Tuesday, 10 February 2015

ছাত্রলীগ কোথায়? আওয়ামী লীগ কোথায়? -- শওগাত আলী সাগর

আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী সন্ত্রাস, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার মচ্ছবের মধ্যে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের এ ধরনের বৈঠক নিয়ে রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহী মানুষই কেবল নয়, সাধারণ মানুষেরও নিবিড় আগ্রহ ছিল। 'খুনখারাবির' এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির ভাবনা-পদক্ষেপের ব্যাপারেই মূলত মানুষের আগ্রহ ছিল। বৈঠক শেষে মিডিয়ায় বৈঠক সম্পর্কে যে খবর প্রকাশিত/প্রচারিত হয়েছে, তাতে স্বস্তি পাওয়ার মতো কোনো তথ্য ছিল না। বরং কতগুলো প্রশ্ন ও শঙ্কাই মানুষের মনে দানা বেঁধে উঠেছে। প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের বাইরে ক্ষমতাসীন যে রাজনৈতিক দলটি আছে, সেটি আসলে কোথায়?

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে বেশ কয়েক দিন আগেই প্রশ্নটা করেছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। তিনি বলেছিলেন, 'ছাত্রলীগারগুলো কোথায়? সারা বছর তো অনেক মারপিট করলা, তা-ও নিজেরা নিজেরাই...এখন একটু যাওনা দগ্ধ মানুষের পাশে, পাপমোচন হোক...।' আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকের পর ঠিক এ প্রশ্নটিই মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগ কোথায়? আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার মচ্ছবে দলটির রাজনৈতিক অবস্থান কী? কর্মসূচিই বা কী?

না, কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা থেকে সে ধরনের কোনো কর্মসূচির ঘোষণা আসেনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশের এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের যে কিছু করার আছে, তা নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হয়েছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তাহলে আওয়ামী লীগ কোথায়? ঠিক এ প্রশ্নটিই উঠেছিল গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগেও। সে সময়ও বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন ঠেকানোর নামে সারা দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সেই সময়টায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশকেও পিটিয়ে মারা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক জোট যখন সন্ত্রাস করে, মানুষ মেরে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করছে, সেই সময়টাতেও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি। সরকার বলতে কেবল প্রশাসনকে পাওয়া গেছে। এবারও ঠিক একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা প্রশ্ন করেছিলেন, 'ছাত্রলীগারগুলো কোথায়?' ঠিক এর পরপরই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের একটি হুংকার থেকে ছাত্রলীগের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। না, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার পরামর্শ শুনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্নিদগ্ধ মানুষের পাশে ছুটে যায়নি। বরং 'পেট্রল দিয়ে আগুন জ্বালানো'র ঘোষণা দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি এবং অবস্থানের জানান দিয়েছিলেন এই ছাত্রনেতা। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজে ছাত্রলীগের এক সভায় তিনি বলেছিলেন, 'এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর যদি পেট্রলের আঁচ লাগে, যদি তারা হামলার শিকার হয়, তাহলে বেগম জিয়ার গুলশান কার্যালয় ঘেরাও করে পেট্রল দিয়ে আগুন দেওয়া হবে।' তার আগেও তিনি ফেসবুক স্টেটাসে বিএনপি নেতাদের 'নেড়ি কুত্তার মতো পেটানোর' হুমকি দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন।

বিএনপি নেতাদের 'নেড়ি কুত্তার মতো পেটানোর হুমকি' দিলেও এ ছাত্রলীগ নেতার সেই ধরনের কর্মতৎপরতা চোখে পড়েনি। সেটি অবশ্যই সুখের কথা। তিনি বিএনপি নেতাদের পেটাতে যাবেন, সেটা কোনোভাবেই আমরা চাই না। তবে সিদ্দিকী নাজমুল এ ধরনের একটি হুমকি দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার আর তার নিজের নেতৃত্বাধীন সংগঠনকে 'পেটানোর' একটা সুযোগ করে দিয়েছিলেন অবশ্যই। মিডিয়াওয়ালারা, টক শোওয়ালারা তাঁর কথার সূত্র ধরে সরকারকে ভালোই 'পিটিয়েছে' কয়েক দিন। দেশব্যাপী পেট্রলবোমা আর আগুনে পুড়ে যাওয়া অসংখ্য নারী, শিশুসহ মানুষের আহাজারিতে সারা দেশ যখন যন্ত্রণাকাতর তখন এই ছাত্রনেতা খালেদা জিয়ার অফিসে পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার খায়েশ ব্যক্ত করে বরং সরকারকেই বিরূপ সমালোচনার মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন।

ছাত্রলীগ কোথায়?- এ প্রশ্নটি এর আগেও উঠেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাঈদীর মামলার রায়কে ঘিরে যখন সারা দেশে জামায়াত-শিবির সহিংসতা শুরু করে তখনো অনেকেই কৌতূহলী ছিল ছাত্রলীগের ব্যাপারে। গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট যখন নির্বাচন ঠেকানোর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বাসে আগুন দিচ্ছিল, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারছিল তখনো প্রশ্নটা উঠেছিল- ছাত্রলীগ কোথায়? আওয়ামী লীগের গত পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদটাই ছাত্রলীগ সন্ত্রাস, খুনাখুনির দায়ে মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে। যে সংগঠনটি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সারা বছর কাটায়, সেই সংগঠনটি নিজ দল আক্রান্ত হলে তা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে থাকে কী করে? সম্ভবত এ ধরনের ভাবনা থেকেই 'ছাত্রলীগ কোথায়'- জিজ্ঞাসাটার বিস্তার ঘটেছিল।

