Friday, 20 February 2015

‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি প্রদান করা অবৈধ’ : আল-কুরাআন

মানুষকে দুই ধরনের আগুনে দগ্ধ করে- এক. প্রতিহিংসার আগুন; এই আগুনে হিংসুক নিজেই জ্বলেপুড়ে দগ্ধ হতে থাকে। দুই. বারুদ থেকে সৃষ্ট আগুন; এই আগুন মানুষের জন্য উপকারী বটে, তবে প্রজ্বালনকারী নির্বোধ হলে নিজেও জ্বলতে পারে, আবার অন্যকেও জ্বালাতে পারে। ‘নিজে জ্বলো এবং অন্যকে জ্বালাও’- ইসলাম যেহেতু এর কোনো নীতিকে কোনো অবস্থায়ই সমর্থন করে না, তাই ইসলাম হিংসা-বিদ্বেষকেও হারাম করেছে। আবার বারুদের সৃষ্ট আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো নীতিকেও কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। আর এটাকে মানবতাবিরোধী গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে।

ইসলামে মানব মর্যাদার ধারণা
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য প্রাণীর ওপর স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি। তাদের উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমার বহু সৃষ্টজীবের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা ইসরা ৭০)

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই শ্রেষ্ঠত্ব কোন গুণাবলির ওপর নির্ভরশীল? উদাহরণস্বরূপ দেখুন, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সুশ্রী চেহারা, সুঠাম দেহ, সুষম প্রকৃতি এবং অঙ্গসৌষ্ঠব দান করেছেন, যা অন্যান্য সৃষ্টজীবের মধ্যে নেই। বাকশক্তি ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে নৈপুণ্য মানুষ লাভ করেছে, তা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজের ভাব ব্যক্ত করা এবং আক্ষরিক জ্ঞান সবই মানুষের স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কারের মূলেও রয়েছে এই বিবেকবুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি। এরই সাহায্যে সে কত কিছুই না আবিষ্কার করেছে, না জানি আরো কত কিছু আবিষ্কার করে! এই বিবেকবুদ্ধির মাধ্যমেই সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার পরিচয় ও তার পছন্দ-অপছন্দ জেনে পছন্দের অনুগমন ও অপছন্দ থেকে বিরত থাকে।

মানব হত্যা বিষয়ে ইসলাম
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না; বরং এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইসলাম সব সময় সোচ্চার, সরব এবং হত্যাকারীর জন্য রেখেছে কঠিন শাস্তির বিধান। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হচ্ছে, ‘হত্যার বদলে হত্যা ও পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ছাড়া কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল, আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। (সুরা মায়িদা ৩২)

ভেবে দেখার বিষয় হলো, বিনা কারণে একজন ব্যক্তির হত্যাকারীকে সব মানুষের হত্যাকারী আর রক্ষাকারীকে সবার প্রাণ রক্ষাকারী সমতুল্য বলা হলো কেন? কারণ কোনো ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নরহত্যায় কেবল তখনই লিপ্ত হয়, যখন তার অন্তর থেকে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত অনুভূতি লোপ পেয়ে যায়। আর এ অবস্থায় নিজ স্বার্থের খাতিরে সে আরেকজনকেও হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করবে না। এভাবে গোটা মানবতা তার অপরাধপ্রবণ মানসিকতার টার্গেট হয়ে থাকবে। তা ছাড়া এজাতীয় মানসিকতা ব্যাপক আকারে ধারণ করলে সব মানুষই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং অন্যায় হত্যার শিকার যে-ই হোক না কেন, দুনিয়ার সব মানুষকে মনে করতে হবে, এ অপরাধ আমাদের সবারই প্রতি করা হয়েছে।’ (তাওজিহুল কোরআন ১/৩১৬)। বিপরীতে একজনের প্রাণ রক্ষাকারী গোটা মানবতার রক্ষাকর্তা হিসেবেই স্বীকৃতি পাবে।

মানব মর্যাদা যেহেতু নরঘাতকদের প্রাপ্য নয়, তাই ইসলাম তাদের শাস্তির ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দেয়নি; বরং তাদের জন্য রেখেছে জাগতিক ও পারলৌকিক শাস্তি। জাগতিক শাস্তি হলো হত্যার বদলায় হত্যা, অঙ্গের বদলায় অঙ্গ। (সুরা মায়িদাহ ৪৫) পরকালীন শাস্তির ব্যাপারে ঘোষণা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জেনেশুনে কোনো মুসলমানকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন এবং তাকে লা’নত করবেন। আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা ৯৩)

প্রাণী পোড়ানোর শরয়ি বিধান
হত্যা যেভাবেই করা হোক, এটা যে কতটুকু কষ্টদায়ক তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আর জীবন্ত জ্বলেপুড়ে মরা কী পরিমাণ যন্ত্রণাদায়ক, তা প্রকাশের ভাষাও কোনো মানব-মানবীর পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ইসলাম তো বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু ও কীটপতঙ্গকেও পুড়িয়ে মারতে বারণ করে। তাহলে নিরপরাধ মানুষ পোড়ানোর বৈধতার তো প্রশ্নই আসে না।

এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিপীলিকার একটি বসতি পিপীলিকাসহ পোড়ানো দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কারা পিঁপড়ার বসতিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে? সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, আমরা। এতদ্শ্রবণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি প্রদান করা অবৈধ।’ (আবু দাউদ হা. ২৬৭৫)

অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘একমাত্র আগুনের সৃষ্টিকর্তাই আগুন দ্বারা কাউকে শাস্তি দিতে পারেন।’ (আবু দাউদ হা. ২৬৭৩)

আরেক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে জিনিস দ্বারা (আগুন) স্বয়ং আল্লাহ শাস্তি প্রদান করবেন, তা দ্বারা তোমরা কাউকে শাস্তি প্রদান করো না।’ (বুখারি হা. ৩০১৭)

ইতিহাসে জ্যান্ত মানুষ পোড়ানোর কয়েকটি ঘটনা
ইতিহাসের পাতায় মানুষ পোড়ানোর ঘটনা অনুসন্ধান করলে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কয়েকটি ঘটনা এখানে প্রদত্ত হলো-

ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা : নমরুদ ও তার দোসররা যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে যুক্তিতর্কে হেরে গেল, তখন তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে ইবরাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হোক। ঐতিহাসিক রেওয়াতসমূহে বর্ণিত রয়েছে, এক মাস পর্যন্ত সমগ্র শহরবাসী জ্বালানি কাঠ ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এরপর তাতে অগ্নিসংযোগ করে সাত দিন পর্যন্ত প্রজ্বলিত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অগ্নিশিখা আকাশচুম্বী হলে তারা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নিক্ষেপণযন্ত্রের মাধ্যমে অগ্নিসাগরে নিক্ষেপ করে। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য উত্তপ্ত আগুন শান্তির বাগানে পরিণত হয়ে গেল!

আসহাবে উখদুদের ঘটনা : পবিত্র কোরআনে আসহাবে উখদুদের (গর্তওয়ালা) ঘটনা সম্পর্কেও সুরা বুরুজে আলোকপাত করা হয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা মুসলিম শরিফের ৩০০৫ নম্বর হাদিসে বর্ণিত আছে। এখানে এটাই স্পষ্ট করা হয়েছে যে একদল লোককে আল্লাহর ওপর ইমান আনার কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্নিগর্তে নিক্ষেপ করার পর অগ্নি আরো বেশি প্রজ্বলিত হয়ে তার লেলিহান শিখা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যারা ইমানদারদের অগ্নিতে দগ্ধ করে তামাশা দেখছিল, তারাও এই আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। কেবল নরাধম বাদশাহ ইউসুফ জুনওয়াস পালিয়ে যায়। সে অগ্নি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেখানেই সলিলসমাধি লাভ করে। এর থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো, দঙ্কারীকেও দহন যন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে।

আবু মুসলিম খাওলানি (রা.)-এর ঘটনা : আবু মুসলিম তাঁর উপনাম। তাঁর আসল নাম আব্দুল্লাহ। তিনি ইয়ামানের অধিবাসী। মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার আসওয়াদ আল আনাসি যখন ইয়ামনের ওপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তখন সে হজরত আবু মুসলিম খাওলানি (রা.)-কে তাঁর মত গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তিনি তা সাহসিকতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। আসওয়াদ তাঁকে হত্যা করার জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে অগ্নি প্রজ্বালিত করে এবং তাতে তাঁকে নিক্ষেপ করে। তবে আল্লাহর রহমতে তিনি নিরাপদে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। অতঃপর তিনি মদিনায় আগমন করলে হজরত উমর (রা.) বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ আমাকে উম্মতে মুহাম্মদির মধ্য থেকে এমন একজন ব্যক্তিকে দর্শন করার সৌভাগ্য দান করেছেন, যার সঙ্গে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো আচরণ করা হয়েছে। (তারিখে দামেস্ক)

ইসলামে অঙ্গহানি ও অঙ্গবিকৃতি নিষিদ্ধ : দগ্ধ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে সে অনেক বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু যে প্রাণে বেঁচে যায়, তাকে দিনের পর দিন দহনযন্ত্রণায় ভুগতে হয় আর বিকৃত-বীভৎস আকৃতি নিয়েই এই ধরায় বাঁচতে হয়। অথচ এভাবে মানবাকৃতির বিকৃতি সাধন ইবলিশ শয়তানের প্রতিজ্ঞারই প্রতিফলন। দেখুন, শয়তান আল্লাহ তায়ালাকে চ্যালেঞ্জ করে কী প্রতিজ্ঞা করেছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদের সরল পথ থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত করব। তাদের অনেক আশা-ভরসা দেব এবং তাদের আদেশ করব, ফলে তারা চতুষ্পদ জন্তুর কান চিরে ফেলবে এবং তাদের আদেশ করব, যাতে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। (সুরা নিসা, আয়াত ১১৯)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াজিদ আনসারি (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিনতাই ও প্রাণীর বিকৃত করা থেকে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি ৩/১৩৫ হাঃ ২৪৭৪)

মূলত কাউকে পেট্রলবোমা মেরে দগ্ধ করাও কারো অঙ্গহানি ও অঙ্গবিকৃতির শামিল। ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে দেখা যায়, মানবাকৃতির বিকৃতি সাধন করার মতো ঘৃণিত কাজ তদানীন্তন মক্কার পৌত্তলিকরা উহুদ যুদ্ধের মুসলিম শহীদদের সঙ্গে করেছিল। অতএব, নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ পোড়ানোর মতো মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ ত্যাগ করতে হবে। ন্যূনতম ইমানের অধিকারী একজন মুসলিম এজাতীয় কাজে মেতে উঠতে পারে না। আগুন নিয়ে খেলা করা কোনো মানুষের কাজ নয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক কথা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

© www.uttaranbarta.com/site2/?p=55988