Tuesday, 10 February 2015

নাগরিক সমাজ কি সাধারণ নাগরিকদের? -- আব্দুন নূর তুষার

একটা লম্বা সময় ধরে বিষণ্ন সময় কাটাচ্ছি। দেশ জুড়ে মানুষ পুড়ছে, পুড়ছে মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন।যারা মানুষ পোড়াচ্ছেন তাদের দাবি তারা নাকি গণতন্ত্র পুণরুদ্ধারের জন্য বিপ্ল্বব করছেন। গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার নিয়ে এই লোকগুলির বড় বড় কথা শুনলে আমি হাসি। কারণ এরা মানুষ পুড়িয়ে যে আন্দোলন করছেন সেটাই প্রমাণ করে এদের গণতন্ত্র কতটা মানববান্ধব আর কতটা ক্ষমতাবান্ধব। এদের স্বভাব জান্তব। প্রভূভক্তিতে গদগদ হয়ে এরা ভারত, আমেরিকার সাথে দেনদরবার করে। এদের কিছু বলবার ভাষা আমার জানা নেই। অথবা জানি, ছাপার অক্ষরে বলতে পারছি না।

আজ  সকালে পত্রিকাতে দেখলাম নাগরিক সমাজ নামক একদল লোক যাদের সকলের নাম পত্রিকাতে দেওয়া হয় নাই, তারা রাজনৈতিক সংলাপের শুভ উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেছেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই পত্রের স্বাক্ষরকারী। তারা নাগরিক কমিটি গঠন করবেন। সেখানে ৫ থেকে ৭ জন থাকবেন। বলা হয়েছে, রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা বিহীন মানুষজন সেখানে থাকবেন।

অথচ বেগম জিয়ার কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়েছেন ড. কামাল হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী চঞ্চল। কামাল হোসেন সাহেব কিছুদিন আগে নিজেই বেগম জিয়ার সাথে আলাপ করেছেন বলে পত্রিকাতে ছবি দেখেছি। ৭ ফেব্রুয়ারির এক সভা থেকে তারা নাকি এই উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের চলমান সহিংসতা দুর করতে নাকি এই সংলাপের কোনও বিকল্প নাই। এমনকী তারা ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনে পরামর্শ দেবার জন্য কমিটি/কমিশন বানানোর কথাও বলেছেন। কামাল হোসেন কি অরাজনৈতিক?

১. তারা জ্বালাও পোড়াও চান না। কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সেটি চায় না। তাহলে নাগরিকদের পক্ষ হয়ে আগে জ্বালাও পোড়াও, জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর নিন্দা করে, ধিক্কার দিয়ে, এটা বন্ধ করার জন্য চিঠি দেন না কেন আগে? এটা বন্ধ করার জন্য সংলাপ লাগবে- এটার প্রেসক্রিপশন আগেই তারা দিচ্ছেন কেন? কারা মানুষ পোড়াচ্ছে, কী করলে সেটা তারা বন্ধ করবে? তারা কিন্তু বলেই দিয়েছে যে তারা সরকারের পতন চায়। তার মানে সংলাপ না, সরকার পতন তাদের লক্ষ্য। এই পতনের চুলা জালাতে তারা নিরীহ মানুষকে বেছে নিয়েছে লাকড়ি হিসেবে। তারা বুঝলেন কীভাবে যে সংলাপ এটা বন্ধ করবে? তার মানে তারা জানেন কোন পক্ষ মানুষ পোড়াচ্ছে। তাহলে তারা সর্বসম্মত হয়ে তাদের ধিক্কার না দিয়ে, আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছেন কেন?

অথচ বেগম জিয়ার কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়েছেন ড. কামাল হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী চঞ্চল। কামাল হোসেন সাহেব কিছুদিন আগে নিজেই বেগম জিয়ার সাথে আলাপ করেছেন বলে পত্রিকাতে ছবি দেখেছি। ৭ ফেব্রুয়ারির এক সভা থেকে তারা নাকি এই উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের চলমান সহিংসতা দুর করতে নাকি এই সংলাপের কোনও বিকল্প নাই। এমনকী তারা ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনে পরামর্শ দেবার জন্য কমিটি/কমিশন বানানোর কথাও বলেছেন। কামাল হোসেন কি অরাজনৈতিক?

