কেউ কেউ বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। কেউ কেউ দলটিকে মধ্যপন্থার দল বলেও দাবি করেন। অনেকেই এসব অভিধার সঙ্গে আংশিকভাবে একমত পোষণ করলেও পুরোপুরি পারছেন না। তবে বিএনপির মতো দলটি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি নিশ্চিত অবস্থানে যাওয়ার পর উদারবাদী একটি দলে পরিণত হলে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ অনেক বেশি সহজ হতো। কিন্তু বিএনপির উত্থান যে প্রক্রিয়ায় হয়েছিল, তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়নি, তার পরও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মহলের আশা ছিল, দলটি নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক মতাদর্শের উদার বা রক্ষণশীল মধ্যপন্থা অনুসরণ করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ইতিহাস হলো, দলটি ক্রমেই সাম্প্রদায়িক ধারার কাছে আত্মসমর্পণ করছে, সর্বশেষ জঙ্গিবাদী শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। দলটিতে উদারবাদী ভাবাদর্শের প্রচুর নেতা-কর্মী থাকলেও জামায়াতের মতো গণতন্ত্রবিরোধী ভাবাদর্শের দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দলটি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক আদর্শবিরোধী সব শক্তির নেতৃত্ব প্রদানকারী দলে পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যতে কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে বা টিকে থাকতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বিএনপির এমন প্রান্তিক দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসীদের নির্ভরশীল দলে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়, বরং ঐতিহাসিক, অর্থাৎ জন্মত্রুটি নিয়েই বেড়ে ওঠা রাজনীতির সুনির্দিষ্ট অবস্থান বললে খুব একটা ভুল হবে না।
১৯৭৮ সালে কোন রাজনৈতিক অবস্থার বিপরীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন, তা কমবেশি সবারই জানা। দলটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়নি, এটি দলটির মৌলিক দুর্বলতা। সাধারণত একটি গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের দলের অভ্যন্তরে থাকা বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী মূল দলের সঙ্গে বা নেতৃত্বের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আলাদা একটি দল গঠন করলে তাতে আদর্শের মহা বিপর্যয় ঘটে না, বরং অধিকতর বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। গণতন্ত্রে এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ইংল্যান্ডে টোরি দল থেকে লেবার পার্টির জন্ম হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রেও ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির জন্ম হয়েছে একের ভেতর থেকে অন্যের। ভারতে কংগ্রেস পার্টির অভ্যন্তর থেকেই বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ও সর্বভারতীয় দলের জন্ম হয়েছে। পাকিস্তানের শুরুতে মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ থেকে ন্যাপ, স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ ইত্যাদি দলের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সে ধরনের কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপস্থিতি ছিল না। আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে কেউ বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-উত্তর সময়ে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে হত্যার পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, আওয়ামী লীগসহ সব প্রগতিশীল দলকে রাজনৈতিকভাবে বৈরী অবস্থায় ঠেলে দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে নানা ধরনের সুবিধা বিতরণ করে এমন সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে দিয়ে একটি দল গঠন করা হয়, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করেছিল, সেখানে অতিডান, অতিবাম পন্থায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের সামনে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৯৭৫-৮১ সালে দুটি পথ খোলা ছিল- এক. মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সব দলমত নিয়ে একটি রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা; সেখানে তিনি নিজে নেতৃত্বের অংশেও থাকতে পারতেন অথবা অন্যদের সেই সুযোগ করে দিতে পারতেন। দ্বিতীয় পথটি হলো, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামীবিরোধী সব শক্তিকে দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। প্রথম ধারায় দেশের রাজনীতিকে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দেওয়া হলে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতাকে সশরীরে হারালেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া অচিরেই প্রাণ ফিরে পেত, বাংলাদেশ আজকের এমন পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্বে বা সংকটে হয়তো পড়ত না; তিনি যে দ্বিতীয় ধারাটি চালু করেন, তা শুধু দল হিসেবেই আওয়ামী লীগবিরোধী ছিল না, আদর্শগতভাবেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মতাদর্শবিরোধী