না, বিএনপি-শিবিরের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে ছাত্রলীগও সন্ত্রাস করুক, সেটা আমরা চাচ্ছি না। আমরা বরং চাচ্ছি, চেয়েছি- ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী ইমেজ থেকে বের হয়ে আসুক। ছাত্রলীগ রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নিয়ে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হোক। গত সাধারণ নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের সেই সুযোগটা ছিল। সারা দেশে আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারত ছাত্রলীগ। এবারও আগুনে পোড়া মানুষগুলোর পাশে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারত ছাত্রলীগ। সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাও এ কথাটিই বলেছেন তাঁর ফেসবুক স্টেটাসে। কিন্তু এ ধরনের কোনো তৎপরতায় ছাত্রলীগকে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি আওয়ামী লীগকেও। সরকারের মন্ত্রীরা 'হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা'-জাতীয় চাপাবাজি করেছেন, মিডিয়া সেগুলো ফলাও করে প্রচার করেছে। মিডিয়া প্রচার করেছে মন্ত্রীদের অন্তঃসারশূন্যতাটা জনগণের সামনে তুলে ধরতে। মন্ত্রীরা সেটা বুঝে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাঁরা বরং মিডিয়ার কাভারেজ দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে তিন গুণ চাপাবাজিতে মেতে উঠেছেন।

আওয়ামী লীগ নামের যে সংগঠনটি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, দেশের বর্তমান সংকটে সেই সংগঠনটিকে কি কোথাও পাওয়া গেছে? রাজধানী ঢাকায়, বিভাগীয় শহরে, জেলা উপজেলায়- কোথাও কি আওয়ামী লীগ ছিল? কোথাও কি আওয়ামী লীগ আছে? নানা নামের এত যে অঙ্গসংগঠন দলটির, তাদের অস্তিত্বও তো কোথাও দেখা যায়নি। হ্যাঁ, একটি অঙ্গসংগঠনের তৎপরতার খবর পত্রিকায় দেখা গেছে। সেটি হচ্ছে আওয়ামী ওলামা লীগ। 'হিন্দু প্রধান বিচারপতি' অপসারণের সাম্প্রদায়িক দাবি নিয়ে সংগঠনটি মিছিল করেছে। আওয়ামী ওলামা লীগ কি আওয়ামী লীগের আদর্শের সংগঠন নয়? তাহলে এমন চরম সাম্প্রদায়িক দাবিতে ব্যানারট্যানার নিয়ে তারা মিছিল করে কিভাবে? জামায়াত-হেফাজতও তো এই দাবি করেনি, যেটা করেছে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ওলামা লীগ। কিন্তু আগুন সন্ত্রাস, পেট্রল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষকে সাহস দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাজে এ সংগঠনটিকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি আসলে কোনো অঙ্গসংগঠনকেই।

এই যে রাজনীতির নামে মানুষ খুনের উৎসব শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। অস্থির এই সময়টায় এমপিরা কোথায় ছিলেন? সংসদ অধিবেশন তো মাত্র সেদিন শুরু হলো। তার আগে? তাঁরা কি তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন? মন্ত্রীরা? এক-আধবারের জন্য নিজের নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছেন কজন মন্ত্রী? কেন্দ্রীয় নেতারা? আরেক সিনিয়র সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ ফেসবুক স্টেটাসে প্রশ্ন করেছেন, 'আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো যদি শক্তিশালী হতো, তবে পরাজিত শক্তি বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে নাশকতা করতে পারত কি?'

এ প্রশ্নটিও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক সন্ত্রাস দমন করা কঠিন। রাজনৈতিক শক্তি জনগণের পাশে দাঁড়ালে, জনগণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত হতে সাহস পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি সংগঠন আছে যেই সরকারের, সেই সরকার কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে কেন? আর সরকারের নির্ভরতার সুযোগ যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিয়েছে, সেটি তো পরিষ্কারই। বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরাও রাজনৈতিক নেতাদের মতো 'হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা' বলে বক্তৃতাবাজি করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ যে তেমন একটা করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

একটা সময় ছিল- যখন সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, সন্ত্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে নানা পেশার মানুষকে মাঠে নামতে দেখা যেত। সাংস্কৃতিক জোট, পেশাজীবী জোট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সক্রিয় দেখা যেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এখন আর সেই তৎপরতাগুলো নেই। কেন নেই? এই যে পেট্রলবোমার বীভৎসতা, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার নির্মমতা- তার বিরুদ্ধে সামাজিক শক্তির তেমন কোনো প্রতিবাদ নেই কেন? এক-আধবার হালকাপাতলা কিছুটা 'ম্যাও ম্যাও'-জাতীয় শব্দ শোনা গিয়েছিল বটে; কিন্তু সেগুলো আর বিস্তৃত হয়নি। কেন হয়নি?

বাম-কমিউনিস্টদের একটি অংশ প্রায় জামায়াত-বিএনপি হয়ে আছে। আরেক অংশকে সরকার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু সরকারের যারা অংশীদার, তারা কি এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে? জাতীয় পার্টি-জাসদ- এদের কোনো তৎপরতা আছে কোথাও? রাষ্ট্র পরিচালনা করছে যে রাজনৈতিক শক্তি তাদের আশপাশে রাজনৈতিক মিত্র কেউ কি আছে? যারা সরকারের দুঃসময়ে সরকারের পাশে দাঁড়াতে পারে। যারা দেশের দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে!

আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর আদলে বাংলাদেশে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি আছে। সেই শক্তিগুলো প্রকাশ্য ও সোচ্চার। সহিংসতার বিরুদ্ধে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কোনো রাজনৈতিক শক্তি কোথাও আছে কি?
লেখক : শওগাত আলী সাগর, টরন্টো থেকে প্রকাশিত 'নতুনদেশ'-এর প্রধান সম্পাদক