২. আলোচনার প্রস্তাব ভালো। যে কোনও সংকট সমাধান হবে আলোচনায়। সেটাও ভালো। ধরে নিলাম আলোচনা হবে। সেটা কি মানুষ পোড়ানোর আন্দোলন অব্যাহত রেখেই হবে, নাকি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে? সেসব নিয়ে তাদের কোনও বক্তব্য নেই, তারা আলোচনার আগেই ঠিক করে ফেলেছেন যে ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এটা তারা আগেভাগেই কি করে ঠিক করে ফেললেন? তারা কি জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ?

৩. ৭ তারিখের সভায় গণ্যমান্যদের মধ্যে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, জাসদ রবের সভাপতি আ স ম রব, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মো: মনসুর, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না , গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমেনা মহসিন ইত্যাদি। এরা যদি বলেন এরা অরাজনৈতিক, কিংবা এরা আছেন এমন কোনও কমিটি অরাজনৈতিক হবে, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? রব সাহেব ও মান্না সাহেবের দল বদল ও সমাজতন্ত্র থেকে উত্থান পতনের ইতিহাস তো আমাদের সকলের জানা।

মান্না ভাই আন্নার মতো অনশন করেন। ড. কামাল বিচার বিভাগে লড়াই করেন নাগরিক অধিকারের পক্ষে, ড. জাফরুল্লাহ পোড়া রোগীদের জন্য ঔষধ ও চিকিৎসা দেন, আসম রব একটা জনসভা করেন মানুষ পোড়ানোর বিরুদ্ধে, আমরা দেখি ড্রয়িং রুমের সমুচা সিঙ্গাড়া থেকে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন আবার। আমরা দেখি, যে নাগরিক সমাজের মা-বাপ বলে তারা নিজেদের ভাবছেন সেই রাজনীতির লাকড়িসম জনগণ তাদের নিজে থেকে বেছে নিক।

৪. রেল লাইন উপড়ে ফেলা, রেলগাড়ি ও বাসে, লঞ্চে আগুন দেয়া, গাছ কাটা, সাধারণ নাগরিকের ওপর হামলা এগুলো কি সরকার পতনের আন্দোলন নাকি সহিংস সন্ত্রাস? বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন নিশ্চয়ই তার আইনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতে পারবেন। কোনও রাজনৈতিক দলের কারণে যদি এ ধরনের সহিংসতা শুরু হয়ে থাকে তারা কি সেই রাজনৈতিক দলকে বা জোটকে অনুরোধ করেছেন এসব থেকে বিরত থাকতে?

৫. ভিয়েতনাম কিংবা থাইল্যান্ডে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে মানুষ পোড়ে। দলের সমর্থকেরা নিজেরা নিজেদের গায়ে আগুন দেয় প্রতিবাদ করার জন্য। কই গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশি দল বা জোটের একজন সমর্থককে তো একবেলা অনশন করতে দেখলাম না। এই আন্দোলনে জ্বলে পুড়ে ছারখার মানুষদের প্রতি তো তাদের সামান্য সমবেদনা বা শোক প্রকাশ করতে দেখলাম না। অফিসে ইন্টারনেট বা ডিশ টিভির সংযোগ নেই বলে যে হা-হুতাশ তারা করছেন, সেটুকুও তো তাদের নেতা-নেত্রীরা পুড়ে যাওয়া মানুষের জন্য করেন না। এই নাগরিক নেতারাও এসব নিয়ে বিবৃতি দেন না। তাদের বক্তব্য বেশ মজার। আগুন জ্বলছে, কারণ সরকার ও তার প্রতিপক্ষের বিরোধ। সংলাপ শুরু হলেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে। তার মানে কি সংলাপের প্রস্তুতি ছিল এই পেট্রোল বোমা? এরপর যে কোনও সংকটে, রাজনৈতিক সংলাপ করতে কাউকে বাধ্য করতে হলে আগে পেট্রোল বোমা বানাতে হবে?

 রেল লাইন উপড়ে ফেলা, রেলগাড়ি ও বাসে, লঞ্চে আগুন দেয়া, গাছ কাটা, সাধারণ নাগরিকের ওপর হামলা এগুলো কি সরকার পতনের আন্দোলন নাকি সহিংস সন্ত্রাস? বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন নিশ্চয়ই তার আইনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতে পারবেন। কোনও রাজনৈতিক দলের কারণে যদি এ ধরনের সহিংসতা শুরু হয়ে থাকে তারা কি সেই রাজনৈতিক দলকে বা জোটকে অনুরোধ করেছেন এসব থেকে বিরত থাকতে?

৬. এদের সামাজিক সম্মান অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। কথায় কথায় যে নিজেদের নাগরিক সমাজ দাবি করেন তারা। কোন নাগরিকেরা কোন সভায় তাদের নাগরিকদের প্রতিনিধি হবার ম্যান্ডেট দিয়েছে? কোন প্রক্রিয়ায় এরা নিজেরাই সবার অভিভাবক হয়ে সংকট সমাধানে পত্র চালাচালি করছেন? কোন নাগরিকেরা তাদের মোড়লি মেনে নিয়েছে? যদি সামাজিক উদ্যোগ নিতেই চান, দেখি না আপনাদের এক সপ্তাহ অনশন করেন ভারতের আন্না হাজারের মতো, দেখি না একটা কেজরিওয়ালের মতো আম জনতা দল বানিয়ে জনমত সংগঠন করেন। জনগণকে দূরে রেখে, বন্ধ দেয়ালের মধ্যে বসে সংলাপের আগেই সংবিধান সংশোধনের কথা বলে দিচ্ছেন কেন তারা? কেন তারা আগে ভাগেই মিটিং করছেন বিবদমান একটি পক্ষের সাথে?

ভিয়েতনাম কিংবা থাইল্যান্ডে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে মানুষ পোড়ে। দলের সমর্থকেরা নিজেরা নিজেদের গায়ে আগুন দেয় প্রতিবাদ করার জন্য। কই গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশি দল বা জোটের একজন সমর্থককে তো একবেলা অনশন করতে দেখলাম না। এই আন্দোলনে জ্বলে পুড়ে ছারখার মানুষদের প্রতি তো তাদের সামান্য সমবেদনা বা শোক প্রকাশ করতে দেখলাম না। অফিসে ইন্টারনেট বা ডিশ টিভির সংযোগ নেই বলে যে হা-হুতাশ তারা করছেন, সেটুকুও তো তাদের নেতা-নেত্রীরা পুড়ে যাওয়া মানুষের জন্য করেন না। এই নাগরিক নেতারাও এসব নিয়ে বিবৃতি দেন না। তাদের বক্তব্য বেশ মজার। আগুন জ্বলছে, কারণ সরকার ও তার প্রতিপক্ষের বিরোধ। সংলাপ শুরু হলেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে। তার মানে কি সংলাপের প্রস্তুতি ছিল এই পেট্রোল বোমা?

৭. আমরা সবাই চাই আলোচনা। সেটাই সভ্য দুনিয়ার নিয়ম। সেই আলোচনায় কাউকে বসতে বাধ্য করার জন্য সভ্য রীতি নীতিও আছে। আছে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট, আছে অনশন, আছে অসহযোগ, আছে পোস্টার, ব্যানার, জনসভা, মানববন্ধন। শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি। সরকার যদি এসবে বাধা দেয়, সরকারকে বাধ্য করার জন্য আছে বিচার বিভাগ। ধ্বংসযজ্ঞ তো শেষ কথা। মানুষ পুড়িয়ে সরকার পতনের যে রীতি চালু হলো, মানুষ পোড়ানোর সাথে রাজনৈতিক দাবি দাওয়াকে জুড়ে দিয়ে যাদের রাজনীতি তাদের সাথে যে পত্র চালাচালি শুরু হলো, সেটা কি আসলে অরাজনৈতিক?

৮. মান্না ভাই আন্নার মতো অনশন করেন। ড. কামাল বিচার বিভাগে লড়াই করেন নাগরিক অধিকারের পক্ষে, ড. জাফরুল্লাহ পোড়া রোগীদের জন্য ঔষধ ও চিকিৎসা দেন, আসম রব একটা জনসভা করেন মানুষ পোড়ানোর বিরুদ্ধে, আমরা দেখি ড্রয়িং রুমের সমুচা সিঙ্গাড়া থেকে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন আবার। আমরা দেখি, যে নাগরিক সমাজের মা-বাপ বলে তারা নিজেদের ভাবছেন সেই রাজনীতির লাকড়িসম জনগণ তাদের নিজে থেকে বেছে নিক।

আর যদি না পারেন, তবে তারা টেলিভিশন টক শোতে উপস্থাপনা করেন আর উপস্থাপিত হন। সে চেষ্টাও এদের কেউ কেউ এরই মধ্যে করেছেন। বেয়াদবী মাফ চেয়ে আমি আর না বলি, সেখানে তাদের সাফল্য সম্পর্কে দর্শকরাই ভালো বলতে পারবেন।

লেখক: চিকিৎসক, টিভি ব্যক্তিত্ব।
ইমেইল: abdun.noor@gmail.com