ও ভাবাদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভাবাদর্শের ভিত্তিতে বিএনপির নেতৃত্ব প্রদান শুরু করেন। ফলে তা বাংলাদেশের সমাজজীবনে চাপা পড়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের পুনরুত্থান ঘটার সুযোগ করে দেয়, যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ পরিত্যাগ করেছিল। একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির মাঠে ছেড়ে দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা কতটা সচেতন ছিলেন, তা জানা কষ্টকর। তবে রাজনীতির বাইরের মানুষ হিসেবে আবির্ভূত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পক্ষে রাজনীতির জটিল তত্ত্ব ও প্রয়োগ পরিণতি বোঝা খুব সহজ কাজ ছিল না- এটি নিশ্চিত। একই অবস্থা ছিল সামরিক শাসক হু. মু. এরশাদের জন্যও। তিনিও একই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেছিলেন। তবে অনেকেই আশা করেছিলেন, জিয়াউর রহমান শেষ পর্যন্ত তাঁর দলটিকে একটি মধ্যপন্থার দলে পরিণত করবেন। সেটি তাঁর জীবদ্দশায় ঘটেনি। ১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়া দলের হাল ধরার পর অনেকেই ঠাঁই নিয়েছিল এরশাদের গড়া দলে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, উভয় দলে অতিবাম, অতিডান এবং সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তি, আমলা ও সামরিক কর্মকর্তা রাজনীতির এমন ভাঙ্চুরে সবচেয়ে বেশি দুই সামরিক শাসকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও রাজনীতির বাস্তবতায় তত দিনে সাম্প্র্রদায়িকতা বেশ শক্ত আসন গেড়ে বসে। তারা এরশাদের লাঙলেও চাষাবাদ বসিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, আবার সাতদলীয় জোটের মাধ্যমেও গণতান্ত্রিক চরিত্রের বৈধতা নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করে। এটি মোটেও বুঝতে পারেনি আওয়ামী লীগ, বাম মোর্চা তথা ১৫ দলীয় ঐক্যজোট, যারা অচিরেই ভেঙে আট ও পাঁচ দলে আলাদা হয়ে পড়ে। ১৯৮৩-৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে লড়াকু অবস্থান ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং আট ও পাঁচ দলের; কিন্তু কৌশলে হেরে গেল তারা ১৯৯১-এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবিরোধিতা, ধর্ম চলে যাওয়ার প্রচার-প্রচারণা গোটা নির্বাচনকেই নিয়ে গেল অন্য এক ভুবনে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, শোষণহীন সমাজ, অসাম্প্রদায়িকতা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক বৈধতা লাভের সুযোগটি পেয়ে যায় বিএনপি এককভাবেই, তবে এর পেছনে ভোটের রাজনীতিতে কুশীলবদের পরিকল্পনা সফল হয়। শুরুতে বিএনপির মধ্যে মধ্যপন্থার রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য থাকলেও অচিরেই ডান, বাম সুবিধাবাদ এবং ক্ষমতার সুবিধা গ্রহণকারীদের প্রভাব বেড়ে যায়। বিএনপিতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দ্বন্দ্বের শুরু। আওয়ামী লীগ কৌশলের যুদ্ধে এগিয়ে যায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদায় করে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার সুযোগ পায়। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় গিয়ে অসাম্প্রদায়িক শক্তি নির্মূল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নীলনকশা এঁটে রেখেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সেটিই দেখা গেল। আগে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি বিভক্ত ছিল, ১৯৯৯ সালে তারা আদর্শগতভাবে কাছাকাছি আসে, ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের নির্মূর্ল পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছিল, তা সবারই জানা। এই শক্তিই ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার আসনে বসিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার নীলনকশা করেছিল। সেটি ব্যর্থ করতে চারদলীয় জোটের বাইরে মহাজোট গঠন করে সবাই মাঠে নেমে পড়ে। সেই অবস্থায় চারদলীয় জোট সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দেশে ১/১১ সংঘটিত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের পরাজয়ের পেছনে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের ভয়াবহ রাজনীতির প্রতিক্রিয়া কাজ করেছিল। ২০০৯ সালে গঠিত সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করলে এই প্রেক্ষাপটে জামায়াত ও বিএনপির ঐক্য আরো নিবিড় হতে থাকে। চারদলীয় জোট ১৮ দলে রূপান্তরিত হয়। বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে হেফাজতসহ অন্যান্য শক্তিকেও মাঠে নামায়। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার আড়ালে সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের এনে তাহরির স্কয়ার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতিদের সমাবেশ ঘটিয়ে আবার সরকার উৎখাতের একটা পরিকল্পনা আঁটে। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করে দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা আঁটা হয়। সর্বশেষ এ বছরের ৫ জানুয়ারি বড় ধরনের কিছু একটা সংঘটিত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে বলে এখন বিশ্বাস করার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
