Friday, 20 February 2015

আল্লাহর কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়


ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান। প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা যেমন অপরিসীম, তেমনি আল্লাহতায়ালার কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়। তিনি সব ভাষা জানেন ও বোঝেন। যে যেভাবেই তাকে ডাকেন না কেন তিনি বোঝেন, উত্তর দেন, তার সঙ্গে কথা বলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি, যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমাদের কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)। সব জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গাম্বর এসেছেন, তেমনি সব জাতির স্ব-স্ব ভাষাতেই আল্লাহতায়ালার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব অথবা কিতাববিহীন ওহি পাঠিয়েছেন। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা। আর না হয় মানুষ ভাষার মর্যাদা বুঝত না। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সঙ্গে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলীর মাঝে রয়েছে আকাশসমূহের ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতাও। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা আর রূম : ২২)। ভাষা ও রঙের এই বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আকাশ-মালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি। বর্ণের ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। কিন্তু তবুও এই বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। আর মানবতার এই ঐক্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সৃষ্টিকর্তাও একজনই। মানবজাতির সূচনালগ্নে ভাষা ছিল একটিই এবং তা ছিল ইলহামি ভাষা। এরপর মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে এলাকা এলাকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবেই সূচনাতে মানুষের রঙও ছিল একই রকম। এরপর গ্রীষ্ম, শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুযায়ী তার রঙেরও পরিবর্তন হতে থাকে।

আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা, কেউ যদি ভাবেন যে, বাংলাতে আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি কি তা শুনবেন? এর উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই আল্লাহপাক শুনবেন, কেননা তিনি বলেছেন, সব ভাষাই তার সৃষ্ট এবং সব ভাষাতেই নবী-রসূল পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভাষাই আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদার দিক থেকে খাটো নয়। আর এ জন্য সবাই নিজ নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু বড় কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি আমার প্রিয় মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে। আমরা আজ এতই আধুনিক হয়ে গেছি যে, মাতৃভাষায় কথা বলতেও নাকি লজ্জা লাগে। এফএম রেডিওগুলোতে দেখা যায়, একটি বাক্য বাংলা বললে সঙ্গে চারটি বাক্য বলে অন্য ভাষায়, এটার নামই কি আধুনিকতা? অথচ আল্লাহপাকের কাছে সব ভাষার মর্যাদা সমান। আমরা কি পারি না সর্বত্রে আমাদের দেশমাতৃকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে? আমাদের ওয়াজ-নসিহতগুলো হবে মাতৃভাষায়, আমাদের জুমার খুতবা হবে নিজ ভাষায়, নামাজে নির্ধারিত দোয়ার পর নিজ ভাষায় আল্লাহপাকের কাছে মন খুলে কিছু চাইতে কি পরি না?

আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব না দেই তাহলে আল্লাহপাকের দরবারেও আমাদের কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে না। কেননা বাংলাভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষারজ মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীর রয়েছে অবদান। আমাদের সবার দায়িত্ব, আমাদের লেখায়, কথায়, চলনে-বলনে মাতৃভাষাকে আরও বেশি করে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা। আমাদের ভাষাকে এমন সুন্দর ও মাধুর্যের সঙ্গে ত্র“টিহীনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে কেউ এর কোনো ত্র“টি খুঁজে না পায়। আমরা যদি আমাদের ভাষাকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং জুমার খুতবাগুলোতে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর ও মাধুরভাবে উপস্থাপন করতে পারি তবে অন্যরাও এর প্রতি আসক্ত হতে বাধ্য। জুমার দিনগুলোতে দেখা যায়, মসজিদ ভরে থাকে বর্ষিয়ান মুসল্লিতে, কিন্তু হাতেগনা যে ক’জন যুবক জুমার নামাজে যোগ দেন তারা হয়তো ইমাম সাহেব কি খুতবা দিচ্ছেন তা কানে না নিয়ে মোবাইলে গেমস খেলছেন অথবা চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছেন। এর কারণ কি? এর একটাই কারণ, আর তা হল তারা খুতবায় কোনো স্বাদ পাচ্ছেন না, ইমাম সাহেব আরবিতে যা বলছেন তাও তারা বুঝেন না, তাই তারা দু’রাকাত নামাজের জন্য মসজিদে আসেন আর নামাজ শেষ হলেই সপ্তাহের জন্য ছাড় পেয়েছেন বলে মনে করেন। আজ ছেলে-মেয়েদের নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হল তারা মসজিদমুখি নয় আর ইমাম সাহেবদের সঙ্গে তাদের বন্ধুসুলভ সম্পর্কও নেই। তাই প্রতিটি মসজিদে যদি নিজ মাতৃভাষায় যুগোপযোগী জুমার খুতবা দেয়া হয় আর তা যদি খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে উপস্থাপন করা হয় তাহলে মুসল্লিরা যেমন ঝিমুবেন না, তেমনি যুবকরাও মসজিদ থেকে আধ্যাত্মিক খাদ্য গ্রহণ করে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার চেষ্টা করবেন। তাই সর্বত্রে বাংলা প্রচলনের বিষয়ে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে আর এ কাজ সবচেয়ে বেশি আলেম সমাজই ভূমিকা রাখতে পারে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে নিজ ভাষার গুরুত্ব বোঝার তৌফিক দান করুন, আমিন।

© মাহমুদ আহমদ
masumon83@yahoo.com