃগুরুর জ্ঞান এবং মাতৃভাষায় বেড়ে ওঠে শিশু শিষ্য মানুষ। তাই তো মায়ের ভাষা প্রতিটি মানবের হূদয়ে খুশির ঝরনা ঝরায়।মানবজগতের মানবজাত দুনিয়ার জীবন কাটিয়ে দেয় মায়ের ভাষায় বলতে বলতে চলতে চলতে। আমাদের মা’বুদ রাব্বানা সপ্ত আসমান সপ্ত জমিনে যা কিছু রয়েছে সবকিছুর পালনকর্তা। সর্বপ্রাণীর রিজিকদাতা। সব বিষয়ের মঙ্গলকামী। যুগে যুগে তিনি তাই জগতের মঙ্গলের জন্য এ জগত্ থেকেই মানবদূত মনোনয়ন করেন। যে মানবদূত মা’বুদের মঙ্গলবার্তা পৌঁছে দেবে মানবের ঘরে ঘরে। আমাদের মা’বুদের কী দয়া। তিনি মনোনীত দূত বান্দাকে বান্দার মাতৃভাষায় বার্তা পৌঁছান। যেন তাঁর বুঝতে কষ্ট না হয়। সে যেন মা’বুদের বার্তা জনে-জনে পৌঁছাতে পারে খুব সহজে। মানুষ যেন মা’বুদকে কখনও ভুলে না যায়। মা’বুদের বাতলানো পথে মানুষ জীবন ধারণ করে তারা যেন পরকালের আনন্দ আশ্রমে স্থান করে নেয়। কালের পরিবর্তনে মা’বুদের চিরসুন্দর ধর্মের বাঁক বদল করে দিয়েছে আজকের ধর্মবিদরা। তারা সহজ ধর্মকে কঠিন করে তৈরি করে দিয়েছে কাঠিন্যময় দুনিয়া। যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সেটাই যেন আজকের দুনিয়ার ধর্ম। মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডার খাঁচায় বন্দি ধর্ম কেঁদে ফেরে। আজকের জগতের ধর্মবিদরা কেউ পাঁচবেলা, কেউ দুবেলা, কেউ সপ্তাহান্তে এসব খাঁচার তালা খুলে দিলে মানুষ উদযাপন করে ধর্মানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বন্দি আনুষ্ঠানিক ধর্ম আজ মানুষকে সহজ জীবনের সহজ পথে টানতে পারছে না। বাতলাতে পারছে না চিরসুখের ঠিকানা। গোটা দুনিয়া আজ নকল সুখে সয়লাব।নকল রং করা মানুষ চুল রাঙিয়ে, দাড়ি রাঙিয়ে সংসেজে চিরসুখ বিলি করছে মা’বুদের ভাষায়, মাবুদের নামে। তারা বলছে মাবুদের আরবি ভাষায় জবান না খুললে তোরা কীভাবে সামলাবি কবরের আরবি ভাষার সোয়াল-জোয়াব? হায়রে রঙের দুনিয়ার রঙ করা অভাগা মানুষ! মা’বুদ তোকে খোদার রঙে রঙিন হতে বলেছে। খোদার আরবি ভাষায় বলীয়ান হতে বলেনি। আরবি ভাষা ছিল আমাদের প্রেমের নবী মেহনতি মানুষের নবীর মায়ের ভাষা। সেই ভাষাকে খোদা মর্যাদাবান করেছেন ওহি বাণী প্রেরণ করে। প্রেমের নবী যেন তার মাতৃভাষায় খুব সহজে খোদার পরিচয় মানবসমাজে উপস্থাপন করতে পারেন। যদি দয়াল নবী বাংলাভাষী হতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই মা’বুদের কাছ থেকে বাংলা ভাষায় ওহি-বাণী অর্জন করতেন। কেননা মা’বুদ তো মায়ের ভাষাকেই প্রাধান্য দেন। মায়ের ভাষাই বান্দার জন্য উত্তম ভাষা। বাংলাভাষী মুসলমানকে আরবিভাষী মুসলমান বানাতে চেয়ে মুসলমান আজ পথহারা পথিক। মাতৃভাষায় মা’বুদের শেষ ওহি বাণী কোরআন পাঠ করতে না পেরে তারা ‘নুরুন আলানুর’ আলো থেকে আলোর প্রজ্বলন বঞ্চিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। দেশে-দেশে মুসলমানরা যদি মায়ের ভাষায় ‘ইকরা বিসিম রাব্বি কাল্লাজি খালাক’ (তোমার প্রেমময় মা’বুদের নামে পড়) পড়ত, শিখত— তাহলে তারাই হতো আল কোরআনের একেকজন গবেষক। মুসলমান সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিনের গবেষণা করে কোরআনের গবেষণামূলক আয়াতগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারত। মহামূল্যবান খনিজসম্পদরাজি, আসমানের গায়েবি সম্পদরাজি, ওহির বীজতলা কালব সম্পদরাজি। এসবেরই সূক্ষ্ম সূত্র লুকিয়ে রয়েছে মা’বুদের প্রেমময় বাণী কোরআনে।কোরআনহারা মুসলমান আজ রং করা এক পেখমতোলা ময়ূরীর জীবনযাপন করছে, যা মুহাম্মদের মিমের আলোর সুইচ থেকে বিচ্ছিন্ন। মুহাম্মদী সুইচ আত্মায় বসাতে না পারলে লাইলাহার চির আলোর সন্ধান পাবে না কেউ। মুহাম্মদের মিম। মা আমিনার মিম। মুসলমানের মিম। তিন মিমের পদতলে বেহেশত লুটায়। চোখটি খুলেই দেখি কাকে? মাকে আমার মাকে। সেই মাকে মায়ের ভাষাকে ভালবাসলেই বেহেশত কামনা করা যায়। কেননা মায়ের ভাষায় আলিফের আল্লাহ এবং মিমের মুহাম্মদকে জানা যতটা সহজ, আরবি ভাষায় জানা বাঙালি মুসলমানের জন্য ততটাই দুর্বোধ্য। তাই পেখমতোলা ময়ূরীর দল যেদিন থেকে কোরআনের বুলি মায়ের ভাষায় আওড়াতে পারবে, সেদিনই তাদের রং করা নকল পালক খসে পড়ে মা’বুদের রঙের পালক গজাবে। লাইলাহার এই দুনিয়ায় মিমের আলো জ্বলে মায়ের ভাষায় বেহেশতি সুখজোছনা হয়ে গলে।
লেখক : খইয়াম মাজহারী, ধর্মচিন্তাবিদ
লেখক : খইয়াম মাজহারী, ধর্মচিন্তাবিদ