লক্ষণীয় বিষয়, বিএনপি ২০০৯ সালের পর থেকে ক্রমেই জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেকে সমর্পণ করতে থাকে। জামায়াত যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে ক্ষমতা থেকে সরকার উচ্ছেদের ধারায় অগ্রসর হয়। অন্যদিকে বিএনপি ২০ দলীয় জোটের জনসভায় জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে থাকে। বিষয়গুলো নিয়ে বেশ ভাববার রয়েছে। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের ৫ মে এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার মতো সিদ্ধান্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগেরই জানা ছিল না। খালেদা জিয়া এবং লন্ডনে বসবাসকারী দলের সিনিয়র সহসভাপতি তারেক রহমান ছাড়া অন্য কেউ খুব একটা জানতেন না। দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থক এবং ভোটাররা শীর্ষ নেতাদ্বয়ের সিদ্ধান্তের গূঢ় রহস্য জানার কথা নয়। অথচ বিএনপিতে লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক রয়েছে, যারা বিএনপি করে শীর্ষ দুই নেতাকে ভালোবাসা থেকে। রাজনীতির গভীর আলোচনা-পর্যালোচনা, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়গুলো তাদের খুব একটা জানা নেই। অথচ দলটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চরমপন্থায় সরকার উৎখাতের যেসব বিষয় গভীরে নিহিত থাকে, তা কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলের রাজনীতির জন্য মোটেও সহায়ক হয় না। কেননা বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পথেই জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারে, এর পক্ষে সেই পরিমাণ ভোট রয়েছে। এমন বাস্তবতা বিরাজ করার পর সরকার উৎখাতের হিসাব-নিকাশে বিএনপির অংশ নেওয়ার, দলকে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি দল ও দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ৫ জানুয়ারির পর থেকে দেশে যে পেট্রলবোমার ধারা চালু হয়েছে, তা ২০১৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ঘটানো হয়েছিল। তাতে ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি ছাত্রদলেরও সম্পৃক্ততা ঘটেছে। এবারও তা-ই ঘটেছে। ফলে ২০ দলীয় জোটের রাজনীতি গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিবাদী ধারায় পা ফেলেছে। তাতে বিএনপির মতো এত বড় দলের অংশগ্রহণ ও সমর্থন দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ২০১০ সাল থেকে যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে, তা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিএনপি গোটা সময়টা জামায়াতের পাশে ছিল। তবে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হচ্ছে না। কেননা যেসব উদারবাদী নেতা ও কর্মী দলটিতে রয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা জানার সুযোগ নেই, এ ধরনের জঙ্গিবাদী রাজনীতির সহায়ক শক্তি হওয়ার কল্পনাও তারা করেছে- এমনটি ভাবা কষ্টকর। ২০১৪-পরবর্তী সময় থেকে বিএনপির ক্রমস্খলন, দক্ষিণের প্রান্তিক অবস্থান ছাড়িয়ে চরমপন্থায় যাওয়ার বিষয়টি তাদের নজর এড়িয়ে যায়নি। জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাটি বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শে বেড়ে ওঠার বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিচ্ছে; ২০০১-০৬ সালে সেটি দেখা গেছে একভাবে, কিন্তু ২০১০ সাল থেকে বিএনপির অবস্থান আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই বিপদ শুধু আওয়ামী লীগের জন্যই নয়, গণতন্ত্রের ধারায় বাংলাদেশকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে মহাবিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে। আওয়ামীবিরোধিতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতাকে উন্মুক্ত করে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী সব শক্তিকে নিয়ে একটি ভাবাদর্শ তৈরি করা, যা চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হতেই সাহায্য করবে। বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং ভোটারদের সেই সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদী কাফেলায় যুক্ত করে যে রাজনীতিকে সুযোগ করে দিতে ভূমিকা রাখছে, তার ক্ষতি পূরণ করার শক্তি বাংলাদেশের নেই। এত বড় একটি দল এবং এর সঙ্গে যুক্ত থাকা অথবা না বুঝে সমর্থন দেওয়া মানুষজন নিয়ে দেশের রাজনীতি একটি রাজনৈতিক সুনামির মতো মহাবিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তা থেকে মুক্ত হতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিএনপির ভেতরে মধ্যপন্থায় বিশ্বাসীদের রাজনীতির ভেতরের এসব ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে হবে, অবস্থান নিতে হবে। আমরা একটি মধ্যপন্থার বিএনপিকে দেখতে চাই; তাহলে গণতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা থাকবে, শত্রুতা হবে না। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের প্রতিযোগিতার রাজনীতি বুঝতে হবে, করতে